শুক্রবার, ১৬ মে, ২০১৪

উত্তর সম্পাদকীয় - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

 উত্তর সম্পাদকীয়
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য 



                                   খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না

        "বাজপেয়ী যখন মদতদাতা আর ঠ্যালা সামলান মোদি"

ভারতীয় জনতা পার্টি এবার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আস্তে চায়। তাতে দোষের কিছু নেই। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সুশাসনের। কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের ভোট দিতে বলেছেন। অবশ্য, এ-সব সিরিয়াস কথা শোনা যায় না নরেন্দ্র মোদীর মুখে। তিনি কোথাও লজেন্স-টফির গল্প বলেন, কোথাও চা-পানি-নাস্তার কথা, কোথাও বোঝান বিয়ে করেও বৌ নিয়ে ঘর না করলেকি কি সুবিধা ইত্যাদি ইত্যাদি।
          কিন্তু আমাদের সমস্যা হল, যে যা দেয়, খাই। খাই তো ঠিক, কিন্তু হজম হয় না যে! আর এই বয়সে ‘বেশি খাইলে হজম হয় না’ তো বলেছেন বিখ্যাত গায়ক শাহ আব্দুল করিম নিজেই। তাই গিলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিলতেও পারি না। উগড়ে দিয়তে হয়। তা, ভোটের বাজারে এই কদিনে অনেক খেয়েছি, কিছুটা উগড়ে দিতেই হচ্ছে। মাফ করবান আমাকে।
          এই সময়ে দেখে নিলাম, মাত্র ছয় বছর কেন্দ্রের সরকারে থেকে বিজেপি দেশবাসীকে কোন কোন কেলেঙ্কারী উপহার দিয়েছেন। এমনিতে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ প্রচারের সময়ে বিজেপি-র বিরুদ্ধে ৫৫ পৃষ্ঠার একটি দুর্নীতির চার্জশিট প্রকাশ করেছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিত ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। এখন তো তিনি রাষ্ট্রপতি, তাই তাঁর কথা বাদ দিলাম। সেই চার্যশিটে স্কুল পাঠ্যপুস্তকে আর এস এস-এর চিন্তাধারাকে অবশ্য পাঠ্য করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল। অভিযোগ, আত্মহত্যা করেছেন অন্ধ্রের অনন্তপুরে ২০০৯ জন সহ হাজার হাজার কৃষক। বলা হয়েছিল, এনডিএ আমলে বিজেপি-র দূর্নীতিতে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪৯,০৫৭ কোটি টাকার। এই অঙ্ক সত্যি বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। কম হতে পারে, বেশীও। আসল কথা টাকার অঙ্কে কে বেশী, সেটা নয়। কে সৎ, সেটা জানা জরুরি।  
আপাতত, কেবল বাজপেয়ী জমানায় ঘটে যাওয়া জাতীয় স্তরের দূর্নীতিগুলিরই একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেখে নেয়া যাক।   
·         অপারেশন ওয়েস্টএন্ড স্ক্যামঃ তেহেলকায় ফাঁস এই স্ক্যামে নগদ টাকা নিয়ের আর ডলারে ঘুষ চেয়ে ধরা পড়েন বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণ জানান, বাজপেয়ীর পালিতা কন্যার স্বামী তথা প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অফিসার রঞ্জন ভট্টাচার্য এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি ব্রজেশ মিশ্র সরাসরি জড়িয়ে আছেন এই স্ক্যামে। তাঁরা বিদেশ মন্ত্রক, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, বিদ্যুৎ মন্ত্রকে প্রভাব খাটিয়ে এভাবে টাকা কামাতেন। এই কেলেঙ্কারীতে দেখা যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বাড়িতে বসেই ঘুষ নিচ্ছেন তাঁর দলের মহাসচিব ও ব্যাক্তিগত বান্ধবী জয়া জেটলি।
·         কারগিলের কফিন স্ক্যামঃ নিয়ম না মেনে আমেরিকার এক কোম্পানির থেকে ২৫০০ ডলার দরে ৫০০০ কফিন কেনার বরাত দেওয়া হয়। কারগিল যুদ্ধে নিহতদের জন্য এটা জরুরি বলে বলা হয়। ১৯৯৯ ডিসেম্বরে সেই কোম্পানি ১৮ কেজি ওজনের বদলে সস্তার কাঠ দিয়ে তৈরি ৫৫ কেজি ওজনের কফিন দেবে বলে জানায়। ২০০০-এর মার্চে তারা মাত্র ১৫০টি কফিন দিলে সরকার সেই কোম্পানির প্রাপ্য অর্থের ৯০ শতাংশ বা ৩,৩৭,৫০০ ডলার (সেদিনকার হিসাবে ১.৪৭ লাখ টাকা) মঞ্জুর করে দেয়। পরে অতিরিক্ত ওজন ও বেঢপ মাপের কারণে সব কফিনই বাতিল করতে হয়।
·         অপারেশন বিজয় (কারগিল) পারচেজ স্ক্যামঃ সিএজি এই কেলেঙ্কারী ধরে ফেলে। কারগিল যুদ্ধের নাম করে এই কেনায় দেশের বিপুল অর্থ বরবাদ হয়। গোলাবারুদ কেনার বরাদ্দ ছিল ১০৭.৯৭ কোটি তাকার। আরও ৯১.৯৮ কোটি টাকার গোলাবারুদ কেনা হয়য়, যেগুলির ব্যবহারের তারিখ পার হয়ে গেছে। ‘এখুনি যুদ্ধে দরকার’ বলে ৩৪২.৩৭ কোটি টাকার এমন সব গোলাবারুদ বাইরে থেকে কেনা হয় যেগুলি দেশের অস্ত্র কারখানায় তৈরি হয়। অথচ, এ সব করা হয়য় দশম প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা (২০০২-২০০৭) চূড়ান্ত না করেই/ এ-নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় প্রতিরক্ষা সামগ্রী কেনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের রিপোর্ট দেখতে চেয়েছিল সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি, যা সংসদীয় কমিটির অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সরকার সেটি দেখায় নি।
·         কারগিল সেস এর অপব্যবহারঃ কারগিল যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের উপর চাপানো হয়েছিল যুদ্ধের খরচ মেটাতে। ২০০০-০১, ২০০১-০২ এবং ২০০২-০৩ আর্থিক বছরে যথাক্রমে ৮৯৫৪ কোটি টাকা, ৭৭৩৪ কোটি টাকা এবং ৬৪৯৯ কোটি টাকা কারগিল কর বাবদ আদায় হয়। সরকার এই টাকা প্রতিরক্ষা বিভাগের খাতে জমা না দিয়ে সরকারের সাধারণ তহবিলে নিয়ে নেয়, যা বে-আইনী। অন্যদিকে, সাধারণ মানুষকে কারগিল করের জন্য করছাড়ের ব্যবস্থাও সরকার করেনি, যা বিজেপির মদল লাল লুথরার নেতৃত্বের সংসদীয় কমিটি ‘অন্যায়’ বলে রায় দেয়।
·         হত্যাকারী মিগ কেলেঙ্কারিঃ মিগ বিমানগুলি পুরানো হয়ে গিয়েছিল, তবু বাজপেয়ী সরকার সেগুলি বদলে বিকল্প বিমান ব্যবহারে রাজি না হওয়ায় দেশের অনেক শেরা বৈমানিককে প্রাণ দিতে হয়। কেবল বাজপেয়ী জমানার (১৯৯৮-২০০৩) মধ্যেই ১৩৬টি বিমান দুর্ঘটনার মধ্যে ৮৮টিই ছিল মিগ বিমান। তাঁর পরেও আরও অনেকগুলি মিগ বিমান দুর্ঘটনায় আরও কিছু পাইলটের মৃত্যু হয়েছে।
·         চিকিৎসা সামগ্রী কেনায় দূর্নীতিঃ বাজপেয়ী সরকারের আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রকল্পের ওষুধ কিনত সরকার এমএসও-র মাধ্যমে সরাসরি সরকারি ওষুধের উৎপাদকদের থেকে। কিন্তু, এবার নীতি বদলে কেনা শুরু হল বেসরকারি ও বহুজাতিক উৎপাদক ও বিক্রেতাদের থেকে। ফলে, একটা চক্র তৈরি হল। তদন্তে নেমে সিবিআই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সি পি ঠাকুরের ডানহাত বাঁ-হাত দু’জনকে গ্রেফতার করে ও প্রচুর নথি উদ্ধার করে।
·         দিল্লির জমি বন্টন কেলেঙ্কারি বা হাডকো স্ক্যামঃ - প্রধানমন্ত্রী হয়েই নিজেপি, আরএসএস ও তাঁর সহযোগী সংস্থাগুলিকে দিল্লির গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জলের দরে জমি বন্টন শুরু করে এনডিএ সরকার। আরএসএস প্রধান কে এস সুদর্শণের অধীনস্ত লঘু উদ্যোগ ভারতীকে ৫৭১.২ বর্গ গজ জমি দেওয়া হয় দিল্লির উচ্চবিত্ত এলাকা রোজ এভেন্যুএ। সমর্থ শিক্ষা সমিতি নামে আরেকটি সংগঠনকে দিল্লির নামী নামী সাতটি এলাকায় জমি দেওয়া হয়। এই কেলেঙ্কারিতে দেশের ক্ষতি হয় ১৪,৫০০ কোটি টাকা। এতে সরাসরি জড়িত ছিলেন নগর উন্নয়ন মন্ত্রী অনন্ত কুমার।
·         ইউ টি আই স্ক্যামঃ – ভারত সরকারের ইউনিট ট্রাস্টের ইউএস-৬৪ স্কিমে প্রায় দু কোটি অবসরপ্রাপ্র কর্মচারী, অসংগঠিত শ্রমিক, বিধবা ও পেনসনভোগী লগ্নী করতেন। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তাঁরা ১৮ শতাংশ হারে লাভ পেয়েছিলেন। ১৯৯৮-এ বাজপেয়ী ক্ষমতায় আসার পর ইউটিআই লোকসানে গেলে এস সুব্রহ্মণ্যমকে প্রধান করে ইউটিআই-কে সমস্যামুক্ত করে সরকার। তারপর ‘জয়ললিতার চাপে এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মদতে সুব্রহ্মণ্যম বড় বড় কর্পোরেটের সঙ্গে দহরম-মহরম করে এনডিএ-র কাছের লোকেদের সুবিধা পাইয়ে দিতে ফালতু ও অচল বন্ড কেনায় টাকা ঢালে। ২০০০-এ সফটওয়ারের শেয়ারের দাম পড়ে গেলে সে-বছর আগস্ট সুব্রহ্মণ্যম অজানা সাইবারস্পেস ইনফোসিস লিমিটেডের ৩.৪৫ লাখ শেয়ার ৯৩০ টাকা প্রতি শেয়ার দরে কেনেন। জানা যায়, এই সংস্থার দুই প্রমোটার – অরবিন্দ এবং আনন্দ জুয়ারি আসলে আরএসএসের লোক। এমন ঘটনা ঘটে অসংখ্য। ইউটিআই-এর পুঁজি এক ধাক্কায় ৭৫,০০০ কোটি টাকা থেকে হয়ে যায় মাত্র ২৫,০০০ কোটি টাকা। , ফলে দু-কোটি ছোটো লগ্নীকারী সর্বস্বান্ত হয়ে যান, সরকারি সংস্থার উপর মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়। অভিযোগ, এই কেলেঙ্কারীতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা ও তাঁর ছেলে, যিনি মরিশাসের একটি লগ্নী সংস্থায় আছেন এবং এ-বছর ভোটে প্রার্থী হয়েছেন, জড়িত ছিলেন। মরিশাসের ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে এ-কাজ হয়েছিল।
·         পেট্রল পাম্প ও গ্যাস এজেন্সি স্ক্যামঃ বাজপেয়ী আসলে ৩৮৫০টি পেট্রল পাম্প ও গ্যাসের এজেন্সি দেওয়া হয়েছিল, যার অর্ধেকটাই দেওয়া হয়েছিল বিজেপি, সঙ্ঘ পরিবার, আরএসএস ও এই ধরণের সংগঠনের নেতাদের আত্মীয়-পরিজনদের। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত মহারাষ্ট্রে এর প্রাপকদের কয়েকজনের নাম দেখলেই তা স্পষ্ট হয় – আরএসএস মুখপাত্র এম জি বৈদ্যর ছেলে শ্রীনিবাস মাধবরাও দাইদ্যা, রাজ্য বিজেপি সভাপতি পান্ডুরং ফুন্দকার এর স্ত্রী শ্রীমতী ফুন্দকার, রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ মুন্ডের ভাইপো ধনঞ্জয় মুন্ডে এবং আরও অনেকে। উত্তর প্রদেশে বাজপেয়ীর আত্মীয় রাজ মিশ্র-র স্ত্রী অপর্ণা মিশ্রর নামও আছে এই তালিকায়।
·         জুদেও খনি কেলেঙ্কারীঃ ছত্তিশগড়ের এক নম্বর হিন্দুত্ববাদী নেতা তথা বাজপেয়ীর খনি মন্ত্রী দিলীপ সিং জুদেও ২০০৩ এঁর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দিল্লির তাজ মহল হোটেলে জনৈক ছদ্ম ব্যবসায়ী রাহুল সারাওগির সঙ্গে বসে মদ্যপান করতে করতে ছত্তিশগড় ও ওডিশায় খনি খণিনের অনুমতি দানের বিনিময়ে নগদ টাকা নিতে সম্মত বলে জানান। গোপন ক্যামেরায় ধরা সেই ভিডিওতে শোনা যায় যে তিনি বলছেন, ‘টাকা আমার কাছে ভগবানের মত’। ঘূষের অপরাধ ঢাকতে তিনি বলেছেন, “মহাত্মা গান্ধীও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিড়লাদের থেকে টাকা নিয়েছেন”। ধরা পড়ার পর তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট পিএস নটবর রাটেরিয়া স্বীকার করেন  সারাওগির সঙ্গে সেই বৈঠকের কথা। তাঁর পরই, এক মাস বাদে মামলা রুজু হয়য় জুদেও-এর নামে। তাঁর আগে খোদ প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী পর্যন্ত তাঁকে ক্লিন চিট দেওয়ার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘ক্যাসেটের ছবি অস্পষ্ট। যে অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানির হয়ে এই ব্যবসায়ী এসেছেন, ক্যাসেটে সে-সম্পর্কের বক্তব্য বা আগত ব্যবসায়ীর চেহারা স্পষ্ট নয়’। এমনকি ছত্তিশগড়ের ভোটে বিজেপি জিতেছে, তাই এই অভিযোগ অসত্য, এমন যুক্তিও তিনি দিয়েছিলেন।
·         তেলগি স্ট্যাম্প পেপার স্ক্যামঃ আবদুল করিম তেলগি-র নাম রাতারাতি সবাই জেনেছিলেন বিজেপি আমলের সবচেয়ে বড় স্ক্যামের কারণে। টাকার অঙ্কে এঁর পরিমাণ ৪৩,০০০ কোটি টাকা। জাল কোর্ট স্ট্যাম্প পেপার ছাপিয়ে ৩০০ বেতনভূক কর্মচারীর মাধ্যমে সারা দেশে সেই স্ট্যাম্প পেপার বিক্রি করিয়ে তেলগি ২০২ কোটি টাকার মালিক হয়ে বসেছিলেন। কর্ণাটক প্রথম এই ঘটনা ধরে ফেলে তদন্ত শুরু করতেই সারা দেশ নড়েচড়ে বসে। তেলগিকে এক পর্বে শরদ পাওয়ার ও ছগন ভূজবলের নাম করে, যদিও পাওয়ার ও ভুজবল প্রকাশ্যেই তা অস্বীকার করেন। অভিযোগ, বিজেপি নেতারা নিজেদের পিঠ বাচাতেই এই দুজনকে ফাসাতে চেয়েছিলেন।
·         প্রভিডেন্ট ফান্ড স্ক্যামঃ  অনেকগুলি প্রভিডেন্ট ফান্ড স্ক্যাম হয়েছে দেশে; বিজেপি আমলেরটি ৯২ কোটি টাকার। বিজেপি কর্মী সঞ্জয় আগরওয়ালের হোম ট্রেড নামে কোম্পানি ‘সিমেনস প্রভিডেন্ট ফান্ড দুর্নীতি’টি ঘটায়। সিবিআই মামলাটির তদন্ত করে সঞ্জয় আগরওয়ালের র বিরুধে ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দেয়। বিজেপি কর্মী এই ব্যক্তিটি একই সঙ্গে ৫.৪ কোটি টাকার রঘুবংশী ব্যাঙ্ক স্ক্যামেও জড়িত ছিলেন।
·         বালকো বেসরকারিকরণ স্ক্যামঃ বেসরকারিকরণের নামে দেশের তহবিল এমন খোলাখুলিভাবে বেসরকারি মালিকদের হাতে উজাড় করে দেওয়ার সর্বপ্রথম নিদর্শণ এটি। অগ্নি বা পৃত্থী-র মত জাতীর সামরিক স্বার্থের ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করেছে বালকো। আর সেই কোম্পানিকে, যার সম্পদের শুধু মূল্যই ছিল প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা, সেটি মাত্র ৫৫১ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয় ‘স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার’ এর নামে পিছন দরজা দিয়ে মালিকানায় আনা অনিল আগরওয়ালের স্টারলাইট গোষ্ঠীর কাছে। ছত্তিশগড়ের শঙ্কর গুহ নিয়োগী হত্যার পিছনে স্টারলাইট গোষ্ঠীর হাত ছিল বলে অভিযোগ। এখন এই গোষ্ঠীই ‘বেদান্ত’ নাম নিয়ে ওডিশার নিয়মগিরি পাহাড়ে থাবা বসাতে গিয়েছিল।
·         ভিএসএনএল বেসরকারিকরণ স্ক্যামঃ বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ভিএসএনএলে ভারত সরকারের অংশীদারী ছিল ৫২.৯৭ শতাংশ। আন্তর্জাতিক সব কলের (আইএসডি) একচ্ছত্র অধিকার ছিল ভিএসএনএলের। তা ছাড়া, প্রায় আধ কোটি গ্রাহকের কাছে তাঁরাই ইন্টারনেট পৌছে দিত। বেসরকারি করার জন্য বিজেপি সরকারের যুক্তি ছিল, ২০০৪-এ নয়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী ২০০২-এর মার্চে সেই অধিকার শেষ হবে। পরে জানা যায়, সরকার তারিখ এগিয়ে এনেছিল ‘এ টি অ্যান্ড টি’ নামে একটি বিদেশী কোম্পানীর স্বার্থে। অথচ, ভিএসএনএলের তহবিলে তখন লাভের অঙ্কই ৬০০০ কোটি টাকা। বালকো-তে স্টারলাইটের মত এখানে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার করা হয় ‘ক্রেডিট সুইস ফার্স্ট বোস্টন’ নামে একটি বিশ্ব-দালাল সংস্থাকে। অথচ, এই সংস্থাকেই সেবি শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে নিষীদ্ধ করেছিল। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে টেকনোলজি আনার নামে ২৫ শতাংশ শেয়ার বেসরকারি করা হয়। অধিকার দেওয়া হয়য়, নতুন কোম্পানির হাতে ক্ষমতা হিস্তান্তরের পর আরও ১০ শতাংশ শেয়ার বাজার থেকে তার কেনার অধিকার থাকবে। অর্থাৎ, মাত্র ৩৫ শতাংশ শেয়ার জলের চেয়েও কম দরে কিনে সেই কোম্পানি ৬০০০ কোটি টাকা ক্যাশ ব্যালান্সের ভিএসএনএলকে শুষে ছিবড়ে করার অধিকার পেল বাজপেয়ী জমানায়।
·         আই টিডিসি হোটেল বিক্রি কেলেঙ্কারিঃ এন্ডিএ সরকারে আসার পরপরই ভারতীয় পর্যটন বিকাশ নিগমের (আইটিডিসি) হোটেলগুলি বিক্রির উদ্যোগ নেয়। ১৯টি হোটেলের মধ্যে ৯টিকে তাঁরা বিক্রি করতে সক্ষম হয় মাত্র ৫৫৪৪ কোটি টাকার বিনিময়ে। হোটেলের কর্মচারীদের ইউনিয়নগুলি প্রতিটি ক্ষেত্রেই আপত্তি জানালেও তাঁদের কথা শোনা হয় নি। পরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দূর্নীতি হয়েছে। এরই একটি সেন্টুর হোটেল বিক্রি কেলেঙ্কারি।
·         সেন্টুর হোটেল বিক্রি কেলেঙ্কারিঃ ২০০২ এঁর জুনে হোটেল কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াকে দিয়ে মুম্বাই এয়ারপোর্টের সেন্টুর হোটেলটি মাত্র ৮৩ কোটি টাকায় বাত্রা হসপিটালিটি নামে একটি অজানা সংস্থাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বাত্রা গোষ্ঠীর মালিক এ এল বাত্রা একজন আরএসএস কর্মী ও শিল্পপতি। তাঁর চার মাসের মধ্যে বাত্রা হসপিটালিটি এই হোটেলটি ১১৫ কোটি টাকায় বেচে দেয় সাহারা গ্রুপকে। লাভের অঙ্ক ৩৫ শতাংশ বা ৩২ কোটি টাকা। এঁর ফলে স্পষ্ট হয়ে যায় কিভাবে হোটেল বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে আর এস এস। সিএজি (ক্যাগ) তাঁদের ২০০৪-এর রিপোর্টে বলে, “serious doubts on the methods used by the NDA government for computing the valuation of the underlying assets… … suffered a loss of rupees 145.69 crores in revenue in the sale of Centaur Hotel” অর্থাৎ, এই ভাবে বিক্রির সম্পদের মূল্য ভীষণভাবে কমিয়ে দেখিয়েছে এনডিএ সরকার, যার ফলে দেশের লোকসান হয়েছে ১৪৫।৬৯ কোটি টাকা।
·         অর্ডিন্যান্স ডিপোগুলিতে আগুনঃ এনডিএ আমলে যুদ্ধ, জওয়ানদের জন্য কফিন কেনায়, অস্ত্র কেনায় দূর্নীতির পাশাপাশি একের পর এক অস্ত্রাগারে আগুন লাগার বিষয়টিও এক ভয়ঙ্কর দূর্নীতির গন্ধ ছড়ায়। সামরিক বাহিনীর বিষয় বলেই অনেক কিছুই প্রকাশ্যে আনা হয় না, তবু দুর্ঘটনা হলে তাঁকে চাপাও যায় না। তাই ডিপোগুলিতে অগ্নিকান্ডের খবর প্রকাশ্যে আসে। জুন ২০০১ এঁর আগে মাত্র দু-বছরে কেন ১৭টি বা তাঁর বেশি অস্ত্রাগারে আগুন লেগেছিল, তাঁর কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। কোনও কোনও ঘটনা বয়াবহ আঁকার নিয়েছিল। যেমন, বিকানীরে উদাসর সামরিক এলাকার অস্ত্রাগারে দুপুরে আগুন লাগার পাশাপয়াশি ডিপোর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রাবাহী শতাধিক ট্রাকেও আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। দু-জন অসামরিক ব্যাক্তি নিহত ও ৯ জন আহত হলেও সামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের কোনও হিসাব দেওয়া হয় নি।  আগুন লেগেছিল পশ্চিম দিল্লির মোতিনগর ডিপোতেও। দমকল বাহিনীর অভিযোগ ছিল, প্রথমে তাঁদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। নয়া দিল্লির শুকুর বস্তির গোলাবারুদের ডিপোতেও আগুন লাগে। আগুনে পুড়ে ছাই হয় ২.৮৭ কোটি টাকার গুলিবারুদ। তার আগের দু-বছরে ১৭টি ডিপো আগুনে পড়েছিল। সরকারের সংবাদ এজেন্সি পিআইবি জানিয়েছে, ২৯ এপ্রিল, ২০০১-এ পাঠানকোটের মেমনুন ডিপোয় ২৭.৬৯ কোটি টাকার, ২৪ মে, ২০০১ ব্রিধওয়াল, গঙ্গানগরের ডিপোয় আগুন লেগে ৩৭৫.০৪ কোটি টাকার, শুকুরবস্তি ডিপোর আগনে ২.৮৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।  কেবল ২০০২ সালে সরকার তাই আগ্রা, মুম্বই, চেওকি, দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট, দেহু রোড, জবলপুর, কানপুরের ডিপোগুলির আধুনিকীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। খরচ ধরা হয় ১৮৭ কোটি টাকা, যা অবশ্যই বেড়ে তিন গুণ হয়েছিল।

·         গুজরাট ব্যাঙ্ক স্ক্যামঃ নরেন্দ্র মোদি এবার প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। এ-সব ঘটনার সময়ে তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিশ্চয়ই অনেককিছুই ভুলে যান নি। নিশ্চই তাঁর মনে আছে তাঁর দলের নেতাদের হাত যশে শুধু গুজরাটে সমবায় ব্যাঙ্ক স্ক্যাম এর কথা। ৯ টি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যায়, ১৭টি কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক ‘সিক’ বা অসুস্থ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ৮৭০ কোটি টাকার প্যাকেজ দিয়ে অবস্থা সামলাতে হয়েছিল তাকেই। তাঁর সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী প্রভাতসিং চৌহান-সহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে ১২৪ কোটি টাকা তছরূপের মামলা দায়ের করেন পঞ্চমহল জেলা সমবায় ব্যাঙ্কের প্রশাসক।