শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

জেগে ওঠো - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

জেগে ওঠো 'ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম'
গৌতম চট্টোপাধ্যায়

 
সে কতদিন আগের কথা ! বোধয় ১৯৭৯। সপ্তাহে ৪/৫ দিন ৫-৩০ নাগাদ ডবল ডেকার বাস ধরতাম যাদবপুর ৮বি বাস স্ট্যান্ড থেকে। সোজা দোতলার সামনের কাঁচের কাছাকাছি সীটে জায়গা পেলেই বসা আর কখনো কখনো বিনয় মজুমদারের কল্পনাকে স্বাগত জানানো ~ আমারো মনে হোতো এখানে বসে সত্যি-ই তো ঝাউগাছের ডাল নেড়ে গাছের পাতাগুলিকে, পাখীদের ধুলোট ডানাগুলিকে, ফুলের পাঁপড়িগুলিকে, এমনকি স্থানু-অস্থানু নরনারীদের পোষাক অথবা চুলের ময়লা অনায়াসে পরিষ্কার করে দেওয়া যায় ! একেকদিন নিজেকে অসামান্য লাভবান মনে হোতো ~ হয়তো দেখতাম শঙখ বাবু'র পাশের সীটটাই খালি অথবা কখনো আমি বসে আছি আর তিনি এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে । অনেকটা শ্রদ্ধার জোরাজুরি করেই তাঁকে বসানো যেত । নেহাত-ই সৌজন্য বিনিময় অথবা কোনোদিন তাঁর সাম্প্রতিক কবিতাটির প্রতি আমার মুগ্ধতা জানানো । বাংলা কবিতা'র এই সরলবর্গীয় ঋজু মহাদ্রুম-কে অহরহ প্রণিপাত হই আর ভাবি নীরব এই মানুষটি সামাজিক অভিঘাতে কেমন করে শার্দূলগর্জন করতেও জানেন !!


১৯৮৫/৮৬ সাল হবে বোধয় ~ চিরক্ষ্যাপা জ্যোতির্ময় দত্ত তখন মগ্ন রয়েছেন 'কলকাতা ২০০০' পত্রিকার সম্পাদনায়। সেবছর শরত সংখ্যাটিতে তিনি এক কবিকে আবিষ্কার করলেন, তার আগে বা পরে কেউ সেই কবির নাম শোনেননি বলেই মনে হয়। কবি রঞ্জিত গুপ্ত ~ পরিচিতিতে জ্যোতিদা লিখেছিলেন ~ " হ্যাঁ, এই সনেট-অনুবাদক রঞ্জিত গুপ্ত-ই হচ্ছেন সেই নকশাল দমনকারী পুলিশ কমিশনার, পোলো ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, নৃতাত্বিক, চাষী, এবং ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রঞ্জিত গুপ্ত, আই পি। একটি রেণেসাঁ চরিত্র।" আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি মামুলি রং চড়ানো অতিকথন বা বর্জনীয় পরিচিতিমাত্র... একে নিয়ে বেশী গুরুত্ব দেবার কিছু নেই... ওরকম কবি প্রতিদিন জন্মায় এবং মারা যায়...ইত্যাদি। না, পরের সংখ্যাতেই এক দুর্ধর্ষ চমক 'কলকাতা ২০০০' পত্রিকায় ~ 'একটি চিঠি' প্রকাশিত হয়েছিলো, 'প্রিয় জ্যোতি' সম্বোধন সেরে কবি শংখ ঘোষ তাঁর জিহাদ প্রকাশ করেছিলেন। সবিনয় মূর্তি'র আড়াল থেকে জেগে উঠেছিলো এক মানুষের মুখ, এক প্রতিবাদী বিবেক, এক স্নেহশীল শিক্ষকের নিরাভরণ উপস্থিতি।


বিতর্কিত এই সংখ্যা-তেই প্রকাশিত হয়েছিলো আমার প্রিয়বন্ধু শান্তি নাথের উপন্যাস 'ভূ-নয়না' ~ লেখক পরিচিতিতে ছিলো 'শান্তি কাজ করেন রেলে'। আরেক মুখচোরা লেখক শান্তি তখনো সামনা সামনি পরিচিত হয়নি শংখবাবু'র সাথে। উপন্যাসটি ছিলো প্রখ্যাত ৭০ দশকের পট-ভূমিকায় লেখা। শংখবাবুর সমালোচনার উৎসমুখে ব্যবহৃত হতে থাকলো ভূ-নয়না'র রেফারেন্স। পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত গুপ্ত, IPS, দেবী রায়, রুণু গুহ নিয়োগী, রজত মজুমদারদের মত অত্যাচারী পুলিশ অফিসারদের পিস্টল থেকে যেসব ক্ষীরের পুলি বেরিয়ে আসতো সেসব খেয়ে কত তরুণের, কত জিনিয়াসের প্রাণ গেছে সেসব কাহিনী আমাদের মানে আধ-গেরস্তী বিবেকবান সাহিত্য-সেবকদের অজানা ছিলোনা, তবু কেউ জ্যোতিদাদা'র এই স্টান্ট-ট্যাকটিক্সকে ধাক্কা দেবার কথাটুকুও ভাবতে পারিনি ~ যেটা অনায়াস সহজতায় করে ফেলেছিলেন কবি শংখ ঘোষ।


তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজের পরবর্তী চিরকুট সমূহে পদাতিক কবি থেকে অব্যাহতি'র সড়কসন্ধানে ব্যস্ত ছিলেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বয়সের / অসুস্থতার ভারে তাঁর তীক্ষ্ণ কলমটিকে মাঝেমাঝেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন-ও তো কাউকে রিলে-স্টিক নিয়ে দৌড়তে হবেই। কোথায় যেন ভেঙে যাচ্ছিল 'আমির আবরণ' , কোথায় যেন তীব্র অনুভূতি গ্রাস করছিল বামপন্থী শঙ্খবাবুকে - বামপন্থী সরকারের পুলিশ-আশ্রিত ও পুলিশ- প্রশ্রয়ী থাকার বাহুল্য দেখে দেখে তাঁর প্রতিবাদী কোষসমূহে উদ্গীরণ শুরু হয় । বামপন্থীরাও তো মূলত শাসক ফলে তাদের ঘোষণা করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকার কথা নয় যে ' লাইনেই ছিলাম বাবা '।বামপন্থী সরকারের উদ্দেশে তিনি উচ্চারণ করেন ~ " পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল " ~ বর্তমান দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রতিও বহাল থাকুক একই অনুযোগ । অথবা

"গায়ের জোরে আমার হাবা বোনকে তুমি ধর্ষণ ক'রে গেলে
আমার অধিকার আছে তাকে মিথ্যে ব'লে প্রমাণ করবার
গুলির জোরে আমার বেকার ভাইয়ের হৃৎপিণ্ড তুমি ছিঁড়ে নিলে
আমার অধিকার আছে তোমারই কাছে দুহাত পেতে ভিক্ষে নেবার
ক্ষতিপূরণের আর প্রতিপূরণের..." ~ এই কঠিন শ্লেষ সব শাসককেই
এক পংক্তিতে দাঁড় করিয়ে দেয় সম্ভবতঃ। বাম-রাজত্বের শেষে আসবে বোধয় বামা-রাজ্য ~ এমনটা কল্পনা করেই কি তিনি অগ্রিম জানিয়ে রেখেছিলেন

"অধিকার আছে তোমার রাতুল দুপায়ে
আমার গলে যাওয়া শিরদাঁড়া ছুঁড়ে ফেলবার "!

সদাক্রিয়াশীল জ্যোতিদাদার একটা অসামান্য ভুল অভিব্যক্তি ক্ষেপিয়ে তুলেছিল শংখ ঘোষের মত মানবতাবাদী কবিকে। তিনি রঞ্জিত গুপ্তদের অত্যাচারের ভুলে যাওয়া কীর্তিসমূহকে সুদীর্ঘ চিঠির অভ্যন্তরে জারিত করেছেন অগ্নিরসে। আর এখানে একথাও জানানো উচিৎ যে কবি এই চিঠিটিকে নিজেও সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে মনে হয় কারণ হিসেবে বলা যায় তিনি তাঁর পরবর্তী গদ্যগ্রন্থ "জার্ণাল" এও অন্তর্ভুক্ত রেখেছেন।


কি নির্মম পরিহাস ~ সনেট অনুবাদক "মিশরের অজিম্যানডিয়াস" (রচনাঃ 'পার্সি বিশ শেলী') কবিতার প্রথম স্তবকে বোধয় নিজের আসল মুখ দেখছিলেন আর সভয়ে কবি শংখ ঘোষের ভূমিকার অগ্রিম প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিলেনঃ

"স্পষ্ট ই প্রতীয়মান যে সেই প্রতিভাবান ভাস্করের হাত
ঠিকই ধরেছিলো সেই খলতা যা আকীর্ণ ছিল আসলের চেহারায়
ভাস্করের অকথিত বিদ্রুপ ছেনির ভাষায় ক রেছিলো রেখাপাত।"

2 comments:

A Fair well to pen. বলেছেন...

অসাধারণ এক প্রবন্ধ ! কোথাও কোথাও এত-ই ফরোয়ার্ড আর সাহসী যে - নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা ক'রে, "রাজা, তোর কাপড় কোথায়?" । আরেক বামপন্থী কবির এনে ফেলা এখানে নেহাৎ অপ্রাসঙ্গিক হবে না - যেখানে সুভাষ মুখো আছেন, বীরেন চট্টো আছেন, আছে সত্তরের ক্রিমিনাল রঞ্জিৎ গুপ্ত-র প্রতি অগাধ ঘৃণাও। সত্যি - কতদিন যে বামপন্থি আর দক্ষিণপন্থি শব্দ, মহাশব্দগুলি অবহেলায় বই-এর তাকে পড়েছিল। গৌতমদা নিজে এক মহাযুদ্ধের রথের ঘোড়া। অথচ সমরেশ বসুর উপন্যাসের থেকে আজ এই গদ্য দিয়ে অঙ্গারসঞ্চার - এর মাঝামাঝি যে গৌতমদা নেই, তা তো জানি ! কিন্তু শঙ্খ ঘোষ-ও যে নেই, ছিলেন না কখনো - লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য মধ্যবিত্ত কবি, কিন্তু তা সজোরে ঘোষনা করার ক্ষমতাই তাকে আমাদের হৃৎপিণ্ডে স্থান দিয়েছে। আশ্চর্য্য, আবার সুভাষ এসে গেলেন - আমাদের হৃৎপিণ্ড যতটা বাঁ দিকে, শঙ্খ ঘোষ তার থেকে বেশী বামপন্থি নন। এই সংকলনের এক স্তম্ভস্বরপ হয়ে থাকবে এই প্রবন্ধ। প্রায় মানুষের বুকে হৃদয়ের মত-ই প্রাণসঞ্চার করল এই সংখ্যার ক্ষেপু ব্লগে। আমাকে গৌতমদা প্রভাবিত করছেন আজ বহুবছর - দেখলেম আমার এখনো অনেক কিছু নেবার আছে তার থেকে। অনেক ধন্যবাদ। শুভ জন্মমূহুর্ত, ও শঙ্খবাবু !

Preetha Roy Chowdhury বলেছেন...

ekhane kono kichhu bolar cheye shreyo bodh kori nijer mugdhota tuku rekhe jaoya.