রবিবার, ২১ জুলাই, ২০১৩

ছোটগল্প - ওমর ফারুক

কাজী সাহেবের এক মাস
ওমর ফারুক



কাজী সাহেব নিতান্ত একজন নম্র-ভদ্র মানুষ।বেশ কিছুদিন হল উনার সরকারী ব্যাংকে চাকরি হয়েছে।এই নিয়ে পরিবারে আনন্দের শেষ নেই।বিয়ে করেছিলেন আরও তিন বছর আগে।এতদিন শ্বশুরের উপর বসে দিনযাপন করেছেন।এমন কি শ্বশুর যদি ঈদে কাপড় না দিত তার ঈদও করা হত না।আজ ১৮ দিন হল তিনি চাকরি করছেন।স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন।গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসে।তিনি কারোর সাথেই ঠিক মত কথা বলেন না।চাকরি পাওয়ার পরও এতটা পরিবর্তন আসে নি তার স্বভাব চরিত্রে যতটা এসেছে চাকরি শুরু করার পর থেকে।তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সবার কাছ থেকে।এমন কি তার এতদিনের সঙ্গী প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকেও।কথা বলেন না বললেই হয়।যতকুটু বলেন তাতে মনে হয় তিনি একদম না পেরেই বলেন।তাও রেগে কথা বলেন।সব সময় যেন কাজী সাহেবের মধ্যে এক ধরনের রাগ কাজ করে।আসলেই কি রাগ নাকি স্ত্রীর উপর মন উঠে গেছে?
এই নিয়ে তার স্ত্রীর চিন্তার শেষ নেই।যে মানুষটা ঘণ্টায় কয়েকবার কথা বলতো,যার মধ্যে রাগ সহজে দেখা যেত না,তার মধ্যে এত পরিবর্তন আসল কিভাবে?অফিসের কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ে নি তো?যার কারনে এখন নিজের স্ত্রীকে ও দেখতে পারে না।গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে কিছুদিন আগে।সারাদিন একাই থাকে।এমনিতেই তার মন ভাল থাকে না।তার মধ্যে যদি সে এমন করে খুব কষ্ট হয় তার।

কাজী সাহেবের স্ত্রী ফরিদা বেগম চিঠি লেখলেন তার বড় বোনকে।চিঠি পেয়েই তার বোন ঢাকা চলে আসল।কিছু দিন দেখল কাজী সাহেবের কাণ্ড।কাজী সাহেব বাসায় আসেন চোখ মুখ কালো করে।দেখে মনে হয় এই মাত্র তার বউকে হাসপাতালে রেখে এসেছেন।বাঁচবে না বেশিদিন।এর পর যাবতীয় কাজ নিজেই করেন।খাবারে লবন কম পরলেও মুখ খুলে কিছু বলেন না।রসকষ যা আগে ছিল তা কিছুই এখন আর মুখে নেই।সারাদিন ঘরে বসে থাকেন।স্ত্রীর বড় বোন যে এসেছে,তার সাথে সৌজন্য কথাবার্তা বলতে হবে তাও তিনি করছেন না।একদিন সম্পূর্ণ কাজী সাহেবের উপর নজর রাখলেন তার স্ত্রীর বোন।পরেরদিন কাজী সাহেব অফিসে যাওয়ার পরই মিটিং বসল বাসায়।
ফরিদা বেগম বললেন-বইন কি বুঝলি?
বড়বোন ফিসফিস করে কথা বলছে।যেন কেউ শুনতে না পারে।অথচ ঘরে এই দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই।-তোর জামাই মাগির পাল্লায় পড়ছে।আমার আর দেহন লাগতনা চোখে।সংসার করতাছি সাত বছর ধইরা।বেডাগর চাল-চলন দেখলেই বুঝতাম পারি।
ফরিদা বেগম প্রায় কেদেই দিচ্ছেন।মুখে শাড়ির আচল কামড়ে ধরে বললেন-কি কও এই গুলা।ও এই কাম করতেই পারব না।আমি ওরে চিনি।
কথাটা বলেই ফরিদা বেগম কেঁদে দিলেন।তার বোন সান্ত্বনা দিতে শুরু করল।লাভ হচ্ছে না।কান্নার বেগ বরং আরও বেরে যাচ্ছে।ফরিদা বেগম কান্না কোন রকম থামিয়ে বললেন-আব্বা একটা চিঠি লেখছিল।এখনো চিঠিটা পড়ে নাই।আগে আব্বার কথা শুনলেই তার লোম দাঁড়াইয়া যাইত।
তার বোন বলল-বইন বেডারা ওয়াক্তে ওয়াক্তে রঙ ধরে।হেগরে বিশ্বাস করা ঠিক না।তোর জামাই বদলাইছে।কাল রাইতে দেখলাম একা একা জানি নিজেই কি কইতাছে।তখনই বুঝছি।নতুন মাইয়াগর পাল্লায় পরলেই বেডারা ইমুন করে।আর বউয়ের লগে আজাইরা রাগ দেখায়।
ফরিদা বেগম হাওমাও করে কেঁদে উঠল।কাদার মধ্যেই বলছে-আগে আমারে ছাড়া কিছুই বুঝত না।অহন কিছু কইলে দেমাগ দেখায়রে বইন।আমি বিষ খামু।আমি আর বাচতে চাইনা।
সান্ত্বনা দিচ্ছে আরও বড় বোন।বোনকে বলল-বিষ খাবি কেরে।বেডাগরে কেমনে সোজা করন লাগে আমার জানা আছে।
ফরিদা বেগম যেন আলোর সন্ধান পেল।কথাটা শুনেই তার কান্না থেমে গেল।তার বড় বোন ফিসফিস করে বলল-একটা বান দিতে হইব তোর জামাইরে।ঠাকুর কাকার থেইকা একটা তাবিজ আইনা খাটের নিছে রাখবি।দেখবি তোরে ছাড়া নড়েও না।খালি বউ বউ কইরা মুখের লুল(লালা) ফালাইবো।তোর দুলাভাইরে তো এমনিতেই ঠিক করছি।অহন দেখস না আমি না কইলে মুততেও যায় না।
আচমকা ফরিদা বেগমের মন ভাল হয়ে গেল।মুখের সামনে যেন সেই আগের ফরিদ সাহেবকে দেখতে পেল।যিনি হাসি মুখ ছাড়া কথাই বলছেন না।ফরিদা বেগম তার বোনকে বলল-বইন আমারে একটা তাবিজ লইয়া দাও।টেকা পইসা যা লাগে আমি দিমু নে।
-তোর যাইতে হইব সাথে।সব খুইলা কইতে হইব ঠাকুর কাকারে।ঠাকুর কাকা যার তাবিজ তারে ছাড়া কাউরে দেয় না।
ফরিদা বেগম যেন চিন্তায় পড়ে গেল।কিছুক্ষণ ভেবে বললেন-ওরে রাইখ্যা আমি কেমনে যাই।যাই করুক আমার রান্না ছাড়া খাইতে পারে না।খিদায়(ক্ষুধায়)পেট পইরা গেলেও বাইরে খায় না।ফরিদা বেগমের বড় বোন আবার ফিসফিস করে বলল-এইডাই ঠিক আছে।কয়দিন একটু বুঝক তুই কি আছিলি।
ফরিদা বেগম আর কিছু ভাবল না।আধা ঘণ্টার মধ্যেই সব কিছু গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন।যাওয়ার সময় ফোন দিলে কাজী সাহেবের অফিসে।অফিসে ফোন করার জন্য কাজী সাহেব রাগলেন।তিনি যেতে নিষেধ করলেন না।এতে আরও তারা বুঝতে পারল বউয়ের উপর থেকে তার মন একেবারেই উঠে গেছে।ঠাকুর কাকার তাবিজের সন্ধানে দুইজনই চলে গেলেন বাপের বাড়ি।
রাতে কাজী সাহেব নিজেই রান্না করে খেতে বসেছেন।মন তার ভাল নেই।তিনি ভাবছেন চাকরিটা ছেড়ে দিবেন।আবার নিজেই ভাবছেন চাকরি ছেড়ে দিলে কি খাবেন।
ঠাকুর কাকার কাছে সব কিছু খুলে বললেন ফরিদা বেগম।বলার মধ্যেই কেঁদে উঠলেন।ঠাকুর কাকা অনেক ভেবে বললেন-তোমার জামাই ব্যাংক কি কাম করে?
ফরিদা বেগমের বোন বলল-কাকা ঐ চেক আইলে পাস করাইয়া হেয় টেকা দেয়।
ঠাকুর কাকা ফরিদা বেগমের হাতে একটা তাবিজ দিয়ে বললেন-এই তাবিজ খাটের নিচে রাখবা।তোমার জামাইরে জানাইবা না।জানলে তাবিজ কাম করব না।আর তোমার জামাইরে কইবা চাকরি ছাইড়া দিত।
ফরিদা বেগম চোখের পানি মুছে বললেন-চাকরি ছাড়লে চলুম কেমনে কাকা।এমন তাবিজ দেন যাতে চাকরি করতে পারে কিন্তু মাইয়াগর দিকে না তাকায়।
ঠাকুর কাকা ফরিদা বেগমের মাথায় হাত রেখে বললেন-মা,পুরুষের স্বভাব একবার হইলে খারাপ,কোন তাবিজই আয়ে না কাম।
কথাটা শুনে ফরিদা বেগম আবারও কেঁদে উঠলেন।ঠাকুর কাকা বললেন-তোমার জামাইরে ঐ জায়গা ছারতে কইবা।তাইলেই দেখবা সব ঠিক।
তাবিজ নিয়ে দুইদিন পর আসল ফরিদা বেগম।এসে দেখে ঘরের কিছুই ঠিক নেই।সব অগোছালো।ফরিদা বেগমের মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হল।তিনি ভাবতেও পারছেন না।সব কিছু এত সুন্দর করে গুছিয়ে গেলেন তারপরও এই অবস্থা কিভাবে হল।তাছাড়া কাজী সাহেব নিজেই পরিপাটি থাকতে পছন্দ করে।যে পরিপাটি পছন্দ করে সে নিজেই এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে পারে না।নিশ্চয়ই ঘরে কেউ এসেছে।ফরিদা বেগম সারাক্ষণ কাঁদলেন।তার চোখের পানি যেন শেষই হচ্ছে না।তার মধ্যে কাজী সাহেব আসলেন রাত ১০ টায়।এতরাত তিনি কখনো করেন না।এসে নিজের স্ত্রীকে দেখে তেমন কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না।হটাৎ দেশে গেল কেন,কিছু হয়েছিল কিনা,কিছুই জানতে চাইলেন না।খেয়ে শুধু ঘুমিয়ে পরলেন।
ফরিদা বেগম রাতেই তাবিজ খাটের নিচে রাখলেন।এমনিতে নামাজ না পরলেও আজ তাহাজ্জতের নামাজ পরে ঘুমালেন।আল্লাহর কাছে মুক্তি চাইলেন বিপদ থেকে।
সকালে খাবার টেবিলে প্রথমেই ফরিদা বেগম বললেন-তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও।
কাজী সাহেব ধমক দিয়ে বললেন-চাকরী ছাড়লে খাবা কি?আর এত ভাল চাকরী কি কেউ ছারে?
ফরিদা বেগম ধমক খেয়েই কেঁদে দিল।তাতে কাজী সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হল।না খেয়েই চলে গেলেন কাজে।এমন কি দুপরের খাবারটা নিল না।ফরিদা বেগম ভাবল নিশ্চয়ই ঐ মেয়ে খাবার নিয়ে আসে।এই দুইদিন নিশ্চয়ই ঐ মেয়ের হাতেই খাবার খেয়েছে।সে জন্য এখন তার রান্না করা খাবার ভাল লাগে না।

দিনের পর দিন ঝগড়া করেই দিন যাচ্ছে কাজী সাহেবের।কিছু হলেই বউ কেঁদে দেয়।এর মধ্যেই বলে চাকরী ছাড়তে।কেন ছাড়তে হবে তা বলে না।কাজী সাহেব শুকিয়ে গেছেন।ঠিক মত খান না। ঘুম হয় না।সংসারে অশান্তি থাকলে সুখ কি ভাল চাকরিতে আসে।
আজ রবিবার।মাসের এক তারিখ।কাজী সাহেব বেতন পেয়েছেন।খুশিতে বেতনের অর্ধেক টাকা দিয়ে অনেক কিছু ঘরের জন্য কিনে আনলেন।শ্বশুর-শাশুড়ি,শ্যালকের জন্য ও কাপড় কিনে আনলেন।স্ত্রীর জন্য স্বর্ণের কানের দুল।ফরিদা বেগমের মনে যেন আজ আনন্দ আর সয় না।ঠাকুর কাকার তাবিজ কাজ করছে।মনে মনে ঠাকুর কাকাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিলেন। কাজী সাহেবের মনও আজ ভাল।ভাল করে কথা বলছেন তার স্ত্রীর সাথে।সব জিনিস পত্র আর বেতনের বাকি অর্ধেক টাকা স্ত্রীর হাতে দিলেন।ফরিদা বেগম আরও খুশি।কিছুক্ষণ পর দিলেন চাকরী ছাড়ার লেটার।তাতেও খুশি হল ফরিদা বেগম।মাথায় তার চিন্তাই নেই চাকরির সাথে সাথে এই বাসা ও ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে আবার বাপের বাড়ি।
বিকেলে দুইজন এক সাথে চা খেল।ফরিদা বেগম দেখল কাজী সাহেবের মন আজ বেশ ভাল।কথার মধ্যেই ফরিদা বেগম বলল-তুমি চাকরী ছেড়েই ভাল করেছ।চাকরী করার সময় তুমি অহেতুক আমার উপর রাগ করতা।
কাজী সাহেব হাসলেন।ফরিদা বেগম বললেন-সত্যি কইরা কও তো রাগতা কেরে।
কাজী সাহেব দুহাত ছড়িয়ে দেখিয়ে বললেন-প্রতিদিন এত্ত এত্ত টেকা গুনি ব্যাংকের।এক টাকাও নিজের না।তোমার কেমন লাগত তুমিই কও।মেজাজ কার বালা থাকে?
ফরিদা বেগম মুখে আঙ্গুল দিয়েই ফেললেন।কাজী সাহেবকে বললেন-এই জন্যই তুমি রাগতা?
কাজী সাহেব হেসে বললেন-আমিই ঠিক করছিলাম চাকরিটা ছাইড়া দিমু।এখন ছাইড়া দিছি।আমারও ভাল্লাগে না।কত টেকা গুনি একটা নোটও নিজের না।
ফরিদা বেগম বললেন-আমি ভাবছিলাম তুমি কোন মাইয়ার লগে জড়াইছো তার লাইগা আমারে দেখতে পারতা না।
কাজী সাহেব হেসে বললেন-নারে বউ,আমার মেজাজ এর লাইগাই খারাপ থাকত।কম তো আর কষ্ট করি নাই এই জীবনে।ভাবতাম কবে যে নিজের এত টেকা হইব।
ফরিদা বেগম কি বলবে বুঝতে পারছে না।কাজী সাহেব বললেন-এই এক মাস নিজেই বুঝতাম পারছি নিজেরে।ঘরে শান্তি না থাকলে বাইরেও কাম কইরা মজা পাই না।আমি নিজেই ঠিক করছিলাম কাম ছাইড়া দিমু।

ফরিদা বেগম আবার কেঁদে উঠল।কাজী সাহেব বললেন-কান্দ কেরে?
ফরিদা বেগম বললেন-তুমি চাকরী ছারলা কেরে?
কাজী সাহেব চোখ কপালে তুলে বললেন-তুমিই না কইলা ছাড়তে?
ফরিদা বেগম আরও বেগে কাদতে শুরু করল।এর মধ্যেই বলা শুরু বললেন-আমি কইলেই ছারবা নাকি।তোমার বিবেক বুদ্ধি নাই।

কাজী সাহেব কিছু বললেন না।ফরিদা বেগম কেদেই যাচ্ছে।সারাটা রাত কেদেই গেলেন।মাঝে মাঝে নিজেকেই দোষ দিলেন স্বামীকে না বোঝার জন্য।কাজী সাহেব ঠিক মত ঘুমাতে পারলেন না।সকালে উঠে আবার খেয়ে কাজে গেলেন।চাকরি ছাড়ার লেটারটা ছিল নিজের বানানো।যাবার আগে কাগজে বউকে লেখে গেলেন-আমি কাজে গেলাম।আজ দুপরে এসে খাব বাসায়।রান্না করে রেখ।
অফিসে ঢুকেই দেখা হল শায়লার সাথে।শায়লা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল-কি পেরেছ?
কাজী সাহেব হেসে বললেন-এক মাস লেগেছে।
শায়লা বলল-দুপরে কিন্তু এক সাথে খাব।
-আজ পারব না শায়লা।আজ বাসায় খেতে হবে।ফরিদাকে বলে এসেছি।
শায়লা বলল-দুপরে তোমাকে রাখতে কি আরও এক মাস লাগবে?

দুজন এক সাথে হেসে উঠল।ফরিদা বেগম কাগজের লেখা দেখে আবারও কেঁদে দিল।নিজেই বাজার করল।কাজী সাহেব গরুর মাংস অনেক পছন্দ করে।আজ গরুর মাংস রান্না করবেন।