বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ১১তম সংখ্যা ১ম বর্ষ

সম্পাদকীয়



এই সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে বসে হঠাৎ মাথায় দুটো লাইন নেচে উঠলো -

"আয়রে পাগল আবোল তাবল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয় "


টিভি থেকে কাগজ,কাগজ থেকে ইন্টারনেট সব জায়গায় পৃথিবী ধ্বংসের খবর রটেছে বেশ কিছুদিন আগেই । কেউ কেউ বিয়ে,কেউ প্রেম বা ইসে সেরে রাখছেন। আমি তাই আগে ভাগে সেরে রাখছি সম্পাদকের কাজটি ।

ওপরে গিয়ে পাগলের দলে নাম লেখাতে বাঁধা নেই কোনো ক্ষ্যাপামির ফাস্ট ক্লাস কামরায় জায়গা হবে অবশ্যই ।

কিন্তু প্রস্ন হল ওপর বলে কিছু থাকছে কি? স্রষ্টাকে কান ধরে হিরহির করে টেনেছি খেপুর তুবড়ি দের মাঝে। তুবড়ি ফাটলেই স্রস্টা সাসপেন্ড ! আজগুবি সংখ্যার পরিসংখ্যাণে এ সংখ্যা বিশেষ ভাবে খ্যতি লাভ করবে তা বলা বাহুল্য মাত্র। এই সম্পাদকীয়ও যে পাগলের পাগলামি তাতে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।


এ সংখ্যায় 'ধ্বংসের রাজ্যে খ্যপামি গদ্যময়' ...

ধরুন আপনাকে মুনিবর ব্রম্ভা ফোনে জানালেন

"বস, আজকের দিনটা আর নো মোর লস...
কালই পৃথিবীর ফুল টস"

ব্যস... আপনি প্ল্যান সেরে রেডি ।

ভার মে যায়ে দুনিয়া, পাশের ঘরের বৌদি আর আমি আজ হোল নাইট অ্যাট তন্ত্রা ... বা বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে , বরের পকেট কেটে পুরো শপিং মল মেরি মুঠঠি ম্যায় !!

ইচ্ছে আপনার, ডানা দিল ক্ষেপু, খ্যাপামির এই তো সুযোগ আর নো মোর বকবাস !
আসুন সবাই মিলে প্রাণ ভরে বলি ... জয় ক্ষ্যাপামির জয় !


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে ঊষাসী ভট্টাচার্য


অপ্রকাশিত ডাইরি - মলয় রায়চৌধুরী

আলুর গৌরচন্দ্রিকা
মলয় রায়চৌধুরী




১৯৬৪ সালে ঠাকুমা ৯৪ বছর বয়সে মারা যাবার পর, আমাদের উত্তরপাড়ার বসতবাটী 'সাবর্ণ ভিলা' খন্ডহরে পরিণত হয়েছিল । কিন্তু কলকাতায় রাতে কোথাও আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না বলে ওই খন্ডহরেই রাতটা কাটাতে হতো । ঠাকুমা একা কী করে ওই বারো ঘরের বিশাল খন্ডহরে থাকতেন জানি না ; উনি পাটনায় আমাদের কাছেও যেতে চাইতেন না, বলতেন যে পাটনার বাড়িতে উনি হাঁপিয়ে ওঠেন ; গাছপালা নেই, খোলা আকাশ নেই, কুয়োতলা নেই, বাংলায় গল্প করার জন্য বুড়িদের জমায়েত নেই । ষাটের দশকে যখন আমার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল, আমি ওই খন্ডহরেই আদালত থেকে ফিরে যেতুম রাতটা কাটাবার জন্যে । ঠাকুমা থাকতে ওনার হবিষ্য খেয়ে চলে যেত । উনি মারা যাবার পর খাওয়াটা সমস্যা হয়ে দেখা দিল । সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে উঠত কলকাতার বাইরে থেকে আমার বন্ধুবান্ধবরা আসলে । কলকাতায় তাঁদের আস্তানা নেই । অনেকে খন্ডহরটাই পছন্দ করত প্রধানত যা ইচ্ছা তাই করার বা ফোঁকার বা পান করার স্বাধীনতার জন্যে । ত্রিদিব মিত্রের বাড়ি ছিল হাওড়ার সালকিয়ায় ; তবু ও মাঝে-মধ্যে উত্তরপাড়ার খন্ডহরে থাকতে চলে আসত আমার সঙ্গে । ঠাকুমা মারা যাবার পর বাড়ির সিংদরজার পাল্লা দুটো আর দুটো পায়খানারই কপাট চুরি হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুবান্ধবদের বলে দিতে হয়েছিল যে পায়খানায় গেলে সামনেই মগ রেখে দিতে, যাতে জানা যায় যে কেউ একজন ভেতরে বসে ধ্যান করছেন । আমি পাটনামুখো হলে ওরা পাটনাতেও চলে আসতো ।


একবার অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, যারা আমাদের আন্দোলনের পোস্টার প্রচ্ছদ ইত্যাদির ড্রইং এঁকে দিত, ওরা এসে পৌঁছল খন্ডহরে । আমরা তিনজনে ওই বাড়িতে একত্রিত হয়েছি দেখে ত্রিদিবও পৌঁছে গেল । একেবারে খন্ডহর গুলজার । সকালে মুড়ি কাঁচালঙ্কা খেয়ে-খেয়ে কয়েকদিনে চোঁয়াঢেঁকুর আরম্ভ হলে ত্রিদিব আইডিয়া দিল যাওয়া যাক গৌরকিশোর ঘোষের বাড়ি, সকাল-সকাল । গৌরকিশোর ঘোষ থাকতেন বরানগরে । খেয়াঘাটের কাছে আমাদের বসতবাটী থেকে হন্টন দিয়ে বালিখাল, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে বরানগর । বালিখাল ধেকে শ্যামবাজার যেত বাসগুলো । সকালের ব্রেকফাস্টটা গৌরকিশোর ঘোষের বাসায় সারা যাবে । তখন বালিখালের ফ্লাইওভারটা তৈরি হয়নি ।


সেসময়ে 'দর্পণ' নামে একটা ব্রডসাইড পত্রিকা প্রকাশিত হতো । তাতে আমাদের সম্পর্কে 'বিদেশি সাহিত্যের নকল' ধরণের টিটকিরি মেরে খবর বেরোত । প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই বেরোত কিছু-না-কিছু । ঠাট্টা করে কার্টুনও বেরিয়েছিল কয়েকবার । কার মগজ থেকে ওই মন্তব্যগুলো বেরোচ্ছে তা জানার জন্য আমি, দেবী রায়, সুবিমল বসাক আর ত্রিদিব মিত্র ঢুঁ মেরেছিলুম 'দর্পণ' দপতরে । গিয়ে পাওয়া গেল না কাউকে । ফতুয়া-লুঙ্গি পরা একজন পাকাচুল ম্যানেজার ছিলেন যিনি অফিস সামলাতেন । তাঁকে আমাদের কয়েকটা বুলেটিন দিলুম সম্পাদকদের পড়তে দেবার জন্য । তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলুম যে কাগজটা শুরু করেছেন যুগান্তর পত্রিকার অমিতাভ চৌধুরী আর আনন্দবাজার পত্রিকার গৌরকিশোর ঘোষ । ওনারা দুজনেই খবর পেলেন যে আমরা দলবেঁধে ঢুঁ মেরেছিলুম । অমিতাভ চৌধুরী, বুলেটিনগুলো পড়ে আমরা কী করতে চাইছি অনুমান করলেন, আর পর-পর দুটি সংখ্যা 'দৈনিক যুগান্তরে' সম্পাদকীয় লেখালেন ; আমাদের সমর্থন করেই বলা যায় । সম্পাদকীয় দুটো লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর । আনন্দবাজারে আমাদের সমর্থনে লেখার প্রশ্নই ওঠেনা । অবশ্য 'দেশ' পত্রিকায় জ্যোতির্ময় দত্ত একটা দীর্ঘ তাচ্ছল্য-গদ্য লিখেছিলেন, 'বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ' শিরোনামে , তাতেও সেই একই বক্তব্য, বিদেশি প্রভাব । জ্যোতির্ময় দত্ত এখন আমেরিকায় থাকেন । সম্প্রতি দিল্লির অরুণ চক্রবর্তী আমেরিকা গিয়ে জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জ্যোতির্ময় অরুণকে জানিয়েছেন যে 'হাংরি আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র আন্দোলন' । মন্দ লাগেনি শুনে !


আসল প্রসঙ্গে ফিরি । গৌরকিশোর ঘোষ আমাকে ওনার বাসায় ডেকে পাঠালেন, সকালে একসঙ্গে রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে । ওনার বাড়ির কাছে কোনো মিষ্টির দোকানে সকালে লাইন লাগে ওই কম্বিনেশান খাবার জন্যে । সেই সূত্রেই অনিল, করুণা, ত্রিদিবকে নিয়ে ওনার বাসায় ব্রেকফাস্টটা সেরে ফেলবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলুম । চারজন পৌঁছে গেছি দেখে উনি চ্যাঁচারি ভরা রাধাবল্লভি আর হাঁড়িভর্তি আলুর দম আনালেন । খেতে-খেতে তর্কাতর্কি শুরু হল । গৌরকিশোর ঘোষ শুরু করলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর লিভস অব গ্রাস দিয়ে । ত্রিদিব জীবনানন্দে ইয়েটস, বাংলা কবিতায় সনেটের আঙ্গিক, ছোটগল্পের জন্ম ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলল । অনিল-করুণা রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকায় ফরাসি প্রভাব নিয়ে তর্ক জুড়লো । গৌরকিশোর ঘোষ আমাদের নাটকে 'থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড'-এর কথা তুললেন । আমি কারোর পক্ষই সমর্থন করছিলুম না । একজন কোনো কথা বললেই, আমি শুধু আলুর দমের প্রসংশা করছিলুম । কী দারুন স্বাদ, এত বড়-বড় কেটেও কত নরম, ভেজে করে না সিদ্ধ করে করে, জ্যোতি না চন্দ্রমুখি, রাধাবল্লভির সঙ্গে রাজযোটক কম্বিনেশান ইত্যাদি বলে যাচ্ছিলুম । সাহিত্য নিয়ে একটি কথাও নয় । রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাওয়াবেন শুনে আমি তর্কটার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিলুম ।


গৌরকিশোর ঘোষ, আমার দিকে তাকালেন , মিটিমিটি হাসি সহযোগে বললেন, ও, বুঝেছি, রূপদর্শীকে গুলগল্পের টেক্কা দিচ্ছ ! গৌরকিশোর ঘোষ রূপদর্শী ছদ্মনামে লিখতেন আর তাঁর সেই লেখাগুলোকে বলতেন গুলগল্প ।


আমি বললুম, হ্যাঁ দাদা, আলু জিনিসটা আমাদের দেশের নয় । আমাদের দেশে আসেওনি বেশিদিন হল । এই কন্দমূলটি পোর্তুগিজরা প্রথম জাহাঙ্গিরের দরবারে উপহার দিয়েছিল । স্পেন যখন ইনকাদের হারিয়ে তাদের দেশটাকে দখল করল তখন তারা লাল আলু নিয়ে গেল ইউরোপে । ইউরোপ থেকে লাল আলু এলো আমাদের দেশে । পর্তুগিজরা পেরু বলিভিয়া থেকে শাদা আলুর প্রচলন করেছিল উপনিবেশগুলোয় । আমাদের দেশে ওয়ারেন হেস্টিংস আলুচাষের ব্যবস্হা করেন । প্রথমে দেহরাদুনে চাষ হতো ; তাই তাকে বলি নইনিতাল আলু ; সেই আলুরই জাতভাই হল চন্দ্রমুখি ।


গৌরকিশোর ঘোষ পিঠ চাপড়ে বললেন, 'মক্কেল দেখছি ব্রিফ তৈরি করেই কেস লড়তে এসেছে । ঠিক আছে, পুরোদস্তুর নেমন্তন্ন রইল, পরের বার ফুল কোর্স লাঞ্চ খাওয়াবো ।'
আমার আর যাওয়া হয়নি । পঁয়ত্রিশ মাস ধরে কেস লড়তেই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল । 



নিজের সঙ্গে নিজে - পিয়াস মজিদ

কবিতাজীবনী-২
পিয়াস মজিদ


সৌন্দর্যসমস্ত এবং কুৎসিতের মাঝে সমভাবে ক্রিয়শীল অলঙ্কারশাস্ত্র; এর জারকরসেই সবকিছু প্রাণ পায়। বহতা সমুদ্রের গভীরে আছে অলঙ্কারজ্ঞান, সুউঁচু পর্বতের শিরদাড়াঁয় অলঙ্কারজিজ্ঞাসা জাজ্বল্য, শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যও অলঙ্কারবহুল। নিবিড় নীলিমা, সীতার পাতাল ইত্যাকার সবাই এক গূঢ় অলঙ্কারের নির্মাণমাত্র। আমার ভাবনায় নভোম-লের যাবতীয় সৃষ্টির অমোঘ সূত্র অলঙ্কারশাস্ত্র। কবিতা যদি প্রাচীন কলা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তার অলঙ্কারও প্রাচীনতম। অলঙ্কারের পরিস্রুতিতে কবিতার শরীরকাঠামো এবং আত্মা উভয়ই নির্মিত হয়। প্রাচীনকালে প্রকৃতির সঙ্গে কবি তথা মানুষের সম্পৃক্ততা এত ব্যাপকমাত্রার ছিল যে কাব্যালঙ্কারেও তার ছাপ দেখতে পাই। বিশেষত কৌম সমাজে কবিতা-পাঠের যে সংস্কৃতি তাতে জনমানুষের সঙ্গে যোগাযোগযোগ্য পদ্ধতিতে কবিতার সাজসজ্জার প্রচলন স্বাভাবিক। ধ্বনিবাহুল্যের কথাও এ প্রসঙ্গে প্রধানত উল্লেখ্য। আর চিত্রকল্প। সে কিভাবে কবিতার অন্তর্বয়ব ও বহির্দেশ তৈরি করে? বস্তুভিত্তির সঙ্গে দূরকল্পনার সংযোগ এমন সব চিত্রমালাকে দৃষ্টিসম্ভব করে তোলে যা একভাবে হয়তো খুব স্বাভাবিক, অন্যভাবে হয়তো অভাবিতপূর্ণ। এর আলিঙ্গন ও প্রহারে কবিতার প্রকৃত মুক্তি শুরু হতে থাকে। বাক্যের বন্ধন থেকে তার যাত্রা হয় অপার রহস্যালোকে। যে রহস্যই কবি এবং কবিতাপাঠকের অন্বিষ্ট। চিত্রকল্পের মৌলকাজ মনে হয় এমনই।
আমার নিজের কবিতার সূত্রে বলতে পারি যে কাব্যভাষাকে তার খটখটে, রুঠা ও নীরস অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে নেয় চিত্রকল্প। লাবণ্যের আদিখনি ওর কাছেই। সে ডাকে। কিন্তু আমার কবিতা কি তার ডাকে যথাযথ সাড়া দিতে পারে? কারণ কবিতায় বলার কথা প্রায়শই এত ক্লিশে হয় যে চিত্রকল্পের অনন্যতা বহনে সে হয় অক্ষম। আর তখনই জন্ম নেয় রাশি রাশি অকবিতার। তাই আমার কবিতার উদ্দিষ্ট কথাকে অর্থের সীমাবদ্ধ ঘেরাটোপ হতে ছিন্ন করে চিত্রকল্পের দূরগামিতার সাথে তার সংহতি প্রতিষ্ঠা। তবে সাথে সাথে এও মনে করি যে সংবেদন-প্রধান কবিতাও যেমন দূর্বল চিত্রকল্পের জন্যে মৃতবৃৎ মনে হয় তেমনি অনেক সময় চরম বক্তব্যবহুল কবিতাতেও প্রকৃত চিত্রকল্পের বিভা তাকে উত্তীর্ণ কবিতা হিসেবে প্রতিভাত করে। তাই চিত্রকল্পের ধরন তাৎপর্যবাহী। সামান্য একটি চিত্রকল্পের নির্মাণে ভূমিকা রাখে ভৌগোলিক বাস্তবতা, সমাজ-দেশগত অভিজ্ঞান, সময়ের তাপ ও শৈত্য ইত্যাদি অজস্র প্রপঞ্চ। কবিতার চিত্রকল্প অলৌকিক নয়, লৌকিক। কবির অশ্রু, রক্ত, প্রলাপ, হাহাকার, শক্তি, ক্ষয়, শান্তি ও নৈরাজ্য যেমন চিত্রকল্পের গাঠনিক উপাদান তেমনি চতুপার্শ্বের পঞ্চভূত, যাবতীয় রৌদ্র ও মেঘ, জনতা ও নির্জন সব-ই চিত্রকল্পের উদ্গাতা।
কবিতায় এমন এক চিত্রকল্পের সন্ধান করি যা স্বাভাবিক এবং একই সঙ্গে অদৃষ্টপূর্ব। যাতে মানবিক লিপ্ততার সাথে আছে অতিপ্রকৃতিক উদ্ভাবনা। কোন এক শক্তির পুরোহিত কাজ করে প্রত্যেক কবির অন্তরে; নিরন্তর। চিত্রকল্প সেই ঘুমন্ত পুরোহিতকে জাগায়। সকল ব্যাকরণ ফুরিয়ে গেলে সে পুরোহিত জ্বালিয়ে দেয় ভৌততম রসের ধারা।
এভাবে চিত্রকল্প, এভাবে কবিতা।

সেই আদিম যুগে - মনোরঞ্জন বর্মন

উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগের স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষ
মনোরঞ্জন বর্মন

(প্রথম অংশ)

সৠষ্ঠির প্রতিটি বস্তু ধ্বংসে অবলুপ্তি-একথা সবারই বিশ্বাসযোগ্য।আমাদের ধরা একটি গ্রহ।আমরা এর সৠষ্ঠির ইতিহাস দেখলে দেখতে পাই কি ভাবে এর তৈরি হয়েছে।সেই পাঁচশ কোটি বছর আগের গোলাকার অগ্নি পিন্ড আজ সবুজের সমারোহ।প্রতিটি প্রাণী-উদ্ভিদ আজ তার বুকে শান্তিতে বিরাজ মান।হয়তো পাঁচশ কোটি বছর আগে তাদের কথা ভাবাই যেত না।তবুও আমরা দেখছি এই ধাত্রির বুকে কত প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে,আর তারা কালের নিয়মে তাদের ছাপ রেখে ধাত্রির বুক থেকে বিদায় নিয়েছে।তাই আমাদের বিশ্ব একদিন যে ধ্বংস হবে এই কথা যথা যথ বিশ্বাস যোগ্য।যদিও তার ঠিক ঠিকানা সঠিক ভাবে জানা নেই বা তার জন্য কোন সঠিক বিচা'য আজো অজানা।বিজ্ঞানিরা তাই আজো সক্রিয় এই বিশ্বের প্রতিটি মুহূর্তে কি হতে চলেছে বা ভবিষ্যতে কি হতে পারে।

22 ডিসেম্বর বিশ্বের শেষ দিন-এটা আমারা শুনেছি।দেখেছি নানান পত্র পত্রিকায় ও স্বয়ং টেলিভিশনে।বিজ্ঞানের কথায় এই দিনটিতে মহাকাশ থেকে একটি নক্ষত্র এসে আমাদের গ্রহকে আঘাত করবে।যার ফলে আমাদের গ্রহ ধ্বংস হবে বা তার গঠন বিকৃত হবে।  ফলে বিশ্বের প্রতিটি প্রাণী আর বাঁচতে পারবে না।তাই ধ্বংস অবশ্যই। এই দিনটি যদি বিশ্বের শেষ দিন হয় তবে আমরা তার শেষ জেনারেশন হিসাবে আমাদের কিছু কত'ব্য আছে।আমি আমার প্রকৃতি মাকে হারানোর বেদনাকে মোছার জন্য প্রকৃতিকে আরো গভীর ভাবে ভালো বাসবো।শেষ নিঃশ্বাস ত্যগ করার আগ পয'ন্ত আমাদের পরিপারশিক প্রতিটি প্রাণী ও মানুষের সঙ্গে সৎ ব্যবহার ও সৎ নিষ্ঠা আচার করবো।তাদের ভালোবাসবো আর ভালোবাসার গভীর আল্লাদে নিজেকে বিলয়ে দেব।যাতে 22 ডিসেম্বরে কথা আমার মনের মধ্যে গ্রন্থিত না থাকে।তাছাড়া আমার অনেক প্রিয় লেখক লেখিকার কিছু বই যেগুলি আমার এখনো পড়া হয়নি,সেগুলো পড়বো।আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সকলের সঙ্গে আলাপ করব।তাদের মধ্যে দিয়ে যাবো আমার ভালোবাসার শেষ সত্ত্বা।যা হয়তো উক্ত দিন শেষে আর থাকবে না।

মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীনতম নিদর্শন।সম্ভবত এই ক্যালেন্ডারই বিশ্বের প্রাচীনতম ক্যালেন্ডার।সেই সভ্যতার মানুষ যে ভাবে তাদের ভবিষ্যৎ বাণী পাথরের মধ্যে খোদিত রেখে গেছে তা বিস্ময়কর।তারা তাদের ক্যালেন্ডারের এই দিনটি কেই যে বিশ্বের শেষ দিন বলেছে তা খুবই অবাক।তাদের বক্তব্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের আলোচনা কিছুটা হলেও মিল আছে।তাইমায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার কে কিছুতেই অবিশ্বাস করা যায় নাএই ক্যালেন্ডারেবলা আছে যে এই দিনটি তে বিশ্বের বাইরে থেকে একটি ধাক্কায় বিশ্ব ধ্বংসহবে।তাই তাদের কথা কাল্পনিক হলেও আজ বিজ্ঞান কল্পনায় তা কিছুটা বাস্তব।

যদি এই দিন বিশ্ব ধ্বংস হয় আর আমি বেঁচে থাকি তবে তা হবে আমার সব থেকে আনন্দের দিন।আমি বিশ্ব কে আবার নতুন করে গড়ে তুলব।ধাত্রিকে গড়ে তুলব সবুজে।যাতে এই বিশ্বে আর সাম্রাজ্যবাদ না গড়ে ওঠে ও তার জন্য বিশ্ব আবার কিছুটা বিঘ্নিত না হয় তার জন্য সুরহ কিছু কার্য করে যাবো।বিশ্বকে আরএকমেরু কেন্দীক হতে দেব না।অনু শক্তির কেরামতিতে এক দেশকে অন্য দেশের উপরশ্বাসিত হতে দেব না।আমি ভবিষ্যৎ বিশ্বকে গড়ে তুলব সাম্য-মৈত্রের বেড়াজালে,যেখানে থাকবে ভাত্রি-ভাত্রিত্বর সমন্ধ।আমার ভবিষ্যৎ বিশ্ব হবেশান্তি,সুখ,স্বস্নেহ,ভালোবাসার গভীর বন্ধনে।

যেদিন সেই দিন আসবে তার আগ মুহূর্ত পয'ন্ত আমি থাকবো আমার পরিবার,বন্ধু-বান্ধব ও পারাপরশি সঙ্গে।তাদের বোঝাবো এই বিশ্ব পত্তনেরখেয়ালে ধ্বংস আবশ্যক।তাই আমাদের আপছোস করার কিছুই নেই।আমাদের যেমন জন্মহয়েছে মরতে হবে।সুতরাং এর জন্য কোন দুঃখের কারণ নেই।আমরা সব সময় আনন্দেরগান গাইবো।যতক্ষণ না বিশ্ব ধ্বংস হয়।

আর আমি যদি সুপার ম্যান হতাম তবে আমি ধাত্রিকে ধ্বংস হতে দিতাম না।আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়ে মহাকাশ থেকে আসা নক্ষত্রটাকে দুরেসরিয়ে দিতাম বা তাকে ধ্বংস করে দিতাম।বিশ্বের প্রতিটি প্রানীতে আমিআত্মরক্ষার কাজে নিয়গ হতাম।তাদের সুখকে ছিনিয়ে নিতে দিতাম না।বিশ্বধ্বংসের হাত থেকে তাদের রক্ষা করে আমি আমার সব থেকে পূর্ণএর কাজ বলে মনে করতাম।

এই সংখ্যা কোনো মতে আজগুপি নয়।চারি দিকে 22শে ডিসেম্বরেরসমালোচনাই সম্পাদক কে উদ্বিপনা করেছে এই সংখ্যা প্রকাশ করতে।ধ্বংসের আগেআমাদের লেখনি সমালোচনা করাই সম্পাদকের মূল কাজ।সুতরাং আমি সম্পাদকে শাপ-শাপান্তর করতে চাই না।

যদি ধ্বংসের আগ মুহূতে মাটির তলায় একটু স্থান পাই তাহবে খুবই সুখের উষ্ণ ছোঁয়া।বাঁচার জন্য এই টুকু চেষ্টা করে যাবো।সঙ্গে রাখব আমার প্রিয়লেখক লেখিকার কিছু বই।তার সঙ্গে আমার বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ওরামায়ন,মহাভারত।সেই সময় আমার ভাবনা গুলোকে বাস্তব করার জন্য সাদা পাতা ও কলম অবশ্যক।ধারাপাতের প্রতিটি পাতার মত সূক্ষ ভাবে লিখে যাবো সব কথা। স্রষ্টা আমাদের তৈরি করেছেন।তার আদাতে যদি আজ আমরা বিশ্বকেদেখতে পাই তবে স্রষ্টা কে পার্থনা করে যাই তিনি যেন তার শক্তির দ্বারা এই ধ্বংসের লীলাকে সমারহ করেন।আমরা যেন তার প্রতি অসন্তোষ না হয়ে পরি।তিনিই সর্ব শক্তিমান,বীরবল্লব এই কথা যেন আমাদের মন থেকে মুছে না যায়।



স্রষ্ঠাকে সাসপেন্ড করব - ঊষাসী ভট্টাচার্য

আমি স্রষ্ঠাকে সাসপেন্ড করব
ঊষাসী ভট্টাচার্য


পৃথিবীর সৃষ্টির প্রাক মুহূর্তে স্রষ্ঠা তখন আপেল হাতে ড্যাব ড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছেন তার পাশে বসে থাকা জিরো ফিগার সুন্দরীটির দিকে । তখনই বায়লজ্যিক্যাল এফেক্টের ভয়াভয় প্রকোপে ঘটে যায় সেই চরম বিভীষিকা । জন্ম হলো পৃথিবীর ।

তবে এবার প্রশ্ন হলো স্রষ্ঠা কে ? কেমন দেখতে , কোথায় থাকেন , কী খান , কী করেন, কেমনভাবে করেন ইত্যাদি ইত্যাদি । বাংলায় স্রষ্ঠা শব্দটি বিভিন্ন শব্দার্থে প্রচলিত । বহুল প্রচলিত দুটি শব্দার্থ হলো ভগবান ও ঈশ্বর । স্রষ্ঠা শব্দের অর্থ সৃষ্টিকর্তা । এবার অনুসন্ধান করা যাক, ভগবান এবং ঈশ্বর শব্দের অর্থ ।

ভগবান = ঐশ্বর্যময়

ঈশ্বর = ঐশ্বর্যবিশিষ্ট্য স্বগুণ ব্রম্ভ বা সৃষ্টি-স্থিতির প্রলয় কর্তা ।

অর্থাৎ পাতি বাংলায় আসল কথা হলো , পয়সাওলা ধান্দাবাজ সমস্ত গোলমালের উৎস লোভী একটি জিনিস হলেন ঈশ্বর বা স্রষ্ঠা ।

মায়া ক্যালেন্ডার অনুসারে ২০১২তে পৃথিবীর ইতি । বাকি লুকোবে কোথায় পৃথিবীর স্মৃতি লুকোবে কোথায় ... কেউ জানে না , আমিও জানি না স্রষ্ঠার সৃষ্টিকর্মের কুৎসা লিখতে বসে পৃথিবীর গল্প , এখানেই খতম হবে কি না । বা স্রষ্টা এসে কান মুলে আমার থোতা মুখ ভোঁতা করবে কী না ? তবে যদি স্রষ্ঠা সামনা সামনি এলে কেসটা পুরো জমে যাবে । ছোটবেলায় মনে আছে স্কুলে একটি প্রোজেক্ট করতে দেওয়া হয়েছিল । খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি অত্যন্ত জঘন্য প্রজেক্ট তৈরী করি । তারফলে পেতে হয় গুরুতর শাস্তি । এবার যদি মনে করি পৃথিবী একটি আস্ত প্রজেক্ট এবং এটি তৈরী করেছেন স্রষ্ঠা , তাহলে অন্তত দশবার নি-ডাউন আর একশবার কান ধরে ওঠবোস স্রষ্ঠাকে করানোই যায় । রসাতলে যাওয়া পৃথিবীর অবস্থা আজ পচা ডিমের মতো । যেখানেই ফেলা হোক পচা গন্ধ বেরোবেই । আর্থিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক সব দিকেই পৃথিবীর অবস্থা খসে পড়া দেওয়ালের সিমেন্ট । রং গেছে চটে, ভিতরের পরিতক্ত সিমেন্টের নগ্নতা দৃশ্যমান । ছোটবেলায় শুনেছিলাম , অন্যায় করলে ভগবান নাকি পাপ দেন । আচ্ছা, আজ ভগবানের পাপের বিচার করবে কে ! মায়ের কোলে ছেলে নেই , সদ্যজাত মা নেই, অসুখের চিকিৎসা নেই, হাসপাতালে ডাক্তার নেই, চাকরি করলে মাইনে নেই , রাজনীতিতে নীতি নেই – বিশাল এক নৈরাজ্যের নেই রাজ্যেতে আমরা চরকি খেয়ে মরছি । শুনেছিলাম ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য । সেই কথাটিই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো , আদপে ভগবান পৃথিবীর জন্য কিছুই করেননি । আর ব্যাটা ভগবান লাস্ট দিন স্যালেন্ডার করে বলছেন, “সরি বস্‌, তোমাদের কিছু দিতে পারলাম না তাই ধ্বংস দিয়ে আর কংস জন্মের হাত থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে দিলাম । ”

থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড় নিয়মের জাঁতাকলে ভাগ্য তথা স্রষ্ঠার হাতে আমরা সবাই পুতুল হয়েই বাঁচি। ২১ তারিখ পৃথিবীর ধ্বংসের আগে আমি অন্তত একবার স্রষ্ঠার সাসপেনশন অর্ডারটা জারি করে দিয়ে যেতে চাই । এবার, আমি মালিক , স্রষ্ঠা আমার অফিসে নিম্নপদস্ত কর্মচারী । বরখাস্তের চিঠি দিয়ে বড় বড় করে লিখলাম –

তুমি ব্যাটা বুড়ো ভাম
তোমায় আমি ছুটি দিলাম
আর করতে হবে না পৃথিবী সামলানোর জঘন্য কাম ।
ব্যাস ! তাড়ানোর এই জঘন্য কবিতা জঘন্য স্রষ্ঠার জন্য পাঠিয়ে দিলাম ক্ষেপুর লেটার বক্সে । “ভগবান বুকে” “বিদ্রোহী ভৃগু”-এর মতো ‘পদচিহ্ন’ আঁকতে না পারলেও সাসপেনশন অর্ডার মুকুবে তাকে শো অফ করে দিলাম যাতে আমিও গর্বিত চিত্তে ক্ষ্যাপামী করতে করতে বলতে পারি, “সবার ওপরে মানুষ সত্য স্রষ্ঠা আছে বা নাই ” ।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন !
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

“আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক
আমি চাইনা হতে নব বঙ্গে নবযুগের চালক”

আমি যে বিষয়টি নিয়ে শব্দ সাজাবো তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মান্তর’ কবিতার এই প্রথম দুটি পঙক্তি সুপ্রযুক্ত এমন কথা না বললেও, কোথাওনা কোথাও এই পঙক্তি দুটির ভাবগত প্রাসঙ্গিকতা খুজতে চেষ্টা করেছি । মারণ বিজ্ঞানের ধ্বংশকামী অনুশীলন ও আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বংসমুখী শক্তির বিরুদ্ধে মানব মনের অনন্ত মুক্তির সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ধ্বংসকামী শক্তি কখনোই কাম্য ছিলনা তাঁর কাছে ।

একথা সত্য, জীব ও জড় জগতের তাবৎ সৃষ্টিই তার নিজের মধ্যে নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করে চলে। কিন্তু তা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সূত্র মেনে । সেই সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের সৃষ্টিও ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর হতে পারে মানব ইতিহাসে তার অজস্র নজির রয়েছে । বিজ্ঞানী ওপেনহিমার কি জানতেননা তাঁর আবিষ্কৃত এটম বোমা হিরোশিমা, নাগাসাকি শহর দুটিকে ধ্বংস করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করবে, মানব সমাজের কি বিপর্যয় ঘটাবে ! তবুও অপেনহিমার ভগবৎ গীতার উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে সদম্ভে বলেছিলান “মনে হচ্ছে আমিই মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা” ।

আধুনিক বিজ্ঞান নাকি মানুষের প্রতিরূপ ‘ক্লোন’ সৃষ্টি করতে সক্ষম । ১৯৬০এর দশক থেকে এরকম প্রয়াস শুরু হয়েছিল । নোবেল জয়ী জসুয়া লিডারবার্গ প্রথম ১৯৬৬তে তাঁর একটি লেখায় ‘ক্লোন’ সৃষ্টির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন । জন্ম – মৃত্যুর চিরন্তন সূত্রকে অস্বীকার করে মানুষের প্রতিরূপ সৃষ্টি হলে কি ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক চলে । অবশেষে ২০০১এ রাষ্ট্রসঙ্ঘ সব ধরণের মানব প্রতিরূপ বা ‘হিউম্যান ক্লোনিং’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানায় তার সদস্য দেশগুলির কাছে । অস্ট্রেলিয়া , কানাডা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি , বৃটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানান প্রদেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে । আর মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতো ‘খোদার ওপর খোদকারি’র এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে ফতোয়াই জারি করেছিল । জন্ম-মৃত্যুর জাগতিক সূত্রকে জীবন সৃষ্টির প্রয়াস কি বিপর্যয়কর হতে পারে এমনকি তার স্রষ্টার কাছেও তা আজ থেকে দুশ’ বছর আগেই জেনেছিলাম মেরি শেলীর উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ । হ্যাঁ বাংলা উচ্চারণ এটাই হওয়া উচিত (Frankenstein) ।

‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ -- এই নামটা প্রায় দুশ’ বছর যাবত প্রায় প্রবাদের মত এক ভয়ংকর কল্প-বস্তু হয়ে আছে যে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনি । আমরা প্রবাদের মত বলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ সৃষ্টি করেছ, সে তোমাকেও রেয়াত করবেনা’ । আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে ভয়াল ভয়ংকর ধ্বংসকামী এক বিকট মূর্তি । না , সেই বিকট মূর্তি কিন্তু ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নয় , তার সৃষ্টিকর্তার নাম ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন । সেই নামেই মেরি শেলী তাঁর এই সাড়া জাগানো উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন অর মডার্ন প্রমিথিউস’ । বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে মানুষের প্রতিরূপ - সেই ভয়াল সৃষ্টির জনক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন কে কেন লেখিকা গ্রীক পুরানের বীর নায়ক প্রমিথিউস এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন জানিনা । গ্রীক পুরানের কাহিনি , প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে । মানব অস্তিত্বের অগ্রদূত হিসাবেই প্রমিথিউস পূজ্য । দেবলোক থেকে আগুন চুরি করার জন্য প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েছিলেন সম্রাট জিউ,একটা প্রস্তরখন্ডের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন তার দেহাংশ, শকুনের ভক্ষ্য রূপে । গ্রীকবীর হারকিউলিস অমরত্ব অর্জন করা প্রমিথিউসকে মুক্ত করেছিলেন । লেখিকা মেরি শেলি তাঁর উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিনকে আধুনিক প্রমিথিউস মনে করেছিলেন, হয়তোবা রীতিবিরুদ্ধ বা নিষিদ্ধ বিজ্ঞান সাধনার জন্য, যেমন নরলোকে নিষিদ্ধ আগুন প্রমিথিউস চুরি করেছিলেন দেবলোক থেক্‌ যার দন্ডও তিনি ভোগ করেছিলেন । প্রমিথিউস অমরত্ব অর্জন করেছিলেন আর মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ নামটি প্রায় দুশ বছর ধরে অমর হয়ে আছে প্রবাদের মত, হয়তো থাকবেও আরো অনেকদিন ।

মেরি শেলি তার এই প্রবাদ প্রতীম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে - যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর , শেষ করেছিলেন ২১ বছর বয়সে, অর্থাৎ তিনবছর লেগেছিল উপন্যাসটি লিখতে । লর্ড বায়রন, পি বি শেলী, জন কীটস’এর সমসাময়িক মেরি শেলী ইংরাজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের লেখিকা । আমাদের দেশে তখন গদ্য সাহিত্যের জন্মই হয়নি । সবেমাত্র শ্রীরামপুর মিশনারীরা রামরামবসু প্রমুখদের দিয়ে কিছু পন্ডিতি বাংলা লেখা শুরু করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ কৌমুদি’ ইত্যাদি সংবাদপত্র । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ছদ্মনামে লন্ডন থেকে । ১৮২৩এ ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ২য় সংস্করণ থেকে লেখিকা মেরি শেলীর নাম জানা যায় । উপন্যাসটিকে বলা হয় একাধারে গথিক উপন্যাস এবং বিজ্ঞান কাহিনি বা সায়ান্স ফিকশন’, আবার রোমাঞ্চ কাহিনি বা ‘হরর স্টোরি’ ও বটে । বস্তুত মেরি শেলীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ বিশ্বের প্রথম সার্থক সায়ান্স ফিকশন রূপেই খ্যাত । এরপরে যুগে যুগে অনেক রোমাঞ্চ কাহিনি লেখা হয়েছে সেগুলির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে- কিন্তু কোনটাই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর মত প্রবাদ-প্রতীম হয়ে ওঠেনি ।

উপন্যাসটি আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা । উত্তর মেরু অভিযানকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ওয়ালটন তার বোন মার্গারেটকে চিঠিতে তার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, এভাবেই শুরু হয়েছে কাহিনি । ক্যাপ্টেন ওয়ালটন ছিলেন এক ব্যর্থ লেখক , বাসনা ছিল উত্তর মেরু অভিযানের মধ্যদিয়ে জানবেন বিজ্ঞানের রহস্য আর তা দিয়ে তিনিও বিখ্যাত হয়ে যাবেন ।

ওয়ালটনের জাহাজের কর্মীরা এক অতিকায় মানবকে একটি কুকুরকে নির্দয় ভাবে হত্যা করতে দেখেন , কয়েক ঘন্টা পরে তারা এক বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায় লোককে উদ্ধার করে , তিনিই বিজ্ঞানী ভিকটর ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ঐ অতিমানবের সৃষ্টিকর্তা । সুস্থ হবার পর ভিক্টর তার কাহিনী বলতে থাকেন । বলেন কিভাবে বিজ্ঞানের উচ্চাশা ও রীতিবিরুদ্ধ চর্চা যার ফলশ্রুতি এক অতিমানবের সৃষ্টি এবং সে তার জীবনে কি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল, সেই রোমাঞ্চকর কথা ।

প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের প্রথাগত বিজ্ঞানসম্মত সূত্রগুলি বোধয় ভিক্টরকে ক্লান্ত করেছিল । ভিক্টর আয়ত্ত করেছিলেন মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করার বিদ্যা । ল্যাবরেটরিতে মৃত মানুষের ও পশুর দেহাবশেষ দিয়ে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । ভিক্টর চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি হবে সুন্দর , কিন্তু হ’ল ৮ফুট দৈর্ঘের , হলুদবর্ণ চোখের এক ভয়াল সৃষ্টি । ভিক্টর তার নিজের সৃষ্টিকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন । সৃষ্টি করলেন বটে কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কায়দা তার আয়ত্তে ছিলনা । সে সৃষ্টির পরমুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আতঙ্কিত ভিক্টরকে প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে চলে , ভিক্টর গৃহত্যাগ করেন । মাস চারেক পরে ফিসে এসে দেখেন তার ছোটভাই উইলিয়াম খুণ হয়েছেন। উইলিয়ামের গলার লকেটটি পাওয়া যায় তার দিদিমা জাষ্টিনের পকেটে , দিদিমার ফাঁসি হয় । ভিক্টর ঘটনাস্থলে তার সৃষ্ট অতমানবটিকে দেখতে পান এবং নিশ্চিত হন যে সেইই প্রতিশোধ স্পৃহায় এই হত্যা ঘটিয়েছে, উইলিয়ামের লকেটটি তার দিদিমার পকেটে চালান করে তাঁরও মৃত্যুর কারণ হয়েছে । ভিকটর বিবাহ করেন তাঁর প্রেমিক এলিজাবেথকে , সেইদিনই এলিজাবের খুন হয়ে যান, ভিকটরের সেই ভয়াল সৃষ্টির হাতে । নির্মম প্রতিশোধ স্পৃহায় ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি একে একে হত্যা করে তার সৃষ্টি কর্তার ভাই , উইলিয়াম, বন্ধু ক্লেভারেল, ও প্রেমিকা এলিজাবেথকে ।

ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে অবশেষে দাবী করে ভিকটর যেন তার মতই তার এক প্রেমিকা সঙ্গি সৃষ্টি করে দেন , কেননা তারও জৈবিক সুখের অধিকার আছে । তাহলে সে তার সঙ্গিকে নিয়ে জনমানব হীন কোন স্থানে চলে যাবে । পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভিক্টর সম্মত হয় । কাজটা করার জন্য চলে যায় ইংল্যান্ডে । সেখানেও হাজির হয় দানবটি , সে ভিক্টরের প্রতিমুহুর্তের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলে । ভিক্টর সেই দানবের প্রেমিকা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন । কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভিক্টর উপলব্ধি করেন তাঁর এই দ্বিতীয় সৃষ্টি আরো কি ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্ট করতে পারে । যদি তারা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হন তবে হয়তোবা এক ভয়াল ভয়ঙ্কর অতিমানবের জাতি সৃষ্টি হয়ে যাবে যা সমগ্র মানব সভ্যতারই সংকট ডেকে আনবে । ভিক্টর তার অসমাপ্ত সৃষ্টিটি ধ্বংস করে দেন । ভিক্টর পালিয়ে যান । কিন্তু যাবেন কোথায় ? তারই সৃষ্ট দানব প্রতি মুহুর্তে তার পিছু পিছু থাকছে । অবশেষে ক্যাপ্টেন ওয়ালটন আন্টারটিকায় বিধ্বস্ত , মৃতপ্রায় ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনকে উদ্ধার করেন । উপন্যাসের শেষটা বড় করুণ – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের মৃত্যু হয়েছে । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন ভিকটরের সৃষ্ট সেই দানব তার সৃষ্টিকর্তার মৃত দেহের সামনে শোকার্ত অনুতপ্ত । নিজেই নিজেকে ধ্বংশ করতে উদ্যত, কারণ সে বুঝেছিল তার সৃষ্টিকর্তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অস্তিত্বও অর্থহীন । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন আন্টার্টিকার বরফের স্তুপের মধ্যে বিলিন হয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে ।

একটি সমাজ ছাড়া সৃষ্টি - দুশ’ বছর ধরে তাবৎ বিশ্বের মানুষের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে । চচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ের মধ্যদিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে । রোমাঞ্চকর কাহিনি বা হরর ফিকশন বিশ্বসাহিত্যে কম নেই । ব্রাম স্ট্রোকারের ‘ড্রাকুলা’ , কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ বাস্কার ভিল’ , ভ্যাম্পায়ার’ হিচককের ‘সাইকো’ এই রকম অজস্র রোমহর্ষক চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি, কিন্তু তার কোনটাই ফ্রাঙ্কেনস্টিনের মত এমন স্থায়ী প্রভাব ফেলেনি । মজার কথা কাহিনির নাট্যায়ন বা চলচ্চিত্রায়ন দেখে যতটা আতঙ্কিত হই উপন্যাসটি পড়লে ততটা হইনা । কারণ চলচ্ছিত্রে নানা ডালপালা যুক্ত হয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে আতঙ্কের দৃশ্যায়ন করা হয় । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রবাদ প্রতীম হয়ে যাওয়ার সেটাই মুখ্য কারণ ।

আমাদের জানা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ কি আদৌ ‘ধ্বংশকামী’ অতিমানবীয় সৃষ্টি ছিল ? উত্তর হ্যাঁ এবং নাও বটে । সেতো তার চারপাশের সমাজ সংসারকে ধ্বংশ করতে চায়নি । সেও এই সমাজেই বাস করতে চেয়েছিল । এমনকি সে বলেছিল তার সৃষ্টিকর্তাকে তারই মত এক সঙ্গিকে সৃষ্টি করতে যাকে নিয়ে সে মানব বহির্ভূত কোন স্থানে চলে যাবে । একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তার ছিল, তা ছিল তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি – তাকে সকলে ভয় পাবে তার অতিমানবীয় ভয়াল ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে – এমন সমাজ ছাড়া সৃষ্টির জন্য । তার জিজ্ঞাসা ছিল ভিক্টর যদি তাকে সৃষ্টিই করলেন তাহলে সে জাগতিক সুখ থেকে বঞ্চিত হল কেন ?

কাহিনি থেকে জেনে যাই, ভয়াল অতিমানবটির স্রষ্টা ভিক্টর ছেলেবেলা থেকেই রীতি বিরুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় আকৃষ্ট ছিল , অশ্রদ্ধা ছিল প্রচলিত মূল্যবোধগুলির প্রতি । তার সমাজ ছাড়া সৃষ্টিটিরও তাই সমাজের প্রতি, তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একটা প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিয়েছিল তার সৃষ্টির পরমুহুর্ত থেকেই । তবুও সে তার সৃষ্টিকর্তার মৃতদেহের সামনে এসে শোকানুতপ্ত হয়েছিল এবং নিজেকেই ধ্বংশ করেছিল । এই মনস্তাত্বিক প্রশ্নে কোন কোন সমালোচক উপন্যাসটির লেখিকা মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন । লেখিকা মেরি শেলী তার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাঁর মাকে হারান, তার চার বছর বয়সে পিতা গডউইন পুণর্বিবাহ করেন । সতেরো বছর বয়সে মেরি তার পিতৃবন্ধু বিবাহিত পার্শি শেলীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন । পরের দুবছর তাদের জীবনে নানান বিপর্যয় , ঋণগ্রস্ততা, শিশু সন্তানের মৃত্যু ইত্যাদির পর পার্শিকে বিবাহ করেন , তা্র ব্যক্তিজীবনে কিছুটা স্থিরতা আসে । লেখা শুরু করেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’, কিন্তু ছদ্মনামে । ১৯২৩এ স্বনামে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগে ১৮২২এ মেরির স্বামী পার্শি শেলির মৃত্যু হয় জলে ডুবে ।

এই অভূতপূর্ব সৃষ্টিতে মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার ছায়াপাত ঘটেছে কিনা তা আমার আলোচ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি, দুশ’বছর আগে, কি অসামান্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে মেরি শেলী তার প্রবাদপ্রতীম উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বকে বিজ্ঞানের অপব্যবহার সম্পর্কে সাভধান বার্তা দিয়েছিলেন । এই অনুষঙ্গেই এটম বোমার আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী ওপেন হিমারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম , কোথাও যেন ধ্বংশকামী ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ আর ওপেন হিমারের দম্ভোক্তি একাকার হয়ে যায় । ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ নিশ্চিত ভাবেই দুশ’ বছর আগের এক সাবধান বার্তা, যে প্রাকৃতিক ও জীবজতের দ্বান্দ্বিক সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের যে অনুশীলন তা অপবিজ্ঞান এবং সেই অপবিজ্ঞান সৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হীন কোন কিছুই মানব সভ্যতার পক্ষে শুভ হতে পারেনা, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনা । তাহলে কে সেই ভয়াল দানব ? আমাদের জানা মেরি শেলীর কল্প-চরিত্র অতিমানবটি নাকি তার উপন্যাসের নায়ক ব্যর্থ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন ?

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে - অশোক দেব

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে
অশোক দেব


বেনজির ভুট্টো তো দেখি আমার থেকে লম্বা! কেমন সংকোচ হচ্ছে। নচিকেতা পেছন থেকে এক ঠেলা দিতেই আমি গিয়ে পড়লাম তার বুকে। এ নচিকেতা কিন্তু জীবনমুখী না, এ হল মৃত্যুমুখী নচিকেতা। নিতান্ত বালক। কয়েকদিন থেকে শুনছি পৃথিবীর শেষ । ধ্বংস হয়ে যাবে ইংরাজি সিনেমার ঢঙে। মাত্র চালশে চলছে, কত ফস্টি বাকি, অনেক নস্টিও তো করা হল না। তাই চান্স পেলেই একমনে নচিকেতার ধ্যান করতে লাগলাম। দেবতারা নিশ্চয়ই ব্যস্ত। লবি করতে হলে এ ছেলেটাকে ধরলেই কাজ হবে বলে মনে হল। কী বাঘা বাঘা প্রশ্ন করে ছেলেটা! কে না জানে, বেশি যে প্রশ্ন করে সে আসলে ইমপরটেন্স চায়। এদের পটাতে সুবিধা। তাই হাঁটতে চলতে, উঠতে বসতে শুধু নচিকেতার ধ্যান। বৌ আমার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে মনে করে মদ ছেড়ে এখন গাঁজা ধরেছি। মনে মনে বলি, কাঁহা তুম, কাঁহা বেনজির!

শনি না মঙ্গলবার মনে নেই। সন্ধ্যাবেলা একটা ছেলে এসে কোত্থেকে সামনে দাঁড়াল। স্পাইক করা চুল দেখলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়, ‘অ্যাই তুই কেডা?’ বলতেই সে প্রশ্ন করল, ‘এ জগতের শেষ হলে কি সৃষ্টি শেষ হয়ে যাবে?’

- ভাই ভাই আমার অন্যায় হইয়া গেছে, তুমি...মানে আপনি নচিকেতা?

- হুম, বাট ইয়ু ক্যান কল মি নচি, ক্যান্ট ইয়ু?

নচি ফচি কাম নাই, আমি একটু হেই পার যাইতে চাই।

-কেন?

-না, মানে...

-আমি কি জানি না ভেবেছ?

শালা খালি প্রশ্ন করে কথা বলে। জানলে তো চুকেই গেল। নিয়ে চল। মনে মনে বলি। মুখে ঝোলাই পানসে হাসি।

- চন্দ্রপুর বাসস্টপ চেন না? সেখানে হেঁটে যেতে পারবে তো? কত অটো আছে না? জোড়সংখ্যার নম্বরের যেকোনও একটাতে উঠতে পারবে?

- পারব।

- ওকে। উঠে মনে মনে এই মন্ত্রটা বলতে পারবে না? বলেই কানে কানে একটা মন্ত্র ফুঁকে দিল।

চন্দ্রপুর বাসস্টপ থেকে ২১১২ নম্বরের অটোতে চেপে, মন্ত্র বলার সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে একটা ষাঁড় ডেকে উঠল। তারপর কিছু মনে নেই, দেখি আমি এখানে। সামনে বেনজির ভুট্টো, পেছনে নচিকেতা।

মায়া না কে জানি একটা ক্যালেন্ডার বানিয়েছে। তাতে পৃথিবীর এক্সপায়ারি ডেট ২১ ডিসেম্বর ২০১২। এটা জানতে পেরেই কচিকলাপাতাকাল থেকে ফেনাটিসাইজ করে আসা বেনজিরের সঙ্গে ডেটে যাবার বাসনায় নচিকেতাবন্দনা শেষ পর্যন্ত সাকসেস। কিন্তু টিউবলাইটের মত ফর্সা বেনজির দেখি আমার থেকে লম্বা।

নচির ধাক্কা খেয়ে আপাতত আমি তার বক্ষে। কী সুন্দর গন্ধ! এত ছিন্নভিন্ন হয়ে যে মারা গেছে কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। স্বর্গীয় পার্লারে সব ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে মনে হয়। একটা পাতলা চুল আমার কানের কাছে সুরসুরি দিতেই চকাম করে তার গালে দিলাম এক চুমু বসিয়ে। ইয়া খুদা কিতনা বদমাশ লেড়কা হায়... হিহি করে বলে উঠল বেনজির। লেড়কা, আমি লেড়কা... বেনু, আমার বেনু। কলার ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিল কে? কে আবার, নচিকেতা।

- বসের সঙ্গে দেখা করবে না? তার আগেই চকাম চকাম শুরু?

- কে বস? কেডা?

- ইয়ম ইয়ম, যেতে হবে না?

ইস, এলাকা যমের, তার সঙ্গে একটু দেখা না করলে চলে? গেলাম। আরে, একে দেখি সঞ্জয় দত্তের মত দেখতে। প্রণাম করলাম। অবাক কাণ্ড, তার চকচকে জুতোয় নিজের মুখ দেখলাম। অবিকল শাহেদ কাপুর।

- হুম... কবি? কবিতা লেখেন? যমরাজ আমাকে আপনি করে কথা বলছেন, অবাক... কবিতা লিখি তো ...

- উঁ

- বলুন তো, আমরা সব গর্বিত বাঞ্চোতের দল, কার কথা? ফরাসি কবি জোয়ান কিলদের লেখা পড়েছেন?

কুঁকুঁ করে একটা আওয়াজ বেরোল আমার কণ্ঠ হতে শুনতে পেলাম

- ও,বাঙ্গাল তো... আচ্ছা, অনন্ত খুচরোজ্জমান খোকার পাল্কিনামা পড়েছেন?

-কুঁকুঁ...

শালা আঁতেল মইরা যম হইছে দেখি। কবি টবি কিছু না, আঁতেলরা নিজের ছেলেকেও আপনি করে কথা বলে। আমি কী করি! পড়েছি আতান্তরে

- ছোঁরীয়েঁ নাঁআআআ... বলে আহ্লাদে বাঁচাল বেনজিরই। আমাকে যমের কবল থেকে ছাড়িয়ে স্লো মোশনে ছুটতে লাগল বেনু আমার বেনু। হিন্দু স্বর্গ, মুসলিম স্বর্গ, ইডেন চৌমুহনী, প্যারাডাইসের মোড় পেরিয়ে আমরা চলে এলাম লাভারস পয়েন্টে। সির একাধারে সিন্নি খাওয়াচ্ছে ফরহাদকে। মজনুভাইয়ের পাজামা সেলাই করছে লাইলিদি। আমাদের পাড়ার নুনুদি নিমাইদার প্রেমে আত্মহত্যা করেছিল, তাকে দেখলাম রাজেশ খান্নার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। এসব দেখছি আর বেনু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যায়া হুয়া? তার দিকে তাকাতেই চকচক করে উঠল গোলাপি ক্লিভেজ। তারপর আমরা দেশ পত্রিকার উপন্যাসের মত করলাম। সঙ্গে ইলাস্ট্রেসনের যত মুদ্রা আঁকা থাকে সব সব করলাম আমরা। কোথা দিয়ে কেটে গেল এতগুলি দিন। না ক্ষুধা না তৃষ্ণা। বেনজিরের মত মেয়ে হয় না, প্রধানমন্ত্রী, তা-ও শত্রুদেশের, একটুও দেমাক নেই। শরীরও টানটান জিংলাপোড়া সাপ। বহুজননের ক্লেশ সে পৃথিবীতেই ফেলে রেখে গেছে।

শুধু একজনকে দেখলেই সে সিঁটকে যায়। পাঠান ড্রেস পরা লোকটাকেই দেখলেই বোঝা যায়, সে আইএসআইয়ের হবে। বেনুর বর তামাক না জর্দা, সেই কি সুপারি দিয়ে পাঠালো? সেদিন আমরা একটা সানন্দামার্কা কাজ করছিলাম, দেখি সে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ছুটে গিয়ে কষালাম এক লাথি। সে আমাকে কী জানি কী করল, আমি সোজা পৃথিবীতে। চারদিক থকথকে কাদায় ভরে আছে। শনিগ্রহের ডিসকভারি চ্যানেল থেকে ছবি তুলতে এসেছে একটা টিম। একটা পোকাটাইপের লোক সিলেটি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলছে। ক্যামেরার দিকে কী একটা চকচকে জিনিস দেখিয়ে সে বলছে, ধ্বংসের আগে পৃথিবীর মানুষ কত সুন্দর অলঙ্কার বানাতে পারত। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম একটা নাকছাবি। চোদ্দতম অ্যানিভারসারিতে বৌকে এটা দিয়েছিলাম।

কাল পৃথিবী ধ্বংস হবে! - কল্পনা দাস



ও মা, কাল নাকি পৃথিবী ধ্বংস হবে !
কল্পনা দাস


পৃথিবী নাকি ধ্বংস হবে !!- আর মাত্র কটা দিন, সব শেষ । ডিসেম্বর মাস যেই এল, গেল গেল রব, বাপরে শুধুই মনে হচ্ছে আর বাঁচবনা ? জীবন শেষ ? আসছে ওই ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১২ ।
কি যে হয়েছে , মানুষের মুখে মুখে এক কথা , ২০১২ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আরে বাবা সমাজের যে অবক্ষয়, ঘুন ধরা সমাজ তো কবে-ই ধ্বংসের মুখে এগিয়েছে । তখন তো কারুর মনে হয় নি একবার-ও যে সমাজ ধ্বংস হতে চলেছে ? চারিদিকে হিংসা , দ্বেষ , হানাহানি , তাণ্ডবলীলা , অন্যায় , অবিচার , অত্যাচার তখন কোথায় ছিলে বাবা তুমি ভবিষ্যৎ বক্তা !

নাঃ ভেবেই দেখলাম যে HAPPY NEW YEAR বলা হবেনা , তাই আমি কিন্তু আজ-ই বললাম ‘HAPPY NEW YEAR’.........WELCOME 2013. কারণ আমি বাঁচতে চাই – ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ , তাহারই মাঝখানে পেয়েছি মোর স্থান’ , খুব মনে পড়ল বিশ্ব কবির এই কথা ।

কে একজন ভবিষ্যৎ বাণী করেছে পৃথিবী নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে। উফ অফিসেও আজকাল পৃথিবী ধ্বংসের কথা আলোচনা হচ্ছে । মনে আছে VOLCANO একটি বিদেশী ফিল্ম দেখেছিলাম আনেকদিন আগে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত , তার থেকে সেই গলিত লাভা ধেয়ে আসছে শহর নগর ধ্বংস করে ক্রমশ , প্রান বাঁচাতে মানুষ মরিয়া, ছুটছে যে দিক পানে যেতে পারে। সাঙ্ঘাতিক মর্মান্তিক সেই দৃশ্য ।


আমি বলি কি বাপু , হোক না পৃথিবী ধ্বংস , কেউতো থাকবনা কারুর জন্য-ই । এত ভাবার কি আছে হে । কোন সাংবাদিক থাকবেনা , কোন মিডিয়া থাকবে না যে আমরা খবর পাব। ধুত বোকা বোকা ভাবনা। আবার যেদিন পৃথিবী সৃষ্টি হবে ,আদম- ইভ আসবে , আবার আমরা আসব, সব খেপু এক জায়গায় হবে । তাই বলি কি গলা ছেড়ে গান গাও -



“শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে ।
আঘাত হয়ে দেখা দিল , আগুন হয়ে জ্বলবে ।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা শুরু হবে বৃষ্টি ঢালা ,
বরফ জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে ।
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে ।
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে ,
জীবনে ফুল ফতা হলে মরণে ফল ফলবে”

ধ্বংসের পূর্বাভাস - কৌস্তুভ দে সরকার

২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবীর ধ্বংস? - পূর্বাভাস
(রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কবির কবিতায়)

লিখেছেন – কৌস্তুভ দে সরকার।


২১ ডিসেম্বর ! ২০১২ ! পৃথিবী শেষ ! হয় রাক্ষুসে সুনামি, নয় ভয়ঙ্কর কোনও ভুমিকম্প ! তাতেও না হলে কোনও পরমানু বিস্ফোরণ, মারণাস্ত্রের অপপ্রয়োগ ! সব শেষ ! কাজেই বিষয়টা নিয়ে ভাবতেই হচ্ছে । যদিও এমন ভাবনা বহু আগেই অনেকেই ভেবে রেখেছেন । লিখে রেখে গিয়েছেন । আজ শুধু সে সবের পুনরাবৃত্তি করা । পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাভাস আজ নতুন নয় । নতুন হলো, এমন একটা গুঞ্জন সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়া । মূলত দুটো কল্পিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর শেষ দিন ঘোষণার গুঞ্জন ছড়াচ্ছে । প্রথমতঃ ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে যাচ্ছে মায়া বর্ষপঞ্জির । ২৫০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার বিশাল অঞ্চলজুড়ে বিকাশ লাভ করেছিল এই মায়া সভ্যতা । এই সভ্যতার আরও অনেক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে এর কয়েক হাজার বছর ধরে চলা বর্ষপঞ্জি । দক্ষিণ আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের আগে এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করত এ অঞ্চলের মানুষ । পরে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি চালু হয়ে যায় । সেই বিখ্যাত মেসোঅ্যামেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার পাঁচ হাজার ১২৫ বছরের বৃত্ত শেষ করছে এ বছরের ২১ ডিসেম্বর । এর থেকে রটে গিয়েছে যে , ২০১২ সালের এই ২১ ডিসেম্বর আসলে পৃথিবীরও শেষ দিন । চিনের ‘ই চিং’ বা বাইবেলের ‘ ওল্ড টেস্টামেন্ট’ , মায়া সভ্যতার সেই ভবিষ্যৎবাণীর সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সবকিছুই । দ্বিতীয়তঃ এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত গ্রহ নিবিরু আর পৃথিবীর কক্ষপথ একই রেখায় চলে আসার তত্ত্ব । এই দুটি গ্রহের মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে ; পুরোপুরি না হলেও পৃথিবীর একটা অংশ ছুঁয়ে যাবে নিবিরু । তা ছাড়া নিবিরু পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসার ফলে দুই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত পৃথিবীর গতিতেও এনে দেবে বড় ধরনের পরিবর্তন । কেউ কেউ প্রমাণ হিসেবে নাসার একটি পূর্বাভাসকেও ব্যবহার করছেন । যেখানে বলা হচ্ছে যে , ২০১২ সালে সূর্য তুলনামূলকভাবে বেশি উত্তপ্ত থাকবে । এ সময় ‘সোলার ফ্লেয়ার’ বা সূর্যের মধ্যে বিস্ফোরণের পরিমাণ বেড়ে যাবে । কিংবা, আঘাত হানতে পারে একটি বিশালাকার উল্কাপিণ্ড; হতে পারে সৌর-সুনামি বা কৃষ্ণগহ্বর ।


তবে হুট করে পৃথিবী ধ্বংসের এই গুজবকে আরও উসকে দিয়েছে ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ২০১২ নামে একটি ছবি । যেখানে দেখানো হয়েছে , সূর্যের উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর কেন্দ্রের উত্তাপও ভয়ংকরভাবে বেড়ে যাচ্ছে । এর ফলে গলে যাচ্ছে পৃথিবীর ভূখণ্ড । পৃথিবীতে আর ভূখণ্ড বলে কিছু থাকছে না । পুরো পৃথিবী তলিয়ে যাচ্ছে জলের নিচে । ওই ছবির প্রচার-প্রচারণায় মায়া বর্ষপঞ্জির শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যবহার করা হয়েছে জোরালোভাবেই । প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ নাসার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি পাঠাচ্ছেন । কেউ কেউ এমনও মন্তব্য করেছেন যে , ওই বিভীষিকা শুরুর আগেই তাঁরা সপরিবারে আত্মহত্যা করবেন ! বাধ্য হয়ে নাসা এই বিষয়টি নিয়ে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট খুলে সেখানে বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করছে যে , পৃথিবীর অন্তত এ বছরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই । নিবিরু নামের কল্পিত সেই গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দিয়েছে নাসা । নাসার অ্যাস্ট্রোবায়োলজির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডেভিড মরিসন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এ ধরনের কোনো কিছুর অস্তিত্বই নেই ।’ মরিসন অবশ্য স্বীকার করেছেন যে , এ বছর সোলার ফ্লেয়ার একটু বেশি হতে পারে । তবে তাতে পৃথিবীর ধ্বংসটংস হবার সম্ভাবনা নেই , বড়জোর সমস্যা হতে পারে স্যাটেলাইট যোগাযোগের ক্ষেত্রে।

কিন্তু নাসার বিজ্ঞানীরা যাই বলুন না কেন , যেহেতু কবির চেতনালোক সবার চেয়ে বেশি অগ্রসর । তারা সর্বকালেই সমস্ত চৈতন্য এবং অনুভূতির পুরোভাগে থাকেন । সম্ভবত এ কারণেই বাংলা কবিতার সেরা দিকপাল তথা বিশ্ব সাহিত্যের সর্বোজ্বল নক্ষত্র –বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাতেও আমরা প্রত্যক্ষ করি পরিবেশ বিপর্যয় এবং তার পরিণতিতে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কা । আমরা সবাই জানি ‘আমি’ কবিতাটি—কবির এক অসাধারণ সৃষ্টি । কিন্তু এই কবিতাতেই কবি যেন সত্যিই এক অস্থির সময়ের সংলাপ তুলে ধরেছেন । এতে ধ্বনিত হয়েছে বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এক মহাপ্রলয়ের করুণ আর্তনাদ । মানুষ ও প্রাণীকুলের একমাত্র আবাসস্থল পৃথিবীর প্রতি কবির একান্ত দুশ্চিন্তার চিত্রটিই যেন প্রস্ফুটিত হয়েছে এই কবিতাটির কয়েকটি ছত্রে , শব্দ কণিকায় । এই কবিতায় কবি লিখেছেন –

“বুড়ো চন্দ্রটা, নিষ্ঠুর চতুর হাসি তার,
মৃত্যুদূতের মতো গুঁড়ি মেরে আসছে সে
পৃথিবীর পাঁজরের কাছে ।
একদিন দেবে চরম টান তার সাগরে পর্বতে ;
মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায়
পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য,
গিলে ফেলবে দিনরাতের জমাখরচ ;
মানুষের কীর্তি হারাবে অমরতার ভান,
তার ইতিহাসে লেপে দেবে
অনন্ত রাত্রির কালি ।
মানুষের যাবার দিনের চোখ
বিশ্ব থেকে নিকিয়ে নেবে রঙ,
মানুষের যাবার দিনের মন
ছানিয়ে নেবে রস ।
শক্তির কম্পন চলবে আকাশে আকাশে,
জ্বলবে না কোথাও আলো ।
বীণাহীন সভায় যন্ত্রীর আঙুল নাচবে,
বাজবে না সুর ।
সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে
নীলিমাহীন আকাশে
ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে । ....”

অর্থাৎ কবি যেন এখানে বলতে চেয়েছেন যে , কিছু একটা ধেয়ে আসবে পৃথিবীর দিকে ; আর তাই হঠাৎ দুলে উঠবে পৃথিবী । টান লাগবে সাগরে পর্বতে । বদলে যাবে আহ্নিক গতি । ঘুরতে শুরু করবে উল্টো দিকে ! উত্তর মেরু চলে যাবে দক্ষিণ মেরুতে, দক্ষিণ মেরু উত্তর মেরুতে । পশ্চিম দিকে উঠবে সূর্য ! নড়তে শুরু করবে মহাদেশীয় প্লেটগুলো । ফুঁসে উঠবে মৃত, সুপ্ত, অর্ধসুপ্ত—সব আগ্নেয়গিরি । দেখা দেবে প্রবল জলোচ্ছ্বাস। বেড়ে যাবে সূর্যের উত্তাপ; উত্তাপ বাড়বে পৃথিবীরও । গলিত লাভার মতো গলে যেতে শুরু করবে পৃথিবীর ভূখণ্ড । মর্তলোকে মহাকালের নূতন খাতায় পাতা জুড়ে নামবে একটা শূন্য । অর্থাৎ , পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাবে । মানুষের কীর্তি হারাবে অমরতার ভান । তার ইতিহাসে লেপে দেবে অনন্ত রাত্রির কালি । অর্থাৎ ধ্বংস হয়ে যাবে সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস । শক্তির কম্পন চলবে আকাশে আকাশে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাবে । জ্বলবে না কোথাও আলো । অর্থাৎ অন্ধকারে ছেয়ে যাবে গোটা বিশ্ব । ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর, পৃথিবীর ভাগ্যললাটে যেন লেখা হবে একটাই শব্দ—মৃত্যু !আমাদের ভালোবাসা , মায়া, লোভ, ঘৃণা, পাপ-পুন্যের লাল নীল সবুজ এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে ওই দিনই । সত্যিই কি পৃথিবী ধ্বংস হবে ২০১২ ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখা । যেভাবে অপপ্রচার এবং অপবিজ্ঞানে স্বাভাবিক চিন্তাধারার মানুষের নিজস্ব যুক্তিবোধ ওলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে তার মাঝখানে বিশ্বকবির এই কবিতার লাইনগুলি ভাবলে অস্থিরতা যে আরও বাড়বে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই ।

আর মহাবিশ্ব যখনই ধ্বংস হোক, শেষ পর্যন্ত ইশ্বরকে অন্তত বেকার বসে থাকার ইঙ্গিতও কবি দিয়ে রেখেছেন তাঁর এই কবিতায় –
“ বিধাতা কি আবার বসবেন সাধনা করতে
যুগযুগান্তর ধরে-
প্রলয় সন্ধ্যায় জপ করবেন
‘কথা কও, কথা কও’,.........।

ফরাসি কবি মালার্মের মতে, ‘কবিতা হচ্ছে এমন একটি ভাবপ্রকল্প যার মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের তরঙ্গকে এবং অস্তিত্বের নিগূঢ় ব্যঞ্জনাকে উপস্থিত করে ।’ ‘আমি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথও তেমনি অস্তিত্বের নিগূঢ় ব্যঞ্জনায় যে অস্থির আগামীকালের ইঙ্গিত স্পষ্ট করে তুলেছেন এবং সম্ভাব্য বিপর্যয়ের সচেতনতার যে পরম আর্তনাদ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছেন, তার পর আর কোনও কিছু বলাই সম্ভব নয় যেন ।
যদিও মাত্র কয়েক দশক আগে ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার অসাধারণ কবিতা ‘ছাড়পত্র’তে বিশ্বকে নবজাতকের বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, সেখানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও কিন্তু তার আবাসস্থল পৃথিবীর জন্য ভাবিত, তাড়িত ও উত্কণ্ঠিত । সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন –
“প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ”......
— অর্থাৎ , চরম বিপর্যয় এবং বিলয়ের দিকে তার তীব্র করুণা, তীব্র অভিসম্পাত ধ্বনিত হয়েছে এই কবি কণ্ঠেও ।
একজন কবি—প্রকৃত কবি তার উপলব্ধি দিয়ে ভবিষ্যতকে শনাক্ত করে দেখে থাকেন আগেই । কবি জীবনানন্দ দাশেও আমরা এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করি না । ‘সিন্ধুসারস’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন –
“সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে ;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের – ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন ।”
– অর্থাৎ পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে ও আর সুন্দরভাবে ভোগ করতে মানুষের যত আয়োজন কাণ্ডকারখানা সেইসব প্রচেষ্টার চরম পরিণতিতে কিন্তু অন্ধকার গহ্বরেই যেন মিশে যাবে মানব সভ্যতা । কারন , পৃথিবীর সমস্ত রঙ – রূপ – রস নিংড়ে নিয়ে , জল আলো বাতাসের মতো পৃথিবীর সমস্ত উপাদানের যথেচ্ছ ব্যবহার করে নিয়ে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীকে ক্রমশঃ ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি । তাছাড়া, এই যে ইদানীং কালে সৃষ্টির রহস্য জানার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা , ঈশ্বরকণার জন্য অক্লান্ত আয়োজন তাও যেন ফুরিয়ে যাবে একদিন । অল্পপ্রাণ দিনের মতন আমরা বেঁচে আছি । তাই ‘ এইখানে সূর্যের’ কবিতায় কবি জীবনানন্দ লিখেছেন –
“মাঝে মাঝে বাসুকির লিপ্ত মাথা টলে,
ক্লান্ত হয়ে শান্তি পায় অপরূপ প্রলয়-কম্পনে ;”.........
অর্থাৎ আজকাল এই যে এত ভুমিকম্প হচ্ছে দিকে দিকে তার পূর্বাভাস ছিল এই কবিতায় । আবার তাঁর ‘সুচেতনা’—কবিতাতেও আছে এমনই একটি শঙ্কার বিরল আর্তনাদ -“এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য ; তবু শেষ সত্য নয় ”............ এরকম অমোঘ উচ্চারণ । কবির আশঙ্কা এই সুন্দর পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে । পৃথিবীর মানুষের লোভ – লাভ – লালসার দ্বারা জীবনকে জয় করার সে সুদীপ্ত বাসনা , যে রণ রক্ত সফলতা , জীবনের সফলতালাভের অদম্য চেষ্টা - সেইটাই একমাত্র শেষ কথা নয় । শেষ সত্যটা কি তবে শুধুমাত্র পৃথিবীর ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত ? এবং তাইকি বোঝাতে চেয়েছিলেন কবি জীবনানন্দ ?

পরবর্তীকালে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ‘একদিন’ কবিতায় লিখেছেন – “মানুষই ছুটেছে দেখি মৃত্যুর নিষ্ঠুর অনুষ্ঠানে......”। আবার ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ কবিতায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন –
“মৃত্যু ও জীবনে শুধু একটি ঊর্ধ্বে উঠে-আসা মেঘ
কিংবা এক জলজ হিংসা লেজ ঝাপটে লুপ্ত করে নেবে –
গান গাওয়া !”......

কবিদের এই প্রশ্ন যেন তাদের একার প্রশ্ন নয় । এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারা স্পর্শ করে যান দেশ কাল ও পাত্রকে । কবিকুলের প্রতিনিধি হিসেবে তারা যেন সতর্ক করে দেন সমগ্র মানুষকে—মানবসভ্যতাকে । পৃথিবীকে নিয়ে এত এই যে আবেগ, উৎকণ্ঠা—এর পরিণতি সম্পর্কে কবিরা কি আগেই জেনে ফেলেছেন — পৃথিবীর ভবিষ্যত্ কোন সুতোয় গাঁথা ? এই ধন্দে পড়ে আমি নিজেও একটি ছড়া লিখে ফেলেছি –

পৃথিবী কি ধ্বংস হবে দুহাজার বারো ?
সঠিক এর উত্তর - কে বলতে পারো ?
কি ভাবে ধ্বংস হবে – হঠাৎ না ধীরে ?
সংশয় দেখা দিচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে !
পৃথিবীর সকলেই সে কারনে ভীত
পৃথিবী ধ্বংস হবে – নয়তো কাঙ্খিত ।
রটনা-যে বর্তমানে ব্যাপক জল্পনা !
তারপরে কি থাকবে – সেটাও কল্পনা ।
আমেরিকা ডুবে যাবে ? নাকি আটলান্টিক ?
হিমালয় থেকে যাবে এরকম-ই ঠিক ?
ব্রিটেন উন্নত দেশ – ডুবে যাবে তা-ও ?
মাছেরা মেলবে ডানা, পেয়ে যাবে পা-ও !
মানুষ থাকবে ? না-কি ? থাকবে না পাখী ?
থাকবে কি টাটা-দের ন্যানো একলাখি ?
জটিল প্রশ্ন সব মুখে মুখে ঘোরে ;
পৃথিবী থামবে , না-কি ঘুরবেই , জোরে !
উত্তর সঠিক-টা যেই দেশ দেবে –
ষোলর অলিম্পিকে সব সোনা নেবে !

যাইহোক, বিশ্বজুড়ে এই যে কলকারখানার অবাধ বিস্তার, অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন, রাসায়নিক বর্জ্যে পরিবেশ বিনষ্ট হওয়া, অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ, বোমা বিস্ফোরণ, ওজোনস্তর ক্ষয়ে যাওয়া , জলস্তর নীচে নেমে যাওয়া, উষ্ণায়ন ইত্যাদি নানা কারণে এরই মধ্যে পৃথিবীর পরিবেশে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছে—তাতে এই মুহূর্তে সতর্ক না হলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে তার অবয়ব, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে সবুজ বেষ্টনী, বরফস্তর এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কমে যেতে পারে স্থলভাগ, অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত গরমে তা হয়ে উঠতে পারে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের বসবাসের অযোগ্য । যার প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া আমরা অল্প অল্প করে হলেও হয়তো টের পাওয়া শুরু করে ফেলেছি । দেখা যাক শেষোব্ধি কি হয় ? সেই প্রশ্নের উত্তরটাও সময়-ই সব চেয়ে ভালো দিতে পারবে বোধ হয় ।

পৃথিবী রসাতলে যাবে - ইন্দ্রাণী সরকার

পৃথিবী রসাতলে যাবে
ইন্দ্রাণী সরকার


পৃথিবী যদি আর কয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যায় কী করবো আমি? এর উত্তর নিজেকে নিজেই দেবার জন্য চোখ বুজে ভাবতে থাকলাম | মন বললো থেমে থাকলে ত' চলবে না | লুকোবই বা কোথায় ? মাটির তলার ঘর, নিজন দ্বীপ কী কাজে আসবে ? কিন্তু এ যে মহাপ্রলয় ! সৃষ্টি তছনছ হয়ে যাবে | এর থেকে ত' আমি পালাতে পারবো না কোন সুরক্ষিত পরিবেশে |

আমি ভাবলাম যে দিনটা যখন জানাই আছে কবে পৃথিবী রসাতলে যাবে তখন নিজের জীবনটা একটু অন্য আঙ্গিকে দেখি | এত দিনের জীবনে যদি কারোর মনে আঘাত দিয়ে থাকি, তাদের কাছে ক্ষমা চাইবার এই ত' সময় | আমার প্রিয় জিনিসগুলো একটু নাড়াচাড়া করে নি | আমার প্রিয় বাগানের গাছগুলিকে মনে মনে বলে দি যে ওদের আমি কত ভালোবাসি | সুন্দর গাছগুলোকে আদর দিয়ে দি | কত বছর ধরে ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আমার বাগানের শোভা হয়ে | বন্ধুদের সঙ্গে কিছু সুখ দুঃখের কথা বলে নি | আমার প্রিয় গানগুলি নতুন করে শুনি, বুঝতে চেষ্টা করি আরো একবার |

আমার বাড়ির সবাইকে অনেক আদর আর ভালোবাসা জানিয়ে তাদের দুটো সান্ত্বনার কথা বলি আর একটু চোখের জল ফেলি | এই আমার প্রিয়জন যাদের সঙ্গে আমি বছরের পড় বছর কাটিয়ে এলাম তাদের কাছ থেকে আমার দূরে চলে যাবার সময় এসে গেছে | আর কিসের মায়া !

এবার আমি আমার পুজোর ঘরে যাচ্ছি | কেউ আমায় আর ডেকো না | আমি এখন সেখানে বসে চোখ বন্ধ করে আমার আর এই পৃথিবীর পরম পিতা মহাদেবের চরণে নিজেকে সমর্পণ করলাম | হে মহাদেব ! হে পরম পিতা, আমায় তোমার চরণে স্থান দাও |


পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে....


পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, আর আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর প্রাণের স্পন্দন থেমে যাচ্ছে। চোখের সামনে ভেঙে পড়ছে আকাশচুম্বী দালান। নিমিষেই গুড়িয়ে যাচ্ছে মাটিতে। না, বাস্তবে নয়, এটি অতি জনপ্রিয় মুভি ‘২০১২ এর কাহিনী। তবে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে যে ২০১২ সালে নাকি সত্যিই ধ্বংস যাচ্ছে আমাদের পৃথিবী। ডুমস্ডে-২০১২ নিয়ে সাপ্রতিক জল্পনা-কল্পনা,ইন্টারনেট পাড়ায় হৈ-চৈ, প্রখ্যাত পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন এবং বিজ্ঞানীদের অভিমত নিয়ে এই প্রতিবেদন।

বর্তমানে বিশ্বের পরিস্থিতি, বিজ্ঞানীদের গবেষণা আর নানা দিক ব্যাখ্যা করে পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে! সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছিল ২০০০ বছর আগেকার মায়া সভ্যতা। সেই সময় মায়ারা তৈরী করে ছিল এক রহস্যময় ক্যালেন্ডার। মায়াদের সময় বিশ্বজুড়ে স্থাপত্য, সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ছিল নজিরবিহীন। প্রাচীন মিথ, জ্যোতিষশাস্ত্র কিংবা প্রাচীন বুদ্ধিমান সভ্যতার ওপর যাদের আস্থা চরম তাদের প্রথম পছন্দ মায়া সভ্যতা। সত্যিই মায়াদের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হতে চলেছে? বিজ্ঞানীরা মায়াদের ক্যালেন্ডারের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে কথা না বললেও জানিয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাব্য কিছু নমুনা। এর মধ্যে সূর্যের ভেতরের বিস্ফোরণ ‘সানস্টম’, ভয়ঙ্কর অগ্নুৎপাত, সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার, এবং ‘গেস্নাবাল ওয়ামির্ং -কে পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাব্য দায়ীদের অন্যতম বলে দাবী করা হচ্ছে।

সানস্টর্ম বা সূর্যঝড়কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভবিষৎতের জন্য একটি ভয়ঙ্করতম হুমকি বলে মনে করছেন। সূর্যের ভেতরে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বিস্ফোরণ থেকে তৈরী হয় এনার্জি। আর সেই এনার্জি থেকে ইলেক্ট্রন, প্রোটনের মতো নানা পার্টিকল পৃথিবীতে এসে পৌছায় এবং এগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব এসে পরে পৃথিবীর উপর। সেই সঙ্গে সোলার র্স্ট্রম বা সৌরঝড় তো রয়েছেই। ২০১২ সালে সূর্যের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনার্জি তৈরি হবে, যার নাম ‘সোলার ম্যাক্সিমাম’। এই সৌরঝড়ের ভয়ংকর রেডিয়েশন এবং এনার্জি নির্গমনের ফলে ভূপৃষ্ঠে বা মহাকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখে দিবে। বেড়ে যেতে পারে মানুষের অসুখ বিসূখ, দুঘর্টনা ও ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে পৃথিবী এগিয়ে যাবে চুড়ান্ত পরিণতির দিকে। অন্যদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর আগ্নেয়গিরি হলো আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ভলকানো। মোটামুটি প্রতি ৬,৫০,০০০ বছর পর ভয়ংকর অগ্ন্যুৎপাত হয় এই আগ্নেয়গিরি থেকে। গবেষনা অনুসারে ২০১২ সালে ভয়ংকর বিষ্ফোরণ ঘটবে ইয়োলোস্টোনে হয়তো সেখান থেকে সাংঘাতিক অগ্ন্যুৎপাত হবে, সব বায়ু মন্ডল ঢেকে যাবে, ছাইয়ে হয়তো চাপা পড়ে যাবে সূর্যও। তখন গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এভাবে কিছু দিন চললেই পৃথিবী থেকে প্রাণের স্পন্দন থেমে যাবে।

পৃথিবীর জন্য আরেকটি সম্ভাব্য হুমকি হচ্ছে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’। ব্রহ্মাণ্ড এর জন্মমূর্হূতে পৌঁছতে সুইজারল্যান্ডের জেনাভায় মাটির নিচে তৈরী করা হয়েছে মানুষের তৈরী সবচেয়ে বড় যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন ২৭ কি. মি. লম্বা জোড়া পাইপের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রোটন কোটি কোটি বার চক্কর খাবে এখানে। তারপর প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি পৌছে বিপরীতমুখী প্রোটনের সঙ্গে ভয়ষ্কর ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গ টুকরো টুকরো হয়ে তৈরী হবে ডট্রিলিয়ন ডিগ্রি (১০০,০০০,০০০,০০০) সেন্ট্রিগ্রেড উত্তাপ। মাল্টিপেক্সড অ্যানালগ সিগন্যাল প্রসেসরে জমা হতে থাকবে অগণিত তথ্য। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানবেন বিশ্ব ব্রম্মান্ড সৃষ্টির রহস্য। এর প্রথম পরীক্ষাটি আবার ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু এর ফলে ঘটতে পারে ভয়ংকর দুঘর্টনা। আর ২০১২ সালেই এই যন্ত্রের সাহায্য চালানো হবে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুকিপূর্ণ এই পরীক্ষাটি। তাই এই ঝুকিটাও হেলা করার মতো নয়।

আবার সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, প্রচন্ড উত্তাপে দ্রুত গলে যাওয়া মেরু প্রদেশের বরফ। গলে যাচ্ছে হিমপ্রবাহ। পৃথিবী জুড়ে সমুদ্রের লেভেল বাড়ছে। গ্রীনল্যান্ড ও আ্যন্টার্কটিকার বরফও গলে যাচ্ছে। ফলে এক সময় হয়তো প্রবল জলোচ্ছাসে ভেসে যাবে সারা পৃথিবী। বিজ্ঞানের নানা বিশ্লেষণ ২০১২ সালকে পৃথিবীর অসিৱত্বের একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এমনও হতে পারে এর কিছুই হয়তো ঘটবে না। হয়তো ঘটবে আরো কয়েক শতাব্দী পর। সে আশায় আমরা বুক বাঁধতেই পারি।

মায়ান ক্যালেন্ডার রহস্যঃ ২০১২ ছবির ঘটনার মতো ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর সত্যি সত্যি আমাদের পৃথিবীতে ঘটতে যাচ্ছে ধ্বংসলীলা এ কথাই বলছেন মায়ান পঞ্জিকা বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে বড় ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মায়ান পঞ্জিকাতে আজ পর্যন্ত যত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তার প্রতিটিই কালের আবর্তে সত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই পৃথিবী ধ্বংসের আশংকা নিয়ে এত বেশী আলোচনা হচ্ছে।

সাপ্রতিককালে বিশ্বজুড়ে প্রকৃতি যে আচরণ শুর করেছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। কয়েক বছর ধরেই পৃথিবীর বুকে আঘাত হানছে বৈরী আবহাওয়া। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ধারাবাহিক ভবে ভূমিকম্প, দাবানল, বন্যা, তুষারঝড়, ঝড়-জলোচ্ছাস ও শৈত্যপ্রবাহ বিশ্বজুরে লেগে আছে। আক্রান্ত হচ্ছে রাশিয়া, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইউরোপ, কলম্বিয়া, চীন, ভারত, জাপান, বাংলাদেশসহ বিশ্বেও অধিকাংশ দেশ। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম কাল। এমনকি আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা WMO ২০১০ সালকে ১৫০ বছরের মধ্যেবিশ্বের সবচেয়ে গরম বছর হিসাবে চিিহ্নত করেছে। তারচেয়েও আতঙ্কের বিষয় সাম্প্রতিক কালে জাপানে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে তাতে পৃথিবীর অক্ষ ১ মিনিট কোণে হেলে গেছে। ফলশ্রুতিতে জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের সব হিসাবনিকাশ ভূল প্রমাণ করে উত্তর গোলার্ধেও এলাকা গ্রীনল্যান্ডে নির্ধারিত সময়ের ২ দিন আগে সূর্যদয় হয়েছে। এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। আর জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভবিষ্যৎ ফলাফল হল পৃথিবী ধ্বংস।

উপরে উল্লেখিত তথ্যাবলি থেকে অনুমান করা যায়, ২০১২ সালে হয়ত কিছু না কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানিরা পৃথিবী ধ্বংসের ব্যাপারে একমত নন। তাদের মতে,২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর পৃথিবী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। অনেকের মতে পৃথিবীতে মহামারি দেখা দিবে অথবা কোনো না কোনো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানবে। তবে যাই হোক না কেন আমরা নিশ্চয়ই ‘ডুমসডে-২০১২’ মুভিটির বাস্তবরুপ দেখতে আগ্রহী হব না, তাই না?

আমি স্রষ্ঠাকে সাসপেন্ড করব - মৌ মধুবন্তী

আমি স্রষ্ঠাকে সাসপেন্ড করব
মৌ মধুবন্তী


স্যান্ডি কি নাচলো? কি নাচলো? ট্যাঙ্গো, সাম্বা, সালসা, সাফল, টুইস্ট? নাকি রাম্বা, যাম্ব্রা, মরিস, মাম্বা? অথবা পোলকা, লিম্বা, ডিস্কো? জানতে ইচ্ছে করে সে ভারত নাট্যম, মনিপুরী, কত্থক, এইসব পারে কিনা। জিজ্ঞেস করার সময় পায় নাই জনগণ। তার আগেই সে পথ পরিবর্তন করে এসে তুমুল আঘাত হানে নিউইয়র্কের উপকুলে। যে ম্যানহাটন কোন দিন ঘুমায় না, তাকে সে ডুবিয়ে দিয়েছে কালো গভীর অন্ধকারে। কবিদের ভাণ্ডারে শব্দ থেমে গেছে তার বর্নণা দিতে গিয়ে। লেখকগণ হাতে হাতে বরফ কুচিতে জমানো মদের গ্লাসে চুমুক থামিয়ে দিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল সেই তাণ্ডব? নাচের মুদ্রায় জলের আক্রোশ।

রামেশা ব্যস্ত ছিল তার ঘর সামলাতে। সাথে আছে তার পাঁচ বছরের বাচ্চা। কেউ জিজ্ঞেস করে, ছেলে ? কেউ জিজ্ঞেস করে, মেয়ে? রামেশা বলে, এই আমার অবুঝ বাচ্চা। বাচ্চাদের কোন জেন্ডার নেই। কেউ দেখেনি এই বাচ্চা প্রকৃতির কোন অঙ্গ নিয়ে বেড়ে উঠছে মায়ের কাছে একা একা। বাবার অস্তিত্বের কোন গন্ধ সে পায় নাই কোনদিন। সে কথা নাইবা আনলাম এখানে।

কত কথা পড়ে থাকে আশেপাশে, রাস্তা ঘাটে। কি করে সব কথা ঘুচিয়ে একটা বড় গুপ্তগুহায় লুকিয়ে রাখি? লুকালে পাঠক পড়বে কি করে? সবাই বুঝি লেখা পাঠকের জন্য লেখে? রাত ভর জেগে জেগে কত কথা ভাবি, মাথায় আসে কত উপমা, কত গন্ধরাজ ফুল ফোটে, সুবাস কে পায়? সকাল তো নিরুদ্দেশের যাত্রার ছড়ি হাতে নিয়ে উধাও। আমিও ছড়ি হাতে ক্রমশ হাটি দুপুরের দিকে। দুপুর মানেই বারোটা ।

বারো একটা বিশেষ সংখ্যা। বারোটা গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন সে অনেক ব্যাখ্যা দাবী করে। বারো মানে এক যুগ। একের ভেতরে আরেক। বারো হয় এক এর পরে দুই দিয়ে। প্রেম তো তাই দাবী করে। একজন থেকে আরেকজন মিলে একের পরে দুই। তেমনি এই সৌরমণ্ডলে মোট বারোটা প্ল্যানেট আছে। সান, মার্কারি,ভেনাস আর্থ,মার্স, জুপিটার, স্যাটার্ণ, ইউরেনাস , নেপচুন, প্লুটো,ও নিবিরু।

এই নিবিরু নাকি আমাদের দিকে ধাওয়া করে আসছে। তার কি হয়েছে? সে কেন তার আপন কক্ষ ছেড়ে এইভাবে আমাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে? নিবিরু তুমি কোন ধর্মের অনুসারী? কেন আমাদের সাথে তোমার এই মারামারি? তুমি বাহিরের সার্কেলের শেষ প্রান্ত থেকে খসে এসে মাঝে এস্টরয়েড বেল্টের ভেতরে মার্স দ্বারা ঘেরা-বেষ্টিত আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীকে সত্যি গুতা মারবে? তোমার অন্তরে কি কোন মায়া নেই? আমরা কত স্বপ্নের মেরিলিন মনোরো বিল্ডিং, কত টল টাওয়ার, কত কি করছি এখন ডিজিটাল, নিউক্লিয়ার বোমা , তারা কি তোমাকে আঘাত করেছে? চোখে ধোঁয়া দিয়েছে? তবে এতো কেন গোস্বা করলে যে দড়িদড়া ছিড়ে ছুটে আসছো?

রামেশা রান্না ঘরে ঢুকতেই একখণ্ড ছেড়া “দা নিউইয়র্ক টাইমস” এলোমেলো দেখতে পেলো কাউন্টারে পড়ে আছে। একসময় সে আর মার্ক ভাগাভাগি করে দা নিউইয়র্ক টাইমস পড়ত। আজ সব স্মৃতি। আজ মাথার ভেতর একুশে ডিসেম্বর। রামেশা হাসে, ভালো হবে সবাই মিলে একসাথে নতুন গ্রহে চলে যাব। কিন্তু সৌরমণ্ডলে হঠাৎ এমন বিপর্যয় ডেকে আনছে কেন? অলস হাতে তুলে নেয় সে, “দা নিউইয়র্ক টাইমস”- চোখের সামনে হেড লাইন হাসছে, “ Smile You’re on Infrared Camera”.

বটে!। হিসাবে কি এরা ভুল করেছে? চোখ আরেকটু এগিয়ে যায়, যেতে যেতে নাইট ভিশান তুলে নেয় সাব হেডিং, “BMW's Night Vision system picks out potential hazards in the dead of night” । এমনি ইনফ্রারেড ক্যামেরা কি আমাদের সকলের অন্তর্দৃষ্টি বদলে দিতে পারে না? রাতের ঘন অন্ধকারে কালো কাপড় পরে দাঁড়িয়ে থাকো, এই ক্যামেরা BMW ড্রাইভারকে সজাগ করে দেবে, সামনে বিপদ আছে। সংকেত। আমরা তো প্রতিদিন সংকেত পাই বিপদের, মানি কয়জন? কেন মানিনা, জানিনা। স্বভাব ? এলো কোথা থেকে? কোন গ্যালিলিও কেন আবিষ্কার করেনি এই স্বভাবের উদ্ভট উৎপত্তি?

ইন্টারকম বেজে ওঠে। ভিউ প্যানেলে দেখা যায় এক অদ্ভুত মুখচ্ছবি। এই মুখ তার অনেক চেনা। প্রতিশ্রুতি আর প্রবাদ বাক্য যার ঝোলা ভর্তি, সে রামেশার জ্যান্ডারবিহীন সন্তানের জন্মের একমাস আগ থেকেই উধাও। নেই কোথাও নেই। বস্তুত এই ধরাধামে এই নামে কাউকেই রামেশা আর খুঁজে পায় নাই। তার মুখচ্ছবি ভিউ প্যানেলে। দাড় কাকের মত ভেজা কাপড়ে লবিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। চুল থেকে জল ঝরে গেছে অনেকক্ষণ আগে। নেতিয়ে পড়েছে জলঝরা চুল। জীবন যেমন নেতিয়ে পড়ে প্রাণের মানুষটা হারিয়ে গেলে। সিকিউরিটি অনুমতির অপেক্ষায় আছে। রামেশা ভাবছে, সে কি তবে ভুত দেখছে? নাকি স্যান্ডির দারুণ নৃত্যে সে বেতালে তার দিশে হারিয়েছে। চিমটি কেটে দেখছে নিজেকে বেচে আছে নাকি অনেকক্ষণ আগেই সে মরে গেছে, মরে যাবার পরে দেখা হচ্ছে তার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকের সাথে। এই তার মৃত্যুর পরের ইডেন গার্ডেন। রামেশা লাইন ড্রপ করে দিয়ে লিভিং রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কারেন্ট নেই তো টিভি দেখবে কি করে? জেনারেটর ইমার্জেন্সী সার্ভিস দিচ্ছে মাত্র। ঘরের এক কোনে আর্টিফিসিয়াল ক্যান্ডেল জ্বলছে। যতক্ষণ ব্যাটারি আছে জ্বলবে। তার মত। পেস মেকার আছে তো সে আছে।

সিঁড়ির আলোতে ছায়ামুর্তির মত কেউ হাতে ছোট ছোট ব্যাগে করে খাবার, কেউ বা পান বোতল ওয়াটার, কেউ আবার বিয়ারের ক্যান, ক্যানের খাবার, কফি ও ডোনাট নিয়ে উঠছে উপরের দিকে। পা চলেনা। এই সাতচল্লিশ তলার বিল্ডিং এ রামেশা বসে আছে পঁয়ত্রিশ তলায়। পাঁচ বছরের বাচ্চা কি খাবে? আদৌ কি খাবার আছে বাসায়? রামেশা এইসব ব্যাপারে কোনদিন বেশী বিচক্ষণ নয়। লাস্ট মিনিটের কাজে সে অভ্যস্ত। কাল লাস্ট মিনিট ছিল কি? নাকি অবকাশ না দিয়েই স্যান্ডি এসে হানা দিয়েছে জানালায়। দরজাটা একটু বেশী দূর হয়ে গেছে পঁয়ত্রিশ তলা থেকে। জানালার কাচে আচড় কাটলেও সে ভাঙতে পারেনি বিন্দুমাত্র।

ভাবনার রকেট চড়ে কত কত উঁচুতে নতুন ফ্লোর বানাচ্ছে মার্ক। কিন্তু লবির সেই ওয়ান বাই ওয়ান টাইলস থেকে পা এক চুল নড়েনি, যেন প্যারেক মেরে তাকে আটকে দিয়েছে কেউ। সিকিউরিটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। অন্ধকার হলেও সময় গড়ায়। সুর্য না উঠুক ঘড়ির কাটাই জানান দেয়, দিন কখন কোন প্রহরে। রামেশার গায়ের উপরে গড়িয়ে পড়ে তার পাঁচ বছরের সন্তান। রামেশা হু হু করে কাঁদতে থাকে। বাচ্চাটি ভেবে পায় না, মা কেন এমন করে কাঁদছে। চকলেট চিপস কুকিটায় কামড় দিয়ে সে গড়াতেই থাকে মায়ের গায়ের উপর।

মার্কের ভাবনার রশি গিয়ে ফেঁসে যায় সিকিউরিটির কানে। সে মন দিয়ে শুনছে। পৃথিবীতে অনেক রকম দ্বন্দ্ব আছে। আছে ভুল অথবা আধা ভুল তথ্য। এইসব আমাদের জানা দরকার। মরতেই যদি হবে, তা হলে জেনেই মরা ভালো। কেউ মরেও বেচে থাকে কেউ বেচে থেকেও মরে যায় অজ্ঞাতসারে। হিপ্নোটাইজড হয়ে শুনছে সিকিউরিটি-মার্ক বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কাঁপছে হাত-পা। তবু কণ্ঠ তার তারের মত সুরেলা। তোমাকে জানতে হবে Zechariah Sitchin. গুটিকয় জ্ঞানী মানুষের মধ্যে Sitchin হলো অন্যতম একজন। Sitchin অতি প্রাচীন( সুমেরিয়ান, ইজিপশিয়ান ও হিব্রু) ভাষা পড়তে পারে, বুঝতে পারে, অনুবাদ করতে পারে এবং আধুনিক ভাষার সাথে তার মেলবন্ধন ঘটাতে পারে। তার জীবনকে সে উতসর্গ করেছে এইসব প্রাচীন ভাষা বুঝতে ও অনুবাদ করতে। এতে ছিল টেক্সট, কুনিফরম এবং ক্লে টেবলেট। সিকিউরিটি অফিসার জানেনা, কে বাইরে যাচ্ছে কে ভেতরে ফিরে আসছে। ভিউ প্যানেলগুলো নিজের মত করে চলছে। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত ও কিছু ক্ষিপ্ত লোক অনায়াসে বাইরে ভেতরে আসা –যাওয়া করতে পারছে, তারা আনন্দিত আজকের দিনের জন্য। একজন উৎসাহ দিল মার্ককে, ওকে গল্পে মাতিয়ে রাখার জন্য। যেন তাকে ইয়াবা কিংবা এই জাতীয় নেশার ঘোরে রেখেছে মার্ক। মরতে হবে? এইভেবে তার নিজস্ব সিকিউরিটি নিয়ে সন্দিহান অফিসার হা করে শুনছে আর গিলছে কথাগুলো।

Sitchin আবিষ্কার করলো যে, সুম্যেরিয়ান সভ্যতাই হলো পৃথিবীর প্রথম ও আদি সভ্যতা। তাদেরকে এইসব শিখিয়েছে তাদের গড আনুননাকি ( Anunnaki). সেই তখনই তারা সকল গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে অনেক কিছু জানত। তারা জানত আমাদের সোলার সিস্টেম, তাদের রঙ । তারা জানত আমাদের পুর্ণিমা বান চাঁদ বানুর খবর। কোন একসময় তারা এও বলতে শুরু করলো যে মার্সে পানি আছে। সে কি তুমুল আলোচনা চারিদিকে। অবিশ্বাস্য হলেও এখন আমরা জানতে শুরু করেছি মার্সে পানির প্রমাণ আছে। সব শিখিয়েছে স্রষ্টা আনুননাকি। আনুননাকি এসেছিল আরেকটা গ্রহ থেকে নাম তার নিবিরু। প্রতি ছত্রিশ’শ( তিন হাজার ছয়শ বছর) বছর পরে একবার করে এই নিবিরু আমাদের পৃথিবীর কাছাকাছি ভ্রমণ করতে আসে। তার ঠ্যাং ( ইক্লিপ্স) অনেক লম্বা। সেই কারণে আনুননাকি আমাদের দেখতে আসে সেই প্রথম সভ্যতার সময়। বর্তমানে এস্ট্রনামাররা এই গ্রহের সন্ধানে মাতোয়ারা। তারা এই অজানা গ্রহকে নাম দিয়েছে প্ল্যানেট এক্স। উনিশ নব্বই সালে Sitchin সাক্ষাত করে Dr. Robert Harrington এর সাথে। Dr. Robert Harrington হলো US Naval Observatory এর Supervising Astronomer.

সিকিউরিটি অফিসারের মুখে মাছি ঢুকে গেলেও সে জানবে না কি হয়েছে মুখের ভেতর এমনই বড় হা। মার্ক সেই তার ওয়ান বাই ওয়ান টাইলস থেকে সরে এসে সিকিউরিটির মুখের হা বন্ধ করে দিয়ে বলতে থাকে, মায়ান ক্যালেন্ডার। শেষ হবে একুশে ডিসেম্বর, দুই হাজার বারো সালে। এই ক্যালেন্ডার আসলেই শুরু হয় ওল্মেক্স দিয়ে, মায়ান দিয়ে নয়। ওল্মেক্স সভ্যতায় তাকে ডাকা হয় Thoth বলে। Thoth কে বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন নামে ডাকা হলেও সুমেরিয়ান সভ্যতায় তাকে ডাকা হয় Ningishziddah নামে। নিবিরু গ্রহের আনুননাকিদের অনেকের মধ্য থেকে এই Ningishziddah -ই আমাদের ধরণিতে নেমে আসে । Ningishziddah এর ফেরত যাবার সময় সে নাকি প্রতিজ্ঞা করে, সে আবার ফিরে আসবেই আমাদের গ্রহে। আর সেই আসার দিন হলো একুশে ডিসেম্বর, দুই হাজার বারো সাল। সিকিউরিটি, তা হলে সে আসছে? হয় হয় করে কান্না। শেষ হবে পৃথিবী একুশে ডিসেম্বর। অবিশ্বাস্য এই মায়ানমার ক্যালেন্ডার।

মার্ক বলে, লাইনের সাথে লাইন ধাক্কা খাবে, খাবি খাবে, বাড়ী দেবে, মারবে, অক্ষে অক্ষে রক্ষে করবে আমাদের প্রেম, আমাদের হারিয়ে যাওয়া, আমাদের ব্যর্থতা ও আমাদের সভ্যতা । মেরে কেটে চুরমাচুর করে নতুন গান তুলবে, ঝপাং ঝং।

ওদিকে এলোমেলো সব ভাবনা। আকাশ থেকে নক্ষত্র খসে পড়তে দেখেনি যে কোনদিন সেও প্রস্তুতি নিয়েছে নিবিরু নামে এক অচেনা গ্রহের অকস্মাৎ ভূপাত অধঃপতন দেখবার জন্য। ম্যানহাটন ঘুমায় না। স্যান্ডির নাচের পরে মঞ্চে আলো নিভে গিয়েছিল বটে, তবে সার্চ লাইট এখন পুর্ণোদ্যমে আবার আলোকিত করে রাখবে ম্যানহাটনকে। প্রস্তুতি চলবে একত্রিশ ডিসেম্বর রাতের। দুই হাজার তের সালকে হাতে করে এই রাত আসবে আমাদের কাছে নতুন পৃথিবীকে বরণ করতে।

একজন বদ্ধ উন্মাদের মত হাঁপাতে হাঁপাতে কুর্স লাইট বিয়ার হাতে দৌড়াচ্ছে সিঁড়ির দিকে। কত তলায় উঠতে হবে জানে না। ডেলিভারি। বিল্ডিং এর সামনে রাস্তার উপরে একটা পুলিশ পেট্রোল কার এসে থেমেছে। নিউ ইয়র্ক এম্পাওয়ারম্যান্ট টিম। এম্পয়ায়ারম্যান্ট। মার্ক ঘন ঘন নিশ্বাস নিয়ে এম্পাওয়ার্ড হতে থাকে। ইয়েস। “Earth is coming to an end “ । ব্ল্যাক হোল। সিকিউরিটির চোখ থেকে জল পড়ছে গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ডিউটিতে আছে, তার সুইট হার্টের সাথে দেখা নেই। সে থাকে ব্রঙ্কসে। নিরাপদ আছে । কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস হলে, তাদের বিয়ে হবে কবে? অনেক স্বপ্ন দেখেছে বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে।

রামেশার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়েছে। দু’বছর আগে তার ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে। সেল ফোন চার্জ দিতে পারে নাই। লবির পাওয়ার পয়েন্ট ইউজ করা নিষেধ। মাত্র হল ওয়ে টাকে আলোকিত রাখার জন্যই জেনারেটর। বাচ্চাটা দেখছে মা কেমন যেন করছে। ইন্টারকমে প্রেস করে, সিকিউরিটিকে বলছে, মাই মাম ঈজ সিক। শি ইজ ক্রাইং। মার্কের আত্মায় কেন যেন জোরে আর জোরে ধাক্কা দিতে থাকে। সে শুনছে, কথাবার্তা। মার্ক জানে না রামেশার সার্জারীর কথা , কিন্তু সিকিউরিটির মনে আছে, সেই রাতের কথা। রাত দু’টোয় রামেশাকে এম্বুলেন্স এসে নিয়ে গেছে সেন্ট ভিন্সেন্ট হাসপাতালে। নিউইয়্যর্কের খুব উঁচু মানের একটা হাসপাতালের মধ্যে সেন্ট ভিন্সেন্ট অন্যতম একটা। সেভেনথ এভিনিউতে যেতে লাগে মাত্র দশ মিনিট।

সিকিউরিটি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলে, I will suspend Ningishziddah! মার্ক দৌড়াতে থাকে সিঁড়ি ঘরের দিকে। একুশে ডিসেম্বরের আগেই তাকে পৌছাতে হবে পঁয়ত্রিশ তলায়। বিশ তলায় ওঠার পরে মনে হলো মার্কের, কত নম্বর স্যুইটে সে যাবে? সে তো কেবল বিল্ডিং নাম্বার জানে, ফ্লোর নাম্বার তো জানে না। সব তথ্য, এই ঠিকানা তার জানা ছিলনা। ঘটনাক্রমে সে ফেসবুকে রামেশাকে আবিষ্কার করে। ফেসবুকের এবাউট পড়েই সে তার ঠিকানা জেনে নিয়েছিল দিন কয়েক আগে। কিন্তু কি করে সে রামেশার মুখোমুখি হবে ভেবে ভেবে ঘামাচ্ছিল, আসবার সাহস পাচ্ছিল না। আম্ররক থাকে আপার ম্যানহাটনে। নব্বুই ব্লক হেটে হেটে মার্ক আজ এই দুর্যোগের দিনে এসেছে সিক্সথ এভুনিউতে পার্ক চেষ্টার টাওয়ারে। মার্ক আবার নামতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে। এমন অন্ধের মত নামছে, ল্যান্ডিং এ এক লোকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যায়। কেটে যায় কনুইয়ের খানিকটা। গড়িয়ে যায় সিঁড়ির কয়েক ধাপ। মাথায় চোট লাগে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মার্কের। লোকটা ফাক ইউ বলেই থমকে গিয়ে বলল, সরি। মার্ক নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে।

কত নাম্বার স্যুইটে যাব? সিকিউরিটি হা করে আছে। I will suspend Ningishziddah! নাইন ওয়ান ওয়ান স্যুইটে।মার্ক আবার দৌড়াতে থাকে। যখন পঁয়ত্রিশ তলায় পৌছালো, তখন রামেশার পাঁচ বছরের বাচ্চা মাকে টানতে টানতে হল ওয়েতে নিয়ে আসে। বাচ্চাটা কাঁদছে না। হাঁপাচ্ছে আর বলছে, লেটস গো টু হসপিটাল। মার্ক দেখছে , কি কঠোর পরিশ্রম করছে, একটা অবুঝ বাচ্চা। মার্ক বলে ওঠে I will suspend Ningishziddah! বলেই কাঁধে তুলে নেয় রামেশাকে। বাচ্চা ও মার্ক দু’জন নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। ভাববার কোন সময় ।

মার্ক, হে বয়, নো, হে গার্ল । মার্ক বিরাট দ্বন্দ্বে আছে বাচ্চাটিকে নিয়ে। একি ছেলে না মেয়ে? কি করে ডাকব তাকে। তোমার নাম কি? মাই নেম ইজ মাই বেবি। সাত তলায় এসে পৌঁছেছে। মার্ক একটা ধাক্কা খেলো দেয়ালের সাথে। পাঁচ বছরের বাচ্চা নাম বলতে পারছে না। রামেশা তো এই রকম অগোছালো নয়। কি করে এমন হলো? আমাকে হারিয়ে সেকি এতই দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তা হলে সে এই রকম লাক্সারি এপার্টম্যান্টে থাকে কি করে। হে বয়, হে গার্ল ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনি ম্যান এট হোম?

ম্যান ডাইড বিফোর মাই বার্থ। মার্ক হুমড়ি খেয়ে পড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সে বেচে আছে কেবল নিজের কাছে। বাকী সবার কাছেই সে মৃত। রামেশার দেহ অসাড়। হার্ট বীট আছে, স্লো। রামেশার চোখ বন্ধ। হাতগুলো ঝুলছে। মার্ক হুমড়ি খেয়ে পড়লেও রামেশাকে সে কাঁধের উপর থেকে পড়তে দেয় নাই। সিকিউরিটি দৌড়ে এসেই হেল্প করলো মার্ককে। এতক্ষণে মনে পড়লো সিপিয়ার দেবার কথা। মুখে মুখে সিপিয়ার দিতে শুরু করে মার্ক। আহ কতকাল পরে রামেশার ঠোটে ঠোট। মনের ভেতর মার্কের আগুন জ্বলতে থাকে। এই ঠোট তার অতি প্রিয়। পুলিশের গাড়ি থেকে একজন পুলিশ নেমে আসে। ইমার্জেন্সী সার্ভিস কল করে। মার্ক অপেক্ষা করতে রাজী নয়। সে কাধে করেই হাসপাতাল নিয়ে যাবে। পুলিশ তার অবস্থা দেখছে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে। হাঁটুর উপরে প্যান্ট ছিড়ে গিয়ে চামড়া হা হয়ে আছে। বাচ্চাটা কাউন্টারের সাথে হেলান দিয়ে বসে হাঁপাচ্ছে। মার দিকে অপলক চেয়ে আছে। এই জগতে ওর আর কেউ থাকবে না মা চলে গেলে। এই ভাবনা ওকে গ্রাস করছে না। বয়েসটাই তাকে বুঝতে দিচ্ছে না। মৃত্যু কি জিনিস। তবু সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস, ঈজ শি ডাইং?
মার্ক এবং সিকিউরিটি একসাথে বলে ওঠে, “ I will suspend Ningishziddah!”। ইমার্জেন্সী এম্বুলেন্স এসে তুলে নেয় রামেশাকে এবং মার্ক সহ বাচ্চাকে।

ইমার্জেন্সী রুম। ডক্টর লিও তাকে এটেন্ড করে। মার্ক গিয়ে ডক্টরকে বলে, “I will suspend Ningishziddah!”। ইয়াম্ররজেন্সী এটেন্ডেটরা স্ট্রেচারে করে রামেশাকে নিয়ে যায় অপারেশান থিয়েটার এ। মার্ক কাছে টেনে নেয় বাচ্চাকে। পরম আদরে মুখে মাথায় চুমু দিতে দিতে বলে, “I will suspend Ningishziddah!”। আর ইউ বয় অর গার্ল? আই এম জেন্ডারলেস হিউইম্যানকাইন্ড। মার্ক আবারো বলে, “I will suspend Ningishziddah!”- বাচ্চাটিও শুরু করে। প্রশ্ন, হু আর ইউ? এন্ড হোয়াট ঈজ দিস “I will suspend Ningishziddah!”। স্রষ্ঠা। ক্রিয়েটর হু টেক আ ওয়ে আওয়ার লাইভস। নো! - বাচ্চাটা জোরে চিৎকার করে বলে উঠে, “I will suspend Ningishziddah!”। সবাই ওর দিকে ঘুরে তাকালো। নো ওয়ান ক্যান টেক আ ওয়ে মাই মম।

বাকী যারা ছিল তারাও ঘুরে দেখছে মার্ক বিড় বিড় করে কিছু বলছে। Earth will not End on December 21, 2012. ভুল গনণা । মায়ানমার ক্যালেন্ডারে শুয়ে আছে রামেশা।

টরন্টো, কানাডা, পৃথিবী
১৮ ডিসেম্বর, ২০১২

শিলালিপিতে খোদাই করে যাবো তরুণদের কবিতা - অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

শিলালিপিতে খোদাই করে যাবো তরুণদের কবিতা
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়


কাল যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় আজ আমি কী করব ?
কাল যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আজ আমি কী করব , এটা ভাবতে ভাবতেই ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যেতে পারে । এত কিছু করার আছে , এত কিছু করতে বাকি , কোনটা করব কোনটা না করব সেটার জন্য চব্বিশ ঘন্টা বোধহয় যথেষ্ট নয় । তবু ভেতরের কিছু সুপ্ত ইচ্ছে পিপীলিকার ডানা গজায় মরিবার তরের মতো “কল্পনা আজ চলছে উড়ে হালকা হাওয়ায় পাল মেলে/ পাঁপরি ওজন চলছে তাতে সেই হাওয়াতে পাল পেলে” । যদি সত্যি তাই হয়, অর্থাৎ “ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা” যখন আমি তাহলে শ্রীজাত, বিনায়ক আর অংশুমানকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের তরুণ কবিদের জন্য মহাকালের পাশে রেখে যাবো তাঁদের সৃষ্টি । পৃথিবী যদি সত্যি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পাঠক তবলে আদৌ তো কেউ থাকবে না, আমরা যাদের নিয়ে নান্দনিকতায় মগ্ন থাকি সেই এক একটা টুকরো ইমেজারি চলে যাবে উদভ্রান্ততার ঈশ্বর গহ্বরে । থাকবে না এই কাগুজে লিপি, বৈদ্যুতিক লিপি । কিন্তু হয়তো বা অজন্তা ইলোরা রেখে যাবে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ । আর তার জন্যই আমি বেঁচে থাকা বাংলাভাষীদের শেষ মুহূর্তে জানিয়ে যাবো আমাদের পরবর্তী তরুণ কবিদের সৃষ্টির মাহাত্ম । আমার স্বপ্ন আমি, শ্রীজাত, বিনায়ক আর অংশুমান মিলে একটা ব্লগ করব শেষ দিনে তাতে বাংলা ভাষার সমস্ত তরুণদের প্রচুর কবিতা সংকলিত করে শেষ দিনেও অন্তত চল্লিশ হাজার পাঠককে তাদের কবিতা পড়াবো । তারপর যতখানি পারব সবাই মিলে সেই কবিতাগুলোকে খদাই করে রেখে যাবো শিলালিপির মতো কোনো গুহার ভেতরে যাতে ধ্বংসের পর আবার যদি কোনো সভ্য মানুষের উৎপত্তি হয় আর তারা যদি বাংলাভাষাটা বুঝতে পারে তাহলে তাঁদের জন্য থাকবে আমাদের চারজনের তৈরী এই তরুণ কবিদের পাথুরে শিলালিপির সংকলন । হতেও তো পারে, এটাই হয়ে উঠবে তাঁদের কাছে কবিতা কী তা জানার একমাত্র উপায় । হতে পারে কয়েক হাজার বছর পরে যখন মঙ্গলগ্রহের কোনো প্রান কিউরেটরের ধ্বংসাবশেষ দেখে পৃথিবীর সন্ধান করতে এলো , বা স্পিলবার্গের কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী এসে যদি বাংলা বুঝতে পারে তাহলে তারা দেখতে পারবে এই সময় ভাষার এক অনুপম আঙ্গিক । সেই হবে আমার শ্রেষ্ঠ চাওয়া ।


ইচ্ছে যখন শেষ মুহূর্তেরই তখন ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে নেই । জানি স্রষ্ঠার এই ভয়ানক ধ্বংসলীলার চেয়ে সন্ত্রাস আর কিছু নেই , তবুও যারা ধ্বংসের আগে এই সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংসের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁদের অন্তত মরার আগে কিছু দিয়ে যেতে চাই , বুঝিয়ে দিতে চাই ধ্বংসের চেয়ে জীবনের মূল্য কতখানি ছিল । যদি সেই চব্বিশঘন্টায় তাঁদের কাছে পৌঁছনোর কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি পেয়ে যাই, তাহলে অবশ্যই আমি শেষ চব্বিশ ঘন্টায় যেতে যাই পৃথিবীর সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তিদের বা গোষ্ঠীদের কাছে আর উপহার দিতে চাই ‘লেভ তলস্টয়’ এর বই – ‘রেজারেকশন’ । আর ধ্বংসের আগে আমাদের এই সোনার বাংলার অন্তত ৫০ জন কিশোরকিশোরীকে উপহার দিতে চাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সমগ্র কিশোর সাহিত্য’ । আর যদি আমার একেবারে ব্যক্তিগত ইচ্ছের কথা বলতে হয় তাহলে আমার একান্ত ইচ্ছে বাইরের সেই ধ্বংসের উষ্ণ হাওয়া বইবার আগে, সমুদ্রের জল আমাদের চারপাশকে ঘিরে ঘোরার আগে আমার প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে শেষ মুহূর্তের অন্তিম অবস্থান একটা ফাঁকা সিনেমা হলের মধ্যে টাইটানিক এর সেই দৃশ্যে যেখানে রোজ আর জ্যাক সমুদ্রে ভাসছে । ঠিক সেই সময়েই যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়, আর সিনেমাটাও যেন ফ্রিজ হয় সেখানেই , এর থেকে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে ... 41°46' N, 50° 14' W এর সেই অন্তিম সলিল সমাধি ।

কবিতা - পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত

পাত্রভরা প্রেম
পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত


-১
-


আমার সোনালি প্রেম প্রথমদৃষ্টিতে চমকপ্রদ আল্লাকে পুনরায় গোলাপ
সুপুরুষ কবির কাছে গোপনকথার মধ্যপর্বে প্রেমাতুর এই দুষ্টুমি,
চিঠির ভাঁজে ঘুমিয়ে থাকলো রিনির ঈর্ষা রিনির নৌকো
সাহসীকল্প মেঘের মুদ্রা।আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও কখনো যাবো না।
ক্রমে চিহ্ন দিলাম দেয়ালে টাঙানো হলো ছবি একটার পর একটা
রিনির উনুন, রাত্রির অভিপ্রেত, বেশি বাস্তব প্রতিশ্রুতি আর প্রথম ফটোগ্রাফ।
আল্লার কি শক্তি খুঁজে পেয়েছি খুঁজে পেয়েছি এক মহাদেশ দৌড়ে এলাম
পিয়ানো গোলাপজল দীর্ঘসন্ধ্যা পূর্ণতার অদম্য স্পৃহা
দুই ভিন্ন বয়সের টানাপোড়েন নেই ছবিগুলোর বিশেষ ভঙ্গি লটকে আছে
একটুকরো আমার ছবি আর কিছু নেই রিনির হাতে বৈধ আমি প্রথম শরীর
অপ্রতিরোধ্য আমি সবুজ হৃদয় অসীম সম্ভাবনার কবি
স্রোত মিশে যায় আমার বুকে আল্লা-কসম মুখ লুকিয়ে থাকবো না আর,
রোমাঞ্চ রং চাঁদিনী রাত মন্ত্রমুগ্ধ আবেগ ঘেঁষে পুণ্যশ্লোকের হচ্ছেটা কী
দ্রুতগতির এই যে প্রেম রিনির নিরাময় তো হলো
ও শ্লোক ও শ্লোক ভ্রমণে চলো অসীম উৎসস্থলের দিকে
যাই ঘটুক না এই জীবনে আমার রিনি ক্লেশ জানে না আধ্যাত্মিকে
জাগিয়ে তুলছে কবির দেহ মনের বাষ্প শীতের জীর্ণ তাৎক্ষণিকে
এটা অ্যাবসার্ড এটা অ্যাবসার্ড হচ্ছেটা কি ট্রাফিক পুলিশ অতিপ্রাকৃত

আমার সোনালি প্রেম প্রথমদৃষ্টিতে চমকপ্রদ আল্লাকে পুনরায় গোলাপ


-২-


লেখার প্রসঙ্গ এলে খুনসুটি রস অচেনা সুঘ্রাণ
মেনু কার্ড জুড়ে ঈশপ ঈশপ উট চলে গেছে জাহান্নামে
ক্রমশ নিজের কবিতারা যেন একটি জগৎ সুদূর অতীত
ইচ্ছেমতো বিবৃতি দেবো না বিবরণী নেই বিষণ্নতায়
অলিভ অয়েলে স্থূলকায় চুল খুঁটিনাটি লিখি প্রেমিকা যা চায়
বাগানে বসেছি রিনির বাগান লয়লামজনু সারল্য খাই
খুঁজে না পেলে কি ঈশ্বর দেবে দেয়ালঘড়িতে প্রেমের ম্যাপ
আমার রিনিকে বহুশতাব্দী-ব্যাপ্ত রেখেছি ভালোবাসায়
কথাকার নই নির্যাস রাখি ব্যতিক্রমী শব্দের রং
এখন শৈলী লেখার কফিতে দাও গো উগ্র পেয়ালা্র ওম
মজা দিয়ে লিখি তোমার জাদুতে তাজ্জব কিছু মৃগয়া লাফ

এপিসোডের পর এপিসোড আমি লিখে চলেছি, অহো
আমার রিনির আগুন জানো কি অগ্নিবর্ণ বিবিধ দৃশ্য!
মাখো মাখো প্রেম ফ্ল্যাশব্যাক নেই এই তো সেদিন
গালিব গালিব কাফকা চামচা,প্লেটনিক বলে হয় না কিছুই

খুলে দিলাম নতুন জগৎ এই নাও কল্পস্বর্গ আধুনিক ব্লু
গভীর চোখের কাছে আমি শান্ত আমি ছিন্ন হারিয়ে ফেলেছি মায়াজাল
ও তুলে বিন্যাস দিলো জীবনের অনিবার্য গোপন রূপ তার তৃতীয়-ইমেজ
তুলে দিলো আনন্দজীবন
খারাপ বা ভালো সে সব গুলি মারো


-৩-
মসলিনের বাজার এসেছে ঘুম জড়ানো প্রেম এসেছে স্বর্ণমুদ্রা খোশমেজাজ
আরাম করে নিচ্ছি ঘরে রুমাল উড়াই মকাইবাড়ি পিকোফিনিংস
রিনি রোমের রসিকবিলে অতলান্ত নিঃসঙ্গতা আমার অনুষঙ্গে শিরায়
আরবি ঘোড়া আমিই ছিলাম এক কোটি চার বছ্রর আগে দৃশ্য আছে
অতিপ্রাকৃত জ্যোৎস্নাখন্ড স্তরে স্তরে রূপক ছিলো নিজস্বতায়
লায়লা অতি সরল এবং মজনু লেখে তর্কগুচ্ছ,নিউরোলজি
প্রেমের কলসি উদ্ভ্রান্ত মতো কোন দিকে যায় কোন পাহাড়ে ফুটলো অরেঞ্জ
ভুট্টাক্ষেতের মাথার উপর জীবন আমার জ্যোৎস্না আঁকে অস্ফুট রঙ চার ভঙ্গিমা
হঠাৎ হঠাৎ ডুব মারে লাল-রঙ্এর পাখি রিনি তাদের সুপুষ্ট ফল লম্বা-লাটাই
হায় জানালা প্রেমের বাহুযুগল তুমি গলি-ঘুপচি ক্যান-ওপেনার ফান্টা-সিরাপ
উত্তরণের প্রত্যাশা তাই নতুন স্মারক, রিনি আমার নিবিড়-পাঠ মধ্যে আছে
রিনি আমার আখ্যানে ঢেউ কথক-তোরণ, রেশম-সুতোয় অধুনান্তিক প্রমাণ মেলে


-৪-


আমি বুঝলাম কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত প্রেমিকার আভ্যন্তর
অধৈর্যে নিস্তব্ধ থাকলাম ৩প্রহর,ভ্রূ কুঁচকে লিখে ফেললাম
অদম্য ঠোঁট,চুমো খেলাম অনেক তুখোড় শরবতে
রিনি কোথায় রিনি কোথায় পোর্টিকো নেই দরজা খোলা
ভুল রাস্তায় যাচ্ছে না তো! পৃষ্ঠাগুলো ভীষণ খালি
এক ওয়াগান ফুলের পোশাক আকাশপ্রমাণ আয়না নীরব
পাত্রভরা অলংকরণ আনুগত্যে ভাসছে মেঘের কোঁকড়ানো চুল
খুঁটিনাটি ব্রোঞ্জ-সেরামিক,কলমকাটা ছুরির হাতল,
গোপন কিছুই থাকলো না আর তৈরি হলো একটি কোলাজ
গোপনকথার ঝলমলে ঝাড় জ্বলছে নিভছে আমার মুখে
রিনি কোথায় রিনি কোথায় যুদ্ধ থেকে ফিরবে কখন?
ঘোর লাগা ঘুম অভিজ্ঞতা চিরকালীন পদ্যে আছি।
শ্লোকের মন্ত্র হায় বেচারা, ঘুমপাড়ানি গানের মাছি।
স্মারক তবে এই যথার্থ রক্ষণশীল হোক না শয়ন
সুন্দরী সে আত্মমুগ্ধ প্রেমে পড়েছে মিনিয়েচারে
কাব্যবন্দি থাকুক না সে উসকে দিলেন গালিব শ্লোকে
লাজুক নম্র ইচ্ছেমতো ফুলের কুশন কফির ফুর্তি সামলাবে কে!
অন্বেষণের আর কি বাকি রোমান্সভরা কাব্যে আছি।