বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

উত্তর সম্পাদকীয় - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

উত্তর সম্পাদকীয়
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না

‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ সাংসদ, তব্য গর্বিত নয় রাজ্যবাসী



এই রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন একজন আহমেদ হাসান ইমরান, যিনি পেশায় সাংবাদিক। তাকে জেতাতে কংগ্রেস, আর এস পি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়কদের ভোট কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ। কেনার অভিযোগ উড়িয়ে শাসক দলের মুখ বলেছেন, মমতা সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে তারা স্বেচ্ছায় এসেছেন। মানুষ জানেন, বিনা স্বার্থে রাজনীতিবিদরা এক পা ফেলেন না, উৎকোচ-উপঢৌকনই সার কথা। ইমরানের জয়কে সংখ্যালঘু স্বার্থে তৃণমূলের পদক্ষেপ বলা হয়েছিল, কিন্তু বলা হয়নি ইনি আসলে কে? ইমরান “হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে...” (গুরুদেব মাফ করবেন আশা করি), সেটাও জানা দরকার। জানা দরকার, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হঠাৎ সে দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে এমন একজন সাংবাদিক-রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেন কেন?

আমাদের সমস্যা আরও বেশি। ভোট আসলেই আমাদের খাবারের পরিমাণ বেড়ে যায়। সব দল কিছু না কিছু খাওয়াতে চায়। আমাদের খেতেই হয়, কিন্তু খেলেই কি হজম হয়? হয় না। আমাদের তো রাহুর দশা। আমি এবং আমাদের বেশিরভাগটাই তাই খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না।

সরকারি গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া জঙ্গী ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া বা সিমি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পশ্চিম বাংলায় সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বা ‘আমীর-ই-হলকা’ ছিলেম এই ইমরান। সিমি-কে নিষিদ্ধ করেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর সেই সরকার যার মন্ত্রী ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইমরান নিজে ‘ইসলামিক মিল্লাত’ এবং জেহাদ-এর সমর্থক, মিল্লি কাউন্সিল-এর অন্যতম কর্তা এবং ‘কলম’ পত্রিকার সম্পাদক। একসময় তিনি নিজেকে ইরানের ‘তেহরান রেডিও’-র সাংবাদিক বলে দাবি করতেন। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী ইরানের একটি রেডিও কলকাতায় কেন প্রতিনিধি রাখবে, তা দুর্বোধ্য। ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মত কাগজও ভারতের জন্য একজনকেই প্রতিনিধি রাখতে পারে, তাও দিল্লিতে। গোয়েন্দাদের মতে, তিনি ‘পেইড ফরেন এজেন্ট’ এবং এর প্রমাণ তাঁদের আছে। চার বছর সিমির ‘আমীর-ই-হলকা’ থেকে ইমরান ১৯৮১ সালে ১৯ দরগা রোড ঠিকানা থেকে প্রকাশ করেন মাসিক পত্রিকা ‘কলম’। পত্রিকাটি ১৯৯৩-৯৪ সাল সাপ্তাহিক হয়ে চলে আসে ৪৫ ইলিয়ট রোড-এ আর দরগা রোডের বাড়িটি হয় সিমির কমিউন। সিমি-র অফিস হয় লেনিন সরণীর অন্য একটি বাড়িতে। কলমের তখন সবচেয়ে বেশি প্রচার ছিল আসামের মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে, আর তা সম্ভব হয়েছিল পরবর্তীকালে গঠিত এআইডিইউএফ চেয়ারম্যান বদরুদ্দিন আজমলের। এ-পর্যন্ত খেয়েই ঢেকুর উঠল - আলিগড়ের ছাত্র ইমরান সিমিতে থাওকে থাকতে হঠাৎ একটি পত্রিকা প্রকাশ করে তার বিপুল প্রসারের মত অর্থ কোথা থেকে পেলেন? কারা করল লগ্নী, কেন --- সবই প্রশ্ন।

এখন জানা যাচ্ছে, তার লগ্নী অর্থের জোগান আসত বাংলাদেশের ইসলামিক জঙ্গী সংগঠন ‘জামাত-এ-ইসলামী’-র থেকে। জামাতের নেতা ছিলেন মানবতা-বিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী গোলাম আজম। তাঁর ছেলে তথা বাংলাদেশের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মামুন আল-আজমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন ইমরান। জানা যাচ্ছে, মামুন কয়েকবার কলমের ইলিয়ট রোডের অফিসেও এসেছেন। ইমরানকে তিনি ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ভারতীয় শাখার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে এনেছিলেন। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এই পদে ইমরানের কাজ ছিল এপার বাংলায় ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠিগুলির জন্য অর্থের যোগান বজায় রাখা। ফলে, মুসলিম সমাজের উন্নয়নের নামে আইডিবি-র টাকা এলেও তা সম্প্রদায়ের গরিবদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় নি। ইমরানের সঙ্গে এ-বাংলার জামাতের কাগজের দায়িত্ব দেওয়া আছে, তিনি জনৈক আলাউদ্দিন। এই কারণেই ইমরান তসলিমার লজ্জা বা উতল হাওয়া উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সঙ্গে দেখা করে তসলিমার বই নিষিদ্ধ করার আর্জি জানিয়েছিলেন এবং আদালতে মামলাও করেছিলেন। তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর জন্যে সংখ্যালঘু অংশের সমাজবিরোধীদের দিয়ে বাম সরকারের আমলে দাঙ্গা-পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনেও তাঁর মদত ছিল। তসলিমার লেখা কাহিনি-নির্ভর ‘দুঃসহবাস’ সিরিয়াল বন্ধের জন্য চ্যানেলের কর্ত্রিপক্ষের সঙ্গে মৌলবাদীদের বৈঠকে হাজির ছিলেন কলমের সম্পাদক তথা উর্দূ কাগজ ‘আজাদ হিন্দ’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক ইমরান।

মৌলবাদ-ফ্যসজেধী ও ধর্মনিরপেক্ষ শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তাই ষড়যন্ত্র করেছেন জামাতপন্থী ইমরানরা। তাঁদের কাগজের পাতায় পাতায় তখন শশবাগ-বিরোধী সংবাদ, যার অধিকাংশই মিথ্যা, প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, সংবাদপত্রের ভূমিকা ছাপিয়ে গিয়ের কলকাতায় বাংলাদেশের জামাতের সমর্থনে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিছিল নিয়ে যাওয়ার মত কাজ তাঁরা সংগঠক হিসাবে করেছে। শহীদ মিনারে জামাত এ-ইসলামীর নাম না নিয়ে তারই ছত্রচ্ছায়ার এক ডজন সংগঠনের নামে প্রকাশ্য সমাবেশ করে সেখান থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ““বাংলাদেশের জামাত-এ-ইসলামী আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন।” যারা এই কর্মসূচীর সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন, তাঁদের অন্যতম কলমের দুই কর্মকর্তা।

লক্ষ্যণীয়, শাহবাগের সমর্থনে কলকাতায় একটিও মিছিল করার জন্য অনুমোদন দেয় নি ধর্ম্নিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। শাহবাগের একাডেমির সামনে থেকে ছোট্ট মিছিলকে পথেই নামতে দেওয়া হয় নি। অথচ, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক রাজাকার-আল বদরদের ভারতীয় সংস্করণের জন্য সব অনুমতি দিয়ে রেখেছিল সেই প্রশাসন। তাদেরই অন্যতম প্রবক্তা হলেন ইমরান, যাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল সাংসদ করে পাঠাল। এই সম্পর্কের জেরেই জামাতের স্বার্থ দেখে তিস্তা চুক্তিতে সায় দেন নি মুখ্যমন্ত্রী। দৈনিক হিসাবে প্রকাশের আগেই কলম পত্রিকাকে মমতা সরকারের গ্রন্থাগার বিভাগের প্রকাশিত ‘ক্রয়যোগ্য কাগজ’ এঁর তালিকায় আনা হয়েছিল। আর তাঁর পিছনে মানুষের রক্ত জল করা টাকার থলি নিয়ে হাজির হতে হয়েছিল জালিয়াতি ফান্ড সারদা-র চিট সুদীপ্ত সেনকে। সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পর অন্য অনেক কাগজ বন্ধ হলেও কলম কিন্তু চালুই রইল এবং দেখা গেল, তাঁর পাশে এসে দাড়িয়েছেন তৃণমূলের নম্বর টু – মুকুল রায়। ফলে, ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ এঁর ব্যাপারটা অজানা কিন্তু জিজ্ঞাসার মধ্যেই থাকায় খেতে বাধ্য হওয়ার পরও গেলা আর হল না। হজম হবে না তো!

আহমেদ হাসান ইমরান তাহলে বেশ জনপ্রিয় মানুষ। দেখন বঙ্গবাসীর কী দুর্ভাগ্য, এতদিন সেটা অজানাই ছিল। ডঃ নজরুল ইসলাম, মীরাতুন নাহার থেকে শুরু করে কত কত বুদ্ধিজীবীর চেয়েও যে তিনি খ্যাত, তা বোঝা গেল বাংলাদেশের সংসদে তাঁর নাম যখন উচ্চারিত হল। ২০০ তম টেস্ট খেলার পরও শচীন তেন্ডুলকরের নাম বা বিশ্বসেরা হওয়ার পরও বিশ্বনাথন আনন্দের নাম বাংলাদেশের সংসদে উচ্চারিত হয়য় নি, হল কিনা ইমরানের নাম। ভাবুন! সেখানে শাসন দল আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম ১১২ ফেব্রুয়ারি বললেন, ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে জামাত এ-ইসলামীর কিছু জঙ্গী। সম্প্রতি সাতক্ষিরায় তল্লাশির সময় তাঁরা ভারতে ঢুকে পরে। পারস্পরিক সম্পরক ও কূটনীতির তোয়াক্কা না করে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন ইমরান সাহেব। সে কারণে ইমরানকে বাং;লাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডঃ মন্মোহন সিং এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্যোপাধ্যায়ের প্রতি আহবান জানান তিনি। মনে করালেন, বাংলাদেশে বসে ভারত-বিরোধী চক্রান্তে যুক্ত অনুপ চেটিয়াকে ঢাকার সরকার গ্রেফতার করে ফেরত পাঠিয়েছে। সেভাবেই ইমরানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হোক।

এহ বাহ্য! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরপিএন সিং-কে সম্প্রতি পাঠানো একটি নোটে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলেছেন, জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানির চেষ্টা করছে। তাঁদের এই কাজ সহজ হয়ে গেছে ইমরান সংসদে নির্বাচিত হওয়ায়। আগেই তিনি জামাত এ-ইসলামী ও জামাতের ছাত্র শাখা ছাত্র শিবিরকে মদত দিতেন, এখন সেটা আরও বেশী করে দিচ্ছেন। সাতক্ষিরায় বাংলাদেশি বাহিনীর অভিযানের সময় ৪০ জন জঙ্গী ভারতে ঢোকে এবং দ্রুত তাঁদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে ফেলা হয়। সেই কাজে ইমরানের ভূমিকা ছিল বলে তাদের রিপোর্ট।

অনেক ভেবে ভেবে দেখলাম, ইনিই হলেন আদর্শ ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না’-র ব্যক্তিত্ব। ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ হয়েও সাংসদ রাজ্যবাসীকে গর্বিত করতে পারলেন না। কী দুর্ভাগা আমরা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন