মেঘে ঢাকা তারা : ঝড়ের আগের একটি আবহাওয়া সম্পর্কে
জয়দীপ মৈত্র
" Life is but a walking shadow ...." সাদা কালো পর্দায় তখন দাউদাউ আগুনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে " How to be a good communist " .. আর তিনি , তীক্ষ্ণ চোখে মানসিক হাসপাতালের কেবিনের ফাঁক দিয়ে তিনি চেয়ে রয়েছেন সেই লেলিহানের দিকে। তাঁর চোখের মণিতে জ্বলে যাচ্ছে তাঁর অর্জিত অধিকারের লড়াই। মৌন হয়ে বসে রয়েছেন তিনি। দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর আশা আকাঙ্খা , স্বপ্ন , তাঁর চারপাশের মানুষেরা। তবু তিনি দৃঢ় , সোজা মেরুদন্ডে কোন ভেঙে পরা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর এটাই তো হওয়ার ছিলো। এই মুহুর্তে টলিউডে সর্বাধিক আলোচ্য , হইচই ফেলে দেওয়া ফিল্ম "মেঘে ঢাকা তারা " দেখতে বসে বারবার ভাবছিলাম এই ফিল্মের পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথা। খবরের কাগজ আর ইন্টারনেটের সুবাদে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই জেনে ফেলেছিলাম এটি কাকে নিয়ে তৈরী। ঋত্বিক ঘটক শুধুমাত্র একজন পরিচালক নন। একজন অভিনেতা , নাট্যকর্মী , শ্রমজীবি , বুদ্ধিজীবী , স্বপ্ন দেখা মানুষ নন। এ সমস্ত কিছুর বাইরেও তিনি এক আত্মা , এক চেতনা , একজন মানুষ যিনি তার সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত সময়েও মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে মনে করতেন , আধুনিক বাঙালীর রক্ত , হাড় , মজ্জারও গভীরে কোনো প্রত্যন্ত জায়গায় , যেখানে এখনও হয়ত সুপ্ত হয়ে থাকলেও থাকতে পারে রঙহীন নিতম্বলেহনহীন দৃঢ় স্বাধীনচেতা আপসহীন আগ্নেয় মনোভাব , সেই জায়গায় এই কথাগুলোকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম এবং অব্যর্থ কাজটি কমলেশ্বর করে ফেলেছেন। আহা ! এ শুধু সিনেমা নয় ! এ মহাকাব্য ! প্রত্যেকটি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে এক আশ্চর্য রঙীন মায়াজাল ( হ্যা রঙীন , কারণ যে সিনেমার প্রত্যেকটি দৃশ্যে এত সিনেম্যাটিক বৈচিত্র্য ও তার সুনিপুণ , সুচিন্তিত প্রয়োগ থাকে তাকে নেহাত সাদা কালো ছবির আওতায় ফেললে সিনেমা দেখার তৃতীয় চোখকে অসম্মান করা হয় ) বুনেছেন পরিচালক। শুরু থেকে একটার পর একটা দৃশ্যতলোয়ার ধেয়ে আসে আর এফোঁড়-ওফোঁড়টুকুই চটির মত মাথায় নিয়ে চেয়ে থাকি পর্দায়। ঋত্বিকের জীবনী এবং ফিল্মোগ্রাফি যাঁরা জানেন , তাঁরা বুঝতে পারবেন , কি আশ্চর্য অবলীলায় একের পর এক ন্যারেটিভ ভেঙেচুরে ছারখার করে পর্দার নীলকন্ঠ বাগচী বারবার এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দর্শকের মননে। কি দূর্দান্ত ট্রিটমেন্ট ! তিনটি দৃশ্যের কথা আমি উল্লেখ করবই। ১) শক থেরাপির দৃশ্যে নেপথ্যে বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনী ..২) ফাঁকা মাঠে নীলকন্ঠর " ঘরছাড়া " ছবির শিশুশিল্পীর সঙ্গে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত নীলকন্ঠর কথোপকথন। ৩) " তিতাস একটি নদীর নাম " এবং "অযান্ত্রিক " ছবির দৃশ্য ছুঁয়ে এসে শৈশবের ভবা ( নীলকন্ঠ ) তার মা কে খুঁজে পায় "সুবর্ণরেখা" র চরে। তিনটে ভিন্ন দৃশ্য মাখামাখি এক হয়ে জেগে থাকে। আহা ! কমলেশ্বর , আপনার হাতের আঙুলে পরপর চুমু।আপনার মাথার ভেতরে পরপর চুমু।এবং নীলকন্ঠর এই অতীত রোমন্থিত ফ্ল্যাশব্যাকের নেপথ্যে এক ডাক্তারকে ( আবীর অসম্ভব সুন্দর ) এনে হাজির করা। যেন রোগের গভীরে গিয়ে চিরন্তন চিকিত্সক বুঝতে চাইছে এ আসলে রোগ নয় , এ ওষুধ। এ আসলে আত্মবিস্মৃত বাঙালীর মুখে জ্বলে ওঠা মশালের লেলিহান। ফুলমনীর নাচের প্রথম পা। ছিন্নমূল মানুষের ছিনিয়ে নেওয়ার গানকে প্রায় নিজের শরীরের অঙ্গ বানিয়ে নেওয়া একজন মানুষের লড়াই তথাকথিত লোকরঞ্জিত শিল্পের বিরুদ্ধে। কবিতা , গল্প , নাটক , সিনেমা এবং সিনেমার থেকে ভালো গণমাধ্যম পেলে সিনেমাকেও লাঠি মেরেন বেরিয়ে যাওয়ার সংকল্পের পেছনে যে লড়াই , দৃঢ়তা ফুটে ওঠে , তাতে বারংবার বৃদ্ধ বেহালাবাদকের তার কেটে গেলেও নীলকন্ঠ দমেন না। ঋত্বিক দমেছিলেন ? কী ? "বাইনসোৎ " বাঙালী ? দমেছিলেন ? আজ লোকটার মৃত্যুর পর তাকে মাথায় তুলে নাচো ? একের পর এক ছবিতে উপেক্ষা আর দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহ উপহার দিয়ে সেই সময়ে কি দিয়েছিলে ঋত্বিককে ? বোঝোনি তো , ঋত্বিক আসলে আজন্ম রোমান্টিক একজন মানুষ , যিনি তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে এই বাংলার মানুষ , প্রকৃতি এবং এই ভারতের হাজার বছরের বঞ্চনা শাসন শোষণ প্রতিবাদের দর্শনের ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে আদতে সেই অলৌকিক "দুগ্গা" রই সন্ধান করে বেরিয়েছেন , যা তাঁর মতে মানুষের শৃঙ্খল ছিন্ন করার প্রধান উপাদান। একের পর এক ছবি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের স্বীকার হয়েও তবু তিনি দমে যান নি। আর দমে যান নি বলেই আজ সারা বিশ্বের ফিল্মের ইতিহাসে ঋত্বিক ঘটক এক পোক্ত স্তম্ভ বিশেষ। " দর্শক ফ্লপ করেছে। আমার ছবি ফ্লপ করে নি "..না ঋত্বিক , আপনি ফ্লপ করতেই পারেন না ...সৎ শিল্প কখনও ফ্লপ করে না - এই ছবির মুখ্য চরিত্র শাশ্বতর অভিনয় নিয়ে আমি একটি কথাই বলবো। ভদ্রলোকের জীবনের সম্ভবত সেরা অভিনয় হয়ে থাকলো এটি। চলাফেরা , কথা বলা , চোখের চাহনি - কী অসম্ভব পরিণত চরিত্রায়ণই না করলেন শাশ্বত ! নীলকন্ঠ হয়ে ওঠা হলো এখানে। জীবনে ভুলবো না সিনেমার রিল মাথায় নিয়ে ক্লান্ত মদ্যপ নীলকন্ঠের ঘুমদৃশ্য আর ভোরের নেপথ্যে আকাশবাণীর সুর ! সেলাম কমলেশ্বর। সেলাম আপনাকে।সুরমা ঘটক (এখানে দুগ্গা )-এর চরিত্রে অনন্যা , বিজন ভট্টাচার্যর ( এখানে বিক্রম দা ) চরিত্রে শুভাশিস অসামান্য। আবীর যথাযথ , সুন্দর। প্রত্যেকটা শিল্পীই এখানে সেরা কাজটি করেছেন। ফলে এটি সিনেমার থেকেও একধাপ এগিয়ে যাওয়া " একটা কিছু "হয়েছে। এই ছবির দৃশ্যভাবনা আন্তর্জাতিক মানের। গানের ব্যবহার , ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল , এডিটিং প্রত্যেকটি ছোট বড় জিনিস নিখুঁত। শেষ দৃশ্যটা ভাবুন ! " যুক্তি তক্কো আর গপ্পো " র বঙ্গবালার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন নীলকন্ঠ। পর্দা ক্রমশ রঙীন হয়ে উঠছে। ফুটে উঠেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অংশ -"তুমি গেছো। স্পর্ধা গেছে। বিনয় এসেছে।" এভাবেই তো এই বাংলার শেকড়ের গভীরে , আরো গভীরে রওনা দিয়েছেন ঋত্বিক - সব ভেঙেচুরে সব উপড়ে ক্রমশ আরো গভীরে - আর , আমার মতে এই ছবিতে কমলেশ্বরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব , আধুনিক বাঙালীর গলায় হাতুড়ির বাড়ি মেরে এই সত্যটি গিলিয়ে দেওয়া যে আইনক্সে ৫০০ টাকা টিকিট কেটে , পপকর্ন নিয়ে , বান্ধবীর কোমরে হাত বুলিয়ে এমন একটা সিনেমা দেখে বাঙালী আহা উহু করছে আর চোখের জল ফেলছে (অনেকের তো আবার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে , ঋত্বিকের ছবি যেমন যেতো ) যে লোকটি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়তে লড়তে শেষ জীবনে দুর্বিষহ মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।এটাই চূড়ান্ত মোচড়। এটাই এ ছবির সার্থকতা।আবার টুপি খুললাম কমলেশ্বর। আর আপনি ঋত্বিক ? আপনার কাছে টুপি ছাড়া আর কি খোলার আছে ?বহু আগেই তো উলঙ্গ হয়ে গিয়েছি। আপনি তখনও ব্যর্থ হন নি ঋত্বিক। মানুষের লড়াই ব্যর্থ হয় না, আপনি জানতেন , কখনও হয় না - আপনি পুড়েছেন বলেই সিনেমাপিপাসু মানুষ এবং "বাইনসোৎ " বাঙালী , আমরা আলো পাচ্ছি। "সব পুড়ছে। ব্রহ্মান্ড পুড়ছে। আমি পুড়ছি। " ... শুধু প্রশ্ন , আমরা একটুও পুড়লাম কী ? নাকী "বাইনসোৎ " বাঙালীই থাকলাম ?
" Life is but a walking shadow ...." সাদা কালো পর্দায় তখন দাউদাউ আগুনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে " How to be a good communist " .. আর তিনি , তীক্ষ্ণ চোখে মানসিক হাসপাতালের কেবিনের ফাঁক দিয়ে তিনি চেয়ে রয়েছেন সেই লেলিহানের দিকে। তাঁর চোখের মণিতে জ্বলে যাচ্ছে তাঁর অর্জিত অধিকারের লড়াই। মৌন হয়ে বসে রয়েছেন তিনি। দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর আশা আকাঙ্খা , স্বপ্ন , তাঁর চারপাশের মানুষেরা। তবু তিনি দৃঢ় , সোজা মেরুদন্ডে কোন ভেঙে পরা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর এটাই তো হওয়ার ছিলো। এই মুহুর্তে টলিউডে সর্বাধিক আলোচ্য , হইচই ফেলে দেওয়া ফিল্ম "মেঘে ঢাকা তারা " দেখতে বসে বারবার ভাবছিলাম এই ফিল্মের পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথা। খবরের কাগজ আর ইন্টারনেটের সুবাদে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই জেনে ফেলেছিলাম এটি কাকে নিয়ে তৈরী। ঋত্বিক ঘটক শুধুমাত্র একজন পরিচালক নন। একজন অভিনেতা , নাট্যকর্মী , শ্রমজীবি , বুদ্ধিজীবী , স্বপ্ন দেখা মানুষ নন। এ সমস্ত কিছুর বাইরেও তিনি এক আত্মা , এক চেতনা , একজন মানুষ যিনি তার সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত সময়েও মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে মনে করতেন , আধুনিক বাঙালীর রক্ত , হাড় , মজ্জারও গভীরে কোনো প্রত্যন্ত জায়গায় , যেখানে এখনও হয়ত সুপ্ত হয়ে থাকলেও থাকতে পারে রঙহীন নিতম্বলেহনহীন দৃঢ় স্বাধীনচেতা আপসহীন আগ্নেয় মনোভাব , সেই জায়গায় এই কথাগুলোকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম এবং অব্যর্থ কাজটি কমলেশ্বর করে ফেলেছেন। আহা ! এ শুধু সিনেমা নয় ! এ মহাকাব্য ! প্রত্যেকটি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে এক আশ্চর্য রঙীন মায়াজাল ( হ্যা রঙীন , কারণ যে সিনেমার প্রত্যেকটি দৃশ্যে এত সিনেম্যাটিক বৈচিত্র্য ও তার সুনিপুণ , সুচিন্তিত প্রয়োগ থাকে তাকে নেহাত সাদা কালো ছবির আওতায় ফেললে সিনেমা দেখার তৃতীয় চোখকে অসম্মান করা হয় ) বুনেছেন পরিচালক। শুরু থেকে একটার পর একটা দৃশ্যতলোয়ার ধেয়ে আসে আর এফোঁড়-ওফোঁড়টুকুই চটির মত মাথায় নিয়ে চেয়ে থাকি পর্দায়। ঋত্বিকের জীবনী এবং ফিল্মোগ্রাফি যাঁরা জানেন , তাঁরা বুঝতে পারবেন , কি আশ্চর্য অবলীলায় একের পর এক ন্যারেটিভ ভেঙেচুরে ছারখার করে পর্দার নীলকন্ঠ বাগচী বারবার এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দর্শকের মননে। কি দূর্দান্ত ট্রিটমেন্ট ! তিনটি দৃশ্যের কথা আমি উল্লেখ করবই। ১) শক থেরাপির দৃশ্যে নেপথ্যে বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনী ..২) ফাঁকা মাঠে নীলকন্ঠর " ঘরছাড়া " ছবির শিশুশিল্পীর সঙ্গে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত নীলকন্ঠর কথোপকথন। ৩) " তিতাস একটি নদীর নাম " এবং "অযান্ত্রিক " ছবির দৃশ্য ছুঁয়ে এসে শৈশবের ভবা ( নীলকন্ঠ ) তার মা কে খুঁজে পায় "সুবর্ণরেখা" র চরে। তিনটে ভিন্ন দৃশ্য মাখামাখি এক হয়ে জেগে থাকে। আহা ! কমলেশ্বর , আপনার হাতের আঙুলে পরপর চুমু।আপনার মাথার ভেতরে পরপর চুমু।এবং নীলকন্ঠর এই অতীত রোমন্থিত ফ্ল্যাশব্যাকের নেপথ্যে এক ডাক্তারকে ( আবীর অসম্ভব সুন্দর ) এনে হাজির করা। যেন রোগের গভীরে গিয়ে চিরন্তন চিকিত্সক বুঝতে চাইছে এ আসলে রোগ নয় , এ ওষুধ। এ আসলে আত্মবিস্মৃত বাঙালীর মুখে জ্বলে ওঠা মশালের লেলিহান। ফুলমনীর নাচের প্রথম পা। ছিন্নমূল মানুষের ছিনিয়ে নেওয়ার গানকে প্রায় নিজের শরীরের অঙ্গ বানিয়ে নেওয়া একজন মানুষের লড়াই তথাকথিত লোকরঞ্জিত শিল্পের বিরুদ্ধে। কবিতা , গল্প , নাটক , সিনেমা এবং সিনেমার থেকে ভালো গণমাধ্যম পেলে সিনেমাকেও লাঠি মেরেন বেরিয়ে যাওয়ার সংকল্পের পেছনে যে লড়াই , দৃঢ়তা ফুটে ওঠে , তাতে বারংবার বৃদ্ধ বেহালাবাদকের তার কেটে গেলেও নীলকন্ঠ দমেন না। ঋত্বিক দমেছিলেন ? কী ? "বাইনসোৎ " বাঙালী ? দমেছিলেন ? আজ লোকটার মৃত্যুর পর তাকে মাথায় তুলে নাচো ? একের পর এক ছবিতে উপেক্ষা আর দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহ উপহার দিয়ে সেই সময়ে কি দিয়েছিলে ঋত্বিককে ? বোঝোনি তো , ঋত্বিক আসলে আজন্ম রোমান্টিক একজন মানুষ , যিনি তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে এই বাংলার মানুষ , প্রকৃতি এবং এই ভারতের হাজার বছরের বঞ্চনা শাসন শোষণ প্রতিবাদের দর্শনের ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে আদতে সেই অলৌকিক "দুগ্গা" রই সন্ধান করে বেরিয়েছেন , যা তাঁর মতে মানুষের শৃঙ্খল ছিন্ন করার প্রধান উপাদান। একের পর এক ছবি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের স্বীকার হয়েও তবু তিনি দমে যান নি। আর দমে যান নি বলেই আজ সারা বিশ্বের ফিল্মের ইতিহাসে ঋত্বিক ঘটক এক পোক্ত স্তম্ভ বিশেষ। " দর্শক ফ্লপ করেছে। আমার ছবি ফ্লপ করে নি "..না ঋত্বিক , আপনি ফ্লপ করতেই পারেন না ...সৎ শিল্প কখনও ফ্লপ করে না - এই ছবির মুখ্য চরিত্র শাশ্বতর অভিনয় নিয়ে আমি একটি কথাই বলবো। ভদ্রলোকের জীবনের সম্ভবত সেরা অভিনয় হয়ে থাকলো এটি। চলাফেরা , কথা বলা , চোখের চাহনি - কী অসম্ভব পরিণত চরিত্রায়ণই না করলেন শাশ্বত ! নীলকন্ঠ হয়ে ওঠা হলো এখানে। জীবনে ভুলবো না সিনেমার রিল মাথায় নিয়ে ক্লান্ত মদ্যপ নীলকন্ঠের ঘুমদৃশ্য আর ভোরের নেপথ্যে আকাশবাণীর সুর ! সেলাম কমলেশ্বর। সেলাম আপনাকে।সুরমা ঘটক (এখানে দুগ্গা )-এর চরিত্রে অনন্যা , বিজন ভট্টাচার্যর ( এখানে বিক্রম দা ) চরিত্রে শুভাশিস অসামান্য। আবীর যথাযথ , সুন্দর। প্রত্যেকটা শিল্পীই এখানে সেরা কাজটি করেছেন। ফলে এটি সিনেমার থেকেও একধাপ এগিয়ে যাওয়া " একটা কিছু "হয়েছে। এই ছবির দৃশ্যভাবনা আন্তর্জাতিক মানের। গানের ব্যবহার , ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল , এডিটিং প্রত্যেকটি ছোট বড় জিনিস নিখুঁত। শেষ দৃশ্যটা ভাবুন ! " যুক্তি তক্কো আর গপ্পো " র বঙ্গবালার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন নীলকন্ঠ। পর্দা ক্রমশ রঙীন হয়ে উঠছে। ফুটে উঠেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অংশ -"তুমি গেছো। স্পর্ধা গেছে। বিনয় এসেছে।" এভাবেই তো এই বাংলার শেকড়ের গভীরে , আরো গভীরে রওনা দিয়েছেন ঋত্বিক - সব ভেঙেচুরে সব উপড়ে ক্রমশ আরো গভীরে - আর , আমার মতে এই ছবিতে কমলেশ্বরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব , আধুনিক বাঙালীর গলায় হাতুড়ির বাড়ি মেরে এই সত্যটি গিলিয়ে দেওয়া যে আইনক্সে ৫০০ টাকা টিকিট কেটে , পপকর্ন নিয়ে , বান্ধবীর কোমরে হাত বুলিয়ে এমন একটা সিনেমা দেখে বাঙালী আহা উহু করছে আর চোখের জল ফেলছে (অনেকের তো আবার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে , ঋত্বিকের ছবি যেমন যেতো ) যে লোকটি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়তে লড়তে শেষ জীবনে দুর্বিষহ মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।এটাই চূড়ান্ত মোচড়। এটাই এ ছবির সার্থকতা।আবার টুপি খুললাম কমলেশ্বর। আর আপনি ঋত্বিক ? আপনার কাছে টুপি ছাড়া আর কি খোলার আছে ?বহু আগেই তো উলঙ্গ হয়ে গিয়েছি। আপনি তখনও ব্যর্থ হন নি ঋত্বিক। মানুষের লড়াই ব্যর্থ হয় না, আপনি জানতেন , কখনও হয় না - আপনি পুড়েছেন বলেই সিনেমাপিপাসু মানুষ এবং "বাইনসোৎ " বাঙালী , আমরা আলো পাচ্ছি। "সব পুড়ছে। ব্রহ্মান্ড পুড়ছে। আমি পুড়ছি। " ... শুধু প্রশ্ন , আমরা একটুও পুড়লাম কী ? নাকী "বাইনসোৎ " বাঙালীই থাকলাম ?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন