বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

ছোটগল্প - অজিত দাশ

শহরে কাকের মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু ব্যথা
অজিত দাশ




আজকাল নিজেকে নিজের কাছে অপরিচিত করে তোলার সৌখিন পদ্ধতি আমার চারপাশে খাঁ খাঁ করে। মস্ত বড় দালান উঠে গেলে উচ্চতার দখলে আয়তনকে যেমন চোখে পড়ে না আমারও ঠিক তেমন দশা। একটা অস্পষ্ট তাড়না, শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকার- এত উচ্চতায় পৌঁছেছে যার আয়তন ঠিক জানা নেই। না হয় কেন মাহবুব আজিজের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি। অথচ মাহবুব আজিজ আমার চব্বিশ ঘন্টার বন্ধু, আমাকে ঠিক আমার মত করে না জানলেও আমাকে জানার পদ্ধতি তার বেশ রপ্ত তাই কয়েকদিনের পর্যবেক্ষনে আজ হুট করেই বললো- কিরে কিসের এত ব্যাথা? মিনুর কোন খোঁজ খবর আছে? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকলেও হঠাৎ নিজেকে কাগজের মতো দলা পাকিয়ে গুটিয়ে নেই। সারটেইন অ্যাবসারডিটি- মাহবুব আজিজ জানে। আমার কতগুলু বাতিক তার স্পষ্ট করে জানা তাই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ল্যপ্টপের অজুহাত দেখিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। সারাদিন ব্যাস্ততার মধ্যে দিয়েই সকাল-সন্ধ্যা। ক্লাইন্ট-এমপ্লোয়ি, এমপ্লোয়ি-প্রোজেক্ট, প্রোজেক্ট-মানি। নিজস্ব ফার্ম। থার্টিসিক্স এমপ্লোয়ি। তিল তিল সৌভাগ্য জোড়াতালি দিয়ে আজ এইখানে। মাহবুব বলতো-শালা টাকা ইনকাম কোন কঠিন কিছু নয়রে, এর বাইরে কোন কিছু ইনকাম করাই কঠিন। এই যেমন ব্যালকনির একটা অস্পষ্ট আবহাওয়া ,মানি প্ল্যান্টের চকচকে পাতায় বছরের কয়েকটি দিনের আর্তনাদ আমি ঠিক ঠিক টের পাই। মানে আমারই কিছু পাওয়া না পাওয়া ব্যালকনির এই আয়তন জুড়ে রোপন করে দেই। দৃশ্যত নিজের কাছে উবু হয়ে থাকি। ক’জন পারে। বড্ড বেশি কঠিন এই ইনকাম। ইনডিফারেন্স! ইটস এ পাওয়ার টু গেট সামথিং এলস। টুং করে মোবাইলে টেক্সট এল- ‘বাবা তুমি ব্যাস্ত আছ কিনা ঠিক জানিনা। তাই টেক্সট করলাম। বিকেলে আসছি তাড়াতাড়ি এসো।’ আমার কমবয়সী মেয়ে মিনু। মানে আমার ছোট মিনু। মিনু বলতে আমার আরও একজন মিনু আছে - ধর্মপুরের দোতলা বাসায় থাকে। জার্মান প্রবাসী বাবা-মা। টাকা পয়সা ঢের তবু পলেস্তরা খসা বাড়িতেই তার সারাদিন ভাল লাগে। জানালার পাশে কাঠগোলাপ, স্বর্ণচাপা তবু পলেস্তরার নিয়মিত গন্ধই তাকে বেশ আকৃষ্ট করে। নিয়মিত বলতে তার ভাষায়- ‘একটা জ্যান্ত শরীর। যতদিন আমরা এই নিয়মিত শব্দটি ব্যাবহার করি ঠিক ততদিন একটা জ্যান্ত শরীরী স্বাদ আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমাদের বাঁচতে শিখায়।’ মিনুকে এখন আর তেমন ভাবতে ইচ্ছে হয় না। অথবা ইচ্ছে করলেও সময়কে ঠিক ধরতে পারি না। সময়ের অনুপস্থিতি খুজতে গিয়ে কাগজে আকি ঝুকি করি। কোথাও লিখি ‘হত্যা’, কোথাও ‘পুড়ে যাওয়া সোনা’, মৌনতা ইত্যাদি। খুব যৌবনে যাকে ধ্রুব বলে ধরে নিয়েছি তারও যে তিনটি স্তর আছে কে জানে। ইশ ভালবাসা! ভার্সিটি পিরিয়ড শেষ হওয়ার পর জীবনের অনিচ্ছা শক্তি ঢেকে শেখেরটেকের এই বাড়িতে আমার বাকী জীবন। মিনুর গোছানোর প্রয়োজন ছিল তাই তার মতে সম্পর্ক যতটা দীর্ঘ হলে চলে ততটা মানাসই তার চেয়ে বেশি কিছু মানে একটা অস্পৃশ্য ইমোশান। অবশ্য আমারও কোন অনুযোগ ছিল না। বস্তুবাদ বুঝি যথেষ্ট রেশনাল হোমু সেপিয়েন্স। তবুও অন্ধকার ঘরে তার শরীর মাখা প্রজাপতি আমাকে দিনের পর দিন এমনভাবে শাসন করে ইচ্ছে হয় আরও একবার ফিরে যাই তার কাছে। আরও একবার সাপের মত খামচে ধরি তার শরীর। আরও একবার চষে বেড়াই নানুয়া দিঘী থেকে ধর্মসাগর, রামঘাটলা...। আমারও ইচ্ছে হয় অফিস ফেরত জীবনে নিকট সুখের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে দেখি। মানে নারী-পুরুষ খেলা। যত্নের একটা সামঞ্জস্য টেনে টেনে বুকপকেটে তোলে নেই। শাসনের একটা গন্ডির কাছে নিজেকে দাঁড় করিয়ে বিশ্বস্থ হই। এই যেমন মাহবু আজীজ- অফিস ফেরত জীবনে ছোট একটা ফুটফুটে মেয়ে, আর অপেক্ষার খুনসুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী। একটু দেড়ি হলেই মাহবুবব আজিজকে ঠিক কাঠগড়ায় তুলে ফেলে মৃত্তিকা- কি ব্যাপার এতক্ষণ কই ছিলে, অফিসে কোন নতুন মেয়ে এমপ্লোয়ি এসেছি নাকি। মনোজিত দা অনেক আগেই ফিরেছে। তুমি...? । মাহবুব আজিজের একটু দেড়ি হলে সাই সাই করে আমার কাছে ফোন চলে আসে- দাদা কোথায়? একসাথে? নাকি চলে এসেছেন? মৃত্তিকার একেবারেই সহ্য হয়না অফিস শেষে কোনা আড্ডা, দেড়ি করে বাড়ি ফেরা। বাড়িতে গেলেই চায়ের উপর চা। একটা মলিন আগ্রহ নিয়ে সংসারের সবগুলু টুকি-টাকি যেন একবার নেড়েচেরে আমার কাছে দিব্যি বলে যায় । এটা হয়নি, এটা লাগবে, এটা পেয়েছি, আরও গোছিয়ে কিনব ইত্যাদি। আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। কি আশ্চর্যভাবে নারীরা তাদের জীবনে বিপরীত লিঙ্গের প্রভাবকে শুদ্ধ করে নেয় , সবচেয়ে জঘন্য পুরুষের সমস্ত শুষ্কতা সে ধুয়ে মুছে নেয় নিজের শুদ্ধতা দিয়ে। হুট করেই প্রশ্ন করে বসে- দাদা বিয়েটা করলে না কেন। আমি আতকে উঠি- তড়িঘড়ি উত্তর দিয়ে বসি আমাকে যে কেউ বিয়ে করেনি। একটু গম্ভীর সুরে আবার জবাব দেয়-‘তোমার রসিকতা ঠিক বুঝি না...।’ তারপর নিজের মধ্যে উবু হয়ে ভাবতে থাকি। একটা আবহ শুন্যতার সঙ্গীত আমার চারপাশকে কামড়াতে থাকে। চিবুতে চিবুতে ঠিক মিনুর কাছে নিয়ে যায়। সেই ধর্মপুরের দোতলা বাসার মিনু। গান্ধর্ব বিবাহ মতে মিনু আমার স্ত্রী। যে বিবাহে পাত্র-পাত্রী পরস্পরের প্রতি অনুরাগ বশত দেহ-মিলনে আবদ্ধ হয়, বেদের ভাষ্য অনুযায়ী তাকে ‘গান্ধর্ব বিবাহ’ বলে। এই বিবাহে পাত্র-পাত্রী গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করে মৈথুন ইছা ঘটায়। অবশ্য মৈথুন ইচ্ছাই সম্পর্কের শ্রেষ্ঠ পরিনতি নয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলবত থাকলে আর দশজনের চেয়ে আমরা যেমন বিশেষ ক্ষমতা অনুভব করে অস্তিত্বের একটা বিশেষত্ব দাঁড় করিয়ে দেই। সম্পর্কেও ঠিক তেমন কিছু লাগে। মিনু বলতো নির্যাস। আমি এখনো বুঝে ওঠতে পারিনি। হঠাত টুং করে মোবাইলে ম্যাসেজ- বাবা কোথায়? আসছ না যে? মাঝে মাঝে ছোট মিনু এসে কয়েক দিন থেকে যায়। প্রয়োজনীয় ছোট-খাট জিনিস পত্র নিয়ে, সাথে নতুন রিলিজ হওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে একজন লোক শুধু রবীন্দ্রনাথের গান শোনে এটা তার ভাবতেই বিস্ময় লাগতো। মাঝে মাঝে আমাকে ঠাট্রা করে বলতো- বাবা যতই রবীন্দ্রনাথ শোন না কেন একনের গান না শোনলে কিন্তু স্বর্গে যাবেনা। মিনুকে দেখলে মাঝে মাঝে খটকা লাগে। ভাবতে অবাকা লাগে এ সেই মিনু যে উল্টে-পাল্টে একটা সোঁদা জীবনকে সুগন্ধীময় করে দিচ্ছে। আমি বলি

-থাকনা আর কত ছেড়ে দে।

-তোমার এই চাপিয়ে দেয়া অভ্যাস টা গেলো না। নিজেকে নিয়ে কজন মানুষ থাকতে পারে বল। সবাই কি পারে তোমার সেই ‘বি অবজার্ভার নট অবজার্ভড’ মেথড ফলো করতে। আমার একটা কিছু লাগবে। ধরে নিতে পার সেটা সিম্বোলিক।

-হুম... তাই কর। মৃত্যুর পর কোমড়ে বেঁধে সুখটাকেও সাথে নিয়ে যাবি যখন দরকার একটু একটু খরচ করবি। কি বলিস?

একটা আচমকা নিস্তব্ধতা মিনুর চারপাশে। কথাটা না বাড়ানোর আগ্রহ নিয়ে একটু আক্ষেপের সুরে বললো

-মার খোঁজ খবর নিয়েছো। তোমার বড় মিনুর?

আমি চুপ করে থাকি। মিনু ঠিক বোঝতে পারে সময় কতটা বেমানান। তাই দুজন দুজনকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রা দিয়ে আটকে দেই,যে যার মত করে। মিনুর জন্ম হওয়ার ছয় বছর পর তার মা এক সন্ধ্যায় শেখেরটেকের বাসায় এসে হাজির। সাথে ফুটফু্টে গোলাগাল গড়নের একটি মেয়ে অবিকল সেই আগের মিনু; পাঁচবছর পর এতটা অস্পষ্ট লাগছিল তাকে, মুখের দিকে তাকাতে না তাকাতে বলে ওঠল- তোমার পুরানো মিনুকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। তুমি জান তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। মিথ্যে সম্পর্কের দোহাই দিয়ে ওকে বড় করেছি। আর পারছি না...। ঘাপটি মেরে তাকিয়ে ছিলাম তার মুখের দিকে; মুখের একেকটি ভাসমান রেখা যেন আমাকে বলেছিল তুমি এখনো বদলাওনি মনোজিত কেন যে ব্যাথাকে ব্যাথা বলে জান? মানুষের যেদিকে স্বাভাবিক বিকাশ চিরকাল সেদিকেই তার লোভ। হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই মুখতুলে বলছিল আমাকে আর দেখতে যেওনা। আমি চলে যাচ্ছি । নিরঙ্কুশ কোন কিছুর প্রতিই আমার বেশিদিন মোহ থাকে না। বলতে পার খাঁটি জিনিসের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। তোমার কি মনে নেই ইউরোকিংয়ের সেই বিকেল? চাইনিজ পর্দা আর বিনয়ের স্বচ্ছ ফড়িং যে ডানা মেলেছিল গায়ত্রীর বুকে। সেই আমাদের শেষ দেখা। তারপর শুরু হল কত বছরের অজ্ঞাতবাস।



যেই পাঁচ বছর বয়সী মিনুকে কাছে পেলাম বিলম্বিত প্রসব যন্ত্রণার মতো বুকের সমস্ত আবিরে ঘোলা হয়ে গেল বাড়ির আশপাশ। বুঝেছি পিতৃস্নেহের জ্বালা বুঝিয়ে দিতে মিনুর এই কারবার। ছোট মিনু অবিকল তার মায়ের মতো। চোখের গড়ন, উচ্চতা, স্বভাবের রং। কিন্তু বুদ্ধি আর মেধায় বাবার কাছাকাছি। সহজ কথা ঠিক সহজে বুঝবার ক্ষমতা যেমন আমার ছিলনা ছোট মিনুরও ঠিক একই দশা। আংগুল কাঁটার ভয়ে যে মেয়ে বছরের পর বছর ছুড়ি ধরেনি, জাগতিক অর্থে সে বোকাই। অথচ মায়ের মতোই একদিন আবিষ্কার করে চিরকুটে লিখেছিল-‘বাবা কাল তোমাকে পেয়াজ কেটে দেখিয়ে দিব। আমি এতদিন পর আবিষ্কার করেছি নিজেকে দংশন করার প্রস্তুতিও মানুষকে ভিতরে ভিতরে অনুশীলন করে নিতে হয় নইলে আগুন্তুক হয়ে তাকে ঠিক আঘাত করা যায় না। তুমি ঠিক বলেছ-মানুষের খোলস বদলানোর প্রয়োজনীয়তা আছে।’ মানুষ যে খোলস বদলাতে পারে তা সর্বপ্রথম আমাকে শিখিয়েছে মিনু। সে বলতো - প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে মানুষ খোলস বদলায় না। মানুষ ততটা বিল্ট ইন হতে পারে না। তাকে শিখে নিতে হয়। আমাদের ভিতরটা চিরকাল শিশু থাকার ইচ্ছা পোষণ করে তাই দুঃখ, ব্যাথা, যন্ত্রণা উপশমের ব্যাপারে আমরা শুচিবায়ূগ্রস্থ হয়ে থাকি। যেই আমরা খোলস বদলাতে শিখি পদার্থের নিয়ম অনুসারে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করতে না পারলেও ভাবতে পারি। সেটা সচেতন মনে না হলেও অবচেতন মনে। তাতে কিছুটা স্বস্থি মেলে। এই যেমন ধর তুমি সেই কলেজ থেকে আমাকে এত চেয়েও জানাতে পার নি। নিজেকে বিন্দু পরিমাণ বদলাতে শিখনি মনোজিত। আমি না বুঝলে এতদিনে সর্বনাশই হয়ে যেত। কী আশ্চর্য এত কম বয়সেই- প্যাথ টু হায়ার কনসাসনেস, চয়েসল্যাস এওয়ারনেস এরকম বই বুঝে গেছ । আল্টিমেট কি লাভ বল? এস্কেপ! একপ্রকার পলায়ন; জীবন থেকে না হয় সময় থেকে। মিনুর মুখের ওপর কিছুই বলার সাহস হয়নি তখন। এখনো নেই... মুহূর্তে ব্যল্কনির নীলাভ অন্ধকার নেমে আসে আমার সমস্ত শরীর জুড়ে। ব্যাথার উৎস অনুসন্ধানে ব্যার্থ হই বলে তাকে অস্বীকারের কোন পথ খুঁজে পাই না। টুং করে মিনুর এসএমএস সমস্ত নিস্তব্ধা ভেঙে খান খান করে দেয়। বের বের হতে হতে মাহবুব আজিজ জিজ্ঞেস করে- কিরে জানালিনা কিন্তু? ক্রমশ অন্ধকার ঘোলা করে হঠাৎ নিজের অজান্তেই বলে ওঠি ও হ্যাঁ কিছু ব্যথা আছে , শহরে কাকের মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু ব্যাথা।