বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

ধারাবাহিক - কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

চেয়েছি তোমার বাতাস কে ছুঁতে
কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়





শ্রীরামপুর পাবলিক লাইব্রেরির উল্টো দিকে যে রেললাইন সেটা পেরোলেই রেল কলোনি পুকুরের পাশ দিয়ে যে ইট পাতা গলি সেটা সোজা ঢুকে গেছে হাড়ি পাড়া লেন এর দিকে । একটা একতলা সবুজ রঙের বাড়ি, চার পাশ পলকা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা । ছোট্ট গ্রিলের দরজা খুলে বাঁধানো উঠান ,আর পাঁচিল ঘেঁসে যত্নে লাগানো ফুলগাছ । চন্দ্রমল্লিকা ,গোলাপ , পটুলেখা ও আরো নানা ফুলের গাছ । বাড়ির পিছনেও একটা ছোট বাগান । সেখানে অবশ্য সবজি । লাউ কুমড়ো সিম পেঁপে । বাড়ির সামনে এদিক ওদিক একটা দুটো পুকুর পাতা । শোবার ঘর লাগোয়া লম্বা ফালি বারান্দা থেকে বসে দেখা যায় দুটো একটা ছন্ন ছাড়া হয়ে বেড়ে ওঠা নারকেল গাছ । আর আছে তাল গাছ । বাজ পড়া । পাখিও আছে অজস্র । এখনো কি আছে ? প্রমোটার আর মুঠোফোন কোম্পানিদের তাড়া খেয়ে দলে দলে সমুদ্রের ভিতর হয়তো এত দিনে নেমে গিয়ে শুয়ে আছে তারা, যেমন করে শুভেন্দুর বাবা একদিন মৃত্যুর অজ্ঞানে নেমে গিয়েছিলেন|

আমার একসময়ের সর্বক্ষণের কবিতা সহচর ও বন্ধু শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় -এর ২০০০ সালে প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থীকা "রুটির শিস ও আশ্চর্য চিরাগ " এর পাঠ প্রতিক্রিয়াটুকু বোঝাতেই এই ধান ভানতে শিবের গীত ।কেননা কবি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় এর কবিতার পরতে পরতে উঠে এসেছে এই একশো মিটার বিস্তৃত হাড়ি পাড়া লেনের বস্তু পৃথিবী ও মধ্যবিত্ত দমকল কর্মী বাবা ও একসময়ে নিশ্চয় খুব ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন এমন একজন মা এর কথা । কিন্তু শুভেন্দু সেটা কি ভাবে লিখেছে সেটা স্তব্ধ হয়ে দেখার । একদম প্রবেশক কবিতাটির কথাই ধরা যাক - "আমার অগ্নিনির্বাপক পিতা, মা সসাগরা এইমাত্র / হেঁসেলে গেলেন আর তাওয়ার ওপর শিস দিয়ে উঠলো রুটি " অগ্নি নির্বাপক পিতার সাথে মিলিয়ে মা শব্দের পর সসাগরা বিশেসনটি বসিয়ে ও তৈরী করে নিল ব্যান্জনা । মধ্যবিত্ত পরিবারের আমাদের সবাইকার বাবা অগ্নি নির্বাপক আর মা সসাগরা নয় কি ? এই ভাবেই বার বার উঠে এসেছে ইস্ট পাকিস্তান থেকে শুধু মাত্র প্রাণ টুকু নিয়ে পালিয়ে আসা অমৃত্তু কমিউনিসম এর আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকা একজন বাবার কথা । "খুব রাতে আমার বাবার আত্মা নেমে যায় বাগানের দিকে ,আমরা গোটা পরিবার তখন ঘুমে বিভোর । অসুস্থ চন্দ্রমল্লিকাটির দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন আর সন্ধান করেন অদ্ভুত দর্শন পোকাটির ,দেখি তার সানাই বাদকের মত ফোলা গাল ,হাঁটু অব্দি হাফ প্যান্ট ...." ( বেশী রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি )

আমাদের গোটা নয় -এর দশক জুড়ে ছিল অনিস্চয়তা । বিশ্ব রাজনৈতিক ,আর্থ সামাজিক ,এবং বলাই বাহুল্য এখনকার দিনের ছেলে মেয়েদের মত সামনে প্রচুর কেরিয়ার তৈরী করার সুযোগ ছিল না । এখনকার দিনের মত ব্যঙ্গের ছাতার মত চারিদিকে গজিয়ে ওঠা সেলফ ফাইনানস ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ , ফার্মাসি কলেজ আর ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট ছিল না , আর না ছিল তখন আমাদের বাবা -মা দের র পয়সা । এখন সুযোগ বাড়ার ফলে মেরিট না থাকলেও চলে ,শুধু মাত্র বাবা -মা র অর্থের জোরে ছেলে -মেয়েরা কেরিয়ার বৈতরণী উতরে যায় । উচ্চমাধ্যমিক এ সাতশোর উপর পাওয়া মেধাবী শুভেন্দু তখন পদার্থ বিদ্যার সাম্মানিক। তবু শুভেন্দু কবিতা লিখতে চায়নি । যত দূর মনে পড়ে বখা চোখরার দলে মিশে গিয়ে তাস খেলত খুব আর কবি সোমনাথ মুখোপাধ্যায় এর মেয়েকে দেখতে পাওয়ার লোভে লোভে কবিতা টুকত, বড় প্রধান কবিদের এড়িয়ে, পুরনো দেশ ঘেঁটে ঘেঁটে ও বার করত অখ্যাত সব কবিদের লেখা ।হুবহু টুকে নিজের বলে নিয়ে যেত সোমেনাথ দা র বাড়ি ।সেটাই ছিল ওর পাসপোর্ট, সোমনাথদার বাড়ি ঢুকতে পারার, আর সেই সুযোগে উদ্ভিন্নযৌবনা সহেলি কে দেখতে পাওয়ার সুযোগ। কোনো দিন যদি কবি কন্যার আচড়ে ফেলে দেওয়া চুলের কুন্ডলী বা ব্যবহৃত ন্যাপকিন কুড়িয়ে পাওয়া যেত, ও সেদিন ডবল খুশি, - ও লিখেছে " সে ছিল ছলাকলার অন্তর্বর্তী ঋতু /সে হেতু বাগান পথ ঘন লাল রং /চুলের কুন্ডলী আমি পেয়েছি কুড়িয়ে /এই তুক মন্ত্র পাশে ঘুমিয়ে পড়েছ "(অশরীরী) একেবারে হুবহু টুকে লেখা থেকে অক্ষরবৃত্তের এমন নিখুঁত দুলুনি, মিথ আর ফ্যাক্ট এর অনায়াস মিশেল ,তা শুধু সম্ভভ হয়ে ছিল শুভেন্দুর জেদের কারণে । একদম খাঁটি কবিদের মতই ও একদম শুরু থেকে জানত ,যে ও পারে ঘুরিয়ে দিতে আখ্যানের শেষ অংশটুকু । কেননা সে ধরে সমস্ত ছন্দ ,ধরে কনিষ্ঠায় গিরি গোবর্ধন ।

সহেলি বুঝতে পারে নি শুভেন্দুকে । মেয়েরা নিরাপত্তা চায় । তাই একদিন প্রজাপতি আঁকা বিবাহঋতু মাড়িয়ে আমরা সদলবলে গিয়েছিলাম সোমনাথদা-র বাড়ি ,তখন সহেলির ভুরু আঁকা হচ্ছে ,নতুন করে কেউ চিবুক তুলে ধরে ঘন পল্লব দিচ্ছে চোখে , ঘৃণার ঘিন ঘিনে লাল রং দিয়ে আঁকা হচ্ছে ঠোঁট ... আমাদের মধ্যে শুভেন্দু ছিল একদম নিরুত্তাপ । পেট পুরে খেয়ে সেদিন রাতে ও একটানা লিখে যায় গুচ্ছ কবিতা ,যা পরে বিজল্পতে ছাপা হয় । তখনও charles bukowski পড়িনি ,তখনও জানতাম না ,তিনি কত আগেই লিখে রেখে গিয়েছেন- I ”I loved you like a man loves a woman he never touches, only writes to, keeps little photographs of. I would have loved you more if I had sat in a small room rolling a cigarette and listened to you piss in the bathroom, but that didn’t’ happen. Your letters got sadder your lovers betrayed you, kid, I wrote back, all lovers betray”. কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সহেলির একটা ফোটোগ্রাফ অন্তত শুভর কাছে থাকা দরকার | সেই প্রথম বন্ধুর জন্য ,সোমনাথদার বাড়ি থেকে সদ্য বিবাহিতার মধুচন্দ্রিমার অ্যালবাম থেকে খুলে নিয়েছিলাম একটা ছবি ,সহেলি পাহাড়ে ঝরনার ধারে তার পুরুষের সাথে । শুভ আবার কিছু কবিতা লেখে ,একটা নমুনা এখানে পেশ করতে ইচ্ছে করছে - সন্তর্পনে উঠেছি একদা পাহাড়ি ছায়ার উপত্যকায় / চেয়েছি তোমার বাতাস কে ছুঁতে বৃষ্টির মত ইষৎ ক্লিষ্ট / ভেসেছে বাতাসে পতনের কাল ধুলোয় অম্লে লতানে পুস্প /ঘিরে আছে পথ ভাঙ্গা নুড়ি আর পাতার শব্দ ( সন্তর্পনে উঠেছি একদা )

প্রেম ছাড়া আর একটি বড় উপজীব্য শুভেন্দুর কবিতায় যা আছে তা হলো ক্ষুধা । অসামান্য উপমা আর মেটাফোরে বার বার ধরেছে তাকে কবিতায় । "যেমন পিপড়ের শ্রম নিয়ে তোমাকে চিনতে শিখি মহান খাবার এক " ( তোমাকে চিনতে শিখি ) টিউসন করে সংসার ঠেলে নিয়ে যাওয়া " /নগরীর উপাচার শিক্ষাদান শেষে /আমি ভীরু ভিক্ষুপুত্র তুলে ধরি শির /বগলে ধরেছি চেপে তালপত্র পুঁথি /ক্ষুধা ভিন্ন অন্য কোনো শব্দ নেই তাতে " ( সংসার সোনালী কিছু )

কিন্তু এসব আমি কি লিখছি ? বন্ধুর কবিতা বই-এর আলোচনা করতে বসে , এই সব স্মৃতি -বিস্মৃতি র চেয়ে যা আরো বেশি তা তো ওর লেখা কবিতা ,যার প্রচ্ছদ স্বয়ং কবি সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ,মানে আমাদের সোমনাথদা করে দিয়েছিলেন ।বইটার ছাপা কপি শুভ কবে খবরের কাগজওলাকে বেচে দিয়েছিল ,আমার কাছে ই-কপি পাওয়া যায় ,লাগলে চেয়ে নেবেন ।