শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ১০ম সংখ্যা, ১ম বর্ষ

নেটিজেন, নেটিকেট আর আমরা

যতদুর জানা যায় 'নেটিজেন' একটি ইংরাজি শব্দ, বাংলা করলে দাঁড়ায় 'একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যার অনলাইন কমিউনিটিতে অস্তিত্ত্ব সুস্প্ষ্ট রূপে বর্তমান'। এই অর্থে বাংলা সাহিত্যের আশি নব্বই কিংবা শূন্য দশকের অসংখ্য খ্যাতনামা লেখক/লেখিকা এখনো নেটিজেন হতে পারেননি। একটু বিশদভাবে কারণগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা বেশ কয়েকটি মতভেদ দেখতে পাব।

প্রথমতঃ এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ লেখক/লেখিকা বিশ্বাস করেন লেখার মাধ্যম মানেই কাগজ-কলম, ইন্টারনেটে লেখা - সেতো কেবল অবসর সময় কাটানো। ভালো লেখা সেখানে দেওয়া বা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়তঃ এই প্রবীণ প্রজন্মের কতজন লেখক/লেখিকা আমরা আজকে পাবো যাঁরা আদৌ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। অনেকেই কম্পিউটারের ধারে কাছে আসেন না, ইন্টারনেট ব্যবহার আরও দুরের কথা। তৃতীয়তঃ আজকের দিনে যে কয়েকজন খ্যাতনামা লেখক/লেখিকা নবপ্রজন্মের সমকক্ষ হয়ে এগিয়ে আসতে চেয়েছেন তাদের একাংশের বক্তব্য ইন্টারনেটে লেখা চুরি হয়ে থাকে। সুতরাং লেখা লেখির জগতটা ইন্টারনেট না হয়ে খাতা-কলমই ভালো।

আসুন এবার দেখে নিই নবপ্রজন্মের পথিকৃতরা কী বলে থাকেন। তাদের মতে কাগজ-কলম লেখালেখির জন্য অপরিহার্য হতে পারে, কিন্তু এই অমূল্য সৃষ্টিকে নিজের কাছে ধরে না রেখে যদি অগুন্তি পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌছে দিতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মতো সস্তায় সহজলভ্য মাধ্যম আর হয় না। ধরা যাক একটা সাধারণ মানের লিটল্ ম্যাগাজিন, একটা নূ্ন্যতম ১০০ কপি প্রকাশ করতে গেলে আজকাল কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচা হয়ে যায়। কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের বইয়ের কথা তো আরও বেশি। আমরা জানা দু'একজন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ছাড়া এখনও প্রায় সবাইকেই তাঁদের বই বের করতে হয় পকেট থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচা করে। সুতরাং কতজন লিটল্ ম্যাগাজিনের সম্পাদক, কতজন কবি-সাহিত্যিক নিজের পকেট থেকে বারবার বিপুল পরিমাণে টাকা খরচা করে তাঁর অমূল্য সৃষ্টি কতদিন ধরে পাঠক-পাঠিকাদের দরবারে পৌছে দিতে পারবেন সেটা সত্যিই সন্দেহের বিষয়। সেখানেই সাফল্য নেটিজেনের ক্ষেত্রে, খুব অল্প সময়ে ফেসবুক গ্রুপ বা অধুনা ব্লগজিন তথা ই-ম্যাগাজিনের মাধ্যমে অনেক বেশি সংখ্যক পাঠক/পাঠিকাদের কাছে পৌছে যাওয়া যায় তাঁদের অনন্য সৃষ্টি। আবার এই সমস্ত গ্রুপ বা ব্লগগুলিতে পাঠক-পাঠিকাদের মতামত বা লেখাগুলির সমালোচনা লেখক/লেখিকাদের লেখার মান সমন্ধে মূল্যায়ণের একটা সম্যক ধারণাও পাওয়া যায়। তাই বোধহয় নবপ্রজন্মের কাছে ছাপা বইয়ের চাইতে ই-ম্যাধ্যমে প্রকাশিত লেখার কদর বেশি হতে চলেছে।


এবারে আসা যাক ভালো লেখার কথায়। তরুণ প্রজন্মের উঠতি লেখক/লেখিকাদের মধ্যে আজকাল অনেকই যথেষ্ট ভালো লেখেন, কিন্তু প্রবীণ লেখক/লেখিকারা ভালো লেখার যে মাপকাঠি এতদিন ধরে তৈরী করে গেছেন সেই মানদণ্ডে হয়তো ভালো লেখার সংখ্যা তাঁদের ভাষায় কম হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের লেখার ভঙ্গিমা, শৈলী বা আঙ্গিক তা অনেকাংশেই কেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবীণ প্রজন্মের লেখার ভঙ্গিমার থেকে সম্পূর্ন রুপে আলাদা এবং আরও বেশি উন্নত মানের। তাই এক্ষেত্রে মতভেদ আসতেই পারে যে লেখাটি সত্যিই ভালো না খারাপ। আবার একথাও ঠিক যে নতুন বা উঠতি লেখক/লেখিকাদের প্রথম দিককার লেখা সত্যি করেই হয়তো সেই মানের নয়, কিন্তু তাদের সেই লেখা নিন্মমানের ধরেই নিয়ে যদি যথাযত সমালোচনা মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা যায় আখেরে বাংলা সাহিত্যের আকাশে হয়তো একদিন এরাই উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে। তাই মনে হয় ভালো বা খারাপ একেবারে সেই আলোচনায় না এসে সমস্ত ধরনের লেখাগুলিকে সকলের মতামতের তালিকায় এনে ফেলাটা সব থেকে আজ বেশি জরুরী।

এবারে আসা যাক লেখা চুরির ব্যাপার নিয়ে। একথা অস্বীকার করা যায় না যে লেখা হুবহু কপি করে সহজেই ই-মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং নিজের নামে অনেকে অপরের কবিতা এইভাবে কপি করে চালিয়েও থাকেন, যেটা ছাপা মাধ্যমে করাটা অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক, তবে সেখানেও অনেক লেখাই চুরি হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, যদি কেউ মনে করেন যে তাঁর লেখাটি চুরির হাত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষা করা অবশ্য দরকার, সেক্ষেত্রে তিনি ইন্টারনেটে 'কমন ক্রিয়েটিভ লাইসেন্স'-এর আওতায় লেখাটি 'কপিরাইটেড' করে নিতে পারেন। তাহলে অন্য কেউ কপি করলে তিনি কপিরাইট ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে থাকবেন।

চলুন এবারে নেটিকেট নিয়ে একটু আলোচনায় বসি, 'নেটিকেট' বলতে বোঝায় 'ইন্টারনেট এটিকেট' অর্থাৎ কিছু অবশ্য পালনীয় আচরণবিধি যা ইন্টারনেটে কমিউনিটি, ইমেল, ব্লগ বা অন্যান্য সাইটে মেনে চলা হয়। যদিও আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় সেই সমস্ত 'নেটিকেট' নয় যা ইন্টারনেট বা ই-মেলে ব্যবহারের জন্য অবশ্য পালনীয় বরং সেই সমস্ত নেটিকেট যা ইন্টারনেট কমিউনিটিতে বাংলা সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমরা শুধু সেই সমস্ত আচরণবিধি নিয়ে একটু আলোচনা করব যা হয়তো বাংলা সাহিত্যের বিকাশে একটু হলেও সাহায্য করবে।

আজকে তরুণ প্রজন্মের লেখক/লেখিকারা এবং প্রবীণদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা নেটিজেন হয়েছেন তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ব্লগে বা ফেসবুকে লিখে থাকেন। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখব যে লেখার সঙ্গে যেখানে পছন্দ-অপছন্দের স্থান আছে সেখানে অনেকই পছন্দের বোতামটি টিপেই সরে পড়েন, লেখাটি সম্পর্কে তিনি কোন মতবাদ পোষন করেন না বা সমালোচনাও করে থাকেন না। একথা ঠিক নতুন বা উঠতি লেখক/লেখিকাদের অনেকটাই আত্মতুষ্ঠিতে ভোগেন যে আমার লেখা অনেকজন পছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি ভুলে যাচ্ছে বেশিরভাগ নেটিজেনই তিনি দেখেছেন বোঝাতে লাইক বা পছন্দের বোতামটি টিপে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে পছন্দসই বোঝাতে নয়। এখানেই আমাদের ব্লগে বা ফেসবুকে নেটিকেট হওয়া দরকার যে লেখা পড়ার পরে আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য সেই লেখা সম্পর্কে সঠিকভাবে খোলাখুলি মতামত পোষণ করা। এই বিষয়ে আশাকরি সকলে একমত হবেন।

দ্বিতীয়তঃ আজকাল কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমরা দেখি শখে বা সময় কাটাবার তাগিদে অনেকেই বাংলা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন এবং কয়েকদিন লেখার পড়েই কিছু লাইক পেয়ে বা 'সুন্দর', 'দারুণ' বা এই ধরনের কয়েকটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য দেখে যাইপরনাই আহ্লাদিত হয়ে নিজেকে বেশ বড়মাপের লেখক বা লেখিকা ভাবতে শুরু করেছেন। এই শ্রেণীর লেখক/লেখিকারা নিজের কবিতা লিখে আশা করেন তাঁর কবিতা বা লেখা সকলে পড়বেন বা সমালোচনা করে মতামত পোষণ করবেন, কিন্তু নিজে তিনি কখনও অপরের কবিতা পড়েন না। আজকাল এই ধরণের লেখক/লেখিকাদের সংখ্যাই সবথেকে বেশি হয়ে পড়েছে।


তৃতীয়তঃ যে সমস্ত লেখক/লেখিকারা এখন প্রতিষ্টিত হয়ে গেছেন, হয়ত তারা নেটিজেন আছেন বা নেই, আমরা আশা করব নতুন প্রজন্মের এই ই-মাধ্যমে যে সমস্ত তরুণ/তরুণীরা লিখছেন তাদের হাত ধরে বাংলা সাগিত্যের মুল স্রোতে এগিয়ে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে প্রবীণদেরই অগ্রণী হতে হবে সব থেকে বেশি। তাহলেই ছাপা মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের যে আস্তে আস্তে ভাঙন ধরছে তা রোধ করা যাবে। আগামী দিনে ছাপা মাধ্যমের চেয়ে ই-মাধ্যমই যে সর্বাধিক প্রচলিত হবে এই সত্যটি স্বীকার করে নিয়ে চলুন আমরা সকলে এক সুরে বলি - "লিখুন, পড়ুন আর সকলকেও পড়ান।"

ক্ষেপচুরিয়ানসের পক্ষে
সুমিত রঞ্জন দাস


বাংলা সাহিত্য - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


বাংলা সাহিত্য


রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


আজকাল যে বাংলা সাহিত্য আমরা পড়ি,তার আরম্ভ কি করে হয়েছিল


যতদূর জানা যায়,আনুমানিক খ্রীষ্টীয় নবম শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় (মাগধী এবং প্রাকৃতের বাতাবরণে সংস্কৃতভাষার গর্ভে বাংলাভাষার জন্ম।) সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রীষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোঁহা-সংকলন চর্যাপদ, বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন।

অনেকেরই ধন্দ ছিল, চর্যাপদ আদৌ বাংলা ভাষায় রচিত কিনা!

প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলির সন্ধানে প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদ একটি মূল্যবান উপাদান। ১৯২৬ সালে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন, তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে। এরপর ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর রামেশ্বর শহ, চর্যার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন। ফলে আজ চর্যার ভাষার স্বরূপটি অনেক বেশি সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।

চর্যা পদসংগ্রহ প্রকাশিত হবার পর চর্যার ভাষা নিয়ে যেমন প্রচুর গবেষণা হয়েছে, তেমনি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বজ্জনেরা এই ভাষার উপর নিজ নিজ মাতৃভাষার অধিকার দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।

এ ব্যাপারে যথেষ্ট কৌতুহল থাকা স্বাভাবিক। গদ্য না পদ্য, কি ভাবে লেখা হত এই সাহিত্য? কিরকম ছিল সেই ভাষা? আসুন, দেখা যাক কি ভাবে শুরু হয়েছিল এই যাত্রা!

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের পুরান বাঙ্গলা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তাঁর দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ সালে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাঁদের দাবি অস্বীকার করে চর্যা ও অন্যান্য কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯২৬ সালে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর সেই, The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ সালে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন।

যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চর্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে প্রমাণ করে সেগুলি হল সম্বন্ধ পদে –অর বিভক্তি, সম্প্রদানে –কে, সম্প্রদানবাচক অনুসর্গ –অন্তরে (মধ্যযুগীয় ও আধুনিক রূপ –তরে), অধিকরণে –অন্ত, -ত, অধিকরণবাচক অনুসর্গ –মাঝে, অতীত ক্রিয়ায় –ইল এবং ভবিষ্যত ক্রিয়ায় -ইব। চর্যা মৈথিলী বা পূরবীয়া হিন্দিতে রচিত হলে অতীত ক্রিয়ায় –অল ও ভবিষ্যতে –অব যুক্ত হত।
• গুনিয়া, লেহঁ, দিল, ভণিআঁ, সড়ি, পড়িআঁ, উঠি গেল, আখি বুজিঅ, ধরণ ন জাঅ, কহন না জাই, পার করেই, নিদ গেলা, আপনা মাংসে হরিণা বৈরী, হাড়ীত ভাত নাহি ইত্যাদি বাগভঙ্গিমা ও শব্দযোজনা বাংলা ভাষায় পরবর্তীকালেও সুলভ। এর সঙ্গে অবশ্য তসু, জৈসন, জিস, কাঁহি, পুছমি প্রভৃতি পশ্চিমা অপভ্রংশের শব্দও আছে। তবে সেগুলি মূলত কৃতঋণ বা অতিথি ( Loan words) শব্দ হিসাবেই চর্যায় ব্যবহৃত হয়েছে।
• এছাড়া সম্প্রদানে –ক এবং –সাথ, -লাগ, -লগ-এর বদলে সঙ্গে, সম অনুসর্গের ব্যবহার এবং নাসিক্যধ্বনির বাহুল্যের জন্য চর্যার ভাষাকে রাঢ় অঞ্চলের ভাষা বলে মনে করা হয়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, “চর্যার আচার্যেরা কামরূপ, সোমপুরী, বিক্রমপুর – যেখান থেকেই আসুন না কেন, আশ্চর্যের বিষয়, এঁরা সকলেই রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন।”
• রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হননি।
• চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।লেখকেরা রাঢ় অঞ্চলের ভাষানীতি গ্রহণ করেছিলেন। সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কেন?

তাহলে, রাঢ় অঞ্চল সম্বন্ধে একটু লেখা যাক। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগে বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত একটি বিস্তৃত সমভূমি অঞ্চলের নাম ছিল/আছে রাঢ়। এর সীমানা পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমির প্রান্তভাগ থেকে পূর্বে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অঞ্চল ঈষৎ ঢেউ খেলানো ও এর ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে।


‘রাঢ়’ শব্দটি এসেছে সাঁওতালি ভাষার ‘রাঢ়ো’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ‘পাথুরে জমি’। অন্যমতে, গঙ্গারিডাই রাজ্যের নাম থেকে এই শব্দটি উৎপন্ন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম প্রধান অবদানকারী।


প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।মহাভারতে সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তকে পৃথক করে দেখা হলেও গুপ্ত শাসনে রচিত দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ বলা হয়েছে ‘সুহ্মেষু দামলিপ্তাহ্বয়স্য নগরস্য’। অর্থাৎ দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মেরই একটি নগর ছিল। ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে রাঢ় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –
গঙ্গাবীচিপ্লুত পরিসরঃ সৌধমালাবতংসো
বাস্যতুচ্চৈ স্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্ম দেশঃ।
অর্থাৎ, ‘যে-দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঙ্গাপ্রবাহের দ্বারা প্লাবিত হয়, যে দেশ সৌধশ্রেণীর দ্বারা অলংকৃত, সেই রহস্যময় সুহ্মদেশ তোমার মনে বিশেষ বিষ্ময় এনে দেবে।’ পরবর্তীকালে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-এ বলা হয়েছে –
গৌড়স্য পশ্চিমে ভাবে বীরদেশস্য পূর্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশঃ প্রকীর্তিতঃ।
অর্থাৎ, গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের (বীরভূম) পূর্বে, দামোদরের উত্তরে অবস্থিত প্রদেশই সুহ্ম নামে খ্যাত। এই সকল বর্ণনার প্রেক্ষিতে বর্তমান হুগলি জেলাকেই প্রাচীন রাঢ়ের কেন্দ্রস্থল বলে অনুমান করা হয় এবং এর সীমানা বীরভূম থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে অনুমান।

চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনা অনুসারে, রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পথে চৈতন্যদেব কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কবির বর্ণনায় রাঢ়ের অরণ্যভূমির একটি কাল্পনিক বর্ণনা পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম উজ্জ্বল কবিকল্পনা –
প্রসিদ্ধ পথ ছাড়ি প্রভু উপপথে চলিলা।
কটক ডাহিনে করি বনে প্রবাশিলা।।
নির্জন বনে চলেন প্রভু কৃষ্ণ নাম লৈয়া।
হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া।
পালে পালে ব্যাঘ্র হস্তী গণ্ডার শূকরগণ।
তার মধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।।
ময়ূরাদি পক্ষিগণ প্রভুকে দেখিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হৈয়া।।
হরিবোল বলি প্রভু করে উচ্চধ্বনি।
বৃক্ষলতা প্রফুলিত সেই ধ্বনি শুনি।।
ঝারিখণ্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত।
কৃষ্ণনাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত।।
যাই হোক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য।মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্তপদাবলী,বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলী এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়।

বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:
• আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ (আনুমানিক ৯০০ খ্রী.–১২০০ খ্রী.)
• মধ্যযুগ (১২০০ খ্রী.– ১৮০০ খ্রী.)
• আধুনিক যুগ (১৮০০ খ্রী. – বর্তমান কাল)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট সালতারিখ অনুযায়ী সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা সম্ভব নয়। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সালতারিখের হিসেব অগ্রাহ্য করে না। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্টে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।

যেমন ধরুন:- এই লেখাটি এক শিলালিপিতে পাওয়া:-
শুতনুকা নম দেবদশিক্যী
তং কময়িথ বলনশেয়ে
দেবদিনে নম লূপদখে
এর অর্থ:- সুতনুকা নামে( নম) এক দেবদাসী(দেবদশিক্যী), তাকে(তং)কামনা করেছিল(কময়িথ) বারাণসীর(বলনশেয়ে)দেবদিন নামের এক রূপদক্ষ(লূপদখে), মানে ভাস্কর।

এটা কবে লেখা হয়েছিল, এখনও গবেষণার বিষয়বস্তু। তবে এটা যে আদিযুগ বা প্রাচীন যুগে লেখা হয়েছিল, মনে হয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের পূর্বে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অবহট্ট ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়ের সূচনা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু আগেই বাঙালিরা একটি বিশেষ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্মেষ ঘটে বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা অভিনন্দ ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় ও সদুক্তিকর্ণামৃত নামক দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্ট ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সব বই বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।


আগেই বলেছি,বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলী ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।


শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন, বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য। ১৯০৯ সালে বসন্ত রঞ্জন বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুঁথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে পুঁথিটি প্রকাশিত হয়। যদিও কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ। কৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট এগারোটি খণ্ডে বিভক্ত। পুঁথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর পথ সুগম হয়।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর, ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, বাংলার দেওয়ানী বা রাজস্বের আদায়ের ভার পেয়ে গেল।ফলে, কয়েক বছরের মধ্যেই কোম্পানী; দেশের রাজশক্তি,একেবারে কুক্ষীগত করে ফেলে।“বণিকের মানদণ্ড পরিণত হলো রাজদণ্ডে”। পরবর্তী কালের নিরীখে, সূচনা হলো এক নতুন যুগের। এ সময়ের কিছু আগে থেকেই, বাংলায় গদ্য রচনা আরম্ভ হয়ে গেছিল। শুধু, খ্রীষ্টান মিশনারীরা নয়; ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরাও এ বিষয়ে যত্নবান হয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য, স্মৃতি ও ন্যায় শাস্ত্রের কয়েকটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদের কাজ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই শুরু হয়েছিল।বৈদ্য চিকিৎসকরাও, কয়েকটি কবিরাজী বই, বাংলা গদ্যে লিখেছিলেন। তেতো লাগলেও, এটা মেনে নিতে লজ্জা নেই যে ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অভ্যুদয় না ঘটলে; এ প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসু হতো, তা গবেষনার বিষয়বস্তু।কারণ,ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত নমুনা হলেও; বাংলা গদ্য সাহিত্য এই সাম্রাজ্যবাদের কাছেই ঋণী।ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানী, রাজ্যভার পেয়েই, দেশে আইনকানুন প্রণয়ণ করতে লাগল। সবটাই অবশ্য নিজেদের সুবিধের জন্য। চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজের বাইরে, এটাই হলো বাংলা গদ্য ভাষার প্রথম কার্য্যকর ও ব্যাপক ব্যাবহার।

তারপর, বাঙ্গালিকে, ইংরেজী আর ইংরেজকে বাংলা শেখাবার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে, ব্যাকরণ আর অভিধান রচনা করা হতে লাগল। এ পর্যন্ত, হাতে লেখা বইয়ের ব্যাবহার ছিল। প্রচুর নকলনবীশ ছিলেন, যাঁরা এই বই গুলো হাতে নকল করে লিখতেন। কিন্তু, এগুলো ছিল, সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ। তাই, ছাপার যন্ত্র আর বাংলা টাইপের প্রয়োজন অনিবার্য্য হয়ে উঠল।

বাংলা টাইপের সর্বপ্রথম ছেনী কাটেন একজন ইংরেজ।ইনি ছিলেন,ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একজন কর্মচারী। নাম- চার্লস উইলকিনস। পরে অবশ্য ইনি স্যার উপাধি পেয়েছিলেন। এই সাহেব, শ্রীরামপুরের শ্রী পঞ্চানন কর্মকারকে বাংলা টাইপের ছেনী কাটান শিখিয়ে দেন। এইভাবে, বাংলা টাইপের আবির্ভাব হলো।বাংলা টাইপের প্রথম ব্যাবহার হয়; হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণে।১৭৭৮ সালে এটি হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়।

হ্যালহেডের আসল বাংলা ব্যাকরণ বইটির প্রচ্ছদের প্রতিলিপি

ফলে, বই আর সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সর্বসাধারণের কাছে উন্মুক্ত হল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, আমরা দেখতে পাই-দু- একটি আইনের বই; বাংলায় লেখা হয়েছিল। বইগুলো দলিল পত্রের মত, আরবী-ফার্সী শব্দে ভরা। তাই, পরবর্তীকালে এগুলোকে ঠিক সাহিত্যের কোঠায় ফেলা হয় নি।ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ঢল নামল।খাস বিলেত থেকে আসা ইষ্ট- ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের(এদের সিভিলিয়ান বলা হত) শিক্ষার জন্য ১৮০০ খ্রীঃ এ কোলকাতায় কলেজ অব ফোর্ট উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হল।এই কলেজে প্রাচ্য ভাষার অধ্যক্ষ নিযুক্ত হলেন-শ্রীরামপুরের মিশনারী পাদ্রী উইলিয়াম কেরী।১৮০১ সালের মে মাসে;উইলিয়াম কেরীর সহকারী পণ্ডিত ও মুনশী কয়েকজনকে নিযুক্ত করা হলে; কলেজের প্রকৃত কাজ শুরু হয়।

সিভিলিয়ানদের বাংলা পড়াতে গিয়ে, দেখা গেল- বাংলা বই গুলো সবই কাব্য। এখন প্রয়োজন হয়ে পড়ল বাংলা গদ্যের।কারণ, ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্য না পড়ালে সিভিলিয়ানরা তথাকথিত নেটিভদের সাথে কথা বলবে কি করে?


উইলিয়াম কেরী, তাঁর মুনসী এবং পণ্ডিতদের বললেন ব্যাবহারোপযোগী বাংলা গদ্যের বই লিখতে। নিজেও লেগে গেলেন। লিখে ফেললেন- একটা ব্যাকরণ, একটা অভিধান, একটা কথোপকথনের বই আর একটা গদ্য গ্রন্থ সংকলন। সূচনা হলো, বাংলা গদ্যের। নিজেদের রাজ্য শাসনের জন্য, এগুলো তৈরী করলেও; ভবিষ্যতের বাংলা গদ্য সাহিত্য ঋণী হয়ে থাকল এঁদের কাছে। যে বছর কলেজ কাজ আরম্ভ করল, সেই বছরেই প্রকাশিত হলো; কেরীর “ব্যাকরণ”, ‌‍রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”, আর গোলোক শর্মার “হিতোপদেশ”।‌‍রামরাম বসুর “প্রতাপাদিত্যচরিত্র”,বাংলা অক্ষরে ছাপা প্রথম মৌলিক গদ্য গ্রন্থ।


এর আগে, পোর্তুগীজ পাদ্রীরা যে সব গদ্য গ্রন্থ বের করেছিলেন, সে সবই ছিল ইংরাজী বা রোমান হরফে ছাপা।

এ প্রসঙ্গে, জানিয়ে রাখা যেতে পারে; অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে যে তিনখানা আইনের অনুবাদ গ্রন্থ এবং ১৮০০-০১ সালে বাইবেলের যেটুকু অনুবাদ, শ্রীরামপুর মিশন প্রকাশ করেছিল, তা কিন্তু বাংলা অক্ষরে ছাপা হয়েছিল।

রামরাম বসুর আর একটি গদ্য গ্রন্থ- “লিপিমালা”, প্রকাশিত হয়; পরের বছর অর্থাৎ ১৮০২ সালে। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয়,চণ্ডীচরণ মুন্সীর- “তোতা ইতিহাস”। রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের- “ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রম্” ।

সবাইকে ছাপিয়ে গেছিলেন- মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। কলেজের শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক ছিলেন এই মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ এই মহাপণ্ডিত, কেরী সাহেবের ডান হাত ছিলেন। দেশী লোকের লেখা প্রথম ভারতবর্ষের ইতিহাস- “রাজাবলি”, এনারই রচনা। ১৮১৯ সালে ইনি প্রয়াত হন।


এরপর এলেন বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার, বিশেষত বাংলা গদ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পুরুষ ও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনিই প্রথম বাংলাভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ লিখেছেন, যা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণেরই প্রসারণ/অনুবাদ হলেও আজ অব্ধি বাংলাভাষার ব্যাকরণ এই আদলের মধ্যেই রয়েছে। প্রয়াত হূমায়ুন আজাদ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বাংলাভাষার ব্যাকরণ রচনার আগ্রহ ও প্রয়োজনীয়তার কথা অনেকবার বললেও কাজটি শেষ পর্যন্ত আরদ্ধই রয়ে গেছে, সম্ভবত যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে।

• মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ১৬টি স্বরবর্ণ রেখেছিলেন।
• ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ে প্রথম ভাগের ১৬টি থেকে কমিয়ে ১২টি স্বরবর্ণ করলেন। তিনি দেখালেন ৯, দীর্ঘ ৯, দীর্ঘ ঋ কারের কোনো দরকার নেই।
• মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ৩৪টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে ৪০টি ব্যাঞ্জনবর্ণ আনলেন।

শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়! অপেক্ষাকৃত নতুন বাংলা ভাষার বাক্যবিন্যাস কিন্তু নেওয়া হয়, ফার্সী থেকে।এলেন ঋষি বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ!

বাংলা হরফের বিবর্তন ও আরও কিছু ছবি


বাংলা সাহিত্যের ভাষা,সর্বজনবোধ্য হওয়া উচিত, এটা সবাই মানবেন! চট্টগ্রামের কথ্য ভাষা, বাঁকুড়ার লোক বুঝবে না,বর্দ্ধমানের লোক, মৈমনসিংহের লোকেরা বুঝবে না। এই যে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম ভাষা, সেগুলোকে উপভাষা বলে। এবার সাধারণ ভাবে; এই উপভাষাগুলো কোথায় ব্যবহৃত হয়, একবার দেখে নেওয়া যাক।

• রাঢ়ী:- মূলত, পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া,হুগলি,বর্ধমান, মেদিনীপুর( যদিও, এ জেলায় বেশ কিছুটা ওড়িয়া ভাষার প্রভাব আছে।),মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, চব্বিশ পরগণা।
• বরেন্দ্রী : - উভয় বাংলার উত্তর দিকের জেলা গুলোতে। মালদহ ( কিছুটা ঝাড়খণ্ডি), দিনাজপুর, রাজশাহি, বগুড়া, পাবনা।
কোচবিহার, রংপুর জেলায় কোচ বা কামরূপী ভাষার প্রভাব আছে।
( ডঃ সুকুমার সেনের মতে, রাঢ়ী আর বরেন্দ্রী একই উপভাষা ছিল। পরে, একদিকে বঙ্গালী এবং বিহারীদের প্রভাবে পড়ে; রাঢ়ী আর বরেন্দ্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে, তিনি বলেছেন।)
• বঙ্গালী : -এই ভাষাটির প্রভাব, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অহমের কাছাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।
• এই উপভাষাটি ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে থাকায়, এখানে প্রচুর বৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ফলে, কেউ কেউ এই উপভাষাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে; নোয়াখালি, চট্টগ্রাম,ত্রিপুরা, কাছাড় আর পূর্ব শ্রীহট্টকে নিয়ে আর একটি উপভাষা হঠনের পক্ষপাতী। এটাকে তাঁরা, চট্টগ্রামী উপভাষা বলতে চান।
• ঝাড়খণ্ডী: -দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া।
• কামরূপী উপভাষাটি, বরেন্দ্রী আর বঙ্গালির মাঝামাঝি।

এবার নমুনা (প্রচুর আছে, রকম ফেরও আছে, শুধু সাধারণ কয়েকটি দিলাম) : - ( এখানে যে বানান গুলো ব্যবহৃত হবে, তা উচ্চারণের সুবিধের জন্য)
• রাঢ়ী--- এই তো এক্কুনি দেকে এলুম।
• বরেন্দ্রী-----আ্যকদিন, বাগ( বাঘ) ঘরৎ ( ঘরে) আইল( এলো)
• বঙ্গাল- তোমরাগো, বাড়ী যাইতাম পারি। ( চট্টগ্রামি- আঁই না পাইরগম- আমি পারব না)
• ঝাড়খণ্ডী- কুণ্ঠে, যাছিস রে? (কোথায় যাচ্ছিস?)
• কামরুপী-এ পাখে আয়, মুই না পারিম। (এদিকে আয়, আমি পারব না)

সুতরাং, এই অল্প পরিসরে কি দেখা গেল? প্রত্যেকটা জেলার কথ্য ভাষার মধ্যে ফারাক। তাহলে, আদর্শ কথ্যভাষা কি হবে? দেখা গেছে, কলকাতা আর ভাগীরথী নদীতীরের বসবাসকারীদের ভাষা, সাধারণত শিক্ষিত সমাজে মান্য হয়েছে।

প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ কবি, সাহিত্যিক ছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। এটাই পরে মান্য চলিত হিসেবে নেওয়া হয়। যদি ঢাকা বেতার বা দূরদর্শন দেখেন/শোনেন, তা’লে এই কথার প্রমাণ পাবেন।

কাজেই, এমন একটা মধ্যপন্থা চাই, যে ভাষা সকলে বুঝবে। ঠিক, এই উদ্দেশ্যেই সাহিত্যে প্রয়োগের উপযোগী একটা সংস্কৃতানুগ ভাষা গড়ে উঠেছিল, এবং প্রায় শতাব্দীকালের সাধনায় এই ভাষা একটা সর্বাঙ্গসুন্দর রূপ নিয়েছিল।
এর নামই সাধু ভাষা। এই নামটি দিয়েছিলেন- রাজা রামমোহন রায়।
বিদ্যাসাগরের রচনায় এই সাধু ভাষা প্রাঞ্জলতা লাভ করে। বঙ্কিম এই সাধু ভাষাকে সুন্দরতর করেন। আমরা, এই সাধু ভাষার দুটি রূপ দেখতে পাই। একটা গম্ভীর সংস্কৃতানুগ, তৎসম শব্দে ভরপুর! তৎ মানে তাহার- সংস্কৃতভাষা আর সম মানে সমান।

রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রের রচনার ইন্দ্রজালে এই সাধু ভাষা অপূর্ব সুষমায় মণ্ডিত হয়েছিল।
বিদ্যাসাগর, গম্ভীর সংস্কৃতানুগ, তৎসম শব্দে ভরপুর শব্দে রচনা করতেন। আর বঙ্কিম করতেন- সাধু ভাষার প্রাঞ্জল রূপের ব্যাবহার।

মৌখিক ভাষায় সাহিত্য রচনা, আধুনিক প্রয়াস। এই ভাষায় বহু উৎকৃষ্ট রচনা আমরা এখন পড়ছি।

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায় জানা যায়, ১৯৪৩ সালে, “প্রত্যহ”বলে একটি খবরের কাগজ, এই মান্য চলিত ভাষায় শুরু হয়। যদিও ১৯৪৪ সালে এটি আবার সাধু ভাষায় ফিরে যায়।

কবিগুরুও ১৯১৪ সাল থেকে প্রায় এই মান্য চলিত ভাষায় তাঁর রচনা শুরু করেন। সব চেয়ে মজার ব্যাপার, বীরভূমের প্রচলিত কথ্য ভাষাকে তিনি তাঁর সংবেদনশীল, শিক্ষিত নায়ক, নায়িকার মুখে বসিয়ে দেন। “ বললেম” “করলেম”, কয়েকটা উদাহরণ মাত্র।

“সাধু ভাষা” শব্দটি রামমোহনই প্রথম ব্যাবহার করেন। এটা নিয়ে লিখছি।


সাধু ভাষা” নামটি, রামমোহন কেন দিলেন? সংস্কৃত জানা বা কিছুটা সংস্কৃত জানা লোকেদের সঙ্গে ভাব আদান প্রদানের জন্য, ব্যবহৃত এই ভাষাকে তিনি “সাধু ভাষা” বলেছিলেন। তৎসম শব্দের ব্যবহার প্রচুর বলে, সব অঞ্চলের লোকেরা সহজেই এই ভাষা বোঝে। তাছাড়া, আরও একটা কারণ ছিল। সেই সময় থেকেই আস্তে আস্তে জাতীয় চেতনার একটা আবছা চেহারা ফুটে উঠছে।সমগ্র বাংলার জন্য, এই “সাধু ভাষা” র প্রয়োজন তখন খুব জরুরী। যাই হোক, আজও সমগ্র বাংলার আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্রে এই সাধু ভাষার চলন আছে। তবে, ওই যে বলেছি, বর্তমানে কিন্তু মান্য চলিত ভাষাও চিঠিপত্রে ব্যবহার হচ্ছে।


সাধু ভাষা, সমস্ত বাংলার সম্পত্তি। এর কারণ, সাধু ভাষার আভিজাত্য,গাম্ভীর্য,শব্দধ্বনির সুষমা, বাক্যরীতির সংযম এমনই, যে এই ভাষা, সব রকম ভাব প্রকাশে সক্ষম।
সাধু ভাষার দুটি রূপ।
• গুরুগম্ভীর
• লঘু ( আনন্দবাজার, সম্পাদকীয়তে, লঘু সাধু ভাষার চলন রেখেছে।
“এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড়, নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গ বিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে।”:-

সীতার বনবাস/ বিদ্যাসাগর
(“সাধু ভাষার” গুরুগম্ভীর রূপ)

“একটিবার মাত্র মহেশ মুখ তুলিবার চেষ্টা করিল, তাহার পরেই তাহার অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণদেহ ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল। চোখের কোণ বাহিয়া কয়েক বিন্দু অশ্রু ও কান বাহিয়া ফোঁটা –কয়েক রক্ত গড়াইয়া পড়িল।”: - মহেশ/শরৎচন্দ্র (সাধু ভাষার লঘু রূপ)


ইয়োরোপ বা আমেরিকায় কিন্তু বানান নিয়ে বেশ গবেষণা চলছে।কারণ, তাদের বর্ণমালার সীমাবদ্ধতা! যাই হোক, “শেষ করি George Bernard Shaw এর একটা গল্প দিয়ে।
ইংরেজি ভাষায় বানান বৈচিত্র্যের প্রমাণ প্রদর্শন করতে গিয়ে George Bernard Shaw একবার লিখলেন “Ghoti”, উপস্থিত সকলে এটাকে উচ্চারণ করলেন ‘ঘটি’। কিন্ত Bernard Shaw বললেন, “না, আমি লিখেছি ‘Fish’. তারপর তিনি বাতলে দিলেন – ‘Laugh’ শব্দের বানানে ‘gh’এর উচ্চারণ হচ্ছে ‘এফ’।‘Women’ শব্দের বানানে ‘o’এর উচ্চারণ হচ্ছে ‘আই’। আর ‘Nation’শব্দের বানানে ‘ti’এর উচ্চারণ হচ্ছে ‘শ’।অতএব Ghoti শব্দটির উচ্চারণ হচ্ছে ‘Fish’। উপস্থিত সকলে একেবারে থ বনে গেলেন।” ( পাঠক, আপনি, এবার নিজেই ভেবে নিন, কি বানান লিখবেন। বিদেশের উদাহরণ, না দিলে; আমরা আবার বিশেষ পাত্তা টাত্তা দেই না কিনা!)

কিন্তু, আমাদের গর্ব, আমাদের বর্ণমালা। সম্পূর্ণ, বিজ্ঞান সম্মত ভাবে তৈরী। যেটুকু, খামতি ছিল, তা, অনেক পরীক্ষা নীরীক্ষা করে, ওই মণীষীরা পূরণ করেছেন।

প্রশ্ন, উঠতেই পারে, Post Modern যুগে এসব সতীত্বপনা বাহুল্য।
সবিনয়ে, তাঁদের জানাই; এই যে তথাকথিত বাহিংলেশের প্রবর্তন ঘটেছে, এটা যদি Post Modern যুগের কবিতা, গল্পে( অণু-পরমাণু) ব্যাবহার হয়, কেমন হবে?

থ্যঋণ:- ইন্টারনেট, সুকুমার সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়!‍

(ক্রমশ...)

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি
খামচানো কালপৃষ্ঠা

শ্যাল আই ?

মালিশ কথাটা শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় 'প্যায়াসা' ফিল্মে জনি ওয়াকারের অভিনয় ও মোহম্মদ রফির গান, 'সর যো তেরা চকরায়ে' । ছোটো শহরগুলোয় এখনও মালিশওয়ালাদের দেখতে পাওয়া যায়, হাতে তেলের শিশি নিয়ে 'চম্পি'র খদ্দেরের খোঁজে । কলকাতায় ময়দানেও দেখেছি বছর দশেক আগে ; এখনও আছে কিনা জানি না । এই জনিওয়াকারি মালিশ সনাতন ভারতের নাকি আরবদেশ থেকে এসেছিল ? বোধহয় সনাতন ভারতেরই আরামখোরদের আবিষ্কার । কেননা জনিওয়াকারি মালিশ তো তেল ছাড়া হবে না । কেরালাতেও আজকাল আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজ করাতে বিদেশ থেকে ট্যুরিস্টরা আসেন । তাতেও তেল লাগে । হয়ত আদি শঙ্করাচার্য এত বেশি হাঁটাচলা করতেন যে তিনিই তেল-মালিশ ব্যাপারটার জন্মদাতা । তবে মালিশ আর ম্যাসাজ শব্দ দুটি একই ধরণের কাজ বা কুকাজের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে দেখে মনে হল যে ম্যাসাজ প্রক্রিয়াটার অন্য নাম থাকা দরকার ছিল । ভারতের উত্তরউদারনীতি আক্রান্ত শহরগুলোয় স্পা দেখা দিয়েছে , যেখানে নানারকম আরাম বিক্রি করা হয় নারী বা পুরুষ শরীরের জন্যে । এয়ারপোর্টগুলোয় দেখেছি পা টেপানোর স্পা রয়েছে, যাত্রীরা এদেশ-সেদেশ করার ফাঁকে পা টিপিয়ে নেন । ওগুলো হল পাশ্চাত্য কায়দার 'স্কুপিং' পদ্ধতির ডলারি মালিশ , যত আড়ম্বর তত আরামদায়ক সেবা পাওয়া যায় না ।


যুবক কবি-লেখকরা যদি বিদেশে যেতে চান, বিদেশে যেতে হলে, আমার মনে হয়, কম বয়সেই যাওয়া ভালো । আরও ভালো অবিবাহিত থাকার সময়ে যাওয়া । কেননা যত পারা যায় অভিজ্ঞতা এই সময়েই যোগাড় করে নিলে তা পরে ম্যাজিক-বাস্তব জগত গড়তে কাজে দেবে । যুবাবস্হায় আমার পকেটে খুচরোও থাকত না ; রোজগেরে হবার পর বিদেশগুলোয় যখন গেছি তখন, মগজ চাঙ্গা থাকলেও, মাংসের তাপ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । অত হাঁটতে পারি না ; সিঁড়ি চড়তে পারি না ; সবরকম মাংস খেয়ে হজম করতে পারি না ; পেগের পর পেগ মদ, জাগের পর জাগ বিয়ার খেতে পারি না ; ইচ্ছানুযায়ী মাদকসেবন করতে পারি না । আর নারীসঙ্গের কথা তো বাদই দিতে হয় ।

ম্যাসাজের প্রসঙ্গ এলে থাইল্যান্ডের 'নুয়াড বো রান' পদ্ধতির কথা বলতেই হবে । থাইল্যাণ্ডের ম্যাসাজ একটি প্রধান রোজগারস্রোত হয়ে উঠেছে সে-দেশটায় । ম্যাসাজ শেখাবার সংস্হা আছে, বিশেষজ্ঞ আছেন । আমেরিকানরা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমোদ-প্রমোদের জন্যে আশেপাশের দেশে যাওয়া আরম্ভ করলে থাইল্যান্ডের পাট্টায়ায় নারীসঙ্গ, ম্যাসাজ আর ভোজন তাদের কাছে ডলার খরচের প্রয়োজনীয় ভোগপথ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । পাট্টায়া ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় গো-গো বার গজিয়ে ওঠে । গো-গো বারে গিয়ে কোনও তরুণীকে পছন্দ হলে তাকে সেই রাতের জন্য বা বহু রাতের জন্য সঙ্গিনী করে নেয়া যায়, বার-মালিককে তরুণীটির অনুপস্হিতির জরিমানা দিয়ে । পাট্টায়া, ব্যাংকক ইত্যাদি শহরের হট জোনে কাঁচের দেয়ালের ওপাশে কেবল থং-পরা কচি-কচি তরুণীরা দাঁড়িয়ে থাকেন, রাতপ্রেমিকদের ডাকের আশায় । স্বাভাবিক যে থং পরে দাঁড়িয়ে যখন খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে তখন তারা তো কেবল ম্যাসাজ করবে না, আরও অনেককিছু করবে ।
তার আগেও থাইল্যাণ্ডে পেশা হিসাবে মালিশ ব্যাপারটা থাকলেও, তার তেমন করকরে বাজার ছিল না । মালিশ থাইল্যাণ্ডে গিয়েছিল বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে । বৌদ্ধভিক্ষুদের পরিব্রজনে ক্লান্ত পা দুটিকে আবার চাঙ্গা করে তোলার জন্য ভারতেই আবির্ভাব হয়েছিল এই মালিশের, অর্থে এখন যাকে বলা হচ্ছে থাই মালিশ পদ্ধতি । গৌতম বুদ্ধের শিষ্য ও চিকিৎসক শিভাগা কোমারপাজ ( জীবক কুমারভট্ট ) হলেন থাই ম্যাসাজপদ্ধতিত জনক । ব্যাংককের ওয়াট ফো মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা আছে দেহের কোন-কোন জায়গায় হাত, কনুই, বাহু আর পা দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে । বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের বদলে ম্যাসাজ করেন থাই তরুণীরা ; অবশ্য তাঁরাও বৌদ্ধ । থাই ম্যাসাজ পদ্ধতিতে বিন্দু-নির্ভর চাপ, অ্যাকুপ্রেশার, পেশি-প্রসারণ আর সংকুচন করা হয় , তালে-তালে , হালকা সঙ্গীতের আবহে ।

থাইল্যান্ডে যখন এসেছি তখন থাই ম্যাসাজ না করিয়ে তো আর ফেরত যাওয়া যায় না, বিশেষ করে যখন শুনলুম যে আরথ্রাইটিস, বায়ুদোষ, মাইগ্রেন, পিঠব্যথা ইত্যাদি সারাবার-কমাবার জন্য অব্যর্থ । একবার ম্যাসাজ করালে দেহে ছয় মাস টানা এনার্জি থাকবে ! আমাদের দেশের মালিশের মতন সস্তা নয় কিন্তু থাই ম্যাসাজ । আমি দুই ঘণ্টার জন্য খরচ করেছিলুম দেড় হাজার টাকা ; এখন শুনি আরও বেশি দিতে হয় । প্রায়ান্ধকার সারি-সারি শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘর ; মাটিতে শাদা ধবধবে বিছানা পাতা । প্যান্ট ছেড়ে শাদা লুঙ্গি পরতে হল ; শার্ট ছেড়ে ঢোলা বুশশার্ট । কাকে দিয়ে ম্যাসাজ করাতে চাই তা বেছে নেয়া যায় ; তার কারণ , মানসিক আনন্দও চাই তো ! ম্যাসাজ আরম্ভ হল । যেমন যেমন নির্দেশ পাচ্ছিলুম, সেইমতো একবার উপুড় একবার এপাশ একবার ওপাশ করে-করে চলল ম্যাসাজ । বেশ আরামদায়ক , কোনো সন্দেহ নেই । পায়ের পাতা থেকে একজন তরুণীর দুটি হাত একটু-একটু করে ওপর দিকে উড়তে লাগল, বহুক্ষণ ধরে । ঘুমিয়েই পড়েছিলুম বলা যায় ।
হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে গেল । আমার কুঁচকির কাছে অর্ধচন্দ্রাকারে হাত দুটি এনে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, "শ্যাল আই?"

ধারাবাহিক মৃৎ-সাহিত্য - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার


.
ভাল ভাল গান শুনে বড় হয়েছি আমি ।আচ্ছা গানের সঙ্গে কি লজ্জাবতী লতার কোন সম্পর্ক রয়েছে। আসলে আমার সবসময়ই মনে হয় গান খুব লাজুক হয় । গানের শব্দে আমি কতিপয় পাখিকে উড়ে যেতে দেখেছিলাম ।আবার কিছু পাখিকে ডালে ডালে ফিরে আসতেও। ফাঁকা রাস্তায় মানুষ খুব খোলা মনে গান গায় এবং তা ভুল সুরে ।আমি সাধারণত বাথরুমকে গানঘর বানিয়ে নিই। অগ্রজদের কাছে কলের গানের কথা ঢের শুনি । যুগপৎ বিস্মিত ও নষ্টালজিক হই। অথবা হতে বাধ্য হই ।গানে গানে বোধ করি ভরে উঠেছিল সত্তর দশক । তবে বুঝি বন্দুকের নলের মতই গানও অনিবার্যভাবে শক্তির উৎস হয়ে উঠতে পারে । পাপী ও পাগলেরা গান শুনে আমি দেখেছি এবং আমি নিশ্চিত হিমশীতল নদীগুলি পিপাসার্ত মানুষের মতো কেবল গানের জন্য প্রবাহিত হয় । মানে বয়ে চলে । অথচ কবিদের বিবাহ দিনে গান বাজে । একসময় নাকি বোকাসোকা বিপ্লবীরা গান গাইতে গাইতে ফাঁসিকাঠে চড়তেন । তবে এ নিয়ে বিচলিত হবার কিছু নাই । কেননা দীর্ঘকাল গান বিষয়ে আমি আর ভাববো না । আমার কবিতাতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে কখনো গান আসেনি । আসবার কোন সম্ভাবনাও নেই । তবে যদি কখনো খুব ইচ্ছা করে তবে বান্ধবীদের গান শুনে নিশ্চই আমি খুব আলতো ভাবে তাদের উজ্জল কাঁধে হাত রাখতেই পারি । গানের ভিতর কখনো কখনো বনভোজনের দুপুর এসে ঢোকে । সেই সব দুপুরে সেজে ওঠে থরে থরে মেঘে । আর মেঘের চোখের কাজল । আবার দীঘার ঝাউবন, শিলং পাহাড়ের পাইনবাগান বা কোচবিহার হাসপাতালের মর্গেও সীমানায় বারংবার আছড়ে পড়তেই পারে গানবাজনা, গান ঢেউ এবং এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই জীবনানন্দ গান ভালবাসতেন, তাই তিনি সারাজীবন কষ্ট পেয়েছেন।

১০. আমি সারাজীবন বহু দোলনা দেখেছি, দেখবোও। আমার মেমরী ব্যাঙ্কে কতিপয় পাগল থাকবেন যারা মধ্যসেতুতে সাঁকো ঝাকায়। আর তারা একাজ করে বলেই আমরা হয়তো লিখতে পারি সাঁকো ও শালবন। আবার থালা বাসনের কথাও তো ভাবি। মাটির কলস আমাকে টান টান উত্তেজনায় রাখে। লোকদেবতার থানে বেড়াতে যাই। অথচ, বরাবরই আমাকে টেনেছে অপদেবতারা। যেমন আমাদের মাশানঠাকুর। অন্ধকার রাতের এই আদিম পুজো আমার জীবন টলিয়ে দিয়েছে। তাই নাচগানের আসর থেকে ঘুরে এসে আমি বালিতে মুখ ঘষি । অজগরের মতো ঘুমিয়ে পড়ি। অথচ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে যায় যখন বোবায় ধরে । কিছু করার থাকে না । শূণ্য রুমাল নাড়াই । বিষন্ন হবার আগে আমাদের গলা লম্বা হয়ে যায় । কিন্তু দ্রতগামী অশ্বের লেজ ধরে ঝুলে থাকবার দিনগুলি যে পেরিয়ে এসেছি । তাই সন্ধ্যেবেলায় টেলিফোন বেশ বিগলিত থাকে । বড় বেশী মধ্যবিত্ত হয়ে যাই । মধ্যবিত্তরা বোধ করি নিরাপত্তার অগ্নিকুন্ডলীর বাইরে বেরিয়ে জীবনের গল্পে ভাসাতে পারবেন না । তাই কবিতার লিখার জীবন সুগন্ধের পিঁড়ি পেতে বসে । শ্বেত চন্দনমাখা রুমাল হয়ে পতপত ওরে।
অনিবার্যভাবেই আমরা মাঝে মাঝে তাই পাহাড়ে বেড়াতে যাই । পাহারের আশে পাশে প্রাচীন গুহা ,বিজ্ঞাপনের টুপি ওড়ে । ছায়া খুবই অর্থবহ; তবু্ও সংকেত টেনে আনে অধুনালুপ্ত ব্রতকথা। উপাখ্যান । এই জনপদে ঘুরে ফিরে ভোরবেলা আসে । রাস্তাগুলি নদী হয়ে যায় সব । প্রিয় শব্দেরা দলা পাকানো কুয়াশার অনুবাদে মুখর । শান্ত শব্দেরা ঢেউয়ের ডাকে পুনশ্চ চঞ্চল । উদ্বেল। বেশ তবে শিখিয়ে দাও কিভাবে উদ্বেল হতে হয় । কিভাবে রাত পাখিটির সাথে একা একা শূণ্যতাযাপন ! 

শিল্পকলায় নারী চেতনা - অমিত বিশ্বাস

শিল্পকলায় নারী চেতনা - ২

অমিত বিশ্বাস

ভারতের আধুনিক শিল্পকলা ইতিহাসে দুইজন নারী শিল্পীর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে নেওয়া হয় যারা পরবর্তীকালের শিল্পীদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। প্রথমজন হলেন সুনয়না দেবী (১৮৭৫) আর দ্বিতীয়জন অমৃতা শেরগিল (১৯১৩)। এনাদের মধ্যে কে সর্বপ্রথম আধুনিকতা বয়ে নিয়ে এসেছেন তা নিয়ে দুটি শিবির বিভক্ত হয়েছে এবং বিস্তর বাকযুদ্ধ চলছে। বড়-ছোট প্রমাণের দায় আমাদের নেই, সম্ভবত কালে'রও নেই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মেয়ে সুনয়না দেবীর ছবিতে তাঁর আশেপাশের মানুষজন উঠে এসেছে কখনও পৌরাণিক চরিত্রের রূপ ধরে, কখনো বা স্ব-চরিত্রে। ব্যক্তিগত জীবনে সুনয়না দেবী দক্ষ হাতে সংসার সামলানো এবং বাহিরের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সব্জি-কোটা আর সব্জিওয়ালার সঙ্গে সওদা করার মধ্যবর্তী সময়ে উনি ছবি আকঁতেন। ফলে তাঁর ছবিতে মানুষজনের উপস্থিতি প্রবলতর অথচ মানসিকতা ঘরোয়া হওয়ার দরুন ছবির পশ্চাদপট প্রায় একরঙা অথবা অতিসরল। সুনয়না দেবীর ছবিকে লোকশিল্প ও কালিঘাটের পটের উত্তরসূরি বললে কিছুমাত্র ভুল হবে না। অপরদিকে অমৃতা শেরগিল জন্মসূত্রে শিখ পিতা ও হাংগেরিয়ান সংগীতজ্ঞ মায়ের গুণাবলী পেয়েছিলেন। তাঁর শিল্পশিক্ষা ফ্রান্সে হওয়ার দরুন সমসাময়িক জীবনযাত্রা সমৃদ্ধ ছবিগুলিতে পশ্চাদপটে নৈসর্গিক ব্যাপ্তি লক্ষনীয়। অমৃতা শেরগীলের ন্যুড ছবিগুলিও অসাধারণ। আধুনিক বিশ্বের শিল্পকলার সেরা লক্ষণগুলি তিনি সফলভাবে তাঁর ছবিতে প্রয়োগ করেছিলেন। সেই সঙ্গে মিলেছিল ভারতীয় দর্শনের নিঃশব্দ স্রোত। প্রায় সমসাময়িক দুই নারী দুইভাবে (অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী) রূপের সন্ধান করেছেন, সমালোচকদের ভাষায় 'অভিঘাত সৃষ্টি' করেছেন এবং একইভাবে আধুনিকতার সূচনা করে শিল্পকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই সময় আরও একজনের কথা বিশেষভাবে বলা যায়, তাঁর নাম গৌরি ভঞ্জ। আলপনার নির্যাসকে ক্যানভাসে, ম্যুরালে ছড়িয়ে দেওয়া তাঁর অন্যতম সফল প্রয়াস।

নারী শিল্পীদের শিল্পজীবনে দুটি প্রধান সমস্যা কমবেশি সবাইকে ভুগতে হয়। গৌরী ভঞ্জ অথবা সুনয়না দেবীও তার থেকে রেহাই পান নি। প্রথমটিকে বলা হয় 'মোনালিসা স্মাইল' , অপরটি হলো 'শিল্পী আত্মীয় জাতীয় সমস্যা'। ব্যবহারিক দিক থেকে দেখতে আলপনা, কাঁথা অথবা রুমাল ,শৃঙ্গারের (সাজসজ্জা) প্রয়োজনে মেয়েরা শিশুকাল থেকেই শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। বলা যায় ব্যবহারিক প্রয়োগে শিল্প মজ্জাগত। একটু বড় হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভিভাবকদের মত এদেশের বড়রা চান তাদের মেয়ে নাচে, গানে অথবা শিল্পকলায় পারদর্শিনী হোক। উদ্দেশ্য ভালোপাত্রে কন্যাদান। এনারা স্বযত্নে এড়িয়ে যান ভাস্কর্য অথবা ছাপচিত্র বিভাগকে। আহা যদি স্কিন খারাপ হয়ে যায়!!! এই শেখার কোনো মানে থাকে না যেমন থাকে না শিল্পকলায় পাঠ নিতে আসা সেই শিক্ষার্থীর যে পরবর্তীকালে শিল্পীর বউ-কাম-সেক্রেটারী হয়ে ওঠে। ফলে তাদের সহজাত প্রতিভা যা পালিশে তীক্ষ্ণ হওয়ার কথা ছিল তা ক্রমশ ভোঁতা হতে হতে একেবারে মিশে যায়। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের সেরা ঘোষনা করা দেশ আমেরিকাতে যে চলচ্চিত্র সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম 'মোনালিসা স্মাইল'। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যাটি হলো শিল্পী-আত্মীয় হওয়ার সুবাদে নারীর শিল্পকর্মকে অনুগ্রহের চোখে দেখা। গৌরী ভঞ্জের সম্পর্কে লেখার শুরুতে চলে আসে পিতা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর নাম, পৃথকভাবে তাঁর শিল্পসত্তার বিচার করা হয় না। সুনয়না দেবীর ক্ষেত্রে বড়দাদা অবন-গগনের নাম আসে... বিচার করা হয় ওনারা কতটা প্রভাবিত এই সব মহান শিল্পীদের দ্বারা। শ্যামলী খাস্তগীরের মুখে শোনা একটি ঘটনার উল্লেখ করি এখানে। একসময় সোমনাথ হোর মহাশয় ভীষণ খাপ্পা হয়েছিলেন ভুঁইফোঁড় শিল্পরসিক-কাম-সংগ্রাহকদের উপর। রেবা হোর তাঁর শিল্পকর্মে অর্থাৎ ছবিতে ও টেরাকোটাতে একধরণের নির্যাসিত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেই কাজে তিনি সমাজচেতনা আর আত্মচেতনার এক সুদৃঢ মেলবন্ধন ঘটান। স্বামী সোমনাথ হোরের সঙ্গে তিনি একই বাড়িতে শিল্পকর্মে নিমগ্ন থাকতেন, স্বাভাবিক ভাবে পরস্পরের আলাপ-আলোচনা এবং আদান-প্রদান ঘটতো। সেই সব ভুঁইফোঁড় সংগ্রাহকরা বাজারদর হিসাবে শুধুমাত্র সোমনাথবাবুর কাজ দেখতেন। উনি তাদের মনে করিয়ে দিলেও তারা গুরুত্ব দিয়ে রেবা হোরের কাজ দেখতে উৎসাহবোধ করতেন না, কারণ অবশ্যই বাজার। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে উনি কাজ দেখানোই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আবার প্রখ্যাত ভাস্কর প্রদোষ দাশগুপ্ত ছাপা হরফে জানিয়েছেন ওনার স্ত্রী কমলা দাসগুপ্তের ভাস্কর্য 'আহামরি' কিছু নয় যদিও তারা শিল্পচর্চাকে ঘিরে পরস্পরের কাছে এসেছিলেন। একইভাবে ঘরে-বাহিরে যুদ্ধ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন আমিনা আহমেদ কর (ওয়াইফ অব চিন্তামনি কর!!!)। যার শিল্পকর্ম সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে "বাংলায় প্রথম মহিলা-শিল্পী যিনি সম্পূর্ণ বিমূর্ততাতে না গিয়েও আখ্যান-নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ চিত্র রচনা করতে পেরেছিলেন"। 


(ক্রমশঃ)

ভানুসিংহের পদাবলী - ইন্দ্রাণী সরকার

ভানুসিংহের পদাবলী
ইন্দ্রাণী সরকার

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ | রবীন্দ্রনাথ কৈশোর ও প্রথম যৌবনে "ভানুসিংহ" ছদ্মনামে বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে কিছু পদ রচনা করেছিলেন | ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলিই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয় | কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাগুলি রচনার ইতিহাস পরবর্তীকালে জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ভানুসিংহের কবিতা অধ্যায় বিবৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পদাবলী শব্দের অর্থ

পদাবলী শব্দের উৎস জয়দেবের ‘মধুরকোমলকান্তপদাবলী’। ‘পদসমুচ্চয়’ অর্থে পদাবলী শব্দের প্রয়োগ প্রথম পাওয়া যায় সপ্তম শতাব্দীতে, আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডী-র কাব্যাদর্শে। বাংলায় সুদীর্ঘ কাল ধরে পদাবলীকে যোগরূঢ় অর্থে গানের পর্যায়ভুক্ত করবার প্রচলন চলে আসছে। পদাবলী ভারতীয় গীতিকবিতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের মধ্যে অন্যতম। বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্তর্গত এই গীতিকবিতাগুলি রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৈষ্ণব মতের আধিপত্যের সময় সেই অঞ্চলের বৈষ্ণব পদকর্তারা মিথিলা অঞ্চলের লৌকিক ভাষা মৈথিলীতে বৈষ্ণব পদ রচনা শুরু করেন। পরবর্তী কালে মৈথিলীর সঙ্গে অন্যান্য লৌকিক ভাষার সংমিশ্রণে একটি কৃত্রিম সাহিত্য সৃষ্টির ভাষার উদ্ভব হয় যা ব্রজবুলি নামে পরিচিত। বৈষ্ণব পদাবলিতে প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য প্রভাবিত ছন্দের প্রাধান্য দেখা যায়, ভান বা ভানিতা অর্থাৎ পদের মধ্যে পদকর্তার নামের উল্লেখ বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রাচীন বৈষ্ণব কবিদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথ আনুমানিক ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সকালের মধ্যে ‘ভানুসিংহ’ এই ছদ্মনামে যে ২১ টি পদ রচনা করেন, তাই ভানুসিংহের পদাবলী নামে পরিচিত। আঙ্গিক ও সুর সংযোজনার বিচারে এই পদাবলী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সৃষ্টির এক অন্যতম বিশিষ্ট সম্পদ।

‘জীবন-স্মৃতি’ র ‘ঘরের পড়া’ পরিচ্ছেদে কবি জানিয়েছেন, অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পাদিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ সেই বয়সেই তার বিশেষ প্রিয় ছিল। ১২৮১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে এই পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে মাসে মাসে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, রামেশ্বর প্রমুখ প্রাচীন বৈষ্ণব কবির পদাবলী টীকা সহ প্রকাশিত হতে থাকে ১২৮৩ অবধি। কবি জানাচ্ছেন, বাড়ির গুরুজনেরা এগুলির গ্রাহক হলেও নিয়মিত পাঠক ছিলেন না বলে এগুলো জড়ো করে আনতে বালক কবিকে বেশি কষ্ট পেতে হত না। জ্যতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এই সংগ্রহের অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত খণ্ডগুলি আসত। গুরুজনদের পড়া হলে বালক কবি এগুলো সংগ্রহ করে নিতেন। বিদ্যাপতির দুর্বোধ্য বিকৃত মৈথিলী পদগুলি অস্পষ্ট বলেই বেশি করে কবির মনোযোগ টানত। কবি টীকার ওপর নির্ভর না করে নিজে বুঝবার চেষ্টা করতেন, বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ ও ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলি কবি তার বালক বুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য নোট করে রাখতেন একটা ছোট বাঁধানো খাতায়। এই খাতার নোট অবলম্বনে রচিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ, প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ – বিদ্যাপতি, প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ – উত্তর প্রত্যুত্তর, বিদ্যাপতির পরিশিষ্ট, প্রভৃতি ভারতী পত্রিকায় যথাক্রমে ১২৮৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ, ভাদ্র এবং কার্তিক সংখ্যায় পত্রস্থ হয়।

‘জীবন-স্মৃতি’ র ‘ভানুসিংহের কবিতা’ পরিচ্ছেদ থেকে জানা যায় প্রাচীন কাব্যসংগ্রহের মৈথিলীমিশ্রিত ভাষা বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে দুর্বোধ্য ছিল বলেই তিনি বিশেষ আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের সাথে তার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন।

সূচনা

রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের সূচনায় লেখেন:
অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে যাঁরা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তাঁরা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোম্বাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়াছি তখন আমার বয়স সতেরো। নূতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওযা যাক, তখন আমি চোদ্দয় পা দিয়েছি। খন্ড খন্ড পদাবলীর প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক্ থেকে যখন সেগুলি অন্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত। তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পরে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সাথে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি। প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তপুরের কোণের ঘরে––
গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না। এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।

রচনা

কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পাদিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ গ্রন্থের মধ্যযুগীয় মৈথিলি কবিতাগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জীবনস্মৃতি গ্রন্থে ভানুসিংহের প্রথম কবিতা রচনার যে ইতিহাসটি বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:
"একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম ‘গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম।" রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী উৎসর্গ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। উৎসর্গপত্র থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের নূতন বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাঁকে ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থ প্রকাশের পূর্ববর্তী বছরেই আত্মহত্যা করেছিলেন কাদম্বরী দেবী। পরবর্তীকালে ভানুসিংহের পদগুলিতে কবি প্রচুর সংশোধনী আনেন।

ভানুসিংহের পদাবলী

সূচীপত্র

১- বসন্ত আওল রে
২- শুন লো শুন লো বালিকা
৩- হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে
৪- শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর
৫- সজনি সজনি রাধিকা লো
৬- বঁধুয়া, হিয়া-পর আও রে
৭- শুন, সখি, বাজই বাঁশি
৮- গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে
৯- সতিমির রজনি, সচকিত সজনী
১০- বজাও রে মোহন বাঁশি
১১- আজু, সখি, মুহু মুহু
১২- শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে
১৩- বাদরবরখন, নীরদগরজন
১৪- সখি রে, পিরীত বুঝবে কে
১৫- হম, সখি, দারিদ নারী
১৬- মাধব না কহ আদরবাণী
১৭- সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব
১৮- বার বার, সখি, বারণ করনু
১৯- হম যব না রব, সজনী
২০- কো তুঁহু বোলবি মোয়
২১- মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান

ছোটোগল্প - বিপ্রতীব

ছোটোগল্প - দীর্ঘশ্বাস
বিপ্রতীব

১.

অঘ্রানের শীত শীত বাতাসে বড় দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সিগারেট। মোচড়ানো ভাঁজপড়া সিগারেটটিতে শেষবারের মত টানা কিছুক্ষণ ঘনঘন শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আন্তজ। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে বকুলকান্দি চরের দিকে। হঠাত্‍ কেউ দেখলে ভাববে হয়তো জরুরি কোনো কাজ আছে তার। এমন ভাবাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তজের ব্যাপারটা ভিন্ন। মাটির দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা আন্তজ মিয়ার শৈশবের অভ্যাস। সন্ধ্যা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে, বিকেলের অবশিষ্ট হলুদ আলোটুকু নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। সরু এবড়োথেবড়ো একটা পথ ধরে হাঁটছে আন্তজ। তার বামপাশে আদিগন্ত ধানের ক্ষেত, আর ডানপাশে বহু পুরোনো একটা মরা খাল, খালের ওপাড়ে গৃহস্থ বাড়িগুলোতে জ্বলে উঠছে সন্ধ্যাপ্রদীপ। সরু পথটা পেরিয়ে আন্তজ বড় রাস্তায় ওঠে। সামনে মাইল দেড়েক হেঁটে গেলেই হাতের বামদিকে ইটভাটার পর বকুলকান্দি চর। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন। কোমরের গাঁট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালালো সে। আচ্ছা, মর্জিনা এখন কেমন আছে, তার কি এখনো মনে আছে বিজন নদীর বুকে তিরতির কাঁপন তুলে যাওয়া সেই শুভ্র-সফেদ চাঁদ, হৃদয়ে উন্মাতাল জোয়ার তোলা অপূর্ব জোত্স্না ! মনে মনে ভাবে আন্তজ। নাকি ভুলেই গ্যাছে আরো পাঁচটা ভুলে যাওয়া ঘটনার মতন। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফ্যালে সে।

বেশ বড় নদী, তবে এখন বেশির ভাগটাই শুকনো, খটখটে বালুচর। গেল বার বর্ষায় এখানে জল প্রায় ত্রিশ চল্লিশ হাত পর্যন্ত গভীর ছিল, অথচ এখন হাঁটু জলের বেশি হবে না। চারিদিকে কেমন তীব্র অন্ধকার, মানুষজন নেই। অদূরে ঘনঝোপের ভেতর মাঝে মাঝে দু একটা শেয়ালের অলক্ষুণে আর্তনাদ শোনা যায়। ঘোর লাগা চোখে সন্তপর্ণে বালুচরে নেমে আসে আন্তজ। অনেক দিন পর এখানে আসা তার।
২.
"ইশ! কি কর!" মর্জিনার আগুনজ্বলা ঠোঁটে চুমু দিতে গেলে লজ্জায় মুখ সরিয়ে নেয় মর্জিনা। আন্তজ হেসে চাপা স্বরে বলে, "আমার সোনা বউটারে ইট্টু আদর সোহাগ করি।" মর্জিনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অভিমানী সুরে বলে, "বিয়াই তো করলা না এহনো, বাপে আমার বিয়া ঠিক কইরা ফালাইছে, ভাদ্দর মাসে রাশেদ শিকদারের আধপাগলা পোলাডার লগে বিয়া!" মর্জিনার কথা শুনে আন্তজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, দৃঢ় স্বরে বলে, "আত্মা এই দেহে যতদিন আছে মেম্বরের পোলার লগে তোমার বিয়া হইতে দিমুনা মর্জিনা, তুমি শুধু আমার, আমারেই বিয়া করবা।" আন্তজের রেগে ওঠা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে মর্জিনা। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, "হইছে হইছে, আর গঞ্জের সিনামার মতন ডাইলগ দেওন লাগবো না!" মজির্নার আরো একটু কাছে এসে বসে আন্তজ। চাপা স্বরে বলে, তোমারে বড়ো ভালোবাসি গো মর্জিনা, ছোডকালে মায় অসুখে মইরা গেল, বাপেও দেনার দায়ে ঘরের পিছে শ্যাওড়া গাছে ফাঁস দিয়া মরছে। দুনিয়ায় আমার আপন কেউ বলতে শুধু তুমিই, আমারে ছাইড়া কোনোদিন যাইয়ো না মর্জিনা। মর্জিনা চোখ ফেটে কান্না আসে, মানুষটার জন্য বড়ো মায়া হয় তার। সে শুধু নীরবে বলে, "এমুন কথা আর কোনদিন কইবা না আন্তজ, কে বলছে তোমার কেউ নাই, আমি কি তোমার কেউ না!" "তোমার জন্যেই তো অহনো বাঁইচা আছি মর্জিনা, তয় কবেই এই ভরা নদীর উজান স্রোতে ভাসাইয়া দিতাম দেহতরী!" মর্জিনার হাত দুটো শক্ত করে ধরে আন্তজ। ছলছল ভৈরবীছন্দে বয়ে চলা নদীটির তীর ঘেষে প্রায় সমান্তরাল দু'টি বাঁশের খুঁটিতে রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছোট্ট নৌকাটির ছইয়ের ভেতর বসে ছিল আন্তজ আর মর্জিনা। আকাশে দারুণ অপরূপ পূর্নিমাচাঁদ। জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় মর্জিনাকে দেখে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে আন্তজের। মর্জিনার ঠোঁটে মৃদু চুমু দেয় সে। মর্জিনাও এবার সাড়া দিতে থাকে। গাঢ় আলিঙ্গনে সে আন্তজকে জড়ায়ে ধরে। মর্জিনার সুডৌল স্তনজোড়া আন্তজের খোলা বুকের জমিনে ঠেকে যায়। শরীর জুড়ে যেন তুমুল তোলপাড় বয়ে যেতে থাকে আন্তজের। ধীরে ধীরে চন্দ্রমগ্ন দুটি দেহ এক হয়ে মিশে যেতে থাকে জোছনাস্নিগ্ধ ছইয়ের ভেতর!

৩.

নিঃস্তব্ধ অন্ধকারের ভেতর কোথায় যেন একটা ঝিঁঝিঁ পোকা রাত্রির আশ্চর্য নীরবতা উপেক্ষা করে বিরামহীন ডেকেই চলেছে। সামান্য দূরে ঝাঁকড়া বকুল গাছটির নিচে খানিকটা উঁচু হয়ে আছে মাটি, ভালো করে না দেখলে সহজেই বোঝা যায় না এর অবয়ব। ধীরে ধীরে সেখানে এগিয়ে যায় আন্তজ। হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত দিয়ে তুলতে থাকে ঝুরঝুরে মাটি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে বাড়তে থাকে তার হাতের গতি। একসময় পাগলের মত খামচাতে থাকে। হঠাত্‍ এক ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় আন্তজের আচরণে। নদীর কিনার ঘেঁষে পাগলের মত দুর্বোধ্য প্রলাপ বকতে বকতে ছুটতে থাকে সে। একসময় নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যায় .....
অন্ধকারাচ্ছন্ন বালুচরের বিব্রত বাতাসে একলা পড়ে থাকে আন্তজ মিয়ার
বুকচাপা একরাশ উলঙ্গ দীর্ঘশ্বাস ......

.. মর্জিনারে আমারে ছাইড়া আন্ধার কবরে উঠলি, উপরআলায় সহ্য করবো না ....

সহ্য হবো না উপরআলার ....

প্রসঙ্গ সুচিত্রা মিত্র- কল্পনা দাস


‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে’
কল্পনা দাস

কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্র । তাঁকে আমরা হারালাম(২০১১) যখন , একটা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল বলে মনে হয়। গানের শিল্পী হিসেবে ওনাকে সবাই চেনেন, কিন্তু উনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পীও ।

‘পথ আর বাকি নাইতো আমার
চলে এলাম একা –
তোমার সাথে কই গো হলো দেখা
কুয়াশাতে ঘন আকাশ , ম্লান শীতের ক্ষণে
ফুল ছড়াবার বাতাস বেড়ায় কাঁপন লাগা বনে’

এই আবৃত্তি video তে শুনছিলাম সুচিত্রা মিত্রর কণ্ঠে , অপূর্ব ! তার শিল্পী সত্তার আর একটা পরিচয় ।

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দশ ক্লাসের ছোটো মেয়ে শান্তিনিকেতনে গান নিয়ে পড়তে চাইল। বাবা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের অতি পরিচিত ,তিনি নিজেও ছিলেন একজন মান্য সাহিত্যিক । মা সুবর্ণলতা দেবীর কণ্ঠে রবী ঠাকুরের গান শুনে তখন থেকেই

রবীন্দ্রনাথের কথা-সুরের সঙ্গে পরিচয় । বিশ্বভারতীতে পড়তে চাওয়ার অভিলাষ অবিভাবকেরা খুশি মনেই সম্মতি দেন ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কুড়িদিন পর, Aug. মাসে, এক আকাশ বৃষ্টি নিয়ে বিষণ্ণ মনে বিষণ্ণ বিমর্ষ শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছলেন সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় । এই দিনটি তাঁর কাছে দ্বিতীয় জন্ম । তাঁর জীবনে অন্যরকম ছোঁয়াচ লাগলো । রবীন্দ্র সঙ্গীতের চিরন্তন রূপটি ফুটে ওঠে তাঁর ঐশ্বর্য ময় কণ্ঠে।

সুচিত্রা মিত্রর গলায় বহু রবীন্দ্র সংগীত শুনেছি , কিছু গান যেন তাঁর কণ্ঠে শোনার জন্যই রচিত হয়েছে । তিনি বলতেন “ গানকে আমি চোখের সামনে ভাসতে দেখি”... তাই তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে শুনি –‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, তিনি গলা ছেড়ে গান করতেন । “ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/ মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে ,কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’’। তিনি দেখেন কৃষ্ণকলি মেয়েটি কী ভাবে মাঠের মাঝে দাঁড়ায় , আকাশ ঘিরে কালো কাজল মেঘ ঘনিয়ে ওঠে তমাল বনের শিয়রে, সেই ছবি তিনি দেখতে পান । তাঁর অনুভবের কাথা ব্যক্ত করেন রবীন্দ্র গানে । সুচিত্রা মিত্র সংগীতের সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন , এমনকি যখন গান করছেন তখন তো বটেই , যখন করছেন না তখনও । তিনি গান পড়তেন , সেটাই ছিল তাঁর কাছে রেওয়াজ। YouTube –র দৌলতে আমরা বহু গান-ই শুনতে পাচ্ছি , তার গলায় কত কত গানের কথা বলব জানিনা ......জর্জ দার সাথে, ‘তুমি খুশি থাকো’- মোহর দির সাথে, ‘আজি আনন্দ সন্ধ্যা’- এ ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘হৃদয়ের একূল ওকূল’। আর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ ,...এই গান উস্তাদ আমজাদ আলি (সরোদ) , সুচিত্রা মিত্রর গলা মিলে এক অসাধারন সংগীত মূর্ছনা-র সৃষ্টি করেছে ।

কবিগুরু তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের অনেক গানে বাউল সুর ব্যবহার করেছেন । এই সুরের মধ্যে দিয়েই প্রানের উদ্দিপনা , উৎসাহ আশ্বাস ফুটিয়ে তুলেছেন । ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘এবার তোর মরা গাঙ্গে’ , ‘ ও আমার দেশের মাটি’, --------এই গান গুলো সুচিত্রা মিত্রর গায়কীতেই আমার মনে গেঁথে রয়েছে , কতটা আকুল হয়ে তিনি গান করতেন । তাছাড়া গানের মাধ্যমে নিজকে প্রকাশ করার একটা আলাদা আনন্দতো আছেই, সেই আনন্দ থেকেই উঠে আসে আরও আনেক কিছু। গানের পাশাপাশি ওঁর নিজের লেখা কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ –র মধ্য দিয়েই তাঁর শিল্পী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর ঘর সাজানো , কুটনো কোটা , রান্না সব-ই কী নিখুঁত । একা থাকতেন তিনি, কোন সেক্রেটারী ছিলনা , দীর্ঘ দিন এমনকি কোন কাজের লোকও রাখেননি । ওঁর আদর্শ ছিল নিজের কাজ নিজে করা । ১৯৯৩ সালে খ্যাতির শীর্ষে থাকার সময়ও প্রত্যেক টা ফোন নিজে ধরতেন, কেউ দরজায় বেল বাজালে, নিজেই দরজা খুলে দিতেন। অতিথিকে নিজের হাতে সেবা করাই ছিল তাঁর পছন্দ ।

পরিপূর্ণ শিল্পী সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে আরও কিছু না বললেই নয়, অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন, নতুন করে বলার কিছু নেই, IPTA –র নাটকে উৎপল দত্ত –র সঙ্গে কাজ করেছেন, অভিনয় করেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’ ছবিতে ইন্দ্রাণী হালদারের ঠাকুমার ভুমিকায়। IPTA-র বিখ্যাত ‘ও আলোর পথ যাত্রী’ – সলিল চৌধুরী –র ঘুম ভাঙ্গাবার গান,দেবব্রত বিশ্বাস , সুচিত্রা মিত্র , দ্বিজেন মুখার্জি এঁদের গলায় শুনি আর শিহরণ জাগায় মনে ।

আমার নিজের মনে হয় কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্র প্রমান করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষার , সংস্কৃতির , জাতির আপন বোধকে একক ভাবে তৈরি করেছেন , বদলেছেন, আধুনিক করেছেন । বিশ্ব সেই বোধে অনুপ্রাণিত হয়েছে । আমাদের বিশ্বাসে , নিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ , তাঁর গান............... “ তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মন প্রানে,

সে আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে...............”

কবিতা - পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত

লাফিয়ে উঠলো আকাশ
পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত



মাধুরীলতার কুসুমিত রং আমাকে ক্ল্যাসিক ভালোবাসা দাও
আমি বিদিশার আধুনিকতায় আকাশের নীলে নিখুঁত মিশবো
এক-এক-ঝাঁপটা বৃষ্টি মাখবো মুখের অ্যাপেলে অন্তহীন
উল্কিতে রঙ বাউদিয়া রূপ কার্পেটে মোড়া নতুন পৃথিবী
ফসল তুলবো আকাশের গা্য গুলাব-জামুন চার পেগ হাসি
ফসল তুলবো ভ্যানিলা-আইস লেমন-জুসের সাবেকিয়ানায়
সসপ্যান থেকে সসপ্যানে রং চিনির কিউবে নাট্যরস
তরবারি হাতে যুবক এসেছে মেহগিনি রঙ যুবক এসেছে
শুনতে পেলেন মোহনবাঁশিটি আনন্দরূপ যুবক এসেছে


পাহাড়চুড়োয় লাফিয়ে উঠলো আকাশ এই ছবি শুধু আমিই দেখেছি
অচেতনের আবডালে দৃষ্টি বিনিময়ের উচাটন
ওখান থেকে মাত্র এক কিলোমিটার স্বপ্ন
সন্ধ্যে নামার আগে সামনের বাগানে আগলে রাখলাম উদ্বেগ
এর পরই সোনালি স্বাধীন ঝড়ো পাখির গান আমি শুনলাম
সূর্যাস্তের জীবন ঘোলাটে আয়নার মতো
এর মধ্যেই আমার খয়েরি নেট-ওয়ার্ক বরোদা থিরুঅনন্তপুরম
স্রেফ যেন প্যারিসের যুবক আমি
সদ্য ফোঁটা ফুল গোলাপি ইউরোপ
আমার ক্যামেরায় ক্লিক-ক্লিক শব্দ হয়না থ্রিডির স্ট্রবেরি
সে ছবি তোলে ক্লিপ-লিপস্টিক,সি-বিচ মোহভঙ্গের কাউন্সেলিং ,ছবি তোলে
অর্থপূর্ণ হাসি, সাদা পায়রা, ছিন্নভিন্ন জোনাকি
এরা আমার চিঠির বাক্স নাট্যশালার গান আইপড,
যেন সে একটি ফুলের দোকান ইচ্ছে মতো নকশা কাটে
যেন সে তরবারি কষ্টিপাথরে লাভমেসিন
হঠাৎ ঢুকে পড়লো ফ্যান্টাসির চোরচুন্নি, ঝাঁপিয়ে পড়লো স্থিতপ্রজ্ঞার আলো,
আমি নীরবতার স্রোত জাপটে ধরি আর তখুনি দেখতে পাই
খাঁচার পাখি ঝুমবরাবর ক্ষিদের জ্বালায় মরে,
লাফিয়ে উঠলো ইমোশনাল আকাশ, আমার নতুন প্রেম
বুকের ওপর গড়ে উঠলো বেখেয়াল টেবল-টেনিস,
অ্যাটলিস্ট সঠিক সমস্যার কথা বলো-
নিজের ফিলিংস


দু’টুকরো অবসাদের রজনী তোমাকেও সুর মেলাতে হবে
নিরিখে নিরিখে জীবন নিরিখে নিরিখে ডার্করুম
ও আমার পাগল প্রত্যাশা, বিষয়ব্যাঞ্জনার স্কুল,
এক অধরা স্বপ্নের পিছে পিছে ঘুরপাক , চিঠিতে অবশ্য এ কথা ছিলো না,
চিঠির দাহ্য ঝলকে ঝলকে মিশে গিয়েছিলো সুপারসনিক,
রিচুয়া্ল, তবু সন্ধেবেলায় একটি চুমুর তোলপাড় যেন হারিয়ে না যায়-
যেন হারিয়ে না যায় মেট্রোস্টেশন, ভিড় ঠেলে ঠেলে টার্মিনাল..
যেন তন্দ্রা-রঙের বাথটাব এলো পাপড়ি জড়ানো অধরা মানুষ
স্বপ্ন ভেঙে না যাবার গান গাইতে গাইতে এলো
রূপকথার চারটে সাদা মায়াপরি


মাধুরীলতার কুসুমিত রং আমাকে ক্ল্যাসিক ভালোবাসা দাও
আমি বিদিশার অঙ্গন ছুঁয়ে আকাশের নীলে নিখুঁত মিশবো
এক-এক-ঝাঁপটা বৃষ্টি মাখবো মুখের অ্যাপেলে ইন্টিরিয়র
উল্কিতে রঙ বাউদিয়া রূপ কার্পেটে মোড়া নতুন পৃথিবী
ফসল তুলবো আকাশের গা্য গুলাব-জামুন চার পেগ হাসি
ফসল তুলবো ভ্যানিলা আইস লেমন জুসের সাবেকিয়ানায়


কীভাবে অতিক্রম করি এই পরিচয়, জীবনের রঙ ।
পৃথিবী উত্তেজনার দশদিক স্কিজোফ্রেনিয়ার সাইকেল ছুটছে আকাশের গায়
জীবনের আরও একটা রঙ এক দিগন্ত ক্লাইম্যাক্স আমি উপরের প্রহরায়
অ্যানিমেশনের পাগল তোমার টুপিতে বাজপাখি
আমি ছড়িয়ে পড়লাম তোমার মিউজিয়ামে
অ্যান্টিক স্রেফ অ্যান্টিক নাকি সম্রাট স্বপ্নের হলিউড না আমি সিনেমার ওয়েস্টকোট
আলো জ্বলে উঠলো, ক্যামেরা প্রস্তুত , বিস্তীর্ণ বিলাস ,
যুবতী মনের আমিই তো সম্রাট বসন্তের প্রিন্স আদ্যন্ত দানাহীন আঙুর


এক পাত্র মদের সামনে এক ইঞ্চি আপেল আর আমার ঈগলচিহ্নিত ঢাল
কৌশলের উপর ষোলো আনা জাদুর রাজনীতি ,নৈশ কফির ছিমছাম স্ক্রিন
আমি বিদিশার আঙুল আমি বিদিশার মেকআপ ব্ল্যাকটপ বিকেলের ফুচকা
রঙে ঢঙে তাকে সাজিয়ে তুললাম ইমাজিন , মেটালিক , মার্বেল-ফিনিশ
ও আমার ইলিউশনের ইলিউশন লুকিয়ে কথা লাগামছাড়া ত্বকের সঙ্গে
ও আমার তুখোর বাতাস ঝকঝকে মার্কেট কর্পোরেট ডিজাইন
কঠিন সাফল্যের আর্ট ,আমি মিশে যাই ঝোলানো রূপকথার আঁচে
নেমে পড়লাম এক গামলা ফলের রসে ,পিয়ানোঅ্যাকর্ডিয়ান বেজে উঠলো
বিদিশা আমার বিদিশা আমার ভারাক্রান্ত প্রেমিকা , চেক-ইন করবে কি আজ


আমার হিসেবের মধ্যেই ছিলো মেলে ধরলাম ফ্রুটজুস
শরীরের কাউন্টারে খুলে দিলাম নতুন রেস্তোরাঁ
গ্যালারির চারপাশে বাগিচায় রেখে আসলাম পাখির ডেকোরেশন
লিলি আমার প্রথম প্রেমিকা গান গাইতো ক্রিসেন্থিমাম
গোলাপি জল ছিটিয়ে বলতো ,’এই আমার প্যারিস এই আমার শ্যাম্পেন’
আমি বিদিশার ঘরোয়া আড্ডায় নতুন সেলিব্রিটি , ও আমাকে ইচ্ছেমতো
হিম-ভোদকার সঙ্গে মিশিয়ে দিলো মোক্ষম স্কিজোফ্রেনিয়া
আমি উত্তেজনার কমপ্লিট বিড়বিড় আমি আধবোজা প্রেশারকুকার
আমি প্রিন্টআউট কবিতার কপি
বার বার ভেঙে যাচ্ছি আমি
সসপ্যান থেকে সসপ্যানে রস চিনির কিউব


এমন কি চাপা গলায় যেন আমি ডিপ্রেসড ,কিছুতেই ইন্টারফেয়ার করিনা
তবু হায় আল্লা, পুরনো ভালোবাসার সেই তো আকাশভাঙা বৃষ্টি
শাল-বাগানের নীচে তোমার নতুন আকুতি বিদিশা নিখুঁত
আমি কথার ঢঙে নতুন সেলিব্রিটি কী বলবো আবেগে আপ্লুত
চিকচিক করছে আমার রোমাঞ্চ ডিসিশন নিতে পারছিনা লিলি না বিদিশা
নাকি সদ্য যুবতীর নামমাত্র প্রেম
আমার ফিটনেস প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় সেখানে
একদিন এক দুপুর-বিতানে দেখা হলো সানন্দার সাথে
ম্যাগাজিনের সব ক’টা কবিতার রাখিপূর্ণিমা চিংড়ির মালাইকারি
আমি আহ্লাদে নতুন বয়ফ্রেন্ড ,জীবনের স্রোত আমাকে মিলিয়ে দাও ইভিনিং-প্যারিস


প্রেমে পড়ুন
এই এক চিলতে জীবনের সঙ্গে
এই এক প্যারিস বান্ধব
এই এক নতুন ময়েশ্চারাইজার ওয়াটারমেলন
এই তো আপনারই গার্ডেন ফ্লাওয়ার
প্রেমে পড়ুন

১০
আমি ফিরে যাই কল্পনার কাছে
আমি ফিরে যাই স্বপ্নার লিভ-টুগেদারে
আমি আমার দাম্পত্য রেখে আসি চল্লিশ বছর আগের অ্যাবসোলিউট
ফ্রিডমের কাছে ,আমি কী গালিব নই গজলের গ্ল্যামার নই আমি পাখি
ইউনিক বিন্দাস আমার কবিতা

১১
তোমাদের সামনে আমি তুলে রাখলাম আমার এই বাহানাগুলো
বাহানা অথবা এ আমার অ্যাকটিংও হতে পারে
আমি এক্কেবারে না-পসন্দ কথাগুলো কিছুতেই বলতে পারিনা
ও আমার সানন্দা একদিন আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলো এখন নিজেই আউট
ও আমার রজনী,প্রেশ্যা্স,আমার কবিতায় হাসিখুশি টিপস, এখন রুপোর কয়েন
প্রচুর ভালবাসার অত্যাচারে আমি আর নিজেকে চিনতে পারছি না
আমি দু’হাজার মাইল রণপা নিয়েছি চার হাজার মাইল ব্যাক-স্ট্রোক
আমি কী গালিব নই আমি গজলের গ্ল্যামার নই ,আমি পাখি ইউনিক বিন্দাস..


এই সংখ্যার কবি - শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস

গুচ্ছ কবিতা - শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস

অভিমান


জলে নামতেই

তোমার ছায়া ছড়িয়ে পড়ল ....
বহু সাঁতরেও ধরতে পারিনি তাদের
...অথচ আমার ছায়ায়

নিজেকে


লুকিয়ে রাখো তুমি !

যতবার পিছন ফিরে
তোমাকে ধরতে গেছি
তুমিও পিছন ফিরেছ .......

বৃন্ত


নির্জন বৃন্তেই

লুকিয়ে রয়েছে কোলাহল ...
বৃন্ত ছুঁয়ে
স্থবির সেজে থাকা যায় না তাই...

জন্মদিন


আমার জন্মদিন

বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে ....
ধূ ধূ ক্যালেন্ডারে
এখন
ফরিঙ ধরতে আসে
অবলা কিশোরের দল

এই সংখ্যার কবি - ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

গুচ্ছ কবিতা - ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

রাইকে


রাই,

তীব্র আগুন দরকার।
পুড়ে অঙ্গার হওয়ার আগে
অন্তত একবার উজ্জ্বল সোনা হতে চাই। বিষ ঢাল বিষ।

মরে যেতে যেতে


অন্তত একবার চাই নীলকণ্ঠ রূপ।
ঐ মাতাল চোখে ধরো তীক্ষ্ণ কুঠার
ক্ষত বিক্ষত করে দাও বুক।।
প্রেমের ঐশ্বরিক মুহূর্তে পৌঁছনোর আগে
অন্তত একবার রক্ত মাংসের শরীর চাই।

কারা যায়


কারা পাড়া বেড়াতে যায়?

কারা যায় নদীর খোঁজে?
যখন এখনো তোমার ঘরের আগুন নেভেনি।
যখন এখনো দুয়ারে শ্মশান ভর্তি লোক ।
কারা চলে যায় এইভাবে?
কারা যেতে থাকে,
যখন এখনো থালার থেকে ভাত
আর ঘটির থেকে জল গড়িয়ে নামেনি।
চোখ আর অশ্রু; শরীর আর রক্ত দিয়ে
এইতো নিকনো ঘর।
এইসব থেকে যায়।থেকে যায় স্থির।
তারা চলে যেতে থাকে, তারা চলে যায়
নদীর ধারের থেকে কোনো অন্ধকার পাড়ার দিকে।

প্রলাপ


কি আর পড়বেন বলুন!

সব লেখা থাকে না চোখের সামনে।
কিছু চিঠি ফেলে আসা ডাকঘরে,
কিছু এস এম এস আঙ্গুল ছুঁয়ে
জলের ভেতর ঢুকে যায়।
অথচ দেখুন কি মুশকিল,
জলের রঙ হয় না,জলের রঙ হয় না!

প্রলাপ


এখনো কিছু ক্ষণ কথা বলে যাবো।

এখনো মদের গেলাস ফাঁকা হয়ে যায় নি।
জানো, ওরা বলে, কথা আর খবরের শেষ হয় না।
ওরা কি আমাদের খবর জানে?
এই মুছে যাওয়া, এই বিলকুল খতমের কথা?
এখনো... এখনো কিছু... এখনো কিছুটা...
বেশ ।ওরা যা বলে বলুক, তুমি এবার চোখ বন্ধ কর।
আমি আমার হৃদয় বন্ধ করে আসি।

রাতের কবিতা (গনিকার প্রেমিক)


তুমি পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল হবে বলে,

বারবার অমাবস্যার চৌকাঠ পেরিয়ে এসেছি।
খুলেছি বহুবার শরীর থেকে
সমস্ত অন্ধকার।
অদ্ভুত ঝোঁকে খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁজেছি
অপূর্ব জ্যোৎস্না।
সমস্ত চরাচর জুড়ে শিশির
ঝরা শেষ হয়ে গেলে,
কলঙ্কের মতো ঘুমিয়েছি ভিতরে-বাহিরে।

রাতের কবিতা


কবিতার রাত নামে,

ঐ রাতের আকাশে।
তরল সব আঁধার মিশে মিশে যায়
রাতের কবিতায়।
ঝরণার মতো খুলে খুলে পড়ে
টুপটাপ সব ছন্দ।
আদরে আদরে সোহাগি চাঁদ হাসে।
নিষিদ্ধ ভয় ঐ হোঁচটে, হোঁচটে।
তীব্রতা বাড়ে সব শরীরে, শরীরে।
সোহাগের গায়ে জমে ঘাম।
গরম সব ভালোবাসা
গলে জল হয়ে গেলে
আকাশের গায়ে শুয়ে থাকে
কিছু ঘন- জমাট রাতের কবিতা।

শারীরিক


চুমু খেতে শুরু করলে

তুমি চোখ খোলা রাখার কথা ভুলে যাও।
হয়তো মনে মনে দেখো
পিতার প্রশান্ত মুখ;
কৃষ্ণ ঠোঁট চুষে চুষে
সিক্ত হয় রক্ত যোনী।
আর আমার ব্যস্ত
আঙ্গুল খোঁজে
তীব্র মাতৃস্নেহ রস।

খাবার-১


আমাদের জানা নেই।

জানা নেই ,কিভাবে ভাত
বাড়তে বাড়তে, ওরা
অবলীলায় উঠে চলে
যায় কুয়াশার দিকে।
আমাদের খালি চোখ
ক্ষয়ে যেতে থাকে।
দিন কাটে, রাতও। হয়তো বা জীবনও
ছেঁড়া টুকরোর মতো
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে
শূন্য আসনের আশে পাশে।
আমাদের ঠাণ্ডা উনুন,বেআব্রু থালা,
আমাদের আদিম বিলাসিতা,
বিশুদ্ধ কবিতার মতো অপঠিত থেকে যায়।

খাবার-২


ওরা ফিরে আসুক।

ওদের খাবার থালা,জলের ঘটি,
আম কাঠের পিঁড়ি,
এখনো দুয়ারে দাঁড়িয়ে।
ওরা ফিরে আসবে বলেই খাবার জেগে আছে।

খাবার-৪


যে কোন খাবার থালাই

সুঘ্রাণ বয়ে আনে।
যেন কোন সুমিষ্ট স্বপ্ন;
অযুত অন্ধকারের পর।
আমাদের দিন কাটে রাত্রির খোঁজে।
রাত কাটে আগুনের আড়ালে আড়ালে।
আমাদের খাবার জোটে না।

কবিতা - তপন বাগচী

মালালাকে নিয়ে গান
তপন বাগচী


শিক্ষার মেয়ে, শান্তির মেয়ে, তোমার তুলনা নাই।
সোয়াতের মেয়ে ভগিনী আমার মালালা ইসুফজাই॥

ইসকুলে যেতে চেয়েছিলে তুমি শিক্ষার অধিকার

রাজপথে তুমি দৃপ্ত হেঁটেছ, প্রতিবাদে সোচ্চার-
তোমার সাহস, তোমাকে দিয়েছে বিশ্বের মাঝে ঠাঁই॥
সোয়াতের মেয়ে ভগিনী আমার মালালা ইসুফজাই॥

নারীশিক্ষার পথ রোধ করে অশুভ শক্তিধর,

হুমকির তোড়ে বন্ধ করেছে প্রিয় ইসকুলঘর
মহিয়সী তুমি, তবুও মালালা, লেখাপড়া ছাড়ো নাই॥
সোয়াতের মেয়ে ভগিনী আমার মালালা ইসুফজাই॥

অশুভের গুলি তোমার মাথায়, কণ্ঠ হয়নি রুদ্ধ

চেতনার দূত হয়ে তুমি করো দানবের সাথে যুদ্ধ
তোমার পাশেই দাঁড়িয়েছি আজ পৃথিবীর বোন-ভাই॥
সোয়াতের মেয়ে ভগিনী আমার মালালা ইসুফজাই॥

ফিরে এসো তুমি মানুষের মাঝে, বিবেকের অনুগামী

তোমাকে ডাকছে পৃথিবীর বুকে সকল শান্তিকামী
দিকে দিকে আজ তোমার জয়ের ধ্বনি যে শুনতে পাই॥
সোয়াতের মেয়ে ভগিনী আমার মালালা ইসুফজাই॥

(সুর ও কণ্ঠ : ফকির আলমগী)