প্রবন্ধ
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
"এক্ষণ" – বাংলা সাহিত্য জগতের একদা জনপ্রিয় একটি স্বতন্ত্রধারার পত্রিকা, কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য ও আলোচনা :
১৯৬১ থেকে ১৯৯৫ সাল (বাংলা: ১৩৬৮ সন - ১৪০২ সন) পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য জগতের একদা জনপ্রিয় ও স্বতন্ত্রধারার পত্রিকা 'এক্ষণ'-এর প্রকাশকালের সময়পর্ব। পত্রিকাটি তার প্রকাশনার এই পঁয়ত্রিশ বছরের সময়কালে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছিল। বাঙালি শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত পাঠক মহলে পত্রিকাটির বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সম্পাদক হিসেবে নির্মাল্য আচার্য'র সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি (নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একসময় সিটি কলেজের সহপাঠী ছিলেন ও পত্রিকাটি প্রকাশের প্রাথমিক পরিকল্পনা এনারা দুজনেই করেছিলেন) এবং পত্রিকাটিকে উপস্থাপনার বিষয়ে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য সূচনার সময় থেকেই সত্যজিত রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের যুক্ত থাকা। পত্রিকাটির জন্য 'এক্ষণ' নামটিকে নির্বাচন করেছিলেন সত্যজিত রায় এবং তাছাড়াও পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ অলংকরণের দায়িত্বও নিয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদেই থাকতো শিল্পী সত্যজিত রায়ের অসাধারণ ক্যালিগ্রাফির কাজ।
পত্রিকাটির লেখক তালিকাতে ছিলেন সত্যজিত রায়ের বন্ধু কমলকুমার মজুমদারসহ অনেক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, যাঁদের মধ্যে অনেকেই বাজারচলতি পত্রিকাতে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। সেই সময়ের বাংলা ভাষার এমন কোনও বিখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন না, যারা 'এক্ষণ'-এর হয়ে কলম ধরেন নি।
** 'এক্ষণ'-এর প্রথম সংখ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার সূচীতে যে সমস্ত লেখক, প্রাবন্ধিক ও কবির নাম ছিল তাঁরা হলেন – প্রবন্ধ বিভাগে ভবতোষ দত্ত, শ্যামল রায়চৌধুরী ও মৃণাল সেন; গল্প বিভাগে কমলকুমার মজুমদার; কবিতা বিভাগে অরুণ মিত্র, বিষ্ণু দে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিত সিংহ ও সলিল গঙ্গোপাধ্যায়।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল কমলকুমার মজুমদারের বিখ্যাত গল্প 'গোলাপ সুন্দরী'। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার একটি সংকলন 'জাপানের প্রতি' পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।
'এক্ষণ' প্রকাশের সূচনার বছরটি অর্থাৎ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষের বছর। সেই কারণেই 'সম্পাদকীয়' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল 'রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী বিষয়ক প্রস্তাব' শিরোনামে একটি লেখা। সেই লেখাতে নিজেদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সম্পাদক মন্ডলীর তরফে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।
** 'এক্ষণ'-এর প্রাথমিক পর্ব – বিষয়বৈচিত্র, সুস্থ মূল্যবোধ ও রুচিশীলতার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত :
'এক্ষণ'-এর প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার নির্বাচিত বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম ছিল শেক্সপীয়ার, কার্ল মার্ক্স, দান্তে, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরী প্রভৃতি – যা পত্রিকাটির মান ও গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। লেখার বিষয় হিসেবে সাহিত্যের পাশাপাশি স্থান করে নিয়েছিল রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পচর্চা, নাট্যচর্চা, চলচ্চিত্রচর্চা প্রভৃতি।
'এক্ষণ'-এর এই প্রথম দিকের সংখ্যাগুলির বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে কেবলমাত্র গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা নয় বরং সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলির ওপরেও সম্পাদকমন্ডলীর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার অভিপ্রায় ছিল।
প্রথমে এক্ষণ কলেজ রো-তে অবস্থিত নির্মলেন্দু ভদ্র নামক একজন প্রকাশকের প্রকাশণা সংস্থার থেকে প্রকাশিত হতো। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের প্রকাশণা সংস্থা 'সুবর্ণরেখা' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। ১৯৬২ সাল থেকে 'সূবর্ণরেখা'ই পত্রিকাটির প্রকাশের ঠিকানা হয়ে যায়। সূচনার দু-এক বছরের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জগতে সুস্থ মূল্যবোধ ও রুচিসম্পন্নতার প্রতীক হিসেবে 'এক্ষণ' একটি স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে ফেলে।
** বিষয়বস্তুর নানাবিধ বৈচিত্র্য :
পত্রিকাটির 'পুনর্মুদ্রণ' বিষয়ক বিভাগটি সম্পর্কে প্রথমেই স্বতন্ত্রভাবে কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথম সংখ্যা থেকে প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য রচনার পুনর্মুদ্রণ করা হতো 'এক্ষণ' পত্রিকায়। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জাপানের প্রতি'। পরবর্তী বিভিন্ন সংখ্যায় যে লেখাগুলিকে পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত সাহিত্যিক অনুবাদক ও বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শণ'-এর একজন নিয়মিত প্রবন্ধকার রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রাচীন ভারতবর্ষ', উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর 'আমার কথা', বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্রর ১৭৭৮ সালে লেখা 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত', প্রখ্যাত পন্ডিত শিক্ষাব্রতী প্রবন্ধকার কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ 'পৌল ভর্জিনী' এবং 'দুরাকাঙ্খের বৃথা ভ্রমণ', উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত সাংবাদিক প্রবন্ধকার ও লেখক অক্ষয়কুমার দত্তর 'বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'গুপী গাইন' প্রভৃতি। দুষ্প্রাপ্য এই লেখাগুলির পুনর্মুদ্রণ পত্রিকার মান ও জনপ্রিয়তাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে।
ইউরোপের দর্শণ, রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ক রচনাও 'এক্ষণ'-এর পাতায় গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছিল। এই পত্রিকাই প্রথম পাশ্চাত্যের উত্তর আধুনিক দার্শনিক জাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, জাক লাকাঁর মতবাদ ও চিন্তা-ভাবনাকে সহজ ভাষায় বাঙালী পাঠকদের কাছে তুলে ধরে।
সমসাময়িক ও অতীত দিনের অনেক বিখ্যাত মহিলাদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত মহিলাদের আত্মজীবনীও স্থান পেয়েছিল এই পত্রিকাতে। এরকম প্রায় কুড়িটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, কল্পনা দত্ত (যোশী), জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, শরৎকুমারী দেবীর মতো পরিচিত নাম। এঁদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের অখ্যাত ও অনামী মহিলাদের আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়েছিল। এইসব আত্মজীবনীমূলক রচনায় তৎকালীন বাঙালি সমাজ জীবনের বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছিল।
পত্রিকাটির আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দিক ছিল কলকাতা বিষয়ক গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সরকারী পুঁথিপত্র থেকে বা সরাসরি বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দলিলের মাধ্যমে তথ্য অনুসন্ধান করে লিখিত এই প্রবন্ধগুলি ছিল নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। রাধারমণ মিত্র ও দেবাশিস বসুর কলকাতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়, যা স্বাতন্ত্র ও উৎকৃষ্টতার দিক থেকে কলকাতার ইতিহাসচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
এছাড়াও প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকতো বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবন্ধের সম্ভার। প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর মধ্যে সাহিত্য, রাজনৈতিক, সামাজিক, আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতি, নাটক, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি চর্চা – সব কিছুকেই স্থান দেওয়া হতো। প্রবন্ধ লেখকদের যে নামের তালিকাটি পাওয়া যায় তা রীতিমত সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। এই তালিকাতে ছিলেন অমিয় কুমার বাগ্চী, অশোক মিত্র, আনিসুজ্জামান, কমলকুমার মজুমদার, কার্তিক লাহিড়ী, গৌতম ভদ্র, ছন্দক সেনগুপ্ত, দেবাশিস বসু, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার দাশ, সিদ্ধার্থ ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ব্যোমকেশ মুস্তাফি প্রমুখ। এঁদের মধ্যে অনেকেরই লেখা এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, বিশেষত সত্যজিত রায়ের পরিচালিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য 'এক্ষণ'-এর একটি নিয়মিত বিভাগ হয়ে উঠেছিল।
সত্যজিত রায়ের মোট বাইশটি সিনেমার চিত্রনাট্য এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।
পত্রিকাটির সর্বাঙ্গীন চরিত্র থেকে ক্রমশই এটা পরিস্ফূট হতে থাকে যে পত্রিকাটি সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর রুচি বা পছন্দকে অগ্রাধিকার না দিয়ে মননশীল, বৌদ্ধিক ও গবেষণাধর্মী চর্চার সঙ্গে যুক্ত পাঠকগোষ্ঠীর ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে আগ্রহী।
** 'এক্ষণ' পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা :
১৯৬১ সালে 'এক্ষণ' যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন 'অপুর সংসার'-এ অভিনীত চরিত্রের জন্য নবীন ও প্রতিভাবান নায়ক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার আগে আকাশবাণীর চাকরী ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসের পড়াতে ইতি টেনেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার কারণে সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখালেখির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল তাঁর। এই কারণেই কলেজ জীবন থেকে সহপাঠী বন্ধু নির্মাল্য আচার্যর সঙ্গে তাঁর যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে উঠে আসে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা।
সূচনা পর্বেই অভিনয় জগতে সাফল্য প্রাপ্তি এবং তারপরে পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলির জন্য ব্যস্ততাবৃদ্ধি সত্ত্বেও কেবলমাত্র সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের কারণেই সৌমিত্রবাবু রাজি হয়ে যান একটি পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে। পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তিনিই প্রথম নির্মাল্য আচার্যকে নিয়ে যান সত্যজিত রায়ের কাছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধেই সত্যজিত রায় পত্রিকার নামকরণ করার সাথে সাথেই প্রচ্ছদ অলংকরণ করতেও রাজি হয়ে যান। পত্রিকা প্রকাশের পরে অভিনয় জগতে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সৌমিত্রবাবু বিভিন্ন লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেবলমাত্র লেখাই সংগ্রহ করতেন না, সেগুলো সব পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে দেখতেন। এছাড়াও তিনি পত্রিকার জন্য অর্থ সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন জোগাড় করার কাজও করতেন। এ কথা সত্যিই অনস্বীকার্য যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যুক্ত না থাকলে 'এক্ষণ' এত দ্রুত শক্ত জমির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো কিনা সন্দেহ।
** 'এক্ষণ'-এর উপদেষ্টা হিসেবে সত্যজিত রায় :
সত্যজিত রায়ের সঙ্গে 'এক্ষণ'-এর সম্পর্ক পত্রিকাটির চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সত্যজিত রায়ের শৈল্পিক উৎকর্ষের ছোঁয়ায় পত্রিকাটির রঙিন প্রচ্ছদ বছরের পর বছর ধরে একইসঙ্গে দৃষ্টিসুখকর ও একধরণের গাম্ভীর্যের আভাসে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পত্রিকাটির সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্ক ছিল সেই শুরুর দিন থেকেই। পত্রিকাটির নামকরণ করা থেকে শুরু করে প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ অলংকরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এবং সৌমিত্রবাবুর পরিচিত মহলের ব্যাপ্তির কারণে সূচনার দিনগুলিতে 'এক্ষণ'-এর সাহায্য ও সহযোগিতার অভাব হয়নি।
পরবর্তী সময়ে 'এক্ষণ'-এর সঙ্কটের দিনগুলিতেও তিনি তাঁর নৈতিক অনুপ্রেরণা ও সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে পত্রিকাটির পাশে উপস্থিত ছিলেন। ১৩৮৭র (ইং ১৯৮১) শারদীয় সংখ্যা পর্যন্ত সৌমিত্রবাবু এক্ষণ'-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সৌমিত্রবাবু সরে যাওয়ার পরেও সত্যজিত রায় পত্রিকাটির mentor বা উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯২ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
** 'এক্ষণ' এবং নির্মাল্য আচার্য :
নির্মাল্য আচার্যও ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, তবে তিনি শিক্ষা জগতের মানুষ ছিলেন। 'এক্ষণ' প্রকাশিত হতে শুরু হওয়ার পরে তিনি বাংলার অধ্যাপক হিসেবে আশুতোষ কলেজে যোগ দেন। তিনি পত্রিকা ছাপার জন্য কাগজ কেনা থেকে শুরু করে প্রেসের যাবতীয় কাজ এবং প্রুফ দেখার দায়িত্বটি সামলাতেন। সৌমিত্রবাবু ও নির্মাল্যবাবুর যৌথ উদ্যোগ এবং পরিকল্পনার ফলস্বরূপই এক্ষণ-এর জন্ম হয়েছিল।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত সৌম্য চেহারার নির্মাল্যবাবুর মধ্যে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। তবে নির্মাল্যবাবু কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, সৌমিত্রবাবুর মতো তাঁর জনসংযোগ ছিল না। তিনি সকলের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করতেন না। কফিহাউসে নিয়মিত সকালে বা দুপুরে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে গম্ভীর মুখে প্রুফ দেখতেন তিনি। কেউ তাঁর ধারে-কাছে আসার সাহস করতো না। অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, সিনেমার পর্দার নায়ক হলেও সব ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশতেন তিনি। তবে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতা ও উপদেষ্টা হিসেবে সত্যজিত রায়ের উপস্থিতির কারণে নির্মাল্যবাবুরও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাঁর পরিচিত মহলের ব্যাপ্তি ঘটেছিল।
নির্মাল্যবাবু সম্পাদক হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্বশীল থাকলেও তাঁর এমন কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল যা সম্ভবত সেই সময়ে পত্রিকাটির পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। গল্প ও কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাব ছিল কিছুটা রক্ষণশীল, তিনি মূলত প্রবন্ধের ওপরেই গুরুত্ব দিতেন। সাহিত্যের ছাত্র হলেও তিনি কবিতাকে লেখা বলে মনে করতেন না। একবার তিনি শঙ্খ ঘোষকে বলেছিলেন যে পত্রিকাতে অনেক দিন ধরেই তিনি কোনও লেখা দিচ্ছেন না। শঙ্খবাবু যখন তাঁকে মনে করিয়ে দেন যে গত সংখ্যাতেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, তখন তাঁর উত্তরে নির্মাল্যবাবু বলেছিলেন যে ওটা তো কবিতা, লেখা নয়! শোনা যায় কবিতার প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্বে চিড় ধরার অন্যতম একটি কারণ ছিল।
তবে পুরাতত্ত্ব ও প্রাচীন লেখালেখির বিষয়ে নির্মাল্যবাবুর অপরিসীম আগ্রহ ছিল। মূলত তাঁর এই আগ্রহের কারণেই 'এক্ষণ'-এর পৃষ্ঠায় নিয়মিতভাবে বহু প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য রচনার পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হওয়া সম্ভব হয়েছিল, নির্মাল্যবাবু না থাকলে যেগুলির পান্ডুলিপি হয়তো আর কোনও দিনই দিনের আলোর মুখ দেখতো না। পত্রিকায় প্রকাশিত সেইসব লেখাগুলি পড়ে রবীন্দ্র স্নেহধন্য ও 'বিশ্বভারতী' পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক পুলিনবিহারী সেন একসময় নাকি তাঁকে বলেছিলেন 'পত্রিকার নাম এক্ষণ না রেখে তক্ষণ রাখলেই তো পারতেন ভাই'।
অকালে প্রয়াত হয়েছিলেন নির্মাল্যবাবু। ১৯৯৫ সালের ৩০শে জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। ১৩৮৭-র শারদীয় সংখ্যা থেকেই নির্মাল্য আচার্য 'এক্ষণ'-এর একক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। শেষের দিনগুলো খুব একটা সুখকর ছিল না নির্মাল্যবাবুর। তার বছর তিনেক আগে ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল সত্যজিত রায়েরও প্রয়াণ ঘটেছে। এই অবস্থায় 'এক্ষণ'-এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আর তাঁর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে 'এক্ষণ' তখন প্রায় অবলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ১৪০২ সালের শারদীয় সংখ্যাটি 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয় (ক্রমসংখ্যা হিসেবে মুদ্রিত ছিল ৩৫ বর্ষ, ২০ খন্ড, ৫-৬ সংখ্যা)।
নির্মাল্যবাবুর মৃত্যুর পরে মূলত 'এক্ষণ'-কে কেন্দ্র করেই একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে রায় পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়াত নির্মাল্যবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি নাকি সত্যজিত রায়ের বহু মূল্যবান সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ প্রশাসনকে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যিক দেবেশ রায় অবশ্য নির্মাল্যবাবুর পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। 'আজকাল' সংবাদপত্রে তিনি 'নির্মাল্যের সম্মানের পুনরুদ্ধার চাই' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
** 'এক্ষণ'-এর সংকটকাল এবং অবশেষে পত্রিকাটির অবলুপ্তি :
'এক্ষণ' প্রকাশের সূচনার চার-পাঁচ বছর পর থেকেই ক্রমশ বিষয় বৈচিত্র্য কমে আসার মতোই পত্রিকাটিতে লেখকের সংখ্যাও কমতে থাকে। একই লেখকের লেখা প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় মুদ্রিত হতে থাকে। সেইসব লেখকের লেখা না পাওয়া গেলে 'এক্ষণ' প্রকাশে বিলম্ব হতে শুরু করে। এটি একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা ছিল। এই সময় থেকে বিলম্ব ঘটতে ঘটতে ক্রমশ ত্রৈমাসিক, ষান্মাষিক থেকে পত্রিকাটি বার্ষিক হয়ে যায়।
১৩৬৯ সালের শারদ সংখ্যাটি ছিল 'এক্ষণ'-এর নবম সংখ্যা। এরপরেই অবশ্য পত্রিকাটি প্রথম দেড় বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৩৭১ সালের বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য সংখ্যা থেকে। এরপর দু মাস অন্তর অন্তর মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটির প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে যায়। তারপর ১৩৮০-র শারদ সংখ্যার পর আবার এক বছর 'এক্ষণ'-এর একটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়নি। এরপর প্রকাশিত হতে শুরু হওয়ার পরে কোনও বছর তিনটি, কোনও বছর দুটি এবং পরের দিকে বছরে একটি (কেবলমাত্র শারদ সংখ্যা) – এইভাবে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে।
পরবর্তীকালে সিনেমা জগতে ব্যস্ততা ও ব্যক্তিগত নানা কারণে সৌমিত্রবাবু 'এক্ষণ' পত্রিকার থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে (১৩৮৭ সনের শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের পর) পত্রিকাটির অতীতের গরিমা ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ণ হতে থাকে ও পত্রিকাটির সংকট ঘনীভূত হওয়া শুরু হয়। এই সময় নির্মাল্য আচার্য একমাত্র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন।
১৯৮২-র শারদ সংখ্যা থেকেই 'এক্ষণ'-এ চলচ্চিত্র বিষয়টি বেশী প্রাধান্য পেতে শুরু করে। কোনও একটি সিনেমার চিত্রনাট্যের পাশাপাশি সেটি তৈরির ইতিহাস, স্মৃতিকথা এবং বিদেশী চিত্র সমালোচকদের অনুবাদও প্রকাশ পেতে থাকে। এমনও দেখা যায় একই সংখ্যাতে রুশ পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইন ও জাপানী পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার আত্মজীবনীর অনুবাদকে প্রকাশিত হতে।
এই সময়ের পর থেকেই পত্রিকাটির চরিত্র ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। লেখক সংখ্যা অনেকটাই কমে আসে। বিষয় বৈচিত্রের অভাবে পাঠকগোষ্ঠীর অনেকের কাছেই 'এক্ষণ'কে একঘেয়ে মনে হতে শুরু হয়।
অবশেষে নির্মাল্য আচার্যর মৃত্যুর পরে ১৪০২ সালের শারদীয় সংখ্যাটি 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয় (ক্রমসংখ্যা হিসেবে মুদ্রিত ছিল ৩৫ বর্ষ, ২০ খন্ড, ৫-৬ সংখ্যা)।
** বাংলা সাহিত্য জগতে এক্ষণ-এর অবদান :
মোটামুটি হিসেব করে দেখা যায় ১৩৬৮-র বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য সংখ্যা থেকে ১৪০২-এর শারদ সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকাটির মোট ৭৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলা পত্রিকার জগতে কেবলমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন নয়, বাংলা পত্রিকা প্রকাশণার সামগ্রিক মানকেও একটি উচ্চস্হানে নিয়ে গিয়েছিল।
'এক্ষণ'-এর প্রগতিশীল সাহিত্য ভাবনার জন্য সেটি বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনও যে সংগ্রহযোগ্য হয় তা পাঠকদের চিন্তাভাবনার স্তরে 'এক্ষণ' পত্রিকাই প্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রকাশকের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে – "কিছু কিছু উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান থাকে যা কেবল একজন ব্যক্তির চিন্তা, রুচি, দর্শন আর কর্তব্যনিষ্ঠার গুণেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। 'এক্ষণ' ছিল একান্তভাবেই নির্মাল্যবাবুর পত্রিকা। তাঁর অবর্তমানে পত্রিকার বৈশিষ্ট্য, চরিত্র বজায় রেখে 'এক্ষণ' প্রকাশ করা অসম্ভব। এই সংখ্যাটি তাই 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হল"।
অন্যান্য কিছু ছবির সঙ্গে 'এক্ষণ'-এর সেই দুষ্প্রাপ্য শেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ, সূচিপত্র এবং প্রকাশকের কথা'র ছবি এখানে তুলে দিলাম। এছাড়াও ওই সংখ্যার সঙ্গে ক্রোড়পত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল আশিষ কুমার হাজরা সংকলিত 'সূচী এক্ষণ', যেখানে এক্ষণ-এর প্রথম সংখ্যার থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত লেখক সূচীর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত লেখাগুলিকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করে প্রকাশকাল অনুসারে একটি কালানুক্রমিক তালিকা তৈরী করা হয়েছিল। সেই তালিকার কয়েকটি পৃষ্ঠাও এখানে তুলে দিলাম।
"এক্ষণ" – বাংলা সাহিত্য জগতের একদা জনপ্রিয় একটি স্বতন্ত্রধারার পত্রিকা, কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য ও আলোচনা :
১৯৬১ থেকে ১৯৯৫ সাল (বাংলা: ১৩৬৮ সন - ১৪০২ সন) পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য জগতের একদা জনপ্রিয় ও স্বতন্ত্রধারার পত্রিকা 'এক্ষণ'-এর প্রকাশকালের সময়পর্ব। পত্রিকাটি তার প্রকাশণার এই পয়ত্রিশ বছরের সময়কালে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছিল। বাঙালি শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত পাঠক মহলে পত্রিকাটির বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল সম্পাদক হিসেবে নির্মাল্য আচার্য'র সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি (নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একসময় সিটি কলেজের সহপাঠী ছিলেন ও পত্রিকাটি প্রকাশের প্রাথমিক পরিকল্পনা এনারা দুজনেই করেছিলেন) এবং পত্রিকাটিকে উপস্থাপনার বিষয়ে বিভিন্ন রকম পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য সূচনার সময় থেকেই সত্যজিত রায়ের মতো ব্যক্তিত্বের যুক্ত থাকা। পত্রিকাটির জন্য 'এক্ষণ' নামটিকে নির্বাচন করেছিলেন সত্যজিত রায় এবং তাছাড়াও পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ অলংকরণের দায়িত্বও নিয়েছিলেন তিনি। প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদেই থাকতো শিল্পী সত্যজিত রায়ের অসাধারণ ক্যালিগ্রাফির কাজ।
পত্রিকাটির লেখক তালিকাতে ছিলেন সত্যজিত রায়ের বন্ধু কমলকুমার মজুমদারসহ অনেক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, যাঁদের মধ্যে অনেকেই বাজারচলতি পত্রিকাতে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। সেই সময়ের বাংলা ভাষার এমন কোনও বিখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক ছিলেন না, যারা 'এক্ষণ'-এর হয়ে কলম ধরেন নি।
** 'এক্ষণ'-এর প্রথম সংখ্যার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যার সূচীতে যে সমস্ত লেখক, প্রাবন্ধিক ও কবির নাম ছিল তাঁরা হলেন – প্রবন্ধ বিভাগে ভবতোষ দত্ত, শ্যামল রায়চৌধুরী ও মৃণাল সেন; গল্প বিভাগে কমলকুমার মজুমদার; কবিতা বিভাগে অরুণ মিত্র, বিষ্ণু দে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জিত সিংহ ও সলিল গঙ্গোপাধ্যায়।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল কমলকুমার মজুমদারের বিখ্যাত গল্প 'গোলাপ সুন্দরী'। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার একটি সংকলন 'জাপানের প্রতি' পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল।
'এক্ষণ' প্রকাশের সূচনার বছরটি অর্থাৎ ১৩৬৮ বঙ্গাব্দটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষের বছর। সেই কারণেই 'সম্পাদকীয়' শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল 'রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী বিষয়ক প্রস্তাব' শিরোনামে একটি লেখা। সেই লেখাতে নিজেদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সম্পাদক মন্ডলীর তরফে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।
** 'এক্ষণ'-এর প্রাথমিক পর্ব – বিষয়বৈচিত্র, সুস্থ মূল্যবোধ ও রুচিশীলতার একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত :
'এক্ষণ'-এর প্রথম দিকের কয়েকটি সংখ্যার নির্বাচিত বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম ছিল শেক্সপীয়ার, কার্ল মার্ক্স, দান্তে, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরী প্রভৃতি – যা পত্রিকাটির মান ও গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। লেখার বিষয় হিসেবে সাহিত্যের পাশাপাশি স্থান করে নিয়েছিল রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পচর্চা, নাট্যচর্চা, চলচ্চিত্রচর্চা প্রভৃতি।
'এক্ষণ'-এর এই প্রথম দিকের সংখ্যাগুলির বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে কেবলমাত্র গল্প, কবিতা বা প্রবন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা নয় বরং সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলির ওপরেও সম্পাদকমন্ডলীর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ার অভিপ্রায় ছিল।
প্রথমে এক্ষণ কলেজ রো-তে অবস্থিত নির্মলেন্দু ভদ্র নামক একজন প্রকাশকের প্রকাশণা সংস্থার থেকে প্রকাশিত হতো। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের প্রকাশণা সংস্থা 'সুবর্ণরেখা' প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। ১৯৬২ সাল থেকে 'সূবর্ণরেখা'ই পত্রিকাটির প্রকাশের ঠিকানা হয়ে যায়। সূচনার দু-এক বছরের মধ্যেই বাংলা সাহিত্যের জগতে সুস্থ মূল্যবোধ ও রুচিসম্পন্নতার প্রতীক হিসেবে 'এক্ষণ' একটি স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে ফেলে।
** বিষয়বস্তুর নানাবিধ বৈচিত্র্য :
পত্রিকাটির 'পুনর্মুদ্রণ' বিষয়ক বিভাগটি সম্পর্কে প্রথমেই স্বতন্ত্রভাবে কিছু উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথম সংখ্যা থেকে প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য রচনার পুনর্মুদ্রণ করা হতো 'এক্ষণ' পত্রিকায়। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জাপানের প্রতি'। পরবর্তী বিভিন্ন সংখ্যায় যে লেখাগুলিকে পুনর্মুদ্রিত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উনবিংশ শতকের প্রখ্যাত সাহিত্যিক অনুবাদক ও বঙ্কিমচন্দ্রের 'বঙ্গদর্শণ'-এর একজন নিয়মিত প্রবন্ধকার রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের 'প্রাচীন ভারতবর্ষ', উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর 'আমার কথা', বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্রর ১৭৭৮ সালে লেখা 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত', প্রখ্যাত পন্ডিত শিক্ষাব্রতী প্রবন্ধকার কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যর মূল ফরাসী থেকে অনুবাদ 'পৌল ভর্জিনী' এবং 'দুরাকাঙ্খের বৃথা ভ্রমণ', উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত সাংবাদিক প্রবন্ধকার ও লেখক অক্ষয়কুমার দত্তর 'বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ', উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'গুপী গাইন' প্রভৃতি। দুষ্প্রাপ্য এই লেখাগুলির পুনর্মুদ্রণ পত্রিকার মান ও জনপ্রিয়তাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে।
ইউরোপের দর্শণ, রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ক রচনাও 'এক্ষণ'-এর পাতায় গুরুত্ব সহকারে স্থান পেয়েছিল। এই পত্রিকাই প্রথম পাশ্চাত্যের উত্তর আধুনিক দার্শনিক জাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, জাক লাকাঁর মতবাদ ও চিন্তা-ভাবনাকে সহজ ভাষায় বাঙালী পাঠকদের কাছে তুলে ধরে।
সমসাময়িক ও অতীত দিনের অনেক বিখ্যাত মহিলাদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত মহিলাদের আত্মজীবনীও স্থান পেয়েছিল এই পত্রিকাতে। এরকম প্রায় কুড়িটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে ছিলেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, কল্পনা দত্ত (যোশী), জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, শরৎকুমারী দেবীর মতো পরিচিত নাম। এঁদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের অখ্যাত ও অনামী মহিলাদের আত্মজীবনীও প্রকাশিত হয়েছিল। এইসব আত্মজীবনীমূলক রচনায় তৎকালীন বাঙালি সমাজ জীবনের বিভিন্ন চিত্র উঠে এসেছিল।
পত্রিকাটির আরেকটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দিক ছিল কলকাতা বিষয়ক গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সরকারী পুঁথিপত্র থেকে বা সরাসরি বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দলিলের মাধ্যমে তথ্য অনুসন্ধান করে লিখিত এই প্রবন্ধগুলি ছিল নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। রাধারমণ মিত্র ও দেবাশিস বসুর কলকাতা বিষয়ক প্রবন্ধগুলি এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়, যা স্বাতন্ত্র ও উৎকৃষ্টতার দিক থেকে কলকাতার ইতিহাসচর্চায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল।
এছাড়াও প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকতো বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবন্ধের সম্ভার। প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর মধ্যে সাহিত্য, রাজনৈতিক, সামাজিক, আঞ্চলিক ইতিহাস থেকে শুরু করে শিল্প-সংস্কৃতি, নাটক, চলচ্চিত্র, ফটোগ্রাফি চর্চা – সব কিছুকেই স্থান দেওয়া হতো। প্রবন্ধ লেখকদের যে নামের তালিকাটি পাওয়া যায় তা রীতিমত সম্ভ্রমের উদ্রেক করে। এই তালিকাতে ছিলেন অমিয় কুমার বাগ্চী, অশোক মিত্র, আনিসুজ্জামান, কমলকুমার মজুমদার, কার্তিক লাহিড়ী, গৌতম ভদ্র, ছন্দক সেনগুপ্ত, দেবাশিস বসু, দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, পরিতোষ সেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার দাশ, সিদ্ধার্থ ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নিত্যপ্রিয় ঘোষ, ব্যোমকেশ মুস্তাফি প্রমুখ। এঁদের মধ্যে অনেকেরই লেখা এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, বিশেষত সত্যজিত রায়ের পরিচালিত চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য 'এক্ষণ'-এর একটি নিয়মিত বিভাগ হয়ে উঠেছিল।
সত্যজিত রায়ের মোট বাইশটি সিনেমার চিত্রনাট্য এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।
পত্রিকাটির সর্বাঙ্গীন চরিত্র থেকে ক্রমশই এটা পরিস্ফূট হতে থাকে যে পত্রিকাটি সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর রুচি বা পছন্দকে অগ্রাধিকার না দিয়ে মননশীল, বৌদ্ধিক ও গবেষণাধর্মী চর্চার সঙ্গে যুক্ত পাঠকগোষ্ঠীর ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে আগ্রহী।
** 'এক্ষণ' পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা :
১৯৬১ সালে 'এক্ষণ' যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন 'অপুর সংসার'-এ অভিনীত চরিত্রের জন্য নবীন ও প্রতিভাবান নায়ক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তার আগে আকাশবাণীর চাকরী ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. ক্লাসের পড়াতে ইতি টেনেছেন। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হওয়ার কারণে সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখালেখির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ছিল তাঁর। এই কারণেই কলেজ জীবন থেকে সহপাঠী বন্ধু নির্মাল্য আচার্যর সঙ্গে তাঁর যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে উঠে আসে একটি সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা।
সূচনা পর্বেই অভিনয় জগতে সাফল্য প্রাপ্তি এবং তারপরে পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলির জন্য ব্যস্ততাবৃদ্ধি সত্ত্বেও কেবলমাত্র সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের কারণেই সৌমিত্রবাবু রাজি হয়ে যান একটি পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে। পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার জন্য তিনিই প্রথম নির্মাল্য আচার্যকে নিয়ে যান সত্যজিত রায়ের কাছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধেই সত্যজিত রায় পত্রিকার নামকরণ করার সাথে সাথেই প্রচ্ছদ অলংকরণ করতেও রাজি হয়ে যান। পত্রিকা প্রকাশের পরে অভিনয় জগতে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সৌমিত্রবাবু বিভিন্ন লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কেবলমাত্র লেখাই সংগ্রহ করতেন না, সেগুলো সব পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়ে দেখতেন। এছাড়াও তিনি পত্রিকার জন্য অর্থ সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন জোগাড় করার কাজও করতেন। এ কথা সত্যিই অনস্বীকার্য যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যুক্ত না থাকলে 'এক্ষণ' এত দ্রুত শক্ত জমির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো কিনা সন্দেহ।
** 'এক্ষণ'-এর উপদেষ্টা হিসেবে সত্যজিত রায় :
সত্যজিত রায়ের সঙ্গে 'এক্ষণ'-এর সম্পর্ক পত্রিকাটির চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। সত্যজিত রায়ের শৈল্পিক উৎকর্ষের ছোঁয়ায় পত্রিকাটির রঙিন প্রচ্ছদ বছরের পর বছর ধরে একইসঙ্গে দৃষ্টিসুখকর ও একধরণের গাম্ভীর্যের আভাসে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পত্রিকাটির সঙ্গে সত্যজিতের সম্পর্ক ছিল সেই শুরুর দিন থেকেই। পত্রিকাটির নামকরণ করা থেকে শুরু করে প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ অলংকরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এবং সৌমিত্রবাবুর পরিচিত মহলের ব্যাপ্তির কারণে সূচনার দিনগুলিতে 'এক্ষণ'-এর সাহায্য ও সহযোগিতার অভাব হয়নি।
পরবর্তী সময়ে 'এক্ষণ'-এর সঙ্কটের দিনগুলিতেও তিনি তাঁর নৈতিক অনুপ্রেরণা ও সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে পত্রিকাটির পাশে উপস্থিত ছিলেন। ১৩৮৭র (ইং ১৯৮১) শারদীয় সংখ্যা পর্যন্ত সৌমিত্রবাবু এক্ষণ'-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। সৌমিত্রবাবু সরে যাওয়ার পরেও সত্যজিত রায় পত্রিকাটির mentor বা উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নেন। ১৯৯২ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পত্রিকাটির প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ পরিকল্পনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
** 'এক্ষণ' এবং নির্মাল্য আচার্য :
নির্মাল্য আচার্যও ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, তবে তিনি শিক্ষা জগতের মানুষ ছিলেন। 'এক্ষণ' প্রকাশিত হতে শুরু হওয়ার পরে তিনি বাংলার অধ্যাপক হিসেবে আশুতোষ কলেজে যোগ দেন। তিনি পত্রিকা ছাপার জন্য কাগজ কেনা থেকে শুরু করে প্রেসের যাবতীয় কাজ এবং প্রুফ দেখার দায়িত্বটি সামলাতেন। সৌমিত্রবাবু ও নির্মাল্যবাবুর যৌথ উদ্যোগ এবং পরিকল্পনার ফলস্বরূপই এক্ষণ-এর জন্ম হয়েছিল।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী পরিহিত সৌম্য চেহারার নির্মাল্যবাবুর মধ্যে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। তবে নির্মাল্যবাবু কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, সৌমিত্রবাবুর মতো তাঁর জনসংযোগ ছিল না। তিনি সকলের সঙ্গে মেলামেশা করতে পছন্দ করতেন না। কফিহাউসে নিয়মিত সকালে বা দুপুরে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে গম্ভীর মুখে প্রুফ দেখতেন তিনি। কেউ তাঁর ধারে-কাছে আসার সাহস করতো না। অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত, সিনেমার পর্দার নায়ক হলেও সব ধরণের মানুষের সঙ্গে মিশতেন তিনি। তবে পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতা ও উপদেষ্টা হিসেবে সত্যজিত রায়ের উপস্থিতির কারণে নির্মাল্যবাবুরও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাঁর পরিচিত মহলের ব্যাপ্তি ঘটেছিল।
নির্মাল্যবাবু সম্পাদক হিসেবে যথেষ্ট দায়িত্বশীল থাকলেও তাঁর এমন কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল যা সম্ভবত সেই সময়ে পত্রিকাটির পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। গল্প ও কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাব ছিল কিছুটা রক্ষণশীল, তিনি মূলত প্রবন্ধের ওপরেই গুরুত্ব দিতেন। সাহিত্যের ছাত্র হলেও তিনি কবিতাকে লেখা বলে মনে করতেন না। একবার তিনি শঙ্খ ঘোষকে বলেছিলেন যে পত্রিকাতে অনেক দিন ধরেই তিনি কোনও লেখা দিচ্ছেন না। শঙ্খবাবু যখন তাঁকে মনে করিয়ে দেন যে গত সংখ্যাতেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে, তখন তাঁর উত্তরে নির্মাল্যবাবু বলেছিলেন যে ওটা তো কবিতা, লেখা নয়! শোনা যায় কবিতার প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিই পরবর্তীকালে নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্বে চিড় ধরার অন্যতম একটি কারণ ছিল।
তবে পুরাতত্ত্ব ও প্রাচীন লেখালেখির বিষয়ে নির্মাল্যবাবুর অপরিসীম আগ্রহ ছিল। মূলত তাঁর এই আগ্রহের কারণেই 'এক্ষণ'-এর পৃষ্ঠায় নিয়মিতভাবে বহু প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য রচনার পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হওয়া সম্ভব হয়েছিল, নির্মাল্যবাবু না থাকলে যেগুলির পান্ডুলিপি হয়তো আর কোনও দিনই দিনের আলোর মুখ দেখতো না। পত্রিকায় প্রকাশিত সেইসব লেখাগুলি পড়ে রবীন্দ্র স্নেহধন্য ও 'বিশ্বভারতী' পত্রিকার বিখ্যাত সম্পাদক পুলিনবিহারী সেন একসময় নাকি তাঁকে বলেছিলেন 'পত্রিকার নাম এক্ষণ না রেখে তক্ষণ রাখলেই তো পারতেন ভাই'।
অকালে প্রয়াত হয়েছিলেন নির্মাল্যবাবু। ১৯৯৫ সালের ৩০শে জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। ১৩৮৭-র শারদীয় সংখ্যা থেকেই নির্মাল্য আচার্য 'এক্ষণ'-এর একক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। শেষের দিনগুলো খুব একটা সুখকর ছিল না নির্মাল্যবাবুর। তার বছর তিনেক আগে ১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল সত্যজিত রায়েরও প্রয়াণ ঘটেছে। এই অবস্থায় 'এক্ষণ'-এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আর তাঁর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে 'এক্ষণ' তখন প্রায় অবলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর ১৪০২ সালের শারদীয় সংখ্যাটি 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয় (ক্রমসংখ্যা হিসেবে মুদ্রিত ছিল ৩৫ বর্ষ, ২০ খন্ড, ৫-৬ সংখ্যা)।
নির্মাল্যবাবুর মৃত্যুর পরে মূলত 'এক্ষণ'-কে কেন্দ্র করেই একটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে রায় পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়াত নির্মাল্যবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি নাকি সত্যজিত রায়ের বহু মূল্যবান সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন। তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ প্রশাসনকে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্যিক দেবেশ রায় অবশ্য নির্মাল্যবাবুর পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। 'আজকাল' সংবাদপত্রে তিনি 'নির্মাল্যের সম্মানের পুনরুদ্ধার চাই' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
** 'এক্ষণ'-এর সংকটকাল এবং অবশেষে পত্রিকাটির অবলুপ্তি :
'এক্ষণ' প্রকাশের সূচনার চার-পাঁচ বছর পর থেকেই ক্রমশ বিষয় বৈচিত্র্য কমে আসার মতোই পত্রিকাটিতে লেখকের সংখ্যাও কমতে থাকে। একই লেখকের লেখা প্রায় প্রতিটি সংখ্যায় মুদ্রিত হতে থাকে। সেইসব লেখকের লেখা না পাওয়া গেলে 'এক্ষণ' প্রকাশে বিলম্ব হতে শুরু করে। এটি একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা ছিল। এই সময় থেকে বিলম্ব ঘটতে ঘটতে ক্রমশ ত্রৈমাসিক, ষান্মাষিক থেকে পত্রিকাটি বার্ষিক হয়ে যায়।
১৩৬৯ সালের শারদ সংখ্যাটি ছিল 'এক্ষণ'-এর নবম সংখ্যা। এরপরেই অবশ্য পত্রিকাটি প্রথম দেড় বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আবার প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৩৭১ সালের বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য সংখ্যা থেকে। এরপর দু মাস অন্তর অন্তর মোট সাতটি সংখ্যা প্রকাশের পর পত্রিকাটির প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে যায়। তারপর ১৩৮০-র শারদ সংখ্যার পর আবার এক বছর 'এক্ষণ'-এর একটি সংখ্যাও প্রকাশিত হয়নি। এরপর প্রকাশিত হতে শুরু হওয়ার পরে কোনও বছর তিনটি, কোনও বছর দুটি এবং পরের দিকে বছরে একটি (কেবলমাত্র শারদ সংখ্যা) – এইভাবে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে।
পরবর্তীকালে সিনেমা জগতে ব্যস্ততা ও ব্যক্তিগত নানা কারণে সৌমিত্রবাবু 'এক্ষণ' পত্রিকার থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে (১৩৮৭ সনের শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের পর) পত্রিকাটির অতীতের গরিমা ধীরে ধীরে ক্ষুণ্ণ হতে থাকে ও পত্রিকাটির সংকট ঘনীভূত হওয়া শুরু হয়। এই সময় নির্মাল্য আচার্য একমাত্র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন।
১৯৮২-র শারদ সংখ্যা থেকেই 'এক্ষণ'-এ চলচ্চিত্র বিষয়টি বেশী প্রাধান্য পেতে শুরু করে। কোনও একটি সিনেমার চিত্রনাট্যের পাশাপাশি সেটি তৈরির ইতিহাস, স্মৃতিকথা এবং বিদেশী চিত্র সমালোচকদের অনুবাদও প্রকাশ পেতে থাকে। এমনও দেখা যায় একই সংখ্যাতে রুশ পরিচালক সের্গেই আইজেনস্টাইন ও জাপানী পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার আত্মজীবনীর অনুবাদকে প্রকাশিত হতে।
এই সময়ের পর থেকেই পত্রিকাটির চরিত্র ক্রমশ বদলে যেতে থাকে। লেখক সংখ্যা অনেকটাই কমে আসে। বিষয় বৈচিত্রের অভাবে পাঠকগোষ্ঠীর অনেকের কাছেই 'এক্ষণ'কে একঘেয়ে মনে হতে শুরু হয়।
অবশেষে নির্মাল্য আচার্যর মৃত্যুর পরে ১৪০২ সালের শারদীয় সংখ্যাটি 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয় (ক্রমসংখ্যা হিসেবে মুদ্রিত ছিল ৩৫ বর্ষ, ২০ খন্ড, ৫-৬ সংখ্যা)।
** বাংলা সাহিত্য জগতে এক্ষণ-এর অবদান :
মোটামুটি হিসেব করে দেখা যায় ১৩৬৮-র বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য সংখ্যা থেকে ১৪০২-এর শারদ সংখ্যা পর্যন্ত পত্রিকাটির মোট ৭৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলা পত্রিকার জগতে কেবলমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন নয়, বাংলা পত্রিকা প্রকাশণার সামগ্রিক মানকেও একটি উচ্চস্হানে নিয়ে গিয়েছিল।
'এক্ষণ'-এর প্রগতিশীল সাহিত্য ভাবনার জন্য সেটি বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনও যে সংগ্রহযোগ্য হয় তা পাঠকদের চিন্তাভাবনার স্তরে 'এক্ষণ' পত্রিকাই প্রথম পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রকাশকের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে – "কিছু কিছু উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠান থাকে যা কেবল একজন ব্যক্তির চিন্তা, রুচি, দর্শন আর কর্তব্যনিষ্ঠার গুণেই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। 'এক্ষণ' ছিল একান্তভাবেই নির্মাল্যবাবুর পত্রিকা। তাঁর অবর্তমানে পত্রিকার বৈশিষ্ট্য, চরিত্র বজায় রেখে 'এক্ষণ' প্রকাশ করা অসম্ভব। এই সংখ্যাটি তাই 'এক্ষণ'-এর শেষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশ করা হল"।
অন্যান্য কিছু ছবির সঙ্গে 'এক্ষণ'-এর সেই দুষ্প্রাপ্য শেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ, সূচিপত্র এবং প্রকাশকের কথা'র ছবি এখানে তুলে দিলাম। এছাড়াও ওই সংখ্যার সঙ্গে ক্রোড়পত্র হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল আশিষ কুমার হাজরা সংকলিত 'সূচী এক্ষণ', যেখানে এক্ষণ-এর প্রথম সংখ্যার থেকে শেষ সংখ্যা পর্যন্ত লেখক সূচীর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত লেখাগুলিকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করে প্রকাশকাল অনুসারে একটি কালানুক্রমিক তালিকা তৈরী করা হয়েছিল। সেই তালিকার কয়েকটি পৃষ্ঠাও এখানে তুলে দিলাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন