মুজিব ইরম
মশাহিদ আলীর সময় নাই কোলাকুলি করার। হোক না তিন বছর পর চাচাত ভাইয়ের এই বাড়ি ফেরা। এ-কাজ পরে করলেও হবে, কিন্তু বিচার তো আর পরে বসবে না। টাইম মতো মসজিদে না গেলে এতো দিনের অপেক্ষাই মাটি। এ তো আর গ্রামের লেতিপেতি বিচার নয় যে, গেলে গেলাম, না-গেলে না-গেলাম। এ যে গ্রাম থেকে ইউনিয়ন টপকিয়ে একেবারে জেলায় গিয়ে পৌছেছে! ইউনিয়ন-পৌরসভার চেয়ারম্যান তো অবশ্যই, জেলা শহরের বড় দু’দলের জানু লিডারদেরকেও আনা হয়েছে। এরকম বিচার কি আর তার মতো লোকের জন্য অপেক্ষা করবে, যেখানে মেম্বার, পাড়ার মোড়ল, পাঁতি নেতারাই আর পাত্তা পাচ্ছে না? তাছাড়া কাল ঈদ, এশার নামাজের আগেই বিচার শেষ হবেÑমাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কলমদর মিয়ার মাথায় বিষয়টি ঠিক খোলাসা হয় না। খোলাসা হবার কথাও নয়। ফিরেছে সে তিন বছর পর।
- সময় নাই ভাইসাব, কাহিনি মজার আছে। পাভেলে কইবোনে, আমি যাইগি...
মশাহিদ আলী তড়িগড়ি রওয়ানা দেয়। কাহিনি বলার ভার পড়ে ভাতিজা পাভেলের ওপর। বেচারা যেতে পারছে না, বা যেতে তার বারণ আছে। ক’দিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা, তাছাড়া এতোদিন পর চাচার এই বাড়ি-আসা উপেক্ষা করে সে আর যায়ই বা কেমন করে? অবশ্য দায়িত্ব পেয়ে ক্ষতি তার পুষিয়ে যায়। সে আর দেরি করতে চায় না, কাহিনি তার ঠোঁটের ওপর বসে ছিলো, নাড়া পেয়েই উড়াল দেয়Ñউত্তর-মসজিদর মাইক চুরিত ইমাম সাব জড়িতো আছইন, আইজ তার ফাইন্যাল বিচার অইবো।
- ইমাম জড়িত আছইন, মাইক চুরিত! বিষয়টা কিতা পাভেল?
পাভেল এবার জুত হয়ে বসে। কাহিনির পেছনে যায়।
রোজার ঠিক আগে আগে উত্তরের মসজিদে নয়া মাইক দান করে লতিফ লন্ডনি। রোজার মাস শুরু হয় আনন্দে। মুসল্লিরা তাতে বড়োই খুশি। কিন্তু দিন দশেক যেতে না যেতে মাইক দু’টি চুরি হয়ে যায়। মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান হুরমত উল্লার এককথাÑমাইক চুরিতে ইমাম সাহেবের হাত আছে। এই নিয়ে সারা রোজার মাস কাটে। ঘন ঘন বিচার বসে। পাশের জেলা থেকে ক’মাস আগে আসা কালা মিয়াছাব ১০০০ টাকার চাকরি হারানোর ভয়ে হাত-পা ধরেও রেহাই পায় না। বিচার তার হবেই হবে, মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যানের কথার দাম আছে নাÑতিন তিনটা ছেলে যার লন্ডনে থাকে? এক মিয়াছাব গেলে আরেক মিয়াছাব আসবে, ইমামের কি আর অভাব পড়েছে যে বেয়াদব ইমামকে রাখতে হবেÑযে খালি মুখে মুখে ফতোয়া দেয়, মসলা দেখায়?
হুরমত উল্লার হুমকি-ধামকিতে ইমামের জ্বর আসে।
জ্বর হলে কী হবে, তারাবি নামাজে ঠিকই তাকে হাজির হতে হয়। সিজদায় যেতে বড়ো সময় লাগে। এমনিতেই পেটের জন্য সিজদায় যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়, কপালের আগে পেট মাটিতে চলে যায়। কষ্টেসৃষ্টে কালা মিয়াছাবের কপাল যেই মাটি ছুঁয়েছে, পেছন থেকে সুর ওঠেÑইমামসাব, পুলিশ আইছে!
পুলিশের ভয়ে সিজদা ফেলে উত্তরের ধানি বিলের দিকে দৌড় দেয় সে। লোকজন তাকে খুঁজে পেতে মধ্যরাত হয়ে যায়। ধানি জমির কোণায় মাছধরার গর্তে জলকাদায় লুকিয়ে থাকা কালা মিয়াছাবের কথা শুধু একটাইÑআমি মাইক চুরি করছি না, আমি মাইক চুরি করছি না...
ইমামের জ্বর দ্বিগুণ হয়।
কিন্তু পুলিশ আসবে কোথা থেকে, কেইস-টেইস হলে তো? আসলে সুর তুলে হুরমত উল্লার ভাতিজা একরাম। তার জন্য একরামের বিচার হওয়ার কথা, তা না, উল্টা বিপদ আসে কালা মিয়াছাবের। হুরমত উল্লার এককথাÑইমামের ঈমানে গলদ আছে। পুলিশের ভয়ে যে-ইমাম সিজদা ফেলে দৌড় দেয়, সেই কমজুরি ইমামের পিছনে নামাজ হয় না, হতে পারে না। তাছাড়া এতে প্রমাণ হয়, মাইক চুরিতে তার হাত আছে। এর জন্য কালা মিয়াছাবের শক্ত বিচার হতে হবেÑকী বলেন আপনারা?
হুরমত উল্লার ভাইভাতিজারা সমর্থন করে।
পাভেল কাহিনি আরো এগিয়ে নিতে চায় কিন্তু ইমামের ‘বড় পেট ঠেলে সিজদায় যাওয়া’ আর ‘পুলিশ আইছে’ শুনে ইমামের ‘দর্শনীয় দৌঁড়ের’ বর্ণনায় এতো হাসাহাসি করে যে, তাকে বেশ হয়রান দেখায়।
কলমদর মিয়া উঠে যায়। কাহিনি দাঁড়িয়ে থাকে।
মশাহিদ আলী বাড়ি ফিরে খবর দেয়Ñইমামের চাকরি খতম। ঈদের নামাজ পড়াবেন নোয়াখালির মিয়াছাব।
- ইবার দেখবায় নে চাচা দক্ষিনর মসজিদো কিতা হয়!
কলমদর মিয়া ঠিক বুঝতে পারে না, দক্ষিণের মসজিদে আবার কী হবে! পাভেলকে আর জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না। গ্রামটা কি এতো অল্পতেই পাল্টে গেলো? ছোট এক গ্রাম, মসজিদ আবার তিনটাÑউত্তরে, দক্ষিণে আর পুবে। পশ্চিমেও আছে একটা, তবে তা পাঞ্জেগানা নামাজের জন্য লন্ডনিবাড়ির গুষ্ঠীবদ্ধ। অতএব গ্রামে মসজিদ তিন, কমিটিও তিন।
পাভেল মসজিদ কমিটির গল্পে যোগ দিতে চায়, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় প্রচ- গরম কলমদর মিয়াকে ঝাপটে ধরে। আজ আর বিদ্যুৎ আসবে নাÑ মশাহিদ আলীর কথায় কলমদর মিয়া অবাক হয়Ñকারেন্ট থাকে না কেন? লোকজন প্রতিবাদ করে না?
বিদ্যুৎ নিয়ে মশাহিদ আলীর কোনো অভিযোগ নেই। কী হবে অভিযোগ করে, যেখানে সারাদেশই জিম্মি হয়ে আছে? লন্ডন থেকে এসে দেশের অবস্থা বোঝা কি এতো সোজা? মানুষ কি প্রতিবাদ করে নাই? করছে। কিন্তু লাভটা হলো কী? কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে প্রতিবাদ করবে মানুষ, বাজারে বনডোলার সের যেখানে ৩০০ টাকা?
মশাহিদ আলীর কথায় রাগ ঝরে। বড় ভাই’র সৌদি থেকে পাঠানো টাকায় সংসার চালানোর কষ্ট তার কথায় আরো বাড়তে থাকে। একদা দক্ষিণের পুতায় ঘাস হয়ে থাকা বন ধনিয়ার সের ৩০০ টাকা শোনে কলমদর মিয়ারও ভাবনা হয় বটে। বিদুৎ নাই, বাজারে আগুন, হাওর-পাহাড় দখল করছে চেয়ারম্যান-মেম্বার-এমপিরা, হচ্ছে ফিশারি আর বাগান-বাড়ি, পাকা হচ্ছে রাস্তা, টেন্ডার পাচ্ছে এমপির ভাই-ভাতিজারা, চারপাশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, এর সাথে উড়ছে লন্ডনি টাকা, সাধারণ মানুষের কি এসবে মাথা ঘামানোর সময় আছে, যেখানে সারাদেশই ঘুমিয়ে আছে? এলাকার কথা বলে আর লাভ কী? একদা যে-জমিতে ২/৩ ফসল হতো, এখন হয় এক ফসল, তাও কেউ করে, কেউ তার তোয়াক্কাই করে না। কে আর দেশ নিয়া ভাবে? লন্ডনি টাকা যেখানে মেঘ ঝরায়, রোদ তোলে, শস্য ফলায়?
মশাহিদ আলীর গলায় ঝাঁঝ বাড়ে।
এলাকা না-হয় বাদ গেলো, কিন্তু দেশের মানুষের কি করার কিচ্ছু নাই! কলমদর মিয়া কথা তুলতে চায় কিন্তু পাভেল বড়-হাওরের ফিশারি প্রজেক্টের গল্প শুরু করলে বিষয়টি এখানেই চাপা পড়ে।
বড় হাওরের গল্পে কলমদর মিয়ার আগ্রহ থাকে। শৈশবের সেই হাওরটা যদি একবার দেখে আসা যেতো! কিন্তু এতো গভীর হাওরে যাওয়া যায় কীভাবে?
পাভেল অবাক হয়। বড় হাওরে যাওয়া কি আর কোনো কাজ হলো? কালই সে নিয়ে যাবে কিন্তু আগে মোবাইল ফোনের ওয়াদা করতে হবে, যেই সেই মোবাইল হলে হবে না, একেবারে ভিডিও-অডিও সব থাকতে হবে। চাচাকে নিয়ে সে বিপদেই পড়ে। লন্ডন থেকে আসা চাচার লগে শহরে যাবে, লাইটেস কিনে বাজার-মার্কেট করবে, তা না, যেতে হবে হাওরে। মোবাইলের কথা শুনে বলে কি না, এই বয়সে গ্রামে বসে এত দামি মোবাইল দিয়ে সে কী করবে? আজকাল শুটকি-ওয়ালাও মোবাইল রাখেÑপাভেল খবরটি দিতে পেরেও হতাশ হয়। এ গ্রামে হাতে হাতে যে মোবাইল ঘুরে, চাচায় তার খবরও রাখে না? আর দেখো হাওরের পর নদীনালা পাহাড়-পর্বতের খবর নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। আরে বাবা লন্ডন থেকে এসে এসব কেউ জানতে চায়? করবে লন্ডনের গপ, জানতে চাইবে টাউনের হাল-হকিকত, চারপাশে লন্ডনি টাকার গরম দেখাবে, তা নাÑকাল থেকে অজায়গা-কুজায়গা ঘুরতে হবে। এ আবার কী রকম লন্ডনি, যে খালি বই পড়ে, হাওর-বিল দেখে! কেনো যে চাচাটা লন্ডন থাকে। দেশে এতো পড়ালেখা করেই বা লাভটা হলো কী? অশিক্ষিতরা লন্ডন গিয়ে কোটিপতি হয়ে যায়, আর চাচার কি-না পরিবার নিয়া দেশে আসতেই ৩ বছর লাগে! তারচে দেশে থাকাই কি ভালো ছিলো না?
পাভেল বেজার মনে রাজি হয়।
- কিন্তু যাবো কী করে!
কলমদর মিয়ার অবাক হবার কারণ সে ধরতে পারে না। গাড়ি একটা ভাড়া করলেই তো একেবারে হাওরের পেটে নিয়ে যাবে। পাহাড়ের পেটে যাওয়া তো আরো সোজা।
- বলে কী সে! যে-হাওর বারমাস সমুদ্র হয়ে থাকে, তার পেটে যাবে মাইক্রোবাস! আর যে-গহীন পাহাড়ে দিনের আলো দেখা যায় না, সেখানে রাতেও যাওয়া যেতে পারে!
পাভেল আবার অবাক হয়। চাচার কথায় সে তাল মিলাতে পারে না। বড় হাওর কি আর হাওর আছে? সেখানে তো এখন ফিশারি আর ফিশারি। পাহাড় জুড়ে বাগানবাড়ি। ক্ষমতার হাতে পাহাড় আর হাওর। রাস্তাটাস্তা হয়ে একেবারে একাকার।
- এলাকা কিতা আর আগের মতো আছেনি, চাচা? গেলে দেখবায় নে। আর...
কলমদর মিয়া ‘আর’ বলা শুনেই বুঝতে পারে পাভেল এবার চমক দেবে অন্য গপে। মজই লন্ডনির ছেলে লন্ডন থেকে বাড়ি এসে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি করছে। কাজ করছে ঢাকার সব মেস্তুরি-ইঞ্জিনিয়ার। যে-বাড়ি থেকে এই সেদিনও নৌকা ছাড়া বের হওয়া যেত না, সেখানে হচ্ছে দুই কোটি টাকার বাড়ি!
বিষ্ময় তাকে গিলে ফেলতে হয়।
- দক্ষিন পাড়ার মসজিদ-কমিটির নয়া চেয়ারম্যান হইছে মজই লন্ডনি। দক্ষিন-মসজিদো এবার কিতা অইবো, কইতামনি?
পাভেল আবার মসজিদে চলে আসে। কলমদর মিয়া আজ আর গল্প শুনতে চায় না। বরং কাল বা পরশু একবার হাওর দেখে আসার কথা পাকা করে উঠে যেতে চায়। কিন্তু দক্ষিণের মসজিদে কী ঘটবে আবার! ঘটুক যা ঘটার। পাভেলকে আর লাই দেওয়ার দরকার নাই। কোন গল্প থেকে কোন গল্পে যাবেÑরাতই তাতে জেগে থাকতে হবে। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সে বিশ্রাম নিতে চায়। পাভেল দক্ষিণ-মসজিদের আগাম কাহিনি আর শুরু করতে পারে না।
পাভেলের কথা ফলে ঈদের নামাজের পরপর।
গ্রামের তিন মসজিদেই ঈদের নামাজ হয়। ঈদেচান্দেও হাতেগোনা ক’ঘরের গ্রাম এক হতে পারে না। তাদের চাই আলাদা ঈদগাহ। দক্ষিণ-মসজিদের সামনের ছোট জায়গা তাই ‘খলিলপুর বড় ঈদগাহ’। অন্যান্য মসজিদের সামনেও ঈদগাহ আছে। ঈদের নামাজে শরিক হতে পাভেলের সাথে দক্ষিণের মসজিদে সে ঠিক সময় মতো পৌঁছায়। ভোর থেকেই মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে নামাজ হবে সাড়ে আটটায়। তারা পৌঁছায় পনেরো মিনিট আগে। লোকজন তেমন নাই। কুমিল্লার মিয়াছাবের ওয়াজ শুনছে সবাই। পাভেল কানে কানে জানায়Ñবানিয়াচঙ্গের মিয়াছাবকে বিদায় করার পর কুমিল্লার মিয়াছাবের চাকরি হয়েছে ক’মাস হয়। তারও কাহিনি আছে। কলমদর মিয়া তাকে থামিয়ে দেয়, কাহিনি পরে শোনা যাবে। সবাই ওয়াজ শুনছে। পেছনের সারিতে জায়নামাজ বিছিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তারা।
কুমিল্লার মিয়াছাব ওয়াজে সমাপ্তি টেনে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন ঠিক কাটায় কাটায়। চারপাশে নীরবতা নামে। নামাজ শেষ হয়। সালাম ফেরাতেই সামনের কাতার থেকে উঠে দাঁড়ায় মজই লন্ডনির হুরু ভাতিজা মঈনুÑমিয়াছাব জি, সহি নামাজের শর্ত কিতা কউকা চাই?
মঈনুর তর্জনী তোলা ধমকের সুর ইমামকে বিচলিত করে। পাভেল আড় চোখে কলমদর মিয়ার দিকে তাকায়।
- সহি নামাজের প্রধান শর্ত হইলো : জামা পাক, জাগা পাক, শরীর পাক...
- রাখইন আপনার জাগা পাক, জমিন পাক, ইতা আমরা জানি। আর কিতা কউকা?
- লাইন সোজা করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। একবার হইলো কী, আরবের মাটিতে আমাদের প্রিয় নবী নামাজ পড়তে দাঁড়াইছেন, একটা বখরি এসে...
- রাখইন আফনার বখরি, আসল কথাই তো কইরা না!
ইমামের আর ইয়াদ হয় না, আসল কথা কোনটা। লোকজনও কিছু বলে না। বলবেই বা কে, সবই তো মজই লন্ডনির ভাই-ভাতিজা। তারাই তো ইমাম রাখে, ছাড়ে, মসজিদ চালায়। মঈনু এবার তর্জনী তুলে ইমামকে শাসায়Ñনামাজের টাইম হওয়ার সাথে সাথে সবাইকে না-জানিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ায় সে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেনি, নিয়তও বাঁধতে পারেনি।
- এমলান নমাজ সহি হয়নি, কউকা চাই, মিয়াছাবজি? উপস্থিত মুরব্বিয়ানরা, আপনারাই কউকা নমাজ সহি হইছে কিনা?প
কেউ কিছু বলে না, শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মঈনুর তর্জনী আরো দৃঢ় হয়Ñআপনার বিচার পরে অইবো, মাফ চাউকা, কুতবা আর দোয়া পড়উকা...
কুতবা শেষে ইমামের দীর্ঘ মোনাজাত চারপাশে হাহাজারি নামায়Ñহে আল্লাহ, হে পরওয়ার দিগার, হে রাব্বুল আলামিন, দুজাহানের মালিক, এই দ্বীনহীন, গরিব, মুর্খ ইমামকে তুমি মাফ করিয়া দাও, আমার ভুল হইলে, না-জানিয়া কছুর করলে আমারে তুমি মাফ করিয়া দাও, হে দুনিয়ার বাদশা, হে নাজাত দাতা...
ইমামের চোখ বেয়ে জল নামে। তার চোখ মাটিতে মিশে যেতে চায়।
- কইছিলাম নি চাচা, দক্ষিণ মসজিদেও কাহিনি ঘটবো?
পাভেলের কথায় কলমদর মিয়া কোনো উত্তর করে না। ইমামের কান্না তার কানে বাজতে থাকে।
- এ-ইমামরও কিতা বিচার হইবোনি?
- হইবিনি মানে? একবারে চাকরি খতম। এর আগেও এমলান অইছে। এলাকায় কয়দিন থাকো, দেখবায় নে।
- কেউ কিছু বলে না?
- কে কইবো? ঘরে ঘরে লন্ডনি টাকা, এখন কে কার কথা হুনে? বিচার পাঞ্চাত আর গ্রামে নাই, কিন্তু আবার আছেও। যারা এলাকায় থাকে, তারা করবো কিতা? গাউর মানুষর তো আর বিচার হয় না, এখন সকল বিচার হয় রিক্সার ড্রাইভার, কামলা আর মসজিদর ইমামর। এরা সকলেই বাইরের লোক। ধনে-জনে দুর্বল। এদের বিচার হলে মানুষের কিতা? তারা আছে নিজেরে লইয়া, লন্ডন লইয়া। লন্ডন বরফ পড়লে ইকানো ছাতা টাঙ্গায়। এর মাঝে এসব বিচার-আচার বিনোদন দেয়। করার কিচ্ছু নাই, ইমাম খেদাও। দেখবায় নে ইবার পুবের মসজিদো কিতা ঘটে!
- কিতা ঘটবো?
- উত্তর-মসজিদর ইমাম গেলে দক্ষিণর মসজিদ-কমিটি মনে করে তাদের ক্ষমতা কিতা কমনি? আর দক্ষিণ-মসজিদর ইমাম গেলে পুবের মসজিদ-কমিটিও তাদের ক্ষমতা দেখায়। খোদার ঘর লইয়া ভাগাভাগি, দলাদলি। লন্ডনি টাকায় এলাকা পাল্টাই লাইছে, চাচা। অন্য জেলা হইলে বুঝলো নে ঠেলা। ইমামর উপরে ইমামদারি!
ঘটনার জন্য তাকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
রাতের খাবারে বসে পুবপাড়ার মওলা মিয়া তিন কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি বানানোর গল্প শুরু করলে ঈদের দাওয়াতে ভিন্নতা আনে। মজই লন্ডনির দুই কোটি টাকার বাড়িকে টেক্কা দিতে হবে। ভাই-ভাতিজা সকলেই লন্ডনে থাকে, টাকার কি আর কমতি আছে? চাচাত ভাইয়ের এসব কথায় কলমদর মিয়া মন বসাতে পারে না। তাছাড়া আসার পর থেকেই এই কাহিনি সে শুনে আসছে। ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকার বাড়ি হচ্ছেÑএলাকায় এটাই একমাত্র আলোচ্য বিষয়। ফোর স্ট্রোকের ড্রাইভার থেকে, মাছ বিক্রেতা সকলেই খবরটি কলমদর মিয়াকে দিতে ভুল করে না। মওলা মিয়ার কাছেও তা একমাত্র খবর হয়ে আসে। মজই লন্ডনিকে টেক্কা দেবার বাসনা তার চোখেমুখে আলো ছড়ায়। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। পুব-মসজিদের সেক্রেটারির ফোন। মওলা মিয়াকে এখনই উঠতে হবে। মসজিদ-কমিটির সভাপতি সে। তার একটা দায়িত্ব আছে না? বিচার তো তাকেই করতে হবে!
কলমদর মিয়া অবশ্য কিছুই বুঝতে পারে না। পাভেল শুধু মুচকি হাসে। মওলা মিয়া তড়িঘড়ি করে হাত ধুয়ে রওয়ানা দিতে চায়।
- কারেন্ট থাকে না, ইতা কিতা ইমাম বেটার জানা নাই নি? ভাটি দেশর ইমাম, হারাজীবন কুপি বাতি জ্বালাইছে, আর আইজ আল্লার ঘর আন্ধাইর রাখে, সাহস দেখছোনি! এখন আল্লার আন্ধাইর ঘরে মাইনষে এশার নামাজ পড়বো কেমলান! বেয়াদব ইমাম, খোদার ঘরর লগে বেয়াদবি, ইমামর কিতা অভাব আছেনি?
মওলা মিয়ার সদ্য-কেনা মোটর সাইকেলে জোরে কিক দিলে নির্গত ধোঁয়ায় কেচমা কচুগাছগুলো বড়ো কেঁপে কেঁপে ওঠে।
মশাহিদ আলীর সময় নাই কোলাকুলি করার। হোক না তিন বছর পর চাচাত ভাইয়ের এই বাড়ি ফেরা। এ-কাজ পরে করলেও হবে, কিন্তু বিচার তো আর পরে বসবে না। টাইম মতো মসজিদে না গেলে এতো দিনের অপেক্ষাই মাটি। এ তো আর গ্রামের লেতিপেতি বিচার নয় যে, গেলে গেলাম, না-গেলে না-গেলাম। এ যে গ্রাম থেকে ইউনিয়ন টপকিয়ে একেবারে জেলায় গিয়ে পৌছেছে! ইউনিয়ন-পৌরসভার চেয়ারম্যান তো অবশ্যই, জেলা শহরের বড় দু’দলের জানু লিডারদেরকেও আনা হয়েছে। এরকম বিচার কি আর তার মতো লোকের জন্য অপেক্ষা করবে, যেখানে মেম্বার, পাড়ার মোড়ল, পাঁতি নেতারাই আর পাত্তা পাচ্ছে না? তাছাড়া কাল ঈদ, এশার নামাজের আগেই বিচার শেষ হবেÑমাইকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কলমদর মিয়ার মাথায় বিষয়টি ঠিক খোলাসা হয় না। খোলাসা হবার কথাও নয়। ফিরেছে সে তিন বছর পর।
- সময় নাই ভাইসাব, কাহিনি মজার আছে। পাভেলে কইবোনে, আমি যাইগি...
মশাহিদ আলী তড়িগড়ি রওয়ানা দেয়। কাহিনি বলার ভার পড়ে ভাতিজা পাভেলের ওপর। বেচারা যেতে পারছে না, বা যেতে তার বারণ আছে। ক’দিন পরেই এসএসসি পরীক্ষা, তাছাড়া এতোদিন পর চাচার এই বাড়ি-আসা উপেক্ষা করে সে আর যায়ই বা কেমন করে? অবশ্য দায়িত্ব পেয়ে ক্ষতি তার পুষিয়ে যায়। সে আর দেরি করতে চায় না, কাহিনি তার ঠোঁটের ওপর বসে ছিলো, নাড়া পেয়েই উড়াল দেয়Ñউত্তর-মসজিদর মাইক চুরিত ইমাম সাব জড়িতো আছইন, আইজ তার ফাইন্যাল বিচার অইবো।
- ইমাম জড়িত আছইন, মাইক চুরিত! বিষয়টা কিতা পাভেল?
পাভেল এবার জুত হয়ে বসে। কাহিনির পেছনে যায়।
রোজার ঠিক আগে আগে উত্তরের মসজিদে নয়া মাইক দান করে লতিফ লন্ডনি। রোজার মাস শুরু হয় আনন্দে। মুসল্লিরা তাতে বড়োই খুশি। কিন্তু দিন দশেক যেতে না যেতে মাইক দু’টি চুরি হয়ে যায়। মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান হুরমত উল্লার এককথাÑমাইক চুরিতে ইমাম সাহেবের হাত আছে। এই নিয়ে সারা রোজার মাস কাটে। ঘন ঘন বিচার বসে। পাশের জেলা থেকে ক’মাস আগে আসা কালা মিয়াছাব ১০০০ টাকার চাকরি হারানোর ভয়ে হাত-পা ধরেও রেহাই পায় না। বিচার তার হবেই হবে, মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যানের কথার দাম আছে নাÑতিন তিনটা ছেলে যার লন্ডনে থাকে? এক মিয়াছাব গেলে আরেক মিয়াছাব আসবে, ইমামের কি আর অভাব পড়েছে যে বেয়াদব ইমামকে রাখতে হবেÑযে খালি মুখে মুখে ফতোয়া দেয়, মসলা দেখায়?
হুরমত উল্লার হুমকি-ধামকিতে ইমামের জ্বর আসে।
জ্বর হলে কী হবে, তারাবি নামাজে ঠিকই তাকে হাজির হতে হয়। সিজদায় যেতে বড়ো সময় লাগে। এমনিতেই পেটের জন্য সিজদায় যেতে অনেক কষ্ট করতে হয়, কপালের আগে পেট মাটিতে চলে যায়। কষ্টেসৃষ্টে কালা মিয়াছাবের কপাল যেই মাটি ছুঁয়েছে, পেছন থেকে সুর ওঠেÑইমামসাব, পুলিশ আইছে!
পুলিশের ভয়ে সিজদা ফেলে উত্তরের ধানি বিলের দিকে দৌড় দেয় সে। লোকজন তাকে খুঁজে পেতে মধ্যরাত হয়ে যায়। ধানি জমির কোণায় মাছধরার গর্তে জলকাদায় লুকিয়ে থাকা কালা মিয়াছাবের কথা শুধু একটাইÑআমি মাইক চুরি করছি না, আমি মাইক চুরি করছি না...
ইমামের জ্বর দ্বিগুণ হয়।
কিন্তু পুলিশ আসবে কোথা থেকে, কেইস-টেইস হলে তো? আসলে সুর তুলে হুরমত উল্লার ভাতিজা একরাম। তার জন্য একরামের বিচার হওয়ার কথা, তা না, উল্টা বিপদ আসে কালা মিয়াছাবের। হুরমত উল্লার এককথাÑইমামের ঈমানে গলদ আছে। পুলিশের ভয়ে যে-ইমাম সিজদা ফেলে দৌড় দেয়, সেই কমজুরি ইমামের পিছনে নামাজ হয় না, হতে পারে না। তাছাড়া এতে প্রমাণ হয়, মাইক চুরিতে তার হাত আছে। এর জন্য কালা মিয়াছাবের শক্ত বিচার হতে হবেÑকী বলেন আপনারা?
হুরমত উল্লার ভাইভাতিজারা সমর্থন করে।
পাভেল কাহিনি আরো এগিয়ে নিতে চায় কিন্তু ইমামের ‘বড় পেট ঠেলে সিজদায় যাওয়া’ আর ‘পুলিশ আইছে’ শুনে ইমামের ‘দর্শনীয় দৌঁড়ের’ বর্ণনায় এতো হাসাহাসি করে যে, তাকে বেশ হয়রান দেখায়।
কলমদর মিয়া উঠে যায়। কাহিনি দাঁড়িয়ে থাকে।
মশাহিদ আলী বাড়ি ফিরে খবর দেয়Ñইমামের চাকরি খতম। ঈদের নামাজ পড়াবেন নোয়াখালির মিয়াছাব।
- ইবার দেখবায় নে চাচা দক্ষিনর মসজিদো কিতা হয়!
কলমদর মিয়া ঠিক বুঝতে পারে না, দক্ষিণের মসজিদে আবার কী হবে! পাভেলকে আর জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করে না। গ্রামটা কি এতো অল্পতেই পাল্টে গেলো? ছোট এক গ্রাম, মসজিদ আবার তিনটাÑউত্তরে, দক্ষিণে আর পুবে। পশ্চিমেও আছে একটা, তবে তা পাঞ্জেগানা নামাজের জন্য লন্ডনিবাড়ির গুষ্ঠীবদ্ধ। অতএব গ্রামে মসজিদ তিন, কমিটিও তিন।
পাভেল মসজিদ কমিটির গল্পে যোগ দিতে চায়, কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় প্রচ- গরম কলমদর মিয়াকে ঝাপটে ধরে। আজ আর বিদ্যুৎ আসবে নাÑ মশাহিদ আলীর কথায় কলমদর মিয়া অবাক হয়Ñকারেন্ট থাকে না কেন? লোকজন প্রতিবাদ করে না?
বিদ্যুৎ নিয়ে মশাহিদ আলীর কোনো অভিযোগ নেই। কী হবে অভিযোগ করে, যেখানে সারাদেশই জিম্মি হয়ে আছে? লন্ডন থেকে এসে দেশের অবস্থা বোঝা কি এতো সোজা? মানুষ কি প্রতিবাদ করে নাই? করছে। কিন্তু লাভটা হলো কী? কোনটা ছেড়ে কোনটা নিয়ে প্রতিবাদ করবে মানুষ, বাজারে বনডোলার সের যেখানে ৩০০ টাকা?
মশাহিদ আলীর কথায় রাগ ঝরে। বড় ভাই’র সৌদি থেকে পাঠানো টাকায় সংসার চালানোর কষ্ট তার কথায় আরো বাড়তে থাকে। একদা দক্ষিণের পুতায় ঘাস হয়ে থাকা বন ধনিয়ার সের ৩০০ টাকা শোনে কলমদর মিয়ারও ভাবনা হয় বটে। বিদুৎ নাই, বাজারে আগুন, হাওর-পাহাড় দখল করছে চেয়ারম্যান-মেম্বার-এমপিরা, হচ্ছে ফিশারি আর বাগান-বাড়ি, পাকা হচ্ছে রাস্তা, টেন্ডার পাচ্ছে এমপির ভাই-ভাতিজারা, চারপাশে উন্নয়নের জোয়ার চলছে, এর সাথে উড়ছে লন্ডনি টাকা, সাধারণ মানুষের কি এসবে মাথা ঘামানোর সময় আছে, যেখানে সারাদেশই ঘুমিয়ে আছে? এলাকার কথা বলে আর লাভ কী? একদা যে-জমিতে ২/৩ ফসল হতো, এখন হয় এক ফসল, তাও কেউ করে, কেউ তার তোয়াক্কাই করে না। কে আর দেশ নিয়া ভাবে? লন্ডনি টাকা যেখানে মেঘ ঝরায়, রোদ তোলে, শস্য ফলায়?
মশাহিদ আলীর গলায় ঝাঁঝ বাড়ে।
এলাকা না-হয় বাদ গেলো, কিন্তু দেশের মানুষের কি করার কিচ্ছু নাই! কলমদর মিয়া কথা তুলতে চায় কিন্তু পাভেল বড়-হাওরের ফিশারি প্রজেক্টের গল্প শুরু করলে বিষয়টি এখানেই চাপা পড়ে।
বড় হাওরের গল্পে কলমদর মিয়ার আগ্রহ থাকে। শৈশবের সেই হাওরটা যদি একবার দেখে আসা যেতো! কিন্তু এতো গভীর হাওরে যাওয়া যায় কীভাবে?
পাভেল অবাক হয়। বড় হাওরে যাওয়া কি আর কোনো কাজ হলো? কালই সে নিয়ে যাবে কিন্তু আগে মোবাইল ফোনের ওয়াদা করতে হবে, যেই সেই মোবাইল হলে হবে না, একেবারে ভিডিও-অডিও সব থাকতে হবে। চাচাকে নিয়ে সে বিপদেই পড়ে। লন্ডন থেকে আসা চাচার লগে শহরে যাবে, লাইটেস কিনে বাজার-মার্কেট করবে, তা না, যেতে হবে হাওরে। মোবাইলের কথা শুনে বলে কি না, এই বয়সে গ্রামে বসে এত দামি মোবাইল দিয়ে সে কী করবে? আজকাল শুটকি-ওয়ালাও মোবাইল রাখেÑপাভেল খবরটি দিতে পেরেও হতাশ হয়। এ গ্রামে হাতে হাতে যে মোবাইল ঘুরে, চাচায় তার খবরও রাখে না? আর দেখো হাওরের পর নদীনালা পাহাড়-পর্বতের খবর নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। আরে বাবা লন্ডন থেকে এসে এসব কেউ জানতে চায়? করবে লন্ডনের গপ, জানতে চাইবে টাউনের হাল-হকিকত, চারপাশে লন্ডনি টাকার গরম দেখাবে, তা নাÑকাল থেকে অজায়গা-কুজায়গা ঘুরতে হবে। এ আবার কী রকম লন্ডনি, যে খালি বই পড়ে, হাওর-বিল দেখে! কেনো যে চাচাটা লন্ডন থাকে। দেশে এতো পড়ালেখা করেই বা লাভটা হলো কী? অশিক্ষিতরা লন্ডন গিয়ে কোটিপতি হয়ে যায়, আর চাচার কি-না পরিবার নিয়া দেশে আসতেই ৩ বছর লাগে! তারচে দেশে থাকাই কি ভালো ছিলো না?
পাভেল বেজার মনে রাজি হয়।
- কিন্তু যাবো কী করে!
কলমদর মিয়ার অবাক হবার কারণ সে ধরতে পারে না। গাড়ি একটা ভাড়া করলেই তো একেবারে হাওরের পেটে নিয়ে যাবে। পাহাড়ের পেটে যাওয়া তো আরো সোজা।
- বলে কী সে! যে-হাওর বারমাস সমুদ্র হয়ে থাকে, তার পেটে যাবে মাইক্রোবাস! আর যে-গহীন পাহাড়ে দিনের আলো দেখা যায় না, সেখানে রাতেও যাওয়া যেতে পারে!
পাভেল আবার অবাক হয়। চাচার কথায় সে তাল মিলাতে পারে না। বড় হাওর কি আর হাওর আছে? সেখানে তো এখন ফিশারি আর ফিশারি। পাহাড় জুড়ে বাগানবাড়ি। ক্ষমতার হাতে পাহাড় আর হাওর। রাস্তাটাস্তা হয়ে একেবারে একাকার।
- এলাকা কিতা আর আগের মতো আছেনি, চাচা? গেলে দেখবায় নে। আর...
কলমদর মিয়া ‘আর’ বলা শুনেই বুঝতে পারে পাভেল এবার চমক দেবে অন্য গপে। মজই লন্ডনির ছেলে লন্ডন থেকে বাড়ি এসে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি করছে। কাজ করছে ঢাকার সব মেস্তুরি-ইঞ্জিনিয়ার। যে-বাড়ি থেকে এই সেদিনও নৌকা ছাড়া বের হওয়া যেত না, সেখানে হচ্ছে দুই কোটি টাকার বাড়ি!
বিষ্ময় তাকে গিলে ফেলতে হয়।
- দক্ষিন পাড়ার মসজিদ-কমিটির নয়া চেয়ারম্যান হইছে মজই লন্ডনি। দক্ষিন-মসজিদো এবার কিতা অইবো, কইতামনি?
পাভেল আবার মসজিদে চলে আসে। কলমদর মিয়া আজ আর গল্প শুনতে চায় না। বরং কাল বা পরশু একবার হাওর দেখে আসার কথা পাকা করে উঠে যেতে চায়। কিন্তু দক্ষিণের মসজিদে কী ঘটবে আবার! ঘটুক যা ঘটার। পাভেলকে আর লাই দেওয়ার দরকার নাই। কোন গল্প থেকে কোন গল্পে যাবেÑরাতই তাতে জেগে থাকতে হবে। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে সে বিশ্রাম নিতে চায়। পাভেল দক্ষিণ-মসজিদের আগাম কাহিনি আর শুরু করতে পারে না।
পাভেলের কথা ফলে ঈদের নামাজের পরপর।
গ্রামের তিন মসজিদেই ঈদের নামাজ হয়। ঈদেচান্দেও হাতেগোনা ক’ঘরের গ্রাম এক হতে পারে না। তাদের চাই আলাদা ঈদগাহ। দক্ষিণ-মসজিদের সামনের ছোট জায়গা তাই ‘খলিলপুর বড় ঈদগাহ’। অন্যান্য মসজিদের সামনেও ঈদগাহ আছে। ঈদের নামাজে শরিক হতে পাভেলের সাথে দক্ষিণের মসজিদে সে ঠিক সময় মতো পৌঁছায়। ভোর থেকেই মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে নামাজ হবে সাড়ে আটটায়। তারা পৌঁছায় পনেরো মিনিট আগে। লোকজন তেমন নাই। কুমিল্লার মিয়াছাবের ওয়াজ শুনছে সবাই। পাভেল কানে কানে জানায়Ñবানিয়াচঙ্গের মিয়াছাবকে বিদায় করার পর কুমিল্লার মিয়াছাবের চাকরি হয়েছে ক’মাস হয়। তারও কাহিনি আছে। কলমদর মিয়া তাকে থামিয়ে দেয়, কাহিনি পরে শোনা যাবে। সবাই ওয়াজ শুনছে। পেছনের সারিতে জায়নামাজ বিছিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তারা।
কুমিল্লার মিয়াছাব ওয়াজে সমাপ্তি টেনে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়েন ঠিক কাটায় কাটায়। চারপাশে নীরবতা নামে। নামাজ শেষ হয়। সালাম ফেরাতেই সামনের কাতার থেকে উঠে দাঁড়ায় মজই লন্ডনির হুরু ভাতিজা মঈনুÑমিয়াছাব জি, সহি নামাজের শর্ত কিতা কউকা চাই?
মঈনুর তর্জনী তোলা ধমকের সুর ইমামকে বিচলিত করে। পাভেল আড় চোখে কলমদর মিয়ার দিকে তাকায়।
- সহি নামাজের প্রধান শর্ত হইলো : জামা পাক, জাগা পাক, শরীর পাক...
- রাখইন আপনার জাগা পাক, জমিন পাক, ইতা আমরা জানি। আর কিতা কউকা?
- লাইন সোজা করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। একবার হইলো কী, আরবের মাটিতে আমাদের প্রিয় নবী নামাজ পড়তে দাঁড়াইছেন, একটা বখরি এসে...
- রাখইন আফনার বখরি, আসল কথাই তো কইরা না!
ইমামের আর ইয়াদ হয় না, আসল কথা কোনটা। লোকজনও কিছু বলে না। বলবেই বা কে, সবই তো মজই লন্ডনির ভাই-ভাতিজা। তারাই তো ইমাম রাখে, ছাড়ে, মসজিদ চালায়। মঈনু এবার তর্জনী তুলে ইমামকে শাসায়Ñনামাজের টাইম হওয়ার সাথে সাথে সবাইকে না-জানিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ায় সে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেনি, নিয়তও বাঁধতে পারেনি।
- এমলান নমাজ সহি হয়নি, কউকা চাই, মিয়াছাবজি? উপস্থিত মুরব্বিয়ানরা, আপনারাই কউকা নমাজ সহি হইছে কিনা?প
কেউ কিছু বলে না, শুধু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। মঈনুর তর্জনী আরো দৃঢ় হয়Ñআপনার বিচার পরে অইবো, মাফ চাউকা, কুতবা আর দোয়া পড়উকা...
কুতবা শেষে ইমামের দীর্ঘ মোনাজাত চারপাশে হাহাজারি নামায়Ñহে আল্লাহ, হে পরওয়ার দিগার, হে রাব্বুল আলামিন, দুজাহানের মালিক, এই দ্বীনহীন, গরিব, মুর্খ ইমামকে তুমি মাফ করিয়া দাও, আমার ভুল হইলে, না-জানিয়া কছুর করলে আমারে তুমি মাফ করিয়া দাও, হে দুনিয়ার বাদশা, হে নাজাত দাতা...
ইমামের চোখ বেয়ে জল নামে। তার চোখ মাটিতে মিশে যেতে চায়।
- কইছিলাম নি চাচা, দক্ষিণ মসজিদেও কাহিনি ঘটবো?
পাভেলের কথায় কলমদর মিয়া কোনো উত্তর করে না। ইমামের কান্না তার কানে বাজতে থাকে।
- এ-ইমামরও কিতা বিচার হইবোনি?
- হইবিনি মানে? একবারে চাকরি খতম। এর আগেও এমলান অইছে। এলাকায় কয়দিন থাকো, দেখবায় নে।
- কেউ কিছু বলে না?
- কে কইবো? ঘরে ঘরে লন্ডনি টাকা, এখন কে কার কথা হুনে? বিচার পাঞ্চাত আর গ্রামে নাই, কিন্তু আবার আছেও। যারা এলাকায় থাকে, তারা করবো কিতা? গাউর মানুষর তো আর বিচার হয় না, এখন সকল বিচার হয় রিক্সার ড্রাইভার, কামলা আর মসজিদর ইমামর। এরা সকলেই বাইরের লোক। ধনে-জনে দুর্বল। এদের বিচার হলে মানুষের কিতা? তারা আছে নিজেরে লইয়া, লন্ডন লইয়া। লন্ডন বরফ পড়লে ইকানো ছাতা টাঙ্গায়। এর মাঝে এসব বিচার-আচার বিনোদন দেয়। করার কিচ্ছু নাই, ইমাম খেদাও। দেখবায় নে ইবার পুবের মসজিদো কিতা ঘটে!
- কিতা ঘটবো?
- উত্তর-মসজিদর ইমাম গেলে দক্ষিণর মসজিদ-কমিটি মনে করে তাদের ক্ষমতা কিতা কমনি? আর দক্ষিণ-মসজিদর ইমাম গেলে পুবের মসজিদ-কমিটিও তাদের ক্ষমতা দেখায়। খোদার ঘর লইয়া ভাগাভাগি, দলাদলি। লন্ডনি টাকায় এলাকা পাল্টাই লাইছে, চাচা। অন্য জেলা হইলে বুঝলো নে ঠেলা। ইমামর উপরে ইমামদারি!
ঘটনার জন্য তাকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
রাতের খাবারে বসে পুবপাড়ার মওলা মিয়া তিন কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি বানানোর গল্প শুরু করলে ঈদের দাওয়াতে ভিন্নতা আনে। মজই লন্ডনির দুই কোটি টাকার বাড়িকে টেক্কা দিতে হবে। ভাই-ভাতিজা সকলেই লন্ডনে থাকে, টাকার কি আর কমতি আছে? চাচাত ভাইয়ের এসব কথায় কলমদর মিয়া মন বসাতে পারে না। তাছাড়া আসার পর থেকেই এই কাহিনি সে শুনে আসছে। ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে খালের পাড়ে দুই কোটি টাকার বাড়ি হচ্ছেÑএলাকায় এটাই একমাত্র আলোচ্য বিষয়। ফোর স্ট্রোকের ড্রাইভার থেকে, মাছ বিক্রেতা সকলেই খবরটি কলমদর মিয়াকে দিতে ভুল করে না। মওলা মিয়ার কাছেও তা একমাত্র খবর হয়ে আসে। মজই লন্ডনিকে টেক্কা দেবার বাসনা তার চোখেমুখে আলো ছড়ায়। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। পুব-মসজিদের সেক্রেটারির ফোন। মওলা মিয়াকে এখনই উঠতে হবে। মসজিদ-কমিটির সভাপতি সে। তার একটা দায়িত্ব আছে না? বিচার তো তাকেই করতে হবে!
কলমদর মিয়া অবশ্য কিছুই বুঝতে পারে না। পাভেল শুধু মুচকি হাসে। মওলা মিয়া তড়িঘড়ি করে হাত ধুয়ে রওয়ানা দিতে চায়।
- কারেন্ট থাকে না, ইতা কিতা ইমাম বেটার জানা নাই নি? ভাটি দেশর ইমাম, হারাজীবন কুপি বাতি জ্বালাইছে, আর আইজ আল্লার ঘর আন্ধাইর রাখে, সাহস দেখছোনি! এখন আল্লার আন্ধাইর ঘরে মাইনষে এশার নামাজ পড়বো কেমলান! বেয়াদব ইমাম, খোদার ঘরর লগে বেয়াদবি, ইমামর কিতা অভাব আছেনি?
মওলা মিয়ার সদ্য-কেনা মোটর সাইকেলে জোরে কিক দিলে নির্গত ধোঁয়ায় কেচমা কচুগাছগুলো বড়ো কেঁপে কেঁপে ওঠে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন