সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

আমার জয় গোস্বামী - পৃথা রায়চৌধুরী



আমার জয় গোস্বামী
পৃথা রায়চৌধুরী

 
 জয় গোস্বামীকে আমি কোনোদিন চোখে দেখিনি, আবার -জয় গোস্বামীকে  দেখেছিও বটেকোনো মুহূর্তে ভীষণ একলা লাগলে জয় গোস্বামীকে আমি আমার সামনে দেখতে পাইযখন আমার ভালোবাসার মানুষটি আমার সাথে ঝগড়া করে, তখন যেন মনে হয় আমার যন্ত্রণাকে ভেবেই জয়  লিখছেন সেই অমর কাব্য হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি ব'লে 
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে,
যখন আমার হৃদয় ভাসানো ভালোবাসা চলে যাচ্ছে অতলে যার সন্ধান আজও হয়তো আমার ভালোবাসার মানুষ পায়নি

 জয় গোস্বামী সত্তর দশক থেকে লিখছেনতাঁর সাথে আমার প্রথম আলাপ মেঘ বালিকার জন্য রূপকথা কবিতা বন্ধুদের কাছে শুনে তার পরপরেই ধানবাদের প্রান্তিক অঞ্চলের মেয়ের হাতে এলো একটি ক্যাসেট; ব্রততীর গলায় মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয় চিরকালীন স্থান করে নিলো আমার পরানখানায়সেই বিখ্যাত কবিতা, যে কবিতায় একটি মেয়ে ভালোবেসে নষ্ট হয়ে যায়যে মেয়েটি তার প্রেমিককে আরেকটি মেয়ের সাথে দেখে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়, আর বাড়িতে এসে বলে, “ওদের ভালো হোক

আমি শুধু একটি দিন তোমার পাশে তাকে
দেখেছিলাম আলোর নীচে অপূর্ব সে আলো
স্বীকার করি দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার পুড়িয়ে দিলো চোখ
বাড়িতে এসে বলেছিলাম ওদের ভালো হোক

সেই প্রথম, জয় গোস্বামীকে চেনার একটা অদম্য ইচ্ছে আমাকে পেয়ে বসেছিলএমন সময়ে হাতে এলো আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো বইটিপ্রথম মুদ্রিত অক্ষরে পেলাম আমার প্রিয় কবিকে
বন্ধুবান্ধবীদের মুখে শোনা মেঘবালিকার জন্য রূপকথা যেন হঠাৎ আমার সামনে খুলে দিলো রূপকথার এক জগৎআমার প্রার্থিত এতদিনের পুরুষকে মুহূর্তের মধ্যে পালটে দিলো এই কবিতাটি
অন্য সব মেয়ের মতো আমিও চাইতাম, আমার ভালোবাসার মানুষটি সুদর্শন হোক, বৈভব থাকুক তারএই প্রথম মনে হল, আমার জন্য কেউ দুলাইন কবিতা লিখুকমনে হল কেউ বলুক---- 'তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে '
ভেসে গেলো পার্থিব সবকিছুধন, গৌরব, সম্মান, সামাজিক দায় এক অমোঘ ঝড়েভালোবাসা হলে এভাবেই হোক

সেই থেকে সম্পূর্ণ অচেনা এক কবি, তাঁর কবিতা দিয়ে জায়গা করে নিলেন আমার মনের মণিকোঠায়বইয়ের শেষ পাতার পরে সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জিতে দেখলাম তাঁর বাড়ি রাণাঘাটজন্ম ১০ই নভেম্বর, ১৯৫৪ কলকাতায়; ৫ বছর বয়েস থেকে রাণাঘাটেবাবার মৃত্যু ৮ বছর বয়েসেতথাকথিত শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলেপ্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯ বছর বয়েসে সীমান্ত সাহিত্য, “পদক্ষেপ এবং হোমশিখা নামক তিনটি লিট্‌ল ম্যাগাজিনে, ১৯৭৬ সালে প্রথম লেখা ছাপা হয় দেশ পত্রিকায়
১৯৯০ সালে বের হয় তাঁর আরেকটি বই, “ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা যার উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল 'যারা ভালোবাসে'

এই একটি বই যেই বইটির পর জয় গোস্বামী যদি আর নাও লিখতেন, তাহলেও কবিতা পেয়ে যেত এক অমর কবিকে প্রতিটা পাতায় মণিমুক্তা
দেখা যাক-  'স্নান'কবিতাটি --

'সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই
তাকিয়েছি দূর থেকেএতদিন প্রকাশ্যে বলিনি
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে

জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে বলে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে

আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?

শোনো, আমি রাত্রিচরআমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন করে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধরে ব্যধিঘোর কাটেনি আমারআমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব বলে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি

দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত করে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়'

এই কবিতায় পাওয়া যায় প্রতিভার ঝলক অসম্ভব মেধা ও সহজাত প্রতিভা না থাকলে এই লেখা সম্ভব না শাণিত ছুরির মত লেখা প্রেমের তীব্র প্রকাশ এই কবিতা সাহসী উচ্চারণে নস্যাৎ করা সব কিছুকেই তাই বুঝি প্রকাশ্যে স্নান !ইন্দ্রিয়জ অনুভূতি তথা বোধ প্রকৃতি ও পুরুষের মেলবন্ধনে ফুটে ওঠে এই কবিতায় স্রোতের মত ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের


■“মহৎ কবিতার চারটি লাইন এরকম-
'তোমাকে নিশ্চয় আমি পুত্র রূপে চাইতাম ঠাকুর,কিন্তু তুমি
এই জন্মে কোথাকার কোন এক মেয়ে হয়ে এসে
যেভাবে আমার মন কেড়েছো তুলনা হয় না তার
আজ পুনঃ পুনঃ মরি ওই হাতে, পরিচর্যা করো মৃত্যুখানি ... '

ভাবা যায় ! কি অনন্য মুন্সিয়ানা এভাবেও যে ভাবা যায় তা অনুধাবন করলাম এই কবিতা পড়ে

মায়ের মৃত্যুর পর এই ক্ষীণজীবী কবি লিখলেন সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সবথেকে ছোট কবিতাগুলির একটি, যার অমোঘ শব্দাবলী বয়ে আনল শুধুই হাহাকারমা নেই, তাঁকে আর ডাকা যাবে না কোনোদিনতীব্র দহন যেন নেমে এলো দুটি লাইনের কয়েকটি আখরেকবিতাটির নাম বাৎসরিককবিতাটি হল-
'নাম লিখেছি একটি তৃণে
আমার মায়ের মৃত্যুদিনে '

আর একটি কবিতা  তিল, যেখানে কোনো একটি মুখে একটি তিলে কবি ভালোলাগায় মরে যান
তণ্ডুলের পাশ থেকে উঠে
একটি তিল হাওয়ায় হাওয়ায়
সারাদিন ধরে মাথা কুটে
শেষে একটি মুখ খুঁজে পায়
চিবুকের ঠিক পাশে ওর
প্রিয় স্থানটিতে বসে, আর
কবি দ্যাখে ওই বালিকার
তিলফুলে মরেছে ভ্রমর

আবার, চরম প্রেমে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে লিখলেন প্রেমের এক আশ্চর্য কবিতা-
'তোমার সঙ্গে ঘুমবো আজ
মাটিতে হোক, আগুনে হোক জলে
যেখানে বলো ঘুমবো আজ
যেখানে পারি জায়গা করে নেবো
এখন আমার হুঁশ নেই আর
কোন কালীর দিব্যি
ভালোমন্দ চুলোয় যাকগে
মোদ্দা কথা শোনো-
তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না'

এর আগে খুব কম বাংলা কবিতায় এভাবে প্রেমাস্পদকে পাওয়ার আর্তি দেখা যায়সরল অতিসরল কিছু বাক্য কিভাবে মনের কথা অকপটে বলে দিলো

আবার, আরেকটি কবিতায় লিখলেন
ধুলোরও অনুমতি আছে
পথেরও আপত্তি কিছু নেইগাছ?
জানি, সেও রাজি হয়ে যাবে
যদি আমি
একবার সাহস করে ওই,
ওই একজনকে নিয়ে গাছের, ধুলোর পথে
সারাদিন লুকিয়ে ঘুমোই!

কবি চাইছেন যাকে তিনি ভালোবাসেন এবং জানেন সেও তাঁকে খুব ভালোবাসে, সে যেন অন্তত একবার লুকিয়ে হলেও তাঁকে তার সবটা দিয়ে ভালবাসুক

এই বইতেই আছে সেই অসাধারণ চার লাইন,
'অসামান্য আগুন, সেই
আগুন অসাধারণ
একটিবার রেখেছ হাত
দুবার রাখা বারণ!'
আমাদের অনেকের জীবনেই ঘটে এই ঘটনা , যেখানে প্রেমিককে বাধ্য হয়ে প্রেমিকার হাত থেকে রাখি পরতে হয় আর ভুলে যেতে হয় ভালোবাসা বা ভালোলাগা একটুকরো সুতো আটকে দেয় ভালোবাসাকে এই কবিতাটার নাম 'রাখি'

আমার আরেকটি প্রিয় কবিতা হলো - শ্রাবণ
ওই মেয়েটির কাছে
 সন্ধ্যাতারা আছে

একটি মেয়ের কাছে তার পরম প্রাপ্তি হল, সে তার ভালোবাসার মানুষের কাছেশুধুই তুমিহয়ে থাকতে চায়কত শত প্রেমিক তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে, ভাষায় এই কথা অগুনতি বার তাদের নিজের প্রেয়সীদের বলেছেঅথচ, আমার প্রিয় এই কবি, কেবলমাত্র পাঁচটি শব্দকে কবিতার আকার দিয়ে আমার মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে গেলেনএতো পরিপূর্ণ ভাবে ভালোবাসা দুটি অসামান্য লাইনে-
ওই মেয়েটির কাছে
সন্ধ্যাতারা আছে
একটি মেয়ের এর থেকে বেশি কিই বা চাওয়ার থাকতে পারে? সে এইটুকুতেই বুঝতে পারছে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার প্রেমিক তাকে তার আলোর দিশারী মনে করে; সে তার প্রেমিকের জীবনের সুখ, দুঃখ, ছোট, বড়, সমস্ত কিছুর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ মেয়েটির অপার সুখ এই ভেবেই যে সে তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে অপরিহার্য এখানেই কবি অসাধারণ এক প্রেমিক সত্ত্বা দেখিয়েছেন, এবং সমস্ত মেয়ের মনে ঠিক এরকম ভালোবাসার কথা বলতে পারা প্রেমিকের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন

     এক প্রেমিক কতখানি ভালোবাসলে, যাবতীয় অধিকারবোধে অকপটে স্বীকার করতে পারে যে শুধু সুমিষ্ট ভালোবাসার কথা বা মুহূর্তেই সে তার প্রিয়াকে কাছে চায় না, বরং প্রতিটি দিনের ছোটোখাটো খুঁটিনাটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ মুহূর্তেও তাকে ঠিক তার পাশেই চায় আজীবন, তা ভীষণ ভাবে ফুটে ওঠে জয় গোস্বামীর পাঞ্চালিঃ দম্পতিকথাকবিতায়রোমাঞ্চিত হই ভেবে যে কি সরল বাক্যে উনি প্রেমিকের মনের ভাব প্রকাশ করে গেছেন, যার কোমল তীব্রতা হৃদয়ে বান ডেকে যায়-
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙ্গব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন

আবার কোথাও বলেছেন-
পাগলী, তোমার সঙ্গে আশাপূর্ণ জীবন কাটাব
আমি কিনব ফুল, তুমি ঘর সাজাবে যাবজ্জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় জওয়ান জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে জয় কিষাণ কাটাব জীবন


এই চরমতম প্রেমিক কলমই আবার তুলে দেয় এক নিপীড়িতা বিবাহবিচ্ছিন্না নারীর দুঃখ, পাঠক হৃদয়ে, তাঁর প্রাক্তন”-এ সেই প্রাক্তন স্ত্রীর কথন যা থেকে ঝরে পড়ে তার জীবনের অত্যাচারী পুরুষটির প্রতি অদ্ভুত এক ভালোবাসা, যা কিনা রূপান্তরিত হয়েছে এক ধরনের বিষাদ ছাওয়া মমত্ববোধেসে হুতাশ করে ওঠে-
টেবিলঢাকা মেঝের ওপর
সমস্ত ঘর ছাই ছড়ানো
গেলাস গড়ায় বোতল গড়ায়
টলতে টলতে শুতে যাচ্ছে

কিন্তু বোতল ভেঙে আবার
পায়ে ঢুকলে রক্তারক্তি
তখন তো আর হুঁশ থাকে না
রাতবিরেতে কে আর দেখবে!
পরমুহূর্তেই সেই মেয়েটির প্রতি বিষোদ্গার করে, যার জন্য তার সংসার ছারখার— “কেন, সেই মেয়েটা
সারা কবিতাটিতে এই নারীর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই, তার মাতাল, লম্পট স্বামীটি কেমন আছেহাহাকার, স্বাভাবিক ঈর্ষা ও ভালোবাসার মিশেলে এখানে কবির কলমে নারী মহিমান্বিত

নে পড়ে, আমার বাড়িতে এক বুড়ি আসতো মুড়ি, ‘ভালোচাল, নাড়ু, এসব দিতেতাকে আমি নাম দিয়েছিলাম মুড়ি মাসিএসে আমার কাছে দৈনন্দিন গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতো সেই বুড়িরোগা শরীরে মাথায় এক বিশাল বস্তা নিয়ে ফিসপ্তাহে সে হাজির হতোতার কথা কিছু শুনতাম, কিছু শুনতাম না একদিন বলেছিলাম জয় গোস্বামীর ছবি দেখিয়ে, “জানো মাসি, তোমাকে নিয়ে এই লোকটা কবিতা লিখেছেসেই শুনে তার কি হাসি, তার কথা নিয়ে নাকি অচেনা কেউ কবিতা লিখতে পারে, এটা খুব মজার ব্যাপারঅথচ কি অবলীলায় কবি এই সব মহিলাদের কথা লিখেছেন তাঁর মাসিপিসিকবিতায়এখানে উনি এই সমস্ত খেটে খাওয়া মহিলা, যারা প্রতিদিন শত কষ্ট, অসুবিধা অগ্রাহ্য করে শহরে আসেন জীবিকার আশায়, তাদের কথাই বলেছেন
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মস্ত পরিবার
অনেকগুলো পেট বাড়িতে, একমুঠো রোজগার

ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির পোঁটলা পুঁটলি কোথায়?
রেল বাজারের হোমগার্ডরা সাত ঝামেলা জোটায়

সাল মাহিনার হিসেব তো নেই, জষ্টি কি বৈশাখ
মাসিপিসির কোলে-কাঁখে চালের বস্তা থাক

     চোখের সামনে যেন একটি সদ্য কলেজ হোস্টেলে আসা, খুব সম্ভবত এক মফঃস্বলের ছেলের প্রতি পুরনো ছাত্রদের অত্যাচার ফুটে ওঠে কবির জীবন্ত কলমে, তাঁর র‍্যাগিংনামক কবিতায়ইচ্ছে করে, ছুটে গিয়ে ছেলেটিকে তাদের কবল থেকে রক্ষা করি আবার পরোক্ষে এই হয়তো জীবনের চরমতম শিক্ষার ভিত হয়ে দাঁড়ায় তার জন্যসে শিখে ফেলে, বুঝে যায় যে কিছু পেতে হলে মুখ বন্ধ করে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে
না বললেই মার খাবে, হাঁ বললেও দাঁড়াতে দেব না
জানো না, মানুষ মাত্রেই পারঙ্গম লঘুগুরু কণা
একত্র মিশিয়ে ফেলে অনুতাপ করে রুনুঝুনু
মারহাব্বা কাটা ঘা-য় শোভানাল্লা নুন ছিটে ছিটে
পথেই গুরুত্বপূর্ণ পান্থশালাএইখানে খেলা ও বিশ্রাম
ভাগ ভাগ করা আছেপিতা, মাতা, নাম, ছদ্মনাম
সব লিখিয়ে ঢুকতে হয়...পেটে খেতে হলে কিন্তু পিঠে
সইয়েও নিতে হয় দু ঘা দশ ঘা, যে যতটা পারো...

'যে ছাত্রীটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে' কবিতায় কবি নিজেই প্রশ্ন করেন আবার নিজেই উত্তর দেন এই সংলাপধর্মী কবিতাটি অনায়াসে তুলে ধরেছে একটি কিশোরীর মনের কথা সে বুঝতে পারছে আস্তে আস্তে জীবনকে একটি মেয়ের জীবনে কতটা যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা যেন চোখের সামনে উঠে আসছে

কী বুঝেছে সে-মেয়েটি ?
সে বুঝেছে রাজুমামা মায়ের প্রেমিক

কী শুনেছে সে-মেয়েটি ?
সে শুনেছে মায়ের শীৎকার

কী পেয়েছে সে-মেয়েটি ?—সে পেয়েছে জন্মদিন ?
চুড়িদার, আলুকাবলিকু-ইঙ্গিত মামাতো দাদার

সে খুঁজেছে ক্লাস নোট, সাজেশন
সে ঠেলেছে বইয়ের পাহাড়

পরীক্ষা, পরীক্ষা সামনেদিনে পড়া, রাত্রে পড়া
ও পাশের ঘর অন্ধকার

অন্ধকারে সে শুনছে চাপা ঝগড়া, দাঁত নখ,
ছিন্ন ভিন্ন মা আর বাবার


সে জানছে মায়ের প্রেম, কামনার কথা, মেয়ে হওয়ার পরিনাম , সে পড়ছে কারণ তাকে দাঁড়াতে হবে আর শুনতে পাচ্ছে বাবা- মায়ের দাঁত, নখ বের করা ঝগড়া মামাতো দাদাও যে শরীর ঘাঁটতে চায় এই উপলব্ধিও হচ্ছে তার সে তাই মায়ের প্রেমকে হয়তো বা সমর্থনও করে , যদিও কবি আমাদের সে কথা বলে দেননি তবু পাঠক নিজেই ভেবে নেবে পরের অংশটা -- এটাই কবিতার ভেতরের কবিতা মেধার ঝলকানি নেই, দেখনদারী নেই , সরল শব্দের ব্যবহারে ফুটে উঠেছে সমাজের ক্রাইসিস


'মেঘ বলতে আপত্তি কি' কবিতার কিছু লাইন --

'আত্মীয় হয় .. আত্মীয় হয় ? আত্মীয় না ছাই
সত্যি করে বল এবার, সব জানতে চাই
দু এক ক্লাস এর বয়স বেশি, গ্রীষ্ম ছুটি হলে
ঘুরেও গেছে কয়েক বছর, এই জানে সক্কলে
আজকে দগ্ধ গ্রীষ্ম আমার তোমায় বলতে পারি
মেঘ দেখতাম, ছাদের ঘরে, ফুলপিসিমার বাড়ি'

বয়ঃসন্ধি কালের আবেগঘন প্রেম, ফ্যান্টাসি -যা কিছুটা নিষিদ্ধও বটে তা বর্ণীত হয়েছে এখানে যার সাথে প্রেম সে কেমন ? আত্মীয় শুধু আত্মীয়ই নয় সে বয়সেও বড়, হয়তো দিদি স্থানীয় কিন্তু সেটা কবি মানতে চান না প্রেমের আকুল আর্তির কাছে সব ক্লিশে হয়ে যায়  

টিউটোরিয়াল কবিতাটি তুলে ধরে এক অসহায় বাচ্চার কথা । ইঁদুরদৌড়ে দৌড়তে
দৌড়তে যে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ।
তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এই জন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?
বাবার মনোমত মার্কস্‌ না পাওয়াতে যাকে শুনতে হয় এমন শলা ফোটানো কথা ।  নিজেকে অপদার্থ ভাবতে ভাবতে যে একদিন বলে ---

না বাপী না, একজন আছে, অপু, একক্লাসে পড়ে
ও বলে যে ওর বাবাও বলেছে প্রথম হতে
বলেছে, কাগজে ছবি, ওর বাবা, ওকে ….
হ্যাঁ বাপী হ্যাঁ, না না বাপী, অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম
বলেছে ও ব্যাক পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায়
বাথরুম সাফ করার অ্যাসিড আছে ও জানে,
হ্যাঁ বাপী হ্যাঁ, ও বলেছে,
উঠে যাবে কাগজের প্রথম পাতায় …..
হয়তো এটা তার নিজের পরিনতির কথাই সে বলতে চেয়েছে । এভাবেই নাম তুলবে সেও ।জানিনা তার বাবা বুঝবেন কিনা , কবি এখানে চুপ করে থেকেছেন আর দায় চাপিয়েছেন পাঠকের ওপর । এই কবিতা পড়ে একটি প্রাণও যদি বেঁচে যায় সেটাই কবির সার্থকতা ।

এমন কত কত কবিতা আছে বলার । মা নিষাদ, নুন, সৎকারগাথা - বলে শেষ করা যাবেনা । আমার জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে বলার ক্ষমতা সামান্য । 
কবি যখন কবিতা লিখবেন তিনি ঢুকে যাবেন চরিত্রে

জয় গোস্বামীর কবিতা আসলে আমাদের রোজনামচা আমরা যা দেখছি চারপাশে তার জ্বলন্ত প্রতিফলন কবিতা মানে যে কেবল শব্দের বিন্যাস- সমবায় নয়, নয় কিছু অনাবশ্যক মেধার দেখনদারী সেটা জয় গোস্বামী প্রমাণ করেছেন তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে এই কারনেই সমাজের নিচু তলার মানুষ থেকে উচ্চবিত্তদের কথা অনায়াস ভঙ্গীতে বলে গেছেন তিনি যে কবিতা একবার পড়ে আবার পড়তে ইচ্ছে হয় সেটাই সার্থক কজন কবিকে চিনি আমরা ? কিন্তু জয় গোস্বামীর নাম সবাই জানে রিলায়েন্স কোম্পানি যেমন মুঠোফোনকে এনে দিয়েছে আম জনতার কাছে তেমনই কবিতাকে জনারণ্যে মিলিয়েছেন জয় গোস্বামী এখানেই তাঁর সার্থকতা



তাং- ১১ /০১ / ২০১৩ ( ইং )

১৩টি মন্তব্য:

  1. অনেক ভালো লেগেছে,সাবলীল টু দ্য পয়েন্ট লেখা... :)

    উত্তরমুছুন
  2. "অন্য সব মেয়ের মতো আমিও চাইতাম, আমার ভালোবাসার মানুষটি সুদর্শন হোক, বৈভব থাকুক তার। এই প্রথম মনে হল, আমার জন্য কেউ দু’লাইন কবিতা লিখুক। মনে হল কেউ বলুক---- 'তোমার জন্য নতুন করে লিখব তবে '
    ভেসে গেলো পার্থিব সবকিছু। ধন, গৌরব, সম্মান, সামাজিক দায় এক অমোঘ ঝড়ে। ভালোবাসা হলে এভাবেই হোক।" 👌

    উত্তরমুছুন
  3. যেমন জয় গোস্বামীর কবিতার সাবলীলতা , তেমনি সাবলীল পৃথার আলোচনা। কবির লেখার মর্মে অনুরণন তুলেছেন পৃথা !ধন্যবাদ পৃথা।

    উত্তরমুছুন
  4. জয় গোস্বামীর মাতা ও পিতার নাম যদি কেউ জানান তো খুবই উপকৃত হই।

    উত্তরমুছুন
  5. দারুণ লাগল এটা পরে

    উত্তরমুছুন
  6. দারুণ লাগল এটা পড়ে।

    উত্তরমুছুন