শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

ছোটোগল্প - বিপ্রতীব

ছোটোগল্প - দীর্ঘশ্বাস
বিপ্রতীব

১.

অঘ্রানের শীত শীত বাতাসে বড় দ্রুত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে সিগারেট। মোচড়ানো ভাঁজপড়া সিগারেটটিতে শেষবারের মত টানা কিছুক্ষণ ঘনঘন শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায় আন্তজ। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকে বকুলকান্দি চরের দিকে। হঠাত্‍ কেউ দেখলে ভাববে হয়তো জরুরি কোনো কাজ আছে তার। এমন ভাবাটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কিন্তু আন্তজের ব্যাপারটা ভিন্ন। মাটির দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা আন্তজ মিয়ার শৈশবের অভ্যাস। সন্ধ্যা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে, বিকেলের অবশিষ্ট হলুদ আলোটুকু নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। সরু এবড়োথেবড়ো একটা পথ ধরে হাঁটছে আন্তজ। তার বামপাশে আদিগন্ত ধানের ক্ষেত, আর ডানপাশে বহু পুরোনো একটা মরা খাল, খালের ওপাড়ে গৃহস্থ বাড়িগুলোতে জ্বলে উঠছে সন্ধ্যাপ্রদীপ। সরু পথটা পেরিয়ে আন্তজ বড় রাস্তায় ওঠে। সামনে মাইল দেড়েক হেঁটে গেলেই হাতের বামদিকে ইটভাটার পর বকুলকান্দি চর। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন। কোমরের গাঁট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ্বালালো সে। আচ্ছা, মর্জিনা এখন কেমন আছে, তার কি এখনো মনে আছে বিজন নদীর বুকে তিরতির কাঁপন তুলে যাওয়া সেই শুভ্র-সফেদ চাঁদ, হৃদয়ে উন্মাতাল জোয়ার তোলা অপূর্ব জোত্স্না ! মনে মনে ভাবে আন্তজ। নাকি ভুলেই গ্যাছে আরো পাঁচটা ভুলে যাওয়া ঘটনার মতন। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফ্যালে সে।

বেশ বড় নদী, তবে এখন বেশির ভাগটাই শুকনো, খটখটে বালুচর। গেল বার বর্ষায় এখানে জল প্রায় ত্রিশ চল্লিশ হাত পর্যন্ত গভীর ছিল, অথচ এখন হাঁটু জলের বেশি হবে না। চারিদিকে কেমন তীব্র অন্ধকার, মানুষজন নেই। অদূরে ঘনঝোপের ভেতর মাঝে মাঝে দু একটা শেয়ালের অলক্ষুণে আর্তনাদ শোনা যায়। ঘোর লাগা চোখে সন্তপর্ণে বালুচরে নেমে আসে আন্তজ। অনেক দিন পর এখানে আসা তার।
২.
"ইশ! কি কর!" মর্জিনার আগুনজ্বলা ঠোঁটে চুমু দিতে গেলে লজ্জায় মুখ সরিয়ে নেয় মর্জিনা। আন্তজ হেসে চাপা স্বরে বলে, "আমার সোনা বউটারে ইট্টু আদর সোহাগ করি।" মর্জিনা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অভিমানী সুরে বলে, "বিয়াই তো করলা না এহনো, বাপে আমার বিয়া ঠিক কইরা ফালাইছে, ভাদ্দর মাসে রাশেদ শিকদারের আধপাগলা পোলাডার লগে বিয়া!" মর্জিনার কথা শুনে আন্তজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, দৃঢ় স্বরে বলে, "আত্মা এই দেহে যতদিন আছে মেম্বরের পোলার লগে তোমার বিয়া হইতে দিমুনা মর্জিনা, তুমি শুধু আমার, আমারেই বিয়া করবা।" আন্তজের রেগে ওঠা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে মর্জিনা। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, "হইছে হইছে, আর গঞ্জের সিনামার মতন ডাইলগ দেওন লাগবো না!" মজির্নার আরো একটু কাছে এসে বসে আন্তজ। চাপা স্বরে বলে, তোমারে বড়ো ভালোবাসি গো মর্জিনা, ছোডকালে মায় অসুখে মইরা গেল, বাপেও দেনার দায়ে ঘরের পিছে শ্যাওড়া গাছে ফাঁস দিয়া মরছে। দুনিয়ায় আমার আপন কেউ বলতে শুধু তুমিই, আমারে ছাইড়া কোনোদিন যাইয়ো না মর্জিনা। মর্জিনা চোখ ফেটে কান্না আসে, মানুষটার জন্য বড়ো মায়া হয় তার। সে শুধু নীরবে বলে, "এমুন কথা আর কোনদিন কইবা না আন্তজ, কে বলছে তোমার কেউ নাই, আমি কি তোমার কেউ না!" "তোমার জন্যেই তো অহনো বাঁইচা আছি মর্জিনা, তয় কবেই এই ভরা নদীর উজান স্রোতে ভাসাইয়া দিতাম দেহতরী!" মর্জিনার হাত দুটো শক্ত করে ধরে আন্তজ। ছলছল ভৈরবীছন্দে বয়ে চলা নদীটির তীর ঘেষে প্রায় সমান্তরাল দু'টি বাঁশের খুঁটিতে রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছোট্ট নৌকাটির ছইয়ের ভেতর বসে ছিল আন্তজ আর মর্জিনা। আকাশে দারুণ অপরূপ পূর্নিমাচাঁদ। জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় মর্জিনাকে দেখে মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে আন্তজের। মর্জিনার ঠোঁটে মৃদু চুমু দেয় সে। মর্জিনাও এবার সাড়া দিতে থাকে। গাঢ় আলিঙ্গনে সে আন্তজকে জড়ায়ে ধরে। মর্জিনার সুডৌল স্তনজোড়া আন্তজের খোলা বুকের জমিনে ঠেকে যায়। শরীর জুড়ে যেন তুমুল তোলপাড় বয়ে যেতে থাকে আন্তজের। ধীরে ধীরে চন্দ্রমগ্ন দুটি দেহ এক হয়ে মিশে যেতে থাকে জোছনাস্নিগ্ধ ছইয়ের ভেতর!

৩.

নিঃস্তব্ধ অন্ধকারের ভেতর কোথায় যেন একটা ঝিঁঝিঁ পোকা রাত্রির আশ্চর্য নীরবতা উপেক্ষা করে বিরামহীন ডেকেই চলেছে। সামান্য দূরে ঝাঁকড়া বকুল গাছটির নিচে খানিকটা উঁচু হয়ে আছে মাটি, ভালো করে না দেখলে সহজেই বোঝা যায় না এর অবয়ব। ধীরে ধীরে সেখানে এগিয়ে যায় আন্তজ। হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত দিয়ে তুলতে থাকে ঝুরঝুরে মাটি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে বাড়তে থাকে তার হাতের গতি। একসময় পাগলের মত খামচাতে থাকে। হঠাত্‍ এক ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় আন্তজের আচরণে। নদীর কিনার ঘেঁষে পাগলের মত দুর্বোধ্য প্রলাপ বকতে বকতে ছুটতে থাকে সে। একসময় নিঃসীম অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যায় .....
অন্ধকারাচ্ছন্ন বালুচরের বিব্রত বাতাসে একলা পড়ে থাকে আন্তজ মিয়ার
বুকচাপা একরাশ উলঙ্গ দীর্ঘশ্বাস ......

.. মর্জিনারে আমারে ছাইড়া আন্ধার কবরে উঠলি, উপরআলায় সহ্য করবো না ....

সহ্য হবো না উপরআলার ....