কবিতা
অরুণাচল দত্ত চৌধুরী
বাঙাল মাছওয়ালা সংবাদ (সংক্ষেপিত)
বাঙালঃ-
পুণ্য জাহ্নবী চ্যুত ইলিশ অবতার
ক্রয় অন্বেষণে রত। বাঙাল পিতার
অতি গতভাগ্যপুত্র। দেশ ভাগ জাত
সেই আমি। কহ মোরে, তুমি কে গো ভ্রাতঃ
বিক্রেতাঃ-
বৎস, তোর জীবনের শৈশব থালাতে
প্রথম ইলিশ মাছ যে ঢেলেছে পাতে
সেই আমি আসিয়াছি বাজারের মাঝ,
তোরে দিতে ইলিশের পরিচয় আজ
বাঙালঃ-
দাদা, তব প্রাইস ট্যাগ কিরণ সম্পাতে
চিত্ত বিচলিত মোর, মুগুর আঘাতে
চূর্ণ বরফের মত। তব কণ্ঠস্বর
যেন পূর্বজন্ম হতে পশি কর্ণ-'পর
জাগাইছে অপূর্ব বেদনা। কহো মোরে
মূল্যখানি বাঁধিয়াছ কী রহস্য-ডোরে
এত উচ্চে হে মাছওয়ালা?
বিক্রেতাঃ-
জানতে চাস?
তবে ধৈর্য ধর। যাবতীয় রহস্যের ফাঁস
ধীরে ধীরে খুলে দিই। সমুদ্র ফেরৎ
এই ইলিশ…
বাঙালঃ-
সামুদ্রিক? তার জয়রথ
কেমনে তা’ প্রবেশিল বাংলার হেঁসেলে
সুক্ষ্ম কাঁটাময় দেহ, তবু তারে খেলে
জিহ্বাতে যে অপূর্ব ভাবের উদয়
স্বর্গস্বাদ চেয়ে তাহা মোটে ন্যূন নয়
মহাভাগ…ব্যক্ত করো সেই ইতিহাস
বিক্রেতাঃ-
শোন তবে, দেখা দিলে পূবালী বাতাস
প্রকৃতির নির্ধারিত নিয়মের বশে
নোনা জল ছাড়ি মৎস্য মিঠাজলে পশে।
আষাঢ় শ্রাবণ মাসে তারা এসে যায়।
প্রবেশে নদীতে। তারা গঙ্গায় পদ্মায়
কোটি কোটি ডিম পাড়ে। মৎস্য শাবকেরা
জন্ম নেয়। এই বার মোহানায় ফেরা।
জটিল জীবনচক্র অতীব প্রাচীন
মানুষেরা ভাঙে… যারা কাণ্ডজ্ঞানহীন।
নাবালক জাটকা ও ইলিশের খোকা
রাশি রাশি মারা পড়ে। সমুদ্রে ঢোকা
হয় না জীবনে আর। লবনাম্বুরাশি
মাঝে সন্তরণ সাধ ওঠে না উদ্ভাসি।
তাই মূল্য কম রাখতে হয়েছি অক্ষমও
মেটাই না ক্রয়সাধ
বাঙালঃ-
শুনি স্বপ্নসম,
বিক্রেতা, তোমার বাণী। হেরো, অন্ধকার
ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে, লুপ্ত চারি ধার--
শব্দহীনা ভাগীরথী। গেছ মোরে লয়ে
কোন্ মায়াচ্ছন্ন লোকে, বিস্মৃত সময়ে,
চেতনাপ্রত্যুষে। পুরাতন সত্যসম
তব বাণী স্পর্শিতেছে মুগ্ধচিত্ত মম।
অস্ফুট শৈশবকাল যেন রে আমার,
যেন মোর প্রাথমিক লোভের আঁধার
আমারে ঘেরিছে আজি। হে মাছওয়ালা
সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, আমিও তো ওলা
মাঝে মধ্যে চেপে থাকি। রয়েছে সঙ্গতি।
জিভে লালা ঝরে, দুঃখে ঝরে আঁখিলোর
তুলাদণ্ডে তোল মাছ দু’এক কিলোর
বিক্রেতাঃ-
অ্যাডাল্ট ইলিশ ভাই ক্রমশ দুর্লভ
বাংলাদেশ, মায়ানমার, আরও কতসব
প্রান্ত থেকে সংগৃহীত কিছু মৃতদেহ
কত সুপ্রাচীন তাহা জানে নাকো কেহ
মণি ও মাণিক্যসম অতি যত্ন ভরে
বিক্রয়ের জন্য আনি বরফ কোটরে।
তাই বিনিময় মূল্য উঁচু থাকে বাঁধা।
জ্ঞানের প্রভাবে তোর কেটে যাক ধাঁধা
সমুদ্রে ফিরুক এবে নব জাতকেরা।
লবণজলের স্নেহে স্বাদে গন্ধে সেরা
হোক তারা। যে জীবন তারা চায়... ইস্
সাধ যেন পূর্ণ করে সে খোকা ইলিশ।
বাঙালঃ-
আজি এই মার্কেটের তিমিরফলকে
প্রত্যক্ষ করিনু পাঠ জ্ঞানের-আলোকে
অবিমৃষ্যকারিতার এই স্তব্ধ ক্ষণে
অনন্ত আকাশ হতে পশিতেছে মনে
জয়হীন চেষ্টার সংগীত, আশাহীন
ক্রয়ের উদ্যম-- হেরিতেছি শান্তিময়
শূন্য ব্যাগ মোর। মধ্যবিত্ত পরাজয়।
এ’পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না আহ্বান।
ইলিশ ঢোকাক ব্যাগে ধনীর সন্তান--
আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে।
খাব না ইলিশ, ডিও দেব না বগলে
নামহীন, গৃহহীন-- পয়সাহীন গাধা
আমারে নির্মমচিত্তে তেয়াগো রে দাদা
দীপ্তিহীন কীর্তিহীন পরাভব-'পরে।
শুধু এই আশীর্বাদ দিয়ে যাও মোরে
সর্বনাশা লোভ ত্যাগি হই যেন জয়ী
খোকা ইলিশের মোহে ভ্রষ্ট নাহি হই।
উফ উফ উফ। কী অসাধারণ! মেধা ও ভাষাজ্ঞানের এত অপূর্ব মিশেল দেখে বার বার চমকে যাই, স্থির হই। অরুণাচলদা তোমায় প্রণাম৷
উত্তরমুছুনচমৎকার
উত্তরমুছুন