শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

প্রসঙ্গ সুচিত্রা মিত্র- কল্পনা দাস


‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে’
কল্পনা দাস

কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্র । তাঁকে আমরা হারালাম(২০১১) যখন , একটা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল বলে মনে হয়। গানের শিল্পী হিসেবে ওনাকে সবাই চেনেন, কিন্তু উনি একজন পরিপূর্ণ শিল্পীও ।

‘পথ আর বাকি নাইতো আমার
চলে এলাম একা –
তোমার সাথে কই গো হলো দেখা
কুয়াশাতে ঘন আকাশ , ম্লান শীতের ক্ষণে
ফুল ছড়াবার বাতাস বেড়ায় কাঁপন লাগা বনে’

এই আবৃত্তি video তে শুনছিলাম সুচিত্রা মিত্রর কণ্ঠে , অপূর্ব ! তার শিল্পী সত্তার আর একটা পরিচয় ।

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দশ ক্লাসের ছোটো মেয়ে শান্তিনিকেতনে গান নিয়ে পড়তে চাইল। বাবা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের অতি পরিচিত ,তিনি নিজেও ছিলেন একজন মান্য সাহিত্যিক । মা সুবর্ণলতা দেবীর কণ্ঠে রবী ঠাকুরের গান শুনে তখন থেকেই

রবীন্দ্রনাথের কথা-সুরের সঙ্গে পরিচয় । বিশ্বভারতীতে পড়তে চাওয়ার অভিলাষ অবিভাবকেরা খুশি মনেই সম্মতি দেন ।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কুড়িদিন পর, Aug. মাসে, এক আকাশ বৃষ্টি নিয়ে বিষণ্ণ মনে বিষণ্ণ বিমর্ষ শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছলেন সুচিত্রা মুখোপাধ্যায় । এই দিনটি তাঁর কাছে দ্বিতীয় জন্ম । তাঁর জীবনে অন্যরকম ছোঁয়াচ লাগলো । রবীন্দ্র সঙ্গীতের চিরন্তন রূপটি ফুটে ওঠে তাঁর ঐশ্বর্য ময় কণ্ঠে।

সুচিত্রা মিত্রর গলায় বহু রবীন্দ্র সংগীত শুনেছি , কিছু গান যেন তাঁর কণ্ঠে শোনার জন্যই রচিত হয়েছে । তিনি বলতেন “ গানকে আমি চোখের সামনে ভাসতে দেখি”... তাই তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে শুনি –‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, তিনি গলা ছেড়ে গান করতেন । “ কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক/ মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে ,কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ’’। তিনি দেখেন কৃষ্ণকলি মেয়েটি কী ভাবে মাঠের মাঝে দাঁড়ায় , আকাশ ঘিরে কালো কাজল মেঘ ঘনিয়ে ওঠে তমাল বনের শিয়রে, সেই ছবি তিনি দেখতে পান । তাঁর অনুভবের কাথা ব্যক্ত করেন রবীন্দ্র গানে । সুচিত্রা মিত্র সংগীতের সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন , এমনকি যখন গান করছেন তখন তো বটেই , যখন করছেন না তখনও । তিনি গান পড়তেন , সেটাই ছিল তাঁর কাছে রেওয়াজ। YouTube –র দৌলতে আমরা বহু গান-ই শুনতে পাচ্ছি , তার গলায় কত কত গানের কথা বলব জানিনা ......জর্জ দার সাথে, ‘তুমি খুশি থাকো’- মোহর দির সাথে, ‘আজি আনন্দ সন্ধ্যা’- এ ছাড়াও তাঁর কণ্ঠে ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘হৃদয়ের একূল ওকূল’। আর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ ,...এই গান উস্তাদ আমজাদ আলি (সরোদ) , সুচিত্রা মিত্রর গলা মিলে এক অসাধারন সংগীত মূর্ছনা-র সৃষ্টি করেছে ।

কবিগুরু তাঁর স্বদেশ পর্যায়ের অনেক গানে বাউল সুর ব্যবহার করেছেন । এই সুরের মধ্যে দিয়েই প্রানের উদ্দিপনা , উৎসাহ আশ্বাস ফুটিয়ে তুলেছেন । ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘এবার তোর মরা গাঙ্গে’ , ‘ ও আমার দেশের মাটি’, --------এই গান গুলো সুচিত্রা মিত্রর গায়কীতেই আমার মনে গেঁথে রয়েছে , কতটা আকুল হয়ে তিনি গান করতেন । তাছাড়া গানের মাধ্যমে নিজকে প্রকাশ করার একটা আলাদা আনন্দতো আছেই, সেই আনন্দ থেকেই উঠে আসে আরও আনেক কিছু। গানের পাশাপাশি ওঁর নিজের লেখা কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ –র মধ্য দিয়েই তাঁর শিল্পী সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় । তাঁর ঘর সাজানো , কুটনো কোটা , রান্না সব-ই কী নিখুঁত । একা থাকতেন তিনি, কোন সেক্রেটারী ছিলনা , দীর্ঘ দিন এমনকি কোন কাজের লোকও রাখেননি । ওঁর আদর্শ ছিল নিজের কাজ নিজে করা । ১৯৯৩ সালে খ্যাতির শীর্ষে থাকার সময়ও প্রত্যেক টা ফোন নিজে ধরতেন, কেউ দরজায় বেল বাজালে, নিজেই দরজা খুলে দিতেন। অতিথিকে নিজের হাতে সেবা করাই ছিল তাঁর পছন্দ ।

পরিপূর্ণ শিল্পী সুচিত্রা মিত্র সম্পর্কে আরও কিছু না বললেই নয়, অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন, নতুন করে বলার কিছু নেই, IPTA –র নাটকে উৎপল দত্ত –র সঙ্গে কাজ করেছেন, অভিনয় করেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’ ছবিতে ইন্দ্রাণী হালদারের ঠাকুমার ভুমিকায়। IPTA-র বিখ্যাত ‘ও আলোর পথ যাত্রী’ – সলিল চৌধুরী –র ঘুম ভাঙ্গাবার গান,দেবব্রত বিশ্বাস , সুচিত্রা মিত্র , দ্বিজেন মুখার্জি এঁদের গলায় শুনি আর শিহরণ জাগায় মনে ।

আমার নিজের মনে হয় কিংবদন্তী শিল্পী সুচিত্রা মিত্র প্রমান করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষার , সংস্কৃতির , জাতির আপন বোধকে একক ভাবে তৈরি করেছেন , বদলেছেন, আধুনিক করেছেন । বিশ্ব সেই বোধে অনুপ্রাণিত হয়েছে । আমাদের বিশ্বাসে , নিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ , তাঁর গান............... “ তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মন প্রানে,

সে আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে...............”