শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় সংখ্যা ২য় বর্ষ


সম্পাদকীয়





মাস ফেব্রুয়ারি , এই মাসেই পাশ্চাত্যমতে ভ্যালেন্টাইন'স্‌ ডে এবং বাঙ্গালীদের অন্যতম সেরা একটি উৎসব - সরস্বতী পূজা । যে পূজা একাধারে বাগদেবীর আরাধনা এবং কৈশোরের প্রেমের উন্মেষকাল ।

এমন সময়ে যখন সবাই এই দুই বিষয়ে সাহিত্যপত্র করছেন তখন আমরা বেছে নিলাম --' শঙ্খ ঘোষ ' !

কেন ?

বাংলাদেশের চাঁদপুরে এমন এক ফেব্রুয়ারি মাসেই জন্মেছিলেন এক প্রবাদপ্রতীম কবি, বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ - চিত্তপ্রিয় ঘোষ, যাঁকে আমরা কবি শঙ্খ ঘোষ নামেই সমধিক চিনি । সরস্বতীর সাথে যাঁর নিগুঢ় যোগাযোগ । বীণাপাণি'র বরপুত্র এই কবিকে সম্মান জানানোর জন্য তাই এই মাস বেছে নেওয়া ।

যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক এই অসামান্য মানুষটি তাঁর লেখনীকে অমরত্বের দিকে উন্নীত করেছেন দিনেদিনে । শুধু কবিতাই নয়, প্রবন্ধ, অনূদিত নাটক কি লেখেননি তিনি ।

কবিতাকে ব্যবহার করেছেন অমোঘ তরবারির মত ।প্রতিটা শব্দের অনন্য ব্যবহার তাঁর লেখায় এনে দেয় এক অপার রহস্যময়তা ।

শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবিদের একজন যিনি তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেন এক অনিবার্যতায়। আপাত শান্ত , আদ্যন্ত ভদ্রলোক এই কবির কলমে ভরা থাকে প্রতিবাদের বারুদ।


বলাইবাহুল্য -- আমাদের মধ্যে যারা সাহিত্যচর্চা করেন কিংবা মুগ্ধ পাঠক তাদের কাছে খুব গর্বের মানুষ কবি শঙ্খ ঘোষ। তাই তাঁকে স্মরণ করে আমরা গুটি কয়েক মুক্তগদ্য, আলোচনা আর কিছু কবিতা দিয়ে সাজিয়েছি এই সংখ্যা।



এমন মানুষকে নিয়ে এই সংখ্যা করার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্বিত।



তিনি দীর্ঘজীবী হন, আমরা অবগাহন করতে থাকি ক্রমাগত শব্দধারায়। অনেকটা আবেগ দিয়ে করা এই সংখ্যা সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে আদৃত হবে এই কামনা রইলো সকলেই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর শিল্পে থাকুন।




ক্ষেপচুরিয়াসে'র পক্ষে -
মিলন চট্টোপাধ্যায় ও পৃথা রায়চৌধুরী

এই সংখ্যার সূচী -

এই সংখ্যায় থাকছে -



এই সময়ের আলোচিত কবি অরুনণাচল দত্তচৌধুরীর - ‘শঙ্খ ঘোষ’ কবিতা সিরিজ



গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের - জেগে ওঠো 'ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম'


বিদিশা সরকারের ব্যক্তিগত গদ্য - "দূর থেকে দেখা কাছের মানুষ"

মিলন চট্টোপাধ্যায়ের - "অনুজ দৃষ্টিতে শঙ্খ-কাব্য"


পৃথা রায়চৌধুরী’র - ‘শঙ্খ ঘোষ - আমার চোখে’


অমলেন্দু চন্দ'র - "শঙ্খ ঘোষের সৃষ্টিশীলতা’র মুখ – কবিতা সাহিত্য আলোচনা ও জীবন"


শর্মিষ্ঠা ঘোষ' এর - "অমোঘ শঙ্খ ধ্বনি"


শমীক ঘোষ' এর - “ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার”


ব্রততী চক্রবর্তী'র - "পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ : শব্দের পাঁজরে অনায়াস যাতায়াত"

শ্রুতি গোস্বামী'র - "আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি"


ইন্দ্রাণী সরকার'এর - 'শঙ্খ ঘোষের চারটি কবিতার অনুবাদ'



অন্যান্য নিয়মিত বিভাগে ---


কবিতাঃ

মৃণালকান্তি দাশ,বারীন ঘোষাল, জুবিন ঘোষ, নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণব বসুধর, সুমিত রঞ্জন দাস, সঞ্জয় ঋষি, প্রসেনজিৎ দত্ত, ইন্দ্রনীল তেওয়ারী ও হাসান রোবায়েত - এই দশজন কবির দশটি কবিতা


ধারাবাহিকঃ

মলয় রায়চৌধুরী’র - ‘খামচানো কালখণ্ড’
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়’এর - ‘অবভাস’

আলোকপর্ণা'র ধারাবাহিক - "চান্দের চর"


সুবীর সকারের
ধারাবাহিক -এপিটাফ


গল্

মৌ মধুবন্তী'র ছোটগল্প - "যেখানে গল্পের শুরু "


















শঙ্খ ঘোষ সিরিজ - অরুণাচল দত্তচৌধুরী

শঙ্খ ঘোষ সিরিজ
অরুণাচল দত্তচৌধুরী

(১)
শব্দ হরিণ ধরবে বলে
পদ্য মাখা ফাঁদ
দিন রাত্তির বিছিয়ে রাখে
এ’টাই অপরাধ
লোকটা সে দোষ স্বীকার করেও
সংযত নয় মোটে
সমস্তক্ষণ শব্দ সাজায়
সুখে ও সংকটে
বিষণ্ণ এই পৃথিবী ছোঁয়
জ্যোৎস্নামাখা চাঁদ
মরতে মরতে মানুষ মাখে
বাঁচার অপরাধ।
কলম যখন আঁচড় কাটে
অস্ত্র বোধ হয় ওটা
গড়িয়ে পড়ে অমৃত আর
আগুন বিষের ফোঁটা
লক্ষ হাজার অযুত ফোঁটায়
বর্ণমালার নদী
দিনযাপনের পাপগুলো সব
ভাসায় নিরবধি
তাই তো তাকে শাস্তি দিলাম
আমরা অতঃপর ...
নদীর পারেই বসত করো
শব্দ নিয়ে ঘর



২)

পালিয়ে যাওয়া অবাধ্য শব্দেরা
ফিরছে শঙ্খ ঘোষের পিছু পিছু
প্রায় দিগন্তে যাদের ঘোরাফেরা
তারাই জানে আকাশ কত নীচু
সত্যি কথা বলার পরেই শোনো
ঘরপোড়াদের সিঁদুর মাখা মেঘে
যদিও আমরা বলি না কক্ষনো
যাচ্ছে ভয়ের গোপন কথা লেগে
সে’সব আগুনজলের কাহিনিকে
সাবধানীরা ভাবছে অবান্তর?
ভাবলে ভাবুক। কলম শুধুই লিখে
রাখছে নিজের শরীর ভরা জ্বর।


অজ পাড়াগাঁয় শহর মফসসলে
তুচ্ছ এখন জ্বরের আলোচনা
টিভির বাক্সে সন্ধ্যে সকাল দোলে
সংস্কৃতিময় সিরিয়ালের ফণা।
মন তো খারাপ হচ্ছে প্রতিদিনই
আমরা বরং কবিকে নিই চিনে
শব্দভেদী বান পাঠালেন যিনি
পুব পশ্চিম উত্তরে দক্ষিণে



৩)

তুমি নাকি প্রকাশ্যে গোপনে
লিখে যাচ্ছ সমসাময়িক?
সমস্ত পড়িনি। মনে মনে
ভেবে গেছি ... পড়ে নেবো ঠিক
আমার এই পল্লবগ্রাহীতা
যদি পারো ক্ষমা করে দিয়ো
যুদ্ধারম্ভে পড়ে নেবো গীতা
আপাতত শান্তি বড় প্রিয়
বাজেটের প্রতিরক্ষাখাতে
জমা থাক নির্ভেজাল দেনা
আমি জানি তোমার লেখাতে
ঘুম ঘুম শান্তিটি মেলে না
রোজ দিন ক্লান্ত মনে দেহে
তবু তুমি আমারও বিবেক
নেতা বলে ‘শঙ্খ ঘোষ কে হে?’
আমি বলি ‘আগে বাংলা শেখ্’!



৪)
কাটআউট ভরা বিজ্ঞাপনের রাজা এবং রাণী
মুখ ঢাকা এই শহর বোঝে সমস্ত শয়তানি।


মাঝ দুপুরে শহর জুড়ে বৃষ্টি নেমেছে
রাস্তার তো ভেজার কথাই। আর কে ভিজেছে?


ভিজল হয়তো কাগজ কলম কবিতা একপাঁজা।
কবি নিজেও ভিজল বুঝি? মেজাজটাই তো রাজা।


না থাকলে সে, যমুনাবতী জন্মাতে পারতো না।
সেই তো দেবে শেষ বিকেলের বাবরকে প্রার্থনা।


ভিজবে না তাই আগুন। বুকের জ্বলতে থাকা পাবক
বুঝিয়ে দেবে বন্ধু কে, ... আর ... কে সেই অভিভাবক!


৫)
জীবিতরা মিশে যায় মিথ-এ
মোড়ে মোড়ে ফ্লেক্স ঝোলে ফ্রেশ
এরই মাঝে গ্রীষ্মে ও শীতে
ভাষা নিয়ে ঘোরো দরবেশ


ঝুলিভরা জাদু মুখরতা
দুয়োরে দুয়োরে কর ফেরি
ভয়ে আলো চেনেনা জনতা
হাতে হাতকড়া মনে বেড়ি


তারা চেনে তোলাবাজ নেতা
তারা চেনে রংবাজ পেশী
কী বা লাভ জেনে কবি কে ... তা’
পাগলু চেনালে লাভ বেশি


আরও লাভ যদি চেনা যায়
ফ্লেক্স যার মুখের বিলাস
যুদ্ধ তো রাজায় রাজায়
উলুখড় হয়ে যায় লাশ


তোমাকে সাক্ষী মানে তারা
রীতি মেনে অবজ্ঞাও করে
আমাদের অত নেই তাড়া
ভাষা দাও আমাদের স্বরে



৬)


তোমাকে অনেক দিতে সাধ হয়, ভাঁড়ারে শব্দ নেই তাই
তোমারই বাগান থেকে তুলে আনি, যত্ন করে গাঁথি সুতো দিয়ে
চিনতে পেরেছো হয়তো, কিম্বা সেই গ্লানিমাখা শব্দ অভিলাষ
আমাকে তেমন করে ছুঁতেই পারেনি কোনওদিন
তবু শোনো ধার চাইছি, কথা দিচ্ছি যথাকালে শোধও দিয়ে দেব
বিধিমত দাবী করলে সাথে অতিরিক্ত দেব বিক্রয় কোবালা


আমার ধ্বংসবীজ জন্মাবধি এখানে প্রোথিত। ঠিকমত মাটি জল পেলে
চিৎকারশব্দে এক নতুন অঙ্কুরমালা জ্বলে উঠতে পারে
পাথরে শেকড় গেঁথে কথাবৃক্ষ উঠে যাবে আকাশের দিকে
এমন প্রার্থনা করলে, চেনা দুর্যোগের মত ঘুর্ণি পাঠিওনা
ঝিমধরা সময়কে চোখে চোখ হৃদয়ে হৃদয় রেখে বলতে দিও
তোমার সমস্ত নিতে সাধ হয়। আপাতত মুছে দাও ভুল ধ্বংসটুকু ...


৭)
ইচ্ছে হলে দিনগুলোকে কচকচিয়ে মেঘ মাখিয়ে খাবো।
আঁশ থাকলে ছিবড়ে হবে। সেটুকু ঝুঁকি সবসময় থাকে।
দাঁতের ফাঁকে কবিতাকুচি খোঁচাতে হবে গোপন টুথপিকে
তবেই সেই দন্তরুচি ভদ্রভাবে প্রকাশ করা যাবে
ট্রাফিকরুল ভঙ্গকারী কঠিনতম শাস্তি পাবে জেনেও
অশ্বমেধে চলেছে তবু কবির দল দেশে ও সন্দেশে
উল্টোদিকে ডাস্টবিনের আড়াল থেকে জাতভিখিরি যারা
খাবলে খায় গায়েও মাখে গতরাতের উদবৃত্ত ব্যথা
তরকারিও সেইটুকুই দরকারি যা ভাষ্য মেনে চলে
মনোমোহন মোহনভোগ দেবার আগে রোজ দু'বার ভাবে।
কথাটা ঠিকই কবিতা নয় সুলভ যাদু ... অ্যাফ্রোডিসিয়াক
অ্যাণ্টাসিড সহযোগেও। তবু কিছুটা সহজপাচ্যতা
দাবী করেছে কলমহাতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক যুবতীরা।
কালিতে নয় ... কলমে নয় ... কি-বোর্ডের নকল কথকতা
ছদ্মবেশে যজ্ঞভূমি বিনা আয়াসে দখল করে আছে।
ওদের আজ প্রশ্ন কর। দখল কর কবরখানাগুলি।
দৈর্ঘ আর প্রস্থ মাপো। খুঁড়তে থাকো নিজের উচ্চতা।
সবাই যেন উঠতে পারে, নিজেই ... শেষ কেয়ামতের দিনে।
প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিচারসভা সাজিয়ে রাখা আছে
সাজান আছে সওয়াল আর নিজের মত তীক্ষ্ণ যুক্তিও।
আর তা'ছাড়া সবাই জেনো লক্ষ্যভেদে ততটা পটু নয়।
মুখোশদের দাঁত থাকে না। আড়াল থেকে নিজের উদ্যোগে
ইচ্ছে হলে চিবিয়ে খাবো প্রাত্যহিক দিনযাপনগুলি
বাঁচুক শুধু ঝড়ের মত শর্তহীন কবিতা কল্পনা



(৮)

আমার বড়ই জ্বর। এসো তুমি। বসো এই ঘরে।
কবিতাপ্রপাত এনে ঢেলে দাও আমার শিয়রে।
ভয়ের তরাসে জ্বর। এ’ অসুখ দারুণ ছোঁয়াচে।
প্রতিবেশীরাও নাকি নিত্যদিন পোড়ে এরই আঁচে।
শরীরে কাঁপুনি ওঠে। জড়োসড়ো হয়ে থাকে মনও।
তবুও বুঝতে পারি পাণ্ডুলিপি গাঢ় আর ঘন
কুয়াশার মত ঝরছে মেলে রাখা খাতায় কাগজে
তুমি যা বলতে চাও সবই ওই বর্ণমালা বোঝে
সবুজ হলুদ লাল অস্যার্থে পুরো ভিবজিওর
রাত কিছু রঙ ঢালে, বাকি সব রঙ জানে ভোর।
পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে আকাশে ছড়িয়ে যায় রঙ
একে কি স্বপ্ন বলব? কবিতাই বলছি বরং ...
বুঝি না জ্বরের ঘোরে যা দেখেছি, সবই কি কবিতা?
অসুস্থ সময়কে আরোগ্য এনে দাও পিতা।

জেগে ওঠো - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

জেগে ওঠো 'ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম'
গৌতম চট্টোপাধ্যায়

 
সে কতদিন আগের কথা ! বোধয় ১৯৭৯। সপ্তাহে ৪/৫ দিন ৫-৩০ নাগাদ ডবল ডেকার বাস ধরতাম যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ড থেকে। সোজা দোতলার সামনের কাঁচের কাছাকাছি সীটে জায়গা পেলেই বসা আর কখনো কখনো বিনয় মজুমদারের কল্পনাকে স্বাগত জানানো ~ আমারো মনে হোতো এখানে বসে সত্যি-ই তো ঝাউগাছের ডাল নেড়ে গাছের পাতাগুলিকে, পাখীদের ধুলোট ডানাগুলিকে, ফুলের পাঁপড়িগুলিকে, এমনকি স্থানু-অস্থানু নরনারীদের পোষাক অথবা চুলের ময়লা অনায়াসে পরিষ্কার করে দেওয়া যায় ! একেকদিন নিজেকে অসামান্য লাভবান মনে হোতো ~ হয়তো দেখতাম শঙখ বাবু'র পাশের সীটটাই খালি অথবা কখনো আমি বসে আছি আর তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে । অনেকটা শ্রদ্ধার জোরাজুরি করেই তাঁকে বসানো যেত । নেহাত-ই সৌজন্য বিনিময় অথবা কোনোদিন তাঁর সাম্প্রতিক কবিতাটির প্রতি আমার মুগ্ধতা জানানো । বাংলা কবিতা'র এই সরলবর্গীয় ঋজু মহাদ্রুম-কে অহরহ প্রণিপাত হই আর ভাবি নীরব এই মানুষটি সামাজিক অভিঘাতে কেমন করে শার্দূলগর্জন করতেও জানেন !!


১৯৮৫/৮৬ সাল হবে বোধয় ~ চিরক্ষ্যাপা জ্যোতির্ময় দত্ত তখন মগ্ন রয়েছেন 'কলকাতা ২০০০' পত্রিকার সম্পাদনায়। সেবছর শরত সংখ্যাটিতে তিনি এক কবিকে আবিষ্কার করলেন, তার আগে বা পরে কেউ সেই কবির নাম শোনেননি বলেই মনে হয়। কবি রঞ্জিত গুপ্ত ~ পরিচিতিতে জ্যোতিদা লিখেছিলেন ~ " হ্যাঁ, এই সনেট-অনুবাদক রঞ্জিত গুপ্ত-ই হচ্ছেন সেই নকশাল দমনকারী পুলিশ কমিশনার, পোলো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, নৃতাত্বিক, চাষী, এবং ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রঞ্জিত গুপ্ত, আই পি। একটি রেণেসাঁ চরিত্র।" আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি মামুলি রং চড়ানো অতিকথন বা বর্জনীয় পরিচিতিমাত্র... একে নিয়ে বেশী গুরুত্ব দেবার কিছু নেই... ওরকম কবি প্রতিদিন জন্মায় এবং মারা যায়...ইত্যাদি। না, পরের সংখ্যাতেই এক দুর্ধর্ষ চমক 'কলকাতা ২০০০' পত্রিকায় ~ 'একটি চিঠি' প্রকাশিত হয়েছিলো, 'প্রিয় জ্যোতি' সম্বোধন সেরে কবি শংখ ঘোষ তাঁর জিহাদ প্রকাশ করেছিলেন। সবিনয় মূর্তি'র আড়াল থেকে জেগে উঠেছিলো এক মানুষের মুখ, এক প্রতিবাদী বিবেক, এক স্নেহশীল শিক্ষকের নিরাভরণ উপস্থিতি।


বিতর্কিত এই সংখ্যা-তেই প্রকাশিত হয়েছিলো আমার প্রিয়বন্ধু শান্তি নাথের উপন্যাস 'ভূ-নয়না' ~ লেখক পরিচিতিতে ছিলো 'শান্তি কাজ করেন রেলে'। আরেক মুখচোরা লেখক শান্তি তখনো সামনা সামনি পরিচিত হয়নি শংখবাবু'র সাথে। উপন্যাসটি ছিলো প্রখ্যাত ৭০ দশকের পট-ভূমিকায় লেখা। শংখবাবুর সমালোচনার উৎসমুখে ব্যবহৃত হতে থাকলো ভূ-নয়না'র রেফারেন্স। পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্ত, IPS, দেবী রায়, রুণু গুহ নিয়োগী, রজত মজুমদারদের মত অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের পিস্টল থেকে যেসব ক্ষীরের পুলি বেরিয়ে আসতো সেসব খেয়ে কত তরুণের, কত জিনিয়াসের প্রাণ গেছে সেসব কাহিনী আমাদের মানে আধ-গেরস্তী বিবেকবান সাহিত্য-সেবকদের অজানা ছিলোনা, তবু কেউ জ্যোতিদাদা'র এই স্টান্ট-ট্যাকটিক্সকে ধাক্কা দেবার কথাটুকুও ভাবতে পারিনি ~ যেটা অনায়াস সহজতায় করে ফেলেছিলেন কবি শংখ ঘোষ।


তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজের পরবর্তী চিরকুট সমূহে পদাতিক কবি থেকে অব্যাহতি'র সড়কসন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বয়সের / অসুস্থতার ভারে তাঁর তীক্ষ্ণ কলমটিকে মাঝেমাঝেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন-ও তো কাউকে রিলে-স্টিক নিয়ে দৌড়তে হবেই। কোথায় যেন ভেঙে যাচ্ছিল 'আমির আবরণ' , কোথায় যেন তীব্র অনুভূতি গ্রাস করছিল বামপন্থী শঙ্খবাবুকে - বামপন্থী সরকারের পুলিশ-আশ্রিত ও পুলিশ- প্রশ্রয়ী থাকার বাহুল্য দেখে দেখে তাঁর প্রতিবাদী কোষসমূহে উদ্গীরণ শুরু হয় । বামপন্থীরাও তো মূলত শাসক ফলে তাদের ঘোষণা করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকার কথা নয় যে ' লাইনেই ছিলাম বাবা '।বামপন্থী সরকারের উদ্দেশে তিনি উচ্চারণ করেন ~ " পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল " ~ বর্তমান দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রতিও বহাল থাকুক একই অনুযোগ । অথবা

"গায়ের জোরে আমার হাবা বোনকে তুমি ধর্ষণ ক'রে গেলে
আমার অধিকার আছে তাকে মিথ্যে ব'লে প্রমাণ করবার
গুলির জোরে আমার বেকার ভাইয়ের হৃৎপিণ্ড তুমি ছিঁড়ে নিলে
আমার অধিকার আছে তোমারই কাছে দুহাত পেতে ভিক্ষে নেবার
ক্ষতিপূরণের আর প্রতিপূরণের..." ~ এই কঠিন শ্লেষ সব শাসককেই
এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয় সম্ভবতঃ। বাম-রাজত্বের শেষে আসবে বোধয় বামা-রাজ্য ~ এমনটা কল্পনা করেই কি তিনি অগ্রিম জানিয়ে রেখেছিলেন

"অধিকার আছে তোমার রাতুল দুপায়ে
আমার গলে যাওয়া শিরদাঁড়া ছুঁড়ে ফেলবার "!

সদাক্রিয়াশীল জ্যোতিদাদার একটা অসামান্য ভুল অভিব্যক্তি ক্ষেপিয়ে তুলেছিল শংখ ঘোষের মত মানবতাবাদী কবিকে। তিনি রঞ্জিত গুপ্তদের অত্যাচারের ভুলে যাওয়া কীর্তিসমূহকে সুদীর্ঘ চিঠির অভ্যন্তরে জারিত করেছেন অগ্নিরসে। আর এখানে একথাও জানানো উচিৎ যে কবি এই চিঠিটিকে নিজেও সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে মনে হয় কারণ হিসেবে বলা যায় তিনি তাঁর পরবর্তী গদ্যগ্রন্থ "জার্ণাল" এও অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন।


কি নির্মম পরিহাস ~ সনেট অনুবাদক "মিশরের অজিম্যানডিয়াস" (রচনাঃ 'পার্সি বিশ শেলী') কবিতার প্রথম স্তবকে বোধয় নিজের আসল মুখ দেখছিলেন আর সভয়ে কবি শংখ ঘোষের ভূমিকার অগ্রিম প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিলেনঃ

"স্পষ্ট ই প্রতীয়মান যে সেই প্রতিভাবান ভাস্করের হাত
ঠিকই ধরেছিলো সেই খলতা যা আকীর্ণ ছিল আসলের চেহারায়
ভাস্করের অকথিত বিদ্রুপ ছেনির ভাষায় ক রেছিলো রেখাপাত।"

দূর থেকে দেখা কাছের মানুষ - বিদিশা

দূর থেকে দেখা কাছের মানুষ
বিদিশা সরকার



প্রেমিক মানেই যেন অরফ্যান। রোদ ঝড় জলে সহনশীল অপেক্ষা।আরেকটু গভীরভাবে ভাবলে, এই রোদ ঝড় জলই ভাসিয়ে দিচ্ছে তার আত্মার শরীর। নিবেদনের এই বহুমাত্রিক শিল্পিত অজস্র পঙক্তিমালায় কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতা প্রেমিকের ঘরে বার বার আসেন,শিক্ষিত করেন।তিনি পরিপূর্ণতার কথা বলেন।আমরা তৃপ্ত হই,ঋদ্ধ এবং প্রণতও।ব্যক্তিগত অনুভবের নিরিখে আমি শুধু আমার মুগ্ধতাই দিতে পারি কবিকে।


এই মুহূর্তে যে বইটি আমার সামনে খোলা রয়েছে,আমি তার ১১ পৃষ্ঠায়। কাব্যগ্রন্থের নাম "ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার"।কবিতাটির শিরোনাম "বিষণ্ণকরণী"।যেন পুরিয়া ধানেশ্রীর আলাপপর্ব।


"রাত্রির ভিতরে এসে আরো রাত্রি মিশে যায় যদি
অন্ধকার থেকে যদি জেগে ওঠে আরো অন্ধকার".........

অন্ধকারের পরতের পর পরত উন্মোচনের কি নিমগ্নতা ! সত্যিই তো অন্ধকারে অভ্যস্ত হলে আরও অন্ধকার ও যে দৃশ্যমান ! অবশ্যই কবির নজর থাকলে । আমরা যা ভেবেছি, বলতে ব্যাকুল হয়েছি-- তিনি তা কতো সহজে বলে দিলেন।


"কথা যদি থেমে যায় কথা যদি দৃষ্টি হয়ে যায়
প্রত্যেক শরীর যদি শরীর উত্তর কথা বলে "

আমরা যেন আলাপপর্ব অতিক্রম করে বন্দিসে এলাম এবং অন্তরায়।


প্রেম কি নির্মোহ,প্রেম কি অভিমান অথবা নিমগ্নতা ? বিষণ্ণতা অতিক্রম করতে না পারার অক্ষমতায় কেন ফিরে যাই সেই অন্ধকারে,যেখানে ছন্দ'র অন্য নাম 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ"।


কবিতাটির শেষ লাইন "শিরোনামে নয়,তুমি নেমে এসো পঙক্তির ভিতরে"..................মহিমান্বিত প্রেম।


আমার ব্যক্তিগত ভাবনায় শঙ্খ ঘোষ আসেন।আমি তার কবিতা সংকলনে বুঁদ হয়ে থাকি।তাকে পড়া মানে কিছুদিন কবিতা না লেখা। সঙ্গীত সম্মেলনের পরের কয়েকদিন আমার মধ্যে পরের কয়েকদিন এরকম একটা ঘোর থাকে।আমি তাকে অতিক্রম করতে পারিনা,করতে চাই ও না।

আমার ভালোলাগার আরেকটি কবিতার কয়েকটা লাইন--


কিছু শব্দ কটা দিন উচ্ছলতা পায় মুখে মুখে
তার পরে মরে যায় আমরা তার শব নিয়ে ঘুরি
দুহাতে তাকেই তুমি সাজাও যে রাগে অনুরাগে
ছন্দের ভিতরে এতো অন্ধকার জেনেছ কি আগে


নির্জন সংলাপ,মুখোমুখি কিছু বিনিময়।বাকি কথা কবিতা বিষয়।


তার নির্বাচিত প্রেমের কবিতার মুখবন্ধে লিখেছেন


"মাটিতে বসান জালা,ঠাণ্ডা বুক ভরে আছে জলে

এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে"

শঙ্খ ঘোষের আরেকটি কবিতার অংশ,কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তকে চূড়ান্ত ভাবে ঘনিয়ে আসা নিবিড় অধিকারবোধের এক ঝলক


"দুপুরে-রুক্ষ গাছের পাতায়

কোমলতাগুলো হারালে
তোমাকে বক্‌ব,ভীষণ বক্‌ব
আড়ালে।.........

মেঘের কোমল করুণ-দুপুর
সূর্যে আঙুল বাড়ালে
তোমাকে বক্‌ব,ভীষণ বক্‌ব
আড়ালে ।


নানা অনুষ্ঠানে অথবা সাহিত্য একাডেমিতে বহুবার তাকে দূর থেকে দেখেছি---- এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারিনি ।ভেবেছি যে মানুষটা পুরোটাই একটা কবিতার আর্কাইভ---- হয়তো তখনও তিনি কবিতামগ্ন। দূর থেকেই প্রনাম ।


অনুজ দৃষ্টিতে শঙ্খ-কাব্য - মিলন

অনুজ দৃষ্টিতে শঙ্খ-কাব্য
মিলন চট্টোপাধ্যায়


শঙ্খ ঘোষ -- এক অবিসংবাদী প্রতিবাদের নাম । যার লেখা নিয়ে বলার মত যোগ্যতাই আমার নেই । তবুও লিখছি ! কেন ?



কারণ কিছু ব্যাতিক্রমী কবি আছেন যাঁদের কবিতা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না । সমাজে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার আগ্রাসী থাবা বাড়ায়,মদমত্ত শক্তির অহংকারী পদচারণ পিষ্ট করে প্রকৃত গণতন্ত্র - তখনই পরশুরামের কুঠারের মত নেমে আসে তাঁর কবিতার অমোঘ লাইন ।



শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ভালো কবিতার শর্ত মেনেও সাম্প্রতিক সময় যতটা প্রতিভাত হয় ততটা খুব কম জনের লেখাতেই আসে । বিপন্নতায় , অস্থিরতায় যখন তাঁর কবিতার লাইন পড়ি তখন ভিতরের বারুদটা ছাপোষা মানসিকতাকে ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চায় ।



১৯৫২ সালে সদ্য তরুণ এক কবির লেখা একটা কবিতা নড়িয়ে দিয়েছিল আপামর কাব্যপ্রেমীকে । সম্ভবত দেশে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল সেটা কবির । কবির নাম - 'শঙ্খ ঘোষ ' আর কবিতার নাম ' যমুনাবতী ' । কিছু লাইন দেখা যাক --



"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা

একটু আগুন দে,
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী-
দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দিই!
হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায় "

এবং


"যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে

যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে!
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ-পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ গিয়ে !
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে ! "


কি অসামান্য কবিতা । এক কিশোরীর মৃত্যু এখানে উপজীব্য । সেই কিশোরী যে মারা যায় পুলিশের গুলিতে এক ভুখা মিছিলে গিয়ে । ভাতের জন্য মৃত্যু , যার ভাতের সন্ধান তাকে এনে দেয় গরম বস্তু তবে ভাতের বদলে সেটা সীসার বুলেট । সব সুখ-স্বপ্ন বারুদের কাছে , মৃত্যু এসে হাত ধরে ।এখানে নিভন্ত চুল্লিকে করে তুলেছেন এক কিশোরীর দহনে দাউদাউ চিতা ।


আবার সেই কবিই পরিণত বয়সে যমুনাবতীর চল্লিশ বছর পর লিখলেন আরেক অমোঘ কবিতা 'ন্যায় অন্যায় জানিনে' ।

"ন্যায় অন্যায় জানিনে"



তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে !

স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল
সমাজবিরোধী।

ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসিপাতা

উল্টেও পারেনা খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানেনা বুলেটরা।
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।

পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।"



কি দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায় প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে এখানে । আক্রমণ এখানে শাণিত কিরীচের মত চিরে ফেলে , সরাসরি ।



তিন রাউন্ড গুলিতে তেইশ জনের মৃত্যু ! কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয় সেই অভিঘাতে শঙ্খ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।


'পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ' --- একেবারে নগ্ন করে দেওয়া রাজনীতির মুখোশ খুলে । কারণ '৪৭' এর আগে এবং অব্যবহিত পরেও স্বাধীন পুলিশের, স্বাধীন বুলেট, স্বাধীন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি ,করেও না , করবেও না ।

লিখলেন --


"ভয়াবহ শব্দধূমে ভরে গেছে পৌষের বাতাস

আর সেই অবসরে কোনও কোনও পিশাচ স্বাধীন
রাজপথ থেকে নারী তুলে নিয়ে চলে যায় ট্রাকে ।"

এই ভাষ্যও সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নারীত্বের অসম্মান ।আজও যা সমান প্রসঙ্গিক । নারী আজও ধর্ষিতা হয় ব্রিজের আড়ালে , প্রকাশ্য রাজপথে,ভাড়ার গাড়িতে । পরদিন সংবাদপত্রে সেটা পড়ে আহ-উহ করা ছাড়া আমরা কিছুই করিনা ।

কি অসহায় লাগে যখন পড়ি --


" আজকাল কবিমাত্রে অনায়াসে জঙ্ঘা বলে যাকে

শব্দের প্রকৃত বোধ কুয়াশায় একা পড়ে থাকে "


অনায়াসে বলে দেন ---



" মত কাকে বলে, শোনো । মত তা-ই যা আমার মত

সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ "

গণতন্ত্রের আসল রূপ ফুটে উঠেছে এই লাইন দুটিতে । মোসাহেবি কর, বাঁচো । এ যেন - আমিই সব । আমি এখানে যে কেউ হতে পারে । কোনো দল, মাফিয়া, সংস্থা-কর্ণধার অথবা বাড়ির গার্জেন ।আমাদের নিজের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য । আমরা যা ভাবি তাই যথার্থ আর বাকিরা ভুল ! মতে না মিললেই সে শত্রু , আমরা হয়ে যাই পরমত অসহিষ্ণু । সে যদি সহমত হয় তাহলে তাকেই করে নিই সর্বক্ষণের সঙ্গী আর সেটা সে নির্গুণ হলেও ।

বর্তমান সময়ে ঠিক এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাই চারদিকে ।


'ধূম লেগেছে হৃদ্‌ কমলে ' বই থেকে দুটি লাইন এইরকম ---



"তোমার স্বাচ্ছন্দ্য দেখি, দূর থেকে

রঞ্জনেরা খুন হলে তুমি বলো, 'মরেনি ও ,
আমার ভিতরে বেঁচে আছে' ... "

কেমন এই স্বাচ্ছন্দ্য যেটা দূর থেকে দেখি ? আসলে এই স্বাচ্ছন্দ্য মধ্যবিত্ত মানসিকতার, ছাপোষা মনোভাবের । তাই কোনো প্রতিবাদে গর্জে না উঠেই --'মরেনি সে ,আমার ভিতরে বেঁচে আছে ' বলে দায় সারা যায় ।


কত বলবো, বলতে গেলে দিনের পর দিন চলে যাবে ।তাও হয়তো বলা হবে না ঠিক করে।


" যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা "

আরওয়াল গণহত্যার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে লিখেছেন --


" ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যূহ ঘেরা

ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা "

ইদানীং ' সালোয়াজুড়ুম ' শব্দটি শুনতে শুনতে আমার আরওয়ালের কথাই মনে পড়ে যায় । এই ভাবেই বোধহয় ভারতবর্ষের ' প্রাইভেট আর্মি ' মান্যতা পেয়ে যায় ।


এ প্রসঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার পরে লেখা সেই লাইনগুলি মনে পড়ছে ---



" নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা ।

যতদূর যেতে বলি যায় এরা,কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায় । যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত,বলে রাত "


নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিলেন সব ছলচাতুরী একমুহূর্তে । নারায়ণী সেনা কারা ? এটা রূপক । এরা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ কর্মী । যাদের না আছে বিবেক,না মনুষ্যত্ব । ধ্বংসের জন্য , এমনকি এদের কোনো অজুহাতও লাগে না । এখানে নারায়ণী সেনা শব্দের কি সুচতুর প্রয়োগ !


নারায়ণের নিজস্ব সেনাই নারায়ণী সেনা আর নারায়ণ শব্দটা নির্দেশ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এক কূট শক্তিকে যে নিজে বসে থাকে রাজাসনে আর তার তল্পিবাহকরা মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায় ।

আবার ,

" ধরো কেউ নিজে থেকে দিতে চায় সব তা বলে কি
বসে থাকা সাজে ? তার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়ে এসো কাছে "

এই কবিতাতেই আছে


' চরিত্রই নেই যার তার আবার ধর্ষণ কোথায় '



ভাবা যায় ! কি নির্মম কষাঘাত । চারপাশে যখন শুনি আইনবিরুদ্ধ ভাষা- 'বেশ্যার আবার চরিত্র কিসের ? ' তখন এই কষাঘাত বিবেকী মানুষদেরও চাবকাতে বাধ্য। হায় নারীত্ব !


'কালযমুনা 'কবিতায় কলম বলছে সেই অসহায় মেয়েটির কথা যে একটা ভোগ্য বস্তু , বিক্রয়যোগ্য পণ্য । যার শরীরের বিনিময়ে কেনা হবে পরিবারের সুখ।


"বেচিস না মা বেচিস না

বেচিসনা আমায়
ওরাও ছিঁড়ে খাবে না হয়
তুই আমাকে খা "


কবি এখানেই সার্থক । সচেতন করানোর জন্য কবি লেখেন না । তিনি লেখেন বিবেকের তাগিদে, আর শঙ্খ ঘোষের বিবেক তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী কলম ।



বাস্তু কবিতায় কবি লেখেন -

' আজকাল বনে কোন মানুষ থাকেনা
কোলকাতায় থাকে '


নাগরিক সুখের আড়ালে লেখা হয় বন্যতার গন্ধ ।শ্লেষ এখানে তীব্র ।



'পাগল' কবিতায় -------



'হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন

নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান '

বুদ্ধির কি দীপ্তি , কি শাণিত বাস্তবতাবোধ । মুহূর্তে হয়ে গেল আসল সম্প্রদায় বিভাজন ।
নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরেই লিখলেন এমন এক কবিতা যা আগুন জ্বেলে দিল মননে ।
কবিতার নাম 'সবিনয় নিবেদন' -------------

"আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |

যে মরে মরুক, অথবা জীবন

কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে ।"


শপথ কে রেখেছেন ? কি শপথ ?

শপথ রেখেছেন মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধানগন । সে শপথে মাটির কথা থাকেনা , মানুষ থাকে উপেক্ষিত । শুধু থাকে ঈশ্বরের নামে শপথ । শপথ রেখেছি কথাটা ব্যাজস্তুতি । প্রতিবাদীদের রক্তে , তাঁদের নরকে পাঠিয়ে স্বস্তি পায় মহান রাজনীতি !

'মার্চিং সং ' কবিতায় --

"নেই কোনো সন্ত্রাস
ত্রাস যদি কেউ বলিস তাদের
ঘটবে সর্বনাশ --
ঘাস বিচালি ঘাস
ঘাস বিচালি ঘাস !"

চারদিকে অরাজকতা , সন্ত্রাস , অত্যাচার চলছে আর রাজনীতিকরা বসে আছেন ঠাণ্ডা ঘরে । তাঁদের গায়ে নেই ঘামের এতটুকু দাগ । সব ঠিক আছে , রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে । যারা প্রতিবাদ করবেন তাঁদের জন্য উপহার - 'সর্বনাশ '। গৃহপালিত চতুষ্পদের মত চুপ থাকো , ভালো থাকো এটাই গণতন্ত্রের দান ।



'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা 'বিকল্প' । যেখানে লেখা হয়েছে --



"নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে

ধ্বনি শুধু থেকে গেল ,থেকে গেল বাণী
আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও
একই মত থেকে যায় গ্রাম রাজধানী "


নির্বাক হয়ে যাই পড়লে । সাম্প্রতিকের থেকেও সাম্প্রতিক হয়ে থাকে এই অমর লাইন ।সত্যিই তো কিছুই পাল্টায় না । আলো আছে যার ,থাকে তার। যে তিমিরে থাকে,সে তো আরও অন্ধকারেই ডুবে যায় । রাজা আসে , রাজা যায় ; আমরা জাবর কেটেই দিনগত পাপক্ষয় করি ।



এরই ভেতর হাতে এলো কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ - - ' প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে '। ২০১২ -র মধ্যে লেখা এই বইতে মোট ৫৫ টি কবিতা ।

'ছেলের তর্পণ করছে বাবা' নামক কবিতার কিছু লাইন এরকম -

" প্রশ্ন করে যায় নচিকেতা । প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে ।

নচিকেতা প্রশ্ন করে, অন্যমনে থেকে তার উত্তর পারিনি কিছু দিতে
হৃদয়ে নিইনি কোনো দায়
বলেছি বরং অনাদরে
' চল্‌ তোকে দিয়ে আসি একাকীর দোরে'... "

মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েই যাই শুধু । সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কবি অপরাধবোধের এই ক্ষয় , পুরাণের অনুষঙ্গে ।


'হাসি' কবিতায় একটি মেয়ের যন্ত্রণা তুলে আনেন কলমে অনাসায় কুশলতায় ।


'... নিজেরই জীবনকথা সাতকাহন করে বলতে বলতে

মেয়েটা হেসেই খুন ।
' সবরকম অভিজ্ঞতা হওয়াই তো ভালো এ জীবনে -
ঠিক কি না ? বলো ?
হীনতম অপমানে হতে থাকে দিনগত পাপক্ষয় -
গায়ে না মাখলেই হলো ।
যা- খুশি করুক-না সে, সয়ে যাই সব,
যে যার আপনমতো থাকি।
শেষাবধি জেনে যাবো নরকের যতটুকু বাকি ।'
আবারও খিলখিল করে
বাতাসে বাতাসে তার গড়িয়ে পড়ে হাসি ।"

কিভাবে বিবেকের মত হয়ে উঠেছে কলম । জীবনের নাক্কারজনক কথাও আজ অনায়াসে বলতে হচ্ছে সমাজের কাছে । দোষীকে শাস্তি দিতে চাওয়া এই সমাজ - আবারও কি দেগে দিচ্ছে না মেয়েটিকে । নিরুপায় মন উত্তর খুঁজে নিচ্ছে ' গায়ে না মাখলেই হলো ' ।

লেখনী এখানে চাবুক ।

আর একটি অনবদ্য কবিতা - 'মাওবাদী'


" এখনও কি তুমি প্রতিবাদ করো ?

-- মাওবাদী !
প্রশ্ন করার সাহস করেছ ?
-- মাওবাদী !
চোখে চোখ রেখে কথা বলো যদি
ঘড়ি-ঘড়ি সাজো মানবদরদি
আদরের ঠাঁই দেবে এই গারদই
মাওবাদী --
সহজ চলার ছন্দটা আজ
একটু না-হয় দাও বাদই !

দুচোখে দেখি সর্ষেফুলের মতো থোকা থোকা

মাওবাদী
এখানে-ওখানে দোকানে-বাজারে হাজারে হাজারে
মাওবাদী
বাঁকা হাসি দেখে ঠিকই চিনে যাই
মাওবাদী, তুমি মাওবাদী !"

এই কবিতা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাম্প্রতিক সময় ।চারপাশে যা ঘটছে তাই উঠে আসে কালির আঁচড়ে । আজ কোনো প্রতিবাদ করলেই তাকে এক বিশেষ অভিধায় অভিষিক্ত করে ফেলা হচ্ছে । গণতন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশে কবি এখানে নির্ভয় । মানুষের জন্য স্বার্থহীন হয়ে কিছু করলেও রাজনীতির ধ্বজাধারী'দের আশঙ্কা হচ্ছে । চারদিকে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে, হাসিরও মানে পাল্টে যাচ্ছে । চারদিকে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করলেই হচ্ছে - রজ্জুতে সর্পভ্রম ' ।


'গলাগলি'- কবিতায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা । যার ভালোর জন্য একদিন বোঝা তুলে নিতে হয়, নামতে হয় পথে তারাই একদিন বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যায়। গলাগলি থেকে নেমে আসে গালাগালিতে । বিশেষ কোন যূথবদ্ধ শক্তি তার হিতাকাঙ্ক্ষীকে পরিয়ে দেয় - স্বৈরতন্ত্রী'র চাদর ।


"যে- কেউ তাদের মোট বইয়ে নিতে পারে তোমাকে দিয়ে

গলাগলি করতে করতে
যে- কেউ তোমার ওপর বইয়ে দিতে পারে গালাগালির তুফান
আর তাই
যে- কোনো তন্ত্র এসে হতভম্ব তোমার কপালে
দেগে দিয়ে যেতে পারে দগদগে দাগে :
স্বৈরতন্ত্রী, স্বৈরতন্ত্রী তুমি ।"

আবার লিখছেন --


"দিনদুপুরে ঘরের মধ্যে এসে আমাকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ ।

টেনে নিয়ে যাচ্ছে পথে ।
কী করেছি ? আমি জানতে চাই।
তাদের মুখে ঢাকনা দেওয়া, কথা বলছে না কেউ ,
কাউকে যদিও দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বুঝতে পারছি পথে পথে উৎসুক জনতা ।
... "
( বিচার )
পুলিশ এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র । অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ পালনকারী । মুখ ঢাকা , অবয়ব আছে , আর সেই অবয়ব কেবলমাত্র নির্দেশ পালন করে । সবাই দেখছে শাসন ও শোষণের উপহার ( ! ), কিন্তু তাদের নির্বাক ও অদৃশ্য থাকা ছাড়া উপায় নেই ।


মনুষ্যত্বের নিরুপায় আত্মসমর্পণ, বিকিয়ে গেছে বিবেক, মেরুদণ্ডহীন হয়ে বেঁচে আছি আমরা । সমাজের এই নিয়ত মৃত্যু লেখা হয় আখরবিন্যাসে । কবি এখানে কষাঘাত করেন । বিদ্যুৎঝলক হয়ে ওঠে তাঁর লেখনী,অসহায়তা ফুটে ওঠে যখন লেখেন --



"......'কী খুঁজছেন ?'

মিহি স্বরে বললেন তিনি : ' মেরুদণ্ডখানা ।'
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের । চমকে উঠে দেখি :
একা নয়, বহু বহু জন
একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ- কোণে ও- কোণে ঘর জুড়ে ।"
( হামাগুড়ি )

অসংখ্য কবিতা , তার অসংখ্য লাইন । কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি নিজেই জানিনা । একদম কালানুক্রমিক নয় এই লেখা । হঠাৎ হঠাৎ আসা কিছু কবিতা, কিছু স্তবক,লাইন যেভাবে আমাকে ভাবিয়েছে সেভাবেই লেখা।

আজ যখন চারদিকে সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে তখনও একই থেকে যাচ্ছে নষ্টামি, অস্থিরতা ।


অত্যাচার, শোষণ আসলে ধ্রুবক । এগুলো একই থাকে শুধু জামার বদল হয়। কবিও তাই কখনো কখনো অস্থিরতায় , দোলাচলে ভুগতে থাকেন । দিনের শেষে কবিও হয়তো আদ্যন্ত এক পরাজিত মানুষ ! তাই অসহায় উচ্চারণে লেখেন ----



" এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন

শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !"


শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবিদের একজন যিনি তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেন এক অনিবার্যতায় ।আপাত শান্ত , আদ্যন্ত ভদ্রলোক এই কবির কলমে ভরা থাকে প্রতিবাদের বারুদ ।


শঙ্খ ঘোষ - আমার চোখে - পৃথা

শঙ্খ ঘোষ - আমার চোখে
পৃথা রায়চৌধুরী

 
শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে লিখতে হবে এই দুঃসাহস করিনি কখনো । কিন্তু এই সংখ্যাটি সম্পাদনা করতে গিয়ে আমার বন্ধুর বারংবার প্রেরণায় মনে হল অন্তত একটু হলেও লিখি । লিখতে বসে মনে হল -- সমুদ্র । এত লেখা, এতো সব অনবদ্য কবিতা, প্রবন্ধ -- কি নিয়ে বলবো ! এ যেন সেই নাবিকের মত যে মাঝ সমুদ্রে হাল ভেঙে বসে আছে । ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হল -- শব্দের ব্যবহার কিভাবে করতে হয় এটাই তো আমি শিখছি । আর সেখানে শঙ্খ ঘোষের মত আর কে হতে পারেন ।


বাংলা কবিতায় কঠিন শব্দ বা তৎসম শব্দের ব্যবহার অনেকদিনের । ইদানীং দেখছি এই প্রবনতা আরো বেশী । সেখানে শঙ্খ বাবু'র কবিতা যেন মরুদ্যান । কি সুন্দর সহজবোধ্য শব্দের ব্যবহার,মুখে মুখে বলা কিছু শব্দ নিয়ে অনায়াসে তৈরি করেন অপার রহস্যময়তা । সাধারণ শব্দের সাহায্যে নির্মিত হয় -- অসাধারণ বুনট ।


এই সময় আমার হাতের কাছে খোলা রয়েছে যে বইটি, তার নাম “নিহিত পাতালছায়া”।


“একদিন সে এসে পড়েছিল এই ভুল মানুষের অরণ্যে। হাতে তাদের গা ছুঁতে গিয়ে কর্কশ বল্কল লাগে বারে বারে।
............ আজ তুমি, যে-তুমি অপমান আর বর্জনের নিত্য পাওয়া নিয়ে তবুও মুঠোয় ধরেছ আমাকে, আমাকেই, আমাকে

সেই তুমি আমার অন্ধ দু-চোখ খুলে দাও, যেন সইতে পারি এই পৃথুলা পৃথিবী, এই বিপুলা পৃথিবী, বিপুলা পৃথিবী …” --- এই অসামান্য লাইন কটি কবি শঙ্খ ঘোষের “বিপুলা পৃথিবী” কবিতার।


ছোট্ট সাত লাইনের একটি কবিতা “মাতাল”। তার মধ্যে দিয়ে কবি কি অনায়াসে সার কথাটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন---যৌবনের তেজী রক্ত প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এমন ভাবে যে চারিপাশের ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচারগুলিকে মেনে নিতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে বোধবুদ্ধি সম্পন্ন অবস্থায়। প্রতিবাদী যুবার সুতীব্র প্রতিবাদ নানান ভাবে ভাঙ্গন ধরাতে পারে সমস্ত ‘কু’র মধ্যে; প্রৌঢ়ত্বের শীতল হয়ে আসা রক্ত, সমস্ত কিছু মেনে নিতে শিখে ফেলে বিনা প্রতিবাদে।
“ আরো একটু মাতাল করে দাও।
নইলে এ বিশ্বসংসার
সহজে ও যে সইতে পারবে না!

এবার তবে প্রৌঢ় করে দাও–

নইলে এ বিশ্বসংসার
সহজে ওকে বইতে পারবে না।”

কোনো কঠিন শব্দের ব্যবহার না করেই কবি ‘পাগল’ কবিতাটিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুস্থ মস্তিষ্কে সমস্ত কিছু সহ্য করে চলা দুর্বিসহ; তাই পাগল হওয়াই হয়তো শ্রেয়।

“ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
যা সওয়াবেন তাহাই সয়।” বলে উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক অনেক বেশি অবিচার সহ্য করতে পারে। অত্যাচারিত তারাই, যারা নির্বোধ, বুদ্ধিমানেরা স্বভাবতই ঊর্ধ্বে থাকেন এসবের...
“হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন
নিচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান—
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।”
নির্বোধের স্থান সর্বদা বুদ্ধিমানের পদতলে।

“আজকাল বনে কোনো মানুষ থাকে না
কলকাতায় থাকে।... ব্যঙ্গাত্মক ‘বাস্তু’ নামক কবিতায় উনি মানুষের মধ্যেকার অমানুষটিকে তুলে ধরেছেন। কিছু মানুষের বর্বরতার কাছে বাকি মানুষদের অসহায়তাই লক্ষ্যণীয়। অসহায় এক প্রেমিক তার খোয়া যাওয়া প্রেমিকার জন্য আজও অপেক্ষা করে থাকে।
“শুধু ওই যুবকের মুখখানি মনে পড়ে ম্লান,
প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা ও কেন গলির কানা বাঁকে
এখনও প্রতীক্ষা করে তাকে!”

আপোষ করে চলার মধ্যে প্রতি পদে আমরা নিজেদের ছোট করে চলি, নিজের কাছেই নিজের আত্মসম্মানটুকুও কিছু ক্ষেত্রে বিকিয়ে যায়।

“আরো কত ছোটো হব ইশ্বর
ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে!
আমি কি নিত্য আমারও সমান
সদরে, বাজারে, আড়ালে?”... কবি শঙ্খ ঘোষ ‘ভিড়’ কবিতায় এমন কথাই সহজভাবে বলেছেন।

কোনো কঠিন আভিধানিক শব্দ ব্যবহার ছাড়াই যে কিভাবে আধুনিক আত্মোপলব্ধির কথা কবিতায় লিখে ফেলা যায়, তার নিদর্শন হোলো তাঁর ‘রাস্তা’।

“রাস্তা কেউ দেবে না, রাস্তা করে নিন।
মশাই দেখছি ভীষণ শৌখিন--”
কখন কেউ রাস্তা ছেড়ে দেবে, এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দেবে, সেই কথা ভেবে অপেক্ষায় থাকলে ঠকতেই হবে শুধু; সকলেই নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে একে অপরকে পেছনে ফেলে। সেই প্রতিযোগিতায় জিততে হলে, নিজেকেও পাল্লা দিয়ে ছুটতে হবে বেছে নেওয়া রাস্তায়।

“নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়।
ছিল, নেই—মাত্র এই;”... কবি নিজের ‘ইট’ কবিতায় সাবলীল ভাবে বলে গেছেন, সমস্ত নশ্বর কিছু “ছিল” থেকে “নেই” হয় অবধারিত ভাবে। এই “ছিল” আর “নেই” –এর মাঝে একটি “,” ব্যবহার করে “আছে” পর্যায়টি সুন্দর সহজভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। স্বাভাবিক তিনটি পর্যায়... অথচ, মানুষ সেই সমস্ত পর্যায়কে স্মৃতিতে ধরে রাখে অন্তিমের পরেও।

কবির আরেকটি অসামান্য কবিতা, ‘মুনিয়া’।

“মুনিয়া সমস্ত দিন বাঁধা ছিল।

খুব বারোটায় উঠে চুপি চুপি খাঁচা খুলে

‘উড়ে যা’ ‘উড়ে যা’ বলে প্ররোচনা দিতে
আমার বুকের দিকে তুলে দিল ঠ্যাঙ—
জ্যোৎস্নায় মনে হলো বাঘিনীর থাবা।”
অত্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে থাকা একটি মেয়ে বা নারী, দমকা হাওয়ার মতো বহির্জাগতিক ভালোবাসা ও তার সাথে মুক্তির আলো দেখতে পেলেই পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সেই বাইরের মানুষটির ওপর; সময়বিশেষে এই নির্ভরতা এমন পর্যায়ে হয়তো পৌঁছে যায়, যাতে সে রক্তাক্ত হতে পারে সামাজিকভাবে। সেই মুহূর্তে মুনিয়ার দুর্বল ঠ্যাঙ যেন বাঘিনীর থাবা হয়ে ওঠে।

নারী ও তার অপ্রাপ্তিজনিত অপূর্ণতা নিয়েও কবি সরল ভাষায় লিখেছেন নানান কবিতা। সেই সব কবিতার মধ্যে একটি হল ‘রাঙামামিমার গৃহত্যাগ’। এক গৃহবধূ বাইরের মুক্তির হাতছানির ডাকে সাড়া দিয়ে যখন তাঁর সাধের তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসার পেছনে ফেলে বেরিয়ে পড়েন সেই অনাস্বাদিতের কাছে ধরা দিতে, প্রতি পদক্ষেপে তিনি তাঁর ছাপ ফেলে রেখে এগিয়ে যান...

“ঘর, বাড়ি, আঙিনা
সমস্ত সন্তর্পণে ছেড়ে দিয়ে মামিমা
ভেজা পায়ে চলে গেল খালের ওপারে সাঁকো পেরিয়ে--”
অথচ, তাঁর অন্তরাত্মা পড়ে থাকে এই সংসারের ভেতর—“ছড়ানো পালক, কেউ জানে না!”

এইভাবে শঙ্খ ঘোষ মিশে যান চেতনায়, মননে । তাঁর লেখা পড়তে পড়তে হরিয়ে যাই পরাণখানার গহন অন্তরে । এই অসম্ভব শক্তিশালী কবিকে শ্রদ্ধা জানাই,তাঁর লেখার আলোচনা আমার পক্ষে স্পর্ধা মাত্র । বাংলাভাষা যতদিন থাকবে কবিও থাকবেন তাঁর সৃষ্টিতে , আমাদের মনের মণিকোঠায় ।

সৃষ্টিশীলতা’র মুখ – অমলেন্দু চন্দ

শঙ্খ ঘোষের সৃষ্টিশীলতা’ র মুখ 
কবিতা সাহিত্য আলোচনা ও জীবন
অমলেন্দু চন্দ


লিখতে হবে “শঙ্খ ঘোষ” কে নিয়ে এটা শুনেই আমার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা চুটকি মনে পড়ে গেল।

বাড়িতে আত্মীয় পরিজনদের নেমন্তন্য, উপলক্ষ – সে একটা বিশেষ ব্যাপার। তো এমন ভালো রান্না যে খবর ছড়াল গন্ধে গন্ধে আর দল বেঁধে লোক আসতে আরম্ভ করল – আত্মীয়ের আত্মীয়, তার আবার মানে

আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয়, এভাবে যত সমাগম বাড়ে সুরুয়া ততই পাতলা হয়, শেষ কালে দেখা গেল শুধু জল পরিবেশন হচ্ছে। মানে যত আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয় এলেন তাদের জন্য সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া পরিবেশণ হতে লাগলো।



শঙ্খ ঘোষ আমার এক ভীষণ প্রিয় শিল্পী – না শুধু কবি বলছি না, কারন কবিতা ছাড়াও তিনি দিয়েছেন আরও অনেক লেখা, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র পর্যায় অধ্যয়নে স্বীকৃত প্রামান্য সহায়ক গ্রন্থ। তার প্রণীত --


“নির্মাণ ও সৃষ্টি”, “ঐতিহ্যের বিস্তার” ও “এ আমির আবরন” কাব্যের অবস্থান, আবরন, অলঙ্কার ছন্দ, ভাষা ও জীবন দর্শন নিয়ে এক ভীষণ প্রাসঙ্গিক ধারনা দেয়। “ছন্দের বারান্দা” তো সর্বজনবিদিত, যেখানে


তিনি রবীন্দ্রনাথে শুরু হয়ে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ সমর সেন সকলের শৈলী বৈশিষ্ট এই সব কে তুলে ধরেছেন।



যা বলছিলাম সেই এমন একজন প্রিয় ও চিত্তপ্রিয় লোককে নিয়ে লিখতে গেলে আমার কলম দিয়ে ওই সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া’ ই হয়ত পরিবেশিত হয়ে যাবে, কারন এমন একটা বিশেষ সঙ্খ্যার লেখার উৎসবে আমার


অবস্থা ওই রবাহুত আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয়’ র মতই।


বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া এই চিত্তপ্রিয় ঘোষ আমাদের শঙ্খ ঘোষ। তার কবিতা লেখার প্রসঙ্গে তিনি তুলনা টানেন এক পথ চলার, যেখানে কবিতা দিশারী ও পথ দুইই, বলেন এ যেন “... এক টুকরো

থেকে অন্য টুকরোয় অবিরাম ... পা তোলা পা ফেলার মত ... এক কবিতার থেকে আরেক কবিতায় পৌঁছন...” (১)।


তাহলে কি শঙ্খ ঘোষের কবিতা কোন ক্রোনলজিক্যাল প্যাটার্ন ফলো করে বা একটি কবিতায় অন্য কবিতার সুক্ত বা সুত্র নিহিত থাকে ? সম্ভবত এর উত্তর হোল আরও গভীর – কবিতা তার কাছে ধর্ম,তাকে ধারন আর যাপন সেটাই পথ চলা। তিনি লেখেন

“...খসে পড়া নক্ষত্র বেজে রইল বুকের মাঝখানে...” (ক) যেন


কবিতাই সেই সুক্ত বা মন্ত্র যার সুত্রে তিনি করেন কবিতারই রূপ নির্মাণ। আর তাই হয়ত বলেন “... কবিতা নিজেই নিজের সম্পূর্ণ সত্তা...”(২) । কিন্তু শুধু এইটুকুতেই তার কাব্যবোধের আত্মস্থ গভীরতা ধরা পড়ে না।


ধরা পরে তার প্রাসঙ্গিকতায়! তিনি এমন এক কবি যার কাছে কবিতার চেয়ে কবিতার কিংবদন্তী কিছুতেই বড় হয়ে ওঠে না।


আজকে কবিতা যখন শুধুমাত্র পাঠকের আত্মস্থ গভীরতায় তৃপ্ত হচ্ছে না, সে চাইছে পাঠক শব্দ সমবায় আর সমাহারের অর্থোদ্ধার করুক, শব্দের চরিত্র ও তার বহুমাত্রিক ব্যাবহার কে নিজের রুচি ও শিক্ষার অঙ্গীভূত করে পাঠকত্ব অর্জন করুক, বিস্ময়বোধের নৃতত্ত্ব যেন তার আহরিত বিদ্যার অঙ্গ হয়, সে পাঠক হিসেবে উত্তীর্ণ হোক। আর এই ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের কার্ভে পাঠক বলছেন কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে।


এরকম একটা সময়ের নিরিখে তার কবিতা বা লেখা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রসঙ্গ এসে পড়ে যে তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক। কবিতা উপলব্ধি বা উপলব্ধি না করতে পারার তারতম্যের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি কি


বলছেন বা বলেছেন?



শঙ্খ ঘোষ বলছেন “... নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়...” (২)।


কিন্তু যেখানে নতুন অর্থ সৃষ্টির প্রচেষ্টাই প্রশ্নবিদ্ধ ও দুর্বোধ্যতার তকমা পাচ্ছে পাঠক বা সমালোচকের কাছে, সেখানে তিনি কি শুধু শ্রেষ্ঠ কবি বা শিল্পীর ক্ষমতার দিকে তার ইঙ্গিত সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন?



সেইখানেই তিনি শঙ্খ ঘোষ, কারন তিনি একটা গ্রাহ্য সীমারেখার ব্যাক্ষাত অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। একটা সীমারেখার কথা জীবনানন্দও বলেছেন এ ব্যাপারে যে “... শেষ পর্যন্ত কবিতা সৃষ্টি ও পাঠ (রসাস্বাদন) একেবারে ব্যাক্তিমনের ব্যাপার। কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এতো তারতম্য...”।



জীবনানন্দ কবিতা বোঝা বা না বোঝার অ্যানালিসিস এড়িয়ে গেছেন তার নিজস্ব জীবন ও কবিতা চর্যার নিয়মে, তার ইম্প্রেশানিস্ট আলো আঁধারীর রহস্যময় বিস্ময়ের বিস্তারী বৈচিত্রের আভঙ্গে। শঙ্খ ঘোষ চেষ্টা করেছেন তারতম্যের অন্তরে নিহিত কারন কে তুলে ধরতে, সীমারেখা কোথায় সে সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতময় ধারনা দিতে । তিনি বলছেন শব্দসন্ধানের ম্যানারিস্ম এর কথা একধরনের আড়ম্বরের সঙ্কটের কথা – শব্দ স্বর ও শব্দমুল এর নির্ণায়ক সুর এর প্রতি তার ইঙ্গিত, শব্দকে তার প্রচলিত প্রাচীন অর্থের নিরিখ থেকে একটু বিস্থাপিত করতে চাওয়ার ইচ্ছা যেখানে প্রবল্ভাবে পরিলক্ষিত। তাই বলছেন এই ম্যানারিসম্‌ কবির ও তার কবিতার


“...স্বাতন্ত্র কে ধরিয়ে দেয়, - কিন্তু কবিতার কাজ শুধুমাত্র স্বাতন্ত্র কে বুঝিয়ে দেওয়া নয় ... শব্দ রচনার অতিসাধ্য প্রেরনা শেষ পর্যন্ত কবিকে ওই জড় অভ্যেসের মহাতমসায় ঠেলে নিয়ে যেতে পারে...” (২)।


কি স্বচ্ছ ও নির্মেদ ইঙ্গিত, সীমারেখার দিকে। তার কবিতায় সম্পৃক্ত জীবনবোধ তাকে দিয়ে বলায় যে

“... কবিতার প্রতিমা কবির কাছে একটা যুদ্ধের চিহ্ন, ... জীবনের সঙ্গে লগ্ন হওয়ার ... জীবনের প্রত্যক্ষ সংঘাতে নিজের বোধকে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব কবির...” (৩) এই বোধের প্রতিমা তার কবিতা। তার শব্দচয়ন,


তাদের নির্মেদ শরীর, তাদের অনলংকৃত স্বাস্থের ঔজ্জ্বল্য।



এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন যে শব্দকে


“... যখন বড় বেশী প্রধান করে তুলি ... শব্দ তখন বুঝিয়ে দেয়


যে সে হয়ে উঠেছে এক বিচ্ছিন্ন সত্তা ... বুঝিয়ে দেয় যে সে কোন সংযোগের বাহন নয় তার (কবিতার) ... সে (হয়ে উঠেছে ) কতগুলো আলগা প্রসাধন মাত্র...” (২)। কথাগুলো ভীষণ প্রাসঙ্গিক যে কোন সময়ের নিরিখে।



এক ভীষণ সচেতন মননশীল প্রক্রিয়ার কাজ দেখা যায় শঙ্খ ঘোষের মধ্যে যার আবেশে সেই চেনা জানা সঙ্কীর্ণ পৃথিবীর জগতটার মধ্যে এক ভিন্ন স্থান উঠে আসে যেখানে প্রাপ্তি বিচ্ছেদ, সাফল্য বা ব্যার্থতার তারতম্যের, কামনা বা বেদনার অকিঞ্চিতকর বিবর্তন কে ছাপিয়ে এক নীলকণ্ঠ আকাশ ধরা দেয় –



“... একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি


তোমার জন্য গলির কোনে


ভাবি আমার মুখ দেখাব


মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে...” কবি এখানে সময়ের বহতায় থাকা মুখ আর মুখোসের দিকে ইঙ্গিত করেন, করেন কস্‌মেটিক চেহারার জলছবির দিকে, যার সাথে রয়েছে অঙ্গাঙ্গী বেশ কিছুটা নিরুপায় অবস্থা। যে নিরুপা, অবস্থান আরও স্পষ্ট হয় এই কবিতার শেষ চার পঙক্তিতে -


“... মুখের কথা একলা হয়ে

রইল পড়ে গলির কোনে


ক্লান্ত আমার মুখোস শুধু


ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে” -


তিনি আরও লেখেন --


“ কে কাকে ঠিক কেমন দেখে / বুঝতে পারা শক্ত খুবিই...”।


এটা কি শুধুই সভ্যতার বিবর্তনে মানুষী ক্রাইসিস এর দিকে আঙুল তুলেছেন? আমার মনে হয় এ আরও বিস্তারী – এক নৈতিক মন্তব্য যেখানে ব্যাক্তি, সমাজ রাষ্ট্র অর্থনীতি সব কোথাও না কোথাও প্রচ্ছন্ন ভাবে ইঙ্গিতের ট্রিগারের মুখে রয়েছে। তার কবিতায় এক ধরনের মেসেজধর্মী ইঙ্গিতময়তা থাকে, বা এভাবে বলা ভালো যে তার কবিতা শুধু চিত্রায়ন নয় শব্দে, শুধু ন্যারেটিভ ধর্মী নয়। কিন্তু সেই মেসেজ কখনই তার কবিতার ব্যাগেজ হয়ে ওঠে না, কারন তিনি কখনই তার কবিতায় সময়ের বিনাশী ক্ষমতা কে মরালিস্টিক মুঢতায় আবিল করেননি।

রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থানগত ক্রাইসিস তাকে কতটা নাড়া দিয়েছে সেটা তিনি লিখে ফেলেন --

“লাইনেই ছিলাম বাবা” নামের কবিতা সঙ্কলনে


“তুমি কোন দলে” কবিতায় –



“... কি কাজ কি কথা সেটা তত বড় কথা নয় আগে বল তুমি কোন দলে


...........


বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন কর তুমি কোন দলে


আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসী শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন কর তুমি কোন দলে”



আর এই অবস্থা আর অবস্থানের ক্রাইসিস যে কত গভীরে সেটা প্রকাশ পায় সেই কবিতাটির শেষ লাইনে যেখানে তিনি লেখেন –



“রাতে ঘুমোবার আগে ভালবাসবার আগে প্রশ্ন কর কোন দল তুমি কোন দল”


কি অসম্ভব মনস্তাত্বিক আর ভালবাসার বোধে জারিয়ে আঁকা শব্দছবি, এই সময়ের সমাজসত্ত্বায় পরিবেষ্টিত থাকা সত্তার ক্রাইসিসের ডেটনেটর যা প্রতিনিয়ত মানুষ, তার মন তার মনন, তার সম্পর্কগুলোকে অ্যাফেক্ট করে চলেছে। আর এই কথা তিনি অত্যন্ত সহজ দৈনন্দিনের বহুল প্রচলিত শব্দকে ব্যাবহার করে অনায়াসে লেখেন। যেন এটাই তার শব্দের নবায়ন।


সেই কবির নিজের কথাই আবার করে বলতে হয় – “জীবনের প্রত্যক্ষ সংঘাতে নিজের বোধকে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব কবির...” আর এই বোধের প্রতিমাই তার কবিতা।


তার রাজনৈতিক প্রতীতি এক নির্মল নির্বেদ সাধারনত্যে ভিন্ন হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন –

“ক্ষমতার উৎস থেকে ক্ষমতার মোহনা যা বল / সে কেবল ক্ষমতাকে দাপিয়ে বেড়ান ক্ষমতায়...” (চরিত্র)।


একজন সাধারন মানুষ হিসেবে তার এই বোধ কে স্থান কাল পাত্রের সীমানা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সত্য কথন বলে মনে হয়। ভাবনার বৈচিত্র নয় অনুভবের সান্দ্রতা মুগ্ধ করে।


সহজিয়া কবি তার অনন্যতার ছাপ রাখেন সেই সব পঙক্তিতে যেখানে ছুঁতে চান ও রাখেন তার বৈচিত্রময় ভাবনার শব্দছবি সময়ের আর মানুষের মূল্যায়নে – “... এতো যদি ব্যুহ চক্র তীর তীরন্দাজ / তবে কেন শরীর

দিয়েছ শুধু বর্মখানি দিতে গেছ ভুলে...” (বর্ম)(৪) । অনন্য জৈবনিক শব্দপ্রতিমা ধরে রাখে অদ্ভুত সত্যির এক আভাষ সহজাত হৃদয় বৃত্তির অনুষঙ্গে। তবু কিন্তু কোথাও মানুষ এক ক্রীড়নক এই তত্ত্ব উঠে আসে না তার কবিতায়, জীবন সম্বন্ধে এতটাই তার সম্ভ্রমবোধ, এতটাই তার ভালোবাসা।



একধরনের ডিফারেন্ট লেভেল অফ কন্সাসনেস এর কাছাকাছি যেটা আমাদের নরমাল কগ্নিসান অফ এক্সপিরিয়েন্স অফ লাইফ কে ছাপিয়ে যায় সেইখানে পৌঁছে দেন পাঠককে, পাঠকের উপলব্ধি কে যেখানে প্রেম


ভালোবাসা জীবন প্রার্থনা সব এক সঙ্গে জড়িয়ে থাকে –



"বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে

তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট

তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস

সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাত্ পেয়েছে তার মানে

নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান

মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে ।"


কি নম্র আনত জীবনজায়িনী প্রায় এক অতিলৌকিক রম্যান্টিসিস্ম এর স্বাদ বয়ে আনে এই সব পঙ্‌ক্তি যেখানে কবি তার নিজের ধরনে প্রায় মিস্টিক হয়ে ওঠেন আবার সেই সব অনুভুতিময়তাকে তা, সীমানায় ধরে রাখেন জীবনের মাটিতে, বলেন প্রেমের কথা, ভালবাসার কথা, যার সন্ধানে তিনি এখনও হাল ছাড়েননি। এ যেন সেই অ্যাব্রাহাম ম্যাসলো’র সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেসান যে প্রসেস প্রতি মুহূর্তে নিজে কেন্দ্রাতিগ হয়ে বাইরে ছুটে যায় আবার কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে জীবনের দিকেই ফিরে আসে। অদ্ভুত সুন্দর ইন্ট্রোভারটেড রিফ্লেক্টিভ লিরিসিস্ম। গ্রেস আর ডেপথের অদ্ভুত সুন্দর সমাহার। দেহাশ্রয়ী মানুষের ভালবাসার স্বাভাবিক বৃত্তি এ কবিতার পরিনতিকে ব্যাঞ্জনাময় করেছে।


প্রতিরোধের জটিলতা সত্ত্বেও শালীনতা বজায় রাখা পঙক্তিতে লেখেন এক নিবিড় সত্তার অনুভুত এমন অনেক কিছু যা মেনে নিতে হয় কিন্তু কিছুতে মনে নেওয়া যায় না, বলে ওঠেন –

“... লজ্জা বাকি আছে কিছু


/ এটাই লজ্জার, এখনও মজ্জার / ভেতরে এতো আগুপিছু...” ।


স্বচ্ছ ইঙ্গিতময়তা এত শালীন এত নিবিড় এতগভীর থেকে উঠে এসেছে যা মুগ্ধ করে। এক ধরনের অ্যাঙ্গুইস চিত্রায়িত যেন। ভাললাগার এইসব পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আবার সেই সীমারেখার বোধের কথা স্মরণযোগ্য। তার

প্রকাশভঙ্গীর সরল পেলব সৌকুমার্যের পাশাপাশি বর্তমান একজন স্থিতধী বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ চিন্তা চেতনার যখন প্রাসঙ্গিকতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন--


“... প্রাসঙ্গিক বলতে বোঝায় যে সেটা অনুধাবনযোগ্য, সেটা অনুসরণযোগ্য নাও হতে পারে...”।


স্মৃতির কাজ জীবনের এক দ্বিতীয় রূপ সৃষ্টি করা (শিশিরকুমার ঘোষ)। শঙ্খ ঘোষের “ছোট্ট একটা স্কুল” ও “অল্প বয়েস, কল্প বয়েস” এ সংহিত সমন্বিত রচনা গুলি পড়তে পড়তে এই কথাটা অনন্য অর্থ নিয়ে ভেসে ওঠে পাঠকের উপলব্ধিতে। দারুন কোন রচনা নয়, কিন্তু এগুলো তার ছেলেবেলার স্মৃতি কে

রুপময় করেছে। ভালো লাগে। দে আর হোয়াট উই কল অ্যাজ স্কেচেস ইন ওয়ার্ডস।


এই স্কেচধর্মীতা তার কবিতায় ভীষণ ছাপ রাখে, যা মাঝে মাঝেই ব্রাশের টান হয়ে যায়, যেমন এই কবিতাটি – অনন্য জলরঙের অ্যাবস্ট্রাক্ট ধর্মী পেইন্টিং যেন –


“চুপ কর, শব্দহীন হও’ – এক অনন্য অ্যাঙ্গুইস -


এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর

লেখো আয়ু লেখো আয়ু

ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও


এ এক ইঙ্গিত মুখর রূপ জগতের অনুভুতি, কোন চিত্র নেই কোন দৃশ্য নেই তবু যেন অনুভুতি এক অমেয় মাত্রায় চিত্রায়িত।


মাত্রাচেতনা শঙ্খ ঘোষের কবিতার এক সতত ক্রিয়াশীল লিটমাস। বোধহয় এ সেই মাত্রা চেতনা যা তার কবিতায় সে ভাবে নারী কে ছেনে দেখতে চায় নি। মানুষী অস্তিত্বের চিরন্তন অর্ধেক ভাগ, তার সম্পর্কিত বোধ বা সেই সান্নিধ্যের দ্বন্ধ বা বাস্তবিকতা, সেখান থেকে উঠে আসা আশ্লেষ বা মন্থন, বা


সেখান থেকে ধেয়ে আসা চঞ্চলতা বা অস্থিরতার ধন্ধ, আমার বিচারে, তার কবিতায় সে ভাবে উঠে আসে নি। খুব সচেতনভাবেই সম্ভবত এ দিকটা তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন তার মাত্রা চেতনার অঙ্গুলিহেলনে। নারী সে অর্থে


রক্ত মাংসের হয়ে ওঠে নি তার কবিতায়।



আমার মনে হয় এই সচেতন অ্যাভয়েড করা উঠে এসেছে তার “ভয়” কবিতায় – হয়ত আমি ভুল, তবু


এটাই মনে হয় যখন এই লাইনগুলো পড়ি –



"ভয়? কেন ভয়? আমি খুব

শান্ত হয়ে চলে যেতে পারি।
তুমি বলো ভয়। দেখো চেয়ে
অতিকায় আমার না-এর
চৌকাঠে ছড়িয়ে আছে হাত-
যে হাতে সমুদ্র, ঘন বন,
জ্যোতির্বলয়ের ঘেরাটোপে
শ্বাপদসুন্দর শ্যামলতা
রক্তপাত, জীবনযাপন।
প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর
স্মৃতি শুধু, ইতিহাস আছে-
তুমি আর আমি শান্ত তার
প্রবাহদুয়ার রাখি খুলে।

তার মাঝখানে যদি পেশি

একবারও কেঁপে ওঠে, সে কি
ভয়? ভয় নয়। ভয় শুধু
শূন্যতাও যদি মুছে যায়-
শুধু এই প্রতিধ্বনিহীন
অস্তীতির ঘট ভেঙে গিয়ে
কোথাও না থাকে যদি না
তার পায়ে উঠে আসে ভয়
শূন্যতাবিহীন শূন্যতায়।"

ভয় শুধু / শুন্যতাও যদি মুছে যায়-/ শুধু এই প্রতিধ্বনিহীন/ অস্তীতির ঘট ভেঙে গিয়ে/কোথাও না থাকে যদি


না/ তার পায়ে উঠে আসে ভয়/ শুন্যতাবিহীন শুন্যতায় –।



অন্য মাত্রায় ভাবতে গেলে মনে হয় এ লেখা যেন তার সেই দেশ ভাগের অনুভুত অ্যাঙ্গুইস। কিন্তু শুধুই কি তাই? আর তাই এ কথাই আমার বেশী মনে হয় যে তার বোধের প্রতীতি তে তিনি খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন রক্ত মাংসের নারীকে। যেখানে চেষ্টা করেছেন সেখানে নারী বড় আলঙ্কারিক হয়ে রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে আরও নাড়াচাড়া করেছেন যারা তারা হয়ত আরও ভালো বলতে পারবেন।


তিনি ইকবাল কে নিয়ে দীর্ঘদিন নাড়া চাড়া করেছেন, ফারসি থেকে নয়, প্রোফেসর আরথার জারবেরি’র জাভেদনামা’র ইংরেজি অনুবাদ থেকে কাজ করেছেন। বিদগ্ধ দের প্রসংসাপ্রাপ্ত এই প্রচেষ্টা ।

১৯৫৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় “দিনগুলি রাতগুলি” আর সেই সুত্রেই কৃত্তিবাসে তিনি অনেকখানি ক্রিটিক্যাল অ্যাটেন্সান পেয়ে যান তৎকালীন এক ঘোষিত কবিপ্রতিভা হিসেবে। সেই শুরু। ১৯৯৯


সালে তার বাংলায় অনুদিত নাটক “রক্তকল্যান” [ মুল নাটক গিরীশ করনাড (১৯৮৯)]। করনাডের এই কাজ ১২শ শতাব্দীর বাসভ আন্না নামিত তৎকালীন দক্ষিন ভারতের এক রিফরমারের কাহিনী, তার কাস্ট রিফরম চেষ্টা ও তার ভায়লেন্ট ঐতিহাসিক পরিনতি সেই সময়ের সমাজে।


৮০ র দশকের মন্ডল মসজিদ ইত্যদি কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ ও সেই সংক্রান্ত অ্যানালজি টানা রচনা ছিল করনাডের মুল নাটক। শঙ্খ ঘোষের কাজ (ওই নাটক নিয়ে) যথেষ্ট সমাদৃত।


সারা জীবন অসংখ্য লেখা লিখেছেন, যার মধ্যে অনেক গ্রন্থই প্রামান্য বলে স্বীকৃত, যেটা আগেও বলেছি। “এ আমির আবরন” গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সঙ্কলন। সেই গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লেখেন “ সুর নয়, কথা...” হোল তার মৌল আলোচ্য বিষয় এই সব লেখায়। তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথের “মনের এক ইতিহাস প্রচ্ছন্ন আছে তার গান গুলির মধ্যে...”।

এর পরের গ্রন্থ (১৯৮২) “নির্মাণ আর সৃষ্টি” তে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান সাহিত্যের সঙ্গে তার ছবি আঁকা র মিল দেখানর, সুর ধরানর চেষ্টা করেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ “ছন্দময় জীবন”।

শিল্পসৃষ্টিকে নানা অ্যাংগল থেকে দেখা ও তার বিবরন – মুলত রবীন্দ্রশিল্পকে কেন্দ্রে রেখে লেখা এই প্রবন্ধমুলক গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লেখেন – “মানুষের শিল্পের উপাদান তো কাঠপাথর নয়, মানুষ নিজে। বর্বর অবস্থা থেকে মানুষ নিজেকে সংস্কৃত করেছে, এই সংস্কৃতি তার স্বরচিত বিশেষ ছন্দময় শিল্প”।



শঙ্খ ঘোষের আর একটি সুন্দর রচনা “কবির অভিপ্রায়” গ্রন্থটি। এটি কতগুলো লেকচারের সঙ্কলন, রবীন্দ্রচর্চায় নিবেদিত এই গ্রন্থে অভিনব প্রয়াস হয়েছে লেখক, লেখা ও পাঠকের ভিন্ন বা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সুন্দর পর্যালোচনা।


অত্যন্ত আত্মস্থ এক ভদ্রলোক কবি যার সবকিছুই ভীষণ ডিসিপ্লিন্ড, সেই ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে তার একটি লেখা দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি। প্রসঙ্গক্রমে আগে বলেছিলাম যে তিনি তার সীমারেখা ভীষণ ভাবে জানেন এবং সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন রক্ত মাংসের প্রতিমা – শুন্যের ভেতরে ঢেউ – তার আর এক উদাহরন বলে আমার মনে হয় –

বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।

কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না


অত্যন্ত মরমী দরদী শুদ্ধতায় নিবেদিত প্রান সহজিয়া ছান্দসিক এই কবি সম্পর্কে একটা কথাই খাটে – হে শিল্পী তুমি যাকে স্পর্শ কর সেই দেখ শিল্প হয়ে ওঠে। জীবন্ত নারী প্রতিমা নাই বা রইল তার লেখায়, যা আছে তাই অনন্য ছায়া মায়ার সরোবরে ডুব চান দিয়ে উঠে আসে। তিনি হলেন সেই জাতের শিল্পী যে নিজের সীমারেখা ভীষণ ভাবে চেনেন এবং সেই সীমারেখার মধ্যে থেকেই অনবদ্য এক্সেলেন্ট হয়ে ওঠেন। দুর্গম বা


ধ্যানগম্যতার লক্ষন তার কবিতায় সে ভাবে ছাপ রাখে না, বরং বুদ্ধি আর আবেগের সমন্বয় তার কবিতার উৎসমুখ।


বাংলার এই কবি একাশি বছরে পা রাখলেন। অভিনন্দন। কখনও কখনও আমার মনে হয় যে রেওয়াজ আছে তাই আমরা কবিতা প্রকাশ করি, বিচার করি, চর্চার অনুষঙ্গে কুতুহল, সহানুভুতি ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে গভীরাত্মক আলোচনায় ধিক্কার বা বাহবা কুড়োই। এত আদর যেখানে , সেখানে আমার অবাক লাগে যে এদের সৃষ্টি নিয়ে এতো লেখার বাজারে এদের জীবন নিয়ে প্রামান্য কোন স্বাদু জীবনী কেউ লেখে না – কেন সে প্রশ্নের উত্তর মহাকাল দিতে থাকুন, আমার মনে হয় এটাই বাংলা কবিতার সাধ সাধ্য আর আরাধ্য সাধনায় নিরত থাকা লোকেদের ভবিতব্য, কারন জীবনী লেখা বাঙ্গালীর ধাতে নেই। তিনি বাঁচুন আরও অনেক বছর এই কামনা কবিতা সাম্রাজ্যের একান্ত পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা আমাদের এই মুগ্ধ সম্ভ্রমের।


উদ্ধৃতি – ১) কবিতার মুহূর্ত ২) নিঃশব্দের তর্জনী ৩) শব্দ এবং সত্য ৪) মূর্খ বড় সামাজিক নয়


উদ্ধৃতি কবিতা – ক) বিপুলা পৃথিবী , (ও অন্যান্য আর অনেক) -


অমোঘ শঙ্খ ধ্বনি - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

অমোঘ শঙ্খ ধ্বনি
শর্মিষ্ঠা ঘোষ


কবিতা আমায় নষ্ট করলো তেরোতে । কবিতা হয়ে উঠলো আমার ‘ নষ্ট প্রভু ‘ অতঃপর । একটা বয়সে সব বাঙ্গালিই অল্পবিস্তর কবিতা চর্চা করে , সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রেমে পড়লে । সেই চর্চা অনেকটাই নষ্ট হয় সময় নামক প্রভুর কাছে বশ্যতা স্বীকারের মাধ্যমে ।মুষ্টিমেয় লড়ে যায় তারপরও , জীবনের প্রেম অপ্রেম ছাড়িয়ে বৃহত্তর জীবনযাপন চালচিত্রের অঙ্গ হয়ে ওঠে তখন কবিতা । তো আমি কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম কয়েকজনের হাত ধরে । কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য । ‘কবিতা কল্পলতা ‘, কেবল হয়ে থাকেনি তাঁর কাছে , রঙ্গ , ব্যঙ্গ , তির্যক কথন , প্রবল কাব্যিক চপেটাঘাত নীতি ভ্রষ্ট সামাজিক প্রভুদের নধর লালিমাযুক্ত গালে এমন মসৃণ আর কে দিতে পারেন ? কাজেই দিনেদিনে সে প্রেম বেড়েই চলে । ছন্দে মজেছিলাম প্রথমে ,তারপর বয়সোচিত মানসিক বন্ধন তৈরি হোল , কবিতার অন্তরাত্মা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা , আত্মিকরন সে এক প্রবল পরাক্রমি শব্দমালাকে , পেটোর মতো ফেটে পরে যারা আমার সামান্য সন্দিগ্ধ আচরণ ছিন্নভিন্ন করে , সাহস জোগায় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার স্বার্থপরতা ঝেড়েফেলে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার ।


তাঁর কবিতায় তুমুল প্রেম আছে , কিন্তু তাঁর কোন পেটেন্ট প্রেয়সী নেই , আর সেইজন্যই বোধহয় , তাঁর কবিতায় আরও বেশিকরে নিজেকে দেখি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে , লজ্জাহীন । মনে হয় , আরে , আমিই তো সেই ।আদ্যন্ত রোম্যান্টিকতা তো আছেই ,আমার প্রেমের চিঠিগুলো ভরে উঠতো তাঁর লাইন কোট করে করে । ছেলেমানুষি প্রেম ভেঙ্গে গেলে সান্ত্বনা খুঁজি তাঁর অমোঘ ‘কাব্যতত্ত্ব’ তে, ‘ মানুষ তো আর শালগ্রাম নয় ঠিক / একইরকম থাকবে সারাজীবন / মাঝে মাঝে পাশ ফিরতেও হবে / মাঝেমাঝেই উড়াল দেবে মন ‘। কমোডিটি সর্বস্ব বাঁচায় সহজ সরল কথাগুলো আমাদের মাথা ঠুকে মরে বিজ্ঞাপনে । সামাজিক থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় আমরা মুখে ঝুলিয়ে রাখি মুখোশ।অথচ কি প্রাঞ্জল , কি সহজ , কি সুগভীর তাঁর উচ্চারণ,কথাগুলি আমার মরমে পশে , আকুল করে আমার বেঁচে থাকা যখন পৃথিবী হুঁশিয়ারি দেয় , ‘ তোমার কোন বন্ধু নেই তোমার কোন বৃত্তি নেই / কেবল বন্ধন ‘। অসীম যন্ত্রণায় , প্রবল একাকীত্বে , মৃত্যুচেতনা যখন নির্ভেজাল গ্রাস করে ফেলতে চায় আমার সমস্ত তনুমন , তখনও কি গভীর প্রত্যয়ে , কি ব্যাপক নির্ভরতায় ফিরেছি আমার প্রথম প্রেমিকের কাছে ,তাঁর দর্শনে, ‘ হলে হলো , না হলে নেই । / এইভাবেই / জীবনটাকে রেখো ।‘ রবীন্দ্রগান , কবিতার পরে তিনি ই আমার আত্মার আনন্দ , প্রাণের আরাম , কষ্টের সাথী , প্রেমের সাক্ষী , অপ্রেমের সান্ত্বনা ,’ সেই সনাতন ভরসাহীনা অশ্রুহীনা / তুমিই আমার সব সময়ের সঙ্গিনী না ? / তুমি আমায় সুখ দেবে তা সহজ নয় / তুমি আমায় দুঃখ দেবে সহজ নয়। ‘


কবিতার ভাষা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা বরাবরই চলছে, চলবে । অনেকেই তৈরি করেন স্বতন্ত্র স্টাইল ; কেউ কেউ ভালোবাসেন রহস্যময় আড়াল , চান পাঠক মস্তিষ্কের অনুশীলন করুক আগে ,যোগ্য হয়ে উঠুক কবির প্রজ্ঞার। নির্বোধ পাঠক কবিতার সাথে আইডেনটিফাই করলো কিনা তাতে তাঁর কোন মাথাব্যথা নেই । কিন্তু সত্যি বলছি , শঙ্খ ঘোষের লেখা পড়তে গিয়ে আমি কখনো আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগিনি । কখনো হীনমন্যতায় ভুগিনি , কখনো মনে হয় নি , তিনি গ্রহান্তরের বুদ্ধিজীবী ,যার সিগন্যাল অ্যান্টেনা ছাড়া ধরা যায় না । আর এই জন্যই হয়তো আমার সে প্রেম আরও বেড়ে চলে , বয়সের সাথে , ম্যাচিওরিটির সাথে আরও গভীর হতে থাকে , আরও নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হতে থাকে,তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এক প্রিজম, যার বর্ণবিচ্ছুরণ আমার অস্তিত্বের এক একটা পরত উন্মোচন করে আমায় ব্যাপক রোমাঞ্চের সন্ধান দেয় । রক্তমাংসের অবয়ব ধারণ করে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ,আমার যা যখন যাকে বলার দরকার , সবই দেখি তিনি কথা জোগান সময়মত।আমি অবসেসড হয়ে পড়ি। আমার বোধের এক্সফলিয়েসান হয় , বোধি লাভ করতে পারি এমন আমি কেউকেটা নই । কিন্তু বুক বাজিয়ে বলতে পারি , ‘ আমি খুব ভালো বেঁচে আছি ‘ ,তাঁর কবিতার ‘ সংসারে কানামাছি ‘।তিনি আজীবন শহর কেন্দ্রিক জীবন যাপন করেন , কিন্তু কোলকাতা শহর নিয়ে তাঁর কোন ভান নেই ।কি অবলীলায় আমিনার বর বলে ওঠে , ‘ কইলকাত্তার পথে ঘাটে অন্যসবাই দুষ্ট বটে / নিজে তো কেউ দুষ্ট না ... কইলকাত্তার লাশে / যার দিকে চাই তারই মুখে আদ্যিকালের মজা পুকুর / শ্যাওলাপচা ভাসে’। জীবন থাকতে তাই সে আর কোলকাতায় যাবে না ।


‘লাইনে ‘ থেকেও লাইন ভাঙার মুরোদ তাঁর আজও অক্ষুণ্ণ , সাম্প্রতিক রাজ্যরাজনীতির প্রেক্ষিতে তা বারবার সামনে এসেছে, আসছে । সেইসাথে ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ সমাজ রাষ্ট্র সময় আর মানবিকতার । আছে ধিকিধিকি ক্রোধ , আছে মরমিয়া মন , অন্যায় যে করে তার মুখের ওপর বলে ওঠার স্পর্ধা , না , তিনি কারুর ‘ইয়েস ম্যান ‘ হন নি ।তিনি জানেই ‘ এই মুখ ওই মুখ সব মুখ সমান’ ... ‘ না – এর পর না , না – এর পর না, না – এর পর না’। ‘ মত তা – ই যা আমার মত / সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ / জ্ঞানীও সে, এমন – কী আপনলোক , প্রিয় । তার চাই / দুপাঁচটি পালকলাগানো টুপি , ছড়ি’। এদিক থেকে প্রবল অহংকারী তিনি । বশ্যতা স্বীকার শিল্পীর ধর্ম নয় । শঙ্খ ঘোষও দাপটে শাসন করছেন তাঁর কাব্য সাম্রাজ্য ।কুডোস।



বাংলা কবিতায় “শঙ্খ” ধ্বনি - ঊষসী

বাংলা কবিতায় “শঙ্খ” ধ্বনি
ঊষসী ভট্টাচার্য


“প্রতি মুহূর্তে স্নাতক যে আমি,প্রতি মুহূর্তে শব-
সে আমির মাটি বুক ভেঙে তোলে স্পন্দিত পল্লব।
সে আমিতে এসে হাজার আমির ঢেউ তোলে জাহ্নবী-
পথে আনপথে গঞ্জে বাজারে, আলীন সে –আমি কবি”

লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগানোর এবং স্বাধীনতা বিস্বাদে ভরা উত্তাল এক সময়-পঞ্চাশের দশক। দেশভাগের ম্লান ক্লান্তি ও রাজনীতি, অর্থনীতির নতুন অনিশ্চয়তায় তখন ধুকছে কলকাতা তথা সমগ্র ‘কলকেতিয়া’ সভ্যতা। কিন্তু নতুন কলমে উঠে আসছে না কোন দামাল হাওয়া বা কলমের রক্তাক্ত প্রতিবাদ । যৌন সাহসিকতা ,প্রেমের অহংকার আর অহংকারের প্রেমে মাতাল তখন কবিকুল। সেই সময়ে “দিনগুলি রাতগুলি” কাব্যগ্রন্থের হাত ধরে আবির্ভাব কবি শঙ্খ ঘোষের।‘নিভন্ত চুল্লিতে’ আগুন দিতে ও আরেক টু কাল বেঁচে থেকে বাঁচার আনন্দ নিতে এবং দিতে তিনি এলেন । তিনি বাংলা কবি ও পাঠক সমাজকে যেন বললেন “ একটু নড়ুন, চাপ সৃষ্টি করুন” । বাংলা কাব্য জগতে নতুন রুচি ও সম্ভ্রম নিয়ে এলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের ‘নুরলজিয়ার ব্যাথার’ বাঁশির সুর বুকে গেঁথে তিনি সৃষ্টি করলে আধুনিকতার নতুন মেঘমল্লার । তার কবিতার জবানীতে ভেসে উঠল-

“তুচ্ছ নীল বেদনা যদি ঘনিয়ে ওঠে বুকে,
বেদনাবতী – ধুলোতে তারা লুটোবে তার ও আগে,
আমার প্রতি রক্তকনা কবিতা কর ...

শঙ্খ ঘোষ এর কবিমানস নির্জন ও ঐতিহ্যানুসারী । বিগত দশকের কবি বিষ্ণু দে,সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় , অরুণ মিত্রের যথার্থ উত্তরসূরি তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর কলমের জোরে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের পরবর্তি কাব্যগ্রন্থগুলি হোলো- ‘নিহিত পাতাল ছায়া’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’ , ‘বাবরের প্রার্থনা’, , ‘তুমি তো তেমন গৌরি নও’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, প্রহর জোড়া ত্রিতাল’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’, ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ প্রভৃতি।

‘কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ-
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে’ ...

কবি শঙ্খ ঘোষ তথাকথিত ঝাঁকযমক পূর্ণ নন ,তিনি থাকেন ‘ আপাত সারল্যের আড়ালে’ । পুড়ে যাওয়া জীবনে, খসে পড়া সমাজে থেকে তিনি পাঠককে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন । এবং কবি কণ্ঠে ভেসে ওঠে “ ধ্বংস করে দাও , আমাকে যদি চাও, / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক”।

দেশকাল সমাজ পরিবেশের ক্রমাগত ভেঙে পড়ার শব্দের পাশাপাশি জীবনের প্রজ্ঞা ও অনুকরণীয় দার্শনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে তার কাব্যচর্চা । টুকরো শব্দের চমকে ঠমকে সংহত পরিসরে তিনি পাঠক মনের গভীরে ডুব দেন – “ প্রতি মুহূর্তে ধান আসক্ত মুঠোয় রাখি ধরে/ তার পরে যায় যদি অবাধ সন্ন্যাসে ঝরে যায়/ এই মাঠে আসে যারা সকলেই বোঝে একদিন/ এক মুহূর্তের মুখ আরেক মুহূর্তে সত্য নয়”

কবি হওয়ার পাশাপাশি তিনি অধ্যাপক,সমালোচক, রবীন্দ্র আলোচক এবং ছান্দসিক।

কবিতায় ছন্দের ব্যাবহার, অন্তমিল এর পাশাপাশি ছন্দের তরঙ্গায়িত খেলা উল্লেখযোগ্য । কখনো শ্লেষের মাধ্যমে কখনো জীবনাভূতি বর্ণনায় তিনি যে বিচিত্র ছন্দের দোলা দিয়েছেন তা বাংলাকবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার ‘বাবুমশাই’ নামক কবিতার ব্যাঙ্গের মাধ্যমে আমরা সেই অপূর্ব দোলা অনুভব করি-

“আমরা ঢের বুঝেছি
আমরা ঢের বুঝেছি, খেঁদি পেঁচি নামের এসব আদর
সামনে পেলেই ভরবে মুখে প্রাণ ভরে তাই সাধো
তুমি সে বন্ধু না,
তুমি সে বন্ধু না যে ধুপধূনা জ্বলে হাজার চোখে
দেখতে পাবে তাকে সেকি যেমন তেমন লোকে ... ।

আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয় মর্জি নিয়ে’। শঙ্খ ঘোষ আধুনিক মর্জির কবি। যিনি আধুনিকতা কে স্বেচ্ছাচার মনে করেননি বা ‘হাংরি’ দৃষ্টিতে আধুনিকতা বিচার করেন নি। তাঁর আধুনিকতা শুনতে পেয়েছে “শব্দ কোরো না/হেসো না বাচ্চা/ চুপ, হাত পা ছুঁড়ো না ।

কবি সম্প্রতি কয়েক বছরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হোলো- “সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি”, “হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ” , “ প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে”

বয়সের ভার এবং জীবনের ক্লান্তি তবু কবির হৃদয়ে এক বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। যা পাঠক তথা বাংলা কাব্য জগতে এক যুগের সৃষ্টি করেছে তা বলা বাহুল্য মাত্র। কবি কলমে তাই উঠে এসেছে “ স্মৃতির চেয়ে কোন বাস্তবিক বাস্তুভুমি নেই”

তবু সময়ের ‘লহমা’য় কবির ‘স্বপ্নগুচ্ছ’ কখনই ম্লান হয়না। আধুনিক দরবারে তা হয় প্রতিভাত। তাই আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে শঙ্খ নিনাদ তাঁর মাধুর্যে চিরকাল আসীন থাকবে।