রাহুল হালদার
ঝরে গেল স্বল্পায়ু
তরুলতা
সুকুমার রায়,সতীশচন্দ্র রায়,সুকান্ত ভট্টাচার্য — এদের মধ্যে একটি মিল হল এরা অসাধারণ প্রতিভাধর হওয়া সত্বেও অতি অল্প বয়েসে দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। এই নামগুলির পাশে আমরা আরেকজনকে স্মরণ করবো যাঁর বাঙালি ঘরে জন্ম কিন্তু পরিবারের সকলের সঙ্গে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মধুসূদন দত্তের মত বিদেশি ভাষার সাহিত্য চর্চা করবার শুরুতেই মাত্র একুশ বছর বয়সে অকাল বিয়োগ হয়। এই অল্প সময়ে বিদেশীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে যিনি সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দের থেকে বয়সে কিছুটা বড় সেই সময়ের রামবাগানের বিখ্যাত দত্ত পরিবারের মেয়ে তরু দত্ত।
তরু দত্ত তাঁর সাহিত্য জীবনে সর্বশ্রেষ্ট্র প্রতিভার স্বাক্ষরটি রেখে গেছেন ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসে। স্বল্পায়ু তরু দত্তের ফরাসি ভাষায় রচিত "Le Journal de Mademoiselle d' Arvers " উপন্যাসটির বাংলার অনুবাদক শ্রী রাজকুমার মুখোপাধ্যায় ঔপন্যাসিক সম্পর্কে লিখেছিলেন " ফরাসীরা তরুকে ফরাসী বলে দাবী করে, ইংরেজরা তরুকে বলে ইংরাজ আর বাঙ্গালীরা যদি তরুকে বাঙ্গালী বলে দাবী করে তাহলে সে প্রয়াস হয়তো অন্যায় হবে না।উপরন্তু তরু ক্রিশ্চান হলেও তার দেহে খাঁটি বাঙ্গালী রক্তই বর্তমান ছিল।।সুতরাং বাঙ্গালী হয়ে আমাদের সঙ্গে তরুর রক্তের সম্বন্ধটা ভোলা যায় কি করে"।
আসলে তরু দত্ত যে সময়ে এই বাংলাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তখন এদেশে ব্রিটিশদের প্রভাবে দেশীয় শিক্ষিত বাঙালি অনেক পরিবার ইংরেজি সাহিত্য, ভাষা, থেকে শুরু করে তাদের রীতিনীতি, আদবকায়দা, খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করা এগুলিকে উন্নত জীবন আর আধুনিক সভ্যতার মাফকাঠি বলে মনে করতেন।আর তরু দত্তের পরিবার সেই যুগের হাওয়াকে অস্বীকার করতে পারেনি। এই কারণেই তরু দত্তের বাবা তাঁদের তিন ভাইবোনের জন্মের কিছু বছর পরেই সপরিবারে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
তাঁদের পারিবারিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আমরা জানতে পারছি যে, তরু দত্তের ঠাকুরদা নীলমণি দত্ত তৎকালীন সময়ের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। নীলমণি দত্ত যখন বর্ধমান জেলার কাটোয়া অঞ্চলের অজপুর গ্রাম থেকে কলকাতার রামবাগানে বসবাস শুরু করেন সেই সময়ে দত্ত বাড়িতে যে সকল দেশী-বিদেশী প্রভাবশালী ব্যক্তিবৃন্দের যাতায়াত ছিল,তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মহারাজা নন্দকুমার, উইলিয়াম কেরী প্রমুখ।নীলমণি দত্তের তিন পুত্র, রসময়, হরিশ আর পীতাম্বর। এঁরা সকলেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন।রসময় দত্তের তৃতীয় পুত্র গোবিন্দ চন্দ্র দত্ত তৎকালীন সমাজে দত্ত পরিবারের সবচেয়ে বেশি সুনাম করেছিলেন।
রসময় দত্ত ছিলেন হিন্দু কলেজের পরিচালক মণ্ডলীর সম্পাদক আর কৈলাসচন্দ্র,হরচন্দ্র,গিরিশচন্দ্র গোবিন্দচন্দ্র দত্তেরা ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের লিখিয়ে এবং কবি।এই পরিবারের অন্য একটি শাখার বিখ্যাত মানুষ হলেন রমেশচন্দ্র দত্ত মহাশয় যিনি ছিলেন পীতাম্বর দত্তের নাতি।রসময় দত্ত সম্পর্কে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন "তাঁর বাড়িতে ইংরেজি বইয়ের একটি অতি চমৎকার সংগ্রহ ছিল এবং তিনি তাঁর পুত্রদের মনেও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সঞ্চারিত করে দিয়েছিলেন "।
ধর্মে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে দত্ত বাড়িতে সকলেই খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইংরেজদের অনুকরণে বাড়িতে প্রায় সকলেই ইংরেজিতে লেখা আর পরস্পরের মধ্যে কথা বলতেন। কিন্তু লেখাপড়ার ব্যাপারে প্রাচ্য গ্রন্থ বিশেষ করে রামায়ণ, মহাভারত ব্রাত্য ছিল না।তেমনি কম ছিল না তাঁদের স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা।
১৮৫৬ সালের ৪ঠা মার্চ গোবিন্দচন্দ্র দত্তের মানিকতলা স্ট্রীটের বাড়িতে জন্ম হয় তরু দত্তের।গোবিন্দচন্দ্রের তিন সন্তান যথা অগ্রজ দাদা অবজু এবং পিঠোপিঠি দুই বোন অরু এবং তরু।ছেলোবেলায় তাঁদের মা ক্ষেত্রমণির কাছে থেকে তিন ভাইবোন ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিগুলি গল্পের মত করে শুনতেন।ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিগুলি তরুর মনে যে গভীর প্রভাব ফেলত সেটা আমরা পরবর্তীকালে তরুর বিষ্ণুপুরাণের দুটি কাহিনিকে নিয়ে লেখা "The Royal Ascetic and the Hindu "গ্রন্থটিতে প্রত্যক্ষ করি আমারা।
অতি অল্প বয়স থেকে তরু দত্তের যে ধারালো বুদ্ধি আর ধীশক্তির বিকাশ ঘটে সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর বাবার কাছে ছেলেবেলা থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। এরপর তরুর শিক্ষা শুরু হয় একজন গোঁড়া খ্রিস্টান শিক্ষক শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তার সঙ্গে চলে সঙ্গীতশিক্ষা Mrs.Sinace এর কাছে।
এরপর ১৮৬৯ সালে গোবিন্দচন্দ্র দত্ত তাঁর স্ত্রী আর কন্যাদের নিয়ে ইউরোপ যাত্রা করেন। বিলেত যাত্রা কালে তাঁরা প্রথমে দক্ষিণ ফ্রান্সে কিছুদিন থাকার পর নিস শহরে বসবাস শুরু করেন। নিস শহরে মাত্র চারমাস বসবাস কালে সেখানকার পাঁসিয়ঁনাঁতে তরু ও অরু কিছুদিন লেখাপড়া করেন। এই ক'মাসে তারা ফরাসি ভাষা ভালো ভাবে রপ্ত করে নেয়। ফরাসি ভাষা রপ্ত শুধুমাত্র তাঁরা ফরাসি পাঁসিয়ঁনাঁতে থাকাকালীন যতটা রপ্ত করেছিলেন, তাতে আরও শান পড়ে গোবিন্দচন্দ্রের উদ্যোগে বাড়িতে মাদার Schwayer নামে একজন শিক্ষিকার দ্বারা তাঁদের গৃহশিক্ষকতা করবার ফলে। এই শিক্ষিকার কাছে পড়াশোনা করবার সময়ই দুই বোনে জানতে ও পড়তে শেখে ভিক্টর হুগো থেকে শুরু করে কবি মুসে(Musset) এর কবিতা।
তারপর তাঁদের ফ্রান্সে বসবাসের পর্ব শেষ হলে সেখান থেকে গোবিন্দচন্দ্র দত্ত ইংল্যান্ডের ব্রমইনে বসবাস শুরু করেন। সেখানে বসবাস করবার সময়ে তরু দত্ত ফরাসি কবিতা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করতে থাকেন। এরপর ১৮৭১ সালে তাঁরা কেমব্রিজ শহরে যান।কেমব্রিজে বসবাসের সময় মিস অ্যারবোলা শোরনামের নামে একজন ইংরেজ মহিলার কাছে বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ এবং পাশ্চাত্য রীতিনীতি শেখেন।কেমব্রিজ শহরে কিছু বছর থাকার পর ১৮৭৩ সালে তাঁরা ইউরোপ ভ্রমণ শেষ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।কলকাতায় ফিরে এসে তাঁরা বেশির ভাগ সময় বাগমারির উদ্যান কিম্বা কলকাতায় নিজেদের বাড়িতে থাকতেন। কলকাতাতে থাকাকালীন ১৮৭৪ সালে তরু তাঁর পিঠোপিঠি দিদি অরুকে হারান। যে যক্ষ্মা রোগে অরু দত্তের প্রাণ গিয়েছিল, সেই রোগেই তরুও আক্রান্ত হন।রোগে আক্রান্ত হলেও পড়াশোনা থেকে তিনি দূরে থাকেননি।বাবার কাছে এই সময় তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের পাঠ নিতে থাকেন। তখন মাদমোয়াজেল ক্লারিস বাদ্যার উপন্যাস "প্রাচীন ভারতে নারী" উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তরু দত্ত বইটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করবার জন্য ঔপন্যাসিকে চিঠি লিখে অনুমতি চাইলে ঔপন্যাসিকের অনুমতি মিললে তিনি বইটি অনুবাদ করেন।
তরু দত্ত শুধুমাত্র ফরাসি ভাষায় উপন্যাস লিখে ফরাসি সাহিত্য সমাজে বিখ্যাত হয়েছিলেন তা নয়, তিনি ফরাসি কবিদের সম্পর্কে প্রবন্ধ, ইতিহাস চর্চা এবং চিঠিপত্রে যা পাওয়া গেছে তাতে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যর পরিচয় পাওয়া যায়।
আবার অপরদিকে ইংরেজি কবিতা, অনুবাদ, লেখা ও বিবিধ বিষয় চর্চার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর রচনাগুলিকে সম্পূর্ণভাবে ইংরেজি করে তুলবার চেষ্টা না করে তাতে ভারতীয় ভাব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।
উদাহরণ হিসাবে আমরা দেখি Du Bartas নামে ফরাসি কবির কবিতায়, পিরেনিজ পর্বতমালায় স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর সৃষ্টি করে এক সমুদ্র থেকে অপর সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার বর্ণনায় তরু দত্ত লিখেছেন ---
"His feet on the two seas planted mark him stand,
His dark looks are the forests overspred,
His ribs the rocks, his sweat the rivers grant,
The fabled son of coelus is not dead
আবার Edmond Dallier এর কবিতায় মৃত কুকুরের উদ্দেশ্যে যে প্রশস্তি বাক্য আছে তার অনুবাদে তরু দত্ত লিখেছেন ---
" A fearless, mind and faithful friend lies here,
Faithful to death, O stranger, dropatear!
When sick and poor, men left measa long,
He stayed. And who was he? Alas my dog.
ইউরোপ ভ্রমণ সেরে তরু দত্তরা যখন কলকাতায় ফিরে এলেন তখন তিনি লালবিহারী দের সম্পদনায় "বেঙ্গল ম্যাগাজিন" পত্রিকায় তাঁর কবিতার অনুবাদগুলি প্রকাশিত করতেন। ১৮৭৭ সাল যখন তাঁর শরীর ভীষণ খারাপ, সেই সময় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই "এ শিফ গ্লীনড ইন ফ্রেঞ্চ ফীল্ডস্ (A Sheaf Gleaned in French Fields)"।তাঁর প্রথম বই প্রকাশের কিছু মাস পরে ১৮৭৭ সালে আগস্ট মাসে তিনি মারা যান।
তরু দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা গোবিন্দচন্দ্র দত্ত এবং মা ক্ষেত্রমণির প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় ভারতের কয়েকটি পুরাণ কথা, বাংলার লোককাহিনী এবং কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিবিজড়িত কবিতা মিলে "এনসেন্ট ব্যালাডস্ এন্ড্য লিজেন্ডস্ অফ হিন্দুস্তান (Ancient Ballads and legends of Hindustan)" নামে বই ১৮৭৮ সালে। এর পরের বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত ফরাসি উপন্যাস "লে জুর্নাল দ্যা মাদমোয়াজেল দ্যার্ভেস(Le Journal de Mlled d' Arvers)" সহ আরো অনেক গ্রন্থ।
অতি অল্প সময়ে তরু দত্ত তৎকালীন সময়ে বাংলা, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ সাহিত্য যে বুৎপত্তি দেখিয়েছেন তাতে তাঁকে নতমস্তকে প্রণাম জানাতে হয়।এই কারণেই তরু দত্তের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ই.জি. টমসন লিখেছিলেন " Toru Dutta remains one of the most astonishing woman that ever lived, a woman whose place in with Sapho and Emily Bronte, fiery and unconquerable of Soul as they..... ".
তথ্যঋণঃ- আভা পত্রিকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন