শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা



সম্পাদকীয়




কবিতায় কবি বলেছেন ' ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়'... কিন্তু উগ্রপন্থার শিকার হয়ে গলা টিপে ধরে সব ভাষা, তা এই সংখ্যাটি করতে গিয়ে টের পেলাম ... আন্দোলন, প্রতিবাদ,ধিক্কার... তরুন সূর্যের অস্তমিত করুণ রাগ সব ছিঁড়ে খাচ্ছে বুকের পাঁজর ... তখন সাহিত্য চর্চার বিলাসী স্বপ্ন কাদায় পড়ে লুটিয়ে একাকার ... লেখা চাইতে গিয়েই শুনছি ... " ভাটার দুনিয়ায় ভাষার জোয়ার কোথায় পাবো ?" শাহবাগের রক্তের দাম দেওয়ার ধৃষ্টতা আমরা করিনি। শুধু কোন স্লোগানে না গিয়ে, মেলাতে চাইলাম... দুই সাঁকো ' সাহিত্য - রাজনীতি'... কিন্তু দুইয়ের তুমুল বিস্ফোরণ ... তবু কিছু চাঁড়া পোঁতার আন্তরিক প্রয়াস, পাঠক বলুক কি হলো!


মৌলবাদী আগ্রাসনে যখন বাংলাদেশের পাশাপাশি কলকাতা তথা সমগ্র বাঙালি ফুঁসছে, তখন ঘরে বসে সম্পাদকীয় লেখা খুব জটিল। কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ কত কিছু জানাতে হয় । চামড়া ছিঁড়ে খাচ্ছে যখন কুমীর, তখন আর কিই বা বলি ? এখন শুধু শপথ নেওয়া আর দেয়াল ভাঙবার পালা... যদিও সেই হাতুড়ি খোঁজার কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি ।



ধর্ম শব্দের আক্ষরিক অর্থ- যা ধারণ করে। কিন্তু ধর্ম গ্রাস করছে এখন, রাজনীতি ,সমাজনীতি তথা মূল ধর্মনীতি । যার ফলাফল হল 'শাহাবাগ' ঘটনা । আজ ৪২ বছর পর ও যে একই ভাবে অপ শক্তি একই ভাবে কার্যকর তা প্রমাণিত । কিন্তু রাজাকার রা কোন ব্যাতিক্রমি মুখ নয়। বরং বেশ কিছুদিন ধরে চলে আসা এক মূর্খ স্তাবক মুখের মিছিল। শাহাবাগ প্রজন্মের দায়িত্ব ও শপথ তাই অনেকখানি। ... যারা ব্যাবসা আর ধর্ম করেন একসাথে এবং রাজনীতিকে নিয়ে আসেন গদি দখলের লড়াইয়ে , এখনো আমাদের বিশ্বাস সেই অন্ধকার দূর হবেই। যদিও কালাপাথর সরানোর কাজস্টাম খুব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ।

ভালো থাকার চেয়ে ভালো রাখা ও বাংলাকে একটু আব্রু দেওয়া বড় প্রয়োজন ।ক্ষ্যাপামি এবার প্রবল ভাবে হোক জীবনে ও রাষ্ট্রে ফুল ফোটাতে । এই নিন হাত পাতলাম - সবাই হাতে হাত মেলান ...

"আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি"




ক্ষেপচুরিয়াস সম্পাদক মণ্ডলীর পক্ষ্য থেকে -
ঊষসী ভট্টাচার্য

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি

খামচানো কালপৃষ্ঠা


কবি রাম বসুর দেয়া মহার্ঘ দু'আনা পুরস্কার

মলয় রায়চৌধুরী


ডায়রির এই এন্ট্রিটা লেখার জন্য গুগল ইমেজে কবি রাম বসুর ছবি খুঁজে পেলুম না । খটকা লাগায়, কৃষ্ণ ধর, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় খুঁজলুম, পেলুম না । কেমন যেন অপমানিত বোধ করলুম । এতকাল যাবত পশ্চিমবঙ্গের বাংলা অ্যাকাডেমি করছিলটা কী ? যতদূর জানি, এই কবিদের বলা হয় বামপন্হী মনোভাবাপন্ন । তাঁদের কবিতাতেও তাঁদের মনোজগত প্রতিফলিত । তার মানে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্হী সরকার এই কবিদেরওয়েবজগতে সংরক্ষণ করার কোনো ব্যবস্হাই করেনি । অথচ যারা, যাকে বলে ক্ষমতার অলিন্দ, সেখানে ঘুরঘুর করেছে, তারা আছে অনেকেই । 'দায়বদ্ধতা' শব্দটা নিয়ে কত কথা শুনেছি সেই সময়ে, সেই চল্লিশের দশকের আলোচকদের লেখায় । তারপর নকশাল আন্দোলনের সময়েও তাঁদের কবিতা থেকে রসদ খুঁজেছেন অ্যাক্টিভিস্টরা । অথচ কবিদের পাঠবস্তুতে দায়বদ্ধতা আছে কিনা তা যাচাই-পরখ করেই বিদ্যায়তনিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাধিকারীরা খালাস । খাদ্য আন্দোলনের সময়ে বড়ো দেবুদা ও ছোটো দেবুদা বহু ব্যানার ও মিছিল-তোরণে শ্রমিকদের ছবি এঁকে দিতেন, সেগুলোও হারিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ।


রাম বসুর কথা তুললুম এইজন্য যে আমি যখন নাকতলায় থাকতুম, তখন হঠাৎই একদিন তাঁর টেলিফোন পাই । কোথা থেকে আমার নম্বর পেয়েছিলেন জানি না । তাঁর কন্ঠস্বরটিও, বার্ধক্যে যেমন হয়, কাঁপা-কাঁপা । আমার সঙ্গে তাঁর কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি । অগ্রজ যে কবিরা পাটনা, চাইবাসা, উত্তরপাড়া, আহিরিটোলাতে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সূত্রে । তিনি জানালেন যে বাঁকুড়ার জনৈক কবি-সম্পাদক আমার একটি বই তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন আর সেই বইটি পড়ে তিনি আমাকে পুরস্কৃত করতে চান ; তিনি ওই কবি-সম্পাদকের মুখে শুনেছেন যে আমি কোনো পুরস্কার নিই না, তা সত্ত্বেও দিতে চান, আর আমাকে তা নিতেই হবে । রাম বসুর কথা শুনে টের পেলুম যে বাঁকুড়ার যে কবি-সম্পাদক আমার ফ্ল্যাটে এসে আমাকে এক হাজার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটেই অনুষ্ঠান করতে চেয়েছিলেন, তিনিই রাম বসুকে বলে থাকবেন । আমিওনাকে বললুম যে আমি সত্যিই কোনো সাহিত্য পুরস্কার নিই না, তা সে সরকারি, বেসরকারি, লিটল ম্যাগাজিন যারই পুরস্কার হোক না কেন । কেননা আমি চাইনা যে আমার মনোপরিসর অন্যের মূল্যবোধ ও জীবনদর্শনের দ্বারা দূষিত হোক । সেকারণে আমি কোনো সম্বর্ধনাও নিই না ।


রাম বসু বললেন যে উনি আমার বিষয়ে সেসব কথা শুনেছেন আর এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনিআমার পাঠক । কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে বিব্রত বোধ করছিলুম, অনুমান করে থাকবেন উনি । বললেন, ওনার সংগ্রহে বহু পুরোনো একটি দুআনি আছে।সেইটেই তিনি আমাকে আমার 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসের জন্য পুরস্কার হিসেবে দিতে চান ।


ধারাবাহিক - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


১।


আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু দিচ্ছিল



সে তাকিয়ে থাকে আর দেখে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালগুলো শুয়ে, জানলাগুলো নুয়ে আর ছাদভুঁয়ে এসে পড়েছে। বাইরে আকাশের দিকে একটা তোরণ, হতে পারে কোন মণ্ডপ আর নহবতখানা। তার আগে মেঘে-মেঘে কিছু রঙ হয়েছিল। পৃথিবীর কন্যাদের বিদায়। এইসময়, যে, কন্যে নয়, হাইওয়ের দিকে উঠছিল। পেট্রোলভ্যানের আলো মাপমত তার পেছনে এসে পড়েছিল। তারপর আর কিছু জানা নেই।


বিষাদ জ্বর নিয়ে গাছগুলো, মনে হয়,দেখে ছিল। প্রলাপ মারীর মধ্যে ছিল তারা। তাই সেভাষা পাতায়-পাতায় বোনা আছে। কোনদিন পাঠোদ্ধার হতে পারে। এদিকে তোলাবাজরা আকছার দানা ব্যবহার করছে। সন্ধের পর থেকেই শোনা যাচ্ছে সেসব অনিপুণ হাতের কারবার। ভারী ভারী মোটর বাইক সব শহরে ঢুকে পড়ছে। যেসব দোকানীরা ফ্লাইওভার, মেট্রো, মল শুঁকেশুঁকে এসেছিল, তারা হাতের সাথে সাথে ল্যাজও গোটাচ্ছে। হয়েছে বেশ। খচ্চর ছোকরারা যা যা মারাচ্ছিল, তার সাথো সংস্কৃতি মিশিয়ে দিচ্ছে। দেদার। লুটছেও ভাল।


সে শুধু লক্ষ্য রাখছে। হিপ পকেটে একটা ছোট নোটবুক, আর পেন্সিলারদের হাতে যেরকম থাকে ঠিক সেরকম একটা পেন্সিল। সুযোগ পেলেই আঁকিবুঁকি কাটছে। আর এমন ভাবে লেখাগুলো আওড়াচ্ছে যে মনে হচ্ছে বাপের না হলেও তার নিজের শ্রাদ্ধের খরচপত্রাদি। একাজে স্টেশানটা তাকে সাহায্য করছে খুব। স্টেশানের নিচে বাজারচত্বর। সব কটা নেশার ঠেক। মদ্দামাগি। শনিমন্দির লাগোয়া মাদুলি দোকান। গেল শনিবারের শালপাতা যেখানে একটা বাছুর চাটছে, ঠিক তার পাশ দিয়েই হাইওয়েটাতে উঠে যাওয়া যায়। এখন একটা ছেলে আর দুটো মেয়ে উঠছে।



২।


তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে…



বাজারী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় যেসব মফঃস্বলের কবিদের লেখা ছাপানোর আমন্ত্রণ জানানো হয় নি, তারা স্টেশান পেরিয়ে, এই প্রাচীন রাস্তাটার মোড় পেরিয়ে, বহু জন্মের নার্সিংহোমটার ঠিক নিচে, অফ্-সপটার সামনে, বাওয়াল দেয়। আর নক্কাছক্কা নেশা করে,যাদের লেখা ছাপা হয়েছে তাদের মা-মাসি করে। এরকমই একটা চাপের সন্ধ্যায় সে সেই নার্স-দিদিমণিকে নার্সিংহোমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে ও দেখতে থাকে। তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে।


আর ঠিক তেমনই তার শাদা জুতো।


নার্সদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণেই সে বাওয়াল দৃশ্য ত্যাগ করে তাকে অনুসরণ করে। ফোর পয়েন্ট ক্রসিঙে যে একটা নিদারুণ শাদা গাড়ি যে একটা নিদারুণ লাল আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল, দিদিমণি এসে সে-টাতে উঠে পড়ে। গাড়িটা শান্ত ও স্নিগ্ধ ভাবে গড়াতে শুরু করে, যেন তার অ্যাক্সিলিয়েটরে চাপ পড়তেই সন্ধ্যা হেলে যায়। আর ঠিক সে সময়েই, ভারী মোটরবাইকটা, এই দৃশ্য-কাব্যের মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়বে বলে, যেনসাইলেন্সর পাইপ ফাটিয়ে, গর্জনরত অবস্থায় গাড়িটার পিছু নেয়। এরপর আর কিছু জানা নেই। কারণ, জানা যায় না।


সে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। গুনে গুনে দুটো হোঁচট খায়। কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টকে সময় জিজ্ঞাসা করে। কাঠিকাবাব রোলের দোকানটা বন্ধ দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তারপর তার ডেরায় ঢুকে পড়ে । আজকের যা যা অনুসন্ধান নোটবুকে লিখে ফেলে। পেন্সিলটাকে ভাঁজে যত্ন করে রাখে।


এ সময়ে মোবাইলটা দুলে দুলে ওঠে। শব্দ তার কাছে বিভীষিকা বলে সে ওটাকে নিথর করে রাখে, ঠিক সেই নির্দেশে, যেভাবে ভাষ্যময় গলায় থিয়েটার শুরুর আগে রেকর্ডেড বাজানো হয়। সে অজান্তে হেসে উঠে। নিজেকে হেসে উঠতে শুনে একটু লজ্জিতও হয়। কারণ, তার বুকশেলফের পেছনে আর একটুও তলানি স্কচ নেই। যে কলটা ইনকামিং, সেটা তাকে আরও কিছু সময় বিব্রত করবে। তার আগে গলায় ঢেলে দিতে পারলে হত। কান দুটো গরম আর ভারী পড়ত। সে বাদ দিতে দিতে শুনত। তারপর না হয় বাদানুবাদে যেত।


হ্যালো রাজনীতি - অমিতাভ প্রহরাজ

অমিতাভ প্রহরাজ
হ্যালো রাজনীতি


"একটা বিস্তীর্ন ভ্রান্ত ধারনা রাজ করছে এ সময়। সেটা হলো রাজনীতি আর রাজনৈতিক ঘটনাকে একই বস্তু ধরে নেওয়া। রাজনৈতিক ঘটনার কবিতাসাহিত্যে প্রভাব আমার কাছে সম্পূর্ন অপ্রাসঙ্গিক। শুধু রাজনৈতিক কেন, যেকোন ঘটনার প্রভাব যদি কবিতায় থাকে, তবে তা কবিতা থাকেনা, অন্য মাধ্যম হয়ে যায়। সাহিত্যের মধ্যে ঘটনাবহনকারী হিসেবে কবিতা বা কাব্যবান কাব্যিবতীরা একেবারেই আনফিট। তার জন্য চওড়া জুলপিওয়ালা উপন্যাস, বা সরু গোঁফের গল্প বা ধুতি পাঞ্জাবী পরা প্রবন্ধ রয়েছে..."



হ্যালো রাজনীতি, মেসেজ পেয়েছি



দারুন শব্দের মধ্যে আধখানা দারুচিনি গাছ। তা সে গাছটি আড়াআড়ি কাটা না লম্বালম্বি দু ফাঁক, এরকম কোন দ্বন্দ্ব আসেনা, ধন্ধও থাকেনা। না আমাদের অনেক অনেক কিছু শেখায়, সেইভেবে গত দুটি না-কে দেখি। সত্যিতো, এই যে দ্বন্দ্ব আসেনা, ধন্ধ থাকেনা, এই দুটি না কেমন অম্লানবদনে একটি পরম আমাদের সামনে ফেলে যায়, যেন ওবেলার রুটি, শক্ত হয়ে গেছে তাকে ফ্লায়িং ডিস্ক এর মতো ছুঁড়ে দিল। আমিও যেন শীতের সকালে উঠোনে চেয়ার, চেয়ারে বসানো কোন গম্ভীর বাবা, সেভাবে তাকাই বাক্যটির দিকে, বাবাদের হাসি অর্থহীন হয়, সেইভাবে হাসি। "দারুন শব্দের মধ্যে আধখানা দারুচিনি গাছ" যেন মল্লিকদা, সকালে দুধ নিতে বেরিয়েছে, মাফলারে মলাট দেওয়া মুখ, শীতের সকালে গম্ভীর বাবাদের দিকে "কি মাস্টামশায়?" "ওই চলছে"। ব্যাস বেরিয়ে চলে যান। হঠাত খেয়াল হয়, আরে মল্লিকমশায়ের মাফলার মলাট, হনু টুপি, তসরের শাল সবকিছু আছে, নীচে চেক কাটা লুঙ্গিটি মায় আছে কোমরের গিঁট সমেত, কিন্তু ভেতরে তো কোন মাল ছিল না!! Rewind করে দেখি, হ্যাঁ এই মুখ ঘোরালেন কিন্তু কই, মুখ কই, এতো বেবাক ফাঁকা, মায় উল্টোদিকের বাবুনদের কোয়ার্টার দেখা যাচ্ছে। ব্যাস, শীতের সকালে রাশভারি বাবাকে নিমেষে বানানো হলো সন্ধ্যের মিলুদি, যে কিনা উঠোনে পেঁপে গাছ নড়ে ওঠে দেখলেই হেঁচকি তুলে ফিট হয়। তাহলে কি মল্লিকমশায় মানে চন্দ্রবিন্দু কেস?? দারুন শব্দের মধ্যে আছে আধখানা দারুচিনি গাছ, এখানে ছবি কই?? একটা জলজ্যান্ত মস্তো গাছ, তবু কিনা সামান্য দৃশ্যটুকুও নেই!! সকালের করিতকর্মা ভাই বিকেল, সেখানেও বাক্যটি ফিট করে দেখি কোন ছবি আসেনাতো। বরং বাক্যটা থেকে টাটকা পায়েসের গন্ধ ভেসে আসে।


ছোটবেলায় জানতাম পৃথিবীর সকলেই কোয়ার্টারে থাকে, পৃথিবীর সকলেই প্ল্যান্টে যায়। পৃথিবীর সর্বত্র অফিসার র‍্যাংকের মানুষ থাকে যারা থাকে বাংলোতে এবং যাদের বাংলোগুলির দিকে তাকিয়ে তলপেটে কিরকম দমবন্ধ লাগে, ফের সাইকেলের প্যাডেলে পড়ে চাপ, ফিরে আসি মাঠে। পৃথিবীর সবারই শিফটিং ডিউটি... এবং পৃথিবীর সবার ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ছোট্ট অবান্তর টুকু আনা একটিই কারনে। সেটা হচ্ছে, আমরা অর্থাৎ এইসব সুখসচ্ছ্বল ইস্পাত শহরের কলোনিতে জন্মানো বাসিন্দারা, পৃথিবী চিনতে কম নাকাল হইনি। কারন আজন্ম আমরা ছিলাম এক অদ্ভুত মডেল পরিবেশে। সবকিছু ঝুলনের মতো সাজানো গোছানো। রাস্তায় রোটারি। স্ট্রিট বা এভিনিউতে একইরকমের বাড়ি। নানান কাকু জেঠু, ডাক্তারজেঠু, তপনকাকু, শিকদার স্যার, কূহুদিদির মা, গৌরীপিসী। সবার বাড়ি একরকম না হলেও হিন্দিতে যাকে বলে বাতাবরন, সেই বাতাবরন একই। সবারই হয়তো রাজদূত, নয়তো বুলেট, নয়তো হীরো হোন্ডা। সুখী পরিবার। সবাই "লেবার ক্লাশের" সঙ্গে খুব বেশী মেলামেশা নয় এবং "অফিসার"দের ব্যাপার আলাদা। আসলে একটা মডেল পৃথিবীতে আমরা ছিলাম যেখানে symmetry একচ্ছত্র অধিপতি। সেই সিমেট্রির ধুনকি থেকে অসমান পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার পর আমরা জানপ্রান দিয়ে একটাই কাজ করেছি প্রথম কয়েক বছর সেটা হলো আকূল হয়ে সিমেট্রি খোঁজা। যতদিনে বুঝেছি যে আমরাই একটা অদ্ভুত পৃথিবী থেকে এসেছি, বাইরের পৃথিবীটা অদ্ভুত নয়, ততদিনে সারভাইভ করার মতো আঁশ, কানকো, ফুলকা ইত্যাদি গজিয়ে গিয়ে একেকজন একেকটা নিজস্ব মডেল করে নিয়েছি। উত্তরপাড়ার কাকু, শ্যামবাজারের বৌ এইসব দিব্যি থাকলেও আমার যে বেসিক কোন শিকড় বা কালচার বা ঐতিহ্য নেই তা ঘোরতরো মালুম হয়। এই জন্ম এবং এই রকম মেটামরফোসিসের ঘটনা হুবহু শূন্য দশকের কবিতায়। শূন্য দশকের কবিতার ছোটবেলা স্বপ্নের মতো, অপূর্ব তার পরিবেশ (আহা, মনে পড়ে এইরকম শীতের বিকেলগুলিতে খেলার সরঞ্জাম নিয়ে আমরা আর কোন এক কোটিমাঠপতি হেলায় এদিকে সেদিকে বিভিন্ন মাঠ ফেলে ছড়িয়ে গেছেন আমাদের জন্য, আহা দুর্গাপুর)। কোন কোটেশান তোলার জন্য আমি এখানে আসিনি। আমার লক্ষ্য কয়েকটা বিষয়ের তলায় সঠিক ফিল-ইন-দ্য-ব্ল্যাঙ্কসের দাগটা বসানো। শূন্য দশকের কবিতা উদবাস্তু কবিতা। প্রথম কবছর সিমেট্রির পৃথিবীতে জমিদারি করার পর যখন আছড়ে পড়লো বাইরের পৃথিবীতে, প্রথমেই ভাঙলো তার মাথার মধ্যেকার মডেল কবিতাটি। যেটি অপ্রতিমা হয়ে বিরাজমান ছিল।


#


মগ্ন আর মুগ্ধ র মধ্যে একটা সুচতুর পার্থক্য রয়েছে। সুচতুর পার্থক্য? হ্যাঁ... পার্থক্য-দার সঙ্গে মানুষের তিনবার আলাপ হয় জীবনে। এই পার্থক্যদা হলো মানুষের আদিম গডফাদার, অপূর্ব লাভ-হেট রিলেশান যার সাথে, কয়েক কেজি মাংস, রক্ত ও হাড়গোড়ের সঙ্গে মানুষ যাকে পিঠে নিয়ে ঘোরে। প্রথমবার আলাপ হওয়ার সময় বোঝাই যায়না আলাপ হয়েছে। পরে কোন একটা সময় হাঁটতে, হাঁটতে আচমকা মুখ ঘোরালে বোঝা যায় পাশে একজন ব্লু জীনস আর সাদা হাফশার্ট পরা লোক হাঁটছে, খুব একটা বিরাট কিছু চমকানো নামেনা তখন। কারন লোকটিকে দেখামাত্র, তক্ষুনি না হলেও সামান্য পরে আবছা আবছা ভাবে মনে পড়ে হ্যাঁ সত্যিই তো, বেশ খানিকক্ষন আগে থেকে, ওই জলট্যাঙ্কির পাশ দিয়ে শর্টকাট করার সময় থেকেই একজন পাশে পাশে হাঁটছিল, খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয়নি। এখন দেখে একটু আধটু কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে। “হাই”


-“হাই, আমার নাম পার্থক্য, পার্থক্য সেন”


-“আমি অমিতাভ্‌, অমিতাভ্‌ প্রহরাজ”


-“জানি”


-“জানেন!! Strange, কি করে জানলেন?”


-“আপনি নিজেই বলেছেন, খেয়াল নেই, গুনগুন করে গান গাইছিলেন “ওহে অমিতাভ্‌ প্রহরাজ/কি নিয়ে ভাবছো আজ/দেখো কত আছে কাজ/ তুমি বড় ফাঁকিবাজ/ ওহে ওহে ওহে ওহে”... ওই শুনে আন্দাজ করেছিলাম”


-“এ বাবা ছি ছি ছি... sorry... sorry… এমনি গাইছিলাম... ইস... এবাবা”


-“sorry বলছেন কেন, আমার তো ভালোই লাগছিল... ফাঁকা রাস্তায়...”


- “কোথায় যাচ্ছেন?”


-“ঠিক করিনি, আপনার সাথেই হাঁটছি...”


-“বাঃ... তুমুল... এটা গ্রেট ব্যাপার, ঠিকঠাক না করে হাঁটা... আমার খুব পছন্দের জিনিস”


-“জানি, সেজন্যইতো করছি”


-“এটাও জানেন!! ভারি ভালো লোক তো আপনি, চলুন, আমার ঘরে যাবেন? আড্ডা দেওয়া যাবে”


-“চলুন”


এইভাবেই পার্থক্যদা ঢোকে জীবনে। বোঝাই যায়না কি করতে এসেছে, কেন, কোথায়, কেমন। একটা নতুন মাইডীয়ার বন্ধু, যে আমাকে অনেকটা বোঝে। যার সাথে কথা বলতে, সময় কাটাতে ভালো লাগে। যার ব্লু জীনস সাদা হাফশার্ট ব্যাপক পছন্দ হয়, নিজের আলনায় শুধু নানান শেডের ব্লু জীনস আর সাদা বা সাদাটে ধরনের নানান কাটিং এর হাফশার্ট ঝোলে। ধীরে ধীরে দেখা যায় পার্থক্য সেন অনেকেরই প্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্লাবে বঙ্কু পচা বলে “শালা পার্থক্যদা না এলে সন্ধ্যেগুলো ইসবগুলের মতো লাগে মাইরি। কি রে অমিতাভ্‌ পার্থক্যদা কি শরীর খারাপ নাকি রে?”। মহল্লার প্রতিটি বন্ধু পার্থক্যদা বলতে অজ্ঞান। এবং এখানেই ফোঁটা, ফোঁটা, জলের মতো জমা হয় কুটুস। কুটুস হচ্ছে এক নতুন অনুভূতি, পার্থক্যদার সাথে আলাপের পর যেটা জীবনে এসেছে। যদিও সব জায়গায় পার্থক্যদা বলতে লোকে অমিতাভ্‌ এর বন্ধু বলেই চেনে, এছাড়া আর কোন পরিচয় জানা যায়না তার। তবু পার্থক্যদার ছায়া আস্তে আস্তে অগাধ হয়ে ওঠে আর অমিতাভ্‌ ছায়ার প্রেশারে তুবড়ে যায়। প্রতীবন্ধী সার্টিফিকেট নিয়ে হাঁটে, বাসে তা দেখিয়ে সীট পায় এবং একদিন জ্বর হয়। জ্বরের সময় ঘটে দ্বিতীয় আলাপটি। অমিতাভ্‌ দেখে পার্থক্যদা “খুব চিন্তার কথা, খুব চিন্তার কথা” ব’লে ক্লাবে বেরিয়ে যায় মনোরঞ্জন খেলতে। আর অমিতাভ্‌ জানলার ফাঁক দিয়ে দেখে পাশের বাড়ির বিল্টু, তারও জ্বর, তার পার্থক্যদা পাশে বসে জলপটি দিচ্ছে। তখন কোন কোন অমিতাভ্‌ বিল্টুর পার্থক্যদার সঙ্গে লুকিয়ে আলাপ করে, আর কোন কোন অমিতাভ্‌ বিল্টুর পার্থক্যদা আর তার পার্থক্যদার মধ্যে আরেকজন পার্থক্যদাকে দেখতে পায় তার সাথে আলাপ করে। প্রথম অমিতাভ্‌গুলো বিল্টুর পার্থক্যদার সঙ্গে নলবনে সময় কাটাতে গিয়ে পুলিশ রেডে ধরা পড়ে যায়। দ্বিতীয় অমিতাভ্‌গুলো নতুন পার্থক্যদাকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে, বোরখা পরিয়ে হাঁটে, তার সঙ্গে সংসার করে। এই পার্থক্যদাকে দিয়ে ফাইফরমাশ খাটায়, কুকুর ছাগলের মতো ব্যবহার করে। এবং এই সমস্ত কাজ নিপুন ভাবে করার জন্য আড়ালবিদ্যা শেখে। এইভাবে বহুদিন ঘরবাড়ি করার পর একদিন বাজার করে ফেরার পর দেখে হাল্কা ব্যাগ নিতে পার্থক্যদা দুহাত কাজে লাগাচ্ছে। অমিতাভ্‌ খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে দেখে পার্থক্যদার দুহাতেরই বুড়ো আঙুল নেই, গ্রিপ করতে অসুবিধে। অমিতাভ্‌ নিজের বুড়ো আঙুল দেখে, সুন্দর কচি ছেলের মতো নড়াচড়া করছে। তখনই হয় তৃতীয় আলাপ, অমিতাভ ও পার্থক্যদার মধ্যে যে পার্থক্যদা তার সাথে। অবাক হয়ে দেখে তৃতীয় পার্থক্যদা হুবহু তার মতো দেখতে, কিন্তু সে স্বাধীন, তার নিজের ইচ্ছে আছে, মর্জি আছে, ব্যক্তিত্ব আছে। এতদিন পার্থক্যদা তে মগ্ন থাকার পর অমিতাভ্‌ মগ্ন থেকে মুগ্ধ হয়। আর কোন কোন দিন, যেহেতু একই রকম দেখতে, অমিতাভ্‌ পার্থক্যদার যায়গায় আসে আর পার্থক্যদা অমিতাভ্‌-এর জায়গায়। ভারী মজা হয়... পার্থক্যদার চোখ প’রে সে শহর দেখে, পার্থক্যদার হাত প’রে সে সই করে। আড়ালবিদ্যার কোর্স শেষ হয়ে গেছে ব’লে প্রকাশবিদ্যার ক্লাসে ভর্ত্তি হয়। লোকে বলে ওর পার্থক্যবাজি করবার কেতাই আলাদা, মেয়েরা বলে অমিতাভ্‌দার পার্থক্য ইজ সো হট!! সত্যি পার্থক্যদাকে ওর আর প্রয়োজন হয়না। সারাদিন হাঁটুগেড়ে কাজ করতে হয় বলে অমিতাভ্‌ এর পা জমে যায়, এগোতে পারেনা, বড্ড বিরক্ত হয়, তখন ওই সত্যি পার্থক্যদাকে লাথি মেরে পা টা ছাড়িয়ে শুয়ে পড়ে ওকেই বলে পা টিপে দিতে... একটা মোটা ঘুম আর প্যাঁকাটি হাসি নড়াচড়া করতে ভাবে, ওঃ এই তো শিখর। পার্থক্যদা ‘ওর’ পা টিপে দিচ্ছে!!! আহা এই তো শিখর...


শূন্য দশকের এভারেজ কবিতা, sorry এই মুহূর্তে আমি কবিতার কোন separate existence এ বিশ্বাস করিনা, শূন্য দশকের এভারেজ লেখা এই জীবনটাই কাটিয়েছে। পার্থক্যদাকে দিয়ে পা টিপিয়ে, জল আনিয়ে, বাসন মাজিয়ে, মশারি টাঙিয়ে, তার ওপর দুবেলা নিজের এঁটো খেতে দিয়ে মাটিতে ঘুমোতে দিয়েছে। এই অমিতাভ্‌গুলো সরলরেখার সাথে প্রেম করতে করতেও করতে পারেনি। একে উদ্বাস্তু, তার একটা হীনমন্যতা অতি গোপনে কাজ করে। সেখানে পার্থক্যদার মতো একটা লোক তার “অধীন”, এই অধীনসুখ মনোরম ভাবে মন টিপে দেয় রোজ। কখনো পার্থক্যদা সেজে ক্লাবে গেলে, “গুরু, গুরু” শোনে। বাড়িতে থাকা পার্থক্যদাকে লাথি মারলেও কাইকাই করেনা, তাই সলমনের মতো তাকে মেরে, মুখ ফাটিয়ে কলার তুলে ডায়লগ মারার আরাম পায়, আরো কতো। শূন্য দশকের কবিতা basically বিহারের জোতদার দের মতো জীবন কাটিয়েছে, আরাম হি আরাম পেয়েছে আলোতে বা অন্ধকারে, বাথটাবে চান করে অডিকোলন মেখে স্বতন্ত্র নামে একটা রাঁড়ের দখলের জন্য খুনোখুনি করেছে... মোদ্দা কথা শূন্য দশকের লেখা আস্তে আস্তে বড়লোক কবিতা, গদিতে বসা লেখার উলটো দিকে নিজের গদি, নিজের বাংলো বানানোর ভঙ্গিমার সাথে খাটভাঙার নেশা করেছে। ব্রিলিয়ান্ট সময়টা সবাইকে দুরন্ত স্টাইলিশ ক্যাম্বিসের তৈরী সমস্যা কিনে দিয়েছে। নিতান্তই দরকার তাই মাঝে মাঝে ঝুলনের সৈনিকের মতো ঝুলনের ক্রাইসিস, ঝুলনের বিপদ কিনে দিয়েছে। ডেন্ডরাইট দিয়ে গাছের পাতা টাকে শক্ত করে আটকে দিয়েছে ডালে, দু পাশে দুটো কঞ্চির সাপোর্ট দিয়েছে, তারপর জল ফেলে, “জল পড়ে/পাতা নড়ে না” লিখে সম্মানীয় বিশ্লেষন পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে... কাকই প্রথম টের পায় লেখাতে ঘা হলে... কাকের ডাক বদলে গেছে, কা কা র বদলে কিহো কিহো ডাকছে, মানে ওর তোতলা ডায়লেক্টে “কি হবে”...



কেউ শেষ হবেনা, নষ্ট হবেনা। শুধু লেখা বা কবিতা নামক কাজটির মানে এবং ধারনা বদলে যাবে পুরো!!! ঠিক যেরকম "রাজনীতি" র সাথে হয়েছে... পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কনসেপ্টগুলোর মধ্যে একটা হলো "politics" যাকে a master mix of art & science with a highly skillful implementation বলে ধরা হয়. এবং that used to be a 'unique' and 'creative' activity, creating good life and just society!! ( "politics is the most important form of human activity because it involves interaction amongst free and equal citizens. It thus gives meaning to life and affirms the uniqueness of each individual."- Hannah Ardent)। ঠিক লেখার মতোই রাজনীতির জন্য দরকার ছিল উচ্চস্তরের মেধা এবং অনুভবের সমন্বয়, যুক্তির ওপর চূড়ান্ত দখল, এবং সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন, ভবিষ্যৎকে দেখার ও বিশ্লেষনের ক্ষমতা, সময়ের থেকে এগিয়ে ভাবনাচিন্তা করার পারদর্শিতা (একজন creative মানুষের গুণাবলির থেকে খুব তফাৎ হচ্ছে কি? আরো মজার কথা, এতেও পুঁথিগত বিদ্যার থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হতো)।


কিন্তু এখন? রাজনীতি, এই activityটির ধারনা ও perception এখন দাঁড়িয়েছে একটা ঘৃন্য, ন্যাক্কারজনক অভ্যেস বা কাজ যেটা বেসিক্যালি খারাপ এবং চালাক লোকেরা করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য, একটা permanent negative aura জড়িয়ে আছে এর সাথে মজ্জায়। সংজ্ঞা থেকে শুরু করে মায় basic concept টিও বদলে গেল। যা ছিল একটা creative activity তা হয়ে গেল একটা permissible crime!!! অফিসে ভয়ঙ্কর politics, শ্বাশুড়ি-ননদের politics!! Creativity র চিহ্নটিও হাওয়া। "রাজনীতি করে কিন্তু ভালো লোক", এতদুর অবধি মেনে নিতে রাজি, তাও as an exception। কিন্তু রাজনীতি করে আর creative genius, একটিও উদাহরন নেই, এটাকে accept করতেই রীতিমতো অসুবিধে। রাজনৈতিক intellectual দের আমরা বড়োজোর ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করাতে পারি, কিন্তু টপার? চাপ আছে। এবং এই আপাদমস্তক চরিত্রবদল, "আমি নিজেও জানিনা গো তোমার কাছে এসে আমি কি করে বদলে গেলাম প্রিয়া, তুমি আমাকে এক অন্য মানুষ করে দিলে"- এই টাইপের ইতিহাসের রোমান্টিক ন্যাকামো ভাবলে খুব ভুল হবে। এবং এটি কোন কাফকা-প্রোডাকশান ও নয়। এটি আসলে সভ্যতা নামক ভদ্রলোকটির ১০০% উদ্দেশ্যপ্রনোদিত এক সুপরিকল্পিত কৌশল। যেটা ছিল একটা specialized subject সেটা হয়ে গেল যেকোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব এমন activity। বলা যায় সময়ের সাথে বাড়লো (বাড়ানো হলো?) আরো আরো মানুষের participation।. যার জন্য একটা বিশেষ শিক্ষা, grooming, skill, experience এর প্রয়োজন ছিল, ধীরে ধীরে তা হয়ে গেল সাধারন মানুষের নাগালে। প্রথমেই উড়িয়ে দেওয়া হলো/বিলুপ্ত হলো specific মাপকাঠি বা standard । যা ছিল মার্কশিট সেটা হলো গ্রেডেশান এবং ফাইন্যালি শুধু সার্টিফিকেট। বিলুপ্ত হলো qualification এর প্রয়োজনীয়তা। "লেখা"/"কবিতা"র ক্ষেত্রেও জার্নি টা একই ভাবে চলছে। গত তিরিশ বছরে GPতে বেড়েছে participation, সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তাকে দরাজ ভাবে গ্রহন করা, encourage করা (প্রসঙ্গত আমি কিন্তু এগুলোকে কোনভাবেই negative phenomenon বলে define করছিনা)। চলেছে অবিশ্রান্ত দৈববাণী "আরো, আরো"।


এবং এই প্রক্রিয়াতে নিরুত্তর ভাবে একটা ঘটনা ঘটে গেছে অজান্তেই। যে "রাজনীতি" ছিল একধরনের বোধ, মনন, মেধাচর্চা, এ্যরিস্টটলের master science, মেকিয়াভেলির art of governance, ধীরে ধীরে তার উপাদানের মধ্যে "অনুপ্রবেশ" করেছে 'সাধারন মানুষের সোচ্চার হওয়া', 'দুর্নীতির প্রতিবাদ', 'অধিকারের লড়াই' এই ধরনের activity যার জন্য কোন বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়না। সোজা বাংলায় কঠিন কাজ পরিবর্ত্তিত হচ্ছে সহজ কাজে। বেশি শ্রম থেকে কম শ্রম। গত কুড়ি বছরে কবিতার ক্ষেত্রে হুবহু এই রূপান্তর দেখা যাচ্ছে। (in fact এই রূপান্তর গতো একশো বছর ধরেই চলছে। প্রথম দিকে তার বৃদ্ধিটা ছিল অতি অতি সামান্য যা চোখে পড়া অসম্ভব, সেটাই গত কুড়ি বছরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আরো স্পষ্ট এক দানবিক আকারের দিকে যাচ্ছে। ভেবে দেখলে ১৯১২ সালে বাংলায় মাত্র একজন কবি, কোন দ্বিতীয় নেই। তিরিশ থেকে চল্লিশে সেটা আঙুলে গোনা যাবে এমন একটা সংখ্যা। পঞ্চাশ ষাট, আঙুলে গোনা না গেলেও সংখ্যাটা বলা যাবে। ২০১২ তে সেনসাস ছাড়া অসম্ভব, তাও approximate সংখ্যা হবে, নির্দিষ্ট নয়। ছবিটা একটা ত্রিভুজ যার base চওড়া থেকে আরো চওড়া হচ্ছে। এবং এতে ধ্বংস বা বিলুপ্তির কোন প্রশ্নই আসেনা। কোন প্রজাতির জায়গা আসেনা। যা হুহু করে, বলতে গেলে দিনকে দিন বদলাচ্ছে তা হলো perception আর image। কিছু ''বিশেষ'' লোকের এক "অপার্থিব" আনন্দের স্বাদ পাওয়ার জন্য একটি "বিশেষ" activity - এটা আর থাকছেনা। যে গন্তব্যের দিকে যাত্রাটা দেখা যাচ্ছে তা হলো "এ এক সব মানুষের ব্যাপার" এবং অবশ্যই "একটা স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে"। যে অতিকায় ক্রিয়াপদটি রাজনীতির সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ফেলেছে, ঠিক সেই শব্দটিই কবিতার ওপর নেমে আসছে ধীরে ধীরে। সেই সহজ সরল শব্দটি হলো "ব্যাবহার"। এবং আমি কখনোই ভাবিনা যে এটা কোন খারাপ বা the end বাঃ ধ্বংস। এটা একটা সম্পূর্ন অন্য দুনিয়ার, এক অন্য দর্শন বা এক অন্য মানসিকতার সূচনা, যেটা হলো এই "কবিতার ব্যবহার"। এবং এই নতুন মানুষটির চরিত্র বা প্রকৃতি কেমন হবে সেটা বলবে সময় আর মানুষের বিবর্তন। সে কি বড় হয়ে রাজনীতির মতো লুচ্চা, লফঙ্গা, bad boy হয়ে যাবে? না কটি good boy হয়ে থাকবে? নাকি কোন তৃতীয় category, একটি অন্যরকম special student হয়ে থাকবে?


উপসংহার।



একটি পরিচয়, ২০১২। "এই যে সত্য রায়, যতই পার্টি করুক মানুষ হিসেবে কিন্তু খুব ভালো। অসৎ নয়। একদম ডেডিকেটেড, আর ভাবে, সত্যিই চেষ্টা করে কিছু করার।"



একটি পরিচয়, ২০৩০।


"এই যে রঞ্জন বলে ছেলেটা, অনেকদিন থেকেই কবিতা লেখে, রেগুলার, মানে ভালোভাবেই attached। কিন্তু ওই অফিসে বস-কে নিয়ে স্পেশাল মোমেন্টস, ঠিক increment এর আগে আগে বা যখন একটু গার্লফ্রেন্ডকে ম্যানেজ করতে হবে, মানে ও যে জব-হোম, জব-হোম ক্যাটেগরির নয় বোঝাতে হবে বা PR এর জন্য... এইসব ফায়দাবাজি, বা প্রফেশনাল রাইটার কে দিয়ে লিখিয়ে দেওয়া... এগুলো করেনা... ও হচ্ছে খুব simple… সত্যিই ডেডিকেটেডলি লেখা করে... অত প্রোপোজিশান, ইমেজ, সার্কুলেশান, পোয়েম-শো এ্যাটেন্ড করা ভাবেনা...সিম্পলি নিজের গ্রুপের মধ্যে লেখে আর মনের আনন্দে লেখে"


অনুবাদ – অত্রি ভট্টাচার্য

অনুবাদ – অত্রি ভট্টাচার্য


"To write a republic" - "প্রজাতন্ত্র লিখতে গিয়ে "
আমেরিকার রাজনৈতিক কবিতাঃ হুইটম্যান থেকে ৯/১১
                                                     - টমি কোতোনেন

[“সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব” বিষয় হিসেবে খুব গণ্ডগোলের লেগেছে আমার ! সাহিত্য রাজনীতিকে প্রভাবিত ক’রে - আমার মতে এই কথাটার মধ্যে কিছু গলদ আছে। প্রথমতঃ, সাহিত্য সমাজের ও সময়ের দর্পণ – এই বিষয়ে বোধ হয় বামপন্থী বা ডানপন্থী কোন রাজনীতিতেই দ্বিমত নেই। আর রাজনীতি আমার মতে, একটি সংগঠিত সমাজের অনেকগুলি ধারকের বা স্তম্ভের মধ্যে একটি। সুতরাং সময়ের কথা যেখানে লেখা হয়, সেখানে আসলে রাজনীতির কথাই লেখা হয়। তাই, প্রথমেই এই সম্ভাবনা বাতিল হয়ে গেল যে, সাহিত্যে রাজনীতি “প্রভাব” ফ্যালে। না, বরং বিষয়টি হতে পারত “সাহিত্যের রাজনৈতীক সংগঠন” বা “সাহিত্যের রাজনীতিগত অংশগুলি”। আমি এক বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেম। “রাজনীতিতে সাহিত্যের প্রভাব”। কিন্তু কেউ উৎসাহ দেখাল না। এই সুতোটি তাই ভবিষ্যতের কোন সাহিত্য-গবেষকের উদ্দেশ্যে ঘুড়িতে লাগিয়ে দিলেম, যদি এখনোও লেখা না হয়ে থাকে এ বিষয়ে। আপাততঃ ফাঁকীবাজী করেই মৌলিক কিছুর বদলে হাফ-মৌলিক-এ চলে গেলেম, অর্থাৎ অনুবাদে। প্রসঙ্গতঃ, কবিতার উদ্ধৃতিগুলি অনুবাদের দুঃসাহস বা অভদ্রতা দেখাইনি। - অত্রি ভট্টাচার্য ]

Tommi Kotonen-এর “To Write a Republic – American Political Poetry from Whitman to 9/11”-এর দ্বিতীয় অধ্যায় “আমেরিকান রাজনৈতীক কবিতাঃ ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও তত্ত্ব” থেকে অংশবিশেষ।



১) রাজনৈতিক কবিতার রণনীতি অথবা কবিতার রাজনৈতীক পাঠ


“in truth / We have no gift to set a statesman right” – Yeats


ইতিপূর্বে আমরা কবিতার রাজনৈতীক দিকগুলি ব্যাখা করবার একাধিক প্রচেষ্টা দেখেছি। সাধারনতঃ লোকের মনে কবিতা এবং রাজনীতি বা “রাজনৈতীক” সম্পর্কে মোটামুটি সংহত কিছু ধারণা থাকে। কিন্তু এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটলে তা বোঝার পক্ষে অনেক বেশী কঠিন হয়ে পড়ে। কবিতা এবং রাজনীতিকে সম্পূর্ন পৃথক বৃত্তের দু’টি কার্য্যক্রম হিসেবে দেখা হয়।

রাজনীতি এবং কবিতার সম্পর্ক এক আধুনিক প্রশ্ন। ডেনিস লেভেরতভ, যিনি কবিও ছিলেন, এই বিষয়ে বলেছেন যে, এই প্রশ্নটি রোম্যান্টিক যুগের আগে তেমন সমস্যার ছিল না এবং কবিতার পৃথগীভূত লিরিক আঙ্গিককে এখনও প্রায়ই যাবতীয় কবিতার সমার্থক হিসেবে ধরা হয়। পুরাতনী আঙ্গিক, যেমন মহাকাব্য বা ব্যালাড ছিল স্পষ্টতঃ গোষ্ঠীগত, কিন্তু বিশিষ্ট নয় এবং এদের উপজীব্য বিষয়গুলিও বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও সুবিধাজনকভাবে উপস্থাপিত হত।
রাজনৈতীক কবিতাকে দেখা হয়েছে নীচু নজরে, যেভাবে কবিতা ও রাজনীতি – উভয়কেই দেখা হয়ে থাকে। রাজনৈতীক কবিতা বললেই অনেকের মনে হবে সেইসব কবিদের কথা যারা রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ এবং বিখ্যাত রাজনীতিবিদদের স্তুতিমূলক কবিতা লিখে থাকেন। এইভাবে দেখলে, রাজনৈতীক কবিকে হয় সুযোগসন্ধানী অথবা স্রেফ বোকাসোকা মানুষ হিসেবেই বোধ হয়। কিন্তু এইভাবে ভাবা ঠিক নয়। বহু বিখ্যাত কবি রাজনৈতীক বিষয়বস্তু নিয়ে লিখেছেন এবং সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত-ও হয়েছেন। পাবলো নেরুদা, ওসিপ ম্যাণ্ডেলস্ট্যাম, ডব্লিউ এইচ অডেন – প্রমুখ অনেকের নামই এক্ষেত্রে মাথায় আসে এবং তারা যে কবি হিসেবে নিম্নমানের – তাও নয়; যদি তা হন-ও, কারণগুলি সেক্ষেত্রে কবিতার থেকে বেশী রাজনৈতীক। তাদেরকেও দুঃসহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিল, যেমন নেরুদা (১৯৫০) যখন লিখছেন – “Molotov and Voroshilov are there / I see them with the others, the high generals / the indomitable ones” । কিন্তু কবিদের বারবার দেখা গিয়েছে রাজনীতির শিকার হতে, যেমন ম্যাণ্ডেলস্ট্যাম স্তালিনের হাতে হয়েছিলেন।

২) কবিতা কোনকিছু ঘটায় না


এই দু-নৌকায় পা রেখে চলা অনেক কবির মধ্যে একজনের নাম ডব্লিউ এইচ অডেন। তিনি আইরিশ বংশোদ্ভূত ছিলেন কিন্তু পরে আমেরিকায় চলে আসেন এবং সেখান থেকে পরে দক্ষিণ ইউরোপে গিয়ে স্থিত হন। সমাজে কবির ভূমিকা বিষয়ে অডেনের সেরা উক্তি বোধ ক’রি ইয়েটসের উদ্দেশ্যে লেখা তার এলিজিখানি, “In Memory of W.B.Yeats”. এই কবিতার দ্বিতীয় এবং সবথেকে বেশী উদ্ধৃত অংশটি হ’ল -
You were silly like us; your gift survived it all:
The parish of rich women, physical decay,
yourself. Mad Ireland hurt you into poetry.
Now Ireland has her madness and her weather still,
For poetry makes nothing happen: it survives
In the valley of its making where executives
Would never want to tamper, flows on south
From ranches of isolation and the busy griefs,
Raw towns that we believe and die in; it survives,
A way of happening, a mouth. (১৯৯১)

পাতি বিশ্লেষকেরা এই কবিতা থেকে সাধারনতঃ যে সারমর্ম উদ্ধার ক’রে থাকেন তা হ’ল – “কবিতা কিছু ঘটাতে পারে না” এবং এই তত্ত্বের আলোকে কবিতাকে ব্যাখা করেন রোজকার জীবন এবং রাজনীতির সম্পূর্ন বিসদৃশ এক উদযাপন হিসেবে। কিন্তু এই বক্তব্যটি পরে কবিতার মধ্যেই বর্জিত হয় এবং এই পাঠের পুরোপুরি বিপরীত এক বক্তব্য উঠে আসে। কবিতা সত্যিই কিছুমিছু ঘটিয়ে থাকে, কিন্তু তা প্রত্যক্ষভাবে নয় –


Follow, poet, follow right

To the bottom of the night,
With your unconstraining voice
Still persuade us to rejoice.

With the farming of a verse

Make a vineyard of the curse,
Sing of human unsuccess
In a rapture of distress.

In the deserts of the heart

Let the healing fountains start,
In the prison of his days
Teach the free man how to praise.

কবিতা ঘটমানতাকে তরান্বিত ক’রে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, অথবা নিত্যদিনের দৃষ্টিকোণের বদল ঘটিয়ে; যে কবি স্বাভাবিকতার স্তরগুলিকে অতিক্রম করেন তিনি পরিবর্তনের সূচনা করেন। এখানে, অডেন অনুসরন করেন শেলীকে, যিনি কবিকে দেখেছিলেন “বিধানদাতা” (Legislator) হিসেবে। এই কবিতায় একই সময়ের দুই ভিন্ন রাজনৈতীক ধারাও অনুভূত হয়। প্রথম ধারণায়, কবি কেবল তার শ্বাশ্বত শব্দগুচ্ছের মধ্যেই বেঁচে থাকেন; কবি যা অর্জন করেন তা শুধু তার মুষ্টিমেয় অনুসারীই স্মরণে রাখেন। কিন্তু দ্বিতীয় ধারণাটি কিঞ্চিৎ ভিন্ন রকমের। ১৯৩৯ সালে রচিত তার ভলতেয়ার-সংক্রান্ত প্রবন্ধে অডেন গণতন্ত্র সম্পর্কে তার ধারণাটিও ব্যাক্ত করছেন এইভাবেঃ- "For democracy is not a political system or party but an attitude of mind" । এই আলোচ্য কবিতাটি সম্ভবতঃ প্রথম অথবা প্রথম কবিতাগুলির মধ্যে একটি, যা অডেন আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন। নিউইয়র্ক আসবার তিনদিনের মাথায় অডেন ইয়েটসের মৃত্যুসংবাদ পান। অডেন আমেরিকা গিয়েছিলেন “উন্মাদ আয়ার্ল্যাণ্ড” আর তার উন্মাদ রাজনীতির আবর্ত থেকে মুক্তি খুঁজতে। তিরিশের দশকে অডেন কবির কর্তব্যের সঙ্গে মার্কসীয় রাজনীতির সমন্বয়ের চেষ্টা করেন, যদিও সাম্যবাদ হাতেকলমের থেকে আদর্শ হিসেবেই তার কাছে অধিকতর গ্রহনযোগ্য ছিল এবং স্বীয় কমরেডদের প্রতি তার মনোভাব তারাও খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে রিপাবলিকানদের ধ্বজাধারী হিসেবে অডেনের অভিজ্ঞতা তাকে রাজনীতির প্রতিই বীতশ্রদ্ধ ক’রে তোলে এবং সিনো-জাপানী যুদ্ধের রিপোর্টাজ লেখবার শেষে তিনি তার রাজনীতির পথ বদলান, তার কবিতায় রাজনীতির অতীত বা উর্দ্ধের পথকে বেছে ন্যান।
অডেন, অনেকের ধারণায়, কবিতার সঙ্গে রাজনীতির অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত থাকবার কথা বলেছিলেন, যেহেতু উভয়-ই ভাষাভিত্তিক চর্চা । যদিচ, তিনি কবিতায় ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা সঞ্চারের উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন। অডেনের মতে, সনাতন মূল্যবোধ এবং কার্য্যক্রমের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকবে, পাশাপাশি, অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য ভাষার কাঠামোগত উপাদানগুলির সঙ্গে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ । এই দ্বন্দ্বটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের কবিতায় এবং কবিতার বিশ্লেষণে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

৩) কোনকিছুই তর্কাতীতভাবে গ্রহণ করা নয়

রাজনৈতীক কবিতার ক্ষেত্রে, সুস্পষ্ট কোন ইঙ্গিত-ও তর্কাতীতভাবে গ্রহন ক’রা উচিত নয়। কবিতাকে এক প্রত্যক্ষ অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার ক’রা সম্ভব, যা রাজনীতির মত ধারাবাহিক ও মসৃণ নয়, কিন্তু তারই একাংশ। কবিতাকে সরাসরি রাজনীতির বার্তাবহ বয়ান হিসেবে গড়ে তোলা যায়ঃ সেক্ষেত্রে তা স্রেফ রাজনৈতীক ভাষ্য হয়ে দাঁড়াবে। সাধারনতঃ এইধরনের কবিতাকে বলা হয় agit-prop (agitation-prpaganda). কিন্তু এই তীক্ষ্ণ অ্যাজিটপ্রপের বাইরেও কবিতায় রাজনীতি থাকা সম্ভব। সাবেকী থেকে শুরু ক’রে ননসেন্স কবিতা, যার মধ্যে কোন নির্দিষ্ট অর্থ বা পরিচিত শব্দ না-ও থাকতে পারে, সঠিকভাবে পাঠ করলে তাদের শরীরেও রাজনৈতীক চিহ্নাবলী আবিষ্কার ক’রা যায়। বলা হয় যে, প্রতিটি কাব্যকলাই রাজনৈতীক শক্তিকে বহন ক’রে। উদাহরনস্বরূপ, ব্রুস এণ্ড্রুজ-এর “Give Em Enough Rope” কাব্যগ্রন্থ থেকে “Sound Machines” কবিতাটি নেওয়া যাকঃ-

Equation Sphinxlike Pmphlet
Misinform Sweet Business Miss Dot Your Eye Favorably
Impressive Rough Interest
Sensational Base Natural Problematize Hey Look
Dominate Ruler Passion
Added Passing Sharp Policy Moving Loco Fancy Line Vibration
Talking Cognitive I'm When Touched
Detention (বানানপ্রমাদগুলি কবিকৃত)
সমস্যা হচ্ছে, এর রাজনৈতীক ব্যাখার সূচনা কোথা থেকে হবে, বা এর ভিত্তিই বা কি? ধরুন দেরিদা যেমন বলেন, যে বয়ানের বাইরে কিছুই নেই, সাথে সাথে এটাও সত্যি, যে বয়ানের মধ্যেও কিছু থাকে না। বাস্তবে শব্দ একটি ধ্বনীমাত্র, যা থেকে কিছুই বোঝায় না। একে প্রসঙ্গে আনতে হয়, অন্যান্য ধ্বনীর সঙ্গে, অন্যান্য অর্থপদ্ধতির সঙ্গে সাযুজ্যে আনতে হয়, বিন্যস্ত করতে হয়। এখানেই আমরা রাজনৈতীকে প্রবেশ ক’রি, আর এখান থেকেই সমস্যার শুরু হচ্ছে।
এণ্ড্রুজ, যিনি যুগপৎ কবি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন, তার রচিত উল্লিখিত অংশটি ননসেন্স বলেই বোধ হয়। আমরা ধরে নিতে পারি এ স্রেফ তার প্রলাপ নয়, বরং তিনি আমাদের, অথবা কাউকে কিছু বলতে চাইছেন। কিন্তু তিনি কি সিরিয়াস? একটি মুদ্রিত গ্রন্থ কি ঠাট্টা হতে পারে? এবং যেহেতু কবিতা হিসেবে ছাপা হয়েছে, সুতরাং এটা কবিতাই। অতএব আমরা মেনে নিচ্ছি যে এটি কবিতা আর এর কোন অর্থ-ও রয়েছে। কিন্তু আমরা কি নিছক ওই কয়টি উদ্ধৃত পংক্তি থেকেই এর অর্থসুত্রটি উদ্ধার করতে সক্ষম? যে শিল্পটি আমাদের চিন্তা করানোর উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত – তাকে কি আমরা দূর থেকে দেখেই কাজ সারব? আসলে “কবিতা”-কে দেখেই মনে হয় হাতেগরম, স্রেফ শব্দ তুলে তুলে জুড়ে জুড়ে একসাথে সেঁটে দেওয়া।
কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি মনগড়া নয়। এখানে এক আবছা খসড়া নকশা, শব্দেরা পংক্তির মধ্যে ব্যকরণ-বহির্ভূতভাবে সাজানো এবং কান পাতলে হয়তো অন্ত্যমিলের অস্পষ্ট প্রতিধ্বনীও মিলবে। শব্দেরা যেন দমন ও স্বাধীনতার মধ্যে দোদুল্যমান এক ধারণাকে বহন করছে।
কবিতার ক্ষেত্রে যা প্রয়োজনীয় তা হ’ল, একে এক স্পেস বা ক্ষেত্র হিসেবে দেখা। এণ্ড্রুজ তার “কবিতা”য় সৃষ্টি করেছেন স্পেসকে ভাষা দিয়ে ভরিয়ে তোলার উপায়, যার সঙ্গে জড়িত এর যাবতীয় অপবিত্রতা, বাস্তবিকতা এবং অবশ্যই – রাজনীতি ! এ হচ্ছে এক ব্যাপক বিশৃঙ্খলার পর্যবেক্ষণ যার নাম জীবন, তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচা যে জীবন ! একে পংক্তিবদ্ধ করতে, এর বিশৃঙ্খল অস্তিত্বকে প্রকাশ করবার জন্য একে পাঠকের কাছে টাটকা ও সদ্যজাত হিসেবে তুলে ধরতে হয় ! পাঠক এই আপাত-অসমাপ্ত বয়ানকে অর্থবহ ক’রে সাজিয়ে নেয়, এবং এই অমসৃণ পাঠ্যবস্তু, পংক্তি ও কাঠামোয় পাওয়া ইঙ্গিতময়তা পাঠকের কাজকে আরো বিশদে নিয়ে যায়। কবিতা তার স্বকীয় ভঙ্গিমায় আমাদের সামনে আনে, খড় ও মাটি থেকে গোটা ভাষাটি গড়ে তোলার পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা । পাঠপদ্ধতির রাজনীতি ও রাজনৈতীক অর্থাবলী এর অবিভাজ্য অঙ্গ।
তাই কবিতা সংক্রান্ত প্রশ্নটি একই সাথে এর রাজনৈতীক কাঠামোর প্রতিও নির্দেশ ক’রে থাকেঃ কার কাছে বয়ানের সঠিক অর্থ থাকে, এবং কার পাঠ বেশী গুরুত্ব পাবে – পাঠকের নাকি কবির নিজের? যে কোন ভাষান্তর-ই এক দুরূহ ক্রিয়া, তা সে কবির দ্বারাই হোক বা অন্য কারো দ্বারা।
উপন্যাস এবং প্রাক্‌-আধুনিক যুগের কবিতা স্বতন্ত্র এবং নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অংশবিশেষ কাল্পনিক হ’লেও, কবিতা হচ্ছে বাস্তব জীবনের এক খণ্ডাংশের উপস্থাপনা এবং কবিতারা এখানে আলোচনামাত্র; ভাষা বাস্তবের যে মৌলিক উপাদানগুলিকে একই সঙ্গে সৃষ্টি ও অবিশ্বাস ক’রে থাকে – তাদের নিয়ে আলোচনা।
এই আলোচনায় আলোচক স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একইসঙ্গে দুইপ্রকার কবিতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন – ভাষাপ্রধান ও বক্তব্যপ্রধান কবিতা। শুরু থেকেই তার উদ্দেশ্য এইসব কাজগুলির রাজনৈতীক উপবয়ানগুলিকে উন্মোচিত ক’রা। যদিও, এর সীমানাগুলি যতটা স্পষ্ট মনে হয়, আসলে ততটা নয়। মনে রাখা উচিত, কবি রন সিলিম্যান কিভাবে রবার্ট গ্রেনিয়ারের বক্তব্য-বিরোধীতার সংশোধন করেছিলেনঃ- “আমি বক্তব্যকে ঘৃণা ক’রি, কিন্তু কথাকে ভালোবাসি”। ভাষাকবিরা যদিও ভাষাচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, তবু তারা কথোপকথনের ভঙ্গীতে অগ্রসর হওয়ার উপরেও প্রাধান্য দিতেন। তর্ক উঠতে পারে, যে “সংলাপধর্মীতা” দীর্ঘকাল ধরেই আমেরিকান কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, একইভাবে জাতীয় স্ব-প্রতিফলনের প্রতি এর প্রবণতাও । কিভাবে আমেরিকার কথা বলা যায় এবং একে বিষয় ক’রে তোলা যায় – এসব-ই হুইটম্যানের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছিল এবং পরবর্তীকালে আরো অনেকানেক সাহিত্যিককে উৎসাহিত করেছে। ভাষাকে স্বয়ং মাধ্যমে পরিণত ক’রে এগনোর মধ্যে দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যায়।
রাজনীতির প্রত্যক্ষ যন্ত্র হিসেবে কবিতাকে ব্যবহার ক’রা যায় আলংকারিকভাবে, রাজনৈতীক উদ্দেশ্যাবলীর কথা আরোও তীক্ষ্মভাবে ব্যাক্ত ক’রার জন্য, অথবা উল্টোটা, অন্যান্য সাহিত্যধারায় যেসব মত মোটামুটি স্পষ্ট, তাদেরকে ধোঁয়াটে ক’রে তোলবার উদ্দেশ্যে। ভাষা-দর্শনের প্রতিনিধিদের কাছে কবিতা চিরকালই ভাষার এক বিশিষ্ট ধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। কারণ কবিতাতেই ভাষাকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, ভাষার এমন এক আঙ্গিক যা তার সাংগঠনিক প্রকৃতির সঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে ওতপ্রোত। ভাষার সর্বশেষ স্তর, সবচেয়ে সচেতনভাবে উপস্থাপনার দশা। কবিতায় সবই “সন্দেহজনক”, কোনকিছুই স্থায়ী নয়, শব্দেরও কোন স্থায়ী অর্থ নাই, এবং বিষয় আর আঙ্গিকের পারস্পরিক সম্পর্কটিকে এমন জটিল ক’রে তোলা হয় যে, কোনটি প্রাথমিক তা সন্ধান ক’রা সঙ্গিন হয়ে ওঠে। রাজনৈতীক ধারণা ও ডিসকোর্সের এই পুনঃক্রিয়া আলংকারিক পুনর্বয়ন হিসেবে, অথবা, এণ্ড্রুজের কবিতার মত রাজনৈতীক কর্মকাণ্ডগুলিকে প্রতিটি ভাষাবৃত্তে উন্মোচনের দায়িত্ব পালন ক’রে থাকে।
আদ্যন্ত রাজনৈতীক বিষয়গুলিও এই আঙ্গিকের অংশ হয়ে ওঠে, যখন তথাকথিত “কাব্যিক পরিভাষা” নামক তন্ত্রকে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে রাজনৈতীক সুরকে ব্যবহার ক’রা হয়। উদাহরনস্বরূপ, চার্লস ওলসেন-এর কবিতার কথা বলা যায়। দৈনন্দিন জীবন, রাজনীতি, বাণিজ্য, আমোদপ্রমোদ মিলেমিশে গিয়ে সাধারণ-রহিত চিন্তার উদ্‌যাপন ক’রে এবং প্রতিটি ভাষা ও কাব্যতত্ত্বের নশ্বর স্বরূপকে পরাকাব্যিক (meta-poetical) বক্তব্য হিসেবে রূপদান ক’রে। এটি অগ্রসর হবার একটি জঙ্গম মাধ্যম, শুন্যে বিন্যস্ত এবং রাজনীতিকে অবশ্যই তার অংশ হতে হবে। রাজনৈতীক উপাদান তার কাব্যতত্ত্বে আবশ্যিক, একই সাথে এটি ভাষায় আমাদের অস্তিত্বের-ও অঙ্গ।
সর্বোপরী, কবিতা আমাদের সমাজে ইন্দ্রিয়নির্ভর ধারণাগুলিকে বিকশিত করতে সাহায্য করে, নতুন অর্থ এবং নতুনভাবে দেখতে ও অনুভব করতে শেখায়। সুতরাং কবিতা এই নতুন চেতনায় গতি আনার ফলে এর থেকে নতুন রাজনীতি জন্ম নিতে পারে, যেন এক “অস্বীকৃত বিধানদাতা” (unacknowledged legislator), শেলীর মতে, অথবা “অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে রাজনীতির স্থান ও ভূমিকা স্থির করে”, (“the place and stakes of politics as form of experience”), রাজনৈতীক পরিমণ্ডলে শিল্পের ভূমিকা বিষয়ে Ranciere যা উদ্ধৃত করেছিলেন।
এই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের রাজনৈতীক কবিতাকে অনুভূমিক বিন্যাসের বদলে এক বা একাধিক স্তরের সমষ্টি রূপেও দেখা যেতে পারে। আলংকারিক স্তরে ভাষা হচ্ছে অতিভাষামূলক চর্চার মাধ্যম । ভাষাকে এখনও প্রশ্নের মুখে ফেলে, সম্ভাবনার বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে চিরে দেখা হয়নি, বরং একে রাজনীতির জন্য ব্যবহৃত হাতবাক্সের মধ্যে রাখা একটি ছেনি বা হাতুড়ির মত ব্যবহার ক’রা হয়েছে। পরবর্তী স্তরে, কবিতা বিকশিত হয় যখন প্রশ্নপদ্ধতি রাজনীতির বৃত্তের অন্তর্গত হতে শুরু ক’রে। ভাষাকে ব্যবহার ক’রে রাজনৈতীক প্রশ্নাবলী ও সীমাবদ্ধতা, ভাষা ও রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এবং তাদের পরীক্ষা ক’রা ও খুলে দেখা এবং সব শেষে ভাষা রাজনৈতীক হয়ে ওঠে। সর্বশেষ স্তরে ভাষা এবং রাজনীতি – উভয়কেই আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি হিসেবে গ্রহন ক’রা হয়। এই স্তরে, রাজনীতির বাইরে এসে রাজনীতির অস্তিত্ব-ই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, রাজনীতি ও ভাষা দুই-ই একটু একটু ক’রে বদলাতে আরম্ভ করে। এই স্তরটি একটি অনুভূতি প্রাগ্‌রাজনৈতীক, (sense protopolitical) বা Philippe Lacoue-Labarthe-এর দেওয়া পরিভাষা অনুযায়ী, “arche-political”। এভাবেই আমরা রাজনীতির ব্যবহারিক দশা থেকে জ্ঞানদর্শনচর্চাগত হয়ে তত্ত্ববিদ্যার দশায় এসে পৌঁছেছি। চার্লস বার্নস্টাইনের সিদ্ধান্ত, “কবিতা রাজনীতির সূচনা”-তেই বেশীরভাগ কবি এসে উপনীত হন, যখন তারা রাজনৈতীক কবিতার সীমার মধ্যেই এর অতুল সম্ভাবনা আবিষ্কার করেন, তাদের নিজ-নিজ কাব্যিক পূর্বশর্ত নির্বিশেষে।
আলোচক দেখিয়েছেন, এই আপাত-অদৃশ্য স্তরগুলি একে অপরকে ধারণ ক’রে রাখে। কোন স্তর কতটুকু গুরুত্ব পাবে তা লেখকের লক্ষ্য ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর ক’রে। কিন্তু এ কথা নিশ্চিত ক’রেই বলা যায় যে, আলোচিত স্তরগুলির প্রায় প্রত্যেকটিকেই যে কোন রাজনৈতীক কবিতায়, এমনকি তথাকথিত agit-prop কবিতাতেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব - সুজন ভট্টাচার্য

সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব
সুজন ভট্টাচার্য


এত দ্রুততার সাথে এই লেখা জমা দেবার হুকুম এল যে এমন একটা গুরুগম্ভীর বিষয়কে কিভাবে সাজিয়েগুছিয়ে পাঠকের দরবারে পেশ করব, সে ভাবনাটুকুরও সময় নেই। অগত্যা খানিক কানামাছি ভোঁভোঁ করেই দায় সামলাতে হবে। এপাশে ওপাশে খামচে খামচেই আলোচনাটা করতে হবে। তাতে যদি সূত্রভঙ্গ হয়, নাচার।


বিশ্বের রহস্যময়তার মাঝখানে প্রবহমান জীবনধারা মানুষের মনে যে হিল্লোল তোলে, মানুষ সাহিত্য বা অন্য যে-কোন নান্দনিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে তাকে পুনরাবিষ্কার করে এবং সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার নবনির্মাণ করে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে যে নতুন প্রসঙ্গটি চলে আসে তা হল সৌন্দর্যসৃষ্টি। অভিজ্ঞতার অনুভবের সৌন্দর্যায়িত বহিঃপ্রকাশ-ই হল মানুষের নান্দনিক সৃজনশীলতা। স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। এই প্রেক্ষাপটেই সাহিত্যে রাজনীতি বা অন্য যে-কোন সামাজিক প্রসঙ্গের প্রভাবকে বিচার করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের উপাদান


সাহিত্যের উপাদান জীবন এবং জীবননির্গত ভাবনাসমূহ। সাহিত্যের প্রকাশমাধ্যম বর্ণরূপ সংকেতের দ্বারা প্রকাশিত ভাষা। যেহেতু ভাষা জনজীবনের সকলেরই সাধারণ সম্পদ বা অধিকার, ফলে সাহিত্য অন্যান্য অনেক প্রকাশমাধ্যমের থেকে অনেকবেশি প্রত্যক্ষ। সাহিত্যের উপজীব্যতা এবং তার ভাববিস্তার অনেক বেশি জনবোধ্য এবং সেই কারণেই প্রাচীনকাল থেকেই তার রসমোক্ষণ অনেক ব্যাপক। সাহিত্যের এই বৈশিষ্টের জন্যই পাঠকমননে তার ক্ষরণের সম্ভাবনা যেমন অসীম, তেমনি আবার এই প্রত্যক্ষতার জন্যই সাহিত্যের চলনেরও সমস্যা অপরিসীম।

মানবসমাজে চলমান অসংখ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হল ব্যক্তিসত্তা বনাম সামাজিক সত্তা। যদিও এমন একটা মত উঠে আসতেই পারে, আদতে সেই ব্যক্তিসত্তা কি সামাজিক সত্তারই এক সংক্ষিপ্ত ও বিশিষ্ট রূপ নয়! ভাবা যাক, একটি মিছিল চলছে; আপনি-আমি সেই মিছিলে পা মিলিয়েছি। হঠাৎই আকাশের এককোণে মেঘের আস্তরণের মধ্যে এক হলুদ-গোলাপি আলোর পটি ঝিকমিক করে উঠল। আমি হয়তো তাকে একবার দেখে নিয়েই আবার সামনে এগোলাম। আর আপনি আকাশের দিকে চোখ রেখে একটুখানি পাশে সরে দাঁড়ালেন, আরেকটু ভাল করে উপভোগ করবেন বলে। এই পার্থক্য মানুষে-মানুষে থাকবেই। কেউ হালকা আলোয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুরে নিমজ্জমান থাকতে ভালবাসবেন, আর কেউ হয়তো সেই সময়েই মোড়ের মাথায় রাজা-উজির মারবেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, একজন সাহিত্যকার এই দুজনের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন তার সৃষ্টির চরিত্র বা ব্যাখ্যানবস্তু হিসাবে? আমি প্রথাগত কলাকৈবল্যবাদের কথা তুলতে চাইছি না। ভবিষ্যতের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তিনি কোন উপাদানটি বেছে নেবেন? এটাই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এবং সেই সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিমানসের প্রকাশ। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল – এমন কোন সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয় না, আর তাই যে যার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কোন একজনকে বেছে নিতেই পারেন। কিন্তু, কেউ মিছিলের একজনকে বেছে নিয়েছেন বলে রাজনীতিকরণের দ্বারা সাহিত্যকে কলুষিত করেছেন ( যে অভিযোগ বারবার বিভিন্নজনের সম্পর্কে শোনা গেছে)- এমনটা ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়। ধরুন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র কথা। তার মানবিক ও নান্দনিক অভিঘাত নিয়ে কোন বিরূপ প্রশ্ন কোথাও শোনা যায় নি। কিন্তু, এমন প্রশ্ন তো শোনাই গেছে, গোটা উপন্যাসে গ্রামীণ দারিদ্রের এক মহাকাব্যিক উপস্থাপনা সত্ত্বেও একবারও একজন মহাজন বা জোতদারের দেখা পাওয়া গেল না! তাহলে কি উপন্যাসের পটভূমিতে এমন একজনও ছিল না? সেটা কি বাস্তব! প্রশ্নটার যাথার্থ নিয়ে কোন সংশয় না থাকলেও, একইসাথে এটাও অবশ্যমান্য যে ‘পথের পাঁচালী’ এক অনন্য রচনা। আবার, মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’-র কথা ধরুন। এক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্য দিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে যেতে তিনি আবার এক সন্তানহারা মায়ের অনুভূতির পরম বিকাশ ঘটিয়ে ফেলেন। অতএব, রাজনীতি নেই বা আছে, কেবল এটা দিয়েই নান্দনিক সিদ্ধান্ত টানা যায় না।

সমাজ ও রাজনীতি


সমাজে একজন মানুষ তো আর পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবেই কোন একক ও স্বয়ং-স্বতন্ত্র সত্ত্বা নয়। কখনো সে পরিবারের সদস্য, কোথাও একটা পাড়া বা গ্রামের বাসিন্দা, কখনো গোটা দেশের নাগরিক। তার একক ব্যক্তি-জীবনের অনেকটাই সেইসব সামাজিক সত্ত্বা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মননের যে অংশে এসে সে স্বাতন্ত্র দাবি করে, সেটাও আবার বিন্দুমাত্র সামাজিক ভিত্তি ছাড়া বিকশিত হতে পারে কিনা, সে বিতর্কও অতি-অবশ্যই আছে। আপাততঃ সে প্রসঙ্গ থাক। আমরা সামাজিক মানুষকেই বিচারে আনি। সেই মানুষটাকে তার খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়, ট্রেনে-বাসে যাতায়াত করতে হয়, পাড়ায় আগুন লাগলে বা বন্যা হলে প্রাণে বাঁচতে হয়, বন্ধের দিন পথে বেরোবে কিনা ভাবতে হয়। চাইলেও তার জীবন থেকে সে রাজনীতিকে বাদ দিতে পারে না। এমন নয় যে তাঁকে সিপিএম- টিএমসির কথাই ভাবতে হবে। কিন্তু গ্যাসের দাম বেড়েছে বলে সে তার বৌকে বলছে, রান্নার বহরটা একটু কমাতে হবে, অথবা ছুটির পরে দুটো টিউশন নেবে কিনা ভাবছে। তার হাতে কোন ঝান্ডা নেই; কিন্তু বিবিধ ঝান্ডার ছায়া তাকে ঘিরে রেখেছে।

এই মানুষটার জীবনকে যদি কেউ সাহিত্যের উপজীব্য করতে চায়, তাহলে সে রাজনীতিকে এড়াবে কি করে? আর সেই কারণেই সাহিত্যে রাজনৈতিক প্রভাব, চাই বা না চাই, চলে আসতেই পারে। রাজনীতি কি শুধু রাজা বা মন্ত্রীদের শলা-পরামর্শের প্রসঙ্গ? প্রাচীন ও মধ্যযুগে অবশ্য সেটাই ছিল রেওয়াজ। আর সেই সময়ের সাহিত্য যেহেতু রাজার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব ছিল না, ফলে সেখানে এই প্রসঙ্গ আসে নি। রাজনীতিকে রাজসভার অঙ্গন ছাড়িয়ে জীবনের খোলা ময়দানে নিয়ে আসার জন্য রেনেসাঁর প্রয়োজন পড়েছিল ইউরোপে। এবং সমকালীন ইউরোপিয়ান সাহিত্যে রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা গেল। ফ্রান্সে ভিক্টর হ্যুগো-ই হোন বা ইংল্যান্ডে শেলী – রাজনীতির ভিত্তিতে সাহিত্য বা সাহিত্যে রাজনৈতিক দিকনির্দেশ একটা প্রবণতা হয়ে উঠল।
আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। কবিকঙ্কনের ফুল্লরার বারমাস্যা তো সেই এক গ্রামীণ নারীর অভাব আর হাহাকারের গাথা। মনে রাখবেন, মার্টিন লুথারের বাইবেল অনুবাদ ইউরোপে সমাজ জাগরণের পথ খুলে দিয়েছিল। আমাদের চৈতন্যদেবও জাতপাতের বিরুদ্ধে প্রায় সমকালেই প্রবল আওয়াজ তুললেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সামাজিক শক্তি তাঁকে গ্রাস করে নিল, হারিয়ে গেল তাঁর আন্দোলনের শক্তি। কিন্তু যেটুকু নাড়া পড়েছিল, তার উপর দাঁড়িয়েই চলে এল ভাঁড়ু দত্ত, তৎকালীন বাংলার রাজশক্তির লুন্ঠনের প্রতীক। এটা কি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নয়? কিংবা মৈমনসিংহ গীতিকার আখ্যানগুলো?

আসলে রাজনীতি বলতে যদি কোন বিশেষ দল বা মতাদর্শের কথা বলি, তাহলে এক কথা। কিন্তু রাজনীতির সেই সংকীর্ণ সংজ্ঞা আমাদের কোথাও পৌঁছে দেবে না। রাজনীতি হল সমাজের বুকে বিবদমান যাবতীয় শক্তির মধ্যে আপাত-ভারসাম্য বজায় রেখে কোন এক বিশেষ পক্ষের ক্ষমতা বজায় রাখার প্রকরণ। এখন সেই ক্ষমতা যদি প্রতিমুহূর্তে গায়ের জোরেই প্রমাণ করতে হয় তাহলে সমাজে এমন এক দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হবে যেখানে সমাজের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানোই মুশকিল। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রসারণের স্বার্থে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠী সমাজ-মননে এমন সব চিন্তা-প্রতীক গুঁজে দেয় যা তার ক্ষমতাকে প্রশ্নের অতীত করে তোলে। তাই কর্মফল বা জন্মান্তরবাদকে ভিত্তি করে যে সাহিত্য রচিত হবে, তাহলে তাকে কি রাজনৈতিক চিন্তাশ্র্য়ী বলা হবে? প্রশ্নটা জটিল।

সাহিত্য ও রাজনীতি


সরাসরি রাজনীতিকে উপজীব্য করে যে সাহিত্য, তাকে রাজনৈতিক সাহিত্য বলে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বিশ্বসাহিত্যে এমন অজস্র নমুনা পাওয়া যায় যা আদ্যন্ত রাজনৈতিক উপাখ্যান হয়েও নান্দনিক বিচারে অনুপম। হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘স্পার্টাকাস’, ‘ফ্রিডম রোড’, ‘লোলা গ্রেগ’, জ্যাক লন্ডনের ‘পিক স্কিল ইউ. এস. এ.’, ‘আয়রন হিল’, বরিস পাস্তারনেকের ‘ডঃ জিভাগো’, জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’, ম্যাক্সিম গর্কির ‘মাদার’, ‘লোয়ার ডেপথ’, - এমন উদাহরণ অজস্র। ফলে মূল বিষয় রাজনৈতিক হলে সার্থক সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না, এহেন অভিযোগ অর্থহীন।
আবার কোন-কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য সরাসরি না থাকলেও, সমাজদেহের জটিলতার ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে এক রাজনৈতিক বাতাবরণের স্পষ্ট আভাষ পাওয়া যায়। লিও টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’ বা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’ – এজাতীয় উদাহরণও প্রচুর। আসলে বৃহৎ ক্যানভাসে উপাখ্যান রচনা করতে গেলে যুগযন্ত্রণার যে ছবি উঠে আসবে তার রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে অবহেলা করা যাবে না। ছোটনাগপুরের জঙ্গলের জনজীবনের সঙ্গে দু-চারদিনের অভিজ্ঞতায় যদি শুধু কষ্টি পাথরের মত এক নারী শরীরের আখ্যানই উঠে আসে, অবহেলিত থাকে জঙ্গলের ঠিকাদারদের বা পাথর খাদানের বাবুদের সমাচার, তাহলে সেই উপাখ্যান যতই শিল্পমন্ডিত হোক না কেন সেটাও খন্ডিত। রাজনৈতিক সাহিত্য যদি শিল্পবোধের প্রতি অবহেলা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক উপাদানকে অস্বীকার করাও সমাজ-বাস্তবতার প্রতি অসততা।

শেষের শুরু

অতি-সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং চরম দ্রুততায় যেটুকু বলা সম্ভব হল, সেটা কখনই এক পূর্ণাঙ্গ চিন্তার প্রকাশ হয়ে উঠতে পারে না। ইলিয়াড-অডিসি বা মহাভারত কতদূর রাজনৈতিক, নাকি এক রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করে আসলে তারা শুধুই মানবিক দলিল – এ প্রশ্নেরও আলোচনা প্রয়োজন। মধ্যযুগে যে কবি লেখেন, ‘শুনো রে মানুষভাই/ সবার উপর মানুষ সত্য/ তাহার উপর নাই’, তিনি কি আদৌ কোন রাজনৈতিক ধারণাহীন শুধুই এক প্রেমপূজারী! সে বিচারও যে দরকার! ফলে এখানে শেষ নয়, বরং এক সন্ধানযাত্রার শুরু।

শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৩

সাহিত্যে পলিট্রিক্স - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য

সাহিত্যে পলিট্রিক্স
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য


ঠাকুমার ঝুলি পড়েছেন ? সেই যে রাজপুত্তুর, কোটালপুত্র আর সওদাগরপুত্র ? এই তিনটে চরিত্র নিয়ে প্রচুর গপ্পো আছে !আর আছে জঙ্গল, বৃষ্টি, রাজকুমারী, ব্যঙ্গমা- বেঙ্গমী, রাক্ষস- খোক্কস, সব মিলিয়ে জমজমাট, মারকাটারি ব্যাপার ।


পরে, আমার এক সবজান্তা- হরফন মৌলা বন্ধু বুঝিয়েছিল, এই রাজপুত্র হচ্ছে প্রশাসক । সওদাগরপুত্র হচ্ছে শিল্প আর ব্যবসার প্রতীক আর কোটালপুত্র হচ্ছে প্রশাসন । রাক্ষস- খোক্কস হচ্ছে বদ লোকজন ।


তাহলে কি দাঁড়াল ? বাচ্চাদের গল্পেও রাজনীতির প্রথম পাঠ । এটা পলিটিকস থুড়ি পলিট্রিক্স কিনা বলুন তো ! আমি ও সব বুঝি না বাপু !


চাঁদ সওদাগরের গল্পে আসি ! প্রশাসকের মনোরঞ্জন না করতে পারলে তোমার সাড়ে সর্বনাশ । মূল ব্যাপারটা তাই ! ঠিক কিনা ? ধম্মোও হল , আর বুঝিয়ে দেওয়া হলো- ক্ষমতায় যে থাকবে, তাকে তুষ্ট করতেই হবে ! মানে, ফাঁকতালে এই সব বক্তব্য তুলে ধরা ! ভাগ্গিস তখন নেট ছিল না ! থাকলে চাঁদু বাবু কার্টুন আঁকতো আর সাপেরা এসে ছোবল দিত ।


বলছি কি, এটাও তো রাজনীতি ! আর মনসামঙ্গল সাহিত্য । দুয়ে, দুয়ে দুধ বা চার না হয়ে হয়ে গেল, পলিট্রিক্স !


তারপরে, ধরুন গিয়ে মহাভারত বা রামায়ণ ! যে বিরুদ্ধে যাবে, তাকে খুন করে প্রতিবাদ যে করা যাবে না, সেটার যথার্থতা প্রমাণ করে দিল সবাই ! খুন, হয়ে দাঁড়াল রাষ্ট্রর ইনসিগনিয়া। মহাভারত আর রামায়ণ আবার মহাকাব্যও বটে ! সাহিত্যের চরম মাপকাঠি ।


তা বাপু, এই সব ব্যাপার আমাদের বর্তমান সাহিত্যে আসবে না, তো আসবে কোথায় ?


এসব দেখে শুনেই তো ওয়াজেদ আলি সাহেব বলেছিলেন- সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলিতেছে।

প্রথমেই বঙ্কিম চন্দ্রে যাই !

“১১৭৪ সালে ফসল ভাল হয় নাই, সুতরাং ১১৭৫ সালে চাল কিছু মহার্ঘ হইল-- লোকের ক্লেশ হইল, কিন্তু রাজা রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝিয়া লইল। রাজস্ব কড়ায় গণ্ডায় বুঝাইয়া দিয়া দরিদ্রেরা এক সন্ধ্যা আহার করিল। ১১৭৫ সালে বর্ষাকালে বেশ বৃষ্টি হইল। লোকে ভাবিল, দেবতা বুঝি কৃপা করিলেন। আনন্দে আবার রাখাল মাঠে গান গায়িল, কৃষকপত্নী আবার রূপার পৈচাঁর জন্য স্বামীর কাছে দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিল। অকস্মাৎ আশ্বিন মাসে দেবতা বিমুখ হইলেন। আশ্বিনে কার্তিকে বিন্দুমাত্র বৃষ্টি পড়িল না, মাঠে ধান্যসকল শুকাইয়া একেবারে খড় হইয়া গেল, যাহার দুই এক কাহন ফলিয়াছিল, রাজপুরুষেরা তাহা সিপাহীর জন্য কিনিয়া রাখিলেন। লোকে আর খাইতে পাইল না। প্রথমে এক সন্ধ্যা উপবাস করিল, তার পর এক সন্ধ্যা আধপেটা করিয়া খাইতে লাগিল, তার পর দুই সন্ধ্যা উপবাস আরম্ভ করিল। যে কিছু চৈত্র ফসল হইল, কাহারও মুখে তাহা কুলাইল না। কিন্তু মহম্মদ রেজা খাঁ রাজস্ব আদায়ের কর্তা, মনে করিল, আমি এই সময়ে সরফরাজ হইব। একেবারে শতকরা দশ টাকা রাজস্ব বাড়াইয়া দিল। বাঙ্গালায় বড় কান্নার কোলাহল পড়িয়া গেল।”


আনন্দমঠ উপন্যাসে, এই ভাবেই শুরু হয় অত্যাচারীদের বর্ণণা । পুরো উপন্যাসেই পাই সেই সময়ের এক নিঁখুত ছবি । সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে ইংরেজ রাজপুরুষদের কদর্য্য রাজনীতির নিপুণ প্রতিফলন ।


শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে রবি দাদুর সেই বিখ্যাত সাহিত্য- তোতা কাহিনী । আরম্ভ কি ভাবে হচ্ছে দেখা যাক !


“পাখিটা মরিল। কোন্‌কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে।'



ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।'


ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।'

রাজা শুধাইলেন, 'ও কি আর লাফায়।'


ভাগিনা বলিল, 'আরে রাম!'



'আর কি ওড়ে।'



'না।'



'আর কি গান গায়।'



'না।'


'দানা না পাইলে আর কি চেঁচায়।'


'না।'


রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।'

পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্‌খস্‌ গজ্‌গজ্‌ করিতে লাগিল।

বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।”

শিক্ষাব্যবস্থার ওপর রাজনীতির কটাক্ষ এই সাহিত্যের উপজীব্য ।

এবারে আসা যাক, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলীর প্রারম্ভিক সূচনায় :-


“শরৎচন্দ্রের সমস্ত উপন্যাস ও ছোট গল্পগুলিকে প্রধানত পারিবারিক, সামাজিক ও মনস্তত্ত্বমূলক – এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করলেও তাঁর অধিকাংশ উপন্যাসের কেন্দ্রভূমিতে বিরাজমান রয়েছে বাঙালীর সমাজ সম্পর্কে এক বিরাট জিজ্ঞাসা এবং বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ জীবনের রূপায়ণ। সমাজের বাস্তব অবস্থা নরনারীর জীবনভঙ্গিমা ও জীবনবোধকে নিয়ন্ত্রিত করে তাদের মানসলোকে যে সূক্ষ্ম জটিল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, শরৎসাহিত্যে আমরা পাই তারই সার্থক রূপায়ণ। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনার এতবড় কাব্যকার ইতিপূর্বে দেখিনি আমারা। মূঢ়তায় আচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুর শাসনে লাঞ্ছিত নরনারীর অশ্রুসিক্ত জীবনকথা অবলম্বন করে মানবদরদী শরৎচন্দ্র গদ্যবাহিত যে কতকগুলি উৎকৃষ্ট ট্রাজেডি রচনা করেছেন তাতে বাঙলা সমাজের অতিবিশ্বস্ত ও বহুচিত্রিত এক আলেখ্য উন্মোচিত হয়েছে আমাদের সামনে।”


বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের দুঃখবেদনাকে উপজীব্য করেই তো রাজনীতির সূত্রপাত । এখানে, রাজনীতিকে উপেক্ষা করি কি করে ?


পথের দাবী উপন্যাসে, সেকালের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা সেই রাজনীতিরই প্রতিফলন ।


চলে আসি, সৈয়দ মুজতবা আলিতে । কাবুল থেকে আরম্ভ করে হিটলারি জমানার জার্মানীর রাজনীতি নিয়ে সে সরস বর্ণণা তিনি দিয়েছেন, তাতে সমকালীন রাজনীতির স্বচ্ছ ধারণা পাঠকের হতে বাধ্য ।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন পূর্ব পশ্চিম । বাংলা ভাগের ফলে যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল জনগণের, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণণা প্রতি ছত্র । রাজনীতি আমরা সেখানে বুঝতেই পারি ।


সত্তোর একাত্তরের উত্তাল রাজনীতি নিয়ে লেখা হয়েছে, প্রচুর গল্প – উপন্যাস । এই প্রজন্ম বুঝতে পারবে, তখন কি রকমের রাজনীতি বজায় ছিল । কত আত্মত্যাগ যে এই সব রাজনীতির পেছনে ছিল, সেটা সে সব গল্প – উপন্যাস না পড়লে আমরা বুঝতেই পারবো না।


ইদানীং যে সব গল্প – উপন্যাস লেখা হচ্ছে তাতে রয়েছে নব প্রজন্মের উত্থান পতনের ছবি। সে সবেও রয়েছে সমকালীন রাজনীতি ।


শেষে বলি, জীবনে সবকিছুর প্রভাব সাহিত্যে প্রতিফলিত হবেই । রাজনীতি তার বাইরে নয়। প্রভাব যদি নাই পড়ে, তবে পরবর্তী প্রজন্ম বুঝবেই না ! হতে পারে, রাজনীতি পাঠকের কাছে বিস্বাদ. তাই বলে তো সাহিত্য তার ধর্ম বিসর্জন দিতে পারে না ! 


রাজনীতি ও সাহিত্যে- একটি আলাপ - কিরীটি সেনগুপ্ত

রাজনীতি ও সাহিত্যে - একটি আলাপ
ক্লিশে …
কিরীটি সেনগুপ্ত



(বিশিষ্ট শিক্ষক, কবি, রাজনীতিজ্ঞ রণদেব দাশগুপ্ত’র সাথে একান্ত আলাপচারিতায় কিরীটি সেনগুপ্ত)


কি হে, মোল্লার দৌড় মসজিদ? রোববারের সকালে রণদেবদার মুখে এই মহার্ঘ্য শুনে তেতে উঠলাম। বললাম, হক কথা’ই বলেছেন – সার্থক বলেছেন দাদা, নিরাকার উপাসনা আর করছি কোথায়। ঐ তো সব পুতুল নিয়ে খেলাধুলো। মুখের কথা তখনো পড়েনি পুরোপুরি, রণদেব’দা শাসিয়ে উঠলেন, এত সস্তা নাকি? খেলবে আবার ধুলো’টি মাখবে না? দাদা…দাদা…দোহাই আপনার, আজ ফের পৌত্তলিকতা নিয়ে শুরু করবেন না, আজ একটা অন্য বিষয় নিয়ে আপনার কাছে এলুম…আপনার সাহায্য না পেলে বেটি’কে যে কথা দিয়েছি, আমার মুখ নিচু হয়ে যাবে দাদা। ঝেড়ে কাশো, কিরীটি – আর এই বেটি কে? তবু যেন ভয় কাটছে না, যা হয় হবে … বললাম, দাদা ঊষা’কে বেটি ডাকি। ওর আবদার, আমাকে লিখতে হবে সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব বিষয়ে। বেশ তো, লেখো’না, রণদেব’দা বললেন, কিন্তু আমি কি করব? খেয়াল করিনি, কখন মহুয়া’দি (রণদেব’দার সহধর্মিণী) আমার পাশে এসে বসেছেন। বললাম, আমাকে এখনো ঘন্টাদুয়েক থাকতে হবে দিদি, আজ এখানেই চা-জল খাবো। লুচি আলুরদম হয়ে যাক। কথাটা বলেছি কি বলিনি, দাদা ফোঁস করে উঠলেন, ওয়েল ডান্ ব্রাদার, লুচি মুখে সাহিত্য চর্চা জমবে ভাল। মহুয়া’দি চলে গেলেন আমার উদরপূর্তির আয়োজনে আর আমি বেটি’র আবদার রাখতে ছিনে জোঁকের মতো সেঁটে থাকলাম দাদার গায়ে। কিন্তু আমি কেন, কিরীটি? এই বিষয়ে তুমি সাহিত্যিক’দের শরণাপন্ন হও, গবেষক’দের কাছে যাও – ওনারা পারফেক্টলি বলতে পারবেন। একটু যেন সাহস পেলাম। বললাম, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না দাদা। এই প্রথম হেসে উঠলেন রণদেব’দা, বললেন, দ্যাখো সত্যি’ই আমার পৈতে নেই। আমার বাবা এই আচার-অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা বৈদিক ব্রাহ্মণ, লোকে ব’লে বদ্যি, আমার গায়ে পৈতে থাক আর না থাক তাতে সমাজের কি? আর সমাজের তথাকথিত ব্রাহ্মণকুল বদ্যিদের উপনয়ন বিষয়ে মাথা ঘামান কি? বললাম, দাদা বদ্যি বামুনের ইতিহাস জেনেই বলছি যে এদেরকে যথোচিত সম্মান সমাজ দেয়না তার পেছনেও উপরমহলের প্রত্যক্ষ রাজনীতি জড়িয়ে আছে। সে যাইহোক, আপনি বিগত ৩০ বছর নিরলস সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন প্রায় সমান সময় ধরে। পদার্থবিদ্যায় শিক্ষকতা করছেন প্রায় দু’দশক কাল। আপনি যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করবেন সেটা অন্য কোথাও পাব বলে মনে হয় না। এবার শুরু করি, দাদা? মুচকি হেসে একটা সম্মতি সূচক আওয়াজ করলেন রণদেব দাশগুপ্ত, হুম।


আমি: দাদা, সাহিত্য আগে নাকি রাজনীতি আগে ?


রণ’দা: বেশ, চাণক্যের সাহিত্য শুনেছো নিশ্চয়। কূটনীতি হোক, শাস্ত্রচর্চা সাহিত্যচর্চার একটা দিক মানবে আশা করি। চর্যাপদের কথা যদি ভাবো, তার পেছনে যে বৌদ্ধ দর্শন সেখানেও প্রচ্ছন্ন রাজনীতির গন্ধ পাবে। এমন একটা বিষয় যার আলোচনা বিশাল ব্যাপ্তিতে চলে যেতে পারে | কারণ, সাহিত্য এবং রাজনীতি এই শব্দদুটির সংজ্ঞা নিয়েই বহু মত এবং বহুতর বিতর্ক আছে | সে তর্কে না ঢুকে বেশির ভাগ মানুষ যে অর্থে এ দুটিকে বোঝেন আলোচনাটি সেই পরিসরে রাখাই ভালো | সাহিত্যের উদ্ভব প্রথাগত রাজনীতির আগে | কিন্তু সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে এক অংশের সাহিত্যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করল |



আমি: দাদা, দুটো বিষয় এলো। সমাজ বিবর্তন এবং একাংশের সাহিত্য|



রণ’দা: ঠিক ধরেছো; সামাজিক রূপান্তরের একটি অনিবার্য চলন ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় | কিন্তু এখানে সেই রূপান্তরই বিবেচনা করছি যা নির্দিষ্ট দর্শনে উদ্বুদ্ধ সচেতন মানবগোষ্ঠীর ক্রিয়াশীলতা দ্বারা অর্থাৎ রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত - যা ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুই-ই হতে পারে | আর, সাহিত্যের একাংশ কেন ? না, সামাজিক উপপ্লবের থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে তথাকথিত বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চার উদাহরণও বিস্তর |


আমি: তাহলে আমরা এসে পড়লাম art for arts' sake আর art for peoples' sake-এর বহুচর্চিত বিভাজনে। যে প্রসঙ্গটি এখানে সরিয়ে রেখে আমরা art for peoples' sake নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো, দাদা।


রণ’দা: আরো একটি ভেদরেখা এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার | রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্যও দু-ধরণের | একটিতে ধরা পড়ে সমকালীন রাজনীতির চলনের নৈর্বক্তিক পর্যবেক্ষণ এবং আর একটিতে লেখকের সক্রিয় মনন পেশ করে রাজনৈতিক আলোড়নের আত্তীকরণ আর নিজমতের উত্সারণ | যদিও মূলতঃ বাংলা সাহিত্য নিয়েই আলোচনা হবে তবু পৃথিবীর দুটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক উত্তরণ - ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের প্রভাবের কথা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না কারণ আমাদের দেশীয় সাহিত্য তথা বঙ্গসাহিত্যেও এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল |


আমি: দাদা, রাজনৈতিক আন্দোলন বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?


রণ’দা: রাজনৈতিক আন্দোলন দুই ধরণের হতে পারে | একরকম হ'ল বড় কোনো বিশ্বব্যাপী বা দেশব্যাপী আর্থ-সামাজিক অভিঘাতের উপ-উত্পাদন আর দ্বিতীয় রকমটি হ'ল এমন রাজনৈতিক আন্দোলন যা ধীরে ধীরে ভরবেগ সংগ্রহ করে দেশব্যাপী এক আমূল পরিবর্তন সূচিত করে | সাহিত্যে এই দুধরণের আলোড়নের ছবিই আসতে পারে , আবার সাহিত্য অনেক সময় এই আন্দোলনকে উত্সাহিত বা নিরুত্সাহিতও করতে পারে | মুশকিল হ'ল এই সনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি সর্বসম্মত নয় | তাই আমি দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া কেবলমাত্র লেখকের নাম উল্লেখ করবো | আশা করি, তুমি আবার বেঁকে বসবেনা, কিরীটি।




আমি: না না দাদা, আপনি বলুন, এই বিষয়ে মহাভারত লিখবো বলে আমি আসি নি।



রণ’দা: যেহেতু ভারতে, এমন কি স্বাধীনতা সংগ্রামেও, ফরাসী বা রুশ বিপ্লবের মতো কোনো আমূল রূপান্তরের কাহিনী ছিল না তাই বাংলা সাহিত্যে হুগো,ভলটেয়ার, গোর্কি , অস্ত্রোভস্কিদের খোঁজ করা বৃথা | কিন্তু সামগ্রিক রাজনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রভাবে যে সামাজিক অপশাসন বা নিশ্চলতা তৈরি হয় তাকে ব্যঙ্গ বা সমালোচনা করে একটি সাহিত্যধারা বাংলায় প্রায় দেড়শ বছর আগেই উপস্থিত | "হুতোম প্যাঁচার নক্সা" থেকে যদি শুরু ধরি তবে "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ " বা " একেই কি বলে সভ্যতা" এই ধারায় পড়বে | তবুও এগুলিকে আমি রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্য বলতে কিছুটা কুণ্ঠিতই থাকব | অবশ্যই এই ধারায় একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে দীনবন্ধু মিত্রের " নীলদর্পণ"। এই একই শিরোপা দাবি করতে পারে মীর মোশাররফ হোসেনের "জমিদার দর্পণ "। কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী একটি গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন ভাষা পেয়েছিল এই সাহিত্যকর্মে | ঠিক এভাবেই, বঙ্কিমচন্দ্রের "আনন্দমঠ" | তবুও এগুলিকে আক্ষরিক অর্থে রাজনৈতিক উপন্যাস বা নাটক বলব না | সেই দিক থেকে দেখলে বঙ্গ-সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর "জাগরী"-ই প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস |



আমি: ঠিক বুঝলাম না দাদা, যদি বিস্তারিত বলেন…



“অনেক হয়েছে, এবার গরম-গরম খেয়ে নাওতো”, মহুয়া’দির ডাকে চমকে উঠলাম। চটপট প্রাতরাশ সেরে গরম চা’এ চুমুক দিতে দিতে



রণ’দা: যা বলছিলাম, "জাগরী" -তেই প্রথম রাজনৈতিক দল, তার নেতৃত্বের বাস্তব উল্লেখ, আন্দোলনের পথ নিয়ে তর্ক উঠে এল সাহিত্য-সীমানায় | "জাগরী" একটি অন্যদিক খুলে দিল বাংলা সাহিত্যে | অনেকে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের "গোরা", "ঘরে বাইরে", "চার অধ্যায়" এবং শরত্চন্দ্রের "পথের দাবী" এই চার’টি রচনাকে রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্যে "জাগরী"-র পূর্বসূরি বলে মনে করেন এবং আমিও তাতে আপত্তির কিছু দেখি না | কিন্তু "জাগরী" -তেই বোধহয় প্রথম এদেশে দুটি মূল রাজনৈতিক দর্শনের সংঘাতের ছায়া পড়তে শুরু করল | আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রভাব তখন দেশে দেশে পড়তে শুরু করেছে -ভারতও তার বাইরে নয় | এরই পথ ধরে পরবর্তীতে সহস্রধারায় পল্লবিত হ'ল বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক |


আমি: বেশ কয়েকজনের নাম মনে আসছে দাদা, তারাশংকর, মানিক, দুই সমরেশ, মহাশ্বেতা, তপোবিজয় প্রমুখ |


রণ’দা: তারাশংকরের 'গণদেবতা' ও 'ধাত্রীদেবতা', সমরেশ বসুর 'বি.টি রোডের ধারে' বা ' শিকলছেঁড়া হাতের খোঁজে', সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' ট্রিলজি, মহাশ্বেতা দেবীর 'অরণ্যের অধিকার' বা 'হাজার চুরাশির মা', তপোবিজয় ঘোষের 'কালচেতনার গল্প' প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ | একথাও ঠিক যে রাজনীতি প্রভাবিত এই সাহিত্যে নাটকের দিক থেকে অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ,মোহিত সেন , উত্পল দত্ত এঁদের নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে | অন্যায় হবে গোলাম কুদ্দুসের উপন্যাস 'লেখা নেই স্বর্ণাক্ষরে'` উল্লেখ না করলে | কবিতার দিকে সুকান্ত, নজরুল থেকে শুরু করে রাম বসু,কৃষ্ণ ধর, দীনেশ দাস,তরুণ সান্যাল , সামশুর রহমান,আবু জাফর বায়দুল্লাহ্,সত্য গুহ, শ্যামসুন্দর মিত্র, সলিল চৌধুরী এদের নাম স্মরণে রাখতে হবেই | এছাড়া আরো কত খ্যাত বা স্বল্পখ্যাত লেখক যে সাহিত্যের এই বিশিষ্ট ধারাটিকে পুষ্ট করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া অসম্ভব | জরুরি অবস্থা, কমিউনিস্ট আন্দোলন, নকশাল পর্ব, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এসবের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গণনাতীত সাহিত্যকর্মের কথা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক কথা বলে ফেললাম, এবার যে উঠতে হবে ব্রাদার।


রণদেব’দার বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করে দিলাম আজ। খাতা-কলম গুটিয়ে গুডবাই এবারকার মতো। জানি, এই প্রবন্ধের পরিসর আলোচ্য বিষয়ের বিশালতাকে ধারণে অক্ষম | একটি পরিধি আঁকার চেষ্টা করেছি মাত্র।

এই সংখ্যার কবি - ব্রততী চক্রবর্তী

এই সংখ্যার কবি
ব্রততী চক্রবর্তী


কথকতা - ১



বুভুক্ষু কালাহান্ডির চোখে ফটফটে সাদা ভাত আর

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে গরম ফ্যানের ঘ্রাণ !
তোর জন্য আগুন জ্বেলেছি ...
ভুল করতে করতে ভুলগুলো গান হয়ে যায়
আর আমার চানঘরে গুনগুন করে
পেন স্টান্ডে লাল-নীল-সবুজের শৌখিনতা
তবে বোবা কলমের আঁচড়ে রং থাকে না
প্রেত যোনির দীর্ঘ নিঃশ্বাস শুকিয়ে থাকে শুধু !


কথকতা - ২



হোঁচট খেয়ে পা যায় পিছলিয়ে --

আমি সটান পৌছে যাই এক বোধি জগতে ।
আমার চারপাশে গিজগিজ করে বাক্য শব্দ
ভিন্ন বর্ণ রকমফের আকারে
লম্বা বাক্য, খাটো বাক্য
শ্বেত বাক্য, নিকষ বাক্য
শ্লীল বাক্য, সেয়ানা বাক্য
রাজা বাক্য, প্রেত বাক্য ।।
আমি মিশে যেতে চাই গভীর অভিনিবেশে ;
ব্যর্থতা চিবুকে রাখে দিকনির্দেশ,
যে বাহারে ফুসফুসে অক্সিজেনের যোগান নেই
তার ফুরিয়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত ।
আমি আবার গোছ-গাছ করে নেই .


কথকতা - ৩



পাথুরে পথের রুক্ষতা শ্যামলী আলো

চোখ ভেসে যায়; শেষ রাতের ক্লান্ত চাঁদ
ভোরের আড়ালে তখন নিকষ সবুজ
আঁকা-বাঁকা পথ সরলরেখা গতি
বায়বীয় যত জটিল সূক্ত, অকারণ তত
কঠিন স্তোত্র; জাতকের কাহিনীর অনিয়ম
স্মৃতি-তর্পণ ! কোনো এক বিস্মৃত বিবর্তনবাদ
সচল কায়াময় -- মস্তিস্কের ধূসরতায় উত্তর
সেইসময় নিরুত্তর, সুপটু কোনো চিত্রকরের
নিপুণ কর চাপে ঢেউ এর মত ছড়িয়ে যায়
দিগন্ত-বলয়; পার্থিব যাবতীয় স্থুলতা লহমায়
অনিকেত এবং সহজ ভারহীন শূন্যতা !
হৃদয় অবগাহনে নিরিবিচ্ছিন্ন নির্বিকল্প প্রশান্তি।


কথকতা - ৪


কোনো আবরণ রাখিনা তাই আড়ালটুকু শুধু

ঋণ - পরিশোধে বিব্রত মূলধন
এই নাকি উন্মুক্ত বাতায়ন ! পদব্রজে পার হয়
যুগাতি বর্ষ - এর জন্য !
সমস্ত আলোচনা মুলতুবি রাখি কোনো এক
নিস্পৃহ স্থিতিশীলতায়
এই মনের অনেক দন্দ্ব, মধ্যযামের ঘন্টাধ্বনি
আগুন জ্বালায়, ছটপট করি
বিরতির পর থাকতে পারে কিছু চমক
এমন ভাবি - হয়তো নির্বুদ্ধিতা
ঘোর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ সাময়িক, বুঝেও
যা বুঝতে চাইনা --
কিছু অকারণ প্রশ্নবোধক আঁচড়ায় কামড়ায়
দুমরায় মোচরায়
হৃদয় থেকে চেঁছে ফেলি সমস্তকিছু যা
ঘটাতে পারে ছন্দপতন !


কথকতা - ৫



ওই খানে - ওই বেঞ্চির ওপর,

শিরদাঁড়া সোজা আর মুখের এক
তৃতীয়াংশ সূর্যের সমান্তরাল |
বেয়াদপ !কানে ঢুকছে না কথাগুলো !
ল্যাম্প পোস্টের গায়ে কাদার ছিটে,
ছাল ছাড়ানো মুরগির মত উল্টো ঝুলছে
শতাব্দীর সব বুদ্ধিজীবী শব্দেরা!
ফাঁকা ডাস্টবিন ময়লা ছড়ানো খাওয়ার
টেবিলের আশেপাশে, আবার সেইসব
ছ্যাবলামি রোজ সকালের দাঁত ব্রাশ
আর দুপুরের ভাতঘুমের মত হাই তোলে
ধমকানির শব্দটা শোনা যাচ্ছে না
হাতের তালু কানা -- এইসব বধির চোখ
আর এই বেতের শব্দে চমকাবে না,
শুভ বুদ্ধির গুরুদশায় সব নিয়ম নাস্তি !


কথকতা - ৬



আমার মতন করে আমাকে খুঁজে নিতে চাই

কিছু নিয়মিত সমীকরণ আর অকারণ আঙ্গিকে
আমার রোজকার ঘেন্না ! জিভের তলা সুড়সুড় করে
রং করা নখে চাপা পড়ে বিপ্লবের ইচ্ছা, সুযোগ বুঝে
আবার নেতিয়ে পড়ি ; তবু কোনদিন এভাবেই চেনা
চাঁদের অর্থ বদলে থাকে, অভ্যস্ত শীতলতায় কালি কলমে
ঘাড় গুঁজি - বুভুক্ষু কিছু ইচ্ছেকে লালন করি !


কথকতা - ৭



প্রতিটা অক্ষর ঋণ - দেউলিয়া ভাবনার জমা-খরচের

খাতায় বিস্তর ভুল আর কাটাকুটি |
প্রতি মুহুর্তে এক অস্তিত্ব সংকট !
বিপন্ন সৃজন আড়াল চায় -
এখন শুধু ঢেউএর সহজ টানের অপেক্ষা;
জোয়ারের ছোঁয়া এড়িয়ে জলে আলতো স্পর্শ,
ভেসে যেতে আজ বড় ভয় !
তবু ওই নিয়ম ভাঙ্গার ডাক বারবার
আমাকে অবশ করে - টেনে হিঁচড়ে
আনে নিরাপদ আরামের বাইরে !
আমার শব্দকে নিশি ভর করে
ঝাঁপ দেই পাগলামিতে !

কবিতা - প্রণব বসুরায়

টেডি বিয়ার ও বসন্ত উৎসব
প্রণব বসুরায়

অপ্রত্যাশিত সূত্রে জানিলাম যে টেডি বিয়ারের বিপুল পরিমাণ আদর ও চাহিদা হইয়াছে---একবার হস্তগত হইলে উহা যথেষ্ট নোংরা না হওয়া পর্যন্ত কেহ তাহাকে পরিত্যাগ করিতেছে না এবং উহাকে লইয়াই নিজস্ব কাজকর্ম সারিতেছে।
#
অতএব, আসন্ন বসন্ত উৎসবে, সাধারণ্যে বিতরণের নিমিত্ত বেশ কয়েকটি টেডি বিয়ার সংগ্রহ করিয়া ফেলিলাম। কিন্তু বর্তমানে শরীর- স্বাস্থ বিশেষ জুতের না হওয়ায় নিজের উপর ভরসা রাখিতে না পারিয়া এক বেলুন-ওয়ালার সহিত চুক্তি করিলাম---যে ব্যক্তি দুই্টি বেলুন একত্রে কিনিবে তাহাকে একটি টেডি বিয়ার বিনামূল্যে বিতরণ করিবে। প্রথমে সে রাজি হইতেছিল না এই বলিয়া যে টেডি বিয়ারের উপযোগিতা সম্বন্ধে তাহার কোন সম্যক জ্ঞান নাই। তাহাকে বুঝাইলাম যে টেডি বিয়ারকে কোলে স্থান দেওয়া যায়, উরুর নিচে রাখিলে পায়ের আরাম হয়, উহাকে বালিশের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা চলে,ও অন্যকে দেখাইয়া আদর-সোহাগ বর্ষণ করা যায়। শুধু এইটুকু বলিলাম----সে রাজি হইয়া গেল।
#
আমার সংগ্রহ তাহাকে হস্তান্তর করিয়া একটি বিশেষ অনুরোধ জানাইলাম-----বসন্ত উৎসবের ঘোর কাটিয়া গেলে আপন ডেরায় প্রত্যাবর্তনের সময় অনেকেই সাময়িক-স্মৃতি বহনে অনিচ্ছুক থাকে বলিয়া টেডি বিয়ারগুলি পরিত্যাগ করিয়া যাইবে----সেই পরিত্যক্ত পুতুলগুলি সংগ্রহ আমাকে যেন ফিরৎ দেয়!
#
আমি পুতুলের সহিত আলাপ করিবার ভাষা শিখিয়াছি। তাহাদের অভিজ্ঞতা আপনাদের জানাইব, কেননা আমি ইহা সবিশেষ জানি যে আপনারা প্রকৃত সমজদার।
#
আপনাদের প্রতিক্রিয়ায় আমারও আগ্রহ আছে , জানিবেন।

কবিতা - সমর বন্দ্যোপাধ্যায়

বাধ্য
সমর বন্দ্যোপাধ্যায়


জানতে হবে কষ্ট নেই
এবং কোনো দুঃখ নেই

আকাশ টুকরো টুকরো মেঘে
নামছে দেখি সন্ধ্যা
গ্রীষ্মকালীন আঁধার থমকে
অয়ি সনির্বন্ধা

স্পর্শের কথা রাত্রি ছোঁয়া
রাত্রির মন কেমন হওয়া

কিন্তু ফাটা মেঘের ব্লেড-এ
ঝলসে ওঠা রক্ত
           আড়াল করা শক্ত

তাই বুঝতে হয়--বাধ্য হয়ে
কোথাও কোনো কষ্ট নেই......
           সত্যি কি খুব সহজ এই!

কবিতা - তারাপ্রসাদ সাঁতরা

স্মৃতিতে ডুবিয়ে নিচ্ছি হৃদয়
তারাপ্রসাদ সাঁতরা


সকলেই গোল হয়ে বসে । আশ্রমিক পাঠের মতো
স্মৃতিতে ডুবিয়ে নিচ্ছি হৃদয় ।

টুকরো টুকরো কথার মাঝে উঠে আসে
দীর্ঘ দীর্ঘ বছরের পা ফেলা জীবন

চরণচিহ্নগুলি রেখে বাড়িতে ফিরে যাওয়া আজ
হাতে বলতে অম্লান ভালোবাসা

সকলেই এখন হাত ডুবাচ্ছি অতীত বাক্সে
বের হচ্ছে রঙিন সব চিঠি

আমি পড়ছি । আমরা পড়ছি সহমর্মিতায়
স্মৃতিতে ডুব দিচ্ছে হৃদয় ।
এখানে কিছু জল যদি ঝরে, তাও সত্য
প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন
চোখের তারায় ফোটে বেদনার রং ।

কবিতা - হিন্দোল ভট্টাচার্য

কুয়াসাযাপন
হিন্দোল ভট্টাচার্য

কবিতা - বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

জৈবউনুন অথবা ম্যাঙ্গোফ্রুটি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


ডানা মেলে উড়ি বিষাদ উধাও আজ
নিলয়ে লিখেছি কবিতাও অফুরান
পাঁজরে স্বপ্ন উৎসব উৎসব
উজানগঙ্গা এখানে শব্দস্নান ।

নির্জনতার পাতায় এঁকেছি রোদ
অবিনশ্বর ওড়ে প্রজাপতি দুটি
ওই ফাঁকামাঠ কবিতায় উঠে আসে
জৈবউনুন অথবা ম্যাঙ্গোফ্রুটি

ক্রমিক বৃষ্টি ভিজেছে শুধু কি শাড়ি
এখনও কি সেই জেগে আছে উত্তাপ ?
পাঁজরে জেগেছে রমনীয় রূপকথা
স্যুটকেশ থেকে বেরিয়ে আসুক পাপ