বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ধারাবাহিক - প্রশান্ত ভট্টাচার্য

সাহিত্যে শ্লীল অশ্লীল বিচার ১
প্রশান্ত ভট্টাচার্য



ছেঁড়া তমসুক
অশ্লীল, অশিষ্ট, গয়ারু ও সাব-অল্টারন বাঙলা
শিষ্টা-শিষ্ট বিচার - শব্দের জাতিভেদ-প্রথা




বাঙলা অভিধানের বাইরে হাজার হাজার শব্দ আছে, যা প্রতিনিয়িত ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু বাঙলা ভাষার স্বঘোষিত মুরুব্বীরা তাদের সাহিত্যের আঙিনায় ঢুকতে দেন না । আসাম থেকে আজকের বিহার ঝাড়খণ্ড ওড়িশা আর পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালি ডায়াস্পরা, এই পরিসরে রোজ ব্যবহার হওয়া হাজার শব্দ বাঙলা অভিধানে, সাহিত্যে স্থান পাচ্ছে না । মুরুব্বীরা একটি কৃত্রিম কাঁচের দেয়াল দিয়ে নিজেদের 'শুদ্ধতা' ঘিরে রেখেছেন । এই কাঁচের দেওয়াল ভাঙ্গার সময় এসেছে ।

যারা 'রমন' লিখবেন কিন্তু চোদাচুদি শুনলে লেখা তো দুরস্থান, কানে আঙ্গুল দেবেন, তাঁরা 'লিঙ্গকে' বাঁড়া বলতে অজ্ঞান হবেন এতো স্বাভাবিক । এরা 'যোনি' বলতে পারেন কিন্তু গুদে আপত্তি । ছুতটা হোল অভিধানে নেই । অথচ আজকের রাস্তার ভকাবুলারিতে বাঁড়া, গুড, ল্যাওরা, পেট করা, গাঁড় মারা, গাদন, ইত্যকার শব্দমালা আখছার ব্যবহার হচ্ছে । অভিধানে থাকলে শ্লীল আর একই মানে হলেও অভিধানে নেই তাই অশ্লীল এটা এলিটিস্ট যুক্তি ।

রাঁড়, ভাতারখাকি, আঁটকুড়ী এই সেইদিনও বাঙলা সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছিল, সে কি দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসুদন লিখেছিলেন বলে ? আসলে বাঙলা ভাষায় গয়ারু শব্দকে ঢুকতে না দেওয়াটা শিক্ষিত, শহুরে ফ্যাসন । মফস্বলের লোকদের গাইয়া বলে তাদের এবং অধুনা শহরে 'নিম্ন' পেশার মানুষের আটপৌরে ভাষাকে অশিষ্ট আখ্যা দেওয়াটাই একধরনের ছুতমার্গ । এরা করবেন বাঙলা ভাষার পরিপোষণ !

'গাঁড় নেই গাঁড়ে বাঁশ, ষোল বিঘে আখচাষ !' \



অভিধানে পাচ্ছি শিষ্ট শব্দের অর্থ কৃত শাসন, উপদিষ্ট, নীতিজ্ঞ, সাধু, ধীর, ধার্মিক অবর্ধিত, সুবোধ ইত্যাদি অর্থাৎ শিষ্টাচার মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তির একরৈখিক বিশেষণ । শব্দ নাকি ব্রহ্ম । তা ব্রহ্মের আবার জাত বিচার কেন, কেনই বা তাকে শিষ্ট অশিষ্টের দাঁড়ি পাল্লায় তোলা ?

চুচি বা চুঁচি শব্দটি সংস্কৃত চুচুক শব্দ থেকে উদ্ভূত । চূচুক মানে স্তনাগ্র, বাঙলায় চুচি মানেও প্রায় তাই, যুবতীর স্তন । এটি শব্দকোষে আছে । এখন ধরা যাক চোদা শব্দটি । সংস্কৃতে চোদ মানে প্রেরক, প্রবর্তক, চাবুক ইত্যাদি । 'জঘনে চোদ এযাম ' -ঋগ্বেদ ৪।৬১।৩ বাঙলায় ব্যঞ্জনাটা পালটে গেছে । তাহলে এই শব্দগুলি অশিষ্ট হলে কি প্রকারে ?

ভদ্রলোকেরা ল্যাওরা, গুদ, পোঁদ বলতে লজ্জা পান, শিশ্ন, যোনি, গুহ্যদ্বার বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, তাদের এই ন্যাকামির অধিকার আছে । কিন্তু তাদের এই শিষ্ট বোধ বাকি কোটি কোটি মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত ?

শত শত আঞ্চলিক বুলি নিয়ে এই বাংলা ভাষা, অজস্র তাঁর ব্যঞ্জনা, পরতে পরতে, বাক্য বন্ধে নব নব দ্যোতনা । কেউ কার উপভাষা নয় । যারা মান্য চলিতের standardize করেন আসলে তা জিনস, কোকাকোলা, এসেম্বলি লাইন উৎপাদনের, পুঁজিবাদী নিয়মের শিকার । বৈচিত্র্য তাদের কাছে ঝামেলা । আমার শেষ কথা বাংলাভাষার উদ্যানে শত পুষ্প প্রস্ফুটিত হোক ।

আমরা টাড়ে বসে পরচে মারা চশমার কাঁচ মুছে বলি 'জলের উপর পানি আর পানির উপর জল' তফাত কি তা বল ?

ছেঁড়া তমসুক

অশ্লীল, অশিষ্ট, গয়ারু ও সাব-অল্টারন বাঙলা ১২

ভাষার রাজনীতি এবং রাজনীতির ভাষা

পরিশেষে ভাষাকে নিয়ে রাজনীতির সূক্ষ্ম অভিমুখগুলো বলে রাজনীতির কথা শেষ করব । শিষ্ট বা সাধু ভাষা যখন চালু ছিল তখন প্রকারান্তরে অশিষ্ট ভাষার অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া হয়েছিল । কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ বাংলা আকাদেমি যখন নয়ের দশকে বাংলা বানান অভিধান বাজারে ছাড়লেন, তখন শিষ্ট অশিষ্টের বেড়া ভেঙ্গে মান্য চলিত বাংলা বলে বাঙলা ভাষাকে standardize করলেন । এবং এক ধাক্কায় বাংলা ভাষায় ভদ্রলোকের হেজিমনি কায়েম করলেন । সর্বার্থে মূলত রাড় বাঙলার বুলিকেই শিরোধার্য করে নিলেন, এবং কোন ব্যাপক আলোচনা ছাড়াই । বাংলা ভাষা বলার মত চব্বিশ কোটি মানুষের ভাষার মতো গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্বের প্রশ্নে কতিপয় স্বঘোষিত বিদ্বজ্জন ও আনন্দবাজার পত্রিকা এই অন্যায় কম্মটি করলেন, এবং আমরা চুপ করে সহ্য করে নিলাম ।

দ্বিতীয় ঝোঁকটি হল ভাষার প্রশ্নে পুরুষতান্ত্রিক মোড়লি । বাংলা ভাষায় অসংখ্য নারী সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ ছিলেন ও আছেন । কিন্তু ভাষা সংস্কারের জন্যে তাদের মতামত কোনোদিনই নেওয়া হয়নি । কারণ ভাষাটা যদি মেয়েলিপনার ছোঁয়াচ লেগে দূষিত হয়ে যায় ।

তৃতীয় ঝোঁক হল ভদ্রলোকের মাস্তানি । এই তথাকথিত ভাষা সংস্কারের জন্য ব্রাহ্মণ, কায়স্থ আর উঁচু জাতের বাইরে কোন দলিত, নিম্নবর্গীয় ভাষাবিদ বা সাহিত্যিক এই দঙ্গলে স্থান পেলেন না । অথচ বাংলা ভাষা ভাষীর ৮০ শতাংশ এইসব 'ছোটলোক' ।

ভয়টা অন্য যায়গায়, যদি এঁদের মত নেওয়া হয় তো হাজার হাজার অশিষ্ট, স্থানীয়, অভিধান বহিভুত কিন্তু বহুল ব্যবহৃত শব্দকে মান্যতা দিতে হবে ।

চতুর্থ ঝোঁক হল, চুপি চুপি, যৌনতার প্রশ্নে ক্যাথলিক বা উগ্র হিন্দু অথবা জঙ্গি ইসলামি মতবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া । উদাহরন স্বরূপ বাঙলা অভিধানে 'পেরিস্ত্রইকা' ঢুকল কিন্তু 'গে', 'লেসবিয়ান', 'ট্রান্স-জেন্ডার' স্থান পেলনা । অথচ শব্দগুলি বহুল ব্যবহৃত হওয়া সত্বেও । খিস্তির কথা তো বললামই না ।

আরেকটি অসহ্য মস্তানি হল আনন্দবাজারি গাঁড় বাজারি । গ্বালিয়র, পটনা, কানিমোঝি, ইত্যকার হাজার বানান কালোয়াতি প্রত্যেকদিন বাজারে ছাড়ছে । গাভাস্কর না গাওস্কর ঠিক করতে করতে গাভাসস্করে কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল । আবার এঁদের সম্পাদকীয়টি লেখা হয় ' সাধু ভাষায় ', মনে হয় সম্পাদক প্রাণীটি বেদের সময় থেকে আধুনিক কালে ট্রান্সপোরটেড হয়েছেন, চলিত ভাষায় বাংলা তার গুরুত্বের সাথে সামঞ্জস্যবিহীন ।

এইসব মাতব্বর ও তাদের অসহ্য ঢেম্নামি সত্বেও বাংলা ভাষার সহজ বহমানতা, তার অনিঃশেষ বিচিত্র শব্দ সম্ভার, ঐতিহাসিক এবং একই সঙ্গে দুরন্ত আধুনিক, তার অসংখ্য বুলি, সীমাহীন পরনকথা নিয়ে এই সব ভাষার ' ডন কিহটে 'দের হারিয়ে নিজের বিচিত্র গতিতে নতুন নতুন শব্দের আবিস্কার ও আত্মিকরণ করবে ।

-

ভাষার রাজনীতি এবং রাজনীতির ভাষা

' হানি । বলিস কি ? পঞ্চাশ টাকা ?

ফতে । মুই কি আর ঝুট কথা বলছি ।

হানি । ( সরোষে ) এমন গরুখোর হারামজাদা কি হেদুদের বিচে আর দুজন আছে ? শালা রাইয়ত বেচারীগো জানে মার‍্যে, তাগোর সব লুটে, তারপর এই করে । আচ্ছা দেখি, কোম্পানির মুলুকে এনছাপ আছে কিনা । বেটা কাফেররে আমি গোরু খাওয়ায়ে তবে ছাড়ব । বেটার এতো বড় মকদুর । আমি গরীব হলাম বলে বয়ে গেল কি ? আমার বাপ দাদা নওয়াবের সরকারে চাকুরি করেছে আর মর বুন কখনো বারয়ে গিয়ে তো কসবগিরি করে নি । শালা …

ফতে । আরে মিছে গোসা কর কেন ? ঐ দেখ, কুটনী মাগীকে মোর কাছে পেটয়েছ্যাল, সে ফের এই দিগে আসতেচে ।

হানি । গস্তানীর মাথাটা ভাঙতে পাত্তাম, তা হ'লি গা-টা ঠান্ডা হতো ।'

১৮৬০ সালে মাইকেল মাইকেল 'পদ্মাবতী নাটক' নাটক লিখে, যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বাজি ধরে ' তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য ' লিখছেন, তার মানসপটে অমিত্রাক্ষর ছন্দের রসরূপ ক্রমশ ধরা দিচ্ছে, ঠিক সেই তখনই, ১৮৬০ সালে নাট্যশালার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ' বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ ' লিখলেন এবং লক্ষণীয় তার ভাষা । কেমন করে নিচুতলার মানুষের মুখের ভাষাকে নাটকের অস্ত্র করতে হয়, তিনি তা দেখিয়ে দিলেন । মাইকেল মধুসূদন দত্তের অকাল প্রয়াণে সবচেয়ে ক্ষতি হল বাঙলা নাটকের ও বাঙলা ভাষার, এ কথা আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি ।



তারপর মন্বন্তর, বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন সব পিঠপিঠি এসে পড়ল, এবং মানুষকে হতচকিত করে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশের পক্ষে দাঁড়ালেন । কিন্তু দেশভাগের জন্য যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আশ্রয়চ্যুত হল, তাদের যন্ত্রণা এবং সদ্য স্বাধীন দুই দেশ কেউই তাদের নূন্যতম মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিল না । এই প্রেক্ষাপতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ একটা আশার আল জাগাল । গ্রামের গরিব মানুষের কথা বলতে লাগল IPTA . 'নবান্ন', 'দুখীর ইমান', 'ছেড়া তার' ইত্যাদি নাটকে শিষ্ট ভাষার পাশাপাশি গয়ারু ভাষা মিশতে লাগল । কিন্তু বামপন্থীদের নিজের পায়ে কুড়ুল মারা একটা পুরনো অভ্যেস । সেরেফ তত্বগত গাঁড়পিঁয়াজি করে একটা ভাষাগত বিপুল সম্ভাবনাকে গুপ্ত হত্যা করল । প্রায় ভেঙে গেল গণনাট্য সঙ্ঘ, এক এক করে জন্ম নিল গ্রুপ থিয়েটার ।

তারপরের পঁচিশ বছর বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রে বড় কিছু হল না । সেই একবারে সত্তরের দশকে 'অপারেশন বর্গা' কে কেন্দ্র করে যখন গ্রামীণ জীবনে সশক্তিকরন হচ্ছিল, সে সঙ্গে বাঙলা ভাষারও বিস্তার প্রসারিত হচ্ছিল দূরতম প্রান্তে । কিন্তু বামপন্থীরা দম ছুট হয়ে ভূমি সংস্কারের কাজটা আমলাদের হাতে তুলে দিয়ে বইমেলা ইত্যাদি নিয়ে মাতল । শহরে বামপন্থি ঝুটো 'বুদ্ধিজিবি' নামক চামচে ক্লাসের জন্ম হল । বামপন্থীদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হল কি করে রাজ্যের সব কিছু লুটে নিয়ে সরকারি কর্মচারী আর মাস্টারদের গবভে ঢালা যায় তার ব্যবস্থা করা । ভাষা ও ভাষার রাজনীতি বিস্তৃত করতে তাদের বয়েই গেসল ।

যখন শাসক সমাজ তার রাজনীতি বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গুছতে ব্যস্ত হয়, তখন তার স্বাভাবিক গুণ গুলিও নস্ট হয় । তারা এটা ভুলে যায় যে ভাষা শুধু লিপি, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রাণ নয়, ভাষা গোটা সমাজকে ধরে রাখে, সমাজে জীবনের জঙ্গমতাকে সে সচল রাখে । হায় ! যাদের কাছে আশা ছিল তারাই বেশি ডোবালো ।

নব্বইএর দশকের মাঝখান দিয়ে রাজনীতি হীনতার অসুখ ছড়িয়ে পরতে লাগল যা নতুন শতকে মহামারীর আকার নিল । সমাজ জীবনে দুষ্কৃতিদের দৌরাত্ম্য বাড়তে লাগল, তার আচ এসে লাগল ভাষাতেও । যে অশিষ্ট, গয়ারু ভাষাকে শহুরে বাঙালী দূরে সরিয়ে রেখেছিল, সেই ভাষা তার তাবৎ কুৎসিত ভঙ্গি নিয়ে অবতীর্ণ হল । শিষ্ট বাঙলার তেইশটা মারা গেল । বাধ্য হয়ে বাঁ হাতে মনসাকে ফুল দিল ভাষার ফুলবাবুরা ।

তারই মধ্যে নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে বিদ্যুৎ চমকের মতো সাব অল্টারন বাঙলা শব্দ গুঁড়ি মেলে ঢুকে পড়তে লাগল ।

এর পরে যে প্যাঁদানি টা বাঙলা ভাষা খেল সেটা আত্মহত্যার সামিল । সেটা এল মোবাইল ফোন, সোস্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটের হাত ধরে । কি করে ভাষাকে সংক্ষিপ্ত করার অক্ষম প্রচেষ্টায় তাকে লুলা, অপাহিজ, বিকলাঙ্গ করা যায় সেতা দেখা গেল ।

সেই সময়, সেই বাঙলা ভাষার সংবেদী সময়ে, বাঙলা ভাষা দু খাতে বইতে লাগল । একদিকে গোপাল উড়ে, দাশরথি রায়, টেকচাদ ঠাকুর, রূপচাঁদ পক্ষি, কালীপ্রসন্ন সিংহ দের বাঙলা, অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, রামমোহনের ধারা । একদিকে ছিল বাংলার লোক সংস্কৃতির পরম্পরা অন্য দিকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির শিকড়হীন অবাস্তব চর্যা । যদিও স্বীকার্য যে অই আবাস্তব চর্চার ফসলে বাঙলা ভাষা সোনার তরীটি কিঞ্চিত ঝকমকে হয়েছিল । কিন্তু বাঙলা ভাষাকে কেউ যদি মান দিয়ে ভালবেসে তার গোড়ায় জল সিঞ্চন করেছিল তো সে বাঙলার নাট্যশালা ।

ইংরেজের হাত ধরে পুঁজিবাদ তখন ধীরে ধীরে শিকড় গাড়ছিল বাঙলার সমাজে, তার জীবনযাত্রায় । ইংরেজের সাম্রাজ্যলোলুপ বর্বরতা ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছিল তার বিবিধ কর্মকাণ্ডে । কিন্তু কলকাতার বাবুসমাজ তার মধ্যে ঔদার্য আবিস্কারের আনন্দে মশগুল হলেন, আর নাট্য শালা তখন 'নীল দর্পণ', 'বুড়ো শালিখের গায়ে রোঁ, 'প্রফুল্ল', ইত্যাদি টিনের তলোয়ার নিয়ে মহারানী ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল ।

এর পেছনে দাঁড়ালেন দুই ধর্মগুরু, বলা ভাল একজন গ্রাম্য সংস্কৃতি জারিত, যাত্রাপালায় সিঞ্চিত কালীসাধক, আর তার চেলা এক বড়লোকের বাউন্ডুলে ছেলে । গুরু বলেন, '- যদি কেউ আমায় গুরু বলে, আমি বলি, দূর শালা, গুরু কি রে ?' ' আমার কোন শালা চেলা নেই । আমিই সকলের চেলা ।' আর চেলা বলে, 'এক শত বৎসর পূর্বে মানুষ পায়ে হাঁটত বা ঘোড়ায় চড়ত । এখন সে সুখী কারণ সে রেলগাড়িতে চড়ে । কিন্তু সে অসুখী কারণ তাকে বেশি উপার্জন করতে হয় । প্রতিটি যন্ত্র যা শ্রম লাঘব করে একই সঙ্গে বেশি শ্রম চাপিয়ে দেয় ।' মানব সমাজের সামগ্রিক ইতিহাসে কথাটা ভ্রান্ত বা বিপদজনক হলেও পুঁজিবাদী সমাজে কথাটা ধ্রুব সত্য । নাট্যশালার এই বৈপ্লবিক ধারাটি কমবেশি আজও রক্ষিত । সমাজের ঘটমান প্রতিটি সঙ্কটে নাট্যশালা নিজ দায়িত্বে অটল থেকেছে , এমনকি ভাষা ও শব্দের বিচরনেও ।

ওদিকে সাহিত্য তার মধ্যবিত্ত কাঁচের স্বর্গে সুখস্বপ্নে বুঁদ হয়ে রইল, একমাত্র ব্যতিক্রম মহামতি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । এদিকে তখন বিদেশী শাসনের জোয়াল দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে । ইতস্তত বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করতে শুরু করেছে । চুয়াড় বিদ্রোহ, সন্যাসী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ স্তিমিত হলেও ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহের ঝড়ে ব্রিটিশ প্রভুদের আঁতে ঘা পড়ল । মানুষের ক্ষোভের বানী উগ্রে দিতে লাগল বঙ্গ নাট্যশালা , বিদ্রোহের ভাষা শীলিত থাকল না, তাই ১৮৮৭ সালে নাট্যশালার ওপর নেমে এল শাসকের রোষ, চালু হল ' নাট্য নিয়ন্ত্রন বিল' । নিয়তির পরিহাস, সে ধারাটি এই ২০১৩ সালেও বহাল তবিয়তে বিরাজমান ।



ইংরেজরা এদেশে এসে বানিজ্যের প্রয়োজনে সুবিধা করার জন্য বাঙলা শেখার প্রয়োজন অনুভব করল । তার আগে রাজ দরবারে কাজ চালাবার জন্য উর্দু শিখে নিয়েছিল । মদ্যিখানে তারা ভাঙা উর্দুতে বার্তালাপ করত, যেটাকে আমরা হিন্দি বলে ভুল করতাম । যদিয়ও ঠেট হিন্দি খুব কম লোকই বলত, আজও তাই ।

শ্রীরামপুর মিশনারি কলেজে উইলিয়াম কেরির উৎসাহে বাঙলা ভাষা শেখার কাজ সুরু হল । ১৭৪৮ সালে মনএল দ্য আসুম্পসাও এবং ১৭৭৪ সালে হ্যালহেড সাহেব বাঙলা ব্যাকরণের বই লিখলেন । তার আগে কোনও বাঙালী পন্ডিত এ ব্যাপারটায় নজর দেবার ফুরসত পাননি, নিজেদের আকচা আকচির জন্য । এর পরে পরেই বিদ্যাসাগর মশাই বাঙলা লিপি সংস্কার করলেন, বাঙ্গালিদের বাঙলা ভাষার বর্ণপরিচয় করালেন । এর আগে অবশ্যি শ্রীরামপুর কলেজের তত্বাবধানে বাঙলা মুদ্রন চালু হয়ে গেছে এবং যথাক্রমে হ্যালহেডের বাঙলা ব্যাকরণ ও বাংলায় গস্পেল, 'মথি লিখিত সুসমাচার' ছাপা হয়ে গেছে । ইংরেজদের হাতে বাঙলা ভাষা হাতে লেখা পুঁথি থেকে ছাপার অক্ষরে মুক্তি পেল । এক অর্থে বাঙলা ভাষার লিখিত রূপ জনসাধারনের হাতের নাগালে এল । এই পর্বে যারা বাংলায় লিখতে সুরু করলেন তারা তাদের লেখায় শিষ্ট এবং চলিত বাঙলা দুটোই সমানভাবে ব্যবহার করলেন ।

ইয়োরোপীয় শিল্প বিপ্লবের আর রেনেসাঁর ঢেউ আছড়ে পরল ভারত সাগরতীরে, কুসংস্কারের নাগপাশে বন্দী দেশীয় সমাজে মুক্তির হাওয়া এসে লাগল । বাংলায় ইংরেজদের ধামাধরা পদলেহী মুৎসুদ্দি অধ্যুষিত শহুরে সমাজের অংশত ঘুম ভাঙল, বাংলায় নব্য বাবুদের মধ্যে 'নবজাগরন' দেখা দিল । তাদের মধ্যে কতিপয় দলছুট বাঙালী সত্যিকারে সমাজ সংস্কারের তাগিদ অনুভব করলেন । শ্রী রামমোহন রায়, শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এঁদের প্রমুখ । বিদ্যাসাগর মশাই মূলত শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টায় প্রাণপাত করতে লাগলেন, এবং ইংরেজদের সহায়তা সফলও হলেন । এঁরা দুজনেই, আরও অনেকের সহায়তায়, গরিষ্ঠ উচ্চবর্ণের চরম ও কুৎসিত বিরোধিতা সত্বেও সতীদাহ, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি রধ করতে আংশিক সফল হলেন ।



কিন্তু প্রকৃত সমাজবিপ্লব হল না । বাঙলা তথা ভারতের মত ঐতিহ্য বিধৃত সমাজে পরিবর্তন আনতে গেলে যে ধর্ম সংস্কারের প্রয়োজন ছিল তাকে রুখে দিল হিন্দু পুনরুত্থানবাদ আর ক্রমশ বিবর্তিত সামাজিক শ্রেণী বিন্যাস । ব্রাহ্মদের ধর্মীয় ন্যাকামি ও গোঁরা হিন্দুদের মধ্যযুগীয় অন্ধ কুসংস্কারের পুনরায় মাথাচাড়া দেওয়া, এই দুয়ের মাঝে পরে নবজাগরনের সুফল কমই পড়ল । আর যেটুকু পড়ল তা নগরকেন্দ্রিক, গ্রাম বাংলায় তার বিস্তার হল না । ফলে আঞ্চলিক ভাষার ধারাগুলি সমানভাবে পল্লবিত হতে পারল না । লেখকদের অধিকাংশ উচ্চবর্ণের হওয়ায় এবং রাঢ় অঞ্চলের বাসিন্দা হওয়ায় রাঢ় বাঙলা ধারা মুখ্য ধারা বলে চালান হল । বাকি ধারাগুলিকে দমিয়ে দিয়ে তাদের বাঙলা ভাষার খাস মহল থেকে বিতারিত করে অশিষ্ট, গ্রাম্য, গয়ারু ইত্যাদি বলে ব্রাত্য করা হল । অথচ কলকাতা আম আদমির বুলিকে মান্য চলিত ইত্যাদি গোঁজামিল দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হল । আলালের ঘরের দুলালরা হুতোম পেঁচার নকশা পরে এবং বর্ধমানের মহারাজার বাঙলা মহাভারতের বাঙলা মানে বুঝতে লেগে পরলেন ।

ব্রাহ্মণ্য ত্যাঁদড়দের চক্রান্তে শ্রীচৈতন্য খুন হলেন এবং বাঙলা ভাষার পুনরায় সংস্কৃতের খপ্পরে পরে গেল । বাঙলা ভাষার মূল পাঁচটা ধারা - বঙ্গাল, বরেন্দ্রী, কামরূপী, ঝাড়খন্ডী এবং রাঢ়ী, এই পাঁচটা ধারার মধ্যে গায়ের জোরে রাঢ়ী কে প্রাধান্য দেওয়া হল । বাকি সব আস্তে আস্তে অশিষ্ট ও গয়ারু চিহ্নিত হতে সুরু করল । এবং বিনা যুক্তিতে শান্তিপুর-নবদ্বীপের বাংলাকে ' প্রমিত ' বলে চালাবার চেষ্টা হতে লাগল । ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ও গোঁরা মুসলমানিরা এইভাবে মৌলবাদী বিভেদের বীজ বপন করল, যার থেকে আজকের এই বিষবৃক্ষের পরিনতি ।

এই চক্রান্তের মধ্যে লালন সাঁই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ । সমাজের নির্যাতিত মানুষের মুখের ভাষাকে, হৃদয়ের রুদ্ধ সঙ্গীতকে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামির ওপরে স্থান দিলেন । শব্দের হেরফেরে তিনি নীচেরতলার মানুষকে বোঝালেন, মনুষ্যত্বই ধর্ম, আরাধ্য যেই হোক, খোদা বা ঈশ্বর । তার ভাব ধারায় নতুন এক জীবন দর্শন নীচের তলার মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল । বাংলাভাষা তাদের গলায় নতুন করে বাজল । সৃষ্ট হল বাউল সুম্প্রদায়ের । জাতিভেদ হীন এক সহজিয়া জীবন চর্যার । কিন্তু তাদেরও উঁচুতলার বাঙ্গালিরা অপাংক্তেয় করে রেখেছিল সোয়া দুশ বছর ধরে । এদিকে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের হাত ধরে বাঙলা ভাষা নিজের একান্ত পরিচয় ঘোষণা করেছিল, পরে তার অনুপ্রেরনায় কৃষ্ণযাত্রার সুচনা হয়েছিল । ভাষাটা ভাগ হলেও ধর্মের বন্ধনে বাঁধা পরা মানুষগুলি তাদের নিজ নিজ আঞ্চলিক ঘরানায় ঈশ্বর ভজনার অছিলায় স্ব স্ব বাগভঙ্গিমা গড়ে তুলছিল। যেন বাংলাভাষার বাউন্ডারিতে দাঁড়ান বদলি ফিল্ডার ।

এমন সময়ে ক্ষয়িষ্ণু মোগল জমানার শেষ নিশ্বাসকে ত্বরান্বিত করে ঝুপ করে পলাশীর আমবাগানে সিরাজি রোশনাই নিবে গেল । এদেশে নতুন রাজা হল সাগর পারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । বাংলার রাজনৈতিক দাবার ছকে মন্ত্রী বিদায় নিল, তার যায়গায় 'রানি' বসলেন ।

বাংলার সমাজনীতি ও রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব পড়েছিল ইসলামের আগমনে, প্রভাব পড়েছিল ক্রমশ বেগবতী বাঙলা ভাষার ওপর । নতুন নতুন শব্দ এসে বাঙলা ভাষার ঝাঁপিতে জমা হল । ইসলামের কল্যাণে জমি জিরেতের, আটপৌরে বাঙালী জীবনে নতুন শব্দমালা চিরস্থায়ী ঘাঁটি গারল । সেরেস্তা, পর্চা, দাদন, খতিয়ান, ফজর, ইত্যকার শব্দ আমাদের নিত্যদিনের বুলিতে স্থান করে নিল । গ্রামবাংলার রোজকার জীবনে সংস্কৃত প্রায় বিলুপ্ত হল । বৌদ্ধ নিচু জাতি যারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অত্যাচারে মাথা কামিয়ে ধর্ম ত্যাগ করেছিল, তারাই ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় মোচোলমান হয়ে টিকিনাড়াদের কাছে 'নেড়ে' বলে দুয়ো পেল ।

অবশিষ্ট ধরমভীরু হিন্দুরা সংস্কৃতকে বিদায় দিয়ে লৌকিক দেবদেবীর মঙ্গল গান আঁকড়ে ধরল । তাতে বাংলার ভাষাগত শ্রীবৃদ্ধি কিছু ঘটল । কৃষি ভিত্তিক বাংলায় অম্বুবাচি থেকে দোল অব্দি যে কৃষি মহোৎসবের সামাজিক কর্মকাণ্ড চলত, তাকে কেন্দ্র করে কোথাও বনদুর্গা কোথাও টুসু উৎসবের চল ছিল । গ্রামবাংলার সমস্ত দেবদেবীই কৃষি ও মাটির সাথে যুক্ত । শাকম্ভরি তো দুর্গারই আর এক নাম । কিন্তু শাসক জমিদার প্রজাদের এই দেবীটিকে হরপ করে মহিষাসুরমর্দিনী পূজা চালু করলেন । মানভূম, সিংভূম, মল্লভূমের বিস্তীর্ণ লোহিত মৃত্তিকায় রয়ে গেল তুসুগান । শ্রী শ্রী চন্ডির মন্ত্র পাঁচশ হাজার বছরে অনড় থাকলেও, চলমান তুসুগান প্রতিদিন সমসাময়িক হয়ে উঠতে থাকল ।

বাঙলা সমাজ জীবনে এরমধ্যে একটি বিরাট অভিঘাত হল শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব । এই মানুষটি আজ অব্দি শ্রেষ্ঠ বাঙালী । সেসময়ের নিরিখে এই মানুষটি শুধু বাঙ্গালির সমাজব্যবস্থায় নাড়া দেননি, বাঙ্গালির মননে, বাঙ্গালির ভাষায়, বাংলার আত্মায় বিপ্লব এনেছিলেন । জাতিভেদ, ধর্মীয় বিভেদ, জাত পাত, ছোঁয়াছুঁয়িকে ঝুঁটি ধরে নেরে দিয়েছিলেন । ফলে একধাক্কায় বাঙলা ভাষার শৈশব কেটে গিয়ে কৈশোর উপস্থিত হল ।

'যতেক আছিল গঙ্গা জলের কলস ।
আগে সব ভাঙ্গিলেন হই ক্রোধবশ ।।
তৈল ঘৃত লবণ আছিল যাতে যাতে ।
সর্ব চূর্ণ করিলেন ঠেঙা লই হাতে ।।
ছোট বড় ঘরে যত ছিল ঘট নাম ।
সব ভাঙ্গিলেন ইচ্ছাময় ভগবান ।।
গড়াগড়ি যায় ঘরে তৈল ঘৃত দুগ্ধ ।
তন্ডুল কার্পাস ধান্য লোন বড়ী মুদ্গ ।।'

বাঙলা ভাষার বিবর্তনের ধারায় কয়েকটি স্তর যা মূলত রাজনৈতিক । স্তরগুলি আমার মতে এই ১) বৌদ্ধ যুগীয় ২) বৌদ্ধ যুগ পরবর্তী ইসলামিক প্রভাব ৩) ইংরেজি ভাষার বিস্তার ও তার প্রভাব ৪) খ্রীষ্টীয়-ব্রাহ্ম ঘোঁট এবং ভিক্টোরিয়ান প্রুডারি ৫) দেশভাগ, দাঙ্গা ও মন্বন্তর ৬) অপারেশন বর্গা ও নীচের তলার জাগরণ ৭) ভদ্রলোকের অপশাসন, আর ৮) চলমান দুরভাষের প্রাদুর্ভাব । এই স্তরভেদ একান্তই আমার এবং এই স্তরগুলির প্রত্যেকটাই প্রবলভাবে রাজনীতিসিক্ত ।

যেহেতু বৌদ্ধযুগ বাঙলা ভাষার শিশুকাল এবং ভাষাটি সবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে তার নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলছে, সে সময়ের বৌদ্ধ সংস্কৃতির রাজনৈতিক প্রভাব এই ভাষায় পরেছে । বাঙলা তখনকার স্থানীয় ও আঞ্চলিক ভাষাগুলির সাথে বোঝাপড়া করে নিজস্ব পথ করে নিচ্ছে । ফলে অসংখ্য স্থানীয় শব্দ বাংলার ভান্ডারে ঢুকে পড়ছে । সম্ভবত 'ভাত' শব্দটি এসময়েই বাঙলার ভান্ডারে প্রবিষ্ট হয় । বৌদ্ধ ধর্মের মতই এই সময় ভাষা বাহুল্য বর্জিত সুঠাম ।

চর্যাপদের সময় থেকে আজ অব্দি বাঙলা ভাষা একটি বহতা নদীর মত শীর্ণ নির্ঝরিণী থেকে আজকের যুবতী । এই দুকূলপ্লাবী নদিতে মিশে গেছে অসংখ্য স্রোতস্বিনী, তাদের জলধারাগুলি স্ব স্ব রঙ সমেত আলাদা চেনার উপায় নেই, অথচ সেই জলভার নিয়েইতো নদীটি পূর্ণতা পেল ।

ভাষা ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে একমাত্র যোগাযোগের সাধন । আবার সমাজের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক পরিচ্ছদ, শৈল্পিক অভিব্যক্তি আর ব্যবহৃত ভাষা, এইসব মিলিয়েই সেই সমাজের সংস্কৃতি । এই সমাজ যত ছোট ও আদিম থাকে ততই তার সংস্কৃতি সরল ও সমধার্মিক থাকে, গোল বাধে যখন সমাজের অস্তিত্বের মানচিত্রটা বিস্তার লাভ করে । তার সংস্কৃতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে । আস্তে আস্তে সমধর্ম লোপ পায়, অন্তত ক্ষীণ হয়ে আসে ।

ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি মালিকানা, উৎপাদনের উপায় গুলির মালিকানা নিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি জীবিকায় ধর্মের প্রবেশ এবং জীবিকার স্তরভেদ ক্রমশ সমাজকে স্তরবিভক্ত করে দেয় । এবং প্রত্যেক স্তরের সংস্কৃতিও আলাদা আলাদা হয়ে যায় । যারা 'বনেদি' তারা দুর্গোৎসব শুরু করে আর যারা সবচেয়ে নীচে তাদের জন্য পরে থাকে 'ইতুপুজো, তুসু ব্রত' ।

উপরতলায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অবশিষ্টের হাস্যকর অনুকরণ, আর নিচের তলায় অশিষ্ট ছড়ায় তুসু গান । এইভাবে রাজনীতি সমাজকে ভাগ করে নেয়, তার সংস্কৃতিকেও । মাঝখানে যে স্তরগুলি থাকে তারা নৈকট্যের সাপেক্ষে নিজেদের স্থান নির্ণয় করে নেয় । যেহেতু উপরঅলাদের টাকাপয়সা, প্রতিপত্তি ও গায়ের জোর বেশি, তাই তারাই ঠিক করে কোনটা সাধু আর কোনটা অশিষ্ট । ভাষার রাজনীতির মূল কথা এটাই । ( চলবে )

আজ একটা শব্দ নিয়ে বলব । শতকরা অন্তত সত্তরজন বাঙ্গালি অধুনা কথার অলঙ্কার হিসেবে 'বোকাচোদা' শব্দটি ব্যবহার করে, কারণে, অকারনে, বেদনায়, উল্লাসে, রাগে, দুঃখে, শোকে, শৃঙ্গারে । যৌনগন্ধী শব্দটি এখন বাঙ্গালীর বচনের তান, গমক, গিটকিরি ।

'আমাকে কি বোকাচোদা পেয়েচ যে আমি আগে থানায় যাব ?'

'ওরে আমার বোকাচোদারে, এখন সন্ধ্যাবেলায় সোহাগ করতে এসেচে !"

'এমন বোকাচোদা সাইকেল, শালা প্যাডেল মেরে মেরে একবিচি হয়ে গেল !' ইত্যাদি

অথচ, অভিধানে স্থান পায়নি । অভিধানে এর থেকে ভারী শব্দ আছে, শালা, খানকি প্রভৃতি, 'বোকাচোদা' নেই । কেন নেই ? অপশব্দ বলে ? কিন্তু অপশব্দ তো শব্দই, অভিধানে থাকবে না কেন ? প্রত্যেকেই তো আর অভিধানের সত্তর হাজার শব্দের ব্যবহার করে না, চার পাঁচশ শব্দেই কাজ চালায় । তবু অভিধানে অতো শব্দ স্থান পেল কেন ? আরও হাজার পঞ্চাশেক 'অপ', 'গয়ারু', 'প্রান্তিক' শদ ঢুকলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে !

হটাত মনে হল 'বোকাচোদা' কথার উৎপত্তি কি করে হল । অনেক ঘেঁটে যে মানেটা পেলাম, সেটা এই,

' মাটিতে ফেলিলে বীর্য মাটিতে শুকায়,
পুকুরে ফেলিলে বীর্য পুঁটি মাছে খায় ।
সেই মাছ খেয়ে যে নারী গর্ভবতী হয়,
তাহার পুত্রেরে লোকেবোকাচোদা কয় ।'

' ওস্তাদ উত্তর করিলেন, আজ্ঞা হককুলরকম গাওনা হিকচি, রামায়ণ গাইবারে পারি, ঢফের গীত গাইবার পারি, ও নেড়ির গানও গাইবার ফারি এয়োগা হুনক্যান ।

হিতার বাতারে আর মন্দার বাতারে ।
দুই বীরেতে যুদ্ধ ময়দানব পথেরে ।।
ফবনের ফুত্রা বেটা নাম তার কি ।
এই মুখেতে খাবা তুমি অগবেদ বাগ্নি ।।

.............................. ঠাকুরানী বিষয়ে জান ? এয়োগ হুন ক্যান -

তারিণী বিটি মাও মাও চউব্বিস পরগণার জননী হইয়া ।
ফেরা হঙ্গেতে হুগিনি লইয়ে এলাহার ফুতে ।
এ ফুঙ্গির ফুতে তারিয়া লয়ো দিয়া রাঙ্গা পাও ;
তারিণী বিটি মাও মাও ।।

........................। বাইয়ানা গাহনা জান ? তবে এয়োগ তপ্পা গাই হহুনক্যা

পোলাতুকা দুইস নারে ,
অলদি পাখির বাচা তোরে দরিয়া দিমু । ......................... শেষে ,
( রসকদমী )
কানে ভাবিচো রানী ।
বিদেশ জাউথী পুনি ।।
কিনি দিমি রঙ্গ মোটা ।
ঊরু দিব ফের কানী । '

এইসব গলি বাঁক বাঙ্গালা ভাষাকে আজ সমৃদ্ধ করেছে, অপশব্দ সমেত । শ্রী ভবানীচরন বন্দ্যোপাধ্যায় ' কলিকাতা কমলালয়ে ' এই ছবি তুলে ধরেছেন উনিশ শতকে বাঙলা ভাষার ।

1 টি মন্তব্য: