সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

ব্যক্তিগত গদ্য - শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়

হে আশ্চর্য হে আকাশ ...
শাশ্বত বন্দ্যোপাধ্যায়



খোলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মুখে ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়া পেলে দেশের কথা খুব মনে পড়ে। বাড়িঘর, পাড়ার পুকুরটার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পুকুরপাড়ের রাধাচূড়া গাছটার কথা। গাছের সামনের রাস্তাটায় ক্রিকেট খেলতে খেলতে বল পড়ে যেত পুকুরের জলে। এদিক ওদিক থেকে ঢিল ছুঁড়ে তাকে টেনে আনা হত কাছে। সেই সব খোলামকুচিদের মনে পড়ে। একটু চ্যাপ্টা টুকরো পেলে তাকে নষ্ট করতাম না। ব্যাঙাচি করতাম। শরীরটাকে বাঁকিয়ে ঝুঁকিয়ে পুকুরের এপার থেকে ওপার জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে লাফ খাওয়াতাম ইঁটের টুকরোটাকে। একদিন খেলা সেরে সবাই চলে গেলে রাধাচূড়ার গায়ে ইঁট দিয়ে ঘষে ঘষে আপন খেয়ালেই লিখেছিলাম দুটো কথা লিখেছিলাম। লিখেছিলাম – “আমি”। আর লিখেছিলাম – “খেলা”। তখন আকাশজুড়ে নেমে আসছে গোধূলি। সন্ধ্যার ফিরিওলারা একজন দুজন করে শুরু করেছে চলাচল। দূরে গলির বাঁকে দুলে উঠছে ঘটিগরমের লন্ঠন। সেইদিন কোনো শব্দ করেনি রাধাচূড়া গাছ। তার গা ছুঁয়ে একা একা দাঁড়িয়ে দেখলাম কে যেন তার স্বর্ণাঞ্চলের শেষপ্রান্তটিকে টেনে সরে যাচ্ছে আমাদের আকাশ থেকে অন্য আকাশে। সেই অতীত আকাশকে মনে পড়ে খুব। সেসব আকাশ কী স্পষ্ট বদলে যেত ঋতুবদলে, উৎসবে। হাওয়ায় পুজো পুজো গন্ধ এলেই দেখতাম বিকেলের আকাশ একটু একটু করে ভরে উঠছে রঙিন ঘুড়িতে। পাখিদের সমস্যা হচ্ছে। শূন্যে বেড়ে যাচ্ছে ভিড়। সাইকেল থামিয়ে, গাড়ির ধাক্কা খেতে খেতে, বুড়ি ঠাকুমাকে ফেলে দিতে দিতে ছুটে যেত হল্লাবাজ বালকের দল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে গেলে বাড়ি ফিরে আসতাম। তখনও জানলা দিয়ে আকাশে দেখি দিনাবসান মেঘে মেঘে ভেসে যাচ্ছে অবোধ কোলাহল। ছাদে ঘুড়ি পড়লে আমি খুব আনন্দ করে কুড়িয়ে নিতাম। একটা পাটকাঠি কিংবা কাঠের টুকরোয় অনেকক্ষণ ধরে জড়িয়ে নিতাম কাটা সুতো। তারপর একসম বাবাই বা গুলুকে ডেকে দিয়ে দিতাম ঘুড়িটা। সেই সব ঘুড়ি ওড়াতে না-পারার দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে। দুঃখ ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো হাহাকার ছিল না মোটেও। আমি ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম না, কিন্তু রোজ বিকেলে দেখতাম মাথার ওপর দোল খাচ্ছে বন্ধুদের ঘুড়ি। ওদের জাদুকর মনে হতো। আর যাদের চিনি না একেবারেই, ওই ঘুড়ির সূত্রে তাদের সঙ্গেও অল্প পরিচয় হয়ে যেত। ভাইকে যখন বলতাম, দ্যাখ্‌ দ্যাখ্‌ শতরঞ্চিটা চুপিচুপি বাড়ছে ... লাল চৌখুপিটাকে শিওর এ্যাটাক্‌ করবে ... তখন ঘুড়ির ওই অতর্কিত স্বভাবের কথা বলে আসলে তো চিহ্নিত করতাম লাটাই হাতে তার চালকটিকেই। তারই নাম হয়ে যেত শতরঞ্চি বা লাল চৌখুপি। নিজের অজান্তেই কারো একটা পক্ষ নিয়ে নিতাম। আমার খুব ভালো লাগত ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি। মনে হত আকাশের কেউ যেন তাকে আঘাত না করে। সে নিজের মতো উড়ুক। উড়তে উড়তে আকাশের বুকে বিভোর হয়ে থাকুক একচিলতে ধূপছায়া রঙ। কোনো ময়ূরপঙ্খীকে দেখে কেউ “দেড়ি দেড়ি” বললেই, আমি চাইতাম ময়ূরপঙ্খী নেমে যাক। সরে যাক আরও দূরে। তবু একেকদিন দেখতাম শেষ বিকেলের মায়ালোকে ভাসতে ভাসতে চলেছে একটা ময়ূরপঙ্খী। আমি ওর জন্য লোভ করিনি। ওকে ভাসতে দিয়েছি। আপনমনে ভাসতে ভাসতে চলে যাওয়া সেই ময়ূরপঙ্খীকে মনে পড়ে। আজ বুঝি সে গিয়ে পৌঁছেছে আমার অকালমৃত বন্ধুদের দেশে। চন্দনামাসি নাকি ছেলেবেলায় পাড়ার ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে জুটে ঘুড়ি ওড়াত! ও-ই আমাকে নানান ঘুড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল। আমি ওড়াতে পারি না জেনেও, ওদের ছাদে ঘুড়ি এসে পড়লে, আমার জন্য রেখে দিত। ঘুড়ি ধরতে গিয়ে বেপাড়ার একটা ছেলেকে ভালো লেগে গিয়েছিল ওর। সেই ভালোলাগা বহুদিন ছিল। কিন্তু বলতে পারেনি। সৎমা জানতে পারলে মেরে গায়ের চামড়া তুলে নিত। চন্দনামাসি বলেছিল, আজও আকাশে ঘুড়ি দেখলে সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। এওতদিনে তার নিশ্চয়ই ঘরসংসার, ছেলেপুলে হয়ে গেছে... আকাশের দিকে চেয়ে থাকা চিরআইবুড়ো চন্দনামাসির দুঃখী অথচ প্রসন্ন সেই মুখখানা মনে পড়ে। আসলে ঘুড়ি-ওড়ার দিনগুলোয়, শরতকালের মেঘময় দিনগুলোয় আকাশে আকাশে ছড়িয়ে থাকে বন্ধুত্ব। আমার মতো মানুষদের জন্য নিঃশব্দ সখ্যতা। আর থাকে এক মায়ামাখানো স্বাধীনতা। মনে পড়ে কোজাগরীর আলোয় ভরে ওঠা আকাশ। কী অপরূপ সেই রাত্রিকাল, কী স্পর্শকাতর তার বিস্তার! সেইসব রাত্রির কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে কাঙাল মনে হত। কিছুতেই যেন প্রকাশ করতে পারছি না তাকে। বাড়িতে বাড়িতে পুজো হচ্ছে। আর ব্যক্তিগত সব প্রদীপের আলো একটু একটু করে মিশে যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। জ্যোৎস্না আমার এক পিসির নাম। লোকের বাড়ি বাড়ি ডিউটি করে। হপ্তায় হপ্তায় টাকা এনে তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে। আর রাত্তিরে মাতাল হয়ে ফিরলে ভাই পিসিকে ধরে মারে। জ্যোৎস্নাপিসি চুপ করে থাকে। লুকিয়ে টাকা জমায়। ছোট্ট ভাইঝিটার জন্য রূপোর দুখানা নুপূর গড়িয়ে দেয়। আকাশভরা চন্দ্রালোক দেখে জ্যোৎস্নাপিসির কথা মনে পরে। মনে হয় তার হাত থেকে রূপোর নুপূর চুরি করে গলিয়ে কে ঢেলে দিয়েছে আকাশে। অনাদি অনন্ত ওই প্রবাহের মধ্যে আজ বিরাজ করছে পিসি। কোনো অনাদর কোনো আঘাত আর স্পর্শ করতে পারছে না তাকে। লক্ষ্মীপুজো পেরোলেই হাওয়ায় বাজিমশলার গন্ধভাসে। দিকে দিকে জন্ম নেয় হাজার হাজার শাদা মোমবাতি। বাবা আর ভাইয়ের সঙ্গে বসে চিলেকোঠার বাজি তৈরির ঘরটার কথা মনে পড়ে। একটাই ছোটো বাটখারা ছিল আমাদের। তাই অনেকগুলো ভারী পাঁচটাকার কয়েনকে ওজন করে বাটখারার মতো ব্যবহার করতাম। আর সুবিধাও হত। অর্ধেক ওজনের কিছু লাগলে, পাল্লা থেকে গুনে গুনে কমিয়ে দিতাম অর্ধেক কয়েন। কালীপুজোর দিন রাত্তিরেই একবার দেখা গেল মশলা লেগে লেগে ওই কয়েনের ওপরগুলো ক্ষয়ে গেছে। আর চলবে না সেগুলো। ভয়ে বাবাকে বলিনি সে কথা। বাবার হাতে একটা ঘরে বানানো রঙমশাল ধরিয়ে দিয়েছিলাম। বাবা শিশুর মতো ঘোরাচ্ছিল। আর দূরান্ত অবধি চলে যাওয়া সেই আলোয় খুব খুশি হয়ে উঠছিলাম আমরা ভাইবোনেরা। তার পর মাকে বললাম গিয়ে বাবার সঙ্গে হাত লাগাতে। ‘এই বুড়ো বয়সে ... তোদের যত সব ...’ বলতে বলতে মা কথা শুনেছিল। সেইদিন রঙমশালটা শেষ হচ্ছিল না কিছুতেই। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের আকাশবন্ধুত্ব বুঝি ওর ভেতর ঢুকে পড়েছিল এক অনিঃশেষ প্রাণ হয়ে। আজ খুশি খুশি সেই মুখগুলো বড়ো মনে পড়ে। মণি বলছিল, দাদা ছবি তোলো ... ছবি তুলে রাখো ... শীতের মুখে তখন ঠান্ডা পড়ছে অল্প অল্প। ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে চারধার। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে বাজির আওয়াজ। উৎসবের পরিব্যাপ্ত সেই চরাচরে আমাদের আনন্দিত বাড়িটার ছবি নিশ্চয়ই এঁকে রেখেছিল কেউ। সে কি কাল? সে কি অদৃশ্য বন্ধুজন কোনো? এখনও আমাদের দেশে অন্ধকার পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে আছে রাধাচূড়া। তার গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি “আমি”। আমার অসমাপ্ত সব “খেলা”ধূলা। কোনো অলৌকিক উল্কাপাতে আমার অস্তিত্ব থেকে ভেঙে আলগা হয়ে গেছে আমার মন। বারবার সে ফিরে যাচ্ছে শ্যামসবুজ সেই ছোট্ট মফস্বলে, শরতশিশিরে ভিজে থাকা লক্ষ্মীর পদচিহ্নময় অলিতে গলিতে ...

আজও কোনো হিমশীতল অন্ধকার নেমে এলে ওপরে চেয়ে দেখি দীপাবলির আশ্চর্য আকাশ হয়ে আমার মাথার ওপর জ্বলে যায় বাবা আর মায়ের শাশ্বত যৌবন ...

1 টি মন্তব্য: