বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

সম্পাদকীয় - ৪র্থ বর্ষ ২য় সংখ্যা

সম্পাদকীয়



বসন্ত এসেছে । চারদিকে বসন্তের গান, পত্রিকার পাতায় পলাশফুলের ছবি সেই কথাই জানাতে চাইছে । শহরে বসন্ত এসেছে কেবল ক্যালেন্ডারে; যদিও গ্রাম, মফঃস্বলে আজও কোকিল ডাকে, কচিমুখের দল মেতে ওঠে ন্যাড়াপোড়া, রং- খেলায় । মেগাপলিশের বাসিন্দারা দোলের দিন মাংসভাত, ভদকা বা বিয়ার খেয়ে লো ভলিউমে রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে পালন করেন বসন্তোৎসব । সাদা পোশাক, অরগ্যানিক আবীর ~ মুখোশ পরায় আন্তরিকতায়, ঠিক যেভাবে দেখনদারীত্বে ঢেকে গেছে সৎ সাহিত্য ।

অন্যএকটা কথা বলি - অন্তর্জালে সাহিত্য নিয়ে যারা সবথেকে উৎসাহী তারাই নাকি ছাপার জন্য ব্যয় করেছে সবথেকে বেশী কাগজ । কি অদ্ভুত বৈপরীত্য ! তবু অস্বীকার করার উপায় নেই এই মাধ্যমকে । দূর দূরান্তে হাতের কাছে বাংলা পত্র- পত্রিকা না পাওয়া মানুষ মাউসের ক্লিকে‌ বা মুঠোফোনের সাহায্যে মুহূর্তে ঢুকে পড়ছেন বাংলা সাহিত্যের অন্তরমহলে - এ এক অভাবনীয় ব্যাপার ।

থাক এসব। বেশী কথা কাজের নয় । ক্ষেপচুরিয়াসের নতুন ব্লগ্‌জিন আপনাদের জন্য প্রস্তুত। সময় করে পড়ে ফেলুন এবারের সংখ্যা । ইচ্ছে হলে মতামত দিন, নইলে নীরবেই পড়ে নিন । কেমন হয়েছে সেটা বলে দেবে সময় । তবে চেষ্টাটা সৎ ছিল এটাই বলার ।

ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষ থেকে সব্বাইকে দোলউৎসবের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখি । রং খেলুন, খেলা হলে ধুয়েও ফেলুন ।

অবশ্য মনের রং কি আর ধোয়া যায় !


ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে ~ মিলন চট্টোপাধ্যায়

উত্তর সম্পাদকীয় - চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

উত্তর সম্পাদকীয়
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না

‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ সাংসদ, তব্য গর্বিত নয় রাজ্যবাসী



এই রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন একজন আহমেদ হাসান ইমরান, যিনি পেশায় সাংবাদিক। তাকে জেতাতে কংগ্রেস, আর এস পি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়কদের ভোট কেনা হয়েছিল বলে অভিযোগ। কেনার অভিযোগ উড়িয়ে শাসক দলের মুখ বলেছেন, মমতা সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে তারা স্বেচ্ছায় এসেছেন। মানুষ জানেন, বিনা স্বার্থে রাজনীতিবিদরা এক পা ফেলেন না, উৎকোচ-উপঢৌকনই সার কথা। ইমরানের জয়কে সংখ্যালঘু স্বার্থে তৃণমূলের পদক্ষেপ বলা হয়েছিল, কিন্তু বলা হয়নি ইনি আসলে কে? ইমরান “হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে...” (গুরুদেব মাফ করবেন আশা করি), সেটাও জানা দরকার। জানা দরকার, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হঠাৎ সে দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে এমন একজন সাংবাদিক-রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেন কেন?

আমাদের সমস্যা আরও বেশি। ভোট আসলেই আমাদের খাবারের পরিমাণ বেড়ে যায়। সব দল কিছু না কিছু খাওয়াতে চায়। আমাদের খেতেই হয়, কিন্তু খেলেই কি হজম হয়? হয় না। আমাদের তো রাহুর দশা। আমি এবং আমাদের বেশিরভাগটাই তাই খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না।

সরকারি গোয়েন্দাদের তথ্য বলছে, ১৯৭৭ সালে জন্ম নেওয়া জঙ্গী ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া বা সিমি-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পশ্চিম বাংলায় সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বা ‘আমীর-ই-হলকা’ ছিলেম এই ইমরান। সিমি-কে নিষিদ্ধ করেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর সেই সরকার যার মন্ত্রী ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইমরান নিজে ‘ইসলামিক মিল্লাত’ এবং জেহাদ-এর সমর্থক, মিল্লি কাউন্সিল-এর অন্যতম কর্তা এবং ‘কলম’ পত্রিকার সম্পাদক। একসময় তিনি নিজেকে ইরানের ‘তেহরান রেডিও’-র সাংবাদিক বলে দাবি করতেন। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদী ইরানের একটি রেডিও কলকাতায় কেন প্রতিনিধি রাখবে, তা দুর্বোধ্য। ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউ ইয়র্ক টাইমস এর মত কাগজও ভারতের জন্য একজনকেই প্রতিনিধি রাখতে পারে, তাও দিল্লিতে। গোয়েন্দাদের মতে, তিনি ‘পেইড ফরেন এজেন্ট’ এবং এর প্রমাণ তাঁদের আছে। চার বছর সিমির ‘আমীর-ই-হলকা’ থেকে ইমরান ১৯৮১ সালে ১৯ দরগা রোড ঠিকানা থেকে প্রকাশ করেন মাসিক পত্রিকা ‘কলম’। পত্রিকাটি ১৯৯৩-৯৪ সাল সাপ্তাহিক হয়ে চলে আসে ৪৫ ইলিয়ট রোড-এ আর দরগা রোডের বাড়িটি হয় সিমির কমিউন। সিমি-র অফিস হয় লেনিন সরণীর অন্য একটি বাড়িতে। কলমের তখন সবচেয়ে বেশি প্রচার ছিল আসামের মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে, আর তা সম্ভব হয়েছিল পরবর্তীকালে গঠিত এআইডিইউএফ চেয়ারম্যান বদরুদ্দিন আজমলের। এ-পর্যন্ত খেয়েই ঢেকুর উঠল - আলিগড়ের ছাত্র ইমরান সিমিতে থাওকে থাকতে হঠাৎ একটি পত্রিকা প্রকাশ করে তার বিপুল প্রসারের মত অর্থ কোথা থেকে পেলেন? কারা করল লগ্নী, কেন --- সবই প্রশ্ন।

এখন জানা যাচ্ছে, তার লগ্নী অর্থের জোগান আসত বাংলাদেশের ইসলামিক জঙ্গী সংগঠন ‘জামাত-এ-ইসলামী’-র থেকে। জামাতের নেতা ছিলেন মানবতা-বিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী গোলাম আজম। তাঁর ছেলে তথা বাংলাদেশের ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মামুন আল-আজমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেন ইমরান। জানা যাচ্ছে, মামুন কয়েকবার কলমের ইলিয়ট রোডের অফিসেও এসেছেন। ইমরানকে তিনি ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের ভারতীয় শাখার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে এনেছিলেন। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এই পদে ইমরানের কাজ ছিল এপার বাংলায় ইসলামিক জঙ্গী গোষ্ঠিগুলির জন্য অর্থের যোগান বজায় রাখা। ফলে, মুসলিম সমাজের উন্নয়নের নামে আইডিবি-র টাকা এলেও তা সম্প্রদায়ের গরিবদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয় নি। ইমরানের সঙ্গে এ-বাংলার জামাতের কাগজের দায়িত্ব দেওয়া আছে, তিনি জনৈক আলাউদ্দিন। এই কারণেই ইমরান তসলিমার লজ্জা বা উতল হাওয়া উপন্যাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সঙ্গে দেখা করে তসলিমার বই নিষিদ্ধ করার আর্জি জানিয়েছিলেন এবং আদালতে মামলাও করেছিলেন। তসলিমাকে কলকাতা থেকে তাড়ানোর জন্যে সংখ্যালঘু অংশের সমাজবিরোধীদের দিয়ে বাম সরকারের আমলে দাঙ্গা-পরিস্থিতি সৃষ্টির পিছনেও তাঁর মদত ছিল। তসলিমার লেখা কাহিনি-নির্ভর ‘দুঃসহবাস’ সিরিয়াল বন্ধের জন্য চ্যানেলের কর্ত্রিপক্ষের সঙ্গে মৌলবাদীদের বৈঠকে হাজির ছিলেন কলমের সম্পাদক তথা উর্দূ কাগজ ‘আজাদ হিন্দ’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক ইমরান।

মৌলবাদ-ফ্যসজেধী ও ধর্মনিরপেক্ষ শাহবাগ আন্দোলনের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তাই ষড়যন্ত্র করেছেন জামাতপন্থী ইমরানরা। তাঁদের কাগজের পাতায় পাতায় তখন শশবাগ-বিরোধী সংবাদ, যার অধিকাংশই মিথ্যা, প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু, সংবাদপত্রের ভূমিকা ছাপিয়ে গিয়ের কলকাতায় বাংলাদেশের জামাতের সমর্থনে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিছিল নিয়ে যাওয়ার মত কাজ তাঁরা সংগঠক হিসাবে করেছে। শহীদ মিনারে জামাত এ-ইসলামীর নাম না নিয়ে তারই ছত্রচ্ছায়ার এক ডজন সংগঠনের নামে প্রকাশ্য সমাবেশ করে সেখান থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ““বাংলাদেশের জামাত-এ-ইসলামী আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন।” যারা এই কর্মসূচীর সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজক ছিলেন, তাঁদের অন্যতম কলমের দুই কর্মকর্তা।

লক্ষ্যণীয়, শাহবাগের সমর্থনে কলকাতায় একটিও মিছিল করার জন্য অনুমোদন দেয় নি ধর্ম্নিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নেয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। শাহবাগের একাডেমির সামনে থেকে ছোট্ট মিছিলকে পথেই নামতে দেওয়া হয় নি। অথচ, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক রাজাকার-আল বদরদের ভারতীয় সংস্করণের জন্য সব অনুমতি দিয়ে রেখেছিল সেই প্রশাসন। তাদেরই অন্যতম প্রবক্তা হলেন ইমরান, যাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল সাংসদ করে পাঠাল। এই সম্পর্কের জেরেই জামাতের স্বার্থ দেখে তিস্তা চুক্তিতে সায় দেন নি মুখ্যমন্ত্রী। দৈনিক হিসাবে প্রকাশের আগেই কলম পত্রিকাকে মমতা সরকারের গ্রন্থাগার বিভাগের প্রকাশিত ‘ক্রয়যোগ্য কাগজ’ এঁর তালিকায় আনা হয়েছিল। আর তাঁর পিছনে মানুষের রক্ত জল করা টাকার থলি নিয়ে হাজির হতে হয়েছিল জালিয়াতি ফান্ড সারদা-র চিট সুদীপ্ত সেনকে। সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হওয়ার পর অন্য অনেক কাগজ বন্ধ হলেও কলম কিন্তু চালুই রইল এবং দেখা গেল, তাঁর পাশে এসে দাড়িয়েছেন তৃণমূলের নম্বর টু – মুকুল রায়। ফলে, ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ এঁর ব্যাপারটা অজানা কিন্তু জিজ্ঞাসার মধ্যেই থাকায় খেতে বাধ্য হওয়ার পরও গেলা আর হল না। হজম হবে না তো!

আহমেদ হাসান ইমরান তাহলে বেশ জনপ্রিয় মানুষ। দেখন বঙ্গবাসীর কী দুর্ভাগ্য, এতদিন সেটা অজানাই ছিল। ডঃ নজরুল ইসলাম, মীরাতুন নাহার থেকে শুরু করে কত কত বুদ্ধিজীবীর চেয়েও যে তিনি খ্যাত, তা বোঝা গেল বাংলাদেশের সংসদে তাঁর নাম যখন উচ্চারিত হল। ২০০ তম টেস্ট খেলার পরও শচীন তেন্ডুলকরের নাম বা বিশ্বসেরা হওয়ার পরও বিশ্বনাথন আনন্দের নাম বাংলাদেশের সংসদে উচ্চারিত হয়য় নি, হল কিনা ইমরানের নাম। ভাবুন! সেখানে শাসন দল আওয়ামী লিগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তথা প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম ১১২ ফেব্রুয়ারি বললেন, ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে জামাত এ-ইসলামীর কিছু জঙ্গী। সম্প্রতি সাতক্ষিরায় তল্লাশির সময় তাঁরা ভারতে ঢুকে পরে। পারস্পরিক সম্পরক ও কূটনীতির তোয়াক্কা না করে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন ইমরান সাহেব। সে কারণে ইমরানকে বাং;লাদেশের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডঃ মন্মোহন সিং এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্যোপাধ্যায়ের প্রতি আহবান জানান তিনি। মনে করালেন, বাংলাদেশে বসে ভারত-বিরোধী চক্রান্তে যুক্ত অনুপ চেটিয়াকে ঢাকার সরকার গ্রেফতার করে ফেরত পাঠিয়েছে। সেভাবেই ইমরানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হোক।

এহ বাহ্য! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরপিএন সিং-কে সম্প্রতি পাঠানো একটি নোটে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বলেছেন, জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানির চেষ্টা করছে। তাঁদের এই কাজ সহজ হয়ে গেছে ইমরান সংসদে নির্বাচিত হওয়ায়। আগেই তিনি জামাত এ-ইসলামী ও জামাতের ছাত্র শাখা ছাত্র শিবিরকে মদত দিতেন, এখন সেটা আরও বেশী করে দিচ্ছেন। সাতক্ষিরায় বাংলাদেশি বাহিনীর অভিযানের সময় ৪০ জন জঙ্গী ভারতে ঢোকে এবং দ্রুত তাঁদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে ফেলা হয়। সেই কাজে ইমরানের ভূমিকা ছিল বলে তাদের রিপোর্ট।

অনেক ভেবে ভেবে দেখলাম, ইনিই হলেন আদর্শ ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না’-র ব্যক্তিত্ব। ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ হয়েও সাংসদ রাজ্যবাসীকে গর্বিত করতে পারলেন না। কী দুর্ভাগা আমরা!

ছোটগল্প - পার্থ বসু

মলের গল্প, গল্পের মলম
পার্থ বসু



বাজারে গিয়ে জিনিস হারিয়ে আসা অশ্মর দাদুর কাছে নতুন কিছু নয়। বয়স যখন তাঁর এক কুড়ি মামার বাড়ি ইলিশ পাঠাচ্ছেন মা। তাঁর হাতে। মামার বাড়ির চৌকাঠে পা রেখে মনে পড়ল মাছ ফেলে এসেছেন ট্রেনে। বয়স যখন দু কুড়ি বাজারের সব্জিওয়ালা , সে কিনা তাঁর বাড়ি চিনত না, খুঁজে পেতে তাঁর শ্বশুরবাড়ি ফেরত দিয়ে এসেছিল ফেলে আসা শাকটা মুলোটা ।এখন তিন কুড়ি পার হয়ে ভুলো মন কথাটা তাঁর ব্র্যান্ড। তাঁর খাতির যাদের সাথে, যারা বন্ধুজন, ভুলো মন এমন কি তাঁরাও। সে গল্প আর একদিন। এখন দাদুর গল্প। মলের গল্প। তা কলকাতা শহর মলে ছেয়ে গেছে।এপারে সাউথ সিটি তো ওপারে অবনী। কথায় বলে স্বভাব যায় না মল-এ। মলেও দাদু জিনিসপত্র হারান। ফেলে আসেন। একবার তো গায়ের কোটটাই খুইয়ে এসেছিলেন। মলের ফ্রি হেলথ চেক মেশিনে ব্লাড প্রেসার মাপতে বসেছিলেন। কোটটা খুলে রাখতে হয়েছিল। ওঠার সময় ভুলে গেলেন নিতে। ক্যামেরা দেখে ফেলেছিল। দেখে ফেলেছিল মলের কর্মীরা তিনি চলে আসার পর।পরের দিন কাস্টমার কেয়ারে যেতে তাই না ফেরত পেলেন। মলগুলি এমনিই। ছিমছাম। অমায়িক সুভদ্র ছেলেমেয়ে কাজ করছে। হৈহল্লা নেই। খুব বেশি হলে মৃদু স্বরে মিউসিক। টয়লেট গুলি এখন নাম পালটে রেস্ট রুম। ময়লা নেই। বদবু নেই। কেনাকাটা করে ভিড় থাকলে সেলফ চেক কাউন্টার । একটা সীমা অব্দি। পেমেন্ট ক্যাশে দিলে মেশিনের স্লটে ঢোকাও। কার্ডে দিলে স্লাইড কর। খুচরো চাই? এটিএম থেকে টাকা তোলা হয় নি? বিল কিছুটা বেশি পেমেন্ট করলেই কাম ফতে। কেনা জিনিস ফেরত দেবেন ? বিল আনেন নি ? হারিয়ে ফেলেছেন ? বার কোড স্স্ক্যান করেই না বিক্রি হয়েছিল। চিন্তা নেই। একে ভোলা মন। রেস্ট রুমের সুবাদে এখন ভাবুকও। এবার মলে যে কীর্তিটি করে বসলেন বলার নয়। যাকে বলে যা তা ! এতদিন যা হারিয়েছেন বা ফেলে এসেছেন মলের মধ্যেই। মানে ভিতরে। এবার মলের বাইরে যে পার্কিং লট মানে কিনা গাড়ি রাখার জায়গা সেখানে --- নাতি ছিল কার সীটে। কার সীটটি ট্রলির উপর। নাতিকে তুললেন গাড়িতে। বেমালুম ভুলে গেলেন বাজারপাতির কথা । মনে পড়ল বাড়ি ফিরে। তাও আরও ঘণ্টা তিন পর। মল ততক্ষণে বন্ধ। প্রথম কাতরে উঠলেন অশ্মর ঠাকুমা।-- সে যে অনেক টাকার জিনিস গো ! আফসোস পরপর সংক্রামিত হল। দাদু থেকে দাদুর ছেলে, ছেলে থেকে ছেলের বউ। আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠল দুঃখে। দাদুর মনে পড়ল , সে অনেকদিন আগে , বাজার থেকে স্কুটারে মাছ কিনে ফিরছেন। বাড়ির দরজায় রাস্তায় স্কুটার রেখে বাড়ি ঢুকেই মনে পড়ল --- মাছ? স্কুটারেই ফেলে এসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে এলেন। মাছ ততক্ষণে হাওয়া । এবার শুধু মাছ নয় , সঙ্গে আপেল , তৎসহ কলা – । যে পেল সে পড়ে পেল। ভাগ্যবান । যে পেল সে শুধু মাছ ভাজবে আর ভাজা মাছটি উলটে খাবে। কামড়ে খাবে আপেল। কুড়িয়ে পাওয়া। চুরির না। পেট পুরে খেতে দোষ কি ? মন খারাপ করে যে যার শুতে গেলেন। ভাবতে পারলে ভাল হত যাক যা গেছে তা যাক। ভাবা যায়! সকালে উঠেই বউমার উল্লাস। তার মোবাইলে মেসেজ এসেছে। এসেছে কাল রাতেই। ইস দেখা হয় নি তখন-- মাছ আপেল কলা ++ ফেলে গেছেন। নিয়ে যান। পাল্টা মেসেজ করে জানতে চাওয়া হল কখন গেলে পাওয়া যাবে। যে মেয়েটি মেসেজ করেছিল তার ডিউটি দুপুর দুটো থেকে। জানা গেল পার্কিং লট থেকে ট্রলি তোলার সময় জিনিসগুলি যে কর্মীর চোখে পড়ে সে কাস্টমার কেয়ারে জমা দেয়। তারপর ক্যামেরা আর মেশিন থেকে সনাক্ত করতে দেরি হয় নি ক্রেতা কে, কার। দেখুন কাণ্ড। এতক্ষন কলকাতা করে মরছি। ঘটনাটা কলকাতার নয়। ঘটেছে আমেরিকায় । ব্লুফিল্ডে । ভার্জিনিয়ায়। অকুস্থল স্যাম'স মল। sam's mall. অশ্মর দাদুর কাছেই স্বকর্ণে শোনা। দাদুকে প্রশ্ন করেছিলাম – আমেরিকায় চোর নেই ? দাদুর তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। তিনি থোড়ি বিশ্বাস করেন আমেরিকায় চোর নেই। তবে কি, তিনি জানালেন চুরি করতে হলে এখানে চোরকে গাড়ি চুরি করতে হবে প্রথম। রাস্তায় হাঁটার গল্প নেই। কিন্তু গাড়ি চুরি করে সামান্য শপ লিফটিং ! পড়তায় পোষাবে ? এমনও হয় তা হলে ? দাদু বললেন – আমাদের দেশে হবে---- কবে ?

ছোটগল্প - অরুণাচল দত্তচৌধুরী

একটি মোরগের গল্প
অরুণাচল দত্তচৌধুরী



বাবার হার্ট অ্যাটাক… মরণাপন্ন। খবর পেয়ে সপরিবারে নিজের গাড়িতে রওনা হল সুহাস। লম্বা রাস্তা। তবু সে নিজেই ড্রাইভ করবে। উপায় নেই, সময়ও নেই। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। দ্রুত সীমান্ত জেলা থেকে দমদমে ফিরতে হবে। যথাসম্ভব সতর্কতা ছিল। তবু, আচম্বিতে…খ্যাঁ …অ্যা……অ্যা…চ, টায়ারপোড়া গন্ধ। রাস্তার ওপর এসে পড়া মোরগটাকে রক্ষা করা গেল না। এরকম ঘটলে হুশ করে স্পিড বাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়াই দস্তুর। সেই প্রথা ভেঙে সুহাস কোনও মতে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করাল। ইস, টায়ার রক্তে মাংসে মাখামাখি। লালচে সাদা পালক লেপ্টে রাস্তায়, গাড়ির বডিতেও। দরজা খুলে নেমে নীচু হয়ে এ'সব দেখে আঁতকে ওঠা সুহাস মাথা তুলেই দেখতে পেল এর মধ্যেই প্রায় কুড়ি পঁচিশ জন মেয়ে পুরুষ ঘিরে দাঁড়িয়েছে। আরও কেউ কেউ ছুটে আসছে এখনও। আতঙ্কিত সুহাসের দিকে উত্তেজিত তর্জনীর মালিকরা গর্জন করে উঠল, -গাড়িটায় আগুন লাগা। ডেরাইভারটাকে পিটিয়ে মেরে ফ্যাল। ভয়ত্রস্ত সুহাস অজান্তেই হাত জোড় করে ফেলল। ওর বউ দীপা গাড়ি থেকে নামেনি এতক্ষণ। সুহাসের গাড়ি থামানোর বোকামিতে যারপরনাই বিরক্ত ম্যানেজমেন্ট পাশ দীপা জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল এ'বার। - আঃ, একটা মোরগই তো মরেছে। মরা মোরগ টা নিয়ে দামটা দিয়ে চলো তো তাড়াতাড়ি। কত দাম হবে দাদা, আন্দাজ… কথা শেষ হবার আগেই ধপাস! এক মাঝবয়সী মহিলা গাড়ির সামনে পিচ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। মুখের কষে ফেনা। সঙ্গে হাতপা'র সামান্য খিঁচুনি। সমস্বরে জনতা আর্তনাদ করে উঠল। - আ হা হা গো। মোরগ কোথা? ও'তো সুন্দরীর ছেলে ছিল। আরও ঘনিষ্ঠ দু'একজন বলল, -গত জন্মদিনে ভালো একটা নামও রেখেছিল… মিত্যুঞ্জয়। কাজেই মোরগ মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ নয়, মিত্যুঞ্জয়ের 'দাহ খরচ'… শ্রাদ্ধশান্তির জন্য চারহাজার আর মৃত্যুঞ্জয়ের মা'র চিকিৎসাখরচ একহাজার, মোট পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে যাত্রা শুরু হল। ভাগ্যিস বাবার চিকিৎসা বাবদ রাখা টাকাটা সাথে ছিল। গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে সুহাস স্পষ্ট শুনল কেউ বলছে -ও সুন্দরী, ও'টাকে কাটাকুটির আগে ভালো করে ধুয়ে নিস কিন্তুক। গাড়িতে যেতে যেতে দীপা ভাবছিল, টাকাটা তো গেলই… মোরগটাও। সুহাসের মাথায় ঘুরছিল সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রশ্ন। কিছুটা হাস্যকর যদিও। আচ্ছা, ওই যে বলল মোরগের জন্মদিন, সেটা কবে? যে দিন ওর মা ডিমটা পাড়ে, নাকি যে দিন ডিমের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে ছানাটা?

ছোটগল্প - সরদার ফারুক

মানুষজনের গল্প
সরদার ফারুক



সীমান্তের কাছের এক মফস্বল শহর । থানা শহরে যেরকম থাকে - একটা ছন্নছাড়া রেলস্টেশন ,ঘেয়ো কুকুরের ঘোরাঘুরি , ব্যস্ত বাস স্ট্যান্ডের পাশে চা সিঙ্গাড়ার দোকান ,কয়েকটা টিনের বেড়ার আড়তের পরেই একমাত্র সিনেমা হল । হলে শো শুরু হবার আগে দর্শক টানতে মাইকে গান বাজে - তুমি যে ডাকাত , তুমি যে চোর / চুরি করেছো হৃদয় মোর ।কেবলমাত্র আজানের সময়ে কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে ।স্টেশনের দিকের রাস্তায় কিছুদূর এগুলেই বড় বড় শিরিষের তোরণের পাশেই করাতকল ।করাতকলের লাগোয়া চায়ের দোকানটাই ইয়াসিনের ।দুপুরবেলা ইয়াসিনের দোকানে রাতজাগা মানুষেরা আস্তে আস্তে অসময়ের ঘুম থেকে উঠে ভিড় জমায় । আজকের আড্ডাটা অনেকক্ষণ জ্বাল দেয়া দুধের মতোই ক্রমশ গাঢ় আর স্বাদু হয়ে উঠছে ।মমিনের বউয়ের লুজ ক্যারেকটারের গল্প (মমিন আড্ডায় অনুপস্হিত ) ,দেশে কেয়ামতের আলামতের নানাবিধ বিবরণ থেকে আড্ডার বিষয়বস্তু এখন পুলিশ সংক্রান্ত নানা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বর্ণনার দিকে মোড় নিয়েছে । দেখা যাচ্ছে প্রায় সবারই একটা করে বলবার মতো দারুণ সত্য ঘটনা আছে ,আর একজন আরেকজনের আগে সেই গল্প বলার জন্য প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছে ।সম্মিলিত কোলাহলে আড্ডা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে বেল্টু মিয়া আর বসে থাকতে পারেনা , ফ্যাঁসফেঁসে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে -‘ সুমুন্দির ছেইলেরা থাম , তুরা কি মানসির পয়দা ? একজন একজন কইরে কতি পারিসনে বাড়া ?’

ধমকে কাজ হয় । বেল্টু মিয়াকে সমীহ না করে উপায় নেই - কষ্টিপাথরের মতো নিকষকালো বিশাল দেহ , ধবধবে সাদা বুকপকেটওয়ালা পাঞ্জাবীর ফাঁক থেকে উঁকি দেয়া গোল্ডলিফের প্যাকেট আর পাঁচশো টাকার নোট তাকে একটা অন্যরকম মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে ।

কিছুক্ষণ নীরবতার পর ল্যাংড়া আজিবর গলা খাকারি দ্যায় , মনে হয় কোন একটা কথা বলার জন্য সে সাহস সঞ্চয় করছে । বেল্টু বলে ওঠে -‘ এই শালা ন্যাংড়া তুই আগে ক’ ,তোরতো শালা অনেক অভিজ্ঞতা-পুলিশের বাখারি খাইয়েই তো তুই ন্যাংড়া হয়ছিস !’

আজিবর বলে ওঠে -‘সিডা সত্যি কতা , কিন্তু আমরা যারা বর্ডারের এদিক ওদিক ঘুইরে পেট চালাই তাগের সগলেরই মাঝেমদ্যি কচন খাতি হয় !এখেনে কিডা আছে বুকি হাতদিয়ে কতি পারে একবারো পুলিশির ঠাপ খায়নি ?’

আবারো নীরবতা নেমে আসলে ,বেল্টু মিয়াই নীরবতা ভেঙে নরম স্বরে বলে - ‘কদিনি ,এ্যাতো তত্ত্ব কতা বাদ দিয়ে ।’

আজিবর নেভী সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে বলে -‘একবার সাইকেলের টিউবের মদ্যি ফেনসিডিল আনতিছিলাম ।বর্ডার পার হতিই এ্যাক শালা হাবিলদার ধইরে বইসলো - মনে হয় আমাগের মদ্যিই কোনো বাইনচোত খবর দিয়িলো !অবশ্যো হাবিলদারডা খুব ভালো ,আমারে কিছু না কইয়ে সুজা এসপি সাহেবের কাছে নিয়ে গেলো । আমারে পরথম লাথিটা মাইরেলো স্বয়ং এসপি সাহেব , কোন কনেস্টবাল আমার গায় হাত দ্যায়নি !’

বারবার এসপি সাহেবের কথা উল্লেখ করতে করতে একধরনের অহংকারের ভাব ফুটে উঠছিলো আজিবরের ভাঙা চোয়ালে আর ঘোলাটে বাল্বের মতো চোখে ।

আজিবরের গল্প শেষ হতেই টেকো শমসের বলতে শুরু করলো তার দেখা এক সত্যি ঘটনা ।কিছুদিন আগে নাকি সে ট্রেনে করে কালিগঞ্জ থেকে খুলনা যাচ্ছিলো ,পথে শুরু হ’ল চেকিং ।মেয়েছেলেদেরও গায়ে হাত দিয়ে চেক করছিলো জি আর পি। এমন সময় একজন যুবতী মেয়ে পুলিশকে বলে উঠলো -‘দ্যাকো বাবা , তুমার সুমান একটা ছেইলে আমারও আছে পুলিশ ডিপারমেনে -গায় হাত দিবানা !’

পুলিশটি হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে -‘তোমার এই বয়সে আমার মতো ছেইলে ?’

যুবতীটি উত্তর দেয় -‘ সিডা অবশ্যি আমার বিয়ের আগের ছেইলে , আর শুনিছি বিয়ের আগের ছেইলে ছাড়া তোমাগের ডিপারমেনে ন্যায়না !’

ঠা ঠা হাসিতে ফেটে পড়ে ইয়াসিনের দোকান । বেল্টু মিয়া একটা গোল্ডলিফ এগিয়ে দেয় টেকো শমসেরের দিকে ।

ছোটগল্প - অজিত দাশ

শহরে কাকের মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু ব্যথা
অজিত দাশ




আজকাল নিজেকে নিজের কাছে অপরিচিত করে তোলার সৌখিন পদ্ধতি আমার চারপাশে খাঁ খাঁ করে। মস্ত বড় দালান উঠে গেলে উচ্চতার দখলে আয়তনকে যেমন চোখে পড়ে না আমারও ঠিক তেমন দশা। একটা অস্পষ্ট তাড়না, শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার- এত উচ্চতায় পৌঁছেছে যার আয়তন ঠিক জানা নেই। না হয় কেন মাহবুব আজিজের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি। অথচ মাহবুব আজিজ আমার চব্বিশ ঘন্টার বন্ধু, আমাকে ঠিক আমার মত করে না জানলেও আমাকে জানার পদ্ধতি তার বেশ রপ্ত তাই কয়েকদিনের পর্যবেক্ষনে আজ হুট করেই বললো- কিরে কিসের এত ব্যাথা? মিনুর কোন খোঁজ খবর আছে? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকলেও হঠাৎ নিজেকে কাগজের মতো দলা পাকিয়ে গুটিয়ে নেই। সারটেইন অ্যাবসারডিটি- মাহবুব আজিজ জানে। আমার কতগুলু বাতিক তার স্পষ্ট করে জানা তাই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ল্যপ্টপের অজুহাত দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সারাদিন ব্যাস্ততার মধ্যে দিয়েই সকাল-সন্ধ্যা। ক্লাইন্ট-এমপ্লোয়ি, এমপ্লোয়ি-প্রোজেক্ট, প্রোজেক্ট-মানি। নিজস্ব ফার্ম। থার্টিসিক্স এমপ্লোয়ি। তিল তিল সৌভাগ্য জোড়াতালি দিয়ে আজ এইখানে। মাহবুব বলতো-শালা টাকা ইনকাম কোন কঠিন কিছু নয়রে, এর বাইরে কোন কিছু ইনকাম করাই কঠিন। এই যেমন ব্যালকনির একটা অস্পষ্ট আবহাওয়া ,মানি প্ল্যান্টের চকচকে পাতায় বছরের কয়েকটি দিনের আর্তনাদ আমি ঠিক ঠিক টের পাই। মানে আমারই কিছু পাওয়া না পাওয়া ব্যালকনির এই আয়তন জুড়ে রোপন করে দেই। দৃশ্যত নিজের কাছে উবু হয়ে থাকি। ক’জন পারে। বড্ড বেশি কঠিন এই ইনকাম। ইনডিফারেন্স! ইটস এ পাওয়ার টু গেট সামথিং এলস। টুং করে মোবাইলে টেক্সট এল- ‘বাবা তুমি ব্যাস্ত আছ কিনা ঠিক জানিনা। তাই টেক্সট করলাম। বিকেলে আসছি তাড়াতাড়ি এসো।’ আমার কমবয়সী মেয়ে মিনু। মানে আমার ছোট মিনু। মিনু বলতে আমার আরও একজন মিনু আছে - ধর্মপুরের দোতলা বাসায় থাকে। জার্মান প্রবাসী বাবা-মা। টাকা পয়সা ঢের তবু পলেস্তরা খসা বাড়িতেই তার সারাদিন ভাল লাগে। জানালার পাশে কাঠগোলাপ, স্বর্ণচাপা তবু পলেস্তরার নিয়মিত গন্ধই তাকে বেশ আকৃষ্ট করে। নিয়মিত বলতে তার ভাষায়- ‘একটা জ্যান্ত শরীর। যতদিন আমরা এই নিয়মিত শব্দটি ব্যাবহার করি ঠিক ততদিন একটা জ্যান্ত শরীরী স্বাদ আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমাদের বাঁচতে শিখায়।’ মিনুকে এখন আর তেমন ভাবতে ইচ্ছে হয় না। অথবা ইচ্ছে করলেও সময়কে ঠিক ধরতে পারি না। সময়ের অনুপস্থিতি খুজতে গিয়ে কাগজে আকি ঝুকি করি। কোথাও লিখি ‘হত্যা’, কোথাও ‘পুড়ে যাওয়া সোনা’, মৌনতা ইত্যাদি। খুব যৌবনে যাকে ধ্রুব বলে ধরে নিয়েছি তারও যে তিনটি স্তর আছে কে জানে। ইশ ভালবাসা! ভার্সিটি পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর জীবনের অনিচ্ছা শক্তি ঢেকে শেখেরটেকের এই বাড়িতে আমার বাকী জীবন। মিনুর গোছানোর প্রয়োজন ছিল তাই তার মতে সম্পর্ক যতটা দীর্ঘ হলে চলে ততটা মানাসই তার চেয়ে বেশি কিছু মানে একটা অস্পৃশ্য ইমোশান। অবশ্য আমারও কোন অনুযোগ ছিল না। বস্তুবাদ বুঝি যথেষ্ট রেশনাল হোমু সেপিয়েন্স। তবুও অন্ধকার ঘরে তার শরীর মাখা প্রজাপতি আমাকে দিনের পর দিন এমনভাবে শাসন করে ইচ্ছে হয় আরও একবার ফিরে যাই তার কাছে। আরও একবার সাপের মত খামচে ধরি তার শরীর। আরও একবার চষে বেড়াই নানুয়া দিঘী থেকে ধর্মসাগর, রামঘাটলা...। আমারও ইচ্ছে হয় অফিস ফেরত জীবনে নিকট সুখের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে দেখি। মানে নারী-পুরুষ খেলা। যত্নের একটা সামঞ্জস্য টেনে টেনে বুকপকেটে তোলে নেই। শাসনের একটা গন্ডির কাছে নিজেকে দাঁড় করিয়ে বিশ্বস্থ হই। এই যেমন মাহবু আজীজ- অফিস ফেরত জীবনে ছোট একটা ফুটফুটে মেয়ে, আর অপেক্ষার খুনসুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী। একটু দেড়ি হলেই মাহবুবব আজিজকে ঠিক কাঠগড়ায় তুলে ফেলে মৃত্তিকা- কি ব্যাপার এতক্ষণ কই ছিলে, অফিসে কোন নতুন মেয়ে এমপ্লোয়ি এসেছি নাকি। মনোজিত দা অনেক আগেই ফিরেছে। তুমি...? । মাহবুব আজিজের একটু দেড়ি হলে সাই সাই করে আমার কাছে ফোন চলে আসে- দাদা কোথায়? একসাথে? নাকি চলে এসেছেন? মৃত্তিকার একেবারেই সহ্য হয়না অফিস শেষে কোনা আড্ডা, দেড়ি করে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে গেলেই চায়ের উপর চা। একটা মলিন আগ্রহ নিয়ে সংসারের সবগুলু টুকি-টাকি যেন একবার নেড়েচেরে আমার কাছে দিব্যি বলে যায় । এটা হয়নি, এটা লাগবে, এটা পেয়েছি, আরও গোছিয়ে কিনব ইত্যাদি। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। কি আশ্চর্যভাবে নারীরা তাদের জীবনে বিপরীত লিঙ্গের প্রভাবকে শুদ্ধ করে নেয় , সবচেয়ে জঘন্য পুরুষের সমস্ত শুষ্কতা সে ধুয়ে মুছে নেয় নিজের শুদ্ধতা দিয়ে। হুট করেই প্রশ্ন করে বসে- দাদা বিয়েটা করলে না কেন। আমি আতকে উঠি- তড়িঘড়ি উত্তর দিয়ে বসি আমাকে যে কেউ বিয়ে করেনি। একটু গম্ভীর সুরে আবার জবাব দেয়-‘তোমার রসিকতা ঠিক বুঝি না...।’ তারপর নিজের মধ্যে উবু হয়ে ভাবতে থাকি। একটা আবহ শুন্যতার সঙ্গীত আমার চারপাশকে কামড়াতে থাকে। চিবুতে চিবুতে ঠিক মিনুর কাছে নিয়ে যায়। সেই ধর্মপুরের দোতলা বাসার মিনু। গান্ধর্ব বিবাহ মতে মিনু আমার স্ত্রী। যে বিবাহে পাত্র-পাত্রী পরস্পরের প্রতি অনুরাগ বশত দেহ-মিলনে আবদ্ধ হয়, বেদের ভাষ্য অনুযায়ী তাকে ‘গান্ধর্ব বিবাহ’ বলে। এই বিবাহে পাত্র-পাত্রী গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করে মৈথুন ইছা ঘটায়। অবশ্য মৈথুন ইচ্ছাই সম্পর্কের শ্রেষ্ঠ পরিনতি নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলবত থাকলে আর দশজনের চেয়ে আমরা যেমন বিশেষ ক্ষমতা অনুভব করে অস্তিত্বের একটা বিশেষত্ব দাঁড় করিয়ে দেই। সম্পর্কেও ঠিক তেমন কিছু লাগে। মিনু বলতো নির্যাস। আমি এখনো বুঝে ওঠতে পারিনি। হঠাত টুং করে মোবাইলে ম্যাসেজ- বাবা কোথায়? আসছ না যে? মাঝে মাঝে ছোট মিনু এসে কয়েক দিন থেকে যায়। প্রয়োজনীয় ছোট-খাট জিনিস পত্র নিয়ে, সাথে নতুন রিলিজ হওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন লোক শুধু রবীন্দ্রনাথের গান শোনে এটা তার ভাবতেই বিস্ময় লাগতো। মাঝে মাঝে আমাকে ঠাট্রা করে বলতো- বাবা যতই রবীন্দ্রনাথ শোন না কেন একনের গান না শোনলে কিন্তু স্বর্গে যাবেনা। মিনুকে দেখলে মাঝে মাঝে খটকা লাগে। ভাবতে অবাকা লাগে এ সেই মিনু যে উল্টে-পাল্টে একটা সোঁদা জীবনকে সুগন্ধীময় করে দিচ্ছে। আমি বলি

-থাকনা আর কত ছেড়ে দে।

-তোমার এই চাপিয়ে দেয়া অভ্যাস টা গেলো না। নিজেকে নিয়ে কজন মানুষ থাকতে পারে বল। সবাই কি পারে তোমার সেই ‘বি অবজার্ভার নট অবজার্ভড’ মেথড ফলো করতে। আমার একটা কিছু লাগবে। ধরে নিতে পার সেটা সিম্বোলিক।

-হুম... তাই কর। মৃত্যুর পর কোমড়ে বেঁধে সুখটাকেও সাথে নিয়ে যাবি যখন দরকার একটু একটু খরচ করবি। কি বলিস?

একটা আচমকা নিস্তব্ধতা মিনুর চারপাশে। কথাটা না বাড়ানোর আগ্রহ নিয়ে একটু আক্ষেপের সুরে বললো

-মার খোঁজ খবর নিয়েছো। তোমার বড় মিনুর?

আমি চুপ করে থাকি। মিনু ঠিক বোঝতে পারে সময় কতটা বেমানান। তাই দুজন দুজনকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা দিয়ে আটকে দেই,যে যার মত করে। মিনুর জন্ম হওয়ার ছয় বছর পর তার মা এক সন্ধ্যায় শেখেরটেকের বাসায় এসে হাজির। সাথে ফুটফু্টে গোলাগাল গড়নের একটি মেয়ে অবিকল সেই আগের মিনু; পাঁচবছর পর এতটা অস্পষ্ট লাগছিল তাকে, মুখের দিকে তাকাতে না তাকাতে বলে ওঠল- তোমার পুরানো মিনুকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। তুমি জান তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। মিথ্যে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ওকে বড় করেছি। আর পারছি না...। ঘাপটি মেরে তাকিয়ে ছিলাম তার মুখের দিকে; মুখের একেকটি ভাসমান রেখা যেন আমাকে বলেছিল তুমি এখনো বদলাওনি মনোজিত কেন যে ব্যাথাকে ব্যাথা বলে জান? মানুষের যেদিকে স্বাভাবিক বিকাশ চিরকাল সেদিকেই তার লোভ। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই মুখতুলে বলছিল আমাকে আর দেখতে যেওনা। আমি চলে যাচ্ছি । নিরঙ্কুশ কোন কিছুর প্রতিই আমার বেশিদিন মোহ থাকে না। বলতে পার খাঁটি জিনিসের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। তোমার কি মনে নেই ইউরোকিংয়ের সেই বিকেল? চাইনিজ পর্দা আর বিনয়ের স্বচ্ছ ফড়িং যে ডানা মেলেছিল গায়ত্রীর বুকে। সেই আমাদের শেষ দেখা। তারপর শুরু হল কত বছরের অজ্ঞাতবাস।



যেই পাঁচ বছর বয়সী মিনুকে কাছে পেলাম বিলম্বিত প্রসব যন্ত্রণার মতো বুকের সমস্ত আবিরে ঘোলা হয়ে গেল বাড়ির আশপাশ। বুঝেছি পিতৃস্নেহের জ্বালা বুঝিয়ে দিতে মিনুর এই কারবার। ছোট মিনু অবিকল তার মায়ের মতো। চোখের গড়ন, উচ্চতা, স্বভাবের রং। কিন্তু বুদ্ধি আর মেধায় বাবার কাছাকাছি। সহজ কথা ঠিক সহজে বুঝবার ক্ষমতা যেমন আমার ছিলনা ছোট মিনুরও ঠিক একই দশা। আংগুল কাঁটার ভয়ে যে মেয়ে বছরের পর বছর ছুড়ি ধরেনি, জাগতিক অর্থে সে বোকাই। অথচ মায়ের মতোই একদিন আবিষ্কার করে চিরকুটে লিখেছিল-‘বাবা কাল তোমাকে পেয়াজ কেটে দেখিয়ে দিব। আমি এতদিন পর আবিষ্কার করেছি নিজেকে দংশন করার প্রস্তুতিও মানুষকে ভিতরে ভিতরে অনুশীলন করে নিতে হয় নইলে আগুন্তুক হয়ে তাকে ঠিক আঘাত করা যায় না। তুমি ঠিক বলেছ-মানুষের খোলস বদলানোর প্রয়োজনীয়তা আছে।’ মানুষ যে খোলস বদলাতে পারে তা সর্বপ্রথম আমাকে শিখিয়েছে মিনু। সে বলতো - প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে মানুষ খোলস বদলায় না। মানুষ ততটা বিল্ট ইন হতে পারে না। তাকে শিখে নিতে হয়। আমাদের ভিতরটা চিরকাল শিশু থাকার ইচ্ছা পোষণ করে তাই দুঃখ, ব্যাথা, যন্ত্রণা উপশমের ব্যাপারে আমরা শুচিবায়ূগ্রস্থ হয়ে থাকি। যেই আমরা খোলস বদলাতে শিখি পদার্থের নিয়ম অনুসারে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করতে না পারলেও ভাবতে পারি। সেটা সচেতন মনে না হলেও অবচেতন মনে। তাতে কিছুটা স্বস্থি মেলে। এই যেমন ধর তুমি সেই কলেজ থেকে আমাকে এত চেয়েও জানাতে পার নি। নিজেকে বিন্দু পরিমাণ বদলাতে শিখনি মনোজিত। আমি না বুঝলে এতদিনে সর্বনাশই হয়ে যেত। কী আশ্চর্য এত কম বয়সেই- প্যাথ টু হায়ার কনসাসনেস, চয়েসল্যাস এওয়ারনেস এরকম বই বুঝে গেছ । আল্টিমেট কি লাভ বল? এস্কেপ! একপ্রকার পলায়ন; জীবন থেকে না হয় সময় থেকে। মিনুর মুখের ওপর কিছুই বলার সাহস হয়নি তখন। এখনো নেই... মুহূর্তে ব্যল্কনির নীলাভ অন্ধকার নেমে আসে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। ব্যাথার উৎস অনুসন্ধানে ব্যার্থ হই বলে তাকে অস্বীকারের কোন পথ খুঁজে পাই না। টুং করে মিনুর এসএমএস সমস্ত নিস্তব্ধা ভেঙে খান খান করে দেয়। বের বের হতে হতে মাহবুব আজিজ জিজ্ঞেস করে- কিরে জানালিনা কিন্তু? ক্রমশ অন্ধকার ঘোলা করে হঠাৎ নিজের অজান্তেই বলে ওঠি ও হ্যাঁ কিছু ব্যথা আছে , শহরে কাকের মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু ব্যাথা।

ছোটগল্প - সোম সরকার

নষ্ট
সোম সরকার



সময়ের বিশ্রাম দরকার । একটু হলে-ও দরকার । ঘড়ির কাঁটা তিনটে একসাথে মোটা সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা হোক । জীবনের সব জামাকাপড় এমনকি অন্তর্বাসসহ লুকিয়ে রাখা হোক । কিয়ৎকালের নগ্নতা-ই তার চলার পথ অবরোধ করবে । নিশ্চিত বাধা ।

ঘরের কোণে রাখা ডাস্টবিন এখন সময়ের বিশ্রামঘর । সাময়িক । জীবনের সমস্ত জঞ্জাল , অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর , উপেক্ষিত মালগুলো বের করে সাফ করতে হবে । দু'তিন ফোঁটা vim দিয়ে ঘষে মেজে সময়োপযোগী করে তুলতে হবে ডাস্টবিনটাকে । সাথে একটু

বের করে রাখা অব্যবহৃতগুলি একসাথে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা ম্যাট্রিক্স বানাতে হবে । হেডিং-এ থাকবে ফেলা আসা সময়ের কোড , প্রতিটা কোডের আন্ডারে রাখা হবে সেই সব ডাস্টের নিজস্ব আইডেন্টিটি নাম্বার । সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে । দেখতে নিশ্চয়-ই বিদঘুটে লাগবে । কিন্তু কিছু করার নেই ।

ডাস্টবিনের মুখে বিছানা বেঁধে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করবে সময় । আধশোয়া অবস্থায় । বিছানার তলা থেকে টপ টপ করে ক্লান্তির ফোঁটা পড়বে । যতক্ষণ বা যতদিন না পড়া থামে ।

তার চোখ থাকবে ওদিকে ম্যাট্রিক্সটার দিকে । অবাক হয়ে দেখবে । ভাববে কেন এতকিছু নষ্ট হয়ে গেলো বা করতে হলো ?

সময় কি এতদিন ধরে নষ্ট হওয়ার জন্যে দৌড়য় ? শুধু শুধু ?

ব্যক্তিগত গদ্য - অর্জুন চক্রবর্তী

অনুভূতির দোরগোড়ায়
অর্জুন চক্রবর্তী



সেদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল, আকাশ কালো মেঘের কল্যাণে নিজের জৌলুষ হারিয়েছে । মুম্বাইয়ের বর্ষাকাল যে কি যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু তারাই বুঝবে যারা ওখানে থেকেছে । সমুদ্রের গায়ের সাথে সেঁটে থাকা বেশ বড় বাংলোর মুখে হুমড়ি খাওয়া বারান্দায় বসে আমি আর বাসুদা ( বিখ্যাত পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য ) গরমাগরম তেলে ভাজা সহ চায়ের ওপর ভর করে আড্ডায় বিভোর । এখানে বলে রাখি, বাসুদার সাথে আমার পরিচয় - প্রথম যখন আমি মুম্বাই যাই তখন থেকে । আমি গুলজারের সহকারী হয়ে কাজ আরম্ভ করার পর সম্পর্কটা আরো কাছের মনে হত । এককালের স্বনামধন্য পরিচালক বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন গুলজার ও বাসু ভট্টাচার্য দুজনেই, সেই হিসেবে ওরা গুরুভাই । বিমল রায়ের সহকারী এবং পরবর্তী কালে স্বাধীন ভাবে কাজ করে সম্মান, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ( র্হিষিকেশ মুখার্জি, দেবু সেন, মুকুল দত্ত , আরো অনেকে ) এদের মধ্যে এরা দুজনেও ছিলেন । এদের সাথে কাজ করে আবার অনেকে নিজেদের প্রমান করেছেন, যেমন- বাসু চ্যাটার্জি ( বাসু ভট্টাচার্যের সহকারী ছিলেন ) গুলজারের সহকারী মেরাজ , রাজ. এন. সিপ্পী. এন. চন্দ্রা ( যাঁর বিখ্যাত ছবি 'অঙ্কুশ' এ আমি অভিনয় করেছিলাম ) এবং আমি নিজে । হৃষীকেশ মুখার্জি’র সহকারী ছিলেন বীরেশ চ্যাটার্জি, যাঁর ছবি 'কড়ি দিয়ে কিনলাম' এক সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল, তাতে সনাতনের ভূমিকায় অভিনয় করে আমি প্রচুর সুখ্যাতি কুড়িয়েছি । এটি এক বিশাল পরিবার ও আমি এই পরিবারেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ, এরকম ধারণা শুধু আমার নয় আমাদের সবার মনে ভালো ভাবে বাস করে, এখনো । এই ধারাবাহিকতাকে এনজয় করি আবার গর্বও হয় এই ভেবে যে এক সূত্রে বাঁধা এত মনিষীদের সাথে আমিও আছি। চারবছর ভাই-এর ( আমি ' গুলজার ' কে এই নামেই সম্বোধন করি ) সঙ্গে কাজ করার পর, দক্ষিন ভারতীয় বিখ্যাত পরিচালক কে. বালাচান্দারের ছবি 'জারা সি জিন্দগী'তে বেশ বড় একটি চরিত্রে অভিনয় করে অভিনেতা হয়ে যাই তারপর আমারই গুরুভাই এন. চন্দ্রা ‘অঙ্কুশ’ ছবিতে আমায় মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ দিয়ে আমায় জনপ্রিয় করে তোলে । সেদিন বৃষ্টিভেজা দুপুরবেলা বাসুদার সঙ্গে বসে চা, তেলেভাজা খেতেখেতে সেই সব স্মৃতি আওড়াছিলাম, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো, কথা সেরে বাসুদা ফিরে এলেন, তাঁকে যেন একটু বিচলিত মনে হলো ।

"মৃনালদা মুম্বাইতে আছেন, আমার এখানে আসছেন আজ, এখুনি" । বাসুদার কথা শুনে আমিও উত্তেজিত, সেই ‘বাইশে শ্রাবণ’ , ‘কলকাতা ৭১’, ‘ভুবন সোমে’র মৃনাল সেন ! যাঁর 'নীল আকাশের নিচে', 'খারিজ', ওকা কুরি কথা' আলোড়ন তুলেছিল এককালে, সেই মৃনাল সেন ! অন্য এক কাজে যাবার তাড়া ভুলে গেলাম ! কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটে । দরজার বেল বাজলো । হন্তদন্ত হয়ে বাসুদা যাঁকে নিয়ে এলেন, প্রথমে তাঁকে দেখে, পরে তাঁর সাথে কথা বলে মন ভরে গেল । ধপধপে সাদা সুতির পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় উষ্কখুষ্ক কাঁচা-পাকা এক রাশ ঘন চুল, চশমার মোটা কাঁচ ভেদ করা তীক্ষ্ণ এক জোড়া অস্থির চোখ, ঠোঁটের ডগায় হালকা মুগ্ধ করা হাসি যেন সর্বক্ষণ সঙ্গী । ওনার গল্পে, প্রশ্নে, উচ্ছাসে - সারা বাড়ি যেন জেগে উঠলো । রিঙ্কি বৌদি ( বাসুদার স্ত্রী ও বিমল রায়ের কন্যা ) চা, সিঙ্গাড়া নিয়ে এলেন । সরল, সোজাসাপটা কথা, গল্পে সব কিছু কেমন যেন সুন্দর হয়ে উঠলো । বাসুদা মৃনাল্ দা কে আমার কথা বলাতে উনি চমকে তাকালেন আমার দিকে, কারণটা ওনার কথায় বোঝা গেল । "আরে ! আমি তো ভাবলাম ও নর্থ ইন্ডিয়ার ছেলে, তা তুমি হিন্দি বলতে পারো ?" বাসুদাই আমার দুটো হিন্দি ছবি ও আমার গুলজারের সাথে সহকারিতার কথা ওনাকে বলাতে মুশকিল আসান ! অনেক্ষণ আমার হাত ধরে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন । "আমি একটা ছবি করব, হিন্দিতে, রমাপদ চৌধরীর গল্প - 'বীজ' । তাতে একটা চরিত্র, তুমি করবে ?" আমার মনে হল যেন হাওয়ায় ভাসছি ! সজোরে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতে যাব, উনি বলে উঠলেন, "শোনো তুমি আবার রাজেশ খান্নার মত গাছের ডাল ধরে গান করার জন্যে বায়না কোরনা যেন, আমি ওসব পারবনা !" সবাই এই কোথায় হেসে যখন লুটোপুটি খাচ্ছে, তখন আমি বোকার মতো ওনাকে বোঝাবার চেষ্টায় ব্যস্ত যে আমার সেরকম কোনো চাহিদাই নেই ! কলকাতায় শুটিং, আমায় কবে যেতে হবে, কবে থেকে কাজ আরম্ভ, সব বলে দিলেন । কলকাতায় আমার নিজস্ব বাড়ি আছে জেনে খুব খুশি । উনি চলে যাবার পরও আমি অনেকক্ষণ বসে রইলাম বুঁদ হয়ে । যথাসময় কলকাতায় পৌঁছে ওনার বেলতলার ফ্লাটে গেলাম, কাজের লোক থাকা সত্তেও নিজেই দরজা খুলে আমায় দেখে হইহই করে উঠলেন । কিছুটা সময় কালো চা সহ আড্ডা , মুকুল বাবু ( মৃনাল’দার প্রোডাকশন দ্যাখেন ) আমায় অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কাগজে সই করালেন, এরই মধ্যে মৃনাল’দা দুবার উঁকি মেরে বলে গেলেন, 'টাকাকড়ির ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হলে আমায় বোলো, লজ্জা কোরনা । আমি শুনেই লজ্জা পেলাম ! আবার আড্ডা, একসময় আমায় জিগ্যেস করলেন "তোমার পরা পুরানো পাজামা আছে, শুটিং এ লাগবে ?" আমি তখন বাড়িতে বারমুডা বা বাবা কাকাদের মতো লুঙ্গি পরতাম, লুঙ্গির কথা শুনে উনি বলে উঠলেন, "না না লুঙ্গি না, লুঙ্গি পরে থাকলে মনে হয় You are easily available ! "হা হা করে সবাই হেসে উঠলো, দেখি উনিও মিটিমিটি হাসছেন ! একথা ওকথার পর আবার প্রশ্ন, "তুমি তো গুলজারের সহকারী ছিলে, তার মানে হিন্দিটা ভালই জানা আছে ?" চায়ে চুমুক দিয়ে মৃনাল’দা আমার দিকে তাকালেন । আমি কিছু বলার আগে ওখানে বসা একজন বলে উঠলেন, "অর্জুন তো হিন্দি বেল্টের ছেলে, ওর জন্ম ওদিকে, হিন্দি জানবেনা ?" ব্যাস আর কোনো কথা নয় আমাকে এই ছবির হিন্দি সংলাপ লিখে দিতে হবে এবং সংলাপ পরিচলকের দায়িত্বও সামলাতে হবে ! ওনার আবদার । রাজি না হয়ে উপায় নেই । যথাসময় অরোরা ষ্টুডিওতে শুটিং আরম্ভ হলো । সে সময় আমার গাড়ি ছিলনা, মুকুল বাবু কিছু বলার আগেই মৃনাল’দার গলা, "অর্জুন’কে আমি পিক আপ করব, ও তো পূর্ণ দাস রোড-এ থাকে, কাছেই, অসুবিধে হবেনা ।" মৃনাল সেন ! প্রতিদিন, তাঁর আম্বাসাডার গাড়ি করে আমায় তুলে ক্যামেরাম্যান কে. কে. মহাজন’কে তুলে ষ্টুডিও যাচ্ছেন ! ভাবা যায় ! শাবানা আজমি, শ্রীরাম লাগু, উত্তরা বাওকর, অনিল চ্যাটার্জি, অপর্ণা সেন, রূপা গাঙ্গুলি আরো অনেক ভালো ভালো অভিনেতা ছিল, যাদের সাথে কাজ করে যে কি আনন্দ পেয়েছিলাম তা ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝানো যাবেনা । আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি এই ভেবে যে, কে. বালাচান্দার থেকে গুলজার, এন. চন্দ্রা থেকে তপন সিংহ, নব্যেন্দু চ্যাটার্জি থেকে মৃনাল সেন ! কত সত্যিকারের পরিচালকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি । কামাল হাসান, নানা পাটেকার, নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, দীপ্তি নাভাল, নীলু ফুলে, আবার ভারতী দেবী থেকে মুনমুন সেন, হরিধন ব্যানার্জি থেকে হারাধন ব্যানার্জি । কত শিল্পী, কত কিছু শিখলাম, জানলাম, আজও শিখে চলেছি । আমার পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবি, 'টলি লাইটস্‌' যখন বেরোল, স্বয়ং গুলজার ভাই এসেছিলেন মুম্বাই থেকে । ছবি দেখে মুগ্ধ ! আমার ছবিতে গীতা দে’র অভিনয় দেখে ভাই বলে উঠলেন, "ওনার অস্কার পাওয়া উচিত !" আমার মুখে কথা নেই । গুলজার ভাই আমায় আশীর্বাদ করে মুম্বাই চলে যাবার কয়েকদিন পর আমার ফোনে একটি কন্ঠস্বর ভেসে উঠলো । সেই অতিপরিচিত গলা ! মৃনাল সেন ! আমাদের প্রিয় মৃনাল’দা ! "কী ! মুম্বাই থেকে গুলজার এসে তোমার ছবি দেখে যাচ্ছে ! আমায় ডাকলেনা ! কেন ?" কি বলব কি বলব করে আমতা আমতা করে মুখ দিয়ে সত্যি কথাটা বেরিয়ে গেলো ! "দাদা আমার সাহসে কুলোয়নি, আপনাকে ডেকে আমার ছবি দেখাবো !"

“ওসব কথা ছাড়ো , কবে দেখাবে বল ?"

"যেদিন আপনি বলবেন !"

"আরে আমি তো বাড়িতেই বসে, তোমার কবে সুবিধে জানাও ?"

"আজ দেখবেন ? প্রিয়া তে ? কাছেই , আমি নিজে গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবো !" আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল !

"না না তার দরকার নেই, আমি চলে আসবো, তুমি থেকো কিন্তু ।"

অন্ধকার সিনেমা হল, আমার পাশে সেই মৃনাল সেন ! নীল আকাশের নিচে, ভুবন সোম, খারিজ, এক দিন আচানাকের - মৃনাল সেন ! পর্দায় ছবিটা ঝাপসা লাগে কেন ? পলক ফেলেতে দেখি - চোখের জল গালে ! একটা অদ্ভুত আত্মতৃপ্তিতে বুক ভরে গেল, আস্তে আস্তে আমার পাশে বসা মানুষটার দিকে তাকালাম । দেখি, ধীমান পুরুষের গভীর নিঃসঙ্গতা নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন একজন, পর্দার দিকে ! আমাদের সবার গর্ব, সবার প্রিয় - মৃনাল সেন ! আমাদের মৃনাল’দা !

ব্যক্তিগত গদ্য - বিমোচন ভট্টাচার্য

আমার ছোটকাকা
বিমোচন ভট্টাচার্য



যে ঘটনার কথা লিখতে যাচ্ছি সেটা আমার ছোটবেলার ..মানে আমি তখন সাত বা আট , আমাদের বিরাট যৌথ পরিবার ছিল তখন ... আমার ছোটকাকা আমার বড় দাদার চেয়ে ছোট ছিলেন.. দুজনে দুজনকে নাম ধরে ডাকলেও ছোট কাকা, তাঁর ছোট বেলা থেকে বিদ্রুপ শুনেছেন দাদার থেকে ছোট হবার জন্যে ..সেই জন্যেই , এখন মনে হয় , ছোট কাকা খুব সেক্লুডেড জীবন যাপন করতেন ,, একটি কুকুর ছিল তাঁর আলসিসিয়ান। তার নাম ছিল শীর্ষেন্দু ,,,কুকুরের নাম শীর্ষেন্দু? পরে শুনেছিলাম শীর্ষেন্দু নামে তাঁর এক অতি প্রিয় বন্ধু প্রয়াত হবার পর ই তিনি কুকুরটি পুষতে শুরু করেন .. তাই ওই নাম.. একদিন ... খুব গরম তখন .. বারান্দায় আমরা ক ভাই খেলছিলাম, এমন সময় আমার এক খুড়তুতো ভাই আমাদের দেখালো আমাদের শীর্ষেন্দুর সঙ্গে রাস্তায় একটা কুকুরের লেজের সঙ্গে লেজ জড়িয়ে গেছে ..(এটাই আমাদের বলা হত তখন ), অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন, তার মধ্যে হাসছেন ও কেউ কেউ। ওদেরই একজন আমাদের বললেন-'তোদের ছোট কাকাকে ডাক ',... আমরা সকলে মিলে ছোট কাকাকে গিয়ে ঘটনাটা বললাম, ছোট কাকা তরতর করে নেমে গেলেন নীচে.. আমরা আবার বারান্দায় .. ওপর থেকে আমরা দেখলাম আমার ফর্সা ছোট কাকার মুখটা লাল হয়ে গেছে.... মা চিত্কার করছেন -' ওরে পিন্টু ,বাড়িতে ঢুকে আয় ..ও তো চলেই আসবে একটু পরে ..আর লোক হাসাস না .. আমার দাদা দিদিরাও দেখলাম মুখ টিপে হাসছেন ... আপাতশান্ত আমার ছোট কাকা কিন্তু বাড়িতে এলেন সঙ্গে শীর্ষেন্দু কে নিয়ে .. স্নান করালেন কুকুরটিকে সাবান দিয়ে তারপর নিজের চিলে কোঠার ঘরে শীর্ষেন্দুকে নিয়ে চলে গেলেল.. দরজা বন্ধ হয়ে গেল আর তার পরেই শুরু হলো বেত দিয়ে কুকুরটিকে প্রহার... আমার এখনো মনে পরে ছোট কাকার সেই প্রলাপ আর শীর্ষেন্দুর সেই চাপা আর্তনাদ.. মা দরজা ধাক্কা দেন .. আমার অতি নিরীহ ঠাকুমা, আমার দাদা দিদিরা সবাই ডাকাডাকি করেন (বাবা বাড়ি ছিলেন না ) , আমার অন্য কাকারা ডাকেন কিন্তু ছোট কাকার কোনো হুঁশ নেই .. বেশ কিছু সময় পর ছোট কাকা দরজা খোলেন .. চোখ দুটো লাল ... ঠাকুমা ধরতে যান ছিটকে সরে গিয়ে ছোট কাকা নীচে নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন .. শীর্ষেন্দু তখন অর্ধমৃত .. মা বললেন ' আহা রে এমন করে কেউ মারে. মলম এলো ..লাল ওষুধ এলো সেগুলো লাগানো হলো ওর গায়ে ।ছোট কাকা ফিরলেন অনেক রাতে। ততক্ষণে বাবা ফিরেছেন এবং তাকে পাড়ার লোকজন ই ব্যাপারটা বলে দিয়েছেন পাড়ায় ঢোকা মাত্রা।সেটা আমরা তাঁর কাছেই শুনলাম .. মা , ঠাকুমা না খেয়ে বসে ছিলেন ..ছোট কাকাকে বাবা বললেন 'কুকুরটাকে ওই ভাবে মারলি কেন ?? তুই তো জানিস এই সময় ওদের কিছু শারীরিক প্রয়োজন থাকে (কিছুই মানে বুঝিনি তখন ).. সেই প্রথম দেখলাম ছোট কাকার চোখ ভর্তি জল .. এদিকে ছোট কাকা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষেন্দু পায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে ... বাবা আরো বললেন -যা খেয়ে নে ..মা আর তোর বৌদি না খেয়ে বসে আছে সেই সকাল থেকে ... ছোটকাকা খাওয়া দাওয়া করে শীর্ষেন্দুকে নিয়ে ফিরে গেলেন চিলেকোঠার ঘরে । বেশ কিছুদিন ছোটকাকাকে পাড়ার বন্ধুরা ক্ষেপাতো ওই ব্যাপারটা নিয়ে ,, দাদা বেশি মেলামেশা করত পাড়াতে, মাকে প্রায় ই বলত পিন্টুর জন্যে পাড়ায় মুখ দেখানো যাচ্ছেনা ... মা বকাবকি করতেন দাদা কে ...তার পর আসতে আসতে ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল .. পাড়ায় অন্য কোনো ঘটনা ঘটলো যেটা এর চেয়েও মুখরোচক , সকলে সেটা নিয়ে পড়লো । আমাদের বাড়িতে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো বেশ কিছুদিন পর। সেই কুকুরটির বাচ্ছা হলো বেশ কয়েকটি যার সবকটাকেই প্রায় আমাদের শীর্ষেন্দুর মত দেখতে ।সেই কুকুরটি থাকত আমাদের বাড়িটার নিচের রকে।আমাদের তো খুব ফুর্তি ঐরকম ফুটফুটে ছ সাত টি বাচ্ছা দেখে .. মা, ঠাকুমা সাবধান করলেন , এ সময় মা কুকুররা খুব কামড়ে দেয় কিন্তু আমরা এত আদর করা সত্যেও পাঁচী কিন্তু আমাদের কিছুই বলত না .. ব্যাস আবার পাড়ায় শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন -দাদার মুখ গম্ভীর হলো .. ছোট কাকা আরো গম্ভীর .. বাড়ির বাইরে বেরোলেই বাচ্ছা কুকুরগুলো পায়ে পায়ে ঘুরত .. ছোট কাকা একটা লাঠি নিয়ে বেরোত .. বাচ্ছা গুলোকে নয় ওদের মাকে দেখতে পেলেই মারতে যেত ....একদিন আমরা বাইরে খেলছি .. ছোটকাকা বেরোচ্ছেন হাতে লাঠি.. ছোটকার এক অতি ঘনিষ্ট বন্ধু টনিকাকু ছোটকাতে বললেন ---কি রে তোর বৌমার ওপর এত রাগ কেন তোর ?? আর নাতি নাতনি গুলোকে তো একটু আদর টাদর করতে পারিস.. তা না দেখা হলেই লাঠি পেটা করিস... টনি কাকুর সঙ্গে যারা ছিল সবাই হেসে উঠলো আর ছোটকা এমন একটা কান্ড করলো যা ইতিপূর্বে আমরা কোনদিন করেতে দেখিনি .. হাতের লাঠিটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো টনি কাকুর ওপর, এলোপাথারী মারতে লাগলো টনিকাকুকে , মাথা ফেটে গেল টনিকাকুর ছোটকাকেও বেশ ভালই মারলো বাকি লোকেরা .. মা , ঠাকুমা দাদা কোনরকমে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে আনলো ছোটকাকাকে ।আজকের দিন হলে থানা পুলিশ হত কিন্তু তখন সেসব হয় নি । ছোটকা আসতে আসতে কি রকম যেন হয়ে গেল .. পাড়ায় বেরোনো বন্ধ করে দিল .. একদিন টনি কাকু এসেও বোঝালো , কিন্তু ছোটকা নির্বিকার ।বেশীর ভাগ সময় ঘরের ভেতরই থাকতো । একদিন সকালে বাড়িতে হইচই ..আমাদের ওপরে উঠতে দেওয়া হচ্ছেনা .. তবুও শুনতে পেলাম চিলেকোঠায় ছোটকা গলায় দড়ি দিয়েছে ... শীর্ষেন্দুর একটা চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম .. দেখতে পাচ্ছিলাম মা , ঠাকুমা . পিসিমারা , দাদা দিদিরা কাঁদছেন.. পুলিশ এলো বাড়িতে .. এক সময় ছোটকার বডি নামালো হলো নীচে ..পুলিশ সেই বডি নিয়ে চলে গেল । পরদিন আবার আমাদের বাড়িতে এলেন ছোটকা .. ফুলে ফুলে ঢাকা হয়ে ,সবাই কাঁদছে .. হঠাত কোথা থেকে টনি কাকু এসে আছড়ে পড়লো ছোটকার দেহে ..বিলাপ করতে লাগলো হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে -'আমার জন্যেই তোকে চলে যেতে হলো রে পিন্টু ..কেন যে তোকে বলতে গেলাম ওই কথা গুলো সেদিন ।সরিয়ে নেওয়া হলো টনি কাকুকে ... দেখলাম পাঁচী তার বাচ্ছা কাচ্ছা নিয়ে দেখছে ছোট কাকাকে ... বাবা বললেন -' শীর্ষেন্দুকে নিয়ে চল শ্মশানে ...চলে গেল সবাই হরিধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানের দিকে । এর কিছুদিন পর শীর্ষেন্দু ও মারা যায়, কিছুই প্রায় খেত না ছোটকা চলে যাবার পর .. আমরাও অন্য পাড়ায় চলে আসি ওই বাড়িটা ছেড়ে । আজ এতদিন পর ছোটকার কথা লিখলাম কেন ? কাল ছোটকার জন্মদিন ছিল .. একটা প্রায় ধুসর হয়ে যাওয়া ছবিতে কাল আমার পঁচাত্তর বছর বয়েসের দাদা একটা মালা পরালো ..আর আমার মনে পড়লো আমার একটা ছোটকাকা ছিল ।

অনুবাদ কবিতা - অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

চীনের কবি ইয়ান জুন-এর কবিতা
অনুবাদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় 



কবি ও সঙ্গীতশিল্পী ইয়ান জুন-এর জন্ম ১৯৭৩ সালে। উত্তর-পশ্চিম চীনের লান্‌ঝৌ প্রদেশে। বর্তমানে বেজিঙে থাকেন। চীনা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পেশাগতভাবে তিনি মিউজিক ইভেন্ট অর্গানাইজ করেন। কবিতা লেখার পাশাপাশি সঙ্গীতের ওপর সমালোচনামূলক নিবন্ধও লেখেন। প্রথম কবিতার বই ‘49 Poems’ (১৯৯৬)। এরপরে প্রকাশিত হয় ‘Infrasonic Sound’ (২০০১), ‘Impossible’ (২০০৬)। অনুদিত হয়েছেন ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি ও ডাচ ভাষায়। বাঙলায় সম্ভবত এই প্রথম। ইয়ান জুন রাজনৈতিক কবিতায় বিশ্বাস রাখেন না। তাঁর মতে কবিতা লেখাটাই একটা রাজনৈতিক কাজ। ওঁর ভাষায়—‘Either all poems are political or else there is no such thing as a political poem. That’s because writing poetry is a political act in itself.’



১২ই অগাস্ট


আমার লেপ, একটি দানব প্রজাতি




২৯শে অগাস্ট

আন্তর্জাতিক মেরামতি দিবস : আমি থমকে
একগাদা তারের স্তূপ নিয়ে

নীল ভুল লাল ভুলগুলি
তেতলায় আলো নেই চারতলাতেও না
ধুয়ে গেলাম                                    আলো জ্বলতেই



২৫শে সেপ্টেম্বর

একটা রাগে গরগর স্বপ্নে : পিচফলের খোসা খুলতে থাকে
একটা অতীতের স্বপ্নে : শরতের হাওয়া হঠাৎ ঝড়

শরীরের মৌমাছিপাড়াকে আমি ইশারায় ডাকি

অল্প কয়েকটা স্বপ্নেরই ব্যাখ্যা করেছি এ পর্যন্ত
বিছানায় তারা আমার অপেক্ষায়

মধুভেজা ঘর চুপচাপের এক ফালি




২৪শে নভেম্বর
এলিয়েন যে নেই এটা এলিয়েন জানেই না

শীতে আমরা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি
গরম চা খাই             চোখের পাতা তাদের কাফন দিচ্ছে বাষ্পে

একটা এলিয়েন কাগজের একটা টুকরোর মতো
জানলা দিয়ে উড়তে উড়তে উড়তে উড়তে হার্বিনের দিকে

একবার বালজাক কি বলেছিল আমার মনে পড়ে
হাওয়াই যদি না থাকে কী কাজে আসবে উইলোগাছ?



ফেব্রুয়ারি ১4, বাবার সাথে হাসপাতালে
ব্রেকফাস্ট খেলাম               ওষুধও
লড়লাম হাওয়া দূষণের সাথে

খুব সকালে ওঠা হ’ল           অপেক্ষা করলাম হাসপাতালে
দেখলাম কানের ডাক্তার কিভাবে হাঁটে

আমরা চুপ ক’রে ছিলাম     পাশাপাশি ব’সে
বাতাসে নৈঃশব্দ আমানত রাখা হচ্ছিল তখন

একদিন           দু’দিন         কোমরে হাত
ধীর লিফটে দাঁড়িয়ে

নতুন স্কার্ফ      নতুন বরফ আর নোংরাও
দুজন দুজনকে শুনছি         শুনতে থাকব        যতক্ষণ না আমরা আর কিচ্ছু শুনতে পাব না





৩০শে অক্টোবর
আমার লাগেজ খেয়ে ফেলেছি
খেয়ে ফেলেছি প্রথম দিনটা                    খুব সকাল আর কাকের কা কা—

দশ মিনিট              বাঁশ বাগান হাওয়ায় দুলছে
ট্রেন              ফ্রিজের ভেতরে একটা ট্রেন

আয়নায় যে লোকটা               আমি
যে লোকটা সমুদ্রতীরে মশার পেছনে দৌড়চ্ছে            ওটা আমি




২রা জানুয়ারি
আমি ভাবতাম আমি কিছু বলতে চাই
বরফের দিকে তাকাতাম একবার               ফিরে যেতাম টেবিলে

অথবা টাকাপয়সা গুনতাম                 নয়তো লন্ড্রি
শহরতলিতে কাক ওড়ে            সামনের দরজা দিয়ে ওড়ে

চুপচাপ ব’সে অপেক্ষা করতাম
শীতকালে ব’সে যেভাবে হটপট অপেক্ষা করে

প্লেনের টিকিটে কোনো ডিসকাউন্ট থাকবে না
আমি তো কুরবানির জন্য বসেছিলাম           নিউ ইয়ার হয়ে গেল




৬ই মে, বাগানে

১. এখন ধ্যান শুরু হচ্ছে।

২. পিঁপড়ে। আমি ওদের অনুভব করতে পারি।

৩. ফালতু কথা আর মধু।

৪. একটা খালি ফাঁকা বাসও একটা বাস।

৫. বাতাসে এই ছোট্ট বেজন্মাগুলো।

৬. ইঞ্জিনের পরের দরজা। আমি আমার দরজায় কামড়াচ্ছি।

৭. থকথকে। আমার ঝড়ের মেঘ। একা একা খাচ্ছি।





১০ই ডিসেম্বর
ভোর তিনটেয় স্বপ্ন দেখলাম        আমি একটা ইঁদুর ধরেছি
একটা এ্যারোপ্লেনের মতো        জলের নিচে প্যারেডে যাচ্ছি

একটা শাদা কাগজ           নিচে পড়তে পড়তে কালো হয়ে যাচ্ছে
একদল অন্ধলোক         সংগ্রাম জারি রাখছে

বরফবিহীন সেইসব শীতের মতো
উৎপত্তির জায়গাটায় ফিরছি

রাগে উত্তেজনায় আমি তাড়াহুড়ো ক’রে ফেলি
একটা পাখা        নিজের হাওয়াকে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে


দীর্ঘ কবিতা - পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত

মূর্ত-বিমূর্ত
পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত



ভেতরে ছড়িয়ে আছে সব,মর্গের শান্তি,লালন ফকির,নিপুণ আকাশ,
বিমূর্ত ক্যানভাসে লিখলাম অস্তিত্বযাপন।ওহে চার দিগন্তের
জীবনকাহিনি প্রচ্ছন্ন জাদুর মধ্যে জম্পেস মিউজিয়াম,চলছি তো চলছি।
একজন কবির সাত টুকরো মাইক্রোফোন,ঠোঁটের কোণে এই তো ছোট্ট হাসি,
নিছক বসতে চেয়েছি তোমার পাশে,তুমি ফুটিয়ে তুলতে চাইলে ভিন্নমাত্রায়
সৃষ্টির গৌরব।উঠে যাচ্ছে ঘুড়ির ল্যাজচেরা লাল ঠোঁট ইস্কুলমাস্টার।
আহা,পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির সন্ধ্যা,আমাকে শিল্পপ্রেমিকের তকমা দিওনা।
গ্যালারির পৃষ্ঠপোষক আমি নই,চার পাতা কবিতা লিখেছি মাত্র।
সাড়ম্বরে লিখিনা কবিতা,লিখিনা লালপেড়ে শাড়ি কপালের টিপ।


নজর কাড়বে এমন কবিতা আমি লিখতে পারিনি।
ক্যাজুয়াল মুকুটমণিপুর ভাড়ার গাড়িতে।
কার্নিভালের নাচগান নিয়ে এসেছি যেন ফুল ফোটে মুক্তির টবে।
কাজ করেই বাঁচতে চায় মন,সে কাজটিও কেউ দেয় না।
শুধু ভাবনার ওপর জীবনলাভ, মানুষপাখিটিকে উড়ান দিতে চাইলাম,
সে বললো,সম্পর্কের ১৪আনা রাজনীতি,দ্বন্দের পথ সম্পূর্ণ মূর্ত হয়েছে
আমি দেখলাম মৃত্যুর খাদ উপভোগ করবার মতোই
খেলাটা সৃষ্টির গৌরব,গভীর তরঙ্গিত।


চোখ বুঁজলাম ইজিচেয়ারের শান্তি
অনিবার্য কিছু নেই অরণ্য মাঠ নদী শিশিরবিন্দু
আমার জীবনকালেই অলীক আয়োজন যা যা আমি দেখতে পেলাম
অথৈ উদ্বাস্তু,শ্লোক কাঁদবে না, একবিন্দুও না,
নিয়ন্ত্রকের চিঠি এলো শেষ রাতে,রঙ্গনা লিখেছে ‘আরে না না
স্কচ নয় দুরন্ত স্কটিশ,যতই কর্কের মুখে রাংতা লাগাও,
এ সবই নিয়তির বিবর্ণ হাত’।


তুমি কি যেন বলতে চাইলে মার্কেস,জগৎ-জার্নালিজম!
জীবন গুরুত্বপূর্ণ
মানুষের গল্প মৃত্যুর ভবিষ্যৎ আর প্রেতাত্মার চোখ
আমি দেখলাম বন্ধুত্ব অটুট থাকেনা
চিত্রায়নের পর চিত্রায়ন মুক্তি আসেনা
উপভোগের দুর্লভ পাখি জৈবিকভাবেই উড়তে শিখেছে


চমৎকার ব্যঙ্গরসাত্মক এই কার্নিভালে আমি মেতে উঠলাম হে উদ্বেল কবি
সর্বোপরি তোমার অধ্যবসায়
মোটেই দু’ফোটা অশ্রুর বিনিময়ে নয়
নগরের পিপাসার্ত প্রাণ লাজুক চেহারার বেশি আর কি আছে তোমার?


আস্তে আস্তে আমি গ্যালারির পারফিউম
দেখতে দেখতে আমি রেস্তোরাঁর চিনেমাটি
জানালা খুলে মেলে ধরলাম উপাদেয় ইন্ধনসামগ্রী
তাকিয়ে দেখছি কেউ ইতস্তত আমাকে দেখছে না তো
অস্তিত্ব আঁকতে আঁকতে আমি মডেলের টাটু হয়ে গেলাম
ফুল পাতায় মাসেলে মাসেলে রান্নাঘরের পিঠে
আমি জানি মাতালের দরজায় আর কোনো মাতাল আসেনা
অবিশ্বাস্য রেখার টান লতানো আধিপত্যের বিস্তার


দীর্ঘকায় ভিন্তেজ-ড্রিংকস ক্রমশ ফুরিয়ে এলো,টের পাচ্ছি জোনাকির রেশ
বেপরোয়া একটি চুমুক দিলাম টেলিস্কোপে
প্রতিটি আক্ষেপের রঙ বেদানার হৃৎপিন্ড নয় যে ছবিতে মিশিয়ে নেবো
দানা,আমি আস্তিত্বের অনুপুঙ্খ রেখেছি দর্পণে

গুচ্ছ কবিতা - সুপ্রিয় মিত্র

কিছু কথা এখনই শুনে যাও
সুপ্রিয় মিত্র



১.
শুনশান - একা হয়ে থাকা... অন্ধকার...আর ভিড় হয়ে মিশে যাওয়ায় তফাৎ কিছু নেই...
বিজ্ঞানের ভাষায়,
উচ্চগ্রামের কোলাহল নিঃশব্দের সমার্থক মাত্র।

২.
চোখ বুজলে, এখনও হৃদস্পন্দন হয়

চোখ বুজলেও, পৃথিবীটা থেমে যায় না
সূর্যের আলো একটুও হয়না ক্ষীণ ...

একভাবে দুই বিশ্বের সমান্তরাল সরণ

প্রথমটা আমার আক্ষেপ ...
পরেরটা সৌভাগ্য....

৩.
কিছু ময়লা জন্ম থেকে রয়ে গেছে ;
আমার মা, ঘষে ধুলেও উঠবে না

বয়সের আড়ালে সে এক বহুরূপী!

৪.
ভালবাসার চারটি দিন পেরোনোর পর,
মুখ দেখতে আর আয়না লাগলো না...
তাকানোর পর মুখ ফিরিয়ে সে বললো
- ' ছিঃ '!
একগাল হাসি বাতাসে ভেসে এসে
আকাশে মিশে গেল...

প্রতিবেশীর সে দৃশ্য চোখে এড়ায়নি
ট্যাঁরা চোখে তাকিয়ে বলেছিল -
" অমন ভালো মেয়ের, এই ছিল রুচি! "

৫.
কিছু কথা এখনও বাকি আছে,
কিছু কথা এখনই শুনে যাও...
স্মৃতির আলো... দোষ আমারই ...
তবু, তুমিই বলো
ভুলে যাওয়া তো, ভুল বলার থেকে ভালো।

৬.
ভালো ধূপের গন্ধ যেমন ঘরময় ছড়িয়ে যায়, আনাচে - কানাচে... তেমনই, আমার বান্ধবীর স্মৃতি, তার উজ্জ্বল উপস্থিতি হৃদয় জুড়ে আনন্দময়... তাও,যেমন মনে হয়, ঠিক এমনটা উপস্থিতি যাকে ধূপ দেখাচ্ছি রাত্রি - দিন, তাকে পাওয়া যেত...
হাঃ...!!
বান্ধবীটা যদি আমার মায়ের মতো হতো।

দুটি কবিতা - হাসান মসফিক


মায়া ফড়িং

আসলে আমার তেমন কিছুই নেই,
দু'চার আনি কিছু রোদ ছিল
শৈশবে জমানো
প্রতি ভাদ্রে শুকাতে শুকাতে
এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

আসলে আমার তেমন কিছুই নেই,
সেই কতকাল আগে; এক বন্ধু নির্জনে ডেকে নিয়ে
একটি মায়া ফড়িং দিয়েছিল
সে কেবল জ্যোৎস্না খেয়েই বাঁচে,
এখন বন্ধুটিও নেই!

আমি কতজনকে বলেছি,
তোমাদের পাড়ায় শুধু ঘুম কিনতে এসেছি
বিনিময়ে দিতে পারি, এক একটা নির্জন পথ ...



ভালোবাসা: দূরপাল্লার মেঘ

নীল মেঘে ঢেকে যায় যদি
কোন পুরুষালী দুপুর,
একলা হয়ো না;

খোঁপায় কোন ঘাসফুল গুজে নিয়ে
ওই বারান্দায় এসো,
ঠিক মাথায় উপর যেখানে আকাশ ঘন;
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দু’নদীর
বুকে চোখ রেখে যদি পারো বলতে
খুব ভালোবাসি, ভালোবাসি ......

শোনো, এভাবে আসো যদি-
দূরগামী কোন হাওয়া নয়, পেতে পারো
দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া
রোমাঞ্চিত যমুনার দখল!

দুটি কবিতা - হিন্দোল ভট্টাচার্য



নাগরিক

ক্ষুধার্ত বাঘের চোখ
ভালবাসতে পারে

আঁকাবাঁকা জঙ্গলের ভেতরে
শহর জেগে রাত হয়ে আছে

শিকারের যখন সময়
তখন কি তার মুখে
শিশু কোন গন্ধ ফুটে ওঠে ?

এই সব সংশয়ের গোপনে গোপনে
খাপ খোলে অন্ধকার

চায়ের দোকানে শীত
                      থমথম করে …




পুঁথি

তুমি প্রকাশিত হও

নিজের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেছ তুমি নিজেই বারবার

এবার সমাধি থেকে উঠে পড়ো

নিজেকে পোড়াও

... অনেক মৃত্যুর পর জীবনে মোমবাতি জ্বলে ওঠে

কবিতা - বিভাস রায়চৌধুরী

সন্ধ্যার সন্ন্যাসী
বিভাস রায়চৌধুরী



এমন বিকেল আছে
কোনো উচ্চারণই আর
মেনে নিতে পারি না কিছুতে...

আমার ভাবনা হয়
শব্দের কষ্ট হবে...
প্রয়োজন নেই কোনো
দিগন্তের গুহা থেকে
টেনে-হিঁচড়ে তাকে বের করা ...

বরং এবার
একাই থাকুক শব্দ ...
বেদনা-নির্জন হোক সব সম্ভাবনা !
আমার জীবনে নামে
সন্ধ্যার সন্ন্যাসী ...
জোনাকির মৃদু লেখাপড়া ... 

কবিতা - মৃণালকান্তি দাশ

মৃণালকান্তি দাশ



সসাগরা দেশে আজ দ্বীপ
জেগে ওঠে -
নির্ভয়া, অপরাজিতা,
বারাসাত, রাঁচি, কামদুনি ।

স্বপ্নের ফানুস ওড়ে,
উড়ে যায় প্রথাসিদ্ধ,
লাল নীল সবুজ বেগুনী ।

রাত্রিবীজ চারা হয়,
মহীরূহ হয়,
দেওয়ালে সহাস্য,
শান্ত আরও একটি দিন -

আমরা গল্প লিখি,
সংবাদভাষ্য লিখি,
ঘাড় গুঁজে কাব্য লিখি,
মেরুদণ্ডহীন ।

কবিতা - মৃণাল বসুচৌধুরী

যদি চাও
মৃণাল বসুচৌধুরী



যদি চাও
      মহামান্য কীটেদের
            পোষা হয়ে থাকো
যদি চাও
      মেঘভাঙা বৃষ্টি নিয়ে
            সামনে দাঁড়াও

কুঁড়েঘরে যে জ্বালায় মাটি'র প্রদীপ
যে বাজায় একতারা
        নাভিমূল ঠেলে
        স্রোতের বিপক্ষে গিয়ে যে
        দাঁড়ায় বারুদের স্তুপে
ভরা জ্যোৎস্নায়
        যে গায় মুক্তির গান
শব্দজালে যে কেবল
        অন্তর্মুখী
        দহনবিলাসী
যদি চাও খাঁচা ভেঙে
        তার পাশে শব্দহীন
               একলা দাঁড়াও

যদি এসব না চাও
        পোষ মেনে পড়ে থাকো
                উড়ালবিহীন 


কবিতা - সুবীর সরকার

সার্কাস
সুবীর সরকার



ক।

যদিও জীবনমরণ,অন্ধ হতে থাকা
গানকে প্রবাদ ভাবলে সহনীয় রোদ
দশ হাত দূরে দড়ির
                        মই
পোশাক পালটে আসে জোকার

খ।

হাসিটুকু ফিরিয়ে দিয়ে শস্যখামারে
                                        যাবো
হুল্লোড়ের পর পাখিরা ডেকে উঠলে
শ্যাওলার মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে
                                        দেওয়া

কবিতা - বারীন ঘোষাল

শর্ট ফ্লিম
বারীন ঘোষাল



লাভা রোনার মনোরম খেলাটি শুরু হয়েছে
পথ
চাইলো
শিশুটি কি হারিয়ে ছুটছে
                                  কী হারিয়ে
গোলাপের সাদা কালো কেঁপে উঠল কাঁটায়
একই আলোর মন্তাজ সারা
শেষের বেণু
ধেনুর সঙ্গে তাল মেলাতে বারণ করেছিলাম
জুম করেছে মুখপান
ব্যাকগ্রাউণ্ডে ডিম্বালিকা ডিমবালিকা ডিম বালিকা ডিম ডিম ডিম

অবধু --- মানে জানিনা
অনাগার --- তাও জানি না
চিত্রনাট্য ডান দিকে ঝুঁকে পড়েছে উল্লাসিকে

দুজন
দুজনের মাথার ওপর একটাই তরুণী মুণ্ডু ঘুরে ফিরে বসতে চাইছে
ল্যাম্পে লম্পট
                   পলাশি
                            পলাশিয়া

ছবির প্রদাহ শেষে এডিটিং চলছে
চোখে জল না জলের দাগ থাকবে
                                            তাই নিয়ে একটু তর্কও হল
একচোট স্ত্রীলিঙ্গ পুলিঙ্গ নিয়ে
যেমন হয় আর কি
একবন পলাশ ফুটিয়ে প্যান করা হলে
আমরা স্ট্যাচু হয়ে গেলাম



কবিতা - সপ্তাশ্ব ভৌমিক

খোলস
সপ্তাশ্ব ভৌমিক



অনেক কথা থাকল বাকি
কথার কথা এসব নাকি
যদিও কথা ভুলেছে আজ শোক
এখন তবু বিবশ ভাষা
কিসের টানে লুকিয়ে আসা
সঠিক কথা জানে না কোনো লোক
মেলার থেকে মুখোশ কেনা
এসব জানি তোমার চেনা
তবুও তুমি করনি সোরগোল
সময় ছোটে নিজের মনে
লুকিয়ে বাঁচি ঘরের কোণে
যে ভাবে সাপ লুকিয়ে রাখে খোল
সময় হলে খোলস একা
ঝোপের ধারে হঠাৎ দেখা
চোখের ভুলে শিউরে ওঠে মন
মানুষ ফেরে নিজের ঘরে
খোলস একা লুকিয়ে পড়ে
খোলস শুধু খোলস অগণন 


কবিতা - অলক বিশ্বাস

শব্দহীন মেঘালয়
অলক বিশ্বাস



দোলপূর্ণিমা ডেকে গেলে দেখি
সকলেই বৃক্ষ হয়ে গেছে।
চোখে চোখে যা কিছু উজাড় ছিলো তোমার আমার দেখি
এখনও তার কিছু কিছু অবশিষ্ট আছে।

সব ফুল ফোটা শেষ হলে পরে
   ঘেঁটুফুলে অম্লান ভাঁজ
   খুলে যায় পাখনার রঙে
মধ্যবর্তী মাঠ পার করে দাঁড়াও সুজন।

হাওয়া এলে এইবেলা
মাটিতে খেলবো ধুলোখেলা।

ঘাসের নিবিড়ে ফুটে আছো একা একা
গল্গে গল্পে শব্দহীন মেঘালয়ে
দেখেছ বসন্ত এসেছে !



কবিতা - সুমিত রঞ্জন দাস

অনুতাপ
সুমিত রঞ্জন দাস



অনেক কষ্টে বহুদিনের চেষ্টায় ভাবতে
শিখিয়েছি তোকে
তোর হাতে দিয়েছি অধরা কলম
লিখতে শিখিয়েছি দু'হাত ভরে;

তুই লিখতে থাকিস,
প্রতি পাতায় ঝরে ঝরে পরে সুবাসিত ছেলেবেলা
আঁকিবুকির ফাঁকে কখন যে কেটে যায় মায়াবেলা ...

তুই বড় হতে ভয় পাস ।

অনেক কষ্টে বহুদিনের চেষ্টায় দাঁড়াতে
শিখিয়েছি তোকে
এখন তুই হাঁটতে থাকিস
ছুটে ধরতে চাস প্রজাপতির পাখনা;

অসহায় লাগে তোর কথা ভেবে ...

এবার বরং চেষ্টা করব ভবিষ্যত উজ্জ্বল গড়তে
অন্ততঃ আত্মসন্তুষ্টির জন্যই ।



কবিতা - শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

বিবাহ
শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ



যেন কোনো রোগ নেই ভূগোলের,
সব আলো যথাযথ জ্বলেছিল-
সমস্ত গন্ধবণিকের ষড়যন্ত্র
পিঙ্গল ধূর্ততা
মলাটের মিলমিশে
বই-এর চাদর হয়ে
ঢেকেছিল যুবতীর স্তন
কোমল রেখাব,

চায়ের দোকান তার আবছায়া মাপে
ভিন্ন নারী তুলনায়
টিমটিমে গ্লাসের তলানি
খুচরো মিটিয়ে পাওনা
যে যার মশারি চড়ে
বিবাহে গেছিল-

সে সব বিবাহে কোনো দোষ ছিল না প্রসঙ্গত! 


কবিতা - নীলাদ্রি বাগচী

ব্যবচ্ছেদ ২২শে ফাল্গুন
নীলাদ্রি বাগচী



যেহেতু তোমার নামে অঙ্গশোভা খবর কাগজ
ফুরোলে বারান্দা আর রাত্রি ভর সোফার কোণায়
ডুবেছে নিশ্বাস নিতে পরিমিত সহযোগিতায়
কার্পণ্য বেজেছে আজ ঘুম বোনা কুরুশ কাঁটায়

এসেছিল এইভাবে অন্যভাবে চলে যেতে চায়
পরীক্ষার দিনগুলি গবেষণা ছোট হয়ে আসে
রোদ্দুরে বাজিয়ে দেয় সাবানের এসব মহিমা
নোটবুক খুলে লেখে হাত নেয় ছায়ার তালিম

শিক্ষা অর্থ অন্ধকার নিকোটিনে অভিভূত নখ
সামনে রাখা স্থিরচিত্রে দু এক দফার কালো জল
মোবাইল পাগলামি চলে যাবে শিয়ালদা শাখা
কেননা সমস্ত আছে বাস্তবিকে কোনও কিছু নেই

তিস্তা নদী বয়ে যায় অর্থহীন এভাবে শাসায়
আজীবন এক ভয় সিঁড়ি ভেঙে শব্দ উঠে আসে...
 

কবিতা - পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়

স্বেচ্ছা নির্বাসন
পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়



যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও, প্রথাগত প্রিয়া ।
আমাকে একা রেখে রুটিনের অবিশ্রাম দাহে…
শব্দের মড়কে ঘেরা অব্যক্ত যন্ত্রণা ছেড়ে, দ্বিধাহীন
চলে যাও পূর্বনির্ধারিত সেই তোমার বিবাহে।

এ আমার স্বেচ্ছানির্বাসন। বন্ধুহীন - প্রেমহীন
এ বৈভবে প্রতিদিন পুড়েপুড়ে ঝরে যেতে দাও।
জানতে চেয়োনা তুমি, কোন দোষ ছিল,কি ছিলনা,
বরং অশ্লীল বলে, ঘৃণ্য বলে, আমাকে কাঁদাও।

আমি কি ভাবিনি ভাবো - কি কারণে রোজ কলুষিত
আমার প্রশ্বাস, স্পর্শ, ধমনীর প্রত্যেকটি লালিমা,
মন আমার আপাদমস্তক কোন অসুখে নিন্দিত?
ভেবেছি, ভেবেও তার কোনদিন পাইনিকো সীমা।

কি ভাবছো? যদি ফের ফিরে আসি, কি হবে তখন ?
সুখী থেকো। বলেছি তো এ আমার স্বেচ্ছানির্বাসন।

কবিতা - বিদিশা সরকার

বন্ধ দরজাটা
বিদিশা সরকার



একটা দরজাও খুলতে পারছিনা

পায়রা ঘরের দরজা
দালানের
সদরেরও
মানুষটা প্রবেশ করবে কিভাবে
মানুষটা প্রবেশ করতে চায়

কোকিল বারণ শোনেনি
যজ্ঞ ডুমুরের গাছে একটানা ---

বারণ শুনতে শুনতে কখন যে
বন্ধ হয়ে গেছে

তেল ঢালছি , ভেসলিন
আলগা হচ্ছে ছিটকিনি
এবার টানেল

মানুষটা টানেলের ভিতর দিয়ে
সহজেই ঢুকে পড়ল
কিছুক্ষন থাক ।

কবিতা - সঞ্জয় ঋষি

এলোমেলো ভাবনারা
সঞ্জয় ঋষি


কাঁঠাল গাছ আর দিদিমার বয়স এক !
একটি ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে আছে গাছ ।
কাঁঠাল গাছ থেকে সুগন্ধ ভেসে আসছে...
বাগানের পাখিগুলি ডালে এসে বসছে

দিদিমা গাছের গোড়ায় জল দেয়
দিদিমার মতন গাছটি একটু ঝুঁকে গেছে...

কবিতা - মলয় রায়চৌধুরী

ফাক ইউ
মলয় রায়চৌধুরী



আছড়ে কেলিয়ে পড়ে গেল আজ আশি বছরের মহীরুহ
প্রতিষ্ঠানের রেডউড; অপগণ্ড শোকক্যালা পরগাছা নিয়ে
খোকাখুকু উইপোকাদের কাঁধে চলল ক্যাওড়ায়

শুরু হল সবুজ শতক জুড়ে শিশিরে রোদেলা হুল্লোড়
ঘাসফুলে বুনোবীজে দুর্দম হাত-পা ছড়ানো উদ্দাম--
অবশ্যি এরাও জানে শিগ্গিরি আলো-হাওয়া চাপা দিয়ে যম
উঠে যাবে আরেকটা রসচোষা গদাইলস্কর ভুঁড়ো ডেডউড ভাম
চুষে খাবে ওদেরই মাটির গন্ধ কচি-তাজা সুখের স্বাধীন

যদ্দিন তা না হচ্ছে তদ্দিন কাশফুলে মুথাঘাসে দুর্বাদলের শীষে
মৌমাছি প্রজাপতি ফড়িঙেরা গেয়ে নিক ফাকিউ ফাকিউ সুরে
ফাকিউ ফাকিউ ফাক ইউ ফাকিউ ফাকিউ ফাক ইউ...



কবিতা - বাপি গাইন

ভাষা
বাপি গাইন



আজকাল ভাষা নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছি।
কি জানি কি স্পর্ধা করে ফেলি ব্যবহারে,
যদি তার কৌলীন্য নষ্ট হয়
যদি ডেকে এনে অপমান করা হয় সেই বান্ধবটিকে
ভয়ে ভয়ে সহজ ভেবেছি তাই,
অযথা জীবন
যাক কিছু দূরে যাক, দড়ি ফেলে
একটু জুড়োক, ঘাস টাস খাক
আমি ব্যাকরণগত ভাবে তাকে
ফেরাতে যাবো না।



কবিতা - বিপুল চক্রবর্তী

আদি সপ্তগ্রাম
বিপুল চক্রবর্তী



১.

হঠাৎ-ই কী ভেবে আমরা বেরিয়ে পড়লাম
চলো, ঘুরে আসি, চলো আদি সপ্তগ্রাম

আদি, তবু লুপ্ত নয়, হৃদয়ের কাছে
আজও ঠায়, সত্য হয়ে, দাঁড়িয়ে সে আছে

সঙ্গে হংসেশ্বরী, বাসুদেব আর
বহে শীর্ণ সরস্বতী, আজও সে অপার

২.

রাজা নেই, মন্ত্রী নেই, নেই সে পুরনো দিন আজ

বাসুদেব মন্দিরের গায়ে
শিল্পীর নৈপুন্যে তবু বেঁচে আছে পুরনো সমাজ

৩.

উন্মত্ত, মাতাল আর ধ্বংসোন্মুখ
আমার এ বৃত্ত ছেড়ে – আমার শহর ছেড়ে

তোমার ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছি
ওগো শীর্ণ সরস্বতী

ও ভাঙা পাঁচিল...

কবিতা - বৈজয়ন্ত রাহা

দোলের রং
বৈজয়ন্ত রাহা



কাকে তুই মিশিয়ে দিলি ভোরের প্রথম ভ্রুণে?
কাকে তুই আড়চোখেতে দেখিস রে জুঁই ফুল?
কাকে তুই সঙ্গোপনে বলিস ভালবাসি?
কাকে তুই নদী ভেবে , ভাঙ্গতে বসিস কূল...

কাকে তুই আবীর দিলি দোলের পরের দিন?
কাকে তুই বললি হেসে 'রঙ দেওয়াটাও আর্ট'
কাকে তুই খুঁজতে আসিস শুধতে দানের ঋণ,
না-রং কবে পিছলে গেলো --বোতাম খোলা সার্ট?

কাকে তুই ভুলতে বলিস জঙ্গলা দিনের ছোপ
শাড়ীতে উড়িয়েছিলি শরীর জুড়ে হাওয়া
কাকে তুই রাখিস বেঁধে ভুলতে চাওয়া মনে,
কাকে তুই ফেরত দিলি বুকের ভিতর পাওয়া?

কবিতা - অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

সবুজ
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়



শৈশবে সবুজ -- রিঙ আলগা হয়ে কোথায় ...
মাঝের আঙুল ঘিরে কালচে পুরনো এক দাগ ...
খেলা- ছলে খুলে গেছে অজান্তে ঝোপ- আগাছায় ...
সবুজের মধ্যে মিশে থাকে আরও সবুজাভ রাত ...

খুঁজতে খুঁজতে কবে সরে গেল অবুঝ কৈশোর ...
যৌবনপ্রান্ত - তবু স্পষ্ট সেই মধ্যমার ছোপ ...
সবুজ সবুজ দিন পার করে কমবয়সী মোড় ...
শৈশববাগান থেকে ধেয়ে আসে হাহাকার ... ক্ষোভ ...

শূন্য আঙুল জানেনা, টুকিটুকি -লুকোচুরি খেলা
অসাবধানে হারিয়েছ আংটি : সবুজ ছেলেবেলা



চলচিত্র সমালোচনা - জয়দীপ মৈত্র

মেঘে ঢাকা তারা : ঝড়ের আগের একটি আবহাওয়া সম্পর্কে
জয়দীপ মৈত্র



" Life is but a walking shadow ...." সাদা কালো পর্দায় তখন দাউদাউ আগুনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে " How to be a good communist " .. আর তিনি , তীক্ষ্ণ চোখে মানসিক হাসপাতালের কেবিনের ফাঁক দিয়ে তিনি চেয়ে রয়েছেন সেই লেলিহানের দিকে। তাঁর চোখের মণিতে জ্বলে যাচ্ছে তাঁর অর্জিত অধিকারের লড়াই। মৌন হয়ে বসে রয়েছেন তিনি। দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে তাঁর আশা আকাঙ্খা , স্বপ্ন , তাঁর চারপাশের মানুষেরা। তবু তিনি দৃঢ় , সোজা মেরুদন্ডে কোন ভেঙে পরা ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের মত সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আর এটাই তো হওয়ার ছিলো। এই মুহুর্তে টলিউডে সর্বাধিক আলোচ্য , হইচই ফেলে দেওয়া ফিল্ম "মেঘে ঢাকা তারা " দেখতে বসে বারবার ভাবছিলাম এই ফিল্মের পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কথা। খবরের কাগজ আর ইন্টারনেটের সুবাদে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার অনেক আগেই জেনে ফেলেছিলাম এটি কাকে নিয়ে তৈরী। ঋত্বিক ঘটক শুধুমাত্র একজন পরিচালক নন। একজন অভিনেতা , নাট্যকর্মী , শ্রমজীবি , বুদ্ধিজীবী , স্বপ্ন দেখা মানুষ নন। এ সমস্ত কিছুর বাইরেও তিনি এক আত্মা , এক চেতনা , একজন মানুষ যিনি তার সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত সময়েও মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোকে পাপ বলে মনে করতেন , আধুনিক বাঙালীর রক্ত , হাড় , মজ্জারও গভীরে কোনো প্রত্যন্ত জায়গায় , যেখানে এখনও হয়ত সুপ্ত হয়ে থাকলেও থাকতে পারে রঙহীন নিতম্বলেহনহীন দৃঢ় স্বাধীনচেতা আপসহীন আগ্নেয় মনোভাব , সেই জায়গায় এই কথাগুলোকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম এবং অব্যর্থ কাজটি কমলেশ্বর করে ফেলেছেন। আহা ! এ শুধু সিনেমা নয় ! এ মহাকাব্য ! প্রত্যেকটি দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে এক আশ্চর্য রঙীন মায়াজাল ( হ্যা রঙীন , কারণ যে সিনেমার প্রত্যেকটি দৃশ্যে এত সিনেম্যাটিক বৈচিত্র্য ও তার সুনিপুণ , সুচিন্তিত প্রয়োগ থাকে তাকে নেহাত সাদা কালো ছবির আওতায় ফেললে সিনেমা দেখার তৃতীয় চোখকে অসম্মান করা হয় ) বুনেছেন পরিচালক। শুরু থেকে একটার পর একটা দৃশ্যতলোয়ার ধেয়ে আসে আর এফোঁড়-ওফোঁড়টুকুই চটির মত মাথায় নিয়ে চেয়ে থাকি পর্দায়। ঋত্বিকের জীবনী এবং ফিল্মোগ্রাফি যাঁরা জানেন , তাঁরা বুঝতে পারবেন , কি আশ্চর্য অবলীলায় একের পর এক ন্যারেটিভ ভেঙেচুরে ছারখার করে পর্দার নীলকন্ঠ বাগচী বারবার এসে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দর্শকের মননে। কি দূর্দান্ত ট্রিটমেন্ট ! তিনটি দৃশ্যের কথা আমি উল্লেখ করবই। ১) শক থেরাপির দৃশ্যে নেপথ্যে বিটোফেনের ফিফথ সিম্ফনী ..২) ফাঁকা মাঠে নীলকন্ঠর " ঘরছাড়া " ছবির শিশুশিল্পীর সঙ্গে হাসপাতালের শয্যায় শায়িত নীলকন্ঠর কথোপকথন। ৩) " তিতাস একটি নদীর নাম " এবং "অযান্ত্রিক " ছবির দৃশ্য ছুঁয়ে এসে শৈশবের ভবা ( নীলকন্ঠ ) তার মা কে খুঁজে পায় "সুবর্ণরেখা" র চরে। তিনটে ভিন্ন দৃশ্য মাখামাখি এক হয়ে জেগে থাকে। আহা ! কমলেশ্বর , আপনার হাতের আঙুলে পরপর চুমু।আপনার মাথার ভেতরে পরপর চুমু।এবং নীলকন্ঠর এই অতীত রোমন্থিত ফ্ল্যাশব্যাকের নেপথ্যে এক ডাক্তারকে ( আবীর অসম্ভব সুন্দর ) এনে হাজির করা। যেন রোগের গভীরে গিয়ে চিরন্তন চিকিত্সক বুঝতে চাইছে এ আসলে রোগ নয় , এ ওষুধ। এ আসলে আত্মবিস্মৃত বাঙালীর মুখে জ্বলে ওঠা মশালের লেলিহান। ফুলমনীর নাচের প্রথম পা। ছিন্নমূল মানুষের ছিনিয়ে নেওয়ার গানকে প্রায় নিজের শরীরের অঙ্গ বানিয়ে নেওয়া একজন মানুষের লড়াই তথাকথিত লোকরঞ্জিত শিল্পের বিরুদ্ধে। কবিতা , গল্প , নাটক , সিনেমা এবং সিনেমার থেকে ভালো গণমাধ্যম পেলে সিনেমাকেও লাঠি মেরেন বেরিয়ে যাওয়ার সংকল্পের পেছনে যে লড়াই , দৃঢ়তা ফুটে ওঠে , তাতে বারংবার বৃদ্ধ বেহালাবাদকের তার কেটে গেলেও নীলকন্ঠ দমেন না। ঋত্বিক দমেছিলেন ? কী ? "বাইনসোৎ " বাঙালী ? দমেছিলেন ? আজ লোকটার মৃত্যুর পর তাকে মাথায় তুলে নাচো ? একের পর এক ছবিতে উপেক্ষা আর দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহ উপহার দিয়ে সেই সময়ে কি দিয়েছিলে ঋত্বিককে ? বোঝোনি তো , ঋত্বিক আসলে আজন্ম রোমান্টিক একজন মানুষ , যিনি তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে এই বাংলার মানুষ , প্রকৃতি এবং এই ভারতের হাজার বছরের বঞ্চনা শাসন শোষণ প্রতিবাদের দর্শনের ইতিহাস খুঁড়ে খুঁড়ে আদতে সেই অলৌকিক "দুগ্গা" রই সন্ধান করে বেরিয়েছেন , যা তাঁর মতে মানুষের শৃঙ্খল ছিন্ন করার প্রধান উপাদান। একের পর এক ছবি মুখ থুবড়ে পড়েছে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপের স্বীকার হয়েও তবু তিনি দমে যান নি। আর দমে যান নি বলেই আজ সারা বিশ্বের ফিল্মের ইতিহাসে ঋত্বিক ঘটক এক পোক্ত স্তম্ভ বিশেষ। " দর্শক ফ্লপ করেছে। আমার ছবি ফ্লপ করে নি "..না ঋত্বিক , আপনি ফ্লপ করতেই পারেন না ...সৎ শিল্প কখনও ফ্লপ করে না - এই ছবির মুখ্য চরিত্র শাশ্বতর অভিনয় নিয়ে আমি একটি কথাই বলবো। ভদ্রলোকের জীবনের সম্ভবত সেরা অভিনয় হয়ে থাকলো এটি। চলাফেরা , কথা বলা , চোখের চাহনি - কী অসম্ভব পরিণত চরিত্রায়ণই না করলেন শাশ্বত ! নীলকন্ঠ হয়ে ওঠা হলো এখানে। জীবনে ভুলবো না সিনেমার রিল মাথায় নিয়ে ক্লান্ত মদ্যপ নীলকন্ঠের ঘুমদৃশ্য আর ভোরের নেপথ্যে আকাশবাণীর সুর ! সেলাম কমলেশ্বর। সেলাম আপনাকে।সুরমা ঘটক (এখানে দুগ্গা )-এর চরিত্রে অনন্যা , বিজন ভট্টাচার্যর ( এখানে বিক্রম দা ) চরিত্রে শুভাশিস অসামান্য। আবীর যথাযথ , সুন্দর। প্রত্যেকটা শিল্পীই এখানে সেরা কাজটি করেছেন। ফলে এটি সিনেমার থেকেও একধাপ এগিয়ে যাওয়া " একটা কিছু "হয়েছে। এই ছবির দৃশ্যভাবনা আন্তর্জাতিক মানের। গানের ব্যবহার , ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল , এডিটিং প্রত্যেকটি ছোট বড় জিনিস নিখুঁত। শেষ দৃশ্যটা ভাবুন ! " যুক্তি তক্কো আর গপ্পো " র বঙ্গবালার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন নীলকন্ঠ। পর্দা ক্রমশ রঙীন হয়ে উঠছে। ফুটে উঠেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অংশ -"তুমি গেছো। স্পর্ধা গেছে। বিনয় এসেছে।" এভাবেই তো এই বাংলার শেকড়ের গভীরে , আরো গভীরে রওনা দিয়েছেন ঋত্বিক - সব ভেঙেচুরে সব উপড়ে ক্রমশ আরো গভীরে - আর , আমার মতে এই ছবিতে কমলেশ্বরের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব , আধুনিক বাঙালীর গলায় হাতুড়ির বাড়ি মেরে এই সত্যটি গিলিয়ে দেওয়া যে আইনক্সে ৫০০ টাকা টিকিট কেটে , পপকর্ন নিয়ে , বান্ধবীর কোমরে হাত বুলিয়ে এমন একটা সিনেমা দেখে বাঙালী আহা উহু করছে আর চোখের জল ফেলছে (অনেকের তো আবার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে , ঋত্বিকের ছবি যেমন যেতো ) যে লোকটি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আজন্ম লড়তে লড়তে শেষ জীবনে দুর্বিষহ মৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন।এটাই চূড়ান্ত মোচড়। এটাই এ ছবির সার্থকতা।আবার টুপি খুললাম কমলেশ্বর। আর আপনি ঋত্বিক ? আপনার কাছে টুপি ছাড়া আর কি খোলার আছে ?বহু আগেই তো উলঙ্গ হয়ে গিয়েছি। আপনি তখনও ব্যর্থ হন নি ঋত্বিক। মানুষের লড়াই ব্যর্থ হয় না, আপনি জানতেন , কখনও হয় না - আপনি পুড়েছেন বলেই সিনেমাপিপাসু মানুষ এবং "বাইনসোৎ " বাঙালী , আমরা আলো পাচ্ছি। "সব পুড়ছে। ব্রহ্মান্ড পুড়ছে। আমি পুড়ছি। " ... শুধু প্রশ্ন , আমরা একটুও পুড়লাম কী ? নাকী "বাইনসোৎ " বাঙালীই থাকলাম ?

প্রবন্ধ - অমিতাভ প্রামাণিক

সাহিত্যসম্রাট ও তাঁর বঙ্গদর্শন – রবির আলোকে
অমিতাভ প্রামাণিক



বাংলাভাষায় সাহিত্যপত্রিকাগুলির বর্তমান অবস্থা একটু দূর থেকে অবলোকন করলে বেশ কিছুটা উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সাহিত্য তো জীবনেরই জলছবি। বাংলার সাম্প্রতিক সামাজিক অবক্ষয় অনেকটাই রাজনৈতিক দলাদলিপ্রসূত, সাহিত্যপত্রিকাগুলিও তার ঊর্ধে উঠতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ পত্রিকাই এখন কোনো দলীয় রাজনৈতিক মুখপত্রের বেশি কিছু নয়। সমস্যা আরো গভীর হয়, যখন শাক দিয়ে এই মাছ ঢেকে রাখার চেষ্টা করা হয়। তা পাঠককূলকে বিভ্রান্ত করে, যা এখন অহরহ ঘটে চলেছে। এর কুফল সাধারণতঃ হয় সুদূরপ্রসারী।

কী হচ্ছে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি, হয়ত এর ফল সম্যক উপলব্ধি করতে পারছি না। এ সময় প্রয়োজন হয় ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখা, তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো।

বাংলাভাষায় প্রথম সার্থক সাহিত্যপত্রিকা বঙ্গদর্শন, সম্পাদক ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের হাত ধরেই বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের আসরে নতুন মর্যাদায় স্থাপিত হয়। বঙ্কিমের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে, নিজের আত্মজীবনী ‘জীবনস্মৃতি’তে এবং জীবদ্দশায় অনেকবার বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম ও বঙ্গদর্শনের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক রবীন্দ্রনাথ, বিভিন্ন প্রবন্ধে তা প্রকাশিত। বঙ্কিম-রবীন্দ্রের পারস্পরিক সম্পর্কের কিছু টুকরো-টাকরা – বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের চোখে – তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

বয়সে তেইশ বছরের বড় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী যখন প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন নেহাৎই চার বছরের বালক। পরবর্তী চার বছরে কপালকুন্ডলা আর মৃণালিনী নামে আরও দুটি উপন্যাস লেখেন বঙ্কিম। তিনটে উপন্যাসই বাঙালি পাঠকসমাজে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।

কর্মসূত্রে এরপর বহরমপুরে বদলি হন বঙ্কিম। সেখানে তখন তারকাদের ছড়াছড়ি। ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামগতি ন্যায়রত্ন, রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার প্রমুখ তাবড় নামজাদা সাহিত্যিকরা তখন পূর্ণ মহিমায়। এদের সান্নিধ্যে এসে বঙ্কিম বাংলায় একটা নতুন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের তাগিদ অনুভব করেন। ১২৭৯ সালের প্রথম মাস থেকেই তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাহিত্যের মাসিক পত্রিকা, বঙ্গদর্শন। বাংলা সাহিত্যে তা এক নবজাগরণের সূচনা করে প্রকৃত অর্থেই।

বঙ্গদর্শন প্রকাশের কারণ হিসাবে পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি লেখেন – সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ। আমরা এই পত্রকে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর পাঠোপযোগী করিতে যত্ন করিব। ... এই আমাদিগের প্রথম উদ্দেশ্য।

সাহিত্যসম্রাটের এই প্রথম উদ্দেশ্য পাঠকসমাজে কেমন গৃহীত হয়েছিল, তার উল্লেখ আছে রবীন্দ্রনাথের আত্মকথা ‘জীবনস্মৃতি’তে – অবশেষে বঙ্কিমের বঙ্গদর্শন আসিয়া বাঙালির হৃদয় লুঠ করিয়া লইল। একে তো তাহার জন্য মাসান্তের প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম, তাহার পরে বড়োদলের পড়ার শেষের জন্য অপেক্ষা করা আরও বেশি দুঃসহ হইত। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর এখন যে-খুশি সেই অনায়াসে একেবারে একগ্রাসে পড়িয়া ফেলিতে পারে কিন্তু আমরা যেমন করিয়া মাসের পর মাস কামনা করিয়া, অপেক্ষা করিয়া, অল্পকালের পড়াকে সুদীর্ঘকালের অবকাশের দ্বারা মনের মধ্যে অনুরণিত করিয়া, তৃপ্তির সঙ্গে অতৃপ্তি, ভোগের সঙ্গে কৌতূহলকে অনেকদিন ধরিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া পড়িতে পাইয়াছি, তেমন করিয়া পড়িবার সুযোগ আর কেহ পাইবে না।

বাংলা ভাষার গতিপ্রকৃতি বদলে গেল লহমায়। বঙ্গদর্শনের আগে কী ছিল আর বঙ্গদর্শন প্রকাশ পাবার পর কী হল, তার বিশ্লেষণে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন - পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেইসব বালক-ভুলানো কথা – কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।

বঙ্গভাষার বাল্যকাল ব্যাপারটাও রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করেছেন অতি সুন্দরভাবে। বঙ্কিম-যুগ শুরু হওয়ার আগে বাংলাভাষার বিন্দুমাত্র গৌরব ছিল না। সংস্কৃত পন্ডিতেরা বাংলাকে গ্রাম্য আর ইংরেজরা বর্বর বলে ভাবত। বাংলাভাষায় কিছু সে সাহিত্য রচনা সম্ভব, লিখে যে কোন কীর্তি অর্জন করা যায়, তা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না। বাংলাভাষায় লেখা বই মানে ছিল দয়া করে বাড়ির বৌ আর বাচ্চাদের জন্যে সরল পাঠ্যপুস্তক, তা না ছিল সরল, না পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।

এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না।

জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে এক ছাত্রসম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথের বঙ্কিমশ্রদ্ধা ও সেইসঙ্গে বঙ্গদর্শনের ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পায় এই ভাষায় - যেমন কাব্যসোহিত্যে মধুসূদন তেমনি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের পথমুক্তির আদিতে আছেন বঙ্কিমচন্দ্র। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ছাত্রদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন বরণীয় ব্যক্তি। ... তাঁর চিত্ত অনুপ্রাণিত হয়েছিল প্রধানভাবে ইংরেজি শিক্ষায়। ... যেমন দূর গিরিশিখরের জলপ্রপাত যখন শৈলবক্ষ ছেড়ে প্রবাহিত হয় জনস্থানের মধ্য দিয়ে তখন দুইতীরবর্তী ক্ষেত্রগুলিকে ফলবান্‌ ক'রে তোলে তাদের নিজেরই ভূমি-উদ্ভিন্ন ফলশস্যে, তেমনি নূতন শিক্ষাকে বঙ্কিমচন্দ্র ফলবান্‌ ক'রে তুলেছেন নিজেরই ভাষাপ্রকৃতির স্বকীয় দানের দ্বারা। তার আাগে বাংলাভাষায় গদ্যপ্রবন্ধ ছিল ইস্কুলে পোড়োদের উপদেশের বাহন। ... কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি শিক্ষার পরিণত শক্তিতেই রূপ দিতে প্রবৃত্ত হলেন বাংলাভাষায় বঙ্গদর্শন মাসিক পত্রে। বস্তুত নবযুগপ্রবর্তক প্রতিভাবানের সাধনায় ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম বাংলাদেশেই য়ুরোপীয় সংস্কৃতির ফসল ভাবী কালের প্রত্যাশা নিয়ে দেখা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে আনীত পণ্য আকারে নয়, স্বদেশের ভূমিতে উৎপন্ন শস্যসম্পদের মতো।

প্রসঙ্গতঃ বঙ্কিম মাত্র চারবছর পত্রিকাটা টানতে পেরেছিলেন। ১২৮২ সালে বন্ধ হয়ে যাবার পর মেজোভাই সঞ্জীবচন্দ্র সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে বছর পাঁচেক অনিয়মিতভাবে প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গদর্শন। তার পর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় এর প্রকাশ হয় গোটা চারেক সংখ্যা। ১২৯০ সালে তাও বন্ধ হয়ে যাবার দীর্ঘ আঠারো বছর পর আবার নব পর্যায়ে আত্মপ্রকাশ করে বঙ্গদর্শন, সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বঙ্গদর্শন প্রথম প্রকাশের সময় রবি বারো বছরের কিশোর, সদ্য কবিতা লিখতে ও দাদাদের আনুকূল্যে এদিক ওদিক ছাপাতে শুরু করেছেন। মেঘনাদবধ কাব্য পড়া হয়ে গেছে, কুমারসম্ভব-অভিজ্ঞানশকুন্তলম্‌ পড়ছেন, পড়ছেন ম্যাকবেথ। সে সময় পত্রপত্রিকায় সমস্ত লেখা লেখকের নাম দিয়ে ছাপা হত না। বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘ভারতভূমি’ বা পরের বছর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দ্বাদশবর্ষীয় বালকের রচিত’ ‘অভিলাষ’ কবিতাদুটির প্রথম বা দ্বিতীয়টি রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে অনুমান। অবশ্য যখন বঙ্গদর্শনে ‘এক চতুর্দশ বর্ষীয় বালকের রচিত’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়, অনেকের মতে বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ঘনিষ্টতার ফলস্বরূপ, তখন রবির বয়স বারো।

বঙ্কিমের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় চতুর্দশ বর্ষের কিছু পরে, সেই সময়ের কলকাতার সমস্ত কলেজ-দ্বারা আয়োজিত রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠানে, ১২৮২ সালের সরস্বতী পূজার দিন। রবীন্দ্রনাথ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন, উক্ত সময়ের পরবর্তীকাল পর্যন্ত তাঁর কলেজের বেতন চুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কলেজে অনুপস্থিতির কারণে তিনি তখন প্রাক্তন ছাত্র! অবশ্য পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে প্রাক্তন ছাত্রদের ভূমিকাই বেশি। তিনি সেই অনুষ্ঠানে জ্যোতিদাদার সরোজিনী নাটক থেকে কয়েকটি তেজোদ্দীপ্ত কবিতা পাঠ করেছিলেন, যার মধ্যে ছিল তাঁর নিজের লেখা – জ্বল্‌ জ্বল্‌ চিতা! দ্বিগুণ দ্বিগুণ। প্রথম দর্শন ও সেই প্রসঙ্গে বঙ্কিমের চরিত্রের শিষ্টতা ও পরিশীলতার উদাহরণ দিতে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র প্রবন্ধে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই রকম - বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ...সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। ... প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্‌গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।

সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন।

বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।

শিষ্টতা ও রুচিশীলতা সমাজের মান্যগণ্য মানুষের কাছে তো বটেই, সাহিত্যিকেরও এক অবশ্যম্ভাবী গুণ হওয়া উচিত, কেননা সাহিত্যিকের পাঠক-পাঠিকাগণ তাঁদের জীবন-যাপন ও সাহিত্যকর্মের মধ্যে অনেক সময়েই প্রভেদ করেন না। রবীন্দ্রনাথ আজীবন এই ধারা মেনে চলেছেন, বহু সময় অকারণ আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হয়েও তাঁর স্থৈর্য ও সংযমের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয়নি। বস্তুত বাংলাসাহিত্যে রুচিশীলতা আমদানির ক্রেডিটও তিনি বঙ্কিমকেই দিয়েছেন - ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।

‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামে এক পত্রিকায় কিশোর রবির বনফুল নামের কাব্য-উপন্যাস ও প্রলাপ নামে কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হচ্ছিল নিয়মিতভাবে। মাত্র সাড়ে পনের বছর বয়সে তিনি সেই পত্রিকায় অন্যের লেখা কাব্যপুস্তকের সমালোচনা প্রকাশ করেন, যার নাম ভুবনমোহিনী প্রতিভা, অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী। তিনটি বইয়ের রচয়িতা যথাক্রমে ভুবনমোহিনী দেবী (ছদ্মনামও হতে পারে), রাজকৃষ্ণ রায় ও হরিশ্চন্দ্র নিয়োগী। এই সমালোচনা বঙ্গদর্শনে নিয়মিত প্রকাশিত বঙ্কিমের গ্রন্থ-সমালোচনার ধাঁচে। তখন দু-রকম রীতিতে গ্রন্থ সমালোচনা করা হত – সংক্ষিপ্ত সমালোচনা, অর্থাৎ সমালোচকের বাহুল্যবর্জিত মতামত এবং দীর্ঘ সমালোচনা যাতে বইটার আলোচ্য বিষয়ের বর্ণনার পর সমালোচকের নিজস্ব বিশ্লেষণ দেওয়া হত। এই প্রথম প্রয়াসে তিনি বঙ্কিমের মতই দ্বিতীয় ধারায় মহাকাব্য, খন্ডকাব্য, গীতিকাব্য ইত্যাদির সাধারণ আলোচনা করে পরে তার গভীরে প্রবেশ করেছেন, একজন সাহিত্য উপদেষ্টা যেমন লেখকের আসন থেকে উঁচুতে বসে লেখককে উপদেশ দেন, সেই ভঙ্গিতে। নিজেই পরে লিখেছেন – খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম ... খন্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম।

বাংলা ভাষায় সাহিত্য-বিষয়ক যতগুলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল সেই সময়, তার আদর্শস্বরূপ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন। সমকালীন ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা তত্ত্ববোধিনী ছিল মূলতঃ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র, সুতরাং ধর্মীয় ও সামাজিক রচনার স্থান, যদিও এতেও সাহিত্যচর্চা কম হত না। বালক রবির অনেক রচনা এতে ছাপা হয়েছে। বঙ্গদর্শন অনুসরণে পরবর্তীতে প্রকাশ পায় আর্য্যদর্শন, বান্ধব, জ্ঞানাঙ্কুর, প্রতিবিম্ব, ভ্রমর। চারবছর নিয়মিত প্রকাশের পর বঙ্গদর্শন বন্ধ হওয়ার কিছু সময় পর অনিয়মিত অবস্থায় সঞ্জীবচন্দ্রের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করলেও তার পূর্বগৌরব ফিরে পায় নি। বাকি পত্রিকাগুলোর হালও একই রকম। প্রতিবিম্ব প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই জ্ঞানাঙ্কুরের সঙ্গে মিলে যায়, তাও শেষরক্ষা হয়নি। আর্য্যদর্শন, ভ্রমর – এদের অবস্থাও তথৈবচ।

বঙ্গদর্শনের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে ১২৮৪ সালের শ্রাবণমাসে আত্মপ্রকাশ করে ভারতী, ঠাকুরবাড়ি থেকে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে ও দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রাথমিক সম্পাদনায়। যদিও এই দুজন মূলতঃ ঐ কাজটুকুই করেছিলেন, অর্থাৎ শুরু করা, নামকরণ করা ও সম্পাদক হিসাবে নাম লেখানো। শুরুতে এর মূল কর্ণধার ছিলেন রবীন্দ্রনাথই, লেখা জোগাড় করা থেকে শুরু করে পত্রিকার যাবতীয় কাজ। কিছু কিছু সংখ্যায় তাঁর নিজের লেখা ছিল পত্রিকার অর্ধেকেরও বেশি। ভারতী পত্রিকা চলেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে, যার মধ্যে কাগজে কলমে রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক ছিলেন মাত্র এক বছর। দ্বিজেন্দ্রনাথের পর তাঁর বোন স্বর্ণকুমারী এবং ভাগ্নী সরলা বহুকাল এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। রবীন্দ্রপ্রতিভা উন্মেষে ভারতী-র গুরুত্ব অপরিসীম।

মাত্র ষোল বছর বয়সে ভারতী-র প্রথম দুটি সংখ্যায় ‘ভিখারিণী’ গল্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গদ্যসাহিত্যের সূত্রপাত। এই গল্পটিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোটগল্প। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে মূলতঃ কবি বলে পরিচিত করলেও তাঁর কবিতার স্বকীয়তা আসতে সময় লেগেছিল। তাঁর জন্মবর্ষে মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু এই ছাঁদ রবিকে প্রভাবিত করেনি একেবারেই। তিনি বিহারীলালের রচনায় শুরুতে বেশ কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সে কথা স্বীকার করেও গেছেন। বিহারীলাল শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন - আমার সেই কাব্যগুরুর নিকট আর-একটি ঋণ স্বীকার করিয়া লই। বাল্যকালে "বাল্মীকি-প্রতিভা' নামক একটি গীতিনাট্য রচনা করিয়া "বিদ্বজনসমাগম"- নামক সম্মিলন উপলক্ষে অভিনয় করিয়াছিলাম। বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্য অনেক রসজ্ঞ লোকের নিকট সেই ক্ষুদ্র নাটকটি প্রীতিপদ হইয়াছিল। সেই নাটকের মূল ভাবটি, এমন-কি, স্থানে স্থানে তাহার ভাষা পর্যন্ত বিহারীলালের "সারদামঙ্গলে'র আরম্ভভাগ হইতে গৃহীত। অবশ্য এই আদর্শ নিজস্ব পথ প্রশস্ত করার পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল না। নতুন বিষয় চয়ন, নতুনভাবে তাদের প্রকাশ ইত্যাদি ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর পথ তাঁকে নিজেই খুঁজে নিতে হয়েছিল। কিন্তু গদ্যের ব্যাপারে, বিশেষ করে কাহিনী চিত্রণে, চরিত্র সৃষ্টিতে অনেকের লেখাই তাঁর গদ্যরচনার দ্রুত পরিণতি প্রদানে সাহায্য করেছিল। বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অকুণ্ঠ, রমেশচন্দ্র দত্তের উপন্যাস বা দীনবন্ধু মিত্রের নাটক তাঁর গদ্যরচনায় সহায়ক হয়েছিল নিঃসন্দেহে, তবে এই তালিকায় অবিসংবাদিতভাবে শীর্ষে ছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র।

রবীন্দ্রনাথের লেখা বাল্মীকি প্রতিভা অভিনীত হয়েছিল বিদ্বজ্জন সভা নামে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠেয় বার্ষিক সভায়, যেখানে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নিমন্ত্রিত হতেন। রবীন্দ্রনাথের সেই প্রথম মঞ্চে অভিনয়, তখন তাঁর বয়স কুড়ি। লিখেছিলেন – তেতালার ছাদের উপর পাল খাটাইয়া স্টেজ বাঁধিয়া এই বাল্মীকিপ্রতিভার অভিনয় হইল। তাহাতে আমি বাল্মীকই সাজিয়াছিলাম (এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল), রঙ্গমঞ্চে আমার এই প্রথম অবতরণ। দর্শকদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন, তিনি এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়া তৃপ্তিপ্রকাশ করিয়াছিলেন।

ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতিই বছর এগারোই মাঘ অনুষ্ঠিত হত অপৌত্তলিক ব্রাহ্মদের বার্ষিক মাঘোৎসব। জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারীর মেয়ে সরলা লিখেছেন – একবার একটা ১১ই মাঘের উৎসবে বাড়ির ছেলেমেয়ে গায়নমন্ডলী আমরা গান গাইতে গাইতে হঠাৎ অনুভব করলুম আমাদের পিছনে একটা নাড়াচাড়া সাড়াশব্দ পড়ে গেছে। কে এসেছেন? পিছন ফিরে ভিড়ের ভিতর হঠাৎ একটা চেহারা চোখে পড়ল – দীর্ঘনাসা, তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি, মুখময় একটা সহাস্য জ্যোতির্ময়তা। জানলুম তিনি বঙ্কিম। যে বঙ্কিম এতদিন তাঁর রচনামূর্তিতে আমাকে পেয়ে বসেছিলেন আজ পেলুম তাঁকে প্রকৃতির তুলিতে হাড়েমাসে রঞ্জনা মূর্তিতে। রবীন্দ্র ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরার লেখনীতেও একই উচ্ছ্বাস – ছোট বেলায় আমি রবিকার সঙ্গে তাঁর সভায় এবং অন্যান্য জায়গায় চলে যেতুম। মনে আছে বঙ্কিমবাবুর বাড়িতেও গিয়েছিলুম। তাঁর তীক্ষ্ণ নাক ও চাপা ঠোঁটের চেহারা এখনও একটু একটু মনে আনতে পারি। তাঁর উপন্যাস তখন টাটকা টাটকা খোলা থেকে সবে নাব্‌ছে, আর মেয়েরা নতুন নতুন বই পড়বার জন্য আঁকুবাঁকু করছে। তিনি জোড়াসাঁকো বাড়ি আসবেন শুনে বর্ণপিসিমা ওঁদের সে কী আগ্রহ! আর খড়খড়ে তুলে উঁকিঝুঁকি মেরে তাঁকে দেখবার সে কী উৎসাহ!

এ থেকে বোঝা যায়, এমনকি সাহিত্যজগতেও সুদর্শন পুরুষদের অতিরিক্ত আবেদন ছিল। অবশ্য এ থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত ছিলেন না উত্তরসূরী রবীন্দ্রনাথও।

এরপর বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমের সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হন। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন - অনেকবার তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইয়াছে কিন্তু উপলক্ষ ঘটে নাই। অবশেষে একবার, যখন হাওড়ায় তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন সেখানে তাঁহার বাসায় সাহস করিয়া দেখা করিতে গিয়াছিলাম। দেখা হইল, যথাসাধ্য আলাপ করিবারও চেষ্টা করিলাম, কিন্তু ফিরিয়া আসিবার সময়ে মনের মধ্যে যেন একটা লজ্জা লইয়া ফিরিলাম। অর্থাৎ, আমি যে নিতান্তই অর্বাচীন, সেইটে অনুভব করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমন করিয়া বিনা আহ্বানে তাঁহার কাছে আসিয়া ভালো করি নাই।

এই লেখাতেই রবীন্দ্রনাথের কবি হিসাবে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর বর্ণনা অসামান্য - তাহার পরে বয়সে আরো কিছু বড়ো হইয়াছি; সে-সময়কার লেখকদলের মধ্যে সকলের কনিষ্ঠ বলিয়া একটা আসন পাইয়াছি - কিন্তু সে-আসনটা কিরূপ ও কোন্‌খানে পড়িবে তাহা ঠিকমত স্থির হইতেছিল না; ক্রমে ক্রমে যে একটু খ্যাতি পাইতেছিলাম তাহার মধ্যে যথেষ্ট দ্বিধা ও অনেকটা পরিমাণে অবজ্ঞা জড়িত হইয়া ছিল; তখনকার দিনে আমাদের লেখকদের একটা করিয়া বিলাতি ডাকনাম ছিল, কেহ ছিলেন বাংলার বায়রন, কেহ এমার্সন, কেহ আর-কিছু; আমাকে তখন কেহ কেহ শেলি বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন - সেটা শেলির পক্ষে অপমান এবং আমার পক্ষে উপহাসস্বরূপ ছিল; তখন আমি কলভাষার কবি বলিয়া উপাধি পাইয়াছি; তখন বিদ্যাও ছিল না, জীবনের অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প, তাই গদ্য পদ্য যাহা লিখিতাম তাহার মধ্যে বস্তু যেটুকু ছিল ভাবুকতা ছিল তাহার চেয়ে বেশি, সুতরাং তাহাকে ভালো বলিতে গেলেও জোর দিয়া প্রশংসা করা যাইত না। তখন আমার বেশভূষা ব্যবহারেও সেই অর্ধস্ফুটতার পরিচয় যথেষ্ট ছিল; চুল ছিল বড়ো বড়ো এবং ভাবগতিকেও কবিত্বের একটা তুরীয় রকমের শৌখিনতা প্রকাশ পাইত; অত্যন্তই খাপছাড়া হইয়াছিলাম, বেশ সহজ মানুষের প্রশস্ত প্রচলিত আচার-আচরণের মধ্যে গিয়া পৌঁছিয়া সকলের সঙ্গে সুসংগত হইয়া উঠিতে পারি নাই।

অবশ্য বঙ্কিমের সাক্ষাৎ পাওয়ার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এ বিষয়ে লিখেছেন - বঙ্কিমবাবু তখন বঙ্গদর্শনের পালা শেষ করিয়া ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। প্রচার বাহির হইতেছে। আমিও তখন প্রচার-এ একটি গান ও কোনো বৈষ্ণব-পদ অবলম্বন করিয়া একটি গদ্য-ভাবোচ্ছ্বাস প্রকাশ করিয়াছি।

এই সময়ে কিংবা ইহারই কিছু পূর্ব হইতে আমি বঙ্কিমবাবুর কাছে আবার একবার সাহস করিয়া যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিয়াছি, তখন তিনি ভবানীচরণ দত্তর স্ট্রীটে বাস করিতেন। বঙ্কিমবাবুর কাছে যাইতাম বটে কিন্তু বেশিকিছু কথাবার্তা হইত না। আমার তখন শুনিবার বয়স, কথা বলিবার বয়স নহে। ইচ্ছা করিত আলাপ জমিয়া উঠুক, কিন্তু সংকোচে কথা সরিত না। এক-একদিন দেখিতাম সঞ্জীববাবু তাকিয়া অধিকার করিয়া গড়াইতেছেন। তাঁহাকে দেখিলে বড়ো খুশি হইতাম। তিনি আলাপী লোক ছিলেন। গল্প করায় তাঁহার আনন্দ ছিল এবং তাঁহার মুখে গল্প শুনিতেও আনন্দ হইত। যাঁহারা তাঁহার প্রবন্ধ পড়িয়াছেন তাঁহারা নিশ্চয় লক্ষ্য করিয়াছেন যে, সে-লেখাগুলি কথা-কহার অজস্র আনন্দবেগেই লিখিত – ছাপার অক্ষরে আসর জমাইয়া যাওয়া; এই ক্ষমতাটি অতি অল্প লোকেরই আছে, তাহার পরে সেই মুখে বলার ক্ষমতাটিকে লেখার মধ্যেও তেমনি অবাধে প্রকাশ করিবার শক্তি আরো কম লোকের দেখিতে পাওয়া যায়।

১২৮০ সালের পৌষ বঙ্গদর্শন সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্র এক প্রবন্ধ লেখেন জয়দেব ও বিদ্যাপতির কবিপ্রকৃতির লক্ষণ বিচার করে। তাঁর মত অনুযায়ী জয়দেব ভোগ ও সুখের কবি এবং বিদ্যাপতি দুঃখের কবি। এঁদের দুই ভিন্নশ্রেণীর গীতিকবি আখ্যা দিয়ে তিনি লেখেন – যাহা জয়দেব সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা ভারতচন্দ্র সম্বন্ধে বর্তে, যাহা বিদ্যাপতি সম্বন্ধে বলিয়াছি, তাহা গোবিন্দদাস-চন্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিদিগের সম্বন্ধে তদ্রূপই বর্তে। এই প্রবন্ধের কিয়দংশ বিদ্যাপতি ও জয়দেব শিরোনামে ১২৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বিবিধ সমালোচনা গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়। কিন্তু ১২৯৪ সালে এই প্রবন্ধটিই যখন বিবিধ প্রবন্ধ প্রথম ভাগ-এ মুদ্রিত হয়, তখন দেখা যায় বঙ্কিম তাঁর পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। ডঃ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তাঁর বঙ্কিমচন্দ্রের রচনায় রবীন্দ্রের প্রভাব প্রবন্ধে এই ঘটনার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন কুড়ি বছর বয়সে তরুণ রবির লেখা চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি শীর্ষক প্রবন্ধটিকে। চন্ডীদাসের প্রেমভাবনা ও তৎপ্রসঙ্গে বিদ্যাপতির কাব্যবিচার শুধুমাত্র প্রবীণ বঙ্কিমকেই প্রভাবিত করেনি, আজ পর্যন্ত এদের কাব্যের তুলনা বিশ বছর বয়সী রবির প্রদর্শিত পথেই অগ্রসর হয়েছে।

একুশ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যাসঙ্গীত কাব্যগ্রন্থ। সেই বছর প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা কমলার সঙ্গে ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসুর বিবাহে নিমন্ত্রিত রবীন্দ্রনাথ পাত্রীপক্ষের বিডন স্ট্রীটের বাড়িতে উপস্থিত হতেই কঠোর বিস্ময়ের সম্মুখীন হন। এ প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতির বর্ণনা - সন্ধ্যাসংগীতের জন্ম হইলে পর সূতিকাগৃহে উচ্চস্বরে শাঁখ বাজে নাই বটে কিন্তু তাই বলিয়া কেহ যে তাহাকে আদর করিয়া লয় নাই, তাহা নহে। ... রমেশ দত্ত মহাশয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহসভার দ্বারের কাছে বঙ্কিমবাবু দাঁড়াইয়া ছিলেন; রমেশবাবু বঙ্কিমবাবুর গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইয়াছেন এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম। বঙ্কিমবাবু তাড়াতাড়ি সে মালা আমার গলায় দিয়া বলিলেন,"এ মালা ইঁহারই প্রাপ্য - রমেশ,তুমি সন্ধ্যাসংগীত পড়িয়াছ?" তিনি বলিলেন,"না"। তখন বঙ্কিমবাবু সন্ধ্যাসংগীতের কোনো কবিতা সম্বন্ধে যে-মত ব্যক্ত করিলেন তাহাতে আমি পুরস্কৃত হইয়াছিলাম। অন্যত্র এই ঘটনা সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – একদিন আমার প্রথম বয়সে কোনো নিমন্ত্রণসভায় তিনি নিজকণ্ঠ হইতে আমাকে পুষ্পমাল্য পরাইয়াছিলেন, সেই আমার জীবনের সাহিত্যচর্চার প্রথম গৌরবের দিন।

অনুজ সাহিত্যিককে এইভাবে বরণ করে নেওয়া বঙ্কিমচরিত্রের এক উজ্জ্বল দিক।

একইভাবে অগ্রজ, সমসাময়িক এবং অনুজ – সকলের প্রতি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রবীন্দ্রচরিত্রেরও এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি তাঁর প্রভূত শ্রদ্ধা ছিল তো বটেই, যদিও সাহিত্যের অঙ্গনে তাঁদের মতপার্থক্য যে একেবারে হয়নি, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - আমি তখন আমার কোণ ছাড়িয়া আসিয়া পড়িতেছিলাম, আমার তখনকার এই আন্দোলনকালের লেখাগুলিতে তাহার পরিচয় আছে। তাহার কতক বা ব্যঙ্গকাব্যে, কতক বা কৌতুকনাট্যে, কতক বা তখনকার সঞ্জীবনী কাগজে পত্রআকারে বাহির হইয়াছিল। ভাবাবেশের কুহক কাটাইয়া তখন মল্লভূমিতে আসিয়া তাল ঠুকিতে আরম্ভ করিয়াছি।

সেই লড়ায়ের উত্তেজনার মধ্যে বঙ্কিমবাবুর সঙ্গেও আমার একটা বিরোধের সৃষ্টি হইয়াছিল। তখনকার ভারতী ও প্রচার-এ তাহার ইতিহাস রহিয়াছে। ... এই বিরোধের অবসানে বঙ্কিমবাবু আমাকে যে একখানি পত্র লিখিয়াছিলেন আমার দুর্ভাগ্যক্রমে তাহা হারাইয়া গিয়াছে। যদি থাকিত তবে পাঠকেরা দেখিতে পাইতেন, বঙ্কিমবাবু কেমন সম্পূর্ণ ক্ষমার সহিত এই বিরোধের কাঁটাটুকু উৎপাটন করিয়া ফেলিয়াছিলেন।

এই বিতর্কের সূত্রপাত বঙ্কিমচন্দ্রের এক প্রবন্ধের উত্তরে ভারতী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ একটি পুরাতন কথা, বিষয়বস্তু হিন্দু-ব্রাহ্ম বৈষম্য। এর উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র লেখেন আর একটি প্রবন্ধ, "আদি ব্রাহ্মসমাজ ও নব হিন্দু সম্প্রদায়'। সেখানে তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য ভুল বুঝে অকারণ সমালোচনা করেছেন। চাপান-উতোর চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন - বঙ্কিমবাবু বলেন, "রবীন্দ্রবাবু "সত্য" এবং "মিথ্যা" এই দুইটি শব্দ ইংরাজি অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। সেই অর্থেই আমার ব্যবহৃত "সত্য" "মিথ্যা" বুঝিয়াছেন। তাঁহার কাছে সত্য Truth মিথ্যা Falsehood। আমি সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহারকালে ইংরেজির অনুবাদ করি নাই..."সত্য" "মিথ্যা" প্রাচীনকাল হইতে যে অর্থে ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে, আমি সেই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। সে দেশী অর্থে, সত্য Truth, আর তাহা ছাড়া আরও কিছু। প্রতিজ্ঞা রক্ষা, আপনার কথা রক্ষা, ইহাও সত্য।'

বঙ্কিমবাবু যে অর্থে মনে করিয়া সত্য মিথ্যা শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন তাহা এখন বুঝিলাম। কিন্তু প্রচারের প্রথম সংখ্যার হিন্দুধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধে যে কথাগুলি ব্যবহার করিয়াছেন তাহাতে এই অর্থ বুঝিবার কোনো সম্ভাবনা নাই, আমার সামান্য বুদ্ধিতে এইরূপ মনে হয়। তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্‌ধৃত করি। "যদি মিথ্যা কহেন, তবে মহাভারতীয় কৃষ্ণোক্তি স্মরণপূর্বক যেখানে লোকহিতার্থে মিথ্যা নিতান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাৎ যেখানে মিথ্যাই সত্য হয়, সেইখানেই মিথ্যা কথা কহিয়া থাকেন।'

প্রথমে দেখিতে হইবে সংস্কৃতে সত্য মিথ্যার অর্থ কী। একটা প্রয়োগ না দেখিলে ইহা স্পষ্ট হইবে না। মনুতে আছে - সত্যং ব্রুয়াৎ, প্রিয়ং ব্রুয়াৎ ন ব্রুয়াৎ সত্যমপ্রিয়ম্‌। প্রিয়ঞ্চ নানৃতং ব্রুয়াৎ, এষ ধর্মঃ সনাতনঃ। অর্থাৎ - সত্য বলিবে, প্রিয় বলিবে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য বলিবে না, প্রিয় মিথ্যাও বলিবে না, ইহাই সনাতন ধর্ম। এখানে সত্য বলিতে কেবলমাত্র সত্য কথাই বুঝাইতেছে, তৎসঙ্গে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝাইতেছে না। যদি প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝাইত তবে প্রিয় ও অপ্রিয় শব্দের সার্থকতা থাকিত না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, এখানে মনু সত্য শব্দে Truth ছাড়া "আরও কিছু'-কে ধরেন নাই ... সত্য শব্দের মূল ধাতু ধরিয়াই দেখি আর ব্যবহার ধরিয়াই দেখি - দেখা যায়, সত্য অর্থে সাধারণত Truth বুঝায় ও কেবল স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায়। অতএব যেখানে সত্যের সংকীর্ণ ও বিশেষ অর্থের আবশ্যক সেখানে বিশেষ ব্যাখ্যারও আবশ্যক।

দ্বিতীয়ত - সত্য বলিতে প্রতিজ্ঞা রক্ষা বুঝায় না। সত্য পালন বা সত্য রক্ষা বলিতে প্রতিজ্ঞারক্ষা বুঝায় - কেবলমাত্র সত্য শব্দে বুঝায় না।

তৃতীয়ত – বঙ্কিমবাবু ‘সত্য' শব্দের উল্লেখ করেন নাই, তিনি ‘মিথ্যা' শব্দই ব্যবহার করিয়াছেন। সত্য শব্দে সংস্কৃতে স্থলবিশেষে প্রতিজ্ঞা বুঝায় বটে - কিন্তু মিথ্যা শব্দে তদ্‌বিপরীত অর্থ সংস্কৃত ভাষায় বোধ করি প্রচলিত নাই - আমার এইরূপ বিশ্বাস।

বঙ্কিমচন্দ্র ক্ষোভের সঙ্গে আরও লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমালোচনায় তাঁকে বিস্তর গালিগালাজ করেছেন। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন - ... শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। ... তাঁহাকে গালি দিবার কথা আমার মনেও আসিতে পারে না। তিনি আমার গুরুজন তুল্য, তিনি আমা অপেক্ষা কিসে না বড়ো! আমি তাঁহাকে ভক্তি করি, আর কেই বা না করে। তাঁহার প্রথম সন্তান দুর্গেশনন্দিনী বোধ করি আমা অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠা। আমার যে এতদূর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল যে তাঁহাকে অমান্য করিয়াছি কেবলমাত্র অমান্য নহে তাঁহাকে গালি দিয়াছি তাহা সম্ভব নহে। ক্ষুব্ধ-হৃদয়ে অনেক কথা বলিয়াছি, কিন্তু গালিগালাজ হইতে অনেক দূরে আছি। মেছোহাটার তো কথাই নাই আঁষ্‌টে গন্ধটুকু পর্যন্ত নাই। ... হৃদয় হইতে উৎসারিত না হইলে সে কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইত না, যিনি বিশ্বাস করেন করুন, না করেন নাই করুন।

বঙ্কিমবাবুর প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ভক্তি আছে তিনি তাহা জানেন। যদি তরুণ বয়সের চপলতাবশত বিচলিত হইয়া তাঁহাকে কোনো অন্যায় কথা বলিয়া থাকি তবে তিনি তাঁহার বয়সের ও প্রতিভার উদারতাগুণে সে সমস্ত মার্জনা করিয়া এখনও আমাকে তাঁহার স্নেহের পাত্র বলিয়া মনে রাখিবেন। আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, আমি সরলভাবে যে-সকল কথা বলিয়াছি, আমাকে ভুল বুঝিয়া তাহার অন্য ভাব গ্রহণ না করেন।

এই তর্কের নিরপেক্ষ বিচার করেছেন রবীন্দ্র-ভাগিনেয়ী সরলা। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ গ্রন্থে লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথের প্রতিপাদ্য এই যে, মিথ্যা কোন অবস্থাতেই কথনীয় নয়। এ বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রকারকৃত ব্যতিক্রম বিধিগুলি তিনি সমর্থন করেন না, বঙ্কিম করেন – এই প্রভেদ। রবীন্দ্রনাথের দুই অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ বিষয়ে শাস্ত্রকারদের ও বঙ্কিমের পক্ষাবলম্বী হলেন, তাঁরা বক্তৃতাসভায় যোগদান করলেন না। কিন্তু ছোটরা তাঁর হীরো-ওয়ারশীপার হল।

... রবীন্দ্রের বক্তৃতা তৎকালীন ভারতীতে বেরিয়েছিল (সে সময় স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন এর সম্পাদিকা), বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্র রচনা সংগ্রহে সেইটি নিশ্চয় সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু বঙ্কিমকে বাঙালীর মনে চিরজাগরূক রাখবার কোন প্রতিষ্ঠান নেই। তাঁর যে শুধু ঔপন্যাসিক প্রতিভা ছিল না, সংস্কারের ও ভাবের গতানুগতিকতায় বাহিত না হয়ে বুদ্ধির প্রখর বিচারশীলতায় তিনি যে কত বড় আধুনিক, রবীন্দ্রের গুরু ও মার্গদর্শী তিনিই যে, সে কথা এই পুরুষের বাঙালীরা জানেনা। সত্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রের আনকম্প্রোমাইজিং আপোষশূন্য মনোভাবের অভিব্যক্তিতে সেদিন আমরা বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা মুগ্ধ হলুম। সত্যভক্তি আমাদের মনে ক্ষোদিত করে দেওয়া হল। শিশুদের পক্ষে এইটেই দরকার।

... বড় হয়ে যখন বিচার বুদ্ধি খানিকটা উদ্বুদ্ধ হল, তখন বঙ্কিমকে পড়ে দেখে অনুভব করলুম, বঙ্কিমের প্রতি সুবিচার করিনি আমরা, সেদিন মাতুল-ভক্তিতে অযথা বঙ্কিম-মতদ্বেষী হয়ে পড়েছিলুম।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তাঁর অবস্থান থেকে কখনোই সরে আসেন নি। অকৃত্রিম সত্যপ্রিয়তা রবীন্দ্র-চরিত্রের এক উজ্জ্বল বৈশিষ্ট, এর সূক্ষ্ম স্বরূপ বোঝা সহজ নয়। ‘ভালো-মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে’ তিনি শুধু লিখেই যাননি, জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় তার নিদর্শন রেখেছেন, সে সত্য অপ্রিয় হলেও। তাঁর প্রতি অযথা আক্রমণে তিনি বিচলিত হননি – সজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলালের অত্যাচার সহ্য করেছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রতিশোধ নিতে চরিত্রহননে উদ্যত হননি একবারও। বস্তুত ব্যক্তিকে নয়, বক্তব্যের বিরোধিতাই তাঁর বহু প্রবন্ধের উপজীব্য। আর প্রিয়জনের মৃত্যু অপেক্ষা অপ্রিয়তর সত্য মানবজীবনে কী আছে? সারা জীবন সেই সত্যের সম্মুখীন হয়েছেন অসম্ভব দৃঢ়তায়, কোত্থেকে সেই শক্তি পেতেন তা এখনও রহস্যই রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের সত্যভাবনা এক পৃথক আলোচনার বস্তু, এর জন্য তাঁকে তাঁর সমকালীন ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মত ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ বা ‘মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয় নি।

বাদ-প্রতিবাদের বৎসরাধিক কাল পরে রবীন্দ্রনাথ আবার একই বিষয়ে দামু ও চামু, বানরের শ্রেষ্ঠত্ব, হেঁয়ালি নাট্য ইত্যাদি প্রবন্ধ রচনা করেন ও সত্য শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন। প্রবন্ধগুলি তাঁর সমালোচনা গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। আগের সমালোচনাটিও ব্যাপকভাবে পুনর্মুদ্রিত হয় বালক, সঞ্জীবনী, তত্ত্ববোধিনী ও তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকায়।

বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’র সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ পরেও লিখেছিলেন - বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্রন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য তাঁহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথের মতে বঙ্কিমচন্দ্র ‘পাশ্চাত্য মুর্খ' অর্থাৎ ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের ওপর অজস্র অবজ্ঞা বর্ষণ করেছেন, যা তাঁর মতে গর্হিত এবং কৃষ্ণচরিত্রের মত গ্রন্থে অশোভন। বঙ্কিম যাঁকে মানবশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, সেই কৃষ্ণ একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সকারণে অস্ত্র ধারণ করতেও অনেক সময়েই বিরত হয়েছেন, তাঁরই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা আদর্শের অবমাননা। শ্রীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনায় অকারণে ইওরোপীয়দের ওপর খোঁচা দেওয়ায় বইটার মূল উদ্দেশ্যটা পর্যন্ত নষ্ট হয়েছে। কেননা কৃষ্ণচরিত্রের মত বই কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য না লিখে সর্বকালের সর্বজাতির জন্যই লেখা হওয়া উচিত।

বঙ্কিম লিখেছেন - হিন্দু পুরাণেতিহাসে এমন কথা থাকিতে আমরা কিনা, মেমসাহেবদের লেখা নবেল পড়িয়া দিন কাটাই, না-হয় সভা করিয়া পাঁচ জনে জুটিয়া পাখির মতো কিচিরমিচির করি। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন - ক্ষণে ক্ষণে লেখকের এরূপ ধৈর্যচ্যুতি "কৃষ্ণচরিত্রে'র ন্যায় গ্রন্থে অতিশয় অযোগ্য হইয়াছে। গ্রন্থের ভাষায় ভাবে ও ভঙ্গিতে সর্বত্রই একটি গাম্ভীর্য, সৌন্দর্য ও ঔদার্য রক্ষা না করাতে বর্ণনীয় আদর্শচরিত্রের উজ্জ্বলতা নষ্ট হইয়াছে। ...বঙ্কিম সামান্য উপলক্ষমাত্রেই য়ুরোপীয়দের সহিত, পাঠকদের সহিত এবং ভাগ্যহীন ভিন্নমতাবলম্বীদের সহিত কলহ করিয়াছেন। ... বঙ্কিম নানা স্থলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের আদর্শ যেমন কার্যকারী এমন দেবতার আদর্শ নহে। কারণ, সর্বশক্তিমানের অনুকরণে আমাদের সহজেই উৎসাহ না হইতে পারে। যারা মানুষে সাধন করিয়াছে তাহা আমরাও সাধন করিতে পারি এই বিশ্বাস এবং আশা অপেক্ষাকৃত সুলভ এবং স্বাভাবিক। অতএব কৃষ্ণকে দেবতা প্রমাণ করিতে গিয়া বঙ্কিম তাঁহার মানব-আদর্শের মূল্য হ্রাস করিয়া দিতেছেন। কারণ, ঈশ্বরের পক্ষে সকলই যখন অনায়াসে সম্ভব তখন কৃষ্ণচরিত্রে বিশেষরূপে বিস্ময় অনুভব করিবার কোনো কারণ দেখা যায় না। বঙ্কিম এই গ্রন্থের অনেক স্থলেই যে-সকল সামাজিক তর্ক উত্থাপন করিয়াছেন তাহাতে গ্রন্থের বিষয়টি বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে মাত্র, আর কোনো ফল হয় নাই।

১২৯৮ সালে প্রকাশিত হয় হিতবাদী পত্রিকা। সেখানে সম্পাদক কী কেমনভাবে লিখতে হবে এই জাতীয় ফরমায়েসি লেখা চাইলে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন সাধনা। তাঁর সাহিত্যসাধনায় এই সাধনা পর্ব (১২৯৮-১৩০২) এক স্বর্ণযুগ। সম্পাদনা ও সাহিত্যচর্চায় রবীন্দ্রনাথের সাধনা-র যুগ অনেকের মতে বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন যুগের (১২৭৯-১২৮২) সঙ্গে তুলনীয়।

হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও ব্রাহ্ম-উদারতা সেই সময়ের সমাজ ও সাহিত্যের অন্যতম চর্চার বিষয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু-ব্রাহ্ম বলতেন। বঙ্কিমের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা থাকলেও তাঁর শিষ্যকূল ও আর্য-ধ্বজাধারী নব্য হিন্দুসমাজের পৃষ্ঠপোষক চন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন, শশধর তর্কচূড়ামণি প্রভূতদের উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছিলেন –

কোথা গেল সেই প্রভাতের গান, কোথা গেল সেই আশা?
আজিকে বন্ধু তোমাদের মুখে এ কেমনতর ভাষা?
তোমরা আনিয়া প্রাণের প্রবাহ ভেঙেছ মাটির আল
তোমরা আবার আনিছ বঙ্গে উজান স্রোতের কাল।

১২৯৮ সালে উড়িষ্যায় বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কটক ও পুরীতে দুই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। কটকের ডিস্ট্রিক্ট জজ কবিবন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। দেশে তখন জুরিপ্রথা ও তাতে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্বের ওপর ইংরেজের বিধিনিষেধের ওপর প্রবল আন্দোলন হচ্ছে। সেই বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রিত ওখানকার র‍্যাভেনশ’ কলেজের অধ্যক্ষ হলোয়ার্ড তাদের সামনেই বলেন, এ দেশের মরাল স্ট্যান্ডার্ড লো, এখানকার লোকেদের লাইফের স্যাক্রেডনেস সম্বন্ধে যথেষ্ট বিশ্বাস নেই, এরা জুরি হবার যোগ্য নয়। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লেখেন - আমার যে কী রকম করছিল সে তোকে কী বলব ... একজন বাঙালির নিমন্ত্রণে এসে বাঙালির মধ্যে বসে যারা এ রকম করে বলতে কুণ্ঠিত হয় না তারা আমাদের কী চক্ষে দেখে! ... তোমাদের উচ্ছিষ্ট তোমাদের আদরের টুকরোর জন্যে আমার তিলমাত্র প্রত্যাশা নেই, আমি তাকে পদাঘাত করি। ... যারা ফিটফাট কাপড় পরে ডগকার্ট হাঁকায় আর আমাদের নিগার বলে, তারা যতই সভ্য ও উন্নত হোক, আমি যদি কখনো তাদের সংশ্রবের জন্যে লালায়িত হই, তবে আমার মাথায় যেন জুতো পড়ে।

কিছুদিন পর পুরীতে বিহারীবাবুর অনুরোধে সেখানকার ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার ওয়ালসের বাড়িতে গেলে চাপরাশি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে পরদিন আসতে বলে। বিরক্ত ও অপমানিত হয়ে ফিরে এলেও পরদিন বন্ধুর সম্মানে সেখানে যান তিনি। কিন্তু মনে মনে ইংরেজ শাসনের ও ভারতীয়দের ওপর তাদের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ মনের মধ্যে জেগে ওঠে প্রবলভাবে।

এর দেড় বছর পরে তিনি লেখেন পর পর প্রবন্ধ – অপমানের প্রতিকার, রাজা ও প্রজা, ইংরেজ ও ভারতবাসী। লেখেন ব্যঙ্গরচনা পয়সার লাঞ্ছনা। ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর ১৮৬১ সালে যে ভারত কাউন্সিল অ্যাক্ট চালু হয়েছিল, ১৮৯২ সালে তা সংশোধিত হয়, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকদের দাবিদাওয়া পূরণের বদলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারানীতি চালু করা হল। সরকারী চাকরিতে ভারতীয়দের প্রবেশের দরজা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ হল। দুই দেশের মুদ্রার বিনিময় এমন করা হল যে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের তাতে প্রভূত ক্ষতির সম্ভাবনা। এর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘ইংরেজ ও ভারতবাসী’ প্রবন্ধটি। কলকাতায় এক সভায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সভাপতিত্বে তা পাঠ করার আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাড়ি গিয়ে প্রবন্ধটি পড়ে শুনিয়ে তাঁর সম্মতি নিয়ে আসেন। বারো বছর আগে বিডন স্ট্রীটে রমেশচন্দ্র দত্তের বাড়িতে বঙ্কিমের জন্য প্রস্তুত মালা তিনি পরিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গলায়। বিডন স্ট্রীটের এই সভাতেই দুই দিকপালের শেষ সাক্ষাৎ ঘটল।

বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উপন্যাস রাজসিংহ রচিত হয়েছিল ১৩০০ সালে, বহুমূত্র রোগে তিনি তখন খুবই পীড়িত। চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বইটির সমালোচনা করুক। সেই মর্মে শ্রীশচন্দ্রের হাত দিয়ে বইটি পাঠিয়েছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ নতুন আঙ্গিকে বইটির সমালোচনা প্রকাশ করেন ভারতীতে, সমালোচনাও যে সাহিত্য হতে পারে, তার এক অপরূপ নিদর্শন ছিল সেটি। অত্যুৎকৃষ্ট এই সমালোচনা প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যু হয়, তিনি সম্ভবত সেটি দেখে যেতে পারেন নি।

বঙ্কিমপ্রসঙ্গ ফিরে ফিরে এসেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। জীবনসায়াহ্নে সাহিত্যের রূপ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি প্রকাশ করেছেন সাহিত্যের অগ্রগতির পিছনে সাহিত্যিকদের অবদানের ভূমিকার গুরুত্ব ও সেই প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমের অবদান। বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, আনন্দমঠ ইত্যাদি যুগান্তকারী উপন্যাসের চরিত্রসৃষ্টি প্রসঙ্গে লিখেছেন - তিনি গল্পসাহিত্যের এক নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিলেন। ... তাঁর পূর্বেকার গল্পসাহিত্যের ছিল মুখোশ-পরা রূপ, তিনি সেই মুখোশ ঘুচিয়ে দিয়ে গল্পের একটি সজীব মুখশ্রীর অবতারণা করলেন। হোমার, বর্জিল, মিল্‌টন প্রভৃতি পাশ্চাত্য কবিদের কাছ থেকে মাইকেল তাঁর সাধনার পথে উৎসাহ পেয়েছিলেন; বঙ্কিমচন্দ্রও কথাসাহিত্যের রূপের আদর্শ পাশ্চাত্য লেখকদের কাছ থেকে নিয়েছেন। কিন্তু, এঁরা অনুকরণ করেছিলেন বললে জিনিসটাকে সংকীর্ণ করে বলা হয়। সাহিত্যের কোনো-একটি প্রাণবান রূপে মুগ্ধ হয়ে সেই রূপটিকে তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন; সেই রূপটিকে নিজের ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনায় তাঁরা সৃষ্টিকর্তার আনন্দ পেয়েছিলেন, সেই আনন্দে তাঁরা বন্ধন ছিন্ন করেছেন, বাধা অতিক্রম করেছেন। এক দিক থেকে এটা অনুকরণ, আর-এক দিক থেকে এটা আত্মীকরণ। ... বঙ্কিম এমন একটি সাহিত্যরূপে আনন্দ পেয়েছিলেন, এবং সেই রূপকে আপন ভাষায় গ্রহণ করলেন, যার মধ্যে সর্বজনীন আনন্দের সত্য ছিল। বাংলাভাষায় কথাসাহিত্যের এই রূপের প্রবর্তনে বঙ্কিমচন্দ্র অগ্রণী। রূপের এই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তারই পূজা চালালেন তিনি বাংলাসাহিত্যে। তার কারণ, তিনি এই রূপের রসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এ নয় যে, গল্পের কোনো একটি থিওরি প্রচার করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। "বিষবৃক্ষ' নামের দ্বারাই মনে হতে পারে যে, ঐ গল্প লেখার আনুষঙ্গিকভাবে একটা সামাজিক মতলব তাঁর মাথায় এসেছিল। কুন্দনন্দিনী সূর্যমুখীকে নিয়ে যে-একটা উৎপাতের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা গৃহধর্মের পক্ষে ভালো নয়, এই অতি জীর্ণ কথাটাকে প্রমাণ করবার উদ্দেশ্য রচনাকালে সত্যই যে তাঁর মনে ছিল, এ আমি বিশ্বাস করি নে - ওটা হঠাৎ পুনশ্চনিবেদন; বস্তুত তিনি রূপমুগ্ধ রূপদ্রষ্টা রূপশ্রষ্টা রূপেই বিষবৃক্ষ লিখেছিলেন।

নবযুগের কোনো সাহিত্যনায়ক যদি এসে থাকেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করব, সাহিত্যে তিনি কোন্‌ নবরূপের অবতারণা করেছেন। …

বঙ্কিমের উপন্যাসে চন্দ্রশেখরের অসামান্য পাণ্ডিত্য; সেইটি অপর্যাপ্তভাবে প্রমাণ করবার জন্যে বঙ্কিম তার মুখে ষড়্‌দর্শনের আস্ত আস্ত তর্ক বসিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু, পাঠক বলত, আমি পাণ্ডিত্যের নিশ্চিত প্রমাণ চাই নে, আমি চন্দ্রশেখরের সমগ্র ব্যক্তিরূপটি স্পষ্ট করে দেখতে চাই। সেই রূপটি প্রকাশ পেয়ে ওঠে ভাষায় ভঙ্গিতে আভাসে, ঘটনাবলীর নিপুণ নির্বাচনে, বলা এবং না-বলার অপরূপ ছন্দে। সেইখানেই বঙ্কিম হলেন কারিগর, সেইখানে চন্দ্রশেখর-চরিত্রের বিষয়গত উপাদান নিয়ে রূপস্রষ্টার ইন্দ্রজাল আপন সৃষ্টির কাজ করে। আনন্দমঠে সত্যানন্দ ভবানন্দ প্রভৃতি সন্ন্যাসীরা সাহিত্যে দেশাত্মবোধের নবযুগ অবতারণ করেছেন কি না তা নিয়ে সাহিত্যের তরফে আমরা প্রশ্ন করব না; আমাদের প্রশ্ন এই যে, তাঁদের নিয়ে সাহিত্যে নিঃসংশয় সুপ্রত্যক্ষ কোনো একটি চারিত্ররূপ জাগ্রত করা হল কি না। পূর্বযুগের সাহিত্যেই হোক, নবযুগের সাহিত্যেই হোক, চিরকালের প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে : হে গুণী, কোন্‌ অপূর্ব রূপটি তুমি সকল কালের জন্যে সৃষ্টি করলে।

এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠের এ এক অনুপম শ্রদ্ধার্ঘ তাঁর অগ্রজ আর এক কালজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠ-র প্রতি।

সাহিত্যবিষয়ে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে এই আলোচনার ইতি টানতে চাই আপাতত। রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সঙ্গীতশিক্ষা করেছিলেন সেই সময়ের নামী শিক্ষক যদুভট্টের কাছে। মোগল সাম্রাজ্যের অন্তিমলগ্নে রাজদরবারের শিল্পীরা দু-মুঠো অন্নসংস্থানের জন্য দিল্লী ছেড়ে ভারতের নানা জায়গায় ছড়িয়ে যান, যদুভট্ট তাদের ঘরানারই উত্তরসূরী। তানসেন-বংশীয় ধ্রুপদ-গায়ক বাহাদুর খাঁ আশ্রয় নিয়েছিলেন বিষ্ণুপুর রাজসভায়। তাঁর এক শিষ্য রামশঙ্করের শিষ্য যদুভট্ট, তাঁর জন্ম বিষ্ণুপুরেই। ত্রিপুরার রাজদরবারে তিনি অনেককাল ধ্রুপদ গাইতেন। বঙ্কিমচন্দ্রও যদুভট্টের কাছে কিছুদিন গান শিখেছিলেন। সেসময় তিনি কিছুকাল বঙ্কিমচন্দ্রের বাসস্থান নৈহাটির কাঁটালপাড়ায় তাঁর বোনের বাড়িতে ছিলেন। যদুভট্টই প্রথম মল্লার রাগে বঙ্কিমের বন্দেমাতরম্‌ গানে সুর দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন ১২৮৮ সালে চুঁচুড়ায় বঙ্কিমের এক সম্বর্ধনা সভায়। এ আর রহমানের হাতে কিছু-মতে-উজ্জীবিত, কিছু-মতে-ধর্ষিত হওয়ার আগে বহু নামী সঙ্গীতজ্ঞ বন্দেমাতরম্‌-এ সুর দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। ১২৯২ সালে ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা ঠাকুরবাড়ি প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার ‘গান অভ্যাস’ অংশে রবীন্দ্রনাথের দেশ-কাওয়ালির সুরে এর প্রথম স্তবকটির স্বরলিপি প্রকাশ করেন। ন্যাশন্যাল সং-এর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই গানটি রবীন্দ্রনাথ প্রথম গেয়েছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ বার্ষিক সম্মেলনে, বঙ্গভঙ্গের আগে এর গ্রামাফোন রেকর্ডও বের করেন তিনি। ছোটমামার স্নেহধন্যা সরলা লিখেছেন – বন্দেমাতরম্‌-এর প্রথম দুটি পদে সুর দিয়েছিলেন নিজে। তখনকার দিনে শুধু সেই দুটি পদই গাওয়া হত। একদিন আমার উপর ভার দিলেন – বাকী কথাগুলোতে তুই সুর বসা। তাই ত্রিংশকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদকরালে থেকে শেষ পর্যন্ত কথায় প্রথমাংশের সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমি সুর দিলুম। তিনি শুনে খুশী হলেন। সমস্ত গানটা তখন থেকে চালু হল। সরলার এই স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০০ সালের ভারতী পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়।

ভারতের ন্যাশন্যাল অ্যান্থেম ও ন্যাশন্যাল সং – দুটিরই রচয়িতা ও সুরকার বঙ্গসন্তান। বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণে এই দুই দিকপাল বঙ্গসন্তানের সাহিত্য সৃষ্টি এক অমর অধ্যায় হয়ে আছে। অথচ কী লজ্জাকর পরিস্থিতি আজ, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলা এখন এক হাস্যকর স্থানে। জনচেতনার উন্মেষে সাহিত্য ও সাহিত্যপত্রিকাগুলির ভূমিকা আজ কুরুচিকর অন্তর্কলহে গুরুত্ব হারিয়েছে।

মুখের সামনে আয়না ধরলে এই জটাজাল থেকে বেরোনোর যে রাস্তা বাঙালী দেখতে পেত, তার নাম বঙ্গদর্শন!