কবির পাখি
রমিত দে
“সে যাই হোক পাখির সাথে কবির সখ্যতা হয়ত চিরন্তন, আসলে কবিও তো রক্ত মাংস গড়া মানুষ ,বাস্তব পৃথিবীতে নিজেকে প্রশ্ন করে মরছেন , পাখিরা যেমন নিজের পালক ফোলাতে পারে তারও তো ইচ্ছে অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের সত্ত্বার ভেতর শূন্যতাকে কিছুটা ফুলিয়ে নেওয়ার ”
“মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়”- তাই কি পাখির দিকে পা
বাড়াবার আগ্রহ কবির শতভাগ! একটু ফাঁকা জায়গা পেয়েছে কি ওমনি পৃথিবীতে বসে ওপরের
দিকে তাকায় আর দেখে ‘নিড়ীহা পাখির বউ উড়ে উড়ে যায়”!-আসলে কোথাও যেন পাখির সাথে
পালাবার একটা অভ্যেস রয়েছে। আর কবির তো ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজেকেই খালি খালি করা,
নিজের পোষা গণিত থেকে নিদেনপক্ষে একটা গাঙচষা হওয়া। যেন পাখি হওয়ার পরীক্ষায় পাশ
তাকে করতেই হবে আর তাই তো সাগরের পাড়গুলোকে প্রান্তর পাহাড় গুলোকে কিভাবে পিছল করে
রেখেছে দেখো, যেন কাৎ হয়ে পড়লেই পাখি! তবে কজনেরই বা ইচ্ছেপুরণ হয় বলো? কিন্তু কবি
তো নাছোড়বান্দা, তিনি তো হীয়াগাছ হীয়াফলের মত পেটের ওপর নতুন পাখিটিকে বসাতে
চাইবেন আর যখন পাখিওয়ালার কাছ থেকে খাঁচার
গল্প শুনতে শুনতে ভেতরে শূন্যের দিকে তাকাবেন তখনই বুঝবেন আসলে পাখি নয় ‘পাখিত্ব’
শব্দটাই তার ওপর চড়াও হয়েছে। যা পাখির হুবহু বর্ণনা মাত্র নয়, বরং তার চেয়ে খানিক
বড়। যে কবি খানিক আগেই “এ বাড়ি তোমার গায়ে এইভাবে কেন গজিয়েছে?” বলে বেশ কিছুকাল
চুপ করে ছিল সেই তখন বলে বসে-“ প্রচুর পাখিত্ব আছে এইখানে মোহনাতে,মোহনাকে
ভালোবাসে বলে,/যেমন আমিই বাসি, সকল পাখিত্ব তাকে ঘিরে ঘিরে ঘিরে উড়ে ফেরে/উপরে
সাঁতার কাটে”। অর্থাৎ কবির পায়ে সবসময়ই সরষে দানা কবির গায়ে সবসময়ই পর্যটনের
পরিযায়ী চাদর। কিন্তু কটা পাখিরই বা সান্নিধ্যে আসে কবি! নাম জানে কজনেরই বা?
বাস্তব পক্ষীজীবনে যাপন করেন কতটুকু ! খুন্তে বক, কানঠুটি, চিপঠুঁটো, তুরুমতি,
তালচড়াই , গগনভের, টিটিপাখি,কাপাসী-কবি কি জানে কারা কুয়োর পুরোনো দেওয়াল খোঁজে আর
কারা পাথরের স্থায়ী বাসিন্দা? জানে কি ছিটে ঘুঘুরা বারান্দা ভালোবাসলেও কন্ঠি
ঘুঘুরা বাড়ি একদমই পছন্দ করে না ! আবার রায়তোতা বা হীরামনতোতার কিয়াক কিয়াক কোন
সান্দ্র বনভূমি ছেড়ে আসার কথা বলে তাও তো জানে না কবি। আসলে তার ভেতরেও একটা পাখি
থাকে, পালক ঘনায়, ক্রমোচ্চ কুহুধ্বনিতে সুর যখন চড়ে যায় তখন সে অস্থির হয়ে ওঠে ।
অস্থির না হলে কেউ কাগজে লেখে “ঙাঙুঙা”! হ্যাঁ তাও আবার বাঙুরের সাইকিয়াস্ট্রি
ইনস্টিটিউটে বসে-খানিকটা সুস্থ হলে হাসপাতাল থেকেই বিনয় মজুমদার লিখলেন প্রানের
ভেতর পাখি ঢোকাবার কয়েক পংক্তি- “কাগজে লিখুন ঙাঙুঙা। আকাশের দিকে তাকান। দেখুন
একটা নতুন দেবতাকে দেখা যাচ্ছে। আপনারা মানুষ। এইবার ঙ র বদলে ঞ দিয়ে একটি শব্দ
লিখুন তো। ঞঞ। আকাশের দিকে তাকান। দেখুন একটি পাখি বসে আছে।“—কেবল বিনয়ের আকাশই নয়
প্রায় সব শিল্পীরই কিন্তু কিছু নিজস্ব পাখিবিজ্ঞান আছে। কেবল শিল্পী কেন, মনে হয়
প্রতিটা মানুষই বোধহ্য় জানে আনজানে নিজের ভেতর পাখি পোষে। তার পালকগুলোকে নিয়ে
মাথা ঘামায়, প্রতিশ্রুতিগুলোকে নিয়ে ওড়ে।একটু সবুজ পর্দা সরিয়ে দেখ, একটু জোর গলায়
ডাক দিয়ে ফেল, দেখ লোকস্য স্থাবরস্য চরস্য দেহীর বাইরে কেমন ল ল ল ল করে হাঁসটা
ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে যেন বারবার পিপুল ফল খাওয়া পান্থজনকে ডেকে নিয়ে চলেছে “মধ্বদঃ”
শব্দটির কাছে। ওখানেই মোহনা শেষ,ওখানেই এক নাগাড়ে ভাসা। আসলে এই ‘মধ্বদঃ” অর্থাৎ
যার কাছে মধু আছে শব্দটির কাছে পৌঁছতে গেলে মায়াপ্রাণের মায়া শব্দটির ওপর হাত চাপা
দিতে হবে। সেটা তো খুব শক্ত! শিল্পীও জানে,কবিও জানে। কিন্তু নাছোড়বান্দা, কে
বোঝাবে তাকে। পঞ্চ ধাতু যা দিয়ে দেহের প্রস্তাবনা তার ভেতরে পাখির ব্যঞ্জনা পুরে
পুরে রেখেছে কবি। একটা সোনালী ডানার চিল না হোক নিদেনপক্ষে সুক্ষদেহী একটা চড়াই তো
থাকবেই থাকবে। যখন কারু দেখা পাবে না তখন
বলবে “ পাখির চোখ মায়ের চোখে বসালে/ মা আকাশের দিকেই চেয়ে থাকবে/আমাদের মুখের দিকে
চেয়ে বলবে না/কী রে খিদে পেয়েছে”, যন্ত্রনায় বলে বসে- “আশাবাদী বটগাছের উপর দিয়ে
ভগবানও একদিন শাশ্বত শালিক হয়ে উড়ে যায়/ সেইখানে আমি নেই”। আর অভিমান হলে তো সে এক
কান্ড, “জবাফুলের ওপর বসে পরাগ ছিঁড়তে ছিঁড়তে” কবি দেখবে কত কয়লাকাটা মানুষ কত
মাটিকাটা মানুষ আর ওদের মধ্যেই কত পালক কত রঙের যে ফুটকি! সারাদিন সারা রাস্তায়
ছোটাছুটির পর ওদের সাথেই যেন বাবুই পাখির বাসা চুরি করবে, লুকিয়ে পড়বে কেউ খুঁজে
যাতে না পায়। আবার কোন কবির তো দুপুরের ঘুঘুডাকে কষ্ট হয়। টিয়া আর করগরিদের সাথে ভাব
হয়, তারপর একদিন তো জলপাইবনের দোয়েলের সাথেও ভাব করে ফেলে আর উড়ে গিয়ে বসে
আংকোরভাটের কুঠা রাজার কাঁধে। অথচ ভাব এদের অনেককেই কবি হয়ত চাক্ষুষ দেখেনও নি ;
আসলে স্থানুত্বের বাইরে বৃত্তের বাইরেও তো বুদবুদ আছে বাসা ভেঙে ফেলার আবদার আছে
আর আমার তোমার আমাদের এই দেহীগন্ধের ভেতর স্থবির ক্ষুধাহরণের ভেতর কবি যেন
সেই আধিকারিক পুরুষ যিনি আত্মাকে ইচ্ছাকে
ঠেলে নিয়ে যেতে চান ওই বাইরের দিকে অভিযানের দিকে। আমরা যেন কবির কাছে এসে একটু
লুকোতে চাই কিংবা কবি নিজেই হয়ত কোনো চিপঠুঁটো মেঠে হাস, কোনো খুরুলে পেঁচা বা
সোনাজঙ্ঘার কাছে এসে উৎক্রান্তি খোঁজেন।
নানান রঙের নানান পাখি, বেশীরভাগ রঙই হয়ত অজানা থেকে যায়,যা
জানা হয়ে ওঠে তা হল মেলাবার খেলা। হ্যাঁ মর্ত্য পাখির সাথে অমর্ত্য পা মেলাবার
খেলা-এই তো কবির সহজ সমীকরন। কিংবা অভেদও, তিনিও হয়ত পাখিদের দায় সারতে
পারেননি,তিনিও হয়ত আজন্ম মেপে চলেছেন পালকের গভীরতা। এক ধরনের পাখি আছে যারা
গাছপালা আর জমির রঙে নিজেদের পালকগুচ্ছ বানিয়ে হুবহু মিশে যায় আগাছা ঘাসের দলে।
যেমন ধর চর্চরি আর ভরত পাখি ওরা মাটির ঢেলার মত দূরের ক্ষেতে পড়ে থাকে যাতে শিকারী
পাখিদের চোখে না পড়ে, আবার তিতির বা বটের
পাখিরা সারা দেহে তামাটেরও ওপর কালো চিট মেখে মেখে সেজেগুজে থাকে সেও আসলে খুব কাছ
থেকে নজরে না পড়ার জন্যই। এগুলোকে বলে
পাখির আত্মরক্ষাকারী বর্ণবৈচিত্র্য; এরকম হাজার উদাহরন আছে যেখানে পাখি তার
ছদ্মবেশ খুঁজছে নিজেকে পৃথক করতে; এ কিন্তু অনুকরন নয়, আত্মরক্ষাকারী বর্ণবৈচিত্র্যের
বাইরে আত্মরক্ষাকারী অনুকরনও দেখা যায় খুদে কুকুপাখির বেলায়,ওরা আবার বড় বাজপাখির
অনেকটা অনুকরন করে যাপনে তাগিদে। কিন্তু পক্ষীবিশারদ তো নই রে বাপু, তো এতো পাখির
সাজগোজ নিয়ে কু কু কেন! আসলে একজন কবিকে পাখির খুব নিকটে ছেড়ে দিলে হয়ত বোঝা যাবে
কবি কিভাবে পাখির মতই “আত্মরক্ষাকারী রং” খুঁজছে পাখিরই দীর্ঘ ছায়ার নিচে। আসলে এই
আত্মরক্ষা তার নিজেরই অস্তির স্পর্শক ধরে ধরে , অনুভুত বিষয়ের আশ্রয় পেরিয়ে তিনি
যেন বৃহদারণ্যকে খুঁজে ফিরছেন আনন্দের মীমাংসা, এ আনন্দ তার আত্মার, তার প্রকৃত
প্রাণের, সহজ থেকে সুডৌল থেকে তার দর্শন
তো এমনই এক নীরব সমগ্রের। জীবনের গায়ে গায়ে কত ছবি! কখনও নদীর ভাঙ্গনের গায়ে গায়ে
অসংখ্যা শালিকের গর্ত তো কখনও ডিমে তা দিতে শালিক আর চড়ুইয়ের গায়ে গা লাগিয়ে ঝগড়া
আবার কখনও বা ছাতারের ধূলো নিয়ে স্নান। এসবই কবির শস্য, যা মাটি থেকে জীবন থেকে
যাপন থেকে খুঁটে নেওয়া আর প্রতিমূর্হুতেই এ বিষয়দর্পণে বোধের ছায়া বাড়ে, বাড়তে
থাকে , শব্দ স্পর্শ রূপ থেকে কবি তখন ছিটকে এসে রূপ থেকে অরূপ বাক থেকে অবাকের
দিকে উপাদাননিরপেক্ষ হতে চান। যে তুতী পাখির বেশে শীতে কবি এসেছিল এই প্রাণভূমির
তুঁত খেতে সেই যেন চৈত্রতে ফিরে চলে স্বদেশে! তাই তো কবির পিঠের পালকের রং খয়েরী!
দেখনি? তার বুক গলায় মাথায় কোনো বৃক্ষতত্ত্ব , রাত বাড়লেই কবিও যেন আত্মরক্ষার রং
খোঁজে, উদ্ভাসিত চেতনার রমন খোঁজে, শব্দের সপ্রতিভতায় লিখে রাখে- ‘ অনেক গভীর রাতে
আমি রোজ বাজপাখি হয়ে যাই- বাজপাখি হই,/ পাহাড়ের বাজপাখি এবং আকাশে উঠে এ সকল উড়ে-উড়ে দেখি।/এই সমভূমি থেকে ওই পাশে
শেষ চূড়া অবধিই রোজ রাতে দেখি।/তৃতীয়ার জোছনায় যদি উড়ে-উড়ে দেখি তবে সবচেয়ে ভালো
লাগে।/তৃতীয়ার জোছনায় এ সকল মিলে মিশে নিটোল ছবির মতো হয়”।
তবে পাখি কি কেবলই কবির খেয়ালপ্রসুত ! তাও বোধ হয় না ,
পুরাতনী সাহিত্যে কালিদাসের মেঘদূত থেকে শুরু করে কুমারসম্ভব ,রঘুবংশ বা ঋতুসংহারে
উদকলোল বিহঙ্গ, কুরর , ক্রৌঞ্চ, গৃধ্র, গৃহবলিভুক, পারাবাত, চক্রবাক,
হিরণ্যহংস,সরিদবিহঙ্গ, হারীত কিংবা সারিকার মত যে একাধিক পাখীর বর্ণনা এবং পাখিদের
দিয়ে যেভাবে কালিদাস কাব্যে দূতীর কাজ করিয়েছেন,কথা বলিয়েছেন কবির নিজের ভাষায়
সেখানে কিন্তু কেবলই কল্পনা নয় বরং পাখিকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক ও প্রাকৃতিক
দৃষ্টিভঙ্গীও গ্রথিত হয়েছে। পরিসর কম অত বৃহত আলোচনার ,তবে এ বিষয়ে গবেষক শ্রী
সত্যচরন লাহা মহাশয়ের গবেষনালব্ধ প্রবন্ধের দুটি অংশকে আমরা সরাসরি তুলে আনতে পারি
যাতে দেখা যাবে পাখি নিয়ে কবিদের অহংকার কেবল অসম্পূর্ণ তথ্যাশ্রয়ী অনুভূতির
স্পন্দন নয় বরং কখনও সখনও রূপকল্প নির্মানের পাশাপাশি বিহঙ্গবর্গের সঠিক আচরনও চিহ্নিত করে। যেমন
মেঘদূতে হংসদের প্রব্রজনের পথে কৈলাস বা মানসসরোবরের প্রসংগ এসেছে বারেবারে। ৫৮ নং
শ্লোকে হতভাগ্য যক্ষের কারাবাসভূমি হতে পাহাড় নদ নদী অতিক্রম করে প্রব্রজনশীল
হংসদের এই মানসসরোবরে প্রবেশ করতে হলে
ক্রৌঞ্চরন্ধ্রের ভেতর দিয়ে যেতে হয় বলে উদ্ধৃত হচ্ছে, কালিদাস যাকে হংসদ্বার
বলেছেন। “প্রালেয়াদ্রেরুপতটমতিক্রম্য তাংস্তান বিশেষান/হংসদ্বারং ভৃগুপতিযশোবর্ত্ম
যত ক্রৌঞ্চরন্ধ্রম/তেনোদীচীং দিশমনুসরেন্তির্যগায়ামশোভী/শ্যামঃ পাদো
বলিনিয়মনাভ্যুদ্যতস্যেব বিষ্ণোঃ”- (“পেরিয়ে
হিমালয়তটের বিস্ময়, হংসদ্বার পাবে সমুখে/ক্রৌঞ্চরন্ধ্র সে পরশুরাম যাতে যশের
পেয়েছেন পন্থা/দীর্ঘ,তির্যক তুমিও সেই পথে আবার উত্তরে চলবে,/শোভন যেন শ্যাম চরণ
বিষ্ণুর, সমুদ্যত বলিদমনে!”-অনুবাদ/বুদ্ধদেব বসু )-ঠিক এখান থেকেই সত্যচরন লাহা
মহাশয় বিশ্লেষন করে দেখিয়েছেন কালিদাসের কাব্যবর্ণিত হংসদ্বার নামটি কবির কল্পময়
হলেও তার উপস্থিতি কিন্তু ছিল; ভারতবর্ষ হতে সে সময় তিনটে গিরিবর্ত্ম দিয়ে
মানসসরোবর ও কৈলাসে যাওয়া হত- লিপুলেখ বর্ত্ম, উন্তধুর বর্ত্ম, এবং নিতি বর্ত্ম
এবং এই নিতিবর্ত্মই ভারতবর্ষের প্রাচীন কবিগনের কাছে ক্রৌঞ্চরন্ধ নামে পরিচিত ছিল।
পাশাপাশি এই মানসসরোবরে যে হাঁসেদের শীতের প্রাক্কালে পূর্ব হতে জড়ো হতে দেখা যায়
তাদের পক্ষীবিশারদ মুরক্রফট লার্জ গ্রে
ওয়াইড গুজ(Large grey wild goose) বলেছেন এবং এই গ্রে গুজ সম্পূর্ণ সাদা নয় বরং সাদার সাথে
লালের আভাযুক্ত। হংসীদের দেহবর্ণনায় অমরকোষ বারবার “চঞ্চুচরণৈর্লোহিতৈঃ সিতাঃ”
শব্দটির প্রয়োগ করেছে। এই সিতাঃ ‘সিত’ শব্দ থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ হল সাদা
কিন্তু সম্পূর্ণ সাদা নয় বরং সাদার সাথে অল্প গোলাপী বা ধূসর মিশ্রিত। ফলে দেহগত
বিবরণ থেকেও কালিদাসের পাখিরা যে বাস্তবে ছিল তার একটা নতুন আলোচনার ইন্ধনই জোগায়।
আবার ‘ঋতুসংহারে’ যৌবনভারনিপীড়তা নায়িকার পার্শ্বচরিত্র হিসেবে কালীদাসের কাব্যে
উঠে এসেছে ঋতুবিশেষে পাখীদের সমগ্র চিত্রটা। বর্ষার শুরুতে মেঘদূতে কবি যে হংসকে
ক্রৌঞ্চরন্ধ্রের মধ্যে দিয়ে মানস সরোবরে চিত্রিত করেছিলেন ঋতুসংহারে সেই হংসকেই
আমরা দেখতে পাচ্ছি শরৎকালের প্রেক্ষাপটে। আবার শরৎ চলে গেলে হেমন্ত এলে তুষারপাত
শুরু হলে ঋতুসংহারে সেই হংসকেও আমরা আর দেখতে পাইনা ; পাশাপাশি তার পরেই ষষ্ঠ
সর্গে কোকিলকে নিয়ে বসন্ত এল। পক্ষীবিশারদ ডেওয়ারও এই প্রব্রজনশীল হাঁসেদের
প্রেক্ষিতেই লিখেছেন- “The migrating birds continue to pour into India
during the earlier part of November. The geese are the last to arrive; they
begin to come before the close of October। অর্থাৎ কালিদাসের কবিতার পাখিদের কবিতার বাইরেও অস্তিত্ব আছে বলেই ধরে নেওয়া
যায়। তাঁর প্রব্রজনশীল হাঁসেরা সমস্ত শীতঋতু এদেশে অতিবাহিত করে বসন্তের শুরু শুরু
ফিরে যায় দেশান্তরে। যাই হোক, কালিদাসের কবিতায় পাখিদের অবস্থান হয়ত পৃথক আলোচনা দাবী
করে কিন্তু এক্ষেত্রে খুব সহজেই উঠে আসে যা তা হল কবিদের পাখীপুরানের পরস্পর
বিভাজিত অভিব্যক্তি। কোথাও সে শুধুই কল্পনা আবার কোথাও প্রাত্যহিক ঘটনাপরম্পরা
থেকে পাখিকে খুঁজে নেন কবি। কখনও পাখিকে না দেখেও চুপিচুপি ডাকটুকু শোনবার জন্য
কবি এগিয়ে যান, ডাকের সাথেই বেঁধে নেন নাভির শিকড় তো কখনও বা আবার বস্তুজগত ও
দৃশ্যজগতের সাথে পাখিকে বেঁধে নেন বাক প্রতিমা গঠনের তাড়নায়।
সে যাই হোক পাখির সাথে কবির সখ্যতা হয়ত চিরন্তন, আসলে কবিও
তো রক্ত মাংস গড়া মানুষ ,বাস্তব পৃথিবীতে নিজেকে প্রশ্ন করে মরছেন , পাখিরা যেমন
নিজের পালক ফোলাতে পারে তারও তো ইচ্ছে অল্প সময়ের জন্য হলেও নিজের সত্ত্বার ভেতর
শূন্যতাকে কিছুটা ফুলিয়ে নেওয়ার। তিনি উত্তর খুঁজে পাচ্ছেননা, কিছুতেই পৌঁছতে পারছেননা মূক শব্দহীন অন্তরভূমিতে, কিছুতেই ছুঁতে পারছেন
না আকাশের সান্নিধ্য। আমরা হয়ত তাকে দেখছি অতীন্দ্রিয় হোমা পাখির মত আকাশ থেকে
নেমে আসতে,আকাশেই ডিম পাড়তে আর মাটি ছোঁওয়ার আগেই নিষ্পন্দ নিথর ছোঁওয়ার আগেই ডানা
দুপাশে উঁচু করে অপার কোনো চৈতন্যলোকে উড়ে যেতে। তা হয়ত না, আর নই বলেই তো রোজ রোজ
কবি আসেন জলার ধারে, লুকিয়ে দেখেন সারসটিকে, লুকিয়ে দেখেন ওড়াটিকে,কবি তো সেই তালচোঁচ
একটু লক্ষ্য করলেই যাকে পুরোনো শিব মন্দিরে বা পূজার দালানে খুঁজে পাবে,জিউলির
আঠার মত চটচটে আর লাল ও গায়ের খসা পালক নিয়ে যে কুহকতত্ত্বে পড়ে আছে বিরাট এক ওড়ার
বাসনা নিয়ে। আসলে সেও তো এই উদ্ভিদজগত প্রাণিজগত এই আবহমান অনন্তের মাঝের কোনো এক
বোকা ইকারুস; রোজ মোম লাগিয়ে ডানা তৈরী করে।। রোজ উড়তে চায় আর সূর্যের কাছে গিয়ে রোজ গলে পড়ে মোহনার
পাড়গুলিতে!
কত পালক ! দেখ,-কত পালক !
পাখিটিকে দেখতে পাচ্ছনা নিশ্চয় ? কবিটিকেও !
এসো, পালকের আরও কাছে চলে এসো...
Lekhata aj sokalei porlam.Mon bhore gelo.khub bhalo lekha,
উত্তরমুছুনমার্জিনের কাকাতুয়া অনেক অন্দরে সেঁধিয়ে গেছে দেখছি। বেড়ে!
উত্তরমুছুন