সাহিত্যসম্রাট ও তাঁর বঙ্গদর্শন – রবির আলোকে
অমিতাভ প্রামাণিক
বাংলাভাষায় সাহিত্যপত্রিকাগুলির বর্তমান অবস্থা একটু দূর থেকে অবলোকন করলে বেশ কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সাহিত্য তো জীবনেরই জলছবি। বাংলার সাম্প্রতিক সামাজিক অবক্ষয় অনেকটাই রাজনৈতিক দলাদলিপ্রসূত, সাহিত্যপত্রিকাগুলিও তার ঊর্ধে উঠতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ পত্রিকাই এখন কোনো দলীয় রাজনৈতিক মুখপত্রের বেশি কিছু নয়। সমস্যা আরো গভীর হয়, যখন শাক দিয়ে এই মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। তা পাঠককূলকে বিভ্রান্ত করে, যা এখন অহরহ ঘটে চলেছে। এর কুফল সাধারণতঃ হয় সুদূরপ্রসারী।
কী হচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি, হয়ত এর ফল সম্যক উপলব্ধি করতে পারছি না। এ সময় প্রয়োজন হয় ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা, তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো।
বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক সাহিত্যপত্রিকা বঙ্গদর্শন, সম্পাদক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের হাত ধরেই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের আসরে নতুন মর্যাদায় স্থাপিত হয়। বঙ্কিমের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে, নিজের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’তে এবং জীবদ্দশায় অনেকবার বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম ও বঙ্গদর্শনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ, বিভিন্ন প্রবন্ধে তা প্রকাশিত। বঙ্কিম-রবীন্দ্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কিছু টুকরো-টাকরা – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের চোখে – তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
বয়সে তেইশ বছরের বড় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী যখন প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন নেহাৎই চার বছরের বালক। পরবর্তী চার বছরে কপালকুন্ডলা আর মৃণালিনী নামে আরও দুটি উপন্যাস লেখেন বঙ্কিম। তিনটে উপন্যাসই বাঙালি পাঠকসমাজে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
কর্মসূত্রে এরপর বহরমপুরে বদলি হন বঙ্কিম। সেখানে তখন তারকাদের ছড়াছড়ি। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ তাবড় নামজাদা সাহিত্যিকরা তখন পূর্ণ মহিমায়। এদের সান্নিধ্যে এসে বঙ্কিম বাংলায় একটা নতুন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেন। ১২৭৯ সালের প্রথম মাস থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা, বঙ্গদর্শন। বাংলা সাহিত্যে তা এক নবজাগরণের সূচনা করে প্রকৃত অর্থেই।
বঙ্গদর্শন প্রকাশের কারণ হিসাবে পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি লেখেন – সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ। আমরা এই পত্রকে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর পাঠোপযোগী করিতে যত্ন করিব। ... এই আমাদিগের প্রথম উদ্দেশ্য।
সাহিত্যসম্রাটের এই প্রথম উদ্দেশ্য পাঠকসমাজে কেমন গৃহীত হয়েছিল, তার উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথের আত্মকথা ‘জীবনস্মৃতি’তে – অবশেষে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় লুঠ করিয়া লইল। একে তো তাহার জন্য মাসান্তের প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম, তাহার পরে বড়োদলের পড়ার শেষের জন্য অপেক্ষা করা আরও বেশি দুঃসহ হইত। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর এখন যে-খুশি সেই অনায়াসে একেবারে একগ্রাসে পড়িয়া ফেলিতে পারে কিন্তু আমরা যেমন করিয়া মাসের পর মাস কামনা করিয়া, অপেক্ষা করিয়া, অল্পকালের পড়াকে সুদীর্ঘকালের অবকাশের দ্বারা মনের মধ্যে অনুরণিত করিয়া, তৃপ্তির সঙ্গে অতৃপ্তি, ভোগের সঙ্গে কৌতূহলকে অনেকদিন ধরিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া পড়িতে পাইয়াছি, তেমন করিয়া পড়িবার সুযোগ আর কেহ পাইবে না।
বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি বদলে গেল লহমায়। বঙ্গদর্শনের আগে কী ছিল আর বঙ্গদর্শন প্রকাশ পাবার পর কী হল, তার বিশ্লেষণে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেইসব বালক-ভুলানো কথা – কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।
বঙ্গভাষার বাল্যকাল ব্যাপারটাও রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন অতি সুন্দরভাবে। বঙ্কিম-যুগ শুরু হওয়ার আগে বাংলাভাষার বিন্দুমাত্র গৌরব ছিল না। সংস্কৃত পন্ডিতেরা বাংলাকে গ্রাম্য আর ইংরেজরা বর্বর বলে ভাবত। বাংলাভাষায় কিছু সে সাহিত্য রচনা সম্ভব, লিখে যে কোন কীর্তি অর্জন করা যায়, তা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। বাংলাভাষায় লেখা বই মানে ছিল দয়া করে বাড়ির বৌ আর বাচ্চাদের জন্যে সরল পাঠ্যপুস্তক, তা না ছিল সরল, না পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।
এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।
জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে এক ছাত্রসম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিমশ্রদ্ধা ও সেইসঙ্গে বঙ্গদর্শনের ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পায় এই ভাষায় - যেমন কাব্যসোহিত্যে মধুসূদন তেমনি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের পথমুক্তির আদিতে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন বরণীয় ব্যক্তি। ... তাঁর চিত্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিল প্রধানভাবে ইংরেজি শিক্ষায়। ... যেমন দূর গিরিশিখরের জলপ্রপাত যখন শৈলবক্ষ ছেড়ে প্রবাহিত হয় জনস্থানের মধ্য দিয়ে তখন দুইতীরবর্তী ক্ষেত্রগুলিকে ফলবান্ ক'রে তোলে তাদের নিজেরই ভূমি-উদ্ভিন্ন ফলশস্যে, তেমনি নূতন শিক্ষাকে বঙ্কিমচন্দ্র ফলবান্ ক'রে তুলেছেন নিজেরই ভাষাপ্রকৃতির স্বকীয় দানের দ্বারা। তার আাগে বাংলাভাষায় গদ্যপ্রবন্ধ ছিল ইস্কুলে পোড়োদের উপদেশের বাহন। ... কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি শিক্ষার পরিণত শক্তিতেই রূপ দিতে প্রবৃত্ত হলেন বাংলাভাষায় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রে। বস্তুত নবযুগপ্রবর্তক প্রতিভাবানের সাধনায় ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম বাংলাদেশেই য়ুরোপীয় সংস্কৃতির ফসল ভাবী কালের প্রত্যাশা নিয়ে দেখা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে আনীত পণ্য আকারে নয়, স্বদেশের ভূমিতে উৎপন্ন শস্যসম্পদের মতো।
প্রসঙ্গতঃ বঙ্কিম মাত্র চারবছর পত্রিকাটা টানতে পেরেছিলেন। ১২৮২ সালে বন্ধ হয়ে যাবার পর মেজোভাই সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে বছর পাঁচেক অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গদর্শন। তার পর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় এর প্রকাশ হয় গোটা চারেক সংখ্যা। ১২৯০ সালে তাও বন্ধ হয়ে যাবার দীর্ঘ আঠারো বছর পর আবার নব পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গদর্শন, সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বঙ্গদর্শন প্রথম প্রকাশের সময় রবি বারো বছরের কিশোর, সদ্য কবিতা লিখতে ও দাদাদের আনুকূল্যে এদিক ওদিক ছাপাতে শুরু করেছেন। মেঘনাদবধ কাব্য পড়া হয়ে গেছে, কুমারসম্ভব-অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ পড়ছেন, পড়ছেন ম্যাকবেথ। সে সময় পত্রপত্রিকায় সমস্ত লেখা লেখকের নাম দিয়ে ছাপা হত না। বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘ভারতভূমি’ বা পরের বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্বাদশবর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘অভিলাষ’ কবিতাদুটির প্রথম বা দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে অনুমান। অবশ্য যখন বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়, অনেকের মতে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ঘনিষ্টতার ফলস্বরূপ, তখন রবির বয়স বারো।
বঙ্কিমের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় চতুর্দশ বর্ষের কিছু পরে, সেই সময়ের কলকাতার সমস্ত কলেজ-দ্বারা আয়োজিত রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে, ১২৮২ সালের সরস্বতী পূজার দিন। রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন, উক্ত সময়ের পরবর্তীকাল পর্যন্ত তাঁর কলেজের বেতন চুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কলেজে অনুপস্থিতির কারণে তিনি তখন প্রাক্তন ছাত্র! অবশ্য পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকাই বেশি। তিনি সেই অনুষ্ঠানে জ্যোতিদাদার সরোজিনী নাটক থেকে কয়েকটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল তাঁর নিজের লেখা – জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ দ্বিগুণ। প্রথম দর্শন ও সেই প্রসঙ্গে বঙ্কিমের চরিত্রের শিষ্টতা ও পরিশীলতার উদাহরণ দিতে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই রকম - বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ...সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। ... প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।
সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।
বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।
শিষ্টতা ও রুচিশীলতা সমাজের মান্যগণ্য মানুষের কাছে তো বটেই, সাহিত্যিকেরও এক অবশ্যম্ভাবী গুণ হওয়া উচিত, কেননা সাহিত্যিকের পাঠক-পাঠিকাগণ তাঁদের জীবন-যাপন ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে অনেক সময়েই প্রভেদ করেন না। রবীন্দ্রনাথ আজীবন এই ধারা মেনে চলেছেন, বহু সময় অকারণ আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়েও তাঁর স্থৈর্য ও সংযমের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয়নি। বস্তুত বাংলাসাহিত্যে রুচিশীলতা আমদানির ক্রেডিটও তিনি বঙ্কিমকেই দিয়েছেন - ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।
‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামে এক পত্রিকায় কিশোর রবির বনফুল নামের কাব্য-উপন্যাস ও প্রলাপ নামে কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হচ্ছিল নিয়মিতভাবে। মাত্র সাড়ে পনের বছর বয়সে তিনি সেই পত্রিকায় অন্যের লেখা কাব্যপুস্তকের সমালোচনা প্রকাশ করেন, যার নাম ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী। তিনটি বইয়ের রচয়িতা যথাক্রমে ভুবনমোহিনী দেবী (ছদ্মনামও হতে পারে), রাজকৃষ্ণ রায় ও হরিশ্চন্দ্র নিয়োগী। এই সমালোচনা বঙ্গদর্শনে নিয়মিত প্রকাশিত বঙ্কিমের গ্রন্থ-সমালোচনার ধাঁচে। তখন দু-রকম রীতিতে গ্রন্থ সমালোচনা করা হত – সংক্ষিপ্ত সমালোচনা, অর্থাৎ সমালোচকের বাহুল্যবর্জিত মতামত এবং দীর্ঘ সমালোচনা যাতে বইটার আলোচ্য বিষয়ের বর্ণনার পর সমালোচকের নিজস্ব বিশ্লেষণ দেওয়া হত। এই প্রথম প্রয়াসে তিনি বঙ্কিমের মতই দ্বিতীয় ধারায় মহাকাব্য, খন্ডকাব্য, গীতিকাব্য ইত্যাদির সাধারণ আলোচনা করে পরে তার গভীরে প্রবেশ করেছেন, একজন সাহিত্য উপদেষ্টা যেমন লেখকের আসন থেকে উঁচুতে বসে লেখককে উপদেশ দেন, সেই ভঙ্গিতে। নিজেই পরে লিখেছেন – খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম ... খন্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম।
বাংলা ভাষায় সাহিত্য-বিষয়ক যতগুলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়, তার আদর্শস্বরূপ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন। সমকালীন ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা তত্ত্ববোধিনী ছিল মূলতঃ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র, সুতরাং ধর্মীয় ও সামাজিক রচনার স্থান, যদিও এতেও সাহিত্যচর্চা কম হত না। বালক রবির অনেক রচনা এতে ছাপা হয়েছে। বঙ্গদর্শন অনুসরণে পরবর্তীতে প্রকাশ পায় আর্য্যদর্শন, বান্ধব, জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, ভ্রমর। চারবছর নিয়মিত প্রকাশের পর বঙ্গদর্শন বন্ধ হওয়ার কিছু সময় পর অনিয়মিত অবস্থায় সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করলেও তার পূর্বগৌরব ফিরে পায় নি। বাকি পত্রিকাগুলোর হালও একই রকম। প্রতিবিম্ব প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই জ্ঞানাঙ্কুরের সঙ্গে মিলে যায়, তাও শেষরক্ষা হয়নি। আর্য্যদর্শন, ভ্রমর – এদের অবস্থাও তথৈবচ।
বঙ্গদর্শনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে ১২৮৪ সালের শ্রাবণমাসে আত্মপ্রকাশ করে ভারতী, ঠাকুরবাড়ি থেকে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রাথমিক সম্পাদনায়। যদিও এই দুজন মূলতঃ ঐ কাজটুকুই করেছিলেন, অর্থাৎ শুরু করা, নামকরণ করা ও সম্পাদক হিসাবে নাম লেখানো। শুরুতে এর মূল কর্ণধার ছিলেন রবীন্দ্রনাথই, লেখা জোগাড় করা থেকে শুরু করে পত্রিকার যাবতীয় কাজ। কিছু কিছু সংখ্যায় তাঁর নিজের লেখা ছিল পত্রিকার অর্ধেকেরও বেশি। ভারতী পত্রিকা চলেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে, যার মধ্যে কাগজে কলমে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক ছিলেন মাত্র এক বছর। দ্বিজেন্দ্রনাথের পর তাঁর বোন স্বর্ণকুমারী এবং ভাগ্নী সরলা বহুকাল এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। রবীন্দ্রপ্রতিভা উন্মেষে ভারতী-র গুরুত্ব অপরিসীম।
মাত্র ষোল বছর বয়সে ভারতী-র প্রথম দুটি সংখ্যায় ‘ভিখারিণী’ গল্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যের সূত্রপাত। এই গল্পটিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে মূলতঃ কবি বলে পরিচিত করলেও তাঁর কবিতার স্বকীয়তা আসতে সময় লেগেছিল। তাঁর জন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এই ছাঁদ রবিকে প্রভাবিত করেনি একেবারেই। তিনি বিহারীলালের রচনায় শুরুতে বেশ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সে কথা স্বীকার করেও গেছেন। বিহারীলাল শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন - আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে "বাল্মীকি-প্রতিভা' নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া "বিদ্বজনসমাগম"- নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের "সারদামঙ্গলে'র আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত। অবশ্য এই আদর্শ নিজস্ব পথ প্রশস্ত করার পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল না। নতুন বিষয় চয়ন, নতুনভাবে তাদের প্রকাশ ইত্যাদি ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর পথ তাঁকে নিজেই খুঁজে নিতে হয়েছিল। কিন্তু গদ্যের ব্যাপারে, বিশেষ করে কাহিনী চিত্রণে, চরিত্র সৃষ্টিতে অনেকের লেখাই তাঁর গদ্যরচনার দ্রুত পরিণতি প্রদানে সাহায্য করেছিল। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অকুণ্ঠ, রমেশচন্দ্র দত্তের উপন্যাস বা দীনবন্ধু মিত্রের নাটক তাঁর গদ্যরচনায় সহায়ক হয়েছিল নিঃসন্দেহে, তবে এই তালিকায় অবিসংবাদিতভাবে শীর্ষে ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথের লেখা বাল্মীকি প্রতিভা অভিনীত হয়েছিল বিদ্বজ্জন সভা নামে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠেয় বার্ষিক সভায়, যেখানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নিমন্ত্রিত হতেন। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম মঞ্চে অভিনয়, তখন তাঁর বয়স কুড়ি। লিখেছিলেন – তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া এই বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনয় হইল। তাহাতে আমি বাল্মীকই সাজিয়াছিলাম (এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল), রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্রথম অবতরণ। দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন, তিনি এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়া তৃপ্তিপ্রকাশ করিয়াছিলেন।
ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতিই বছর এগারোই মাঘ অনুষ্ঠিত হত অপৌত্তলিক ব্রাহ্মদের বার্ষিক মাঘোৎসব। জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা লিখেছেন – একবার একটা ১১ই মাঘের উৎসবে বাড়ির ছেলেমেয়ে গায়নমন্ডলী আমরা গান গাইতে গাইতে হঠাৎ অনুভব করলুম আমাদের পিছনে একটা নাড়াচাড়া সাড়াশব্দ পড়ে গেছে। কে এসেছেন? পিছন ফিরে ভিড়ের ভিতর হঠাৎ একটা চেহারা চোখে পড়ল – দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি, মুখময় একটা সহাস্য জ্যোতির্ময়তা। জানলুম তিনি বঙ্কিম। যে বঙ্কিম এতদিন তাঁর রচনামূর্তিতে আমাকে পেয়ে বসেছিলেন আজ পেলুম তাঁকে প্রকৃতির তুলিতে হাড়েমাসে রঞ্জনা মূর্তিতে। রবীন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার লেখনীতেও একই উচ্ছ্বাস – ছোট বেলায় আমি রবিকার সঙ্গে তাঁর সভায় এবং অন্যান্য জায়গায় চলে যেতুম। মনে আছে বঙ্কিমবাবুর বাড়িতেও গিয়েছিলুম। তাঁর তীক্ষ্ণ নাক ও চাপা ঠোঁটের চেহারা এখনও একটু একটু মনে আনতে পারি। তাঁর উপন্যাস তখন টাটকা টাটকা খোলা থেকে সবে নাব্ছে, আর মেয়েরা নতুন নতুন বই পড়বার জন্য আঁকুবাঁকু করছে। তিনি জোড়াসাঁকো বাড়ি আসবেন শুনে বর্ণপিসিমা ওঁদের সে কী আগ্রহ! আর খড়খড়ে তুলে উঁকিঝুঁকি মেরে তাঁকে দেখবার সে কী উৎসাহ!
এ থেকে বোঝা যায়, এমনকি সাহিত্যজগতেও সুদর্শন পুরুষদের অতিরিক্ত আবেদন ছিল। অবশ্য এ থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত ছিলেন না উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথও।
এরপর বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হন। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন - অনেকবার তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইয়াছে কিন্তু উপলক্ষ ঘটে নাই। অবশেষে একবার, যখন হাওড়ায় তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন সেখানে তাঁহার বাসায় সাহস করিয়া দেখা করিতে গিয়াছিলাম। দেখা হইল, যথাসাধ্য আলাপ করিবারও চেষ্টা করিলাম, কিন্তু ফিরিয়া আসিবার সময়ে মনের মধ্যে যেন একটা লজ্জা লইয়া ফিরিলাম। অর্থাৎ, আমি যে নিতান্তই অর্বাচীন, সেইটে অনুভব করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমন করিয়া বিনা আহ্বানে তাঁহার কাছে আসিয়া ভালো করি নাই।
এই লেখাতেই রবীন্দ্রনাথের কবি হিসাবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর বর্ণনা অসামান্য - তাহার পরে বয়সে আরো কিছু বড়ো হইয়াছি; সে-সময়কার লেখকদলের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ বলিয়া একটা আসন পাইয়াছি - কিন্তু সে-আসনটা কিরূপ ও কোন্খানে পড়িবে তাহা ঠিকমত স্থির হইতেছিল না; ক্রমে ক্রমে যে একটু খ্যাতি পাইতেছিলাম তাহার মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা ও অনেকটা পরিমাণে অবজ্ঞা জড়িত হইয়া ছিল; তখনকার দিনে আমাদের লেখকদের একটা করিয়া বিলাতি ডাকনাম ছিল, কেহ ছিলেন বাংলার বায়রন, কেহ এমার্সন, কেহ আর-কিছু; আমাকে তখন কেহ কেহ শেলি বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন - সেটা শেলির পক্ষে অপমান এবং আমার পক্ষে উপহাসস্বরূপ ছিল; তখন আমি কলভাষার কবি বলিয়া উপাধি পাইয়াছি; তখন বিদ্যাও ছিল না, জীবনের অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প, তাই গদ্য পদ্য যাহা লিখিতাম তাহার মধ্যে বস্তু যেটুকু ছিল ভাবুকতা ছিল তাহার চেয়ে বেশি, সুতরাং তাহাকে ভালো বলিতে গেলেও জোর দিয়া প্রশংসা করা যাইত না। তখন আমার বেশভূষা ব্যবহারেও সেই অর্ধস্ফুটতার পরিচয় যথেষ্ট ছিল; চুল ছিল বড়ো বড়ো এবং ভাবগতিকেও কবিত্বের একটা তুরীয় রকমের শৌখিনতা প্রকাশ পাইত; অত্যন্তই খাপছাড়া হইয়াছিলাম, বেশ সহজ মানুষের প্রশস্ত প্রচলিত আচার-আচরণের মধ্যে গিয়া পৌঁছিয়া সকলের সঙ্গে সুসংগত হইয়া উঠিতে পারি নাই।
অবশ্য বঙ্কিমের সাক্ষাৎ পাওয়ার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এ বিষয়ে লিখেছেন - বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রচার বাহির হইতেছে। আমিও তখন প্রচার-এ একটি গান ও কোনো বৈষ্ণব-পদ অবলম্বন করিয়া একটি গদ্য-ভাবোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়াছি।
এই সময়ে কিংবা ইহারই কিছু পূর্ব হইতে আমি বঙ্কিমবাবুর কাছে আবার একবার সাহস করিয়া যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিয়াছি, তখন তিনি ভবানীচরণ দত্তর স্ট্রীটে বাস করিতেন। বঙ্কিমবাবুর কাছে যাইতাম বটে কিন্তু বেশিকিছু কথাবার্তা হইত না। আমার তখন শুনিবার বয়স, কথা বলিবার বয়স নহে। ইচ্ছা করিত আলাপ জমিয়া উঠুক, কিন্তু সংকোচে কথা সরিত না। এক-একদিন দেখিতাম সঞ্জীববাবু তাকিয়া অধিকার করিয়া গড়াইতেছেন। তাঁহাকে দেখিলে বড়ো খুশি হইতাম। তিনি আলাপী লোক ছিলেন। গল্প করায় তাঁহার আনন্দ ছিল এবং তাঁহার মুখে গল্প শুনিতেও আনন্দ হইত। যাঁহারা তাঁহার প্রবন্ধ পড়িয়াছেন তাঁহারা নিশ্চয় লক্ষ্য করিয়াছেন যে, সে-লেখাগুলি কথা-কহার অজস্র আনন্দবেগেই লিখিত – ছাপার অক্ষরে আসর জমাইয়া যাওয়া; এই ক্ষমতাটি অতি অল্প লোকেরই আছে, তাহার পরে সেই মুখে বলার ক্ষমতাটিকে লেখার মধ্যেও তেমনি অবাধে প্রকাশ করিবার শক্তি আরো কম লোকের দেখিতে পাওয়া যায়।
১২৮০ সালের পৌষ বঙ্গদর্শন সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র এক প্রবন্ধ লেখেন জয়দেব ও বিদ্যাপতির কবিপ্রকৃতির লক্ষণ বিচার করে। তাঁর মত অনুযায়ী জয়দেব ভোগ ও সুখের কবি এবং বিদ্যাপতি দুঃখের কবি। এঁদের দুই ভিন্নশ্রেণীর গীতিকবি আখ্যা দিয়ে তিনি লেখেন – যাহা জয়দেব সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা ভারতচন্দ্র সম্বন্ধে বর্তে, যাহা বিদ্যাপতি সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা গোবিন্দদাস-চন্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের সম্বন্ধে তদ্রূপই বর্তে। এই প্রবন্ধের কিয়দংশ বিদ্যাপতি ও জয়দেব শিরোনামে ১২৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিবিধ সমালোচনা গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। কিন্তু ১২৯৪ সালে এই প্রবন্ধটিই যখন বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম ভাগ-এ মুদ্রিত হয়, তখন দেখা যায় বঙ্কিম তাঁর পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। ডঃ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তাঁর বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় রবীন্দ্রের প্রভাব প্রবন্ধে এই ঘটনার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন কুড়ি বছর বয়সে তরুণ রবির লেখা চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি শীর্ষক প্রবন্ধটিকে। চন্ডীদাসের প্রেমভাবনা ও তৎপ্রসঙ্গে বিদ্যাপতির কাব্যবিচার শুধুমাত্র প্রবীণ বঙ্কিমকেই প্রভাবিত করেনি, আজ পর্যন্ত এদের কাব্যের তুলনা বিশ বছর বয়সী রবির প্রদর্শিত পথেই অগ্রসর হয়েছে।
একুশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যাসঙ্গীত কাব্যগ্রন্থ। সেই বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা কমলার সঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুর বিবাহে নিমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ পাত্রীপক্ষের বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে উপস্থিত হতেই কঠোর বিস্ময়ের সম্মুখীন হন। এ প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতির বর্ণনা - সন্ধ্যাসংগীতের জন্ম হইলে পর সূতিকাগৃহে উচ্চস্বরে শাঁখ বাজে নাই বটে কিন্তু তাই বলিয়া কেহ যে তাহাকে আদর করিয়া লয় নাই, তাহা নহে। ... রমেশ দত্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহসভার দ্বারের কাছে বঙ্কিমবাবু দাঁড়াইয়া ছিলেন; রমেশবাবু বঙ্কিমবাবুর গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম। বঙ্কিমবাবু তাড়াতাড়ি সে মালা আমার গলায় দিয়া বলিলেন,"এ মালা ইঁহারই প্রাপ্য - রমেশ,তুমি সন্ধ্যাসংগীত পড়িয়াছ?" তিনি বলিলেন,"না"। তখন বঙ্কিমবাবু সন্ধ্যাসংগীতের কোনো কবিতা সম্বন্ধে যে-মত ব্যক্ত করিলেন তাহাতে আমি পুরস্কৃত হইয়াছিলাম। অন্যত্র এই ঘটনা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – একদিন আমার প্রথম বয়সে কোনো নিমন্ত্রণসভায় তিনি নিজকণ্ঠ হইতে আমাকে পুষ্পমাল্য পরাইয়াছিলেন, সেই আমার জীবনের সাহিত্যচর্চার প্রথম গৌরবের দিন।
অনুজ সাহিত্যিককে এইভাবে বরণ করে নেওয়া বঙ্কিমচরিত্রের এক উজ্জ্বল দিক।
একইভাবে অগ্রজ, সমসাময়িক এবং অনুজ – সকলের প্রতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রবীন্দ্রচরিত্রেরও এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি তাঁর প্রভূত শ্রদ্ধা ছিল তো বটেই, যদিও সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁদের মতপার্থক্য যে একেবারে হয়নি, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - আমি তখন আমার কোণ ছাড়িয়া আসিয়া পড়িতেছিলাম, আমার তখনকার এই আন্দোলনকালের লেখাগুলিতে তাহার পরিচয় আছে। তাহার কতক বা ব্যঙ্গকাব্যে, কতক বা কৌতুকনাট্যে, কতক বা তখনকার সঞ্জীবনী কাগজে পত্রআকারে বাহির হইয়াছিল। ভাবাবেশের কুহক কাটাইয়া তখন মল্লভূমিতে আসিয়া তাল ঠুকিতে আরম্ভ করিয়াছি।
সেই লড়ায়ের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্কিমবাবুর সঙ্গেও আমার একটা বিরোধের সৃষ্টি হইয়াছিল। তখনকার ভারতী ও প্রচার-এ তাহার ইতিহাস রহিয়াছে। ... এই বিরোধের অবসানে বঙ্কিমবাবু আমাকে যে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন আমার দুর্ভাগ্যক্রমে তাহা হারাইয়া গিয়াছে। যদি থাকিত তবে পাঠকেরা দেখিতে পাইতেন, বঙ্কিমবাবু কেমন সম্পূর্ণ ক্ষমার সহিত এই বিরোধের কাঁটাটুকু উৎপাটন করিয়া ফেলিয়াছিলেন।
এই বিতর্কের সূত্রপাত বঙ্কিমচন্দ্রের এক প্রবন্ধের উত্তরে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ একটি পুরাতন কথা, বিষয়বস্তু হিন্দু-ব্রাহ্ম বৈষম্য। এর উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন আর একটি প্রবন্ধ, "আদি ব্রাহ্মসমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়'। সেখানে তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য ভুল বুঝে অকারণ সমালোচনা করেছেন। চাপান-উতোর চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন - বঙ্কিমবাবু বলেন, "রবীন্দ্রবাবু "সত্য" এবং "মিথ্যা" এই দুইটি শব্দ ইংরাজি অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। সেই অর্থেই আমার ব্যবহৃত "সত্য" "মিথ্যা" বুঝিয়াছেন। তাঁহার কাছে সত্য Truth মিথ্যা Falsehood। আমি সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহারকালে ইংরেজির অনুবাদ করি নাই..."সত্য" "মিথ্যা" প্রাচীনকাল হইতে যে অর্থে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, আমি সেই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। সে দেশী অর্থে, সত্য Truth, আর তাহা ছাড়া আরও কিছু। প্রতিজ্ঞা রক্ষা, আপনার কথা রক্ষা, ইহাও সত্য।'
বঙ্কিমবাবু যে অর্থে মনে করিয়া সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা এখন বুঝিলাম। কিন্তু প্রচারের প্রথম সংখ্যার হিন্দুধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধে যে কথাগুলি ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে এই অর্থ বুঝিবার কোনো সম্ভাবনা নাই, আমার সামান্য বুদ্ধিতে এইরূপ মনে হয়। তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করি। "যদি মিথ্যা কহেন, তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।'
প্রথমে দেখিতে হইবে সংস্কৃতে সত্য মিথ্যার অর্থ কী। একটা প্রয়োগ না দেখিলে ইহা স্পষ্ট হইবে না। মনুতে আছে - সত্যং ব্রুয়াৎ, প্রিয়ং ব্রুয়াৎ ন ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্। প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রুয়াৎ, এষ ধর্মঃ সনাতনঃ। অর্থাৎ - সত্য বলিবে, প্রিয় বলিবে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলিবে না, প্রিয় মিথ্যাও বলিবে না, ইহাই সনাতন ধর্ম। এখানে সত্য বলিতে কেবলমাত্র সত্য কথাই বুঝাইতেছে, তৎসঙ্গে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝাইতেছে না। যদি প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝাইত তবে প্রিয় ও অপ্রিয় শব্দের সার্থকতা থাকিত না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, এখানে মনু সত্য শব্দে Truth ছাড়া "আরও কিছু'-কে ধরেন নাই ... সত্য শব্দের মূল ধাতু ধরিয়াই দেখি আর ব্যবহার ধরিয়াই দেখি - দেখা যায়, সত্য অর্থে সাধারণত Truth বুঝায় ও কেবল স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায়। অতএব যেখানে সত্যের সংকীর্ণ ও বিশেষ অর্থের আবশ্যক সেখানে বিশেষ ব্যাখ্যারও আবশ্যক।
দ্বিতীয়ত - সত্য বলিতে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝায় না। সত্য পালন বা সত্য রক্ষা বলিতে প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝায় - কেবলমাত্র সত্য শব্দে বুঝায় না।
তৃতীয়ত – বঙ্কিমবাবু ‘সত্য' শব্দের উল্লেখ করেন নাই, তিনি ‘মিথ্যা' শব্দই ব্যবহার করিয়াছেন। সত্য শব্দে সংস্কৃতে স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায় বটে - কিন্তু মিথ্যা শব্দে তদ্বিপরীত অর্থ সংস্কৃত ভাষায় বোধ করি প্রচলিত নাই - আমার এইরূপ বিশ্বাস।
বঙ্কিমচন্দ্র ক্ষোভের সঙ্গে আরও লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমালোচনায় তাঁকে বিস্তর গালিগালাজ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন - ... শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। ... তাঁহাকে গালি দিবার কথা আমার মনেও আসিতে পারে না। তিনি আমার গুরুজন তুল্য, তিনি আমা অপেক্ষা কিসে না বড়ো! আমি তাঁহাকে ভক্তি করি, আর কেই বা না করে। তাঁহার প্রথম সন্তান দুর্গেশনন্দিনী বোধ করি আমা অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠা। আমার যে এতদূর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল যে তাঁহাকে অমান্য করিয়াছি কেবলমাত্র অমান্য নহে তাঁহাকে গালি দিয়াছি তাহা সম্ভব নহে। ক্ষুব্ধ-হৃদয়ে অনেক কথা বলিয়াছি, কিন্তু গালিগালাজ হইতে অনেক দূরে আছি। মেছোহাটার তো কথাই নাই আঁষ্টে গন্ধটুকু পর্যন্ত নাই। ... হৃদয় হইতে উৎসারিত না হইলে সে কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইত না, যিনি বিশ্বাস করেন করুন, না করেন নাই করুন।
বঙ্কিমবাবুর প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ভক্তি আছে তিনি তাহা জানেন। যদি তরুণ বয়সের চপলতাবশত বিচলিত হইয়া তাঁহাকে কোনো অন্যায় কথা বলিয়া থাকি তবে তিনি তাঁহার বয়সের ও প্রতিভার উদারতাগুণে সে সমস্ত মার্জনা করিয়া এখনও আমাকে তাঁহার স্নেহের পাত্র বলিয়া মনে রাখিবেন। আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি সরলভাবে যে-সকল কথা বলিয়াছি, আমাকে ভুল বুঝিয়া তাহার অন্য ভাব গ্রহণ না করেন।
এই তর্কের নিরপেক্ষ বিচার করেছেন রবীন্দ্র-ভাগিনেয়ী সরলা। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথের প্রতিপাদ্য এই যে, মিথ্যা কোন অবস্থাতেই কথনীয় নয়। এ বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রকারকৃত ব্যতিক্রম বিধিগুলি তিনি সমর্থন করেন না, বঙ্কিম করেন – এই প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে শাস্ত্রকারদের ও বঙ্কিমের পক্ষাবলম্বী হলেন, তাঁরা বক্তৃতাসভায় যোগদান করলেন না। কিন্তু ছোটরা তাঁর হীরো-ওয়ারশীপার হল।
... রবীন্দ্রের বক্তৃতা তৎকালীন ভারতীতে বেরিয়েছিল (সে সময় স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এর সম্পাদিকা), বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনা সংগ্রহে সেইটি নিশ্চয় সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু বঙ্কিমকে বাঙালীর মনে চিরজাগরূক রাখবার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাঁর যে শুধু ঔপন্যাসিক প্রতিভা ছিল না, সংস্কারের ও ভাবের গতানুগতিকতায় বাহিত না হয়ে বুদ্ধির প্রখর বিচারশীলতায় তিনি যে কত বড় আধুনিক, রবীন্দ্রের গুরু ও মার্গদর্শী তিনিই যে, সে কথা এই পুরুষের বাঙালীরা জানেনা। সত্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রের আনকম্প্রোমাইজিং আপোষশূন্য মনোভাবের অভিব্যক্তিতে সেদিন আমরা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হলুম। সত্যভক্তি আমাদের মনে ক্ষোদিত করে দেওয়া হল। শিশুদের পক্ষে এইটেই দরকার।
... বড় হয়ে যখন বিচার বুদ্ধি খানিকটা উদ্বুদ্ধ হল, তখন বঙ্কিমকে পড়ে দেখে অনুভব করলুম, বঙ্কিমের প্রতি সুবিচার করিনি আমরা, সেদিন মাতুল-ভক্তিতে অযথা বঙ্কিম-মতদ্বেষী হয়ে পড়েছিলুম।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর অবস্থান থেকে কখনোই সরে আসেন নি। অকৃত্রিম সত্যপ্রিয়তা রবীন্দ্র-চরিত্রের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট, এর সূক্ষ্ম স্বরূপ বোঝা সহজ নয়। ‘ভালো-মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’ তিনি শুধু লিখেই যাননি, জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় তার নিদর্শন রেখেছেন, সে সত্য অপ্রিয় হলেও। তাঁর প্রতি অযথা আক্রমণে তিনি বিচলিত হননি – সজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালের অত্যাচার সহ্য করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চরিত্রহননে উদ্যত হননি একবারও। বস্তুত ব্যক্তিকে নয়, বক্তব্যের বিরোধিতাই তাঁর বহু প্রবন্ধের উপজীব্য। আর প্রিয়জনের মৃত্যু অপেক্ষা অপ্রিয়তর সত্য মানবজীবনে কী আছে? সারা জীবন সেই সত্যের সম্মুখীন হয়েছেন অসম্ভব দৃঢ়তায়, কোত্থেকে সেই শক্তি পেতেন তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সত্যভাবনা এক পৃথক আলোচনার বস্তু, এর জন্য তাঁকে তাঁর সমকালীন ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মত ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ বা ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয় নি।
বাদ-প্রতিবাদের বৎসরাধিক কাল পরে রবীন্দ্রনাথ আবার একই বিষয়ে দামু ও চামু, বানরের শ্রেষ্ঠত্ব, হেঁয়ালি নাট্য ইত্যাদি প্রবন্ধ রচনা করেন ও সত্য শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন। প্রবন্ধগুলি তাঁর সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। আগের সমালোচনাটিও ব্যাপকভাবে পুনর্মুদ্রিত হয় বালক, সঞ্জীবনী, তত্ত্ববোধিনী ও তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায়।
বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ পরেও লিখেছিলেন - বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্রন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য তাঁহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথের মতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘পাশ্চাত্য মুর্খ' অর্থাৎ ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের ওপর অজস্র অবজ্ঞা বর্ষণ করেছেন, যা তাঁর মতে গর্হিত এবং কৃষ্ণচরিত্রের মত গ্রন্থে অশোভন। বঙ্কিম যাঁকে মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, সেই কৃষ্ণ একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সকারণে অস্ত্র ধারণ করতেও অনেক সময়েই বিরত হয়েছেন, তাঁরই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা আদর্শের অবমাননা। শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনায় অকারণে ইওরোপীয়দের ওপর খোঁচা দেওয়ায় বইটার মূল উদ্দেশ্যটা পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। কেননা কৃষ্ণচরিত্রের মত বই কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য না লিখে সর্বকালের সর্বজাতির জন্যই লেখা হওয়া উচিত।
বঙ্কিম লিখেছেন - হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কিনা, মেমসাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না-হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মতো কিচিরমিচির করি। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন - ক্ষণে ক্ষণে লেখকের এরূপ ধৈর্যচ্যুতি "কৃষ্ণচরিত্রে'র ন্যায় গ্রন্থে অতিশয় অযোগ্য হইয়াছে। গ্রন্থের ভাষায় ভাবে ও ভঙ্গিতে সর্বত্রই একটি গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য ও ঔদার্য রক্ষা না করাতে বর্ণনীয় আদর্শচরিত্রের উজ্জ্বলতা নষ্ট হইয়াছে। ...বঙ্কিম সামান্য উপলক্ষমাত্রেই য়ুরোপীয়দের সহিত, পাঠকদের সহিত এবং ভাগ্যহীন ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিত কলহ করিয়াছেন। ... বঙ্কিম নানা স্থলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের আদর্শ যেমন কার্যকারী এমন দেবতার আদর্শ নহে। কারণ, সর্বশক্তিমানের অনুকরণে আমাদের সহজেই উৎসাহ না হইতে পারে। যারা মানুষে সাধন করিয়াছে তাহা আমরাও সাধন করিতে পারি এই বিশ্বাস এবং আশা অপেক্ষাকৃত সুলভ এবং স্বাভাবিক। অতএব কৃষ্ণকে দেবতা প্রমাণ করিতে গিয়া বঙ্কিম তাঁহার মানব-আদর্শের মূল্য হ্রাস করিয়া দিতেছেন। কারণ, ঈশ্বরের পক্ষে সকলই যখন অনায়াসে সম্ভব তখন কৃষ্ণচরিত্রে বিশেষরূপে বিস্ময় অনুভব করিবার কোনো কারণ দেখা যায় না। বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই।
১২৯৮ সালে প্রকাশিত হয় হিতবাদী পত্রিকা। সেখানে সম্পাদক কী কেমনভাবে লিখতে হবে এই জাতীয় ফরমায়েসি লেখা চাইলে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাধনা। তাঁর সাহিত্যসাধনায় এই সাধনা পর্ব (১২৯৮-১৩০২) এক স্বর্ণযুগ। সম্পাদনা ও সাহিত্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের সাধনা-র যুগ অনেকের মতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন যুগের (১২৭৯-১২৮২) সঙ্গে তুলনীয়।
হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও ব্রাহ্ম-উদারতা সেই সময়ের সমাজ ও সাহিত্যের অন্যতম চর্চার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু-ব্রাহ্ম বলতেন। বঙ্কিমের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁর শিষ্যকূল ও আর্য-ধ্বজাধারী নব্য হিন্দুসমাজের পৃষ্ঠপোষক চন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, শশধর তর্কচূড়ামণি প্রভূতদের উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছিলেন –
কোথা গেল সেই প্রভাতের গান, কোথা গেল সেই আশা?
আজিকে বন্ধু তোমাদের মুখে এ কেমনতর ভাষা?
তোমরা আনিয়া প্রাণের প্রবাহ ভেঙেছ মাটির আল
তোমরা আবার আনিছ বঙ্গে উজান স্রোতের কাল।
১২৯৮ সালে উড়িষ্যায় বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কটক ও পুরীতে দুই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। কটকের ডিস্ট্রিক্ট জজ কবিবন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। দেশে তখন জুরিপ্রথা ও তাতে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের ওপর ইংরেজের বিধিনিষেধের ওপর প্রবল আন্দোলন হচ্ছে। সেই বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রিত ওখানকার র্যাভেনশ’ কলেজের অধ্যক্ষ হলোয়ার্ড তাদের সামনেই বলেন, এ দেশের মরাল স্ট্যান্ডার্ড লো, এখানকার লোকেদের লাইফের স্যাক্রেডনেস সম্বন্ধে যথেষ্ট বিশ্বাস নেই, এরা জুরি হবার যোগ্য নয়। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লেখেন - আমার যে কী রকম করছিল সে তোকে কী বলব ... একজন বাঙালির নিমন্ত্রণে এসে বাঙালির মধ্যে বসে যারা এ রকম করে বলতে কুণ্ঠিত হয় না তারা আমাদের কী চক্ষে দেখে! ... তোমাদের উচ্ছিষ্ট তোমাদের আদরের টুকরোর জন্যে আমার তিলমাত্র প্রত্যাশা নেই, আমি তাকে পদাঘাত করি। ... যারা ফিটফাট কাপড় পরে ডগকার্ট হাঁকায় আর আমাদের নিগার বলে, তারা যতই সভ্য ও উন্নত হোক, আমি যদি কখনো তাদের সংশ্রবের জন্যে লালায়িত হই, তবে আমার মাথায় যেন জুতো পড়ে।
কিছুদিন পর পুরীতে বিহারীবাবুর অনুরোধে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ওয়ালসের বাড়িতে গেলে চাপরাশি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে পরদিন আসতে বলে। বিরক্ত ও অপমানিত হয়ে ফিরে এলেও পরদিন বন্ধুর সম্মানে সেখানে যান তিনি। কিন্তু মনে মনে ইংরেজ শাসনের ও ভারতীয়দের ওপর তাদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ মনের মধ্যে জেগে ওঠে প্রবলভাবে।
এর দেড় বছর পরে তিনি লেখেন পর পর প্রবন্ধ – অপমানের প্রতিকার, রাজা ও প্রজা, ইংরেজ ও ভারতবাসী। লেখেন ব্যঙ্গরচনা পয়সার লাঞ্ছনা। ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৮৬১ সালে যে ভারত কাউন্সিল অ্যাক্ট চালু হয়েছিল, ১৮৯২ সালে তা সংশোধিত হয়, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকদের দাবিদাওয়া পূরণের বদলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারানীতি চালু করা হল। সরকারী চাকরিতে ভারতীয়দের প্রবেশের দরজা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ হল। দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় এমন করা হল যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তাতে প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা। এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধটি। কলকাতায় এক সভায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সভাপতিত্বে তা পাঠ করার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়ি গিয়ে প্রবন্ধটি পড়ে শুনিয়ে তাঁর সম্মতি নিয়ে আসেন। বারো বছর আগে বিডন স্ট্রীটে রমেশচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বঙ্কিমের জন্য প্রস্তুত মালা তিনি পরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গলায়। বিডন স্ট্রীটের এই সভাতেই দুই দিকপালের শেষ সাক্ষাৎ ঘটল।
বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস রাজসিংহ রচিত হয়েছিল ১৩০০ সালে, বহুমূত্র রোগে তিনি তখন খুবই পীড়িত। চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বইটির সমালোচনা করুক। সেই মর্মে শ্রীশচন্দ্রের হাত দিয়ে বইটি পাঠিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নতুন আঙ্গিকে বইটির সমালোচনা প্রকাশ করেন ভারতীতে, সমালোচনাও যে সাহিত্য হতে পারে, তার এক অপরূপ নিদর্শন ছিল সেটি। অত্যুৎকৃষ্ট এই সমালোচনা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়, তিনি সম্ভবত সেটি দেখে যেতে পারেন নি।
বঙ্কিমপ্রসঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। জীবনসায়াহ্নে সাহিত্যের রূপ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি প্রকাশ করেছেন সাহিত্যের অগ্রগতির পিছনে সাহিত্যিকদের অবদানের ভূমিকার গুরুত্ব ও সেই প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের অবদান। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, আনন্দমঠ ইত্যাদি যুগান্তকারী উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টি প্রসঙ্গে লিখেছেন - তিনি গল্পসাহিত্যের এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিলেন। ... তাঁর পূর্বেকার গল্পসাহিত্যের ছিল মুখোশ-পরা রূপ, তিনি সেই মুখোশ ঘুচিয়ে দিয়ে গল্পের একটি সজীব মুখশ্রীর অবতারণা করলেন। হোমার, বর্জিল, মিল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে মাইকেল তাঁর সাধনার পথে উৎসাহ পেয়েছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্রও কথাসাহিত্যের রূপের আদর্শ পাশ্চাত্য লেখকদের কাছ থেকে নিয়েছেন। কিন্তু, এঁরা অনুকরণ করেছিলেন বললে জিনিসটাকে সংকীর্ণ করে বলা হয়। সাহিত্যের কোনো-একটি প্রাণবান রূপে মুগ্ধ হয়ে সেই রূপটিকে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন; সেই রূপটিকে নিজের ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনায় তাঁরা সৃষ্টিকর্তার আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দে তাঁরা বন্ধন ছিন্ন করেছেন, বাধা অতিক্রম করেছেন। এক দিক থেকে এটা অনুকরণ, আর-এক দিক থেকে এটা আত্মীকরণ। ... বঙ্কিম এমন একটি সাহিত্যরূপে আনন্দ পেয়েছিলেন, এবং সেই রূপকে আপন ভাষায় গ্রহণ করলেন, যার মধ্যে সর্বজনীন আনন্দের সত্য ছিল। বাংলাভাষায় কথাসাহিত্যের এই রূপের প্রবর্তনে বঙ্কিমচন্দ্র অগ্রণী। রূপের এই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তারই পূজা চালালেন তিনি বাংলাসাহিত্যে। তার কারণ, তিনি এই রূপের রসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ নয় যে, গল্পের কোনো একটি থিওরি প্রচার করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। "বিষবৃক্ষ' নামের দ্বারাই মনে হতে পারে যে, ঐ গল্প লেখার আনুষঙ্গিকভাবে একটা সামাজিক মতলব তাঁর মাথায় এসেছিল। কুন্দনন্দিনী সূর্যমুখীকে নিয়ে যে-একটা উৎপাতের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা গৃহধর্মের পক্ষে ভালো নয়, এই অতি জীর্ণ কথাটাকে প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য রচনাকালে সত্যই যে তাঁর মনে ছিল, এ আমি বিশ্বাস করি নে - ওটা হঠাৎ পুনশ্চনিবেদন; বস্তুত তিনি রূপমুগ্ধ রূপদ্রষ্টা রূপশ্রষ্টা রূপেই বিষবৃক্ষ লিখেছিলেন।
নবযুগের কোনো সাহিত্যনায়ক যদি এসে থাকেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করব, সাহিত্যে তিনি কোন্ নবরূপের অবতারণা করেছেন। …
বঙ্কিমের উপন্যাসে চন্দ্রশেখরের অসামান্য পাণ্ডিত্য; সেইটি অপর্যাপ্তভাবে প্রমাণ করবার জন্যে বঙ্কিম তার মুখে ষড়্দর্শনের আস্ত আস্ত তর্ক বসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, পাঠক বলত, আমি পাণ্ডিত্যের নিশ্চিত প্রমাণ চাই নে, আমি চন্দ্রশেখরের সমগ্র ব্যক্তিরূপটি স্পষ্ট করে দেখতে চাই। সেই রূপটি প্রকাশ পেয়ে ওঠে ভাষায় ভঙ্গিতে আভাসে, ঘটনাবলীর নিপুণ নির্বাচনে, বলা এবং না-বলার অপরূপ ছন্দে। সেইখানেই বঙ্কিম হলেন কারিগর, সেইখানে চন্দ্রশেখর-চরিত্রের বিষয়গত উপাদান নিয়ে রূপস্রষ্টার ইন্দ্রজাল আপন সৃষ্টির কাজ করে। আনন্দমঠে সত্যানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসীরা সাহিত্যে দেশাত্মবোধের নবযুগ অবতারণ করেছেন কি না তা নিয়ে সাহিত্যের তরফে আমরা প্রশ্ন করব না; আমাদের প্রশ্ন এই যে, তাঁদের নিয়ে সাহিত্যে নিঃসংশয় সুপ্রত্যক্ষ কোনো একটি চারিত্ররূপ জাগ্রত করা হল কি না। পূর্বযুগের সাহিত্যেই হোক, নবযুগের সাহিত্যেই হোক, চিরকালের প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে : হে গুণী, কোন্ অপূর্ব রূপটি তুমি সকল কালের জন্যে সৃষ্টি করলে।
এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠের এ এক অনুপম শ্রদ্ধার্ঘ তাঁর অগ্রজ আর এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠ-র প্রতি।
সাহিত্যবিষয়ে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে এই আলোচনার ইতি টানতে চাই আপাতত। রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সঙ্গীতশিক্ষা করেছিলেন সেই সময়ের নামী শিক্ষক যদুভট্টের কাছে। মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিমলগ্নে রাজদরবারের শিল্পীরা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের জন্য দিল্লী ছেড়ে ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যান, যদুভট্ট তাদের ঘরানারই উত্তরসূরী। তানসেন-বংশীয় ধ্রুপদ-গায়ক বাহাদুর খাঁ আশ্রয় নিয়েছিলেন বিষ্ণুপুর রাজসভায়। তাঁর এক শিষ্য রামশঙ্করের শিষ্য যদুভট্ট, তাঁর জন্ম বিষ্ণুপুরেই। ত্রিপুরার রাজদরবারে তিনি অনেককাল ধ্রুপদ গাইতেন। বঙ্কিমচন্দ্রও যদুভট্টের কাছে কিছুদিন গান শিখেছিলেন। সেসময় তিনি কিছুকাল বঙ্কিমচন্দ্রের বাসস্থান নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় তাঁর বোনের বাড়িতে ছিলেন। যদুভট্টই প্রথম মল্লার রাগে বঙ্কিমের বন্দেমাতরম্ গানে সুর দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন ১২৮৮ সালে চুঁচুড়ায় বঙ্কিমের এক সম্বর্ধনা সভায়। এ আর রহমানের হাতে কিছু-মতে-উজ্জীবিত, কিছু-মতে-ধর্ষিত হওয়ার আগে বহু নামী সঙ্গীতজ্ঞ বন্দেমাতরম্-এ সুর দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। ১২৯২ সালে ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা ঠাকুরবাড়ি প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার ‘গান অভ্যাস’ অংশে রবীন্দ্রনাথের দেশ-কাওয়ালির সুরে এর প্রথম স্তবকটির স্বরলিপি প্রকাশ করেন। ন্যাশন্যাল সং-এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই গানটি রবীন্দ্রনাথ প্রথম গেয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ বার্ষিক সম্মেলনে, বঙ্গভঙ্গের আগে এর গ্রামাফোন রেকর্ডও বের করেন তিনি। ছোটমামার স্নেহধন্যা সরলা লিখেছেন – বন্দেমাতরম্-এর প্রথম দুটি পদে সুর দিয়েছিলেন নিজে। তখনকার দিনে শুধু সেই দুটি পদই গাওয়া হত। একদিন আমার উপর ভার দিলেন – বাকী কথাগুলোতে তুই সুর বসা। তাই ত্রিংশকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদকরালে থেকে শেষ পর্যন্ত কথায় প্রথমাংশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমি সুর দিলুম। তিনি শুনে খুশী হলেন। সমস্ত গানটা তখন থেকে চালু হল। সরলার এই স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০০ সালের ভারতী পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়।
ভারতের ন্যাশন্যাল অ্যান্থেম ও ন্যাশন্যাল সং – দুটিরই রচয়িতা ও সুরকার বঙ্গসন্তান। বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণে এই দুই দিকপাল বঙ্গসন্তানের সাহিত্য সৃষ্টি এক অমর অধ্যায় হয়ে আছে। অথচ কী লজ্জাকর পরিস্থিতি আজ, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা এখন এক হাস্যকর স্থানে। জনচেতনার উন্মেষে সাহিত্য ও সাহিত্যপত্রিকাগুলির ভূমিকা আজ কুরুচিকর অন্তর্কলহে গুরুত্ব হারিয়েছে।
মুখের সামনে আয়না ধরলে এই জটাজাল থেকে বেরোনোর যে রাস্তা বাঙালী দেখতে পেত, তার নাম বঙ্গদর্শন!
বাংলাভাষায় সাহিত্যপত্রিকাগুলির বর্তমান অবস্থা একটু দূর থেকে অবলোকন করলে বেশ কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সাহিত্য তো জীবনেরই জলছবি। বাংলার সাম্প্রতিক সামাজিক অবক্ষয় অনেকটাই রাজনৈতিক দলাদলিপ্রসূত, সাহিত্যপত্রিকাগুলিও তার ঊর্ধে উঠতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ পত্রিকাই এখন কোনো দলীয় রাজনৈতিক মুখপত্রের বেশি কিছু নয়। সমস্যা আরো গভীর হয়, যখন শাক দিয়ে এই মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। তা পাঠককূলকে বিভ্রান্ত করে, যা এখন অহরহ ঘটে চলেছে। এর কুফল সাধারণতঃ হয় সুদূরপ্রসারী।
কী হচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি, হয়ত এর ফল সম্যক উপলব্ধি করতে পারছি না। এ সময় প্রয়োজন হয় ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা, তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো।
বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক সাহিত্যপত্রিকা বঙ্গদর্শন, সম্পাদক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের হাত ধরেই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের আসরে নতুন মর্যাদায় স্থাপিত হয়। বঙ্কিমের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে, নিজের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’তে এবং জীবদ্দশায় অনেকবার বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম ও বঙ্গদর্শনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ, বিভিন্ন প্রবন্ধে তা প্রকাশিত। বঙ্কিম-রবীন্দ্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কিছু টুকরো-টাকরা – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের চোখে – তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
বয়সে তেইশ বছরের বড় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী যখন প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন নেহাৎই চার বছরের বালক। পরবর্তী চার বছরে কপালকুন্ডলা আর মৃণালিনী নামে আরও দুটি উপন্যাস লেখেন বঙ্কিম। তিনটে উপন্যাসই বাঙালি পাঠকসমাজে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
কর্মসূত্রে এরপর বহরমপুরে বদলি হন বঙ্কিম। সেখানে তখন তারকাদের ছড়াছড়ি। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ তাবড় নামজাদা সাহিত্যিকরা তখন পূর্ণ মহিমায়। এদের সান্নিধ্যে এসে বঙ্কিম বাংলায় একটা নতুন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেন। ১২৭৯ সালের প্রথম মাস থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা, বঙ্গদর্শন। বাংলা সাহিত্যে তা এক নবজাগরণের সূচনা করে প্রকৃত অর্থেই।
বঙ্গদর্শন প্রকাশের কারণ হিসাবে পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি লেখেন – সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ। আমরা এই পত্রকে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর পাঠোপযোগী করিতে যত্ন করিব। ... এই আমাদিগের প্রথম উদ্দেশ্য।
সাহিত্যসম্রাটের এই প্রথম উদ্দেশ্য পাঠকসমাজে কেমন গৃহীত হয়েছিল, তার উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথের আত্মকথা ‘জীবনস্মৃতি’তে – অবশেষে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় লুঠ করিয়া লইল। একে তো তাহার জন্য মাসান্তের প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম, তাহার পরে বড়োদলের পড়ার শেষের জন্য অপেক্ষা করা আরও বেশি দুঃসহ হইত। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর এখন যে-খুশি সেই অনায়াসে একেবারে একগ্রাসে পড়িয়া ফেলিতে পারে কিন্তু আমরা যেমন করিয়া মাসের পর মাস কামনা করিয়া, অপেক্ষা করিয়া, অল্পকালের পড়াকে সুদীর্ঘকালের অবকাশের দ্বারা মনের মধ্যে অনুরণিত করিয়া, তৃপ্তির সঙ্গে অতৃপ্তি, ভোগের সঙ্গে কৌতূহলকে অনেকদিন ধরিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া পড়িতে পাইয়াছি, তেমন করিয়া পড়িবার সুযোগ আর কেহ পাইবে না।
বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি বদলে গেল লহমায়। বঙ্গদর্শনের আগে কী ছিল আর বঙ্গদর্শন প্রকাশ পাবার পর কী হল, তার বিশ্লেষণে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেইসব বালক-ভুলানো কথা – কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।
বঙ্গভাষার বাল্যকাল ব্যাপারটাও রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন অতি সুন্দরভাবে। বঙ্কিম-যুগ শুরু হওয়ার আগে বাংলাভাষার বিন্দুমাত্র গৌরব ছিল না। সংস্কৃত পন্ডিতেরা বাংলাকে গ্রাম্য আর ইংরেজরা বর্বর বলে ভাবত। বাংলাভাষায় কিছু সে সাহিত্য রচনা সম্ভব, লিখে যে কোন কীর্তি অর্জন করা যায়, তা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। বাংলাভাষায় লেখা বই মানে ছিল দয়া করে বাড়ির বৌ আর বাচ্চাদের জন্যে সরল পাঠ্যপুস্তক, তা না ছিল সরল, না পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।
এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।
জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে এক ছাত্রসম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিমশ্রদ্ধা ও সেইসঙ্গে বঙ্গদর্শনের ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পায় এই ভাষায় - যেমন কাব্যসোহিত্যে মধুসূদন তেমনি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের পথমুক্তির আদিতে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন বরণীয় ব্যক্তি। ... তাঁর চিত্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিল প্রধানভাবে ইংরেজি শিক্ষায়। ... যেমন দূর গিরিশিখরের জলপ্রপাত যখন শৈলবক্ষ ছেড়ে প্রবাহিত হয় জনস্থানের মধ্য দিয়ে তখন দুইতীরবর্তী ক্ষেত্রগুলিকে ফলবান্ ক'রে তোলে তাদের নিজেরই ভূমি-উদ্ভিন্ন ফলশস্যে, তেমনি নূতন শিক্ষাকে বঙ্কিমচন্দ্র ফলবান্ ক'রে তুলেছেন নিজেরই ভাষাপ্রকৃতির স্বকীয় দানের দ্বারা। তার আাগে বাংলাভাষায় গদ্যপ্রবন্ধ ছিল ইস্কুলে পোড়োদের উপদেশের বাহন। ... কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি শিক্ষার পরিণত শক্তিতেই রূপ দিতে প্রবৃত্ত হলেন বাংলাভাষায় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রে। বস্তুত নবযুগপ্রবর্তক প্রতিভাবানের সাধনায় ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম বাংলাদেশেই য়ুরোপীয় সংস্কৃতির ফসল ভাবী কালের প্রত্যাশা নিয়ে দেখা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে আনীত পণ্য আকারে নয়, স্বদেশের ভূমিতে উৎপন্ন শস্যসম্পদের মতো।
প্রসঙ্গতঃ বঙ্কিম মাত্র চারবছর পত্রিকাটা টানতে পেরেছিলেন। ১২৮২ সালে বন্ধ হয়ে যাবার পর মেজোভাই সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে বছর পাঁচেক অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গদর্শন। তার পর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় এর প্রকাশ হয় গোটা চারেক সংখ্যা। ১২৯০ সালে তাও বন্ধ হয়ে যাবার দীর্ঘ আঠারো বছর পর আবার নব পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গদর্শন, সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বঙ্গদর্শন প্রথম প্রকাশের সময় রবি বারো বছরের কিশোর, সদ্য কবিতা লিখতে ও দাদাদের আনুকূল্যে এদিক ওদিক ছাপাতে শুরু করেছেন। মেঘনাদবধ কাব্য পড়া হয়ে গেছে, কুমারসম্ভব-অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ পড়ছেন, পড়ছেন ম্যাকবেথ। সে সময় পত্রপত্রিকায় সমস্ত লেখা লেখকের নাম দিয়ে ছাপা হত না। বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘ভারতভূমি’ বা পরের বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্বাদশবর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘অভিলাষ’ কবিতাদুটির প্রথম বা দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে অনুমান। অবশ্য যখন বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়, অনেকের মতে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ঘনিষ্টতার ফলস্বরূপ, তখন রবির বয়স বারো।
বঙ্কিমের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় চতুর্দশ বর্ষের কিছু পরে, সেই সময়ের কলকাতার সমস্ত কলেজ-দ্বারা আয়োজিত রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে, ১২৮২ সালের সরস্বতী পূজার দিন। রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন, উক্ত সময়ের পরবর্তীকাল পর্যন্ত তাঁর কলেজের বেতন চুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কলেজে অনুপস্থিতির কারণে তিনি তখন প্রাক্তন ছাত্র! অবশ্য পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকাই বেশি। তিনি সেই অনুষ্ঠানে জ্যোতিদাদার সরোজিনী নাটক থেকে কয়েকটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল তাঁর নিজের লেখা – জ্বল্ জ্বল্ চিতা! দ্বিগুণ দ্বিগুণ। প্রথম দর্শন ও সেই প্রসঙ্গে বঙ্কিমের চরিত্রের শিষ্টতা ও পরিশীলতার উদাহরণ দিতে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই রকম - বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ...সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। ... প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।
সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।
বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।
শিষ্টতা ও রুচিশীলতা সমাজের মান্যগণ্য মানুষের কাছে তো বটেই, সাহিত্যিকেরও এক অবশ্যম্ভাবী গুণ হওয়া উচিত, কেননা সাহিত্যিকের পাঠক-পাঠিকাগণ তাঁদের জীবন-যাপন ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে অনেক সময়েই প্রভেদ করেন না। রবীন্দ্রনাথ আজীবন এই ধারা মেনে চলেছেন, বহু সময় অকারণ আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়েও তাঁর স্থৈর্য ও সংযমের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয়নি। বস্তুত বাংলাসাহিত্যে রুচিশীলতা আমদানির ক্রেডিটও তিনি বঙ্কিমকেই দিয়েছেন - ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।
‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামে এক পত্রিকায় কিশোর রবির বনফুল নামের কাব্য-উপন্যাস ও প্রলাপ নামে কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হচ্ছিল নিয়মিতভাবে। মাত্র সাড়ে পনের বছর বয়সে তিনি সেই পত্রিকায় অন্যের লেখা কাব্যপুস্তকের সমালোচনা প্রকাশ করেন, যার নাম ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী। তিনটি বইয়ের রচয়িতা যথাক্রমে ভুবনমোহিনী দেবী (ছদ্মনামও হতে পারে), রাজকৃষ্ণ রায় ও হরিশ্চন্দ্র নিয়োগী। এই সমালোচনা বঙ্গদর্শনে নিয়মিত প্রকাশিত বঙ্কিমের গ্রন্থ-সমালোচনার ধাঁচে। তখন দু-রকম রীতিতে গ্রন্থ সমালোচনা করা হত – সংক্ষিপ্ত সমালোচনা, অর্থাৎ সমালোচকের বাহুল্যবর্জিত মতামত এবং দীর্ঘ সমালোচনা যাতে বইটার আলোচ্য বিষয়ের বর্ণনার পর সমালোচকের নিজস্ব বিশ্লেষণ দেওয়া হত। এই প্রথম প্রয়াসে তিনি বঙ্কিমের মতই দ্বিতীয় ধারায় মহাকাব্য, খন্ডকাব্য, গীতিকাব্য ইত্যাদির সাধারণ আলোচনা করে পরে তার গভীরে প্রবেশ করেছেন, একজন সাহিত্য উপদেষ্টা যেমন লেখকের আসন থেকে উঁচুতে বসে লেখককে উপদেশ দেন, সেই ভঙ্গিতে। নিজেই পরে লিখেছেন – খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম ... খন্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম।
বাংলা ভাষায় সাহিত্য-বিষয়ক যতগুলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়, তার আদর্শস্বরূপ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন। সমকালীন ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা তত্ত্ববোধিনী ছিল মূলতঃ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র, সুতরাং ধর্মীয় ও সামাজিক রচনার স্থান, যদিও এতেও সাহিত্যচর্চা কম হত না। বালক রবির অনেক রচনা এতে ছাপা হয়েছে। বঙ্গদর্শন অনুসরণে পরবর্তীতে প্রকাশ পায় আর্য্যদর্শন, বান্ধব, জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, ভ্রমর। চারবছর নিয়মিত প্রকাশের পর বঙ্গদর্শন বন্ধ হওয়ার কিছু সময় পর অনিয়মিত অবস্থায় সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করলেও তার পূর্বগৌরব ফিরে পায় নি। বাকি পত্রিকাগুলোর হালও একই রকম। প্রতিবিম্ব প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই জ্ঞানাঙ্কুরের সঙ্গে মিলে যায়, তাও শেষরক্ষা হয়নি। আর্য্যদর্শন, ভ্রমর – এদের অবস্থাও তথৈবচ।
বঙ্গদর্শনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে ১২৮৪ সালের শ্রাবণমাসে আত্মপ্রকাশ করে ভারতী, ঠাকুরবাড়ি থেকে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রাথমিক সম্পাদনায়। যদিও এই দুজন মূলতঃ ঐ কাজটুকুই করেছিলেন, অর্থাৎ শুরু করা, নামকরণ করা ও সম্পাদক হিসাবে নাম লেখানো। শুরুতে এর মূল কর্ণধার ছিলেন রবীন্দ্রনাথই, লেখা জোগাড় করা থেকে শুরু করে পত্রিকার যাবতীয় কাজ। কিছু কিছু সংখ্যায় তাঁর নিজের লেখা ছিল পত্রিকার অর্ধেকেরও বেশি। ভারতী পত্রিকা চলেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে, যার মধ্যে কাগজে কলমে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক ছিলেন মাত্র এক বছর। দ্বিজেন্দ্রনাথের পর তাঁর বোন স্বর্ণকুমারী এবং ভাগ্নী সরলা বহুকাল এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। রবীন্দ্রপ্রতিভা উন্মেষে ভারতী-র গুরুত্ব অপরিসীম।
মাত্র ষোল বছর বয়সে ভারতী-র প্রথম দুটি সংখ্যায় ‘ভিখারিণী’ গল্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যের সূত্রপাত। এই গল্পটিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে মূলতঃ কবি বলে পরিচিত করলেও তাঁর কবিতার স্বকীয়তা আসতে সময় লেগেছিল। তাঁর জন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এই ছাঁদ রবিকে প্রভাবিত করেনি একেবারেই। তিনি বিহারীলালের রচনায় শুরুতে বেশ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সে কথা স্বীকার করেও গেছেন। বিহারীলাল শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন - আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে "বাল্মীকি-প্রতিভা' নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া "বিদ্বজনসমাগম"- নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের "সারদামঙ্গলে'র আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত। অবশ্য এই আদর্শ নিজস্ব পথ প্রশস্ত করার পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল না। নতুন বিষয় চয়ন, নতুনভাবে তাদের প্রকাশ ইত্যাদি ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর পথ তাঁকে নিজেই খুঁজে নিতে হয়েছিল। কিন্তু গদ্যের ব্যাপারে, বিশেষ করে কাহিনী চিত্রণে, চরিত্র সৃষ্টিতে অনেকের লেখাই তাঁর গদ্যরচনার দ্রুত পরিণতি প্রদানে সাহায্য করেছিল। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অকুণ্ঠ, রমেশচন্দ্র দত্তের উপন্যাস বা দীনবন্ধু মিত্রের নাটক তাঁর গদ্যরচনায় সহায়ক হয়েছিল নিঃসন্দেহে, তবে এই তালিকায় অবিসংবাদিতভাবে শীর্ষে ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথের লেখা বাল্মীকি প্রতিভা অভিনীত হয়েছিল বিদ্বজ্জন সভা নামে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠেয় বার্ষিক সভায়, যেখানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নিমন্ত্রিত হতেন। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম মঞ্চে অভিনয়, তখন তাঁর বয়স কুড়ি। লিখেছিলেন – তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া এই বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনয় হইল। তাহাতে আমি বাল্মীকই সাজিয়াছিলাম (এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল), রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্রথম অবতরণ। দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন, তিনি এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়া তৃপ্তিপ্রকাশ করিয়াছিলেন।
ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতিই বছর এগারোই মাঘ অনুষ্ঠিত হত অপৌত্তলিক ব্রাহ্মদের বার্ষিক মাঘোৎসব। জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা লিখেছেন – একবার একটা ১১ই মাঘের উৎসবে বাড়ির ছেলেমেয়ে গায়নমন্ডলী আমরা গান গাইতে গাইতে হঠাৎ অনুভব করলুম আমাদের পিছনে একটা নাড়াচাড়া সাড়াশব্দ পড়ে গেছে। কে এসেছেন? পিছন ফিরে ভিড়ের ভিতর হঠাৎ একটা চেহারা চোখে পড়ল – দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি, মুখময় একটা সহাস্য জ্যোতির্ময়তা। জানলুম তিনি বঙ্কিম। যে বঙ্কিম এতদিন তাঁর রচনামূর্তিতে আমাকে পেয়ে বসেছিলেন আজ পেলুম তাঁকে প্রকৃতির তুলিতে হাড়েমাসে রঞ্জনা মূর্তিতে। রবীন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার লেখনীতেও একই উচ্ছ্বাস – ছোট বেলায় আমি রবিকার সঙ্গে তাঁর সভায় এবং অন্যান্য জায়গায় চলে যেতুম। মনে আছে বঙ্কিমবাবুর বাড়িতেও গিয়েছিলুম। তাঁর তীক্ষ্ণ নাক ও চাপা ঠোঁটের চেহারা এখনও একটু একটু মনে আনতে পারি। তাঁর উপন্যাস তখন টাটকা টাটকা খোলা থেকে সবে নাব্ছে, আর মেয়েরা নতুন নতুন বই পড়বার জন্য আঁকুবাঁকু করছে। তিনি জোড়াসাঁকো বাড়ি আসবেন শুনে বর্ণপিসিমা ওঁদের সে কী আগ্রহ! আর খড়খড়ে তুলে উঁকিঝুঁকি মেরে তাঁকে দেখবার সে কী উৎসাহ!
এ থেকে বোঝা যায়, এমনকি সাহিত্যজগতেও সুদর্শন পুরুষদের অতিরিক্ত আবেদন ছিল। অবশ্য এ থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত ছিলেন না উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথও।
এরপর বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হন। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন - অনেকবার তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইয়াছে কিন্তু উপলক্ষ ঘটে নাই। অবশেষে একবার, যখন হাওড়ায় তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন সেখানে তাঁহার বাসায় সাহস করিয়া দেখা করিতে গিয়াছিলাম। দেখা হইল, যথাসাধ্য আলাপ করিবারও চেষ্টা করিলাম, কিন্তু ফিরিয়া আসিবার সময়ে মনের মধ্যে যেন একটা লজ্জা লইয়া ফিরিলাম। অর্থাৎ, আমি যে নিতান্তই অর্বাচীন, সেইটে অনুভব করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমন করিয়া বিনা আহ্বানে তাঁহার কাছে আসিয়া ভালো করি নাই।
এই লেখাতেই রবীন্দ্রনাথের কবি হিসাবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর বর্ণনা অসামান্য - তাহার পরে বয়সে আরো কিছু বড়ো হইয়াছি; সে-সময়কার লেখকদলের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ বলিয়া একটা আসন পাইয়াছি - কিন্তু সে-আসনটা কিরূপ ও কোন্খানে পড়িবে তাহা ঠিকমত স্থির হইতেছিল না; ক্রমে ক্রমে যে একটু খ্যাতি পাইতেছিলাম তাহার মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা ও অনেকটা পরিমাণে অবজ্ঞা জড়িত হইয়া ছিল; তখনকার দিনে আমাদের লেখকদের একটা করিয়া বিলাতি ডাকনাম ছিল, কেহ ছিলেন বাংলার বায়রন, কেহ এমার্সন, কেহ আর-কিছু; আমাকে তখন কেহ কেহ শেলি বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন - সেটা শেলির পক্ষে অপমান এবং আমার পক্ষে উপহাসস্বরূপ ছিল; তখন আমি কলভাষার কবি বলিয়া উপাধি পাইয়াছি; তখন বিদ্যাও ছিল না, জীবনের অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প, তাই গদ্য পদ্য যাহা লিখিতাম তাহার মধ্যে বস্তু যেটুকু ছিল ভাবুকতা ছিল তাহার চেয়ে বেশি, সুতরাং তাহাকে ভালো বলিতে গেলেও জোর দিয়া প্রশংসা করা যাইত না। তখন আমার বেশভূষা ব্যবহারেও সেই অর্ধস্ফুটতার পরিচয় যথেষ্ট ছিল; চুল ছিল বড়ো বড়ো এবং ভাবগতিকেও কবিত্বের একটা তুরীয় রকমের শৌখিনতা প্রকাশ পাইত; অত্যন্তই খাপছাড়া হইয়াছিলাম, বেশ সহজ মানুষের প্রশস্ত প্রচলিত আচার-আচরণের মধ্যে গিয়া পৌঁছিয়া সকলের সঙ্গে সুসংগত হইয়া উঠিতে পারি নাই।
অবশ্য বঙ্কিমের সাক্ষাৎ পাওয়ার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এ বিষয়ে লিখেছেন - বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রচার বাহির হইতেছে। আমিও তখন প্রচার-এ একটি গান ও কোনো বৈষ্ণব-পদ অবলম্বন করিয়া একটি গদ্য-ভাবোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়াছি।
এই সময়ে কিংবা ইহারই কিছু পূর্ব হইতে আমি বঙ্কিমবাবুর কাছে আবার একবার সাহস করিয়া যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিয়াছি, তখন তিনি ভবানীচরণ দত্তর স্ট্রীটে বাস করিতেন। বঙ্কিমবাবুর কাছে যাইতাম বটে কিন্তু বেশিকিছু কথাবার্তা হইত না। আমার তখন শুনিবার বয়স, কথা বলিবার বয়স নহে। ইচ্ছা করিত আলাপ জমিয়া উঠুক, কিন্তু সংকোচে কথা সরিত না। এক-একদিন দেখিতাম সঞ্জীববাবু তাকিয়া অধিকার করিয়া গড়াইতেছেন। তাঁহাকে দেখিলে বড়ো খুশি হইতাম। তিনি আলাপী লোক ছিলেন। গল্প করায় তাঁহার আনন্দ ছিল এবং তাঁহার মুখে গল্প শুনিতেও আনন্দ হইত। যাঁহারা তাঁহার প্রবন্ধ পড়িয়াছেন তাঁহারা নিশ্চয় লক্ষ্য করিয়াছেন যে, সে-লেখাগুলি কথা-কহার অজস্র আনন্দবেগেই লিখিত – ছাপার অক্ষরে আসর জমাইয়া যাওয়া; এই ক্ষমতাটি অতি অল্প লোকেরই আছে, তাহার পরে সেই মুখে বলার ক্ষমতাটিকে লেখার মধ্যেও তেমনি অবাধে প্রকাশ করিবার শক্তি আরো কম লোকের দেখিতে পাওয়া যায়।
১২৮০ সালের পৌষ বঙ্গদর্শন সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র এক প্রবন্ধ লেখেন জয়দেব ও বিদ্যাপতির কবিপ্রকৃতির লক্ষণ বিচার করে। তাঁর মত অনুযায়ী জয়দেব ভোগ ও সুখের কবি এবং বিদ্যাপতি দুঃখের কবি। এঁদের দুই ভিন্নশ্রেণীর গীতিকবি আখ্যা দিয়ে তিনি লেখেন – যাহা জয়দেব সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা ভারতচন্দ্র সম্বন্ধে বর্তে, যাহা বিদ্যাপতি সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা গোবিন্দদাস-চন্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের সম্বন্ধে তদ্রূপই বর্তে। এই প্রবন্ধের কিয়দংশ বিদ্যাপতি ও জয়দেব শিরোনামে ১২৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিবিধ সমালোচনা গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। কিন্তু ১২৯৪ সালে এই প্রবন্ধটিই যখন বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম ভাগ-এ মুদ্রিত হয়, তখন দেখা যায় বঙ্কিম তাঁর পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। ডঃ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তাঁর বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় রবীন্দ্রের প্রভাব প্রবন্ধে এই ঘটনার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন কুড়ি বছর বয়সে তরুণ রবির লেখা চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি শীর্ষক প্রবন্ধটিকে। চন্ডীদাসের প্রেমভাবনা ও তৎপ্রসঙ্গে বিদ্যাপতির কাব্যবিচার শুধুমাত্র প্রবীণ বঙ্কিমকেই প্রভাবিত করেনি, আজ পর্যন্ত এদের কাব্যের তুলনা বিশ বছর বয়সী রবির প্রদর্শিত পথেই অগ্রসর হয়েছে।
একুশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যাসঙ্গীত কাব্যগ্রন্থ। সেই বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা কমলার সঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুর বিবাহে নিমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ পাত্রীপক্ষের বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে উপস্থিত হতেই কঠোর বিস্ময়ের সম্মুখীন হন। এ প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতির বর্ণনা - সন্ধ্যাসংগীতের জন্ম হইলে পর সূতিকাগৃহে উচ্চস্বরে শাঁখ বাজে নাই বটে কিন্তু তাই বলিয়া কেহ যে তাহাকে আদর করিয়া লয় নাই, তাহা নহে। ... রমেশ দত্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহসভার দ্বারের কাছে বঙ্কিমবাবু দাঁড়াইয়া ছিলেন; রমেশবাবু বঙ্কিমবাবুর গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম। বঙ্কিমবাবু তাড়াতাড়ি সে মালা আমার গলায় দিয়া বলিলেন,"এ মালা ইঁহারই প্রাপ্য - রমেশ,তুমি সন্ধ্যাসংগীত পড়িয়াছ?" তিনি বলিলেন,"না"। তখন বঙ্কিমবাবু সন্ধ্যাসংগীতের কোনো কবিতা সম্বন্ধে যে-মত ব্যক্ত করিলেন তাহাতে আমি পুরস্কৃত হইয়াছিলাম। অন্যত্র এই ঘটনা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – একদিন আমার প্রথম বয়সে কোনো নিমন্ত্রণসভায় তিনি নিজকণ্ঠ হইতে আমাকে পুষ্পমাল্য পরাইয়াছিলেন, সেই আমার জীবনের সাহিত্যচর্চার প্রথম গৌরবের দিন।
অনুজ সাহিত্যিককে এইভাবে বরণ করে নেওয়া বঙ্কিমচরিত্রের এক উজ্জ্বল দিক।
একইভাবে অগ্রজ, সমসাময়িক এবং অনুজ – সকলের প্রতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রবীন্দ্রচরিত্রেরও এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি তাঁর প্রভূত শ্রদ্ধা ছিল তো বটেই, যদিও সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁদের মতপার্থক্য যে একেবারে হয়নি, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - আমি তখন আমার কোণ ছাড়িয়া আসিয়া পড়িতেছিলাম, আমার তখনকার এই আন্দোলনকালের লেখাগুলিতে তাহার পরিচয় আছে। তাহার কতক বা ব্যঙ্গকাব্যে, কতক বা কৌতুকনাট্যে, কতক বা তখনকার সঞ্জীবনী কাগজে পত্রআকারে বাহির হইয়াছিল। ভাবাবেশের কুহক কাটাইয়া তখন মল্লভূমিতে আসিয়া তাল ঠুকিতে আরম্ভ করিয়াছি।
সেই লড়ায়ের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্কিমবাবুর সঙ্গেও আমার একটা বিরোধের সৃষ্টি হইয়াছিল। তখনকার ভারতী ও প্রচার-এ তাহার ইতিহাস রহিয়াছে। ... এই বিরোধের অবসানে বঙ্কিমবাবু আমাকে যে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন আমার দুর্ভাগ্যক্রমে তাহা হারাইয়া গিয়াছে। যদি থাকিত তবে পাঠকেরা দেখিতে পাইতেন, বঙ্কিমবাবু কেমন সম্পূর্ণ ক্ষমার সহিত এই বিরোধের কাঁটাটুকু উৎপাটন করিয়া ফেলিয়াছিলেন।
এই বিতর্কের সূত্রপাত বঙ্কিমচন্দ্রের এক প্রবন্ধের উত্তরে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ একটি পুরাতন কথা, বিষয়বস্তু হিন্দু-ব্রাহ্ম বৈষম্য। এর উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন আর একটি প্রবন্ধ, "আদি ব্রাহ্মসমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়'। সেখানে তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য ভুল বুঝে অকারণ সমালোচনা করেছেন। চাপান-উতোর চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন - বঙ্কিমবাবু বলেন, "রবীন্দ্রবাবু "সত্য" এবং "মিথ্যা" এই দুইটি শব্দ ইংরাজি অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। সেই অর্থেই আমার ব্যবহৃত "সত্য" "মিথ্যা" বুঝিয়াছেন। তাঁহার কাছে সত্য Truth মিথ্যা Falsehood। আমি সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহারকালে ইংরেজির অনুবাদ করি নাই..."সত্য" "মিথ্যা" প্রাচীনকাল হইতে যে অর্থে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, আমি সেই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। সে দেশী অর্থে, সত্য Truth, আর তাহা ছাড়া আরও কিছু। প্রতিজ্ঞা রক্ষা, আপনার কথা রক্ষা, ইহাও সত্য।'
বঙ্কিমবাবু যে অর্থে মনে করিয়া সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা এখন বুঝিলাম। কিন্তু প্রচারের প্রথম সংখ্যার হিন্দুধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধে যে কথাগুলি ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে এই অর্থ বুঝিবার কোনো সম্ভাবনা নাই, আমার সামান্য বুদ্ধিতে এইরূপ মনে হয়। তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করি। "যদি মিথ্যা কহেন, তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।'
প্রথমে দেখিতে হইবে সংস্কৃতে সত্য মিথ্যার অর্থ কী। একটা প্রয়োগ না দেখিলে ইহা স্পষ্ট হইবে না। মনুতে আছে - সত্যং ব্রুয়াৎ, প্রিয়ং ব্রুয়াৎ ন ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্। প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রুয়াৎ, এষ ধর্মঃ সনাতনঃ। অর্থাৎ - সত্য বলিবে, প্রিয় বলিবে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলিবে না, প্রিয় মিথ্যাও বলিবে না, ইহাই সনাতন ধর্ম। এখানে সত্য বলিতে কেবলমাত্র সত্য কথাই বুঝাইতেছে, তৎসঙ্গে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝাইতেছে না। যদি প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝাইত তবে প্রিয় ও অপ্রিয় শব্দের সার্থকতা থাকিত না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, এখানে মনু সত্য শব্দে Truth ছাড়া "আরও কিছু'-কে ধরেন নাই ... সত্য শব্দের মূল ধাতু ধরিয়াই দেখি আর ব্যবহার ধরিয়াই দেখি - দেখা যায়, সত্য অর্থে সাধারণত Truth বুঝায় ও কেবল স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায়। অতএব যেখানে সত্যের সংকীর্ণ ও বিশেষ অর্থের আবশ্যক সেখানে বিশেষ ব্যাখ্যারও আবশ্যক।
দ্বিতীয়ত - সত্য বলিতে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝায় না। সত্য পালন বা সত্য রক্ষা বলিতে প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝায় - কেবলমাত্র সত্য শব্দে বুঝায় না।
তৃতীয়ত – বঙ্কিমবাবু ‘সত্য' শব্দের উল্লেখ করেন নাই, তিনি ‘মিথ্যা' শব্দই ব্যবহার করিয়াছেন। সত্য শব্দে সংস্কৃতে স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায় বটে - কিন্তু মিথ্যা শব্দে তদ্বিপরীত অর্থ সংস্কৃত ভাষায় বোধ করি প্রচলিত নাই - আমার এইরূপ বিশ্বাস।
বঙ্কিমচন্দ্র ক্ষোভের সঙ্গে আরও লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমালোচনায় তাঁকে বিস্তর গালিগালাজ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন - ... শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। ... তাঁহাকে গালি দিবার কথা আমার মনেও আসিতে পারে না। তিনি আমার গুরুজন তুল্য, তিনি আমা অপেক্ষা কিসে না বড়ো! আমি তাঁহাকে ভক্তি করি, আর কেই বা না করে। তাঁহার প্রথম সন্তান দুর্গেশনন্দিনী বোধ করি আমা অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠা। আমার যে এতদূর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল যে তাঁহাকে অমান্য করিয়াছি কেবলমাত্র অমান্য নহে তাঁহাকে গালি দিয়াছি তাহা সম্ভব নহে। ক্ষুব্ধ-হৃদয়ে অনেক কথা বলিয়াছি, কিন্তু গালিগালাজ হইতে অনেক দূরে আছি। মেছোহাটার তো কথাই নাই আঁষ্টে গন্ধটুকু পর্যন্ত নাই। ... হৃদয় হইতে উৎসারিত না হইলে সে কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইত না, যিনি বিশ্বাস করেন করুন, না করেন নাই করুন।
বঙ্কিমবাবুর প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ভক্তি আছে তিনি তাহা জানেন। যদি তরুণ বয়সের চপলতাবশত বিচলিত হইয়া তাঁহাকে কোনো অন্যায় কথা বলিয়া থাকি তবে তিনি তাঁহার বয়সের ও প্রতিভার উদারতাগুণে সে সমস্ত মার্জনা করিয়া এখনও আমাকে তাঁহার স্নেহের পাত্র বলিয়া মনে রাখিবেন। আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি সরলভাবে যে-সকল কথা বলিয়াছি, আমাকে ভুল বুঝিয়া তাহার অন্য ভাব গ্রহণ না করেন।
এই তর্কের নিরপেক্ষ বিচার করেছেন রবীন্দ্র-ভাগিনেয়ী সরলা। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথের প্রতিপাদ্য এই যে, মিথ্যা কোন অবস্থাতেই কথনীয় নয়। এ বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রকারকৃত ব্যতিক্রম বিধিগুলি তিনি সমর্থন করেন না, বঙ্কিম করেন – এই প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে শাস্ত্রকারদের ও বঙ্কিমের পক্ষাবলম্বী হলেন, তাঁরা বক্তৃতাসভায় যোগদান করলেন না। কিন্তু ছোটরা তাঁর হীরো-ওয়ারশীপার হল।
... রবীন্দ্রের বক্তৃতা তৎকালীন ভারতীতে বেরিয়েছিল (সে সময় স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এর সম্পাদিকা), বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনা সংগ্রহে সেইটি নিশ্চয় সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু বঙ্কিমকে বাঙালীর মনে চিরজাগরূক রাখবার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাঁর যে শুধু ঔপন্যাসিক প্রতিভা ছিল না, সংস্কারের ও ভাবের গতানুগতিকতায় বাহিত না হয়ে বুদ্ধির প্রখর বিচারশীলতায় তিনি যে কত বড় আধুনিক, রবীন্দ্রের গুরু ও মার্গদর্শী তিনিই যে, সে কথা এই পুরুষের বাঙালীরা জানেনা। সত্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রের আনকম্প্রোমাইজিং আপোষশূন্য মনোভাবের অভিব্যক্তিতে সেদিন আমরা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হলুম। সত্যভক্তি আমাদের মনে ক্ষোদিত করে দেওয়া হল। শিশুদের পক্ষে এইটেই দরকার।
... বড় হয়ে যখন বিচার বুদ্ধি খানিকটা উদ্বুদ্ধ হল, তখন বঙ্কিমকে পড়ে দেখে অনুভব করলুম, বঙ্কিমের প্রতি সুবিচার করিনি আমরা, সেদিন মাতুল-ভক্তিতে অযথা বঙ্কিম-মতদ্বেষী হয়ে পড়েছিলুম।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর অবস্থান থেকে কখনোই সরে আসেন নি। অকৃত্রিম সত্যপ্রিয়তা রবীন্দ্র-চরিত্রের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট, এর সূক্ষ্ম স্বরূপ বোঝা সহজ নয়। ‘ভালো-মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’ তিনি শুধু লিখেই যাননি, জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় তার নিদর্শন রেখেছেন, সে সত্য অপ্রিয় হলেও। তাঁর প্রতি অযথা আক্রমণে তিনি বিচলিত হননি – সজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালের অত্যাচার সহ্য করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চরিত্রহননে উদ্যত হননি একবারও। বস্তুত ব্যক্তিকে নয়, বক্তব্যের বিরোধিতাই তাঁর বহু প্রবন্ধের উপজীব্য। আর প্রিয়জনের মৃত্যু অপেক্ষা অপ্রিয়তর সত্য মানবজীবনে কী আছে? সারা জীবন সেই সত্যের সম্মুখীন হয়েছেন অসম্ভব দৃঢ়তায়, কোত্থেকে সেই শক্তি পেতেন তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সত্যভাবনা এক পৃথক আলোচনার বস্তু, এর জন্য তাঁকে তাঁর সমকালীন ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মত ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ বা ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয় নি।
বাদ-প্রতিবাদের বৎসরাধিক কাল পরে রবীন্দ্রনাথ আবার একই বিষয়ে দামু ও চামু, বানরের শ্রেষ্ঠত্ব, হেঁয়ালি নাট্য ইত্যাদি প্রবন্ধ রচনা করেন ও সত্য শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন। প্রবন্ধগুলি তাঁর সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। আগের সমালোচনাটিও ব্যাপকভাবে পুনর্মুদ্রিত হয় বালক, সঞ্জীবনী, তত্ত্ববোধিনী ও তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায়।
বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ পরেও লিখেছিলেন - বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্রন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য তাঁহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য।
রবীন্দ্রনাথের মতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘পাশ্চাত্য মুর্খ' অর্থাৎ ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের ওপর অজস্র অবজ্ঞা বর্ষণ করেছেন, যা তাঁর মতে গর্হিত এবং কৃষ্ণচরিত্রের মত গ্রন্থে অশোভন। বঙ্কিম যাঁকে মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, সেই কৃষ্ণ একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সকারণে অস্ত্র ধারণ করতেও অনেক সময়েই বিরত হয়েছেন, তাঁরই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা আদর্শের অবমাননা। শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনায় অকারণে ইওরোপীয়দের ওপর খোঁচা দেওয়ায় বইটার মূল উদ্দেশ্যটা পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। কেননা কৃষ্ণচরিত্রের মত বই কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য না লিখে সর্বকালের সর্বজাতির জন্যই লেখা হওয়া উচিত।
বঙ্কিম লিখেছেন - হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কিনা, মেমসাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না-হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মতো কিচিরমিচির করি। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন - ক্ষণে ক্ষণে লেখকের এরূপ ধৈর্যচ্যুতি "কৃষ্ণচরিত্রে'র ন্যায় গ্রন্থে অতিশয় অযোগ্য হইয়াছে। গ্রন্থের ভাষায় ভাবে ও ভঙ্গিতে সর্বত্রই একটি গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য ও ঔদার্য রক্ষা না করাতে বর্ণনীয় আদর্শচরিত্রের উজ্জ্বলতা নষ্ট হইয়াছে। ...বঙ্কিম সামান্য উপলক্ষমাত্রেই য়ুরোপীয়দের সহিত, পাঠকদের সহিত এবং ভাগ্যহীন ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিত কলহ করিয়াছেন। ... বঙ্কিম নানা স্থলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের আদর্শ যেমন কার্যকারী এমন দেবতার আদর্শ নহে। কারণ, সর্বশক্তিমানের অনুকরণে আমাদের সহজেই উৎসাহ না হইতে পারে। যারা মানুষে সাধন করিয়াছে তাহা আমরাও সাধন করিতে পারি এই বিশ্বাস এবং আশা অপেক্ষাকৃত সুলভ এবং স্বাভাবিক। অতএব কৃষ্ণকে দেবতা প্রমাণ করিতে গিয়া বঙ্কিম তাঁহার মানব-আদর্শের মূল্য হ্রাস করিয়া দিতেছেন। কারণ, ঈশ্বরের পক্ষে সকলই যখন অনায়াসে সম্ভব তখন কৃষ্ণচরিত্রে বিশেষরূপে বিস্ময় অনুভব করিবার কোনো কারণ দেখা যায় না। বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই।
১২৯৮ সালে প্রকাশিত হয় হিতবাদী পত্রিকা। সেখানে সম্পাদক কী কেমনভাবে লিখতে হবে এই জাতীয় ফরমায়েসি লেখা চাইলে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাধনা। তাঁর সাহিত্যসাধনায় এই সাধনা পর্ব (১২৯৮-১৩০২) এক স্বর্ণযুগ। সম্পাদনা ও সাহিত্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের সাধনা-র যুগ অনেকের মতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন যুগের (১২৭৯-১২৮২) সঙ্গে তুলনীয়।
হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও ব্রাহ্ম-উদারতা সেই সময়ের সমাজ ও সাহিত্যের অন্যতম চর্চার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু-ব্রাহ্ম বলতেন। বঙ্কিমের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁর শিষ্যকূল ও আর্য-ধ্বজাধারী নব্য হিন্দুসমাজের পৃষ্ঠপোষক চন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, শশধর তর্কচূড়ামণি প্রভূতদের উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছিলেন –
কোথা গেল সেই প্রভাতের গান, কোথা গেল সেই আশা?
আজিকে বন্ধু তোমাদের মুখে এ কেমনতর ভাষা?
তোমরা আনিয়া প্রাণের প্রবাহ ভেঙেছ মাটির আল
তোমরা আবার আনিছ বঙ্গে উজান স্রোতের কাল।
১২৯৮ সালে উড়িষ্যায় বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কটক ও পুরীতে দুই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। কটকের ডিস্ট্রিক্ট জজ কবিবন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। দেশে তখন জুরিপ্রথা ও তাতে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের ওপর ইংরেজের বিধিনিষেধের ওপর প্রবল আন্দোলন হচ্ছে। সেই বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রিত ওখানকার র্যাভেনশ’ কলেজের অধ্যক্ষ হলোয়ার্ড তাদের সামনেই বলেন, এ দেশের মরাল স্ট্যান্ডার্ড লো, এখানকার লোকেদের লাইফের স্যাক্রেডনেস সম্বন্ধে যথেষ্ট বিশ্বাস নেই, এরা জুরি হবার যোগ্য নয়। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লেখেন - আমার যে কী রকম করছিল সে তোকে কী বলব ... একজন বাঙালির নিমন্ত্রণে এসে বাঙালির মধ্যে বসে যারা এ রকম করে বলতে কুণ্ঠিত হয় না তারা আমাদের কী চক্ষে দেখে! ... তোমাদের উচ্ছিষ্ট তোমাদের আদরের টুকরোর জন্যে আমার তিলমাত্র প্রত্যাশা নেই, আমি তাকে পদাঘাত করি। ... যারা ফিটফাট কাপড় পরে ডগকার্ট হাঁকায় আর আমাদের নিগার বলে, তারা যতই সভ্য ও উন্নত হোক, আমি যদি কখনো তাদের সংশ্রবের জন্যে লালায়িত হই, তবে আমার মাথায় যেন জুতো পড়ে।
কিছুদিন পর পুরীতে বিহারীবাবুর অনুরোধে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ওয়ালসের বাড়িতে গেলে চাপরাশি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে পরদিন আসতে বলে। বিরক্ত ও অপমানিত হয়ে ফিরে এলেও পরদিন বন্ধুর সম্মানে সেখানে যান তিনি। কিন্তু মনে মনে ইংরেজ শাসনের ও ভারতীয়দের ওপর তাদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ মনের মধ্যে জেগে ওঠে প্রবলভাবে।
এর দেড় বছর পরে তিনি লেখেন পর পর প্রবন্ধ – অপমানের প্রতিকার, রাজা ও প্রজা, ইংরেজ ও ভারতবাসী। লেখেন ব্যঙ্গরচনা পয়সার লাঞ্ছনা। ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৮৬১ সালে যে ভারত কাউন্সিল অ্যাক্ট চালু হয়েছিল, ১৮৯২ সালে তা সংশোধিত হয়, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকদের দাবিদাওয়া পূরণের বদলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারানীতি চালু করা হল। সরকারী চাকরিতে ভারতীয়দের প্রবেশের দরজা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ হল। দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় এমন করা হল যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তাতে প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা। এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধটি। কলকাতায় এক সভায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সভাপতিত্বে তা পাঠ করার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়ি গিয়ে প্রবন্ধটি পড়ে শুনিয়ে তাঁর সম্মতি নিয়ে আসেন। বারো বছর আগে বিডন স্ট্রীটে রমেশচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বঙ্কিমের জন্য প্রস্তুত মালা তিনি পরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গলায়। বিডন স্ট্রীটের এই সভাতেই দুই দিকপালের শেষ সাক্ষাৎ ঘটল।
বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস রাজসিংহ রচিত হয়েছিল ১৩০০ সালে, বহুমূত্র রোগে তিনি তখন খুবই পীড়িত। চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বইটির সমালোচনা করুক। সেই মর্মে শ্রীশচন্দ্রের হাত দিয়ে বইটি পাঠিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নতুন আঙ্গিকে বইটির সমালোচনা প্রকাশ করেন ভারতীতে, সমালোচনাও যে সাহিত্য হতে পারে, তার এক অপরূপ নিদর্শন ছিল সেটি। অত্যুৎকৃষ্ট এই সমালোচনা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়, তিনি সম্ভবত সেটি দেখে যেতে পারেন নি।
বঙ্কিমপ্রসঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। জীবনসায়াহ্নে সাহিত্যের রূপ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি প্রকাশ করেছেন সাহিত্যের অগ্রগতির পিছনে সাহিত্যিকদের অবদানের ভূমিকার গুরুত্ব ও সেই প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের অবদান। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, আনন্দমঠ ইত্যাদি যুগান্তকারী উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টি প্রসঙ্গে লিখেছেন - তিনি গল্পসাহিত্যের এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিলেন। ... তাঁর পূর্বেকার গল্পসাহিত্যের ছিল মুখোশ-পরা রূপ, তিনি সেই মুখোশ ঘুচিয়ে দিয়ে গল্পের একটি সজীব মুখশ্রীর অবতারণা করলেন। হোমার, বর্জিল, মিল্টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে মাইকেল তাঁর সাধনার পথে উৎসাহ পেয়েছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্রও কথাসাহিত্যের রূপের আদর্শ পাশ্চাত্য লেখকদের কাছ থেকে নিয়েছেন। কিন্তু, এঁরা অনুকরণ করেছিলেন বললে জিনিসটাকে সংকীর্ণ করে বলা হয়। সাহিত্যের কোনো-একটি প্রাণবান রূপে মুগ্ধ হয়ে সেই রূপটিকে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন; সেই রূপটিকে নিজের ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনায় তাঁরা সৃষ্টিকর্তার আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দে তাঁরা বন্ধন ছিন্ন করেছেন, বাধা অতিক্রম করেছেন। এক দিক থেকে এটা অনুকরণ, আর-এক দিক থেকে এটা আত্মীকরণ। ... বঙ্কিম এমন একটি সাহিত্যরূপে আনন্দ পেয়েছিলেন, এবং সেই রূপকে আপন ভাষায় গ্রহণ করলেন, যার মধ্যে সর্বজনীন আনন্দের সত্য ছিল। বাংলাভাষায় কথাসাহিত্যের এই রূপের প্রবর্তনে বঙ্কিমচন্দ্র অগ্রণী। রূপের এই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তারই পূজা চালালেন তিনি বাংলাসাহিত্যে। তার কারণ, তিনি এই রূপের রসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ নয় যে, গল্পের কোনো একটি থিওরি প্রচার করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। "বিষবৃক্ষ' নামের দ্বারাই মনে হতে পারে যে, ঐ গল্প লেখার আনুষঙ্গিকভাবে একটা সামাজিক মতলব তাঁর মাথায় এসেছিল। কুন্দনন্দিনী সূর্যমুখীকে নিয়ে যে-একটা উৎপাতের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা গৃহধর্মের পক্ষে ভালো নয়, এই অতি জীর্ণ কথাটাকে প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য রচনাকালে সত্যই যে তাঁর মনে ছিল, এ আমি বিশ্বাস করি নে - ওটা হঠাৎ পুনশ্চনিবেদন; বস্তুত তিনি রূপমুগ্ধ রূপদ্রষ্টা রূপশ্রষ্টা রূপেই বিষবৃক্ষ লিখেছিলেন।
নবযুগের কোনো সাহিত্যনায়ক যদি এসে থাকেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করব, সাহিত্যে তিনি কোন্ নবরূপের অবতারণা করেছেন। …
বঙ্কিমের উপন্যাসে চন্দ্রশেখরের অসামান্য পাণ্ডিত্য; সেইটি অপর্যাপ্তভাবে প্রমাণ করবার জন্যে বঙ্কিম তার মুখে ষড়্দর্শনের আস্ত আস্ত তর্ক বসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, পাঠক বলত, আমি পাণ্ডিত্যের নিশ্চিত প্রমাণ চাই নে, আমি চন্দ্রশেখরের সমগ্র ব্যক্তিরূপটি স্পষ্ট করে দেখতে চাই। সেই রূপটি প্রকাশ পেয়ে ওঠে ভাষায় ভঙ্গিতে আভাসে, ঘটনাবলীর নিপুণ নির্বাচনে, বলা এবং না-বলার অপরূপ ছন্দে। সেইখানেই বঙ্কিম হলেন কারিগর, সেইখানে চন্দ্রশেখর-চরিত্রের বিষয়গত উপাদান নিয়ে রূপস্রষ্টার ইন্দ্রজাল আপন সৃষ্টির কাজ করে। আনন্দমঠে সত্যানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসীরা সাহিত্যে দেশাত্মবোধের নবযুগ অবতারণ করেছেন কি না তা নিয়ে সাহিত্যের তরফে আমরা প্রশ্ন করব না; আমাদের প্রশ্ন এই যে, তাঁদের নিয়ে সাহিত্যে নিঃসংশয় সুপ্রত্যক্ষ কোনো একটি চারিত্ররূপ জাগ্রত করা হল কি না। পূর্বযুগের সাহিত্যেই হোক, নবযুগের সাহিত্যেই হোক, চিরকালের প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে : হে গুণী, কোন্ অপূর্ব রূপটি তুমি সকল কালের জন্যে সৃষ্টি করলে।
এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠের এ এক অনুপম শ্রদ্ধার্ঘ তাঁর অগ্রজ আর এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠ-র প্রতি।
সাহিত্যবিষয়ে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে এই আলোচনার ইতি টানতে চাই আপাতত। রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সঙ্গীতশিক্ষা করেছিলেন সেই সময়ের নামী শিক্ষক যদুভট্টের কাছে। মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিমলগ্নে রাজদরবারের শিল্পীরা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের জন্য দিল্লী ছেড়ে ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যান, যদুভট্ট তাদের ঘরানারই উত্তরসূরী। তানসেন-বংশীয় ধ্রুপদ-গায়ক বাহাদুর খাঁ আশ্রয় নিয়েছিলেন বিষ্ণুপুর রাজসভায়। তাঁর এক শিষ্য রামশঙ্করের শিষ্য যদুভট্ট, তাঁর জন্ম বিষ্ণুপুরেই। ত্রিপুরার রাজদরবারে তিনি অনেককাল ধ্রুপদ গাইতেন। বঙ্কিমচন্দ্রও যদুভট্টের কাছে কিছুদিন গান শিখেছিলেন। সেসময় তিনি কিছুকাল বঙ্কিমচন্দ্রের বাসস্থান নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় তাঁর বোনের বাড়িতে ছিলেন। যদুভট্টই প্রথম মল্লার রাগে বঙ্কিমের বন্দেমাতরম্ গানে সুর দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন ১২৮৮ সালে চুঁচুড়ায় বঙ্কিমের এক সম্বর্ধনা সভায়। এ আর রহমানের হাতে কিছু-মতে-উজ্জীবিত, কিছু-মতে-ধর্ষিত হওয়ার আগে বহু নামী সঙ্গীতজ্ঞ বন্দেমাতরম্-এ সুর দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। ১২৯২ সালে ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা ঠাকুরবাড়ি প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার ‘গান অভ্যাস’ অংশে রবীন্দ্রনাথের দেশ-কাওয়ালির সুরে এর প্রথম স্তবকটির স্বরলিপি প্রকাশ করেন। ন্যাশন্যাল সং-এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই গানটি রবীন্দ্রনাথ প্রথম গেয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ বার্ষিক সম্মেলনে, বঙ্গভঙ্গের আগে এর গ্রামাফোন রেকর্ডও বের করেন তিনি। ছোটমামার স্নেহধন্যা সরলা লিখেছেন – বন্দেমাতরম্-এর প্রথম দুটি পদে সুর দিয়েছিলেন নিজে। তখনকার দিনে শুধু সেই দুটি পদই গাওয়া হত। একদিন আমার উপর ভার দিলেন – বাকী কথাগুলোতে তুই সুর বসা। তাই ত্রিংশকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদকরালে থেকে শেষ পর্যন্ত কথায় প্রথমাংশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমি সুর দিলুম। তিনি শুনে খুশী হলেন। সমস্ত গানটা তখন থেকে চালু হল। সরলার এই স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০০ সালের ভারতী পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়।
ভারতের ন্যাশন্যাল অ্যান্থেম ও ন্যাশন্যাল সং – দুটিরই রচয়িতা ও সুরকার বঙ্গসন্তান। বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণে এই দুই দিকপাল বঙ্গসন্তানের সাহিত্য সৃষ্টি এক অমর অধ্যায় হয়ে আছে। অথচ কী লজ্জাকর পরিস্থিতি আজ, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা এখন এক হাস্যকর স্থানে। জনচেতনার উন্মেষে সাহিত্য ও সাহিত্যপত্রিকাগুলির ভূমিকা আজ কুরুচিকর অন্তর্কলহে গুরুত্ব হারিয়েছে।
মুখের সামনে আয়না ধরলে এই জটাজাল থেকে বেরোনোর যে রাস্তা বাঙালী দেখতে পেত, তার নাম বঙ্গদর্শন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন