রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ ১২তম সংখ্যা

সম্পাদকীয়


রঙ-বেরং এ সাজল পুতুল ছোট্টো শিশুর হাত ধরে
ভোটরঙ্গে বঙ্গপুতুল মাতল খুনে, ছোট্টো শিশুর হাত পোড়ে...

মানুষগুলো গিরিগিটির মতো খোলোস ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে যায় রঙ থেকে রঙে। বিশেষত, এই বাংলায় এখন যেন মানুষের একমাত্র পরিচয় রঙে। রঙ দিয়ে যায় চেনা। রঙের আমি রঙের তুমি। ভারতীয় না। বাঙালিও না। সে অর্থে রঙিন। শুধু বন্দুকের নলই নয়, রঙও ক্ষমতার উত্স। রঙ বলে দেবে তুমি কোন পথে যাবে। রঙ বলে দেবে তুমি কি স্বপ্ন দেখবে। হীরক রাজার যন্তর-মন্তরে মগজ ধোলাই করে রঙ তোমাকে শিখিয়ে দেবে তোতাবুলি। জপতে থাকবে অন্ধবিশ্বাসীর মতো। আবার হাজার অপরাধ কর না তুমি, রঙ মিলে গেলে ফাঁসি হবে না। যমের দুয়ার থেকে বাঁচিয়ে আনবে। আর, গণতন্ত্রকে রঙ মাখিয়ে শালুতে পুঁটুলি বেঁধে গুমঘরের প্রেতকোণে টাঙিয়ে রাখবে। তাই, তুমি মানুষ না জানোয়ার? তুমি হিন্দু না মুসলমান? তুমি ধনী না দরিদ্র? তুমি শিশু না বৃদ্ধ? তুমি নারী না পুরুষ? এসব কিছুই বড় কথা নয়। বড় কথা তুমি কোন রঙে নিজেকে শিয়াল সাজিয়েছ! বেরং থেকেছ তো, হর্তা-কর্তা-বিধাতার লুকোনো তুলির তীক্ষ্ণ টানে টুকটুকে করে তুলবে তোমার মন, তোমার পরিচ্ছদ। ঘর-গেরস্থালি, ভিটে মাটিতেও সেই তুলির একছোপে আঁকা হয়ে যাবে নিমেষেই ধ্বংসরুপ।

‘তবু দূর আকাশে চাঁদ হাসে,
তবু ফুল ফোটে তার সুবাসে’...

হয়তো একদিন সাত রঙে রংধনু আঁকা হবে বাংলার আকাশে আকাশে। একদিন সত্যি সব রং খেলা যাবে কোনো এক বসন্তদিনে। হয়তো একদিন কোনো রঙ মানুষকে দলতন্ত্রে বাধ্য করবে না আর কোনোদিন। হয়তো কোনো শিশুর হাত পুড়বে না রঙের দাপটে। কোনো ঘর-গেরস্থালি, ভিটে মাটিতে আঁকা হবে না রঙিন নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, বর্বরতা; বরং, মানুষের প্রতি ঘরে ঘরে রঙেরা এঁকে দেবে রাশি রাশি ভালোবাসা। গাছে গাছে আরো বেশি কিছু ফুল। একদিন নিশ্চয়ই সব রঙ নিজেদের সঁপে দেবে কবিতার পায়ে। কবিতাও যে প্রতিবাদেরই এক অনন্য উচ্চারণ। আর সেইদিন অবশ্যই কবিতারঙে রেঙে উঠবে মহাপৃথিবীর ‘বাতাস জল আকাশ আলো’। আসুন বন্ধুরা! এপার বাংলা, ওপার বাংলা, প্রবাসী বাংলা(লক্ষণার্থে)র সমস্ত বন্ধুরা আসুন আমরা সকলে মিলে সেইদিনের প্রতীক্ষায় বন্দুকের নল নয়, কবিতাকে শক্তিশালী করে তুলি। সকলে ভালো থাকুন! কবিতায় থাকুন! সর্বোপরি কবিতার জয় হোক...

ক্ষেপচুরিয়াসের পক্ষে
বাণীব্রত কুণ্ডু ও নাশিদা খান চৌধুরী
 
 

উত্তর সম্পাদকীয় - অরিন্দম চন্দ্র

এ দেশ তোমার আমার
অরিন্দম চন্দ্র


সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন থাকাটা কোন দোষ নয় কিন্তু সমকালকে বাদ দিয়ে কি সত্যিই সাহিত্য হবে??এখানে এ’বিষয়ে যে কোন আকাদেমিক ডিসকাশন চলতেই পারে,কিন্তু আমি বলতে চাই এই যে এ’দেশের সীমারেখা বা তার বাইরে ঘটমান বর্তমানকে কি আমরা অস্বীকার করেই সাহিত্যে তন্নিষ্ট হব----বা পারব??

বিগত দুটি দশক জুড়ে এ দেশে চলছে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।স্বাধীনতা পরবর্তী চার-পাঁচটি দশক কেমন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক হোক,কিন্তু এ লেখার মূল উপজীব্য গত দুই দশক আমাদের এই দেশের মাটি আর দেশের মানুষ।আজ আমরা টিভির পর্দায়,সিনেমায়,খবরের কাগজের পাতায় পাতায় শুধু CONSENT MANUFACTURE হতে দেখি,কিন্তু আমার ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে বসা ছাত্র,তার বাপ-মা পরিবার তারা কোথায়,তাদের কথা কোথায়?

পাঠক আমাকে পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট বলতেই পারেন।কিন্তু কিছু চিন্তা না করবার চেয়ে ভুল চিন্তা করাও ভালো,তাই না?আসুন সাম্প্রতিক কিছু তথ্যের আলোয় দেখি কেমন আছে,আমার আপনার দেশের ম্যাঙ্গো পাবলিক,মানে গরীব মানুষ?
U.N.D.P র সাম্প্রতিকতম WORLD REPORT, 2013 দুই হাত তুলে সাধুবাদ জানিয়েছে এ দেশকে।এ বছর ব্রাজিল,চীন,রাশিয়া আর ভারতের মোট উৎপাদন সম্মিলিতভাবে কানাডা,ফ্রান্স,জার্মানী,ইতালী,ব্রিটেন আর আমেরিকার মোট G.D.P র চেয়ে বেশী হয়েছে—পাঠক,ভুলবেন না—১৫০ বছরে এই প্রথম।

ঐ এক রিপোর্ট বলেছে ভারতের দারিদ্র্য দূরীকরণে সাফল্যের কথা----বিগত দুই দশকে,অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৪৯.৪% থেকে ৩২.৭%।কম হল,প্রিয় পাঠক??

GLOBAL HUNGER INDEX অনুযায়ী গোটা দুনিয়ার ৮৮ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ২০০৯ সালে ৬৫ তম, ২০১০ সালে ৬৭ আর ২০১১ সালেও ৬৭।না না, এখানে নম্বর যত বাড়বে আপনি তত খারাপ,মানে পাকিস্তানের চেয়েও।আজ দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য চালু “মিড-ডে-মিল”—ভাবুন তো একবার,প্রাইমারী ক্লাসে প্রতিদিন প্রতি ছাত্র ৩ টাকা ৪৪ পয়সা আর আপার প্রাইমারীতে দৈনিক ৫ টাকা।আমার আপনার ঘরের বাচ্ছারা নাই বা গেল খিচুড়ী স্কুলে,কিন্তু পাশের বাড়ির দিনু বা মিনু কি পুষ্টি পাবে ঐ টাকায়!প্রতি বছর সামরিক খাতে ব্যয় বাড়বে আর শিশুরা অবহেলিত থাকবে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!!!!

GINI INDEX, যার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের আর্থ-সামাজিক অসাম্য মাপা হয়,তার বিচারে ভারতের ১০% সবচেয়ে বড়লোক শ্রেণীর আয় সবচেয়ে কম আয়ভূক্ত ১০% মানুষের চেয়ে ৮.৬ গূণ বেশী।O.E.C.D র দেওয়া সাম্প্রতিকতম তথ্যের ভিত্তিতে এই ফারাক বর্তমানে প্রায় ১২ গূণ।

UNICEF এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আপনার আমার প্রিয় দেশের অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কঙ্গো,তানজানিয়া,বাংলাদেশ এমন কি পাকিস্তানের চেয়েও বেশী।

জলবাহিত রোগে এই পোড়া দেশে প্রতি বছর ১ লক্ষ শিশু মারা যায়।মোট জনগণের মাত্র ৩৪% সরকারী হাসপাতালে যেতে পারে।শূণ্য থেকে ছয় বছরের শিশু কণ্যার সংখ্যা ২০০১ সালে ৯২৭ থেকে ২০১১ সালে ৯১৪ তে নেমেছে(সরকারী জনগণনা ২০১১ দ্রষ্টব্য)।হে পাঠক,আমি ইঙ্গিত দিচ্ছি না কিচ্ছু,আপনি ভেবে নিন...

যে দেশের প্রায় ৫০% মানুষ শৌচাগারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত সে দেশের যোজনা কমিশনের দুটি শৌচাগার তৈরী হল ৩৫ লক্ষ টাকায়,যার মধ্যে ৫ লক্ষ টাকা লেগেছে কে কে সেখানে ঐ কম্মটি করতে পারবেন সেই জন্য কার্ড বানাতে।

প্রিয় পাঠক,এ দেশ তোমার আমার...আর আজ এ দেশ দুই ভাগে বিভক্ত---বড়লোকেদের ইন্ডিয়া আর গরীবমানুষের ভারত।না, এটা কোন নির্বাচনী প্রচারের কথা নয় বন্ধু,আসুন এই ভারতের মানুষের জন্য কিছু ভাবি,কিছু লিখি বা আরও কিছু করি।হ্যাঁ,কিছু দায় আমাদের প্রত্যেককেই আজ নিতে হবে,কিছু ত্যাগ সবাইকেই করতে হবে।ক্ষুধার্ত মানুষ আজ ডাকছে,মানুষ সত্যিই খুব কাঁদছে।আমাদের লেখায় তাদের ভাষা দিতে হবে,প্রয়োজনে পথে নামতে হবে। আমাকে আমার মত থাকতে দাও,বোধ করি আপনিও আর ভাববেন না,ভাবতে পারবেনও না।

কবিতা - মলয় রায়চৌধুরী

দশক নির্দেশিকা
মলয় রায়চৌধুরী



যখন প্রথমসারির পৌরজোকাররা তাদের স্নেহধন্য হরিণচরণ ডটপেন নাচিয়ে শবাধিকার মারফত অ্যালবার্ট হল কফিহাউসকে মধ্য কলকাতা থেকে উত্তর বা দক্ষিণ কিংবা পুব-পশ্চিম কলকাতা কোথাও তুলে নিয়ে যায় একজোড়া বৃষ্টিসুখী জিরাফ গলায় গলা জড়িয়ে বাবলাকাঁটার মগডালে প্রার্থনাসঙ্গীত খোঁজে আর তখন বইমোসায়েবরা নিশ্চিন্ত হয় যে যাক বাবা একটা দশক ফুরুলো । চিয়ার্স ।

সৃষ্টিসুখের সিমফনি কিন্তু কাতরানি জাগায় না । সব দোষ সি-সেকশান দ্বিচারিতার ।

যে প্রেমিক শুক্রাণুরা ডিম্বাণুলোভী দৌড়ে হেরে গিয়েছিল তাদের মোরগভাষার মাধুর্যে গাওয়া এলিজি দিয়ে পরের দশকের ফুলশয্যা । কেননা ভগ্ননীড়ের কাঠিকুটো সবই রবিদাদুর ফসিলকোষে আর দি ওল্ড ম্যান তো সুপ্তের বুকে খুদ গব্বর ।

ধারাবাহিক - অভীক দত্ত

বিলাভারত
অভীক দত্ত



গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রাজনীতির একচেটিয়া নয়। বাসে ট্রামে নন্দীগ্রামে সব জায়গাতেই এর প্রাচুর্য আছে। কুরুক্ষেত্রে কৌরবেরা যুদ্ধের সময় শুরু থেকেই হেরে বসেছিল প্রচুর সৈন্য থাকা সত্ত্বেও। এর কারণ ওই।

দ্রোণ, ভীষ্ম, কৃপাচার্য সবাই লড়লেন বটে কিন্তু আদতে তারা লড়েছিলেন চেয়ারের হয়ে। মন থেকে তারা ছিলেন পান্ডবদের পক্ষে। এর ফল হয়েছিল মারাত্মক। জয়দ্রথের মৃত্যুর পরে যখন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল একাট্টা হয়ে লড়ার তখন কৌরব শিবিরে শুরু হল প্রবল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব।

কর্ণ যখন গরম গরম কথা বলে চেষ্টা করছেন কৌরবদের তাতানোর হঠাৎ করে কৃপাচার্য বলে বসলেন “ওহে, সূতপুত্র, অত বড় বড় কথা বলছ কেন? তুমি সব জায়গাতেই হেরে ভূত হয়ে আছো আর এদিকে বলছ তুমি পান্ডবদের মারবে”।

শুরু থেকেই এই বৃদ্ধদের পান্ডবপ্রীতিতে বিরক্ত কর্ণ যা নয় তাই বলে বসলেন কৃপাচার্যকে।বলেই বসলেন “বুড়ো তোর ওই জিভ আমি ছিড়ে ফেলে দেব”।

দ্রোণপুত্র অশ্বত্থমার মামা কৃপাচার্য। খচে গেলেন তিনি। খড়গ উদ্যত করে মারতে হাজির হয়ে গেলেন কর্ণকে। দুর্যোধন কোনমতে যুযুধান দুপক্ষকে ঠেকান।

মানেটা বোঝাই যাচ্ছে বেশ। এদের কারও লক্ষ্যই স্থির ছিল না। কেউ একাট্টা ছিল না। তার ওপর মুখে যাই বলুক দুর্যোধন, কর্ণদের মনে পাপবোধটা ছিল যে তারা পাণ্ডবদের সাথে যা করেছে সেটা ঠিক হয় নি। কর্ণ সেটা বলেও বসছেন জয়দ্রথের মৃত্যুর পরে।

২।

দাবা খেলায় যেমন সৈন্যের পেছনে মন্ত্রীকে ছুটিয়ে আচমকা হানা দিয়ে মন্ত্রী খেয়ে নেওয়া যায় সুকৌশলে, কৃষ্ণ একই ট্যাক্টিক্স নিয়েছিলেন। কর্ণের কাছে ছিল ইন্দ্রের থেকে পাওয়া কবচ কুন্ডল ও বৈজয়ন্তী বাণ। কবচ কুন্ডল আগেই হস্তগত হয়ে গেছিল, বাকি ছিল বৈজয়ন্তী বাণ। যে বাণ সযত্নে কর্ণ তুলে রেখে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য।মনে রাখতে হবে কুন্তীর কাছে দেখা হবার পর কর্ণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি অর্জুন বাদে বাকি পান্ডব সন্তানদের কিছু করবেন না।

জয়দ্রথ বধের পর পরই কুরুপান্ডবে শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। আর কর্ণ ছিলেন পুরো ফর্মে। একের পর এক পান্ডবপক্ষের সেনা পরাজিত হচ্ছেন দেখে অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন চল, এবার আমরা কর্ণ সংহার করি।

কৃষ্ণ ভালভাবেই জানতেন কর্ণের অস্ত্রের কথা। তিনি অর্জুনকে বাঁধা দিলেন। ব্লেই দিলেন “নাহ, মুড ভাল নেই আমার। তুমি এক কাজ কর, ঘটোৎকোচ ভাল শিখেছে ঝারপিট ওকে পাঠাও”।

অগত্যা ঘটোৎকোচ ফুল পাওয়ারে যুদ্ধ শুরু করল। আর কর্ণও ঘটোৎকোচের মায়াজালে পর্যুদস্ত হয়ে শেষ মেষ আর পারলেন না।

বৈজয়ন্তী খসিয়ে ফেললেন। অতঃপর ঘটোৎকোচের মৃত্যু এবং কৃষ্ণের তুমুল নৃত্য।

অর্জুন ব্যথিত হয়ে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে কৃষ্ণ ব্যাখ্যা দিলেন আসলে কর্ণর তিনটে লাইফ লাইনের শেষটাও নষ্ট হয়ে গেল। যুধিষ্ঠির সহ বাকিরা বেশি প্যানপ্যানানি করলে কৃষ্ণ বলে দেন আসলে ঘটোৎকোচের আত্মাটা নষ্ট হয়ে গেছিল তা এভাবে পরিশুদ্ধ হল।

আদতে অনার্য ঘটোৎকোচকে গিনিপিগ হিসেবে দাঁড় করিয়ে কৃষ্ণ সুকৌশলে কর্ণের ইন্দ্রপ্রদত্ত বাণের ভূমিকা শেষ করে দিলেন। সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। কর্ণকে এই কারনেই এতদিন কৃষ্ণ অ্যাভয়েড করছিলেন কারণ তিনি জানতেন কর্ণ যদিও জানেন অর্জুন তাঁর ভাই তবু শ্রেষ্ঠত্ব জনিত ইগোর কারণে কোনদিনই তিনি অর্জুনকে সহ্য করতে পারতেন না।

এক টার্গেটের জন্য সযত্নে সাশ্রয় করে রাখা বাণ চলে গেল ঘটোৎকোচ বধে। অব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া ইয়ে কর্ণ?

৩।

পুণ্য বল বড় বল। সততার প্রতীক যুধিষ্ঠিরের রথ ভূমি থেকে সব সময় চার আঙুল উপরে থাকত। “অশ্বত্থমা হত ইতি গজ” কেসের পর বাকিদের মতই তাঁর রথের চাকা ভূমি স্পর্শ করে।

শুধু পোস্টার টাঙালেই হয় না, করে দেখাতে হয়। স্বয়ং যুধিষ্ঠির পারেননি... তো বাকিরা...

মুক্তগদ্য - রঙ্গীত মিত্র

বিনায়ক দা এবং এই সময়
রঙ্গীত মিত্র



“একটি অসাধারণ গদ্য লিখতে বলল জুবিন”

ঋতুরা পালাচ্ছে ঐ দেখো
ঐ দেখো তারা আমার মোবাইলের স্ক্রিন।
আমি রোজভাবি প্লেবয় হবো
হতে পারিনা।
রোজ ভাবি কারুর উপকার করবো।
পারি না।
এইভাবে যেতে যেতে দেখি একটা ইওয়ান বাস ডাকছে আমাকে
আরে আমি তো অনেকেই দেখলাম
আমি দেখেছি অন্ধকারকে
কিন্তু কাল থেকে মন খারাপ
আমি ঠিক বড় হয়ে যাব।দেখবেন আমি ঠিক বড় হয়ে যাব...

পর্ব-১

লিখতে বল্লেই হলো! আমি তো আমার ওই “অসাধারণ” লেখা লিখতে পারিনা।জুবিন শুনবে না।আসলে আজ এমনিই ফোন করা।দেশে বেরোনো বিনায়কদার কবিতা নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।কি অসাধারণ লেখা...প্রতিটা লাইন-ই আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলো...এইযে সময়কে দেখার একটা চোখ...বিনায়কদাই পারে।বিনায়কদার লেখায় বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে...যা আগে বাংলা কবিতায় আমি দেখিনি। শুধু কবিতা কেন? গান, গদ্য , নাটক, প্রবন্ধ সব-ই লিখেছেন বিনায়কদা।কি ভার্সেটাইল মানুষ। এছাড়াও দেবতুল্য মানুষ...সৎ,হেল্পফুল...সবেতেই ১০০তে ১০০ ; আমি অন্ততঃ বিনায়কদার ভিতরে কোনো খারাপ কিছু দেখিনি। এবং এই সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত মানুষ তিনি।অথচ কখনো প্রকাশই করেন না।বরং কিভাবে মানুষের পাশে থেকে লড়াই করা যায়...সেটাই দেখান।আমার সব ভালোকিছুই বিনায়কদার জন্যে হয়েছে। বিনায়কদার বাড়ি গেছি অনেকবার।অনেকবার-ই খুব বিরক্ত করেছি।বিনায়কদা আমাকে শিখিয়েছেন,একলা নয় সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।সবার ভালো করতে হবে। আজ জুবিনের সাথে বিনায়কদার লেখা নিয়ে , বিনায়কদাকে নিয়ে অনেক কথা হলো।

দেবায়ূধ,কুবলয়দা,সোহম,জুবিন,অরন্যদা,প্রশান্ত,সৌভিকদা,দেবাদৃতা,আমি এবং আরো অনেকে তাই জন্যে বিনায়কদাকে এতো ভালোবাসি। ওইরকম পবিত্র এবং খাঁটি মানুষ পাওয়া খুব কঠিন।বিনায়কদাকে সেলাম জানাই।


পর্ব-২

গড়িয়াহাটের রাস্তায় হাঁটলে অনেক সুন্দরীদের দেখা যায়।তারা নিজেরা যতটা সুন্দরী নয় তার থেকে এক্সপোজ করে। শরীরটাই নাকি সব।আমার প্রজন্ম সেটাই বোঝে।তাদের কাছে দামি ওয়াইন আর পেট্রোল একই।তারা আবিস্কার করতে চায় না। বরং একই জিনিস ফলো করে।ইদানীং কেউ কেউ নিজেকে আলাদা প্রমান করে।বলে তারা বিপ্লবী।কিন্তু ভিতরে তাদের কিছুই নেই।নিম্নমধ্যমেধা। মেয়েদের বিভিন্ন রং-এর জিন্সের মতো আমাদের যাপন। এইভাবতে ভাবতে লেকমার্কেটে দাঁড়িয়ে আছি। শরীর বার করা মেয়েদের বার-ভীর করা দুপুর আজ।আজ তাদের বয়ফ্রেন্ড বদল।হাত নেড়ে ট্যাক্সী ডাকাটাও তাদের কাছে ফল পেড়ে নেওয়ার মত । সেইরকম একটি মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফোন করছিলো।হঠাত দেখলাম একটি গাড়ি এলো।গাড়ি তাকে তুলে নিয়ে হু হু করে চলে গেলো।এ প্রসঙ্গে বলে রাখি আজকাল ট্যাক্সির পিছনে তো চোখ ফ্যালা যায়-ই না। দামি গাড়ি জামা কাপড়—গ্ল্যামার হোটেলের দরজার ফুটোদিয়ে সব ইন্টার নেট করে দেয়।তবে একেই বলে বেঁচে থাকা।আধা-প্রস্টিটিউসান কি? আসলে যৌনতাও একটা চাপিয়ে দেওয়া।এদের কাছে সব কিছুই নিয়ম।কোথাও রহস্য নেই। বদলের বদলে কেবল পিছনে চলে যেতে যেতে জামাকাপড় ছোটো হতে থাকে।যদিও আমি ওয়েস্ট্র্যানাইজেশানকে সমর্থন করি।কিন্তু কপিপেস্টকে নয়।যার ভিতরে কিছুই নেই সে শুধু কেন বড় বড় কথা বলে যাবে?মামদোবাজি নাকি? নারীস্বাধীনতাকে আমিও সমর্থন করি।আমার-ও ভালো লাগে একটি মেয়ে পুরুষের থেকে এগিয়ে আছে...কিন্তু সে যদি কিছুই বোঝে না...শুধু শরীরটাই সব তার...মাথায় তার কিছু নেই...তার সাথে কি কথা বলবো? আমরা শুধু তাই কপিই করে যাচ্ছি...এটাই জীবন...


পর্ব-৩

বৃষ্টির এলো।আস্তে আস্তে।পৃথিবীটা যেন ইউনিসেক্স টয়লেটের মতো। একটি মেয়েকে দেখলাম ছাতা আছে অথচ ভিজছে।তার শরীর...স্তন...জিন্সের কোমর...ভাঁজ উঠে আসছে কাগজের উপর...যেরকম ফুল ফুটে ওঠে...যেরকম সিগারেটের প্রথম ধোঁয়া...যেরকম ভদকার ফ্লেবার...যেরকম প্রথম প্রেম...সব কিছুর ভালোর ভিতর থেকে সে অপরূপা হয়ে বৃষ্টীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে আমার হৃদয়...আমাদের গোলপার্কের মোড়...তবে এখনো সব কিছু সহজ ও অনেক হয়ে গিয়ে বড় ভুল হয়েছে।কারণ আমি দেখলাম একটি মেয়ে বাইকের পিছনে বসে বৃষ্টীতে ভিজছে।তার শরীরের সব অংশ...সার্ট...মাইক্রো-মিনিস্কার্ট থেকে বেরিয়ে আসছে...যেরকম টিউব থেকে মাজন বেরিয়ে আসে...আমার চশমায় তার ছাপ...আমাকে যৌনঋণী করে দিয়ে সে চলে যাচ্চে...কিন্তু আমাকে আর বসে থাকলে হবে না।ক্যাফেলায় যেতে হবে।সুতপা এখন ঘুমছে।সৌভিকদা,দিপ,কৌস্তব,কিঙ্কিনিরা বসে আছে...আমি লেকেরা রাস্তায় দেখেছে এক মধ্যতিরিশের মহিলা বিয়ার খেয়ে বিয়ারের ক্যান ফেলে রেখে যাচ্ছে...আমি দেখেছি একটি মেয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের...তার শরীরে টোমাটোর মতো সূর্য লেগে...তার শরীরের আমাজন...নদীর গতিপথে দাঁড়িয়ে বলছি আমি ভিতরটাকে আরো প্রসারিত করো কমরেড...দ্রুত দ্রুত দৌড়াতে গেলে আরো আন্তর্জাতিক হতে হবে।আরো অ্যাডভান্সড হতে হবে।নিজেদের আপডেট করতে হবে। সব কিছুই তো জীবনের অঙ্গ।কিন্তু আগে হিউম্যানফিলিংসগুলোকে জাগ্রত করো...নিজেকে কোথাও আটকে রেখোনা।কাউকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যাও...এনজয় ইয়োর লাইফ বস...

সিস্টেমের বাইরে গিয়ে অন্য কিছু করে দেখানোর সিস্টেম হয়ে যাওয়া না হয়ে যাওয়া একদম নিজের ব্যাপার...একবার সেই দিকে প্রকৃতির মতো তাকিয়ে দেখো

সে অপ্সরীর মত তাকিয়ে আছে...


গুচ্ছ কবিতা – অজিত দাশ

গুচ্ছ কবিতা
অজিত দাশ



দিদিকে

খুব বৃষ্টি হলে তোমার কথা মনে পড়ে। সাপলুডুর নিরানব্বই ঘরে
উঠতে গিয়ে সে কি তুমুল কান্ড! তোমার মনে নেই? তুমি টপকে
গেছ মই আর আমাকে গিলেছে সাপ ।

একটা ছক্কাও উঠেনি জীবনে। গল্প শুধু অবহেলার –ভাপসা গন্ধ মেখে
বিকেলের শুয়ে থাকায় এলোপাথাড়ি যত মুখের চিহ্ন...

তারপরও কিছু থাকে, নাগরিক ক্লান্তি ছেড়ে- বুকের ওল্টো পিঠে
জমে থাকা অন্ধকার রক্তের মতো লাগে ।


অরন্যের দিনরাত্রি


অহেতুক কিছু দৃশ্য ছেড়ে- পাগলের মতো
কেউ বা নেশার বুদবুদে রহস্য হয়ে ঘুড়ে
কেউ বা মিছে প্রজাপতি হরিণডাঙ্গায়- আমারও ইচ্ছে
কতদিন মদিরার জল মেখে রূপালী স্নানে- তোমার
ডোরা কাটা চাঁদে পূর্ণ আস্থা ছিলো- শুনেছি জংঘার বিজয়ে
একদিন মাতৃত্ব আসে- ললিতকলা আসে পূর্ণ প্রেম হয়ে।


বিরহ দর্শন

জয়শ্রী চলে যাবে...
মিথ্যে ঠাকুরের নাম নিয়ে
সর্বনাশ করি প্রেমের

সিঁদুর কৌটোর মত
বিশেষ ‘রঙ’ জমিয়ে দেখি
দস্যুতা ছেড়ে ধূপ-চন্দন
ভালবাসেন বন্ধ্যা ঈশ্বর

আমি রক্ত জবা তুলে নেই
উঠোনের এক কোনে
তুলসী ছিড়ে হাতে নিয়ে ডাকি
জয়শ্রী দেখো?
ঠাকুরঘর পাশ কাটিয়ে
তোমার শুদ্ধ অভিমান ভালবাসি...


মায়া


আলগোছে টান দিও
বেনি পাকালে সর্বনাশ হবে
এই জন্ম পাওয়া
এক চুমুক শেষ করে
আরেকটু নেশা হলে
ফণা তুলে দাঁড়াবো ভাবি...

গুচ্ছ কবিতা – স্নিগ্ধদীপ ঘোষ

গুচ্ছ কবিতা
স্নিগ্ধদীপ ঘোষ



স্বাদ বদলের কবিতা ১

উদ্বেল ছুটে যাই সর্ষে খেতের আলে
পকেট ভর্তি আমের কলি, বাসক ফুল
কাঁদরের জলে প্যান্ট ভিজিয়ে হাসি,
সাদা বক আর রুপাই আমার বন্ধু

সরস্বতী সব ভালবাসা দেয়নি
উন্মুক্ত সাওয়ারে চুবড়ি ভেজে ব্রজবাসী মিথ

ডোরবেল গেয়ে যায় দিনাতিপাতের গান। টুং টাং...


স্বাদ বদলের কবিতা ৩

সাইকেল চড়ে এসে
টুক করে নেমে আসে ভালবাসা
তোর জন্যেই ভিক্ষে করে আনি
এক ঝুলি নীল অপরাজিতা।
- সাঁই তোর চাদর কোথায়?

এখনো বিকেল।
অচিন পাখি বহুমাত্রিক রাগ শোনে মলিন একতারায়

সূর্য নিভে গেলে মেঘপিওনের শ্বাস শোনা যায়


স্বাদ বদলের কবিতা ৪

গমের শিষে গঙ্গা ফড়িং দেখেছি
ঝাউবন, চন্দনা সাদা বাছুর দেখেছি
শ্রীমতী আলতা দেখেছি আমি, মিছিল, জাহান্নাম
প্রকৃতির আগে নাড়ি দেখেছি একমনে

ঢেউ দেখে এসে
মা ডাকতে গিয়ে আমি তোমায় ডেকে ফেলেছি


স্বাদ বদলের কবিতা ৫

ডুঙির তল ভেজা জল খেয়ে যায় বিকেলের বক
পালুই এর উপর বসে চোরকাঁটা ছাড়াই , আর
রাজকীয় লেকচার শুনে যায় কালো গরু ও সাদা গরু
কর্ষণে লাল মাটি হেসে গায় হুনা হুম হুনা

লালাভ আলোয় ধানের ডুলি বাড়ি ফিরে গেলেও
কিছু শ্বাসগন্ধ কাব্য হয়েই থেকে যায়। সঙ্গোপনে

বখশিশ দিলেও ওয়েটার আর পান্তা ভাত দিয়ে যায় না

গুচ্ছ কবিতা - গোপাল লাহিড়ী

গুচ্ছ কবিতা
গোপাল লাহিড়ী



সনাতন মানুষ


তখনও মোমের গলন কেউ টের পায় নি
পুড়েছে ঘরবাড়ি, পুড়েছে শুকনো পাতার স্তুপ,
রক্ত নদী বইছে কুলুস্বরে.
নিজের দেয়াল সরিয়ে উঠে এলে তুমি
কপালে কালো মেঘের কারুকাজ
ধুসর হয়ে গেল মোহময় বিকেল.
রাত্রি খুলে ফেলেছে তার রুপোলি পোষাক
আলোর মুখ এখন অভিশপ্ত, পান্ডুর,
শামুকের খোলে বিলীন প্রকৃত জীবন.
এভাবেই অন্ধকার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে,
এভাবেই ঝরে গেছে সমস্ত কাঠগোলাপ,
অবশিষ্ট থাকে নি একটিও সনাতন মানুষ.
চতুর্দিকে যত পচে যাওয়া উদ্ভিদ,
যে মন্ত্র বুকের মধ্যে নিয়ে বাঁচব,
তা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে গেল সাদাকালো পাখি ।


দুপুরবেলার রাগ রাগিনী

ঠিক দুপুরেই সোনা দীঘির জলে দু একটা ডুব
চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেন কবেকার
একটা মস্ত পাহাড়ের উত্তুঙ্গ শিখরের রং বদল,
শুনতে পাই পাইন ও ইউক্যালিপ্টাস জঙ্গলের গান.
আকাশ যেন আজ যা খুশি করার অধিকার পেয়েছে
একফালি অন্ধকার গাছের ছায়া, নরম ঘাস
যেন জমাট রক্তের মধ্যে ভীষণ ভাবে বেঁচে থাকা,
সহজ সরল অঙ্ক কষে বোঝা যায় না.
হাঁসেদের হলুদ পায়ে বেঁধে দিয়েছি যত লুকোনো প্রতিশ্রুতি
মেঘকুয়াশা, গোধুলির রং একদিন প্রাণের বন্ধু ছিল,
ছিল প্রবল উত্তাপ, পায়ে হেঁটে বেড়ানো সবুজ মাঠ,
আগুনে পুড়িয়েছি ছোটবেলা, বড়বেলা, অতন্দ্র প্রহর.
আজ হারিয়ে গেছে দিনের আলোয় ঝলমলে সেই পৃথিবী
আর শোনা যায় না দুপুরবেলার রাগ রাগিনী,
দু কথা, চার কথা, গুণগুণ গান, আর চুপচাপ বসে থাকা
কত কত বার এমনটাই কেন হয়ে থাকে।


ভালবাসার রোজনামচা

যতটা অকৃপণ আকাশ ততই সংকীর্ণ গাছের ছায়া
টুপ টুপ ফুল ঝরা যেন মানুষের আত্মসমর্পণ
অশান্তির তীব্রতায় কেঁপে ওঠে কালরাত্রি.
বৃষ্টি জলে ধুয়ে ধুয়ে পাতারা আজ কী ভীষণ বিবর্ণ !

থচ পোড়া সমস্ত শিকড় বাকড় কোনো বিকল্প খুঁজে পায় না.
মেঘেরা আজ কেন জানি থেকে থেকে ঈষৎ অধৈর্য্য
কবেকার লালমাটি, উষ্ণ জলপ্রপাত, মৌন পাহাড়,
তরতাজা, সুন্দর, আদুরে, উদার সরু সরু শিরা-উপশিরা ,
সুগন্ধী জলের ছোট ছোট কণা, ভিজে চুলের স্নিগ্ধ আমেজ,
সবকিছু মেনে নিয়ে তোমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে চেয়ে থাকা.
রোদ্দুর মেখে ঠোঁটে তুমি রাত্রির দুরত্ব অনেক লঘু করেছ,
সময়ের শাসন মানতে মানতে দিন গেল কত সহজে ফুরিয়ে,
এদিকে বিষাদের রেখাচিত্র পেরিয়ে মুখখানি নিয়ে এলে কাছে,
উতলা ডালপালায় লেখা আছে আমার কবিতার প্রতিটি শব্দ
বেমালুম ভুলে গেলে পলক না পড়তে ভালবাসার রোজনামচা.


মায়াবী স্বপ্নপুরী

যেন আর ফিরে যাওয়ার তাগিদ নেই
পুড়ে পুড়ে কালো ছেঁড়া কাঁথা, ঘরবাড়ি
জমিতে এখনো তাজা গণগনে আগুন.
বুকের পাথর ফেলে চলে যায় ঝড়ো হাওয়া.

বিস্তারের সংস্পর্শে আসে না কেন প্রকৃতি
জোয়ার ভাটার চিন্হ জেগে থাকে ভিতরে,
অজান্তে সৃষ্টি করে এক অদ্ভূত কোলাহল
এখনো কিছুটা পিছনে হাঁটে স্বাধীনতা.

ঝাপসা কোনো পাখি বসে আছে গাছের ডালে
আজ আর উড়ে যাওয়ার দরকার নেই
ঠোঁটে ফুটে ওঠে যেন পুরনো স্বরলিপি.
সন্চারিতে ভেসে ওঠে আলো অন্ধকার.

টুপটুপ করে ঝরে যায় পাতা, পুড়ে মরার জন্য
নিজের সবকিছু ছেড়ে ঝাঁপ দিতে চায়,
এদিকে দু'একটা মানুষ এখনো পায়ে হেঁটে
যেতে চায়, ছুঁতে চায় এক মায়াবী স্বপ্নপুরী।


ঝোড়ো সময়

আর কিছু নয়, স্রেফ পাতার ঘেরাটোপে এক নিঃশর্ত ঘুম
প্রকৃতই মানতে পারি না এই শান্তিপর্ব.

সমবেত ঘৃনা, চকচক করে নির্ভুল পাথরের চোখ
একটা মুখের সঙ্গে আরেকটা মুখের কত পার্থক্য.

অশ্রুপাতের পর মুছে যায় শরীরের মালিন্য
তোমার সমর্পিত দুরের মোমবাতি জ্বলে ওঠে.

বাইরে ভিতরে অস্থিরতা, নাকি কিছু নয় !
অনর্গল, স্বচ্ছ, কল্পনার অনিঃশেষ প্রেম উদারতা.

তুমি ফিরে যাও ম্লানমুখে বন্দীশিবিরে
অলংকার ছেড়ে চলে যায় নিঃশব্দে শব্দেরা.

নির্ভুল কবে হবে মেঘহীন ভোরের আকাশ
আর কিছু নয়, ফিরিয়ে আনো ঝোড়ো সময়.

কবিতা - সাজ্জাদ সাঈফ

তিনটি কবিতা
সাজ্জাদ সাঈফ


আল্পনা

তোমাকে বলা হয়নি পিঠ বেঁকে বেঁকে এই সমুদ্র অন্ধকারেই ডোবে-

খাঁজ কাটা কাটা প্রবাল পাথর ঢালু সৈকত,ধীর দ্রুতালাপে সান্ধ্য বাতাস আড্ডামুখর!

কড়া নেড়ে এইমাত্র যে ঘরে ঢুকবে বলে দাঁড়িয়ে আছো,এই ঘর থেকে গীতা পাঠে রোজ ডাকি সমুদ্রঝড়,উপাসনায়,অগ্নিমদে!

তুচ্ছ ব্যাথায় কাতর তো নই-

অক্ষরে ঘাস রাত্রি বিলাস বিদগ্ধ ঘুম;নামতা গোলাপ ভ্রুণ পাপড়ি স্বেচ্ছা দহন!

ফিরতি ক্ষতের ফুলদানী আজ তোমার শেমিজে আল্পনা।



মেঘ

পথের ধূলোরা এই মাঝরাত্রে মেঘ মাদলের গান শোনে
আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা মহাসড়কের হল্লা
পৃথিবীর গল্পকে জাগিয়ে রাখে,জাগতিক রাখে নিঃশ্বাসে...

হাতের তেলোয় শেষ ঘুটি-
নরমুন্ডু,খুন তালিকা,রক্তচামচ;
ছায়াঘুমে মশাল মিছিল,দুঃস্বপ্নের বায়ান্ন তাস;

মজ্জা মদে আকন্ঠ গান একটু ফাঁকায় সেতার সাজায়
ঠিক তার রুদ্ধশ্বাস দানেই আকাশ উড়ালসেতু,নামমাত্র ইচ্ছেযাপন,চিরকুট হয়ে বৃষ্টিজলও বিতরণ করে মেঘের জীবন!



জাহাজ

ভেতর থেকে বন্ধ জানালায় নক করেছি বহুবার ,সাড়া না পেয়ে অতৃপ্ত মন ফিরেছে একা,লাউঝোপে কাদা জল মাখা মিথ্যে প্রতীক্ষা,তোপধ্বনি বুকে অস্থির ঘাম,ছাই ওড়া শ্মশাণের কাঁদাকাটি ওঠে প্রাণের পল্লবে-

ঝড় জাত পাত কৌলিন্যের খাঁড়া সমুখে দেয়াল কাঁটার,পত্রপাঠে শ্যাওলা ঢাকা বৈঠায় এসে থমকে গেছে রাত,থমথমে রাত,ব্যান্ডেজ করা জ্যোছনা যেন পাততাড়ি তোলা, কুয়াশাবাতিক!

তোমাকে সুদূরে সৈকত লাগোয়া বাতিঘর জানি,অস্তিত্ব,গোপন তিলক,কিছু অপারগ অভিধায় নিকট জাহাজ!

কবিতা - টুম্পা মণ্ডল

নদী নামের নদী
টুম্পা মণ্ডল


দুটো নদী মেশা ঘোলা জলে
অচেনা ডানারা বেঞ্চের কিনারা ছুঁয়ে
ফিরে যায় নিভু আঁচে । পাক খাওয়া স্রোত ওড়ে,
স্তম্ভে স্তম্ভে কমলার স্বাদ আর দিনশেষে
জেটি গায়ে স্টিমারের ধোঁয়া স্থবির হয়
বোবা আকাশে --
#
এভাবেই এককুচি তুমি আর এককুচি আমি
কোলঘেঁষে মুখোমুখি বসি ।
#
দীর্ঘকাল নদী বয়ে চলে একা ।
#
আমাদের অবস্থান এপারে-না-ওপারে এই ভেবে
অস্থির ব্রিজ ও ফারাক আওড়ায় ....
দুটো নদী মিলে গিয়ে পরও দুটো নদী থাকে ?
#
নিশব্দে বয়ে যাচ্ছে মানুষের জোড়া-জোড়া গোড়ালির ছাপ ,
শ্বাস বায়ু , সাঁঝবেলা , জুবুথুবু মেঘে গলে যাওয়া স্বর ....
আমাদের দূরত্ব নিশ্বাসে ।
#
ঠিক তখনই পরদের বাষ্পে গঙ্গোত্রী ভাঙে
আরেক নতুন নামের নদী ।

কবিতা - জয়দীপ মৈত্র

উল্কা
জয়দীপ মৈত্র



বিষণ্ন কুয়োর মতো তোমার মুখ ফেরানো
আকাশের শেকড় ছিঁড়ে
ডানাহীন গড়াতে থাকি
পুড়ে পুড়ে অবশেষে নিভতে হয় তাই নিভে যাওয়া
#
উল্কার কান্না তবু জোনাকী হয়ে ভেসে বেড়ায়

কবিতা - তন্ময় ভট্টাচার্য

প্রাথমিক ধাপে
তন্ময় ভট্টাচার্য


শহর কলকাতার হেরিটেজ চিড়গুলো
ধারণ করেছি বলে
বেদাত্রয়ীর চোখে ঘুম নেই
#
লতানে হিসেব ঢেকে ছিটকে বেরোতে চায়
প্লাস-মাইনাস স্থিতিশীলতা
#
শহীদ স্মরণে আমি কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে
কিছু নাগরিক ভিক্ষুক স্বভাবের থুতু ছেটালেও
লাল ইঁট সাদা হবে না
#
বেদাত্রয়ীর হাতে রং-তুলি। ভেবেছিলো
শৈল্পিক সাধনায়
আমার ফাটল বোজাবে
#
খড়খড়ি তুলে দিতে কাটা-কাটা রোদ এসে
কি স্পষ্ট করে দিলো প্রতিটা হিসেব, আয়োজন
#
জার ঘেঁটে স্মৃতি ছাড়া কিছু উঠবে না
আমি বেদাত্রয়ীকে ছেড়ে
নাটমন্দিরে মিশে গেছি

কবিতা - দেবাশিস মজুমদার

স্মৃতিপলি-কাঁচনদী
দেবাশিস মজুমদার


এক পশলা বৃষ্টি শেষে মাটির একটা সোঁদা গন্ধ
নাকে লেগে থাকে, গাঢ় মৌতাত উসকে দেয়,
সঙ্গ দেয় লাজুক কিশোরী রোদ। ঠিক এই মুহূর্তে
যে বাড়িটা পেরিয়ে এলাম ওটা অবন্তিকাদের বাড়ি।
এই পথে এলেই আমার আগ্নেয়গিরির শীতল
পার্শ্বদেশের কথা মনে পরে যায়, নৈসর্গের কথা
ভাবতে গিয়ে সবকিছু কেমন বিসর্গে রূপান্তরিত হয়।
#
ইদানীং গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য ফি বছর ফাগুন
আসেনা, অশোকে-কিংশুকে রং লাগেনা তেমন।
দৃষ্টিকোণের সঠিক কোন খুঁজতে জেরবার নগর
জীবন, চারিদিকে ফ্রাস্টেটেড গল্পের ঘুণপোকা
রোদ পোহায়, বুকের ভিতর একটা ছোট্ট মুনিয়া
উড়ে বেড়ায়, এ ডাল ও ডাল ছাড়িয়ে কখন যেন
আঙ্গুলে ছড়িয়ে পড়ে ধুলোমাখা ক্লান্ত পাখি।
#
স্মৃতির ভিতর একমাত্র প্রতিবিম্ব সুগঠিত কাঁচের নদী,
মাঝে মাঝে তার পাড় ভাঙ্গে। ওই পলি চূর্ণ বেলায়
বারে বারে পা বিঁধে যায়, বিশেষণ প্রকাশ্যে সাঁতরায়,
সর্বনামেরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে চেটে পুটে খায় সর্বস্ব। অথচ
একটা ছোট্ট ডাকে জড়ো হতে পারত এইসব যাবতীয়
চকিত, ছোটো ছোটো হোঁচটগুলো পেড়িয়ে এগুনো
যেত নিজস্ব যৌথ-খামারে, পাঁচমিশালী সংসার।
#
বাড়িটা এখন পিছনে পরে রইলো, মুনিয়ার মতো
আজকাল তুমিও মন থেকে আঙ্গুলে, তাই প্রাত্যহিক
এইসব বোকা বোকা কবিতারা রচিত হয়, বোঝেনা
বারবার তাকে জানিয়ে কী লাভ –
একদিন আমি কিন্তু ঠিক-ই এসেছিলাম।

কবিতা - রুদ্রশংকর

মধ্য তিরিশের প্রেম
রুদ্রশংকর


চোখের পলকে অতিথি নতুন প্রেম
মধ্য তিরিশে আর একটা মেলামেশা
মাতাল হাতের তালুতে শীতের ঘুম
মেয়েটির মুখে মরা জ্যোৎস্নার নেশা

নেশায় নেশায় চুম্বন গাঢ় হয়
রতিতীর্থের সফলতা বুকে ঝোলে
মানুষ মাফিক আমাদের জ্ঞানোদয়
কাতর গোলাম তখনও কি মাথা তোলে !

মাথা তুলতেই সহজতা ভেঙে যায়
সহজ উপায়ে তোমাকে কবুল করি
তোমার সওয়াবে স্যাঁতসেঁতে ভাল থাকা
গোপনে আমি মুখোমুখি ঢুকে পড়ি

চোখের পলকে অতিথি নতুন প্রেম
সঙ্গী-সাথীরা হাড়মাস গিলে খেল
যতটা আমার, ততোটা তোমার নয়...
আমিও গেলাম, আগুনও সঙ্গে গেল !

কবিতা - সতীশ বিশ্বাস

সুখ
সতীশ বিশ্বাস


নিয়ম মানায় কোন সুখ নেই
বড়ো একঘেঁয়ে লাগে মাঝে মাঝে
দিনের আলোকে;একা একা তাই-
ঘন অন্ধকার চোখে চেয়ে থাকা বৃত্তের দিকে
গোলাপের শিশু কুঁড়িটির মত ফুটে উঠলে
একটি জোনাকি- দিনের আকাশ ভরে অজস্র তারায়
গুহার ভেতর থেকে তিরতির ছুটে আসে
আলোকের ধারা।


কবিতা - রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

বিষ
রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ


লালনের পথ ভিজিয়ে গেল
আলোর রস।
তাকাতে হয় না
সামলে নেওয়া ঢেউ
দু-পাশে অদৃশ্য প্রথায়
ভাঙছে বিষ ।

কবিতা - সতীনাথ মাইতি

নীল-কবচ
সতীনাথ মাইতি



নীলার কবলে কবলে
নেচে ওঠে ফের আংটি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে ফেলে ভাগ্যর
মন-লিপি বরদাস্তে
#
রেখা সয়ে সয়ে ক্ষান্ত
ঠাঁই চায়, কর-বন্দী-
কেন, সযত্নে নীল হয়ে যায়!
সহচর এক মন্দির।
#
কার সাধে তুমি ছিলে ভাল
এসব জানি ফালতু
দিন রাতে সেই খুলবেই
ভেজা-কথা তুমি জানতে।
#
রক্তের ভিতরে চূর্ণী
কেন স্নেহাশিস আপামর
এ-জীবন শুধু সাথে গায়
শেষ রূপরেখা, মন্তর...।
#
শেষ আভা নামে জন্মে
আর কতদূরে যক্ষ –
শুধু বেঁচে থাকে বাঙ্ময়
শুধু লেখা থাকে ব্যাখ্যান

কবিতা - রত্নদীপা দে ঘোষ

ফ্রুটবাস্কেট
রত্নদীপা দে ঘোষ


কমলালেবু আর শসার জোরদার বক্তৃতা চলছে চৌরাস্তার মোড়ে ......

ফলবিক্রেতার গন্ধ , ঘাম , ভিড় ... ফলেরাই ট্রামলাইন যত্রতত্র , ভিটামিনের প্রাচুর্য আমাকে পৌঁছে দ্যায় পোঁটলা পুঁটলি সমেত ডিপোর আবছা মুখে একটা গোটা বেদানার মধ্যে ঢুকে পড়ি , রক্তনালিকা চাকার মতো জোরালো , ফর্সা তারাদের বীচি .. আল্গাভাবে সেঁটে থাকে রমণীমুখ , যৌন ঘণ্টাধ্বনি ... খণ্ড খণ্ড অংশগুলো লাল মেঘ ,জিপসিসূর্যের সোনা ... রুমালে মুছে নিচ্ছি অন্ধকার নেভানো টর্চ , ট্রাফিকী মুদ্রা ...

চাঁদনি চকের ফলরুট ধরে গানবাজনার হলুদ লসিকা কোথায় যে হারালো

বেদানা কিছুতেই বললো না ...

কবিতা - সুদীপ মুখোপাধ্যায়

ঈশ্বর
সুদীপ মুখোপাধ্যায়



আমার বিপদের জন্য বেঁচে থাকো ঈশ্বর
ভেঙে-যাওয়া দিনকাল । বন্ধুরা মুখোশ
পকেটে তাপ্পি আর কলারে কাঁটা ।
এই নিয়ে নামাজ, মন্দির, গুরুদ্বার ।
মনখারাপের দিনে শীতের রোদের মতো সুখ
তুমি থাকো, তুমি থাকো, তুমি থাকো ।

কবিতা - সৈকত ঘোষ

অবয়ব ও শূন্যতা বিষয়ক
সৈকত ঘোষ


সোনালি রং এর শব্দদের বিশ্বাস করতে নেই
নৌকার হাল ধরে যে মরদ
তার কাঁধে তুমি জঙ্গলের গন্ধ পাবে

নেশা লাগতে পারে

শরীরের পাপড়ি সরিয়ে দিলে তুমি ঈশ্বর
তবে এই খেলা নৈমিত্তিক নয়

ডুবসাঁতারে ঝিনুক পেতে পার
বুকে লুকিয়ে থাকা আশ্রয়ের মত
যে মুক্তো তুমি তুললে
তা হয়ত রোদ্দুর ...

প্রতিচ্ছবি খুজতে নেমে একচোখ বন্ধ করে
আমি নিজেকেই দেখি
বহুক্ষণ নিরুত্তর থাকলে
শুন্যতাবোধ ছুটে যায়

তোমার চোখে প্রেম নেই , দংশন নেই
শুধু কয়েকটা অস্পষ্ট অবয়ব


কবিতা - দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

দুটি কবিতা
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়


বৃষ্টিদিন

বৃষ্টির ভিতর গান রেনকোর্টের
জানালায় মেঘের গাছ নিয়ে দেখেছ কি
আমার দিন ফুরালো শাওন স্বপ্নে
আবার এসেছ আষাঢ় আর ছায়াচোখে
পড়ে ফেলেছি কায়াহীনের আষাঢ়ে গল্প
ছাদের পাইপ বেয়ে নেমে আসা
হাইড্রেন আর রাস্তায় অভার বাউন্ডারি
বাউণ্ডুলে আমাকেও আটকে রাখে দেওয়ালে
আর রঙচটা পোস্টারে চোখকেও
ফোঁটা ফোঁটা কবিতায় দিলে
জমা জলে উদোম চান আর ভাটিয়ালি
ভাসান সে কাগুজে নৌকার -- হৃদয়ে নোটিস
হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ
মজা জলা মজা সেরে নেয় টাপুরটুপুরে
বজ্র-বিদ্যুতেও পাড়াজুড়ে কই-কই রব
রবিবার আর রবিতে থাকল না ...

ভাঙনের সময়

তুমি কখন মেয়ে হয়ে যাও
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেপে নাও
হেঁটে যাওয়া পুরুষ শরীর
চুল থেকে ঝরে পড়া জল
বুকের দেয়াল বেয়ে আরো গভীরে
#
ভেঙে যাওয়া আয়নায় ছড়ায় ভাবনা
আর তুমি প্রস্তুত করো স্বরলিপি
                               আত্মহত্যার
#
পাথুরে জমিতে এভাবেই এসে পড়ে
                               রক্তকরবী

কবিতা - উমাপদ কর



ধারাবাহিক - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার



টরেয়া রে টরেয়া
হাতিবান্ধার টরেয়া

৩১।
মাইল মাইল দিগন্তের ভিতর,দিগন্ত পেরিয়ে আরো আরো দিগন্তের ভিতর,নদীঘেরা মানুষঘেরা অরন্যঘেরা গানঘেরা বাজনাঘেরা জীবনের অনন্ততা ছুঁয়ে কোথাও কি যাবার থাকে মানুষের! প্রশ্ন নয়,প্রত্যাশাহীন সংশয় হয়ে কবে কার কতকালের জীবন যেন মায়াকুহকময়তায় জীবনেরই বন্দনাগান।চড়িয়ে যাওয়ায় ছড়িয়ে যাবার আবহমানের আবহমানতায় চিরসত্য হয়ে জীবন যেন নুড়িভাষা নদীর অঞ্চলকথার অত্যাশ্চর্য চোরাটান।


৩২।
দিগন্তের মধ্যেখানেই তো নেমে আসে মানুষ।কত কত মানুষ।ভালোমন্দ হাসিকান্না অসুখবিসুখ নাচগান শীতবর্ষা হাটগঞ্জ পাইকারব্যাপারি বাথানটাথান টাড়িবাড়ি নিয়ে উজ্জলতর সব মানুষের যাপন দিয়েই তো একটানা বুঁনে চলা নকসিকাঁথা।পালাগানের মাষ্টার টরেয়া বর্মন পেরিয়ে যেতে থাকে সুপারিবন শুকনো বাঁশের সাঁকো।হাতিবান্ধার ধানহাটিতে নাচতে থাকে বুধেশ্বরী বুড়ি।ঢোল বাজিয়ে উড়ানি কইতরের গান বাঁধে হরিকান্ত।সবকিছু নিয়েই তো জীবনের জীবন হয়ে উঠবার প্রয়াস।

৩৩।
ধলা মুরগিটা বাচ্চা ফুটাইচে...
নদির কাছাড়ে কাছাড়ে ঘুরে বেরান মুন্সি করিম।প্রবীন চোখের ওপর তার আসমানের ছায়া।ডান হাতে কনুই-এর নিচে দীর্ঘ ক্ষতের কাটাকুটি।তুষভাণ্ডার জমিদারবাড়ির চড়ক মেলা থেকে কত কত কালখণ্ড পুরনো এক শীতকালীন সন্ধ্যেয় বড়খাতার তিস্তা সন্নিহিত জঙ্গলপথে এক চিতাবাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।গাছের শুকনো ডাল দিয়েই করিম মুন্সির মরণপন লড়াই।সেই থেকে মুন্সি করিম দশ চল্লিশ গঞ্জগাঁয়ে মিথের মতোন।সেই থেকে তিনি ঘুরে বেড়ান জীবনময় অন্তহীন।

ধারাবাহিক - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়



১০।


--বল, বর্গীদের আসার টেন্টেটিভ টাইম কোনটা?




--বল দেখি, সবচেয়ে বড় জুজু কী?

--জানি না, স্যার। জুজুর দিব্যি…

--ভাব, ভাবতে শেখ। ভাবতে শেখাটাও একটা প্রক্রিয়া

--স্যার, ভাবতে পারছি না, মানে পারতে শিখিনি স্যার!

--জুজুর নাম মাওবাদ

--স্যার, সেটা কী?

--বল, বর্গীদের আসার টেন্টেটিভ টাইম কোনটা?

--স্যার, এনি টাইম অ্যান্ড এভ্রি টাইম, ছড়া কাটলেই হল, মা, ঠাকুমা…

--ইন্টারেস্টিং

বাই দ্য ওয়ে, তোমার ঠাকুমার নাম বল, মানে পিতামহী, এবং প্রপিতামহীর। তাহলেই পাক্কা

--বলছেন স্যার, এনক্যয়ারি করবেন না তো?

--তুমি তো একটা আস্ত বা-মাল দেখছি। কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কিছু জানা আছে?

আচ্ছা, বল তো ধাক্কা কাকে বলে? এ পর্যন্ত রাজ্য সরকার লোয়ার কোর্ট, হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট

মিলিয়ে মোট কতোগুলো ধাক্কা খেয়েছে?

--স্যার, আপনি মাইরি বি-প্রতিক্রিয়াশীলদের মত প্রশ্ন করছেন…আপনাকে কিন্তু লটকে দেবে স্যার,

ওই জুজুতে, ওরাও দিত স্যার, আর এরাও শিখে নিয়েছে স্যার, বালের চাকরিটা আমাকে দেবেন

স্যার? না হলে কিন্তু জুজু লেলিয়ে দেব...

--অ্যাই, অ্যাই, বাঁড়া চুপ। মুখে ন ইঞ্চি গুঁজে দেব। ওই বি-প্রতিক্রিয়াশীলটা কী?

--কোন এক ‘দা আছেন স্যার, ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশানে একটা করে বি লাগাতে বলেছেন স্যার।

উদাহরণ স্বরূপ স্যার বি-স্বরূপ, না, স্যার বানানটা ভুল হল মনে হচ্ছে স্যার। বি-গাদন স্যার। যেটা

আপনি আমাকে দিচ্ছেন স্যার। আমিও এট্টু দিচ্ছি স্যার। উনি কিন্তু এরকম সিচুয়েশানেই লাগাতে

বলেছেন, স্যার...সত্যি সত্যি লাগাতে...



--বাঁড়া চুপ। চুপ বাঁড়া।



সেদিন ভোরে পা বাড়িয়ে ঘর্মবর্ষণের আগে এরকম একটা কথোপকথন কল্পনা করে সে নিজের মধ্যে নিজেই খানিকটা হেসে লেটে পুটে নিল। আর বেরোতেই নিজের ল্যাজে নিজেরই পা রাখল। মেঘলা হয়ে আছে, না, না, হয়ে থাকবে কেন? ইমপারেটিভ নয়। আকাশ মেঘলা করে আছে। কেউ একটা পিছু নিচ্ছে।বৃষ্টি পড়তে পারে ভেবে যারা হাতে ছাতা, বা কানটুপি দেওয়া উইন্ড চিটার নেয়, সেরকমই একজন।



অ্যাই, বুলবুলি নিয়ে কোন প্রশ্ন হয় নি… দাঁড়াও, দেখাচ্ছি…

ইংরাজি কবিতা – ইন্দ্রাণী সরকার






ইংরাজি কবিতা – ইন্দ্রাণী সরকার
Indrani Sarkar – Five poems



You and My dream

The moon appeared distorted
almost like my dream, unclear.
Silence that only existed,
I stared for long with despair.
I thought of you, my beloved
as I sat beneath the tree.
But realized you are never there
as I only find none but me.

Light

How many ways I may give you light?
The sparkling light from the sun,
the mystic moonlight of a moonlit night,
the drizzling light of the morning dews,
or a candle light covered with much care.
Everything I kept for you my beloved.
If you do not wish to have let me know,
I will distribute and splash all the light,
I will let them float on the running water.
But I will not let you forget that I only
loved you to light up your dull puzzling eyes.


If Friendship Prevails

No more call,
no more beckoning from me
I let you free
as you let go of my hand.

But I know
that if friendship prevails
you be back
walking on the sultry sand.


The Horizon


The river is dazzling with silhouettes
of the lighted skyline with a blue sky.
My eyes wander along the pathway

and are lost in a beauty I can't deny.
My mind wonders along the riverbank
when all asleep under the blue sky.
The moonlit night casts a spell on me
as the lighted city line is held high...


The Vagabond Mind

The vagabond mind searches
the most precious jewel which is lost,
through the woods and red brick path
some day and somewhere.

The mind is stolen along with
the tides of that wild river.
The mind stoops in a drunken mood
along with the spring air.



Finding you

In the middle of a night,
I was in my love's flight.
The stars were weeping,
the moon was moaning.
The joyous hearts are broken.
The words of love remain unspoken.
Can I win you back again
and thus be free from all my pain ?
Love sparkled once more,
when I found you in my heart's core.

অনুবাদ গল্প – কৌশিক ভাদুরী

অনুবাদ গল্প – কৌশিক ভাদুরী
বিচার


( মূল : অস্ট্রিয়ান লেখক মার্টিন অয়ার-এর The Justice , সরাসরি ইংরেজিতে লেখা )


বন্ধুরা! যা বলছি বিশ্বাস করলে তো ভাল, না হলে ঠকে যাবে!

অনেক কাল আগে এই পৃথিবীতেই ছোট্ট একটা মহাদেশ ছিল। এখন সেটার পুরোটাই সাগরের নীচে, খুঁজলেও ম্যাপে পাবে না। আর যখন এই মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল, মানচিত্র তৈরির ব্যাপারটাই আবিষ্কার হয়নি। প্রাচীন পৃথিবীর যে সব মানচিত্র ইতিহাস বইতে দেখ, পাবে না ওখানেও। গুনলে হয়তো সপ্তম মহাদেশই হতো, কিন্তু তখনও তো কোনো মহাদেশই আবিষ্কার হয়নি। সবাই জানত মহাদেশ মানে একটাই, গোনার প্রশ্নই ওঠেনি। যাই হোক, সেই মহাদেশে, যা ছিল সপ্তম নয় প্রথমও নয় একমাত্র মহাদেশ, ভারী অদ্ভুত মানুষ-জন বাস করত।

এই মানুষেরা, সত্যি বলতে কি, অদ্ভুত রকমের ছিটগ্রস্ত ছিল, বোকা নয় মোটেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওরা যখন চাকা আবিষ্কার করে তখনও পর্যন্ত কোন মহাদেশেই চাকা আবিষ্কৃত হয়নি, কারণ আর কোন মহাদেশই আবিষ্কার হয়নি। চাকার পরে-পরেই আবিষ্কার করল আগুন, পিরামিড, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন। কিন্তু বললাম না, ওরা ছিল অদ্ভুত ছিটগ্রস্ত, কি করে বোঝাই! ধরা যাক ওদের কারুর বাড়িতে বেড়াতে আসবেন এক পিসি। পিসি তাঁর মোবাইল ফোনে ফোন করলেন : ‘বুঝলি, এই রোববার আসছি । তোদের সঙ্গে দু’এক দিন কাটিয়ে যাব। তোদের খুব ইচ্ছে করে বুড়ি পিসিকে দেখতে, তাই না!’ বাড়িতে ঠিক হয়েছে রোববারে সি-বিচে আউটিং। লাগেজ প্যাকিং হয়ে গেছে। চাকাগুলো গ্যারেজ থেকে বার করে বাড়ির সামনে রাখা। যেই না পিসির ফোন অমনি আবার লাগেজ খোলো, চাকা গ্যারেজে ঢোকাও, হাঁ করে বসে থাক পিসির আসার অপেক্ষায়। ধরা যাক, পিসি সেই যে এলেন, ছুটি কবেই ফুরিয়ে গেছে, ছ’সপ্তাহ কেটে গেছে, ফেরার আর নাম গন্ধ নেই। এদিকে ব্রেকফাস্টে সবাইকে চা খেতে হচ্ছে, কেন না পিসির ফতোয়া : কফি অস্বাস্থ্যকর। বাবাকে তো সিগারেট ছাড়তেই হলো; কারণ পিসি গন্ধটা সহ্য করতে পারেন না। দুপুর ১টা থেকে ৪টে বাচ্চারা চুপ-চাপ; ওটা পিসির দিবানিদ্রার সময়। আশ্চর্য হলো লোকগুলো পিসিকে বার করে দেবে না। নিদেনপক্ষে কোথায় আঙুলে একটা লিপস্টিক নিয়ে; বাড়ির সব চেয়ে ছোট মেয়েটার গালে লাল-লাল ফুটকি বসিয়ে দেবে, স্কারলেট ফিভার হয়েছে; সে সব কিচ্ছু না। উল্টে চুপচাপ নিজেদের স্যুটকেস ব্যাগ প্যাক করবে। চাকাগুলো গ্যারেজ থেকে বার করবে। বাড়ির চাবি পিসির হাতে দিয়ে চলে যাবে সমুদ্র তীরে। তাঁবু খাটিয়ে গোটা পরিবার দিনের পর দিন সেখানে; যেখানে বাবা যতখুশি সিগারেট খেতে পারে, সকালে জলখাবারের সাথে কফি পেতে অসুবিধে নেই, সারা দুপুর বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচি করে নিজেদের মধ্যে খেলে কাটাতে মানা নেই।

কিংবা ধরা যাক; স্কুলে নতুন হেডমিস্ট্রেস এসেছেন। কোন এক টিচার অন্যদের কাছে সারাক্ষণ গাইছেন : ‘পড়ানোর ছিরিছাঁদ দেখেছো; তবু ওরা আমাকে হেডমিস্ট্রেস করবে না।’ কেউ কিন্তু ওঁকে এ কথা বলছে না : ‘উনি অনেক বেশি দিন পড়াচ্ছেন। এই ছুটিতে প্রত্যেক দিন এক্সট্রা ক্লাস নিয়েছেন, যে সময় তুমি শুধুই ব্যস্ত থেকেছ পায়ের নখে রঙ দিতে।’ বদলে ওরা কী করবে; কাউন্সিলের কাছে চিঠি লিখবে : ‘নতুন হেডমিস্ট্রেস এসে থেকে এই মহিলা কানের কাছে সারাক্ষণ গজগজ করছেন; মাথা ধরতে ধরতে আমাদের মাইগ্রেন হওয়ার উপক্রম, অনুগ্রহ করে এনাকে এক্ষুনি হেড মিস্ট্রেস করে দিন; আমাদের মাথাগুলো বাঁচুক।’ আর সব থেকে আশ্চর্য যে বেশির ভাগ সময়ে এসব চিঠি নতুন হেড মিস্ট্রেসই ফরওয়ার্ড করে সই করে দেন।

কোন বাচ্চা হয়তো লাগাতার খারাপ নম্বর আনছে। টিচাররা ওকে একই ক্লাসে রেখে দেন না; -আহা বাচ্চাটা কি সুন্দর হাসে। আর একই ক্লাসে রেখে দিলে; সাথে না পেয়ে দুঃখ পাবে না বন্ধুরা! সে যতই বানান ভুল করুক; অথবা সেই মহাদেশগুলোর নাম না বলতে পারুক যেগুলো এখনও আবিষ্কার হয়নি।

তোমরা চাইলে আমি এ রকম ঘটনার বিবরণ দিয়েই চলতে পারি। সে নয় পরে দেখা যাবে। আর একটা বলেই আপাতত শেষ করি। ধর : রাস্তার মোড়ে দুটো চাকায় ধাক্কা হয়েছে। রাস্তায় লোকেদের তো দুটো পক্ষ নিয়ে নেওয়ার কথা। এক দল বলবে : ‘আমরা দেখেছি ওই চাকাটাই উল্টো দিক থেকে আসছিল। আর কী স্পিড!’ আর এক দল বলবে : ‘ছাড়ুন ছাড়ুন ও সব বাজে কথা। আমরা দেখেছি সঠিক ঘটনা। ও মশাই আপনি যদি কোর্টে যান, আমরা সাক্ষি দেব, এই নিন আমাদের নাম ঠিকানা।’ এই নিয়ে দু’দলে কোথায় তর্ক-বিতর্ক করবে, সে সব না করে এই মানুষেরা বলে : ‘ও মশাই জলদি রাস্তা ছাড়ুন, চাকা সাইড করুন।’ স্বগতোক্তি করবে : ‘ শয়তান জানে কেন যে আমরা সবার আগে চাকা আবিষ্কার করতে গেলাম।’

বন্ধুরা বুঝতেই পারছ এই পাগলামো কোন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার নয়, আর দেয়ওনি ওদের। ওরা সব সময়ই দ্বিতীয় সারিতে থেকেছে। সিনেমা হলে সব সময় পেয়েছে লড়ঝরে সিট। সুপার মার্কেটে মাংস কেনার অভিজ্ঞতা ওদের ভাগ্যে কোন দিনই জোটেনি। স্কুলে ওরা কোনদিনই হেডমিস্ট্রেস হতে পারেনি। বরং ওরা চিরকাল সমুদ্রের তীরে তাঁবু খাটিয়ে থেকেছে, কফি সিগারেট খেয়ে আর চেঁচামেচির খেলা খেলে নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট করেছে।

এই ভাবে চলতে চলতে একদিন এক জাদুকরের আবির্ভাব হলো। জাদুকরের নাম ‘দি গ্রেট বিলোনি’। ও বাজারের চত্বরের মধ্যে ম্যাজিক কার্পেটটা ল্যান্ড করাল। সব্বাইকে জাদু ওড়না নাড়িয়ে অভিবাদন করে বলল : আজ থেকে এই মহাদেশের নাম হলো বিলোনিয়া! কারণ আমিই আবিষ্কার করলাম এই মহাদেশ।

লোকে একটু আশ্চর্য হল। কেন না তারা ভাবত, আবিষ্কার করা যখন তাদের একচেটিয়া কাজ, তারাই আবিষ্কার করেছে এই মহাদেশ। তখন জাদুকর বোঝাল তোমরা এমন কিছুকে আবিষ্কার করতে পার না যেটা তোমরা আবহমান কাল থেকেই জানো। হয় তো মহাদেশটার নাম হত গুলব্র্যানসোনিয়া বা হার্শকোভিৎজিয়া, সেখানে বিলোনিয়া নামটা মন্দ কী!

তারপর জাদুকর ক্রমাগতই সেই মহাদেশের অলিগলি চক্কর দিতে থাকল। এই ভাবেই একদিন বুঝতে পারল মহাদেশের মানুষ-জনের সমস্যাটা আসলে কোথায়। -‘মানুষ হিসেবে তোমরা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। তোমাদের ভিতরে আছে সম্ভাবনার প্রাচুর্য। অভাব শুধু দুটো জিনিসের।’ লোকে উসখুস করে উঠল কি সেই দুটো জিনিস। -‘ প্রথমটা হল গাড়ি’।

তখন জাদুকর দেখাল; কী করে একটা কাঠের বাক্স মতো বস্তু চাকার সাথে সংযুক্ত করে পাওয়া যায় গাড়ি; কী ভাবে তাইতে করে মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। একটা দিয়ে শুরু করে সাতটা চাকা ব্যবহার করে লোকেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাল। শীঘ্রই বুঝে গেল চাকার আদর্শ ব্যবহার হচ্ছে দুটো অথবা চারটে। এর পর আর বেশি কঠিন হলো না; একে একে মোটর গাড়ি, স্টিম ইঞ্জিন বা রেল গাড়ি আবিষ্কার। একদিন কেউ আবিষ্কার করে বসল; গাড়িতে গাধাও জোতা যায়; তাতে করে বেশ চলার সময় অনাবশ্যক শব্দ দূষণও হয় না ।

‘আর দ্বিতীয়টা কী জিনিস’; লোকে প্রশ্ন করল জাদুকরকে।

‘শোন বলি; দ্বিতীয় বিষয়; যেটার অভাবে তোমাদের উন্নতি রুখে গেছে; সেটা হলো বিচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান।’

‘তা সেটা কী রকম বস্তু; এই কাঠের বাক্স যাকে গাড়ি বললে; সে রকমই কিছু কী?’

‘না; সেটা বস্তু নয়; নীতি।’

লোকে মাথা নাড়ল; যেন বোঝা গেছে। কিন্তু ঘটনা; নীতি বিষয়টাই তাদের ধারনার বাইরে।

‘বিচার মানে প্রত্যেকে যাতে তার ন্যায্যটুকু পায়; সেই ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করা; ন্যায্য থেকে এক চুল কম কিংবা বেশি নয়।’

'তা আমরা তো সেটাই করি।'

'না কর না। তোমরা লোককে সেটাই দাও যেটা সে চায়; যাতে সে আর ঘ্যানঘ্যান না করে। সুতরাং সেটা বিচার নয়। আর যারা ঘ্যানঘ্যান করে না বা করতে চায় না তারা কিছুই পায় না।'

'মানেটা তো এই রকমও হতে পারে চাহিদা তত জরুরি নয় যতটা হলে ঘ্যানঘ্যান করা যায়।প্রয়োজনের গুরুত্ব নিজের থেকে বেশি আর কে বুঝতে পারে?'

জাদুকর আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে লম্বা নি:শ্বাস ফেলল।

'দ্যাখো; তোমরা ঠিক করে বল তো বিচার ব্যবস্থা চাও কিনা; ওটা দিতে আমার জাদু-লাঠি একবার হেলানোই যথেষ্ট; আর আমিও গলা ধরে যাওয়ার খপ্পর থেকে রেহাই পেয়ে যাই।'

লোকেরা বলল : 'ঠিক আছে; যদি এতে করে আমাদের উন্নতি হয়; আসুক তা'হলে'

জাদুকর তার জাদুদণ্ড সাঁই করে যেই না নাড়লো; ম্যাজিক কার্পেট উদয় হলো। জাদুকর সেটায় বসে উড়ে গেল। তিনি ইতিমধ্যেই নতুন মহাদেশগুলোর ফাটাফাটি সবনাম ঠিক করে রেখেছেন। যথা : বিলোনিয়া-২, বিলোনিয়া-৩, ইত্যাদি। এবার কাজ হলো নামের উপযুক্ত মহাদেশগুলো খুঁজে বার করা।

এদিকে জাদুকর চলে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মহাদেশের মানুষ টের পেতে আরম্ভ করলো; জাদুকর কীসের কথা বলেছিল। এখন তারা নিজেদের বিলোনিয়ান বলে; আর মাথা নাড়তে নাড়তে বলাবলি করে :‘সত্যি কী পাগলই না ছিলাম আমরা এতদিন!’ সমুদ্র তীর থেকে যে যার তল্পি গুটিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল। বাড়ির অধিকার দাবি করতে লাগলো। এদিকে পিসিরা গুছিয়ে স্থিতু বাড়িতে। বলতেই বলেন তারা :‘চালাকি! আমাদের একা ফেলে চলে গিয়ে এখন বাড়ির অধিকার? মোটেই ছাড়ব না।’ তারপর লম্বা ঝগড়া;মৌখিক চুক্তি, সাধারণ আইন বা এই ধরনের বিষয়ে ক্রমাগত কথা বিনিময় হতে থাকলো।

এর পরের ধাপে বিলোনিয়ানরা আদালত তৈরি করলো। অনেক মামলা এদিকে জমা পড়ে গেছে, এক-এক করে বিচার করতে হবে; তাই ঠিক হলো প্রত্যেক দিন সকাল দশটায় আদালত বসবে।

প্রথম মামলা বিচারের জন্যে এলো : দুই গরিব ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের জন্য পিতৃদত্ত টিকে ছিল কেবল একটা গাধা । দু'জনের প্রত্যেকেই বলল; গাধাটা তার দরকার; গাড়ি টানার জন্যে;রাস্তায় রাস্তায় জিনিস-পত্র ফেরি করে জীবন নির্বাহ করবে। এই কেসটার সমাধান সহজ। সাব্যস্ত মতো গাধাটা দু'টুকরো করে অর্ধেক অর্ধেক দু'ভাইকে দেওয়া হলো। যদিও ভাইদের দু’জনেইপ্রতিবাদ করল : অর্ধেক গাধা তো কিছু না পাওয়ার সামিল; কারণ অর্ধেক গাড়িও টানতে সক্ষম নয়। কিন্তু ওদের বলা হলো ভাগ-বাঁটোয়ারা একদম সমান হয়েছে; সুতরাং আর কোন কথাই গ্রাহ্য নয়। ভ্রাতৃদ্বয় গজগজ করতে করতে চলে গেল; গাধার টুকরো দুটো ওখানেই পড়ে রইলো।

পরের মামলাটা জটিল। সেটা একটা মাতালের ব্যাপার; মাতাল অবস্থায় ঘুসি মেরে রাস্তায় এক জনের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম প্রস্তাব এলো : যা’র চোখ গেছে সে ঘুসি মেরে সেই মাতালের একটা চোখ অন্ধ করে দেবে; এর পর দু'জনেই দু'জনকে একটা করে কাচের চোখ গড়িয়ে দেবে; কারণ বিচার মানে একদম মাপ মতো; চোখের বদলে চোখ।

কিন্তু পরের দিন সেই মাতালকেই আবার আদালতে আনতে হলো; আজ সে আর এক জনের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। রায় আগের মতোই পুনরাবৃত্ত হতে যাচ্ছে; কথা উঠলো : মাতালের একটা চোখ তো আগের দিনের সাজাতেই গেছে, আজ আর একটা গেলে দেখবে কী করে; এক চোখ গেলে কিছুটা চালিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু দু'চোখ গেলে সেটি হওয়ার নয়; দুচোখবিশিষ্টের একটি চোখ যাওয়ার ফলএকচোখওয়ালার একমাত্র চোখ যাওয়ার ফলের সমতুল নয়। অতএব বিচার ন্যায্য নয়। কথা হলো মাতাল একজনের দৃষ্টির অর্ধেক নিয়েছে; সুতরাং মাতালেরও দৃষ্টির অর্ধেক নেওয়া হোক; ওর অর্ধেক চোখ নেওয়া হোক। তা'তেও অসুবিধে অর্ধেক চোখ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি বা সম্ভব হয়; অর্ধেক চোখে কোনোই কাজ হবে না, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে। এই ভাবে মামলা চলতেই থাকলো।

এদিকে আদালতে এবার এক "পিসি-ভাইপোর বাড়ির দাবি" মামলা উঠে এসেছে। এই পিসি ভাইপোর বাড়ি বহু বছর আছেন। একা থাকার শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দূর করতে তিনি আর একভাইপোকে বাড়িতে ডেকে বসিয়েছেন। ভাইপো ও তার স্ত্রী সেখানে থাকার সুবাদে তাদের ছেলেপুলেরাও সেই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছে। সে বিবাদী পক্ষ। বক্তব্য : ' বাইরের দেওয়াল আমিই রং করেছি,ঘরের ভিতরে নতুন ওয়াল পেপার লাগিয়েছি, এ বাড়ি আমার।'

অন্য ভাইপোর বক্তব্য : 'জলের পাইপ, কল-বেসিন সমস্ত প্লাম্বিং আমি নয়তো আর কে করিয়েছে শুনি?'

বিচারকেরা বললেন : 'রাখুন ওসব ওয়ালপেপার-প্লাম্বিং, আসল কথা হলো বাড়িটা কে তৈরী করেছে?'

প্রথম ভাইপো মাথা চুলকে বলল : 'দেখুন এটা তো অনেক পুরনো বাড়ি; তৈরি কে করেছিল সে বিষয়টা সঠিক বলা মুশকিল; তবে এটুকু বলতে পারি আমার জন্ম ওই বাড়িতেই।'

'কিন্তু তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে।'

'না ধর্মাবতার মোটেই না। কানের কাছে সারাক্ষণ গজগজ করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে।'

'তুমি তোমার পিসিকে তাড়িয়ে দিতে পারতে।'

'মাননীয় বিচারক এ কী বলছেন; পিসি তাড়ানোর কথা কস্মিন কালেও কেউ শুনেছে!'

'কিন্তু তুমি তো ফিরে আসতে চাও বলে পিসিকে কখনও নোটিশ দাওনি।'

'আমরা তাঁবুর নীচে থাকি অস্থায়ী বাসায়; ধর্মাবতার, এটাই কী যথেষ্ট সূচক নয় যে আমি আমারপৈত্রিক ভিটেয়ে ফিরে আসার দিন গুনছি।'

এইবার পিসি হাত তুললেন; তাঁর কিছু বলার আছে। 'ধর্মাবতার যতদূর স্মৃতিতে আছে; একদা এই বাড়িতেই থাকতেন আমার বাবা। একবার বাদী ভাইপোর বাবার পিসি ছুটি কাটাতে এলেন এবং থেকে গেলেন। আমার বাবাকে বেরিয়ে গিয়ে থাকতে হলো সমুদ্র তীরে তাঁবু খাটিয়ে। সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে মাথার সব চুল উঠিয়ে ফেললেন ভালো মানুষ লোকটি। সুতরাং বোঝা যায় না কী উত্তরাধিকারহিসেবে আমার দাবিই ন্যায্য; ধর্মাবতার।'

আদালতে তখন তলব মোতাবেকে পুরনো দলিল দস্তাবেজ ফটো অ্যালবাম অনেক পেশ হয়েছে।সেখানেও দেখা গেল অনুক্রম-পরাক্রমে এমন অনেক পিসি-ভাইপোর নিষ্পত্তি-বিহীন বিবাদ বিদ্যমান। কোথাও-কোথাও আবার দূর ও নিকট তুতো-ভাইদের অমীমাংসিত সামলাতে গিয়ে বৃদ্ধা প্র-উপমাতাদের টেনে নামাতে হয়, তো কোথাও ধর্ম-মায়েদের।

মামলা চলতেই থাকলো, চলতেই থাকলো। মানুষ-জনের খিদে পেয়ে গেল। কেন না মামলা চলাকালীনতারা রোজগারে যেতে পারেনি। খাবারের ভাঁড়ার শূন্য।

এদিকে আদালত চত্বরে পড়ে-পড়ে সেই গাধার টুকরো দুটো পচেছে। চতুর্দিকে দুর্গন্ধ। টেকা দায়। কেউই ভাবেনি ও দুটো হটানো উচিত; বিধিবদ্ধ ভাবে সেগুলো অন্যের সম্পত্তি। সরাতে যাবে কে!দুই-ভাই এদিকে একটা নৌকো চুরি করে সমুদ্রে লা-পতা। মনে আশা যদি জাদুকরের দেখা মেলে;তাকেও তো দিতে হবে তার ন্যায্য প্রাপ্য! দেখতে দেখতে কোটি-কোটি মাছিতে ঢেকে গেল গাধার দুটোটুকরো। কালক্রমে সমস্ত বিলোনিয়াবাসী অসুস্থ হয়ে মারা পড়ল।

এইবার একদিন জাদুকর ফিরে এলো; দেখতে; বিলোনিয়ায় উন্নতির হাল-হকিকত্‌! আকাশচারীম্যাজিক কার্পেটে বসে দেখে ওই দৃশ্য; কোথায় উন্নতি কোথায় কী মাছি ছাড়া গোটা মহাদেশে কিছুটি নেই। অমনি জাদু-লাঠি একবার সাঁই করে দিল। কোথায় কী; মহাদেশ-কে- মহাদেশ দ্বীপ-কে-দ্বীপ ডুবে গেল;উড়ে এসে মাছিগুলো ছেঁকে ধরল। গাধার টুকরো তো খেতে খেতে কবেই শেষ হয়ে গেছে; এখন তারা ক্ষুধার্ত। নিমেষের মধ্যে জাদুকরকে খেয়ে শেষ করে ফেলল। ম্যাজিক কার্পেট তার জাদু-নির্ধারিত সময়ে উড়ে গেল। উড়তে উড়তে জাদুটোনা ফুরিয়ে একদিন মাটিতে আছড়ে পড়ল। এক পথচারী সেটা পেয়ে হাটে বিক্রি করতে এনেছিল। সে-দিন আমার ছুটি ছিল; আমি তখন হাটে; দেখতে পেয়ে কিনে নিলাম। বাড়িতে বসার ঘরে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। বন্ধুরা চলে এস একদিন; কার্পেটটা দেখে যাবে।

ছোটগল্প - ওমর ফারুক

কাজী সাহেবের এক মাস
ওমর ফারুক



কাজী সাহেব নিতান্ত একজন নম্র-ভদ্র মানুষ।বেশ কিছুদিন হল উনার সরকারী ব্যাংকে চাকরি হয়েছে।এই নিয়ে পরিবারে আনন্দের শেষ নেই।বিয়ে করেছিলেন আরও তিন বছর আগে।এতদিন শ্বশুরের উপর বসে দিনযাপন করেছেন।এমন কি শ্বশুর যদি ঈদে কাপড় না দিত তার ঈদও করা হত না।আজ ১৮ দিন হল তিনি চাকরি করছেন।স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসে।তিনি কারোর সাথেই ঠিক মত কথা বলেন না।চাকরি পাওয়ার পরও এতটা পরিবর্তন আসে নি তার স্বভাব চরিত্রে যতটা এসেছে চাকরি শুরু করার পর থেকে।তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সবার কাছ থেকে।এমন কি তার এতদিনের সঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকেও।কথা বলেন না বললেই হয়।যতকুটু বলেন তাতে মনে হয় তিনি একদম না পেরেই বলেন।তাও রেগে কথা বলেন।সব সময় যেন কাজী সাহেবের মধ্যে এক ধরনের রাগ কাজ করে।আসলেই কি রাগ নাকি স্ত্রীর উপর মন উঠে গেছে?
এই নিয়ে তার স্ত্রীর চিন্তার শেষ নেই।যে মানুষটা ঘণ্টায় কয়েকবার কথা বলতো,যার মধ্যে রাগ সহজে দেখা যেত না,তার মধ্যে এত পরিবর্তন আসল কিভাবে?অফিসের কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ে নি তো?যার কারনে এখন নিজের স্ত্রীকে ও দেখতে পারে না।গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে কিছুদিন আগে।সারাদিন একাই থাকে।এমনিতেই তার মন ভাল থাকে না।তার মধ্যে যদি সে এমন করে খুব কষ্ট হয় তার।

কাজী সাহেবের স্ত্রী ফরিদা বেগম চিঠি লেখলেন তার বড় বোনকে।চিঠি পেয়েই তার বোন ঢাকা চলে আসল।কিছু দিন দেখল কাজী সাহেবের কাণ্ড।কাজী সাহেব বাসায় আসেন চোখ মুখ কালো করে।দেখে মনে হয় এই মাত্র তার বউকে হাসপাতালে রেখে এসেছেন।বাঁচবে না বেশিদিন।এর পর যাবতীয় কাজ নিজেই করেন।খাবারে লবন কম পরলেও মুখ খুলে কিছু বলেন না।রসকষ যা আগে ছিল তা কিছুই এখন আর মুখে নেই।সারাদিন ঘরে বসে থাকেন।স্ত্রীর বড় বোন যে এসেছে,তার সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলতে হবে তাও তিনি করছেন না।একদিন সম্পূর্ণ কাজী সাহেবের উপর নজর রাখলেন তার স্ত্রীর বোন।পরেরদিন কাজী সাহেব অফিসে যাওয়ার পরই মিটিং বসল বাসায়।
ফরিদা বেগম বললেন-বইন কি বুঝলি?
বড়বোন ফিসফিস করে কথা বলছে।যেন কেউ শুনতে না পারে।অথচ ঘরে এই দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই।-তোর জামাই মাগির পাল্লায় পড়ছে।আমার আর দেহন লাগতনা চোখে।সংসার করতাছি সাত বছর ধইরা।বেডাগর চাল-চলন দেখলেই বুঝতাম পারি।
ফরিদা বেগম প্রায় কেদেই দিচ্ছেন।মুখে শাড়ির আচল কামড়ে ধরে বললেন-কি কও এই গুলা।ও এই কাম করতেই পারব না।আমি ওরে চিনি।
কথাটা বলেই ফরিদা বেগম কেঁদে দিলেন।তার বোন সান্ত্বনা দিতে শুরু করল।লাভ হচ্ছে না।কান্নার বেগ বরং আরও বেরে যাচ্ছে।ফরিদা বেগম কান্না কোন রকম থামিয়ে বললেন-আব্বা একটা চিঠি লেখছিল।এখনো চিঠিটা পড়ে নাই।আগে আব্বার কথা শুনলেই তার লোম দাঁড়াইয়া যাইত।
তার বোন বলল-বইন বেডারা ওয়াক্তে ওয়াক্তে রঙ ধরে।হেগরে বিশ্বাস করা ঠিক না।তোর জামাই বদলাইছে।কাল রাইতে দেখলাম একা একা জানি নিজেই কি কইতাছে।তখনই বুঝছি।নতুন মাইয়াগর পাল্লায় পরলেই বেডারা ইমুন করে।আর বউয়ের লগে আজাইরা রাগ দেখায়।
ফরিদা বেগম হাওমাও করে কেঁদে উঠল।কাদার মধ্যেই বলছে-আগে আমারে ছাড়া কিছুই বুঝত না।অহন কিছু কইলে দেমাগ দেখায়রে বইন।আমি বিষ খামু।আমি আর বাচতে চাইনা।
সান্ত্বনা দিচ্ছে আরও বড় বোন।বোনকে বলল-বিষ খাবি কেরে।বেডাগরে কেমনে সোজা করন লাগে আমার জানা আছে।
ফরিদা বেগম যেন আলোর সন্ধান পেল।কথাটা শুনেই তার কান্না থেমে গেল।তার বড় বোন ফিসফিস করে বলল-একটা বান দিতে হইব তোর জামাইরে।ঠাকুর কাকার থেইকা একটা তাবিজ আইনা খাটের নিছে রাখবি।দেখবি তোরে ছাড়া নড়েও না।খালি বউ বউ কইরা মুখের লুল(লালা) ফালাইবো।তোর দুলাভাইরে তো এমনিতেই ঠিক করছি।অহন দেখস না আমি না কইলে মুততেও যায় না।
আচমকা ফরিদা বেগমের মন ভাল হয়ে গেল।মুখের সামনে যেন সেই আগের ফরিদ সাহেবকে দেখতে পেল।যিনি হাসি মুখ ছাড়া কথাই বলছেন না।ফরিদা বেগম তার বোনকে বলল-বইন আমারে একটা তাবিজ লইয়া দাও।টেকা পইসা যা লাগে আমি দিমু নে।
-তোর যাইতে হইব সাথে।সব খুইলা কইতে হইব ঠাকুর কাকারে।ঠাকুর কাকা যার তাবিজ তারে ছাড়া কাউরে দেয় না।
ফরিদা বেগম যেন চিন্তায় পড়ে গেল।কিছুক্ষণ ভেবে বললেন-ওরে রাইখ্যা আমি কেমনে যাই।যাই করুক আমার রান্না ছাড়া খাইতে পারে না।খিদায়(ক্ষুধায়)পেট পইরা গেলেও বাইরে খায় না।ফরিদা বেগমের বড় বোন আবার ফিসফিস করে বলল-এইডাই ঠিক আছে।কয়দিন একটু বুঝক তুই কি আছিলি।
ফরিদা বেগম আর কিছু ভাবল না।আধা ঘণ্টার মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন।যাওয়ার সময় ফোন দিলে কাজী সাহেবের অফিসে।অফিসে ফোন করার জন্য কাজী সাহেব রাগলেন।তিনি যেতে নিষেধ করলেন না।এতে আরও তারা বুঝতে পারল বউয়ের উপর থেকে তার মন একেবারেই উঠে গেছে।ঠাকুর কাকার তাবিজের সন্ধানে দুইজনই চলে গেলেন বাপের বাড়ি।
রাতে কাজী সাহেব নিজেই রান্না করে খেতে বসেছেন।মন তার ভাল নেই।তিনি ভাবছেন চাকরিটা ছেড়ে দিবেন।আবার নিজেই ভাবছেন চাকরি ছেড়ে দিলে কি খাবেন।
ঠাকুর কাকার কাছে সব কিছু খুলে বললেন ফরিদা বেগম।বলার মধ্যেই কেঁদে উঠলেন।ঠাকুর কাকা অনেক ভেবে বললেন-তোমার জামাই ব্যাংক কি কাম করে?
ফরিদা বেগমের বোন বলল-কাকা ঐ চেক আইলে পাস করাইয়া হেয় টেকা দেয়।
ঠাকুর কাকা ফরিদা বেগমের হাতে একটা তাবিজ দিয়ে বললেন-এই তাবিজ খাটের নিচে রাখবা।তোমার জামাইরে জানাইবা না।জানলে তাবিজ কাম করব না।আর তোমার জামাইরে কইবা চাকরি ছাইড়া দিত।
ফরিদা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন-চাকরি ছাড়লে চলুম কেমনে কাকা।এমন তাবিজ দেন যাতে চাকরি করতে পারে কিন্তু মাইয়াগর দিকে না তাকায়।
ঠাকুর কাকা ফরিদা বেগমের মাথায় হাত রেখে বললেন-মা,পুরুষের স্বভাব একবার হইলে খারাপ,কোন তাবিজই আয়ে না কাম।
কথাটা শুনে ফরিদা বেগম আবারও কেঁদে উঠলেন।ঠাকুর কাকা বললেন-তোমার জামাইরে ঐ জায়গা ছারতে কইবা।তাইলেই দেখবা সব ঠিক।
তাবিজ নিয়ে দুইদিন পর আসল ফরিদা বেগম।এসে দেখে ঘরের কিছুই ঠিক নেই।সব অগোছালো।ফরিদা বেগমের মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হল।তিনি ভাবতেও পারছেন না।সব কিছু এত সুন্দর করে গুছিয়ে গেলেন তারপরও এই অবস্থা কিভাবে হল।তাছাড়া কাজী সাহেব নিজেই পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে।যে পরিপাটি পছন্দ করে সে নিজেই এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে পারে না।নিশ্চয়ই ঘরে কেউ এসেছে।ফরিদা বেগম সারাক্ষণ কাঁদলেন।তার চোখের পানি যেন শেষই হচ্ছে না।তার মধ্যে কাজী সাহেব আসলেন রাত ১০ টায়।এতরাত তিনি কখনো করেন না।এসে নিজের স্ত্রীকে দেখে তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না।হটাৎ দেশে গেল কেন,কিছু হয়েছিল কিনা,কিছুই জানতে চাইলেন না।খেয়ে শুধু ঘুমিয়ে পরলেন।
ফরিদা বেগম রাতেই তাবিজ খাটের নিচে রাখলেন।এমনিতে নামাজ না পরলেও আজ তাহাজ্জতের নামাজ পরে ঘুমালেন।আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইলেন বিপদ থেকে।
সকালে খাবার টেবিলে প্রথমেই ফরিদা বেগম বললেন-তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।
কাজী সাহেব ধমক দিয়ে বললেন-চাকরী ছাড়লে খাবা কি?আর এত ভাল চাকরী কি কেউ ছারে?
ফরিদা বেগম ধমক খেয়েই কেঁদে দিল।তাতে কাজী সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হল।না খেয়েই চলে গেলেন কাজে।এমন কি দুপরের খাবারটা নিল না।ফরিদা বেগম ভাবল নিশ্চয়ই ঐ মেয়ে খাবার নিয়ে আসে।এই দুইদিন নিশ্চয়ই ঐ মেয়ের হাতেই খাবার খেয়েছে।সে জন্য এখন তার রান্না করা খাবার ভাল লাগে না।

দিনের পর দিন ঝগড়া করেই দিন যাচ্ছে কাজী সাহেবের।কিছু হলেই বউ কেঁদে দেয়।এর মধ্যেই বলে চাকরী ছাড়তে।কেন ছাড়তে হবে তা বলে না।কাজী সাহেব শুকিয়ে গেছেন।ঠিক মত খান না। ঘুম হয় না।সংসারে অশান্তি থাকলে সুখ কি ভাল চাকরিতে আসে।
আজ রবিবার।মাসের এক তারিখ।কাজী সাহেব বেতন পেয়েছেন।খুশিতে বেতনের অর্ধেক টাকা দিয়ে অনেক কিছু ঘরের জন্য কিনে আনলেন।শ্বশুর-শাশুড়ি,শ্যালকের জন্য ও কাপড় কিনে আনলেন।স্ত্রীর জন্য স্বর্ণের কানের দুল।ফরিদা বেগমের মনে যেন আজ আনন্দ আর সয় না।ঠাকুর কাকার তাবিজ কাজ করছে।মনে মনে ঠাকুর কাকাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিলেন। কাজী সাহেবের মনও আজ ভাল।ভাল করে কথা বলছেন তার স্ত্রীর সাথে।সব জিনিস পত্র আর বেতনের বাকি অর্ধেক টাকা স্ত্রীর হাতে দিলেন।ফরিদা বেগম আরও খুশি।কিছুক্ষণ পর দিলেন চাকরী ছাড়ার লেটার।তাতেও খুশি হল ফরিদা বেগম।মাথায় তার চিন্তাই নেই চাকরির সাথে সাথে এই বাসা ও ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে আবার বাপের বাড়ি।
বিকেলে দুইজন এক সাথে চা খেল।ফরিদা বেগম দেখল কাজী সাহেবের মন আজ বেশ ভাল।কথার মধ্যেই ফরিদা বেগম বলল-তুমি চাকরী ছেড়েই ভাল করেছ।চাকরী করার সময় তুমি অহেতুক আমার উপর রাগ করতা।
কাজী সাহেব হাসলেন।ফরিদা বেগম বললেন-সত্যি কইরা কও তো রাগতা কেরে।
কাজী সাহেব দুহাত ছড়িয়ে দেখিয়ে বললেন-প্রতিদিন এত্ত এত্ত টেকা গুনি ব্যাংকের।এক টাকাও নিজের না।তোমার কেমন লাগত তুমিই কও।মেজাজ কার বালা থাকে?
ফরিদা বেগম মুখে আঙ্গুল দিয়েই ফেললেন।কাজী সাহেবকে বললেন-এই জন্যই তুমি রাগতা?
কাজী সাহেব হেসে বললেন-আমিই ঠিক করছিলাম চাকরিটা ছাইড়া দিমু।এখন ছাইড়া দিছি।আমারও ভাল্লাগে না।কত টেকা গুনি একটা নোটও নিজের না।
ফরিদা বেগম বললেন-আমি ভাবছিলাম তুমি কোন মাইয়ার লগে জড়াইছো তার লাইগা আমারে দেখতে পারতা না।
কাজী সাহেব হেসে বললেন-নারে বউ,আমার মেজাজ এর লাইগাই খারাপ থাকত।কম তো আর কষ্ট করি নাই এই জীবনে।ভাবতাম কবে যে নিজের এত টেকা হইব।
ফরিদা বেগম কি বলবে বুঝতে পারছে না।কাজী সাহেব বললেন-এই এক মাস নিজেই বুঝতাম পারছি নিজেরে।ঘরে শান্তি না থাকলে বাইরেও কাম কইরা মজা পাই না।আমি নিজেই ঠিক করছিলাম কাম ছাইড়া দিমু।

ফরিদা বেগম আবার কেঁদে উঠল।কাজী সাহেব বললেন-কান্দ কেরে?
ফরিদা বেগম বললেন-তুমি চাকরী ছারলা কেরে?
কাজী সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন-তুমিই না কইলা ছাড়তে?
ফরিদা বেগম আরও বেগে কাদতে শুরু করল।এর মধ্যেই বলা শুরু বললেন-আমি কইলেই ছারবা নাকি।তোমার বিবেক বুদ্ধি নাই।

কাজী সাহেব কিছু বললেন না।ফরিদা বেগম কেদেই যাচ্ছে।সারাটা রাত কেদেই গেলেন।মাঝে মাঝে নিজেকেই দোষ দিলেন স্বামীকে না বোঝার জন্য।কাজী সাহেব ঠিক মত ঘুমাতে পারলেন না।সকালে উঠে আবার খেয়ে কাজে গেলেন।চাকরি ছাড়ার লেটারটা ছিল নিজের বানানো।যাবার আগে কাগজে বউকে লেখে গেলেন-আমি কাজে গেলাম।আজ দুপরে এসে খাব বাসায়।রান্না করে রেখ।
অফিসে ঢুকেই দেখা হল শায়লার সাথে।শায়লা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল-কি পেরেছ?
কাজী সাহেব হেসে বললেন-এক মাস লেগেছে।
শায়লা বলল-দুপরে কিন্তু এক সাথে খাব।
-আজ পারব না শায়লা।আজ বাসায় খেতে হবে।ফরিদাকে বলে এসেছি।
শায়লা বলল-দুপরে তোমাকে রাখতে কি আরও এক মাস লাগবে?

দুজন এক সাথে হেসে উঠল।ফরিদা বেগম কাগজের লেখা দেখে আবারও কেঁদে দিল।নিজেই বাজার করল।কাজী সাহেব গরুর মাংস অনেক পছন্দ করে।আজ গরুর মাংস রান্না করবেন।


শিল্পকলা - মধুছন্দা মিত্র ঘোষ


শিল্পকলা - অপূর্ব দাস