সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

আমার রবীন্দ্রনাথ - ইন্দ্রাণী সরকার

আমার রবীন্দ্রনাথ
ইন্দ্রাণী সরকার


রবীন্দ্রনাথআমার জীবনের সঙ্গে যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত| তাঁর এক একটি গান যেন আমারিমনের বিভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ করে | তাঁর ছোটগল্প, উপন্যাস, গীতিনাট্য, চিত্রকলা আমায় সদাই মোহিত করে থাকে | সব কিছুর মধ্যে আমি যেন আমার ভাবনারপ্রকাশ দেখি|
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা সাহিত্যেরএকমাত্র নোবেল বিজয়ী কবি হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্ব-দরবারেমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আমাদের এক অনন্য গৌরব। তার জন্যবাংলাভাষী প্রতিটি মানুষ যথার্থই গৌরববোধ করে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বনন্দিতএক অমর কবি-প্রতিভা। বেদ-উপনিষদের চিন্তা-দর্শন তার সাহিত্যে প্রতিফলিতহলেও, সে চিন্তা-দর্শন জানার বা অনুসরণ করার উদ্দেশ্যে অনেকে তার সাহিত্যপাঠ করলেও, যারা তার চিন্তা-দর্শন-আদর্শের অনুসারী নয়, তারা মূলত তারসাহিত্যের ভাব, শৈল্পিক উত্কর্ষ ও মানবিক আবেদনে মুগ্ধ-আপ্লুত হয়েই তা পাঠকরি। তার সাহিত্যের ভাষা ও গুণগত উত্কর্ষ পাঠকের জন্য একটি বড় আকর্ষণ। সেকারণে রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রিয় কবি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার বিপুলঅবদানে উত্কর্ষমণ্ডিত ও সুসমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনিবিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাইসব বাংলাভাষীর কাছে তিনি বরেণ্য ও আদরণীয়। বাংলা সাহিত্যের তিনি শ্রেষ্ঠকবি, বাংলাভাষী সব মানুষের তিনি গর্ব।
তাঁর প্রথম কবিতা হল...জল পড়ে পাতা নড়ে| কবি তাঁর "জীবন স্মৃতি" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন :
"
তখনকর, খল প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিনপড়িতেছি জল পড়ে পাতা নড়েআমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিলজিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় নাতাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় নামিলটাকে লইয়াকানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া, সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল।

আমিকবিতা লিখি, এ খবর যাহাতে রটিয়া যায় নিশ্চয়ই সে-সম্বন্ধে আমার ঔদাসীন্যছিল না। সাতকড়ি দত্ত মহাশয় যদিচ আমাদের ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন না তবু আমারপ্রতি তাঁহার বিশেষ স্নেহ ছিল। তিনি প্রাণীবৃত্তান্ত নামে একখানা বইলিখিয়াছিলেন। আশা করি কোনো সুদক্ষ পরিহাসরসিক ব্যক্তি সেই গ্রন্থলিখিতবিষয়ের প্রতি লক্ষ করিয়া তাঁহার স্নেহের কারণ নির্ণয় করিবেন না। তিনিএকদিন আমাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি নাকি কবিতা লিখিয়া থাক।লিখিয়া যে থাকি সে কথা গোপন করি নাই। ইহার পর হইতে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবারজন্য মাঝে মাঝে দুই-এক পদ কবিতা দিয়া, তাহা পূরণ করিয়া আনিতে বলিতেন।তাহার মধ্যে একটি আমার মনে আছে

রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।

আমিইহার সঙ্গে যে পদ্য জুড়িয়াছিলাম তাহার কেবল দুটো লাইন মনে আছে। আমারসেকালের কবিতাকে কোনোমতেই যে দুর্বোধ বলা চলে না তাহারই প্রমাণ-স্বরূপেলাইনদুটোকে এই সুযোগে এখানেই দলিলভুক্ত করিয়া রাখিলাম

মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে
,
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।

ইহারমধ্যে যেটুকু গভীরতা আছে তাহা সরোবরসংক্রান্তঅত্যন্তই স্বচ্ছ। আর-একটিকোনো ব্যক্তিগত বর্ণনা হইতে চার লাইন উদ্ধৃত করিআশা করি, ইহার ভাষা ও ভাবঅলংকারশাস্ত্রে প্রাঞ্জল বলিয়া গণ্য হইবে

আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।"

রবীন্দ্রনাথঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত ওইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীরজন্ম দেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন।রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্বনির্দেশ করেছেন। প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতেরঅনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ওকীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। এই পর্বেররবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধিগুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিতকবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন। ১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাসশুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময়রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন। প্রথমবিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়। কবির এইসময়কার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহসুরসৃষ্টি। তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে। এইগ্রন্থের "পূজা", "প্রেম", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "আনুষ্ঠানিক" ও "বিচিত্র"পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিতহয়েছিল। ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে বাল্মীকি-প্রতিভা, কালমৃগয়া গীতিনাট্যএবং চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, ও শ্যামা সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।

রবীন্দ্রনাথেরসময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তুরবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেওঅন্তর্ভুক্ত করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদিনৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন। এই শৈলীটি "রবীন্দ্রনৃত্য" নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতেগানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে
রবীন্দ্রনাথঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনিতাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন | তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল "কঙ্কাল", "নিশীথে", "মণিহারা", "ক্ষুধিত পাষাণ", "স্ত্রীর পত্র", "নষ্টনীড়", "কাবুলিওয়ালা", "হৈমন্তী", "দেনাপাওনা", "মুসলমানীর গল্প"ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট তেরোটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এগুলিহল: বৌ-ঠাকুরাণীর হাট (১৮৮৩), রাজর্ষি(১৮৮৭), চোখের বালি (১৯০৩), নৌকাডুবি (১৯০৬), প্রজাপতির নির্বন্ধ (১৯০৮), গোরা (১৯১০), ঘরে বাইরে(১৯১৬), চতুরঙ্গ (১৯১৬), যোগাযোগ (১৯২৯), শেষের কবিতা (১৯২৯), দুই বোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) ও চার অধ্যায় (১৯৩৪) |
বস্তুত, রবীন্দ্রোত্তরকালে এমন কোনোবাংলাভাষী লেখক আছেন, যিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ দ্বারাপ্রভাবিত হননি? এই প্রভাব কখনও পড়েছে সাহিত্যের ভাব-পরিমণ্ডল সৃজনক্ষেত্রে, কখনও সংগঠন-নির্মাণে, কখনও-বা আঙ্গিক নির্মিতিতে। রবীন্দ্রনাথের কালে যারাকবিতা লিখেছেন, যারা পরিচিতি পেয়েছেন রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে, তাদেরপক্ষে অনিবার্য ছিল রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ এবং একই সঙ্গে অসম্ভব ছিলরবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। ফলে তার প্রবল দীপ্তির জোয়ারে অনেকেই হারিয়ে গেছেন, অনেকেই নির্মাণ করতে পারেননি নিজস্ব কোনো দ্বীপভূমি। প্রায় সকলেইএদিক-সেদিক ঘুরেফিরে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা-উপনিবেশেই আশ্রয়নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের বিয়োগান্ত রচনাগুলি আমায় ছোটবেলায় ভীষণ ভাবে নাড়া দিয়ে গেছে |
কোথা থেকে যে শুরু করব যেন বুঝতে পারি না...

সেই "জল পড়ে
, পাতা নড়ে" থেকে শুরু হয় যেমন কবির জীবনের ইতিহাস, আমিও যেন
সেই ইতিহাসের ভাগীদার হয়ে যাই | তারপর আমার যাত্রা শুরু হয় তাঁর গানে, কবিতায়, গল্পে, গীতিনাট্যে অনন্তধামের যাত্রী যেন আমি প্রতি পদে পদে, প্রতিটি মুহুর্তে তাঁর পথের পথিক | কবির "দুই বিঘা জমি" কবিতার আবেদন মাতৃভূমির প্রতি, "বীরপুরুষ" কবিতায় বালকের বীরত্ব,  "দেবতার গ্রাসে" ব্রাহ্মণের অনুশোচনা, "শিশুতীর্থে" কবির যীশুখ্রিষ্টের প্রতি শদ্ধা নিবেদন, "ডাকঘরে" অমলের প্রকৃতিপ্রেম ও রাজার সঙ্গে মিলিত হবার উচ্চাশা আরও কত কী যেন আর মনে পড়ে না |

তাঁর গান যেন এক রত্নভান্ডার | কোন রত্ন বেছে নেব তাই ভেবে কূল পাই না | এরই মধ্যে কবির "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি", "কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি", "আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার", "হৃদয়ক সাধ মিটাওল হৃদয়ে", "মন মোর মেঘের সঙ্গী", "মম চিত্তে নিতি নৃত্যে", "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু", "তুমি কেমন করে গান কর হে গুনী" আরও অনেক অনেক গান মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায় | তাঁর গান গেয়ে গেয়ে আমার জীবন যেন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে |

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন