শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৩

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলোকপর্ণা

চান্দের চর
(দ্বাদশ কিস্তি)
অলোকপর্ণা


রেজ্জাককে কিছু রুটি আর তরকা ধরিয়ে দিয়ে হাবুল বেরিয়ে গিয়েছে কোথাও। রেজ্জাক এই প্রথম তরকা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে হাবুলকে টলতে টলতে ঘরে ঢুকে আসতে দেখে সে। হাবুল ঘরের কোণে বসে ঝিমোতে থাকে। পুরো খাবারটা শেষ হলে রেজ্জাক উঠে গিয়ে ঘরের অপর কোণের বেসিন থেকে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। ঘরে একটাই বিছানা, পুরোনো হলুদ দাগ পড়া চাদর তাতে পাতা। রেজ্জাক হাবুলের পাশে এসে বসে।


“হাবুলদা, শোবে না?”


“উম?”


“শুয়ে পড়ো...”


“হুম...”


রেজ্জাক হাবুলের বিশাল শরীরের পাশে একচিলতে জায়গা খুঁজে নিজেকে গুঁটিয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের হাঁটাহাটির পর তার ঘুম আসতে দেরী হয় না।


কলকাতায় রাতটা আজ যেন আলাদা রকম গভীর। চাঁদনী চকের গলির মধ্যে দ্বৈপায়নের আবার জ্বর এসেছে। সে চোখ খুলে শুয়ে আছে রাস্তার একপাশে। রাস্তার কয়েকটা কুকুর ঘোরা ফেরা করছে, কেউই দ্বৈপায়নকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে বলে মনে হয় না। ভাবলেশহীণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আধা ভিখারী মানুষটাকে ওরা ওদের মত নামানুষের পর্যায়েই গণ্য করেছে। একটা সময় পর দ্বৈপায়নের আর চোখের পলক পড়ে না। সে যেন চোখ খুলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। তার চোখের আড়ালে রবি বাউল বসে থাকেন চাঁদের অপেক্ষায়। তিনি টের পান দ্বৈপায়নের জ্বর রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে গাঢ় হচ্ছে।

রেজ্জাক দেখে তার গায়ের ওপর কচ্ছপের মতো বিশাল একটা খোলা। প্রচন্ড ভারী সেই খোলসের তলায় রেজ্জাক শ্বাস নিতে পারছে না, নড়তে পারছে না। রেজ্জাক ছটফট করতে থাকে। একটু বাদেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে দেখে হাবুলের বিরাট লোমশ দেহ তার ওপর ঝুঁকে এসেছে। রেজ্জাক ছিটকে উঠে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু হাবুলের একটা হাত তাকে আবার চেপে ধরে শুইয়ে দেয়। রেজ্জাক টের পায়, তার গায়ে গেঞ্জি বা প্যান্ট কিছুই নেই। রেজ্জাক চেঁচাতে থাকে। এর মধ্যেই হাবুল তাকে উল্টে ফেলেছে। নিজের প্যান্ট খুলতে তার মুহূর্তও লাগে না। রেজ্জাকের চিৎকার কলকাতার গভীর রাতে কারোর কানে পৌঁছায় না। সে টের পায় তার শ্রোণী গহ্বর বরাবর এক শক্ত দন্ডাকার কিছু ঢোকানোর চেষ্টা করছে হাবুল। রেজ্জাকের দুটো হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে সে। রেজ্জাক পা ছুঁড়তে শুরু করে। নিজেকে দুমড়ে মুচরে ফেলতে চায় হাবুলে হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য। হঠাৎ সারা শরীরে নিদারুণ ব্যথা দিয়ে সেই শক্ত নলাকার বস্তুটি রেজ্জাকের ভিতরে ঢুকে আসে। রেজ্জাক কঁকিয়ে ওঠে। কেউ শুনতে পায় না। কলকাতা শহর যেন বহুদিন আগেই বধির হয়েছে। পরবর্তী মিনিট পাঁচ কয়েক বার ঝাঁকুনি খাওয়ার রেজ্জাক বোঝে হাবুলদা তার শরীর থেকে বের হয়ে গেছে। রক্তে ভেসে যায় বিছানা। রেজ্জাক ওঠার চেষ্টা করে। প্রচন্ড ব্যথায় পা নাড়াতে পারে না।

“হাবুলদা... এটা কেন করলে!” হাহাকার বের হয় চিৎকার করতে গিয়ে চিরে যাওয়া রেজ্জাকের গলা থেকে। হাবুল কোনো সাড়া দেয় না। এক হাতে রেজ্জাকের মাথাটা ধরে আবার খাটে ঠেসে গুঁজে দেয়। রেজ্জাক সেখানে পড়েই কাঁদতে থাকে। হাবুল তাকে একটা চাদর ছুঁড়ে দেয়। রেজ্জাকের ক্ষমতা হয় না সেটা দিয়ে নিজেকে ঢাকবে। হাবুল তার পাশে রক্তের ওপরই শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই সে গভীর ঘুমে চলে যায়। রেজ্জাক টের পায় হাবুলের শ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। সে পা তোলার চেষ্টা করে। এতো যন্ত্রণা যেন তার আগে হয় নি। আপ্রাণ কচ্ছপের মতো অনেক চেষ্টা করে সে উল্টে ফেলে নিজেকে। হাবুলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কোনো সাড় আছে কি না, তারপর দাঁতে দাঁত চেপে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসে গায়ের চাদরটা নিয়ে। তার পা বেয়ে রক্ত গড়াতে থাকে। ঘরের দরজার খিলটা তেমন শক্ত না হওয়ায় রেজ্জাকের দরজা খুলতে অসুবিধা হয় না। অতি সাবধানে দরজা টেনে দিয়ে রেজ্জাক সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসে। এই বাড়ির কোনো সদর দরজা নেই। রেজ্জাক বাইরে রাস্তায় এসে যায়। দু তিনটে কুকুর রেজ্জাককে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে। রাস্তার ওপাশে কেউ একজন আস্তে আস্তে উঠে বসে। পাগলটা!


রেজ্জাক ভরসা করে উঠতে পারে না। এও যদি হাবুলদার মত হয়! সে দেখে পাগলটা তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে। কোনো অন্যথা নেই দেখে রেজ্জাক খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তা পার হয়।


“কি হয়েছে তোর!!” দ্বৈপায়ন ভীত হয়, তার সামনে রেজ্জাক গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে ফুঁপিয়ে চলেছে।


“বল আমায়, কি হয়েছে...” সে খেয়াল করে রেজ্জাকের পা বেয়ে একটা ঠান্ডা তরল তার গায়ের কাছে বয়ে এসেছে।


“রক্ত!” রেজ্জাক কেঁদে ফেলে, “হাবুলদা... হাবুলদা...” আর কোনো কথা সে বলতে পারে না। দ্বৈপায়ন একটানে তার গায়ের চাদর খুলে নেয়, এক হাত দিয়ে রেজ্জাককে ঘুরিয়ে দেখে তার পিছনে এক গহ্বর তৈরী হয়েছে, তার অন্ধকার থেকে রক্ত মাংস বেরিয়ে আসতে চাইছে। এতো বিভৎস দৃশ্য দ্বৈপায়ন তার উনত্রিশ বছরের জীবনে দেখেনি। সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। “কে করেছে এটা!” চিৎকার করে দ্বৈপায়ন। রেজ্জাক কিছু বলতে পারে না, কান্নায় ভেঙে পড়ে। হঠাৎ কুকুরগুলো ডেকে উঠতে দ্বৈপায়ন দেখে সকালের সেই দশাসই চেহারার লোকটা বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়, এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো সে রেজ্জাককেই খুঁজছে। দ্বৈপায়নের কিছু বুঝতে আর বাকী থাকে না। সে উঠে পড়ে।



রাস্তার ওপাশে রেজ্জাককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাবুল গর্জে ওঠে, “রেজ্জাক!”


দশ বছরের ছেলেটা দ্বৈপায়নের পিছনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ে কাঁপতে থাকে।


হাবুল দ্রুত রাস্তার এপারে এসে দ্বৈপায়নের সামনে এসে দাঁড়ায়। এক হ্যাচকা টানে রেজ্জাককে তার থেকে আলাদা করে দেয়।


রেজ্জাক চেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে। হাবুল রেজ্জাককে নিয়ে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরতেই দ্বৈপায়ন হাবুলের হাত খামচে ধরে। “আপনি এটা কি করছেন! ও একটা সামান্য বাচ্চা!”


হাবুল ঘুরে তাকায় দ্বৈপায়নের দিকে। তার চোখ ঘোলাটে হয়ে আছে। মুখ থেকে লালা বেরিয়ে এসেছে খানিক। সে কিছু না বলে আবার রেজ্জাককে নিয়ে রাস্তা পার হতে যায়, রেজ্জাক ছটফট করতে থাকে। দ্বৈপায়ন এবার জোরে হাবুলের কাঁধ খামচে ধরে। হাবুল পিছু ফিরে প্রথমে এক ঘুষি মারে দ্বৈপায়নকে। দ্বৈপায়ন মাটিতে পড়ে যেতে হাবুল তার ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকে এলো পাথারি ঘুষি মারতে থাকে। নাক মুখ ফেটে যেতে থাকে দ্বৈপায়নের। জ্বর গায়ে শীর্ণদেহী দ্বৈপায়ন হাবুলের থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে না। হাবুলের হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেতেই রেজ্জাক চাদরটা আঁকড়ে ধরে দৌড়াতে থাকে। সবচেয়ে জোরে দৌড়ে সে হাবুলের থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চায়। দূরে চলে যেতে যেতে তার কানে আসে দ্বৈপায়নের চিৎকার। একসময় তাও শুনতে পারে না সে।



“হ্যালো স্যর, ই পি আই হসপিটাল থেকে এই মাত্র ফোন এসেছিল। ওরা বলছে ওদের ওখানে আজ সকালে একজন পেশেন্ট এসেছে। সে বলছে তাঁর নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ঘোষ।”

তীর্থঙ্কর উঠে বসেন লেখার টেবিল থেকে, “কখন এসেছে সে? কোনো ইনজুরি আছে তার?”


“আজ ভোরের দিকে কয়েক জন লোক তাকে এখানে অ্যাডমিট করিয়েছে, মুখে ছটা স্টিচ পড়েছে, মাথায় আটটা, ফিফথ রিব বোনে একটা ফ্র্যাকচার আছে।”


“আচ্ছা, আমি আসছি এখনই” তীর্থঙ্কর ফোন কেটে দিয়ে দ্রুত আর একটা নম্বরে কল করে।


“ডঃ ঘোষ...”


“বলো... কি ব্যাপার? এনিথিং রং?”


“খানিকটা... মনে হয় পাওয়া গেছে তাকে...”


“দেখো এটাও ফেক কি না... এই নিয়ে কতবার ফোন এলো?”


“এটা চার নাম্বার, এর আগে বেকবাগান, শিয়ালদা, সল্ট লেক থেকে তিনবার পুলিশের কাছে খবর এসেছিল।”


“তুমি গিয়েছিলে সেখানে?”


“হ্যাঁ... ”


“খেটেছো তাহলে পিকুর জন্য। এবার কি করবে?”


“আমার মনে হচ্ছে এটা জেনুইন। আপনি আসবেন একটু বড় বাজারের কাছের ই পি আই হসপিটালে?”


“হসপিটালে!”


“হ্যাঁ, কিছু স্টিচ আর রিব বোন ফ্র্যাকচার”


“হুম, আসছি তাহলে। তুমি থাকবে ওখানে?”


“হ্যাঁ।”


ফোন রেখে তীর্থঙ্কর দ্রুত গাড়ি বের করে আনেন। কলকাতার রাস্তায় যদিও দ্রুত চলাচল অসম্ভব তাও কোনোক্রমে তিনি দ্রুত ই পি আই হসপিটালের দিকে গাড়ি চালাতে থাকেন।



ডঃ ঘোষ কাচের দরজার এপারে এসে দাঁড়ালেন।


ওপাশে বেডে যে মানুষটা শোয়া তাকে দেখে চমকে ওঠেন তিনি। মুখময় স্টিচের পাশে সাদা সাদা দাগ গুলো চোখ এড়ায় না তাঁর। গা গুলিয়ে ওঠে ডঃ ঘোষের। পিকু! দরজা ঠেলে ঢুকে আসতে পারেন না তিনি। এসব কবে হল পিকুর গায়ে! এই কদিনে এতো ছড়িয়ে যেতে পারে না ভিটিলিগো। পিকু ফোনে তো কিছুই জানায় নি। ও কি ইচ্ছা করেই... না, তা কি করে হয়। অপদার্থ পুত্রের প্রতি ঘেন্নায় বমি পেতে থাকে ডঃ ঘোষের। বারংবার গলা দিয়ে ঠেলে পাঠাতে থাকেন অর্ধপাচ্য খাবারের অংশবিশেষ। কিছুক্ষণ পরে পাশে দাঁড়ানো পুলিশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন “এ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নয়।”