বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ছোটগল্প - মৌ মধুবন্তী

যেখানে গল্পের শুরু
মৌ মধুবন্তী

মগজের ভেতর মন উড়ে যাচ্ছে। মেঘের ভেতর পুঞ্জ পুঞ্জ মন। খেলছে, খুটে খাচ্ছে স্মৃতির দানাগুলো। প্রথম পা পড়েছে এক্সিটের বাইরে। দ্বিতীয় পা তখন কোমর বন্ধের মত ঝুলে আছে আকাশে।গল্পটা এখানে শেষ হলে অনেক ভালো হতো। আসলে গল্পটা এখানেই শুরু।কিয়স্কে দাঁড়িয়ে ঘামছে সে। সেলফ-সার্ভিস বোর্ডিং পাস নিয়ে লাগেজ চেক ইন করে দেবে। সব কাজ চেক লিস্ট ধরে করেছে। এবার কোন ভুল হয় নাই। সামনের পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির মত লম্বা মানুষটা তার বোর্ডিং পাসটা নিয়ে চলে গেলো কাউন্টারে তার থ্রি হান্ড্রেড সিক্সটি ডিগ্রী স্যুটকেস্টাকে চেক ইন করাতে। সেও তার স্যুটকেসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আলতো করে। একই ক্যাটাগরির স্যুটকেস । ঝকঝক করছে। গতকালই সে কিনেছে। দু’শো পঁচিশ ডলার দিয়ে। এই স্যুটকেসের সুবিধা হলো, এটা ফোর হুইলার। চারদিকেই চক্কর খেতে পারে। সোজা হয়ে চলতে পারে পাশে পাশে। জীবন সঙ্গী, পাশেই চলো, পেছন পেছন নয়। ঘাড়ে ও শোল্ডারে কোন চাপ পড়ে না। স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মত। পেছনে পেছনে ঘেজর ঘেজর করে না। মোলায়েম আওয়াজ।ইন্সট্রাকশান স্ক্রিন পপ আপ করলো। টাইপ, স্ক্যান ইত্যাদি ইত্যাদি । টাচ স্ক্রিনে হাতের ছোঁয়া দিল। স্ক্যান বাটন নড়ে চড়ে বসলো পরের স্ক্রিনে। ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করলো সে। আজকাল ডোমেস্টিক ফ্লাইটে লাগেজ চেক করতে প্রতি লাগেজে পঁচিশ ডলার করে চেক ইন ফি দিতে হয়। সাথে একটা ক্যারিওন রাখা যায়। ফি জমা করে দিতেই ইন্সট্রাকশান, পাসপোর্ট খাবার জন্য হা করে মুখ খুলে দিলো। মেশিনের চারিদিকে হাতড়াতে শুরু করে সে। কোথায় আছে সেই মহা খাদক সোয়াইপ স্লট যেখানে সে তার সাধের, স্বপ্নের বড় আকাঙ্ক্ষিত নেভীনীল রঙের পাসপোর্টটা সোয়াইপ করবে। পাশের কিয়স্কে দাঁড়ানো লোকটা কি করছে তাই সে অনুকরণ করার চেষ্টা করল। সোয়াইপ স্লটে স্ক্রিনের ডিজিটাল ইন্সট্রাকশান অনুসারে পাসপোর্ট কায়দা করে ধরলো। ছবির দিকটা উপরে। তার আগের পৃষ্ঠার প্রথমেই একটা স্ক্যান বার আছে। সেই দিকটা স্লটে যাবে। স্লটে পাসপোর্টের নর্থ ইস্ট কর্ণার ছুঁইয়ে ধীরে ধীরে সে টান দিলো বাম দিক থেকে ডান দিকে। ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। বাম দিক থেকে ব্যথা ডানদিকে প্রসারিত হচ্ছে। নিজেকে বিস্তৃত করছে। সহ্য করা যায়। এমন ব্যথায় কাঁদতে হয় না। এতো দূর যাবে। তার জন্য অনেক মানসিক শক্তির দরকার। বামদিকের কিয়স্ক থেকে অন্তত পাঁচজন লোক চলে গেছে কাউন্টারে। ডানদিক থেকে তার ও বেশী ছাড়া কম হবে না। কিয়স্কের সামনে আজকে কোন এজেন্ট নেই হেল্প করতে। বারে বারে সে আশেপাশে তাকাচ্ছে। একটু সাহায্য আশা করছে। হিন্টস দরকার। না নেই। কেউ নেই। যেমন কেউ ছিল না গতকাল, গত পরশু। বা তার আগের দিন। একাই সব কাজ করেছে। কাজের সময় কেউ থাকে না। সবাই অনেক অনেক অজুহাত বানাতে মহাদক্ষ । তাই কারো কাছে সাহায্য চাইবার চেয়ে নিজের উপর ভরষা করে চলাই সবচেয়ে ভালো সাহায্য। এই কিয়স্ক মানুষ নয়। মানুষের আবিষ্কৃত। কিয়স্ক তার সাথে মানুষের মত অজুহাত দেখাবে না। ডান পায়ের জুতার গোড়ালি দিয়ে সে এয়ারপোর্টের টাইল করা ফ্লোরে ঠক করে একটা আওয়াজ তুলে নিজেকে সচেতন করে তুললো। আর কয়েক সেকেন্ড মাত্র, তার বোর্ডিং পাস হাতে এসে যাবে। ঝকঝকে প্রিন্টে লেখা থাকবে তার নাম, গন্তব্য এয়ারপোর্টের নাম, ফ্লাইট নাম্বার, গেট নাম্বার, ও সীট নাম্বার। হা।পাসপোর্ট বাম দিক থেকে ডানদিকে পুরো রাস্তা গড়িয়ে পার হলো। তার ব্যক্তিত্বের ধারালো বৈভব নিয়ে। কিন্তু স্ক্যান হলো না। তার ভেতর দিয়ে কোন এক্সরে রে গেলো কিনা বোঝা গেলো না। ডিজিটাল ছবিটা ইন্সট্রাকশান দিয়েই যাচ্ছে। হচ্ছে না। কিছুই হচ্ছে না। একবার, দুইবার, তিনবার্,--- বারো বার, এক ডজন বার সে স্ক্যান করলো । হলো না। ওর্গাজম হচ্ছে না। হবার নয়। কোথাও তাকে ঠোক্কর খেতেই হবে। এ কেমন জীবন। নিজের উপর নিজেই ক্ষুব্ধ। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আর ইউ দেয়ার?ঘামছে দর দর করে। অথচ আবহাওয়ায় এখন শীতের প্রকোপ। মাইনাস ছয় ডিগ্রীতে সে ঘর থেকে বেরিয়েছে। এখন বাইরে হাওয়া বেড়েছে। উইন্ড শিল্ড বাড়া মানেই তো মাইনাসের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। সে ঘামছে বোবার মত। তল পেটে প্রচণ্ড চাপ। ভেবেছিল সিকিউরিটি পার হয়ে তারপর রেস্টরুমে যাবে। দুই পা চিপে ব্লাডারের চাপ কমাতে চেষ্টা করল। সামনের কাউন্টার থেকে ডাক এলো, নেক্সট। হুড়মুড় হুড় করে পাসপোর্ট হাতে সে প্রায় দৌড়ে গেল। গুড মর্নিং!ইয়েস, গুড মর্নিং। হাউ মেনি লাগেজ?ওয়ান।হাউ উইল ইউ পে? ক্যাশ ওর ক্রেডিট?এই এক সুবিধা। এই প্লাস্টিকটা সারাক্ষণ সার্ভিস দিতে থাকে, যদি মিনিমাম পে করা থাকে প্রতি মাসের ডিউ ডেটে। এর হেরফের হলেই ডিক্লাইন। সে রকম হবার কোন আশঙ্কা নেই। আসার আগে পুরো বিল শোধ করে দিয়ে আস্ত ক্রেডিট লাইনটা নিয়েই সে বেরিয়েছে তার গন্ত্যবের দিকে। কত কি প্ল্যান আছে। একটা টেক্সট ম্যাসেজ এসেছে। তার আওয়াজ কানে আসলো। সেল ফোনটা পকেটে। ভলিউম কমাতে ভুলে গেছে। তাতে কি? এয়ারপোর্ট বলে কথা। চারিদিকে এনাউন্সম্যান্ট। কত রকম নামের ডাক শোনা যাচ্ছে। এই মিস্টার এই লাইনে আসো। ঐ মিস সেই লাইনে যাও। এককান দিয়ে ঢুকছে আর গারবেজের মত আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মগজটা ক্লিয়ার রাখা দরকার। সব কথা নাকি কানে ঢুকাতে নেই। আরে কানে ঢুকলেই কি আর শোনা হয় নাকি। শুনতে হলে মনোযোগ দিতে হয়। কানে যা যায় তা হলো আওয়াজ। চারিদিকে আওয়াজ। মনের ভেতর এখন কত রকম আওয়াজ চলছে।ক্রেডিট কার্ড। হাত বাড়িয়ে কোচ সিগনেচার প্লেটেড ক্লাচ থেকে মেরুন রঙের ভিসা কার্ডটা বের করতে করতে মনে হলো, এখুনি টেক্সট ম্যাসেজটা দেখা দরকার। সেল ফোনে রিং বাজছে। কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে ফোন ধরতে যাবে। কাউন্টার থেকে মিষ্টি কণ্ঠে এজেন্ট বললো, এখানে ফোন ধরা নিষেধ। রেখে দিল ফোন। পকেটে যেখানে ছিল সেখানে। কিছুটা নড়চড় হতেও পারে। লাইফ তো আর প্রতি মুহুর্তে ফটোকপি নয়। যা দিলাম তাই কপি হয়ে বেরিয়ে আসবে। পুরো পঁচিশ ডলার চার্জ করে এজেন্ট কার্ড ফেরত দিল সাথে রিসিট। লাগেজ ট্যাগের ‘পিল হিয়ার’ অংশের ব্যাক সাইড থেকে ওয়াক্স পেপারটা পিল করে তার লাগেজে ট্যাগ লাগিয়ে দিল। লাগেজ টা হাতের দিকে ঠেলে দিল । ফলো দা ব্লু লাইন ফ্রম হিয়ার।মনের ভেতর খচ খচ করছে। সেলফোন হাতে নিয়ে টেক্সট ম্যাসেজ চেক করতে ইচ্ছে করছে। খুব যত্ন নিয়ে চারিদিকে সে দেখে নিলো, অন্যেরা সেল ইউজ করছে কিনা। একটু আগেই তো না করলো। বাহ, সবার হাতেই কিছু না কিছু ডিজিটাল ডিভাইস আছে। ফোন, আই প্যাড, টেবলেট, নেটবুক। তার স্মার্ট ফোনটা সে বের করতে পকেটে হাত চালিয়ে দিল। যেন অভিযানে নামিয়েছে হাতের পাঁচ আঙ্গুলকে। পাঁচ আঙ্গুল মুঠ করে শক্ত বাঁধনে বেঁধে তুলে আনছে তার পকেট থেকে স্যামসাং গ্যালাক্সি থ্রি। আই ফোন সে নেয় নাই ইচ্ছে করেই। এর চেয়ে কম দামেই সে পেতে পারতো আই ফোনফোর জি। মাত্র উনোয়াশি ডলার । সাথে বাবা কালা চান্দ ট্যাক্স। একে ফাঁকি দেবে এমন সাধ্যি কারো নেই। তের পার্সেন্ট ট্যাক্স হিসাব করে নাও পাঠক। সব উত্তর লেখক লিখে দিলে পাঠক কি ভেরেণ্ডা বাজবে বসে বসে। অংক করে নাও মগজের খেলায়। আজকাল সব ফোনে ক্যালকুলেটর আছে, আর ফোন নাই এমন পাঠক দুনিয়ায় নাই বলা চলে। তার দুনিয়া এখন তার পাঁচ আঙ্গুলের মুঠোয়। ব্লু লাইন ততক্ষণে শেষ। ফোন আবার রেখে দিতে হলো। পাসপোর্ট দেখার জন্য আরেক জন ওঁৎ পেতে আছে। এই কাজ করতে এদের বোরিং লাগে না? রাজ্যের লোকের হরেক রকম চেহারা দেখে দেখে মনে কি প্রেম ট্রেম জাগে না? মনের ভেতর কি কোনা আন্দোলন তৈরি হয় না? যেমন ওর মন এখন এক প্রবল আন্দোলনে মেতে আছে। সে তাকে বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছে । রেস্টরুম, রেস্টরুম। ক্যারিওন লাগেজ টেনে টেনে সে এগিয়ে গেল সিকিউরিটির চেকপয়েন্টের দিকে। কনভেয়র বেল্টের পাশেই স্ট্যাক করা আছে নানান রঙের ও সাইজের বিন। বড় একটা বিনে সে তার হাত ঘড়ি, পকেট থেকে ফোন, কোমর থেকে বেল্ট ও পা থেকে মাইকেল করের(MK) চকচকে ওয়েদার বুটটা তুলে দিল। যা তোরা পার হয়ে যা । গা থেকে খুলে দিল এনা বেলার লাইট ফিদার জ্যাকেট, কোচের রেপ্লিকা হ্যান্ডব্যাগ। সাথে রইলো সে নিজে ও তার মন । তার মনের কোন ব্র্যান্ড নেম নেই। সে একা। আশ্চর্য মোজাটাও খুলতে হলো। হাতের আংটিগুলো খুলতে হলেই এখন দশজন চাকর-নকর দরকার হতো। ক্যারিওন তুলতেই এজেন্ট জিজ্ঞেস করলো, তার সাথে ল্যাপটপ আছে কিনা। সে ক্যারিওন লাগেজের সাইড পকেট থেকে তার গেটওয়ে নেটবুক বের করে বিনে রেখে দিলো। নোট বুকের ভেতরে আছে অনেকগুলো গল্প। ওরা একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। না কফি হাউস নয়। বিগ ব্যঙ হাউসে। বিল গেট জিন্দাবাদ। কম্পিউটার আবিষ্কার করেছিল। বডি ডিটেক্টরের দিকে এক পা এগুতেই মনে পড়লো গলায় ট্যানযানাইট স্টোনের প্যান্ডেন্টটা ঝুলছে। এক পা পিছিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে স্টেনলেস সিলভারের চেইনটা খুলে আবার আরেকটা বিনে রেখে দিল। বিন টা হাত দিয়ে ঠেলে দিলো এক্সরে মেশিনের দিকে। মেশিনের ওদিকে অনেক গুলো বিন জমা হয়ে গেছে। সে আশংকায় আছে। একজন মহিলা পার হয়ে গেছে বডি ডিটেক্টরের ওদিকে বডি চেক করে। সে দেখতে পাছে, একজন মহিলা এজেন্ট তার গায়ে কোমরে গ্লাবস পরা হাত দিয়ে দিয়ে চেক করছে। মনে পড়ে তার সারা গায়ে ভালোবাসার হাতের পরশ। অনেক যত্নে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে আদরে আহ্লাদে পরশে বিমোহিত করে রাখতো। ভৌগলিক দূরত্ব ও বিশ্বাস আনুপাতিক। সাম্রাজ্য ভাগ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে মাত্র। হৃদয় ভাগ হয় না। হৃদপিণ্ড যদি হৃদয় হয়, তা হলে তাতে চারটি মেজর ভাগ আছে। এই চার ভাগের কথা ভেবেই হয়তো মোল্লারা চার বউকে হালাল করেছে। নিজের হৃদপিণ্ড খুলে তো দেখেনি। গরু ছাগলের টা দেখেই অনুমান করেছে কয় কুঠুরি আছে সেখানে। নারী হৃদয়ে কয়টা কুঠুরি আছে তার সন্ধান আজো পায় নাই। তাই এক তরফা হাদিস বুনেছে খেলারামের মাঠে। কি একটা নড়ে চড়ে ওঠে তলপেটে। বডি ডিটেক্টর এর ভেতর দিয়ে পার হয়ে সে ওপারে পৌঁছে গেলো। মানুষ মরে গেলেও কি এমনি করে বডি ডিটেক্টরের ভেতর দিয়ে পার হতে হবে? যাবে তো আত্মাটাই অন্য গ্রহে। নতুন দিনের সন্ধানে। মূল দেহ মাংস ও হাড় সব মজে যাবে মাটিতে। তারপর হবে কার্বন। কনভেয়র বেল্ট থেকে সবগুলো জিনিশ কুড়িয়ে হাঁসফাঁশ করতে করতে সে গিয়ে বসলো একটা ওটোম্যানে। কমলা রঙের ওটোম্যান। আর ও চারটে কালার আছে। হলুদ, সবুজ ও লাল। বাচ্চাদেরকে এন্টারটেইন করতে এই বিশ্বে জায়গায় জায়গায় এমিউজম্যান্টের ব্যবস্থা এতো সুন্দর, মনে হয় বাচ্চারাই আমাদের সর্বস্ব। আসলেই তো। ওরা না থাকলে প্রজন্ম পাবো কোথায়? আর তারা হলো আমাদের অতিথি। তাদের যত্নের ত্রুটি করা চলে না। তার সন্তান এখন তার থেকে অনেক দূরে। মনের ভেতরে নিত্যই বাস করে সে। তবুও সময় মানুষকে প্রিয়জন থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে। একে একে মোজা, বুটজুতা পায়ে পরে নিল। গলায় লকেট সহ চেইনটা। হাতে বুলভা রিষ্ট ওয়াচ। কোমরে ক্রিম রোজ স্কিনি বেল্টটা টাইট করে পরে নিল, কালো, নীল ও ক্রিম কালারের ডলমান স্লিভ ম্যাটালিক নীট ইন্টারনেশানাল কনসেপ্ট সোয়াটারের উপরে। কনফিডেন্স এখন আকাশ চুম্বী। তলপেটে চাপ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।রেস্টরুম। সাইন। সোজা গিয়ে বাঁয়ে টার্ণ নিতে হবে। পরবর্তী টার্নের আগে মাঝ বরাবর বাম দিকে উইম্যান রেস্টরুম। ডানদিকে ম্যান’স। দুনিয়ার সব কিছুতে পুরুষদের স্বদিখ্যেতা নকশা আঁকার মত ছকে কাটা। একদিন মেয়েরাও এমন সুযোগ পাবে। মনে মনে ভাবছে , জোরে হাসলে এখানেই পি পড়ে যাবে। দেখার মত দৃশ্য হবে বটে। হ্যান্ড বেগে একসেট এক্সট্রা কাপড় আছে। তাই বলে এমন অঘটন? না, না । পা চালাচ্ছে জোরে। ক্যাট ওয়াক করে হাঁটলে চাপ কিছুটা কম হবে কিনা ভাবছে। এতে মনটাকে ডাইভার্ট করা যাবে। যাচ্ছে । কাজ হচ্ছে। ক্যারিওন হাঁটছে তার সাথে। তিনশ ষাট ডিগ্রী মাতাল তালে। লাগেজ কি কাল রাতে মারগারিটা বা কনিয়াক কিছু পান করেছে নাকি। নাকি নিউ ইয়ারের উন্মাদনা এখনো তাকে গ্রাস করে রেখেছে। রেস্টরুম। গ্লোবাল আকৃতির প্রবেশ দ্বারের সামনে একটা বিশাল অতসী কাঁচের মত দেয়াল। দুইপাশ থেকে ঢোকা যায় রেস্টরুমে। বিশাল আয়োজন। এতো বড় একটা ঘর হয়ত অনেকের নেই। তাতে কি ? এয়ারপোর্ট বলে কথা। সব কিছু নিয়ে দেহটাকে সেঁধিয়ে দিল একটা ক্লিয়ারেন্স রুমে। তলপেট ক্লিয়ার হলে কেমন শান্তি, এর ব্যাখ্যা দিতে গেলে ফ্লাইট মিস হবার সমূহ সম্ভাবনা । হাতে মাত্র এক ঘন্টা সময় বাকী। আরাম। হাতে ধুয়ে হাতে স্যানিটাইজার মেখে সব কিছু সাথে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে অলস পায়ে। তাড়া নেই। এক্সটিক ফিলিংস।গেট নাম্বার সি থার্টি ফোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পকেটে ফোনটা আওয়াজ তুলছে। কে রে বাবা, এই সকালে এতো ফোন করছে। কেউ তো জানেনা সে আজ তার শহর, দেশ ছেড়ে অন্য শহরে অন্য দেশে যাচ্ছে। গেলেই বা লোকের কি? আজকাল আর কাউকেই বন্ধু বলতে ইচ্ছে করে না। সবাই লোক হয়ে গেছে। লৌকিকতায় পারদর্শি। কিন্তু মনটা ফাঁকা। ঠনঠনে আওয়াজ তোলে, বাজেনা সুরে। ঝংকার নেই আছে শুধু খন্ডকালীন যুদ্ধের দামামা। পৃথিবীর অনেক দেশেই নিত্য যুদ্ধ চলছে। এই সেদিন ভারতের মুম্বাই শহরে দামিনী ও একটা করুণ মৃত্যুকে বরণ করে নিল। মরেই যুদ্ধের ঘোষণা দিল। বাইরে বরফ পড়ছে। আকাশ নীল। মনের ভেতর হাজারটা পাখী উড়ছে একসাথে। দুপুর রোদের মত কড়া ব্যক্তিত্ব নিয়ে পিঠ টান টান করে সে এসে পৌছালো গেট সি থার্টি ফোরের সামনে। দেখলো, বাইরের দিকে চোখ মেলে দেখা যায় যতদূর ইচ্ছে সেই রকম কোন সীট আছে কিনা। লাকি। পেয়ে গেল একটা সীট। পাশেই প্লাগ ইন ইলেকট্রিক সিস্টেম। এই এয়ারপোর্টে ওয়াই-ফাই ফ্রি। মহা খুশী। আবারো ফোনের আওয়াজ। আরও একটা ম্যাসেজ আসলো। ভাবলো ফেসবুক নোটিফিকেশান। বুকের ভেতর একটা ডাহুক ডাক দিলো। তবু পাত্তা দিল না সে।বসার আগে পেটে একটা ধাক্কা লাগলো। হ্যাঁ । বটে। গতকাল বিকেল পাঁচটায় এক বোল চিকেন ভেজিট্যবল স্যুপ খেয়েছে। তারপর চলে গেছে দীর্ঘ পনের ঘণ্টা না খেয়ে। খেতে হবে। পাশেই আছে ভিনিফার রেস্টুরেন্ট। হাঁটা দিলো সেই দিকে। হঠাৎ চোখে পড়ে একটা বড় পোস্টার ম্যাট্রোলিঙ্ক। বাহ! দারুণ তো। এয়ারপোর্ট থেকে ইউনিয়ন স্টেশান পর্যন্ত সরাসরি সার্ভিস প্ল্যান করছে । Toronto Board of Trade Metrolinx President and CEO Bruce McCuaig এই কথা ঘোষণা দিয়েছে। এই পরিকল্পনায় আছে বিগ মুভ। রিজিওনাল ট্রান্সপোর্টেশান প্ল্যান গ্রেটার টরন্টো এবং হ্যামিল্টন এলাকার লোকদেরকে সার্ভ করবে। হ্যামিল্টন যাওয়া আর ও সহজ হবে। কবি জয় গোস্বামীর কবিতার মত, কত সহজ হবে? ভালবাসবে তবে? নোট বুকে টুকে নিলো এই তথ্য । পরে গিয়ে এই নিয়ে বিশদ জানা যাবে। কবে শুরু হবে , বাজেট কত, ট্রেনের স্পীড কি হবে? ফেয়ার কত হবে এবং কতদিনে কাজ শেষ হবে, চালু হবে সার্ভিস ইত্যাদি, ইত্যাদি। জোরে হেসে উঠলো সে । একাই। আশে পাশে লোকেরা জানলো না সে কেন হাসলো? বাংলাদেশের টিভির জনপ্রিয় মুখ হানিফ সংকেতের কথা মনে পড়লো। তার আছে ইত্যাদি। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। যখন থেকে ইত্যাদিকে জানে, তখন থেকেই তার স্বপ্ন সে একদিন এই শো’তে যাবে হানিফ সংকেতের সাথে বাৎচিত করবে, এবং কিছু পারফর্ম করবে। তার বিশ্বাস সে দর্শকের মনোরঞ্জনে পুরো স্বার্থক হবে। হানিফ সংকেতকে দেখলেই তার হাসি পায়। হাসি স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ উপকারী। স্ট্রেস রিলিফ করে। তা হলে হানিফ সংকেতকে এখন থেকে থ্যারাপির জন্য কাজে লাগানো যাবে। তাকে ঢাকার সেন্ট্রাল পয়েন্টে টল বিল্ডিঙের উপরে ঝুলিয়ে রাখলে সারা ঢাকা শহর দেখবে আর হাসবে আর স্ট্রেস রিলিফ হবে আর সবাই একদিন মানুষ হয়ে মানুষ কে শ্রদ্ধা করবে, নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। কোন করাপশান থাকবে না। হাসিনা-খালেদা বিবাদের অবসান হবে। লাইনের শেষ প্রান্তে সে দাঁড়িয়ে । সামনে একজন মাত্র অতি বয়স অভিজ্ঞ মানবী লাল রঙের সোয়েটার গায়ে এবং ক্রিম কালারের প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। বাম হাতের আঙ্গুলে এক ক্যারাটের একটা ডায়মন্ড রিং ঝলসে উঠছে চিল্কার মত। কি ভালো আমার লাগলো আজ এই সকাল বেলায় কেমন করে বলি? কেমন করে বলি, কি ভালো তোমাকে বাসি।মে আই হেল্প ইউ?ইয়েস। ইউ ক্যান। ওয়ান চিনামন ক্রোস্যান্ট টোস্টেড উইথ সেডার চিজ। ডি ক্যাফ কফি নো সুগার। এন্ড বোটল অফ ওয়াটার। রুম টেম্পারেচার প্লিজ। ইফ পসিবল। ভিসা কার্ডে পে করে ফিরে গেল সারিবদ্ধ চেয়ারগুলোর দিকে। পেছন থেকে কেউ ডাক দিল। ঘুরে তাকাতেই দেখে তার প্রাক্তন কলিগ তাকে ডাকছে তার সাথে জয়েন করতে টেবিলে। হলো না। ফেসবুকে হানা দেয়া হলো না। মাত্র ৩৫ মিনিট বাকী আছে বোর্ডিং এর। এর মধ্যে সে একবারও ফেসবুকে যেতে পারবে না, সে কি করে হয়। তবে প্রাক্তন কলিগের ডাককেও উপেক্ষা করা যায় না। ফিরে চললো টেবিলের দিকে। আন্ডার ওয়ারের একটা এডের পাশ দিয়ে যেতেই বুকটা ধক করে ওঠে। কি লাভ? হ্যান্ডশ্যাক ও হাগ করেই বসে পড়ে বিপরীত দিকের চেয়ার টেনে। দু’জনে অনেক গল্প করলো প্রাক্তন অফিসের। কলিগটাও আগের অফিসে নেই। সে নতুন কোম্পানিতে জয়েন করেছে সিনিয়র ভাইস পদে। কফি পান এর সাথে গল্পের রস মিশে একেবারে যেন একাকার, স্যুফলে। মিশেল। সময় হলো। স্কাই প্রাইয়োরিটির যারা তাদের ডাক এলো। তার কলিগ চলে গেলো। একই প্লেনে তারা বসবে দুই সামজিক সীটে। যে যেমন পে করেছে। সে ভাইস। বসবেই তো । অফিসের খরচ। জোন ওয়ান কে ডাকছে। তার হলো জোন টু। জেনারেল। সীট নাম্বার টুয়েন্টি এইট ডি। জানালার পাশেই। খুব খুশী। অনেক ছবি তুলতে পারবে সে। বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে সাথে আইডি হিসাবে আছে তার কানাডিয়ান পাসপোর্ট। ক্যারিওন লাগেজে একটা ট্যাগ লাগিয়ে দিলো। কারণ, ক্যারিওন টা তার সাথে যাবে না। তারা আলাদা জায়গায় রাখবে। পরে আটলান্টায় নামলে তাকে তার ক্যারিওন হাতে ধরিয়ে দেবে। ভুলে গেছে নেটবুক তার ভেতরে। ক্যারিওনে চড়ে সেও চলে গেলো। বুকটা খালি খালি লাগছে। ক্যারিওন চলে গেলো। সেও হাঁটছে জেট ওয়ে ধরে। একটু অস্বস্তি আছে মনে। ক্যারিওন টা ঠিক মত পাবে তো? হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে ঢুকে গেলো ডেল্টা এয়ারের পেটের ভেতর। মনে হচ্ছে মায়ের জরায়ুতে ফেরত যাচ্ছে। এমনিও ওয়াটার নেই। অক্সিজেন আছে। বিরাট লাইন। আঠাশ নাম্বার লাইন মানেই তো সামনে গাদা গাদা লোক দাঁড়ানো। সময় তো যায়। প্যাসেঞ্জারও হাঁটে। সেও হাঁটে। আরেকটা টেক্সট ম্যাসেজ। বাজ করছে তার বাম পাশের পেটের কাছে। সুড়সুড়ি লাগতো যদি সোয়াটার না থাকতো। হাত দিয়ে অনুভব করলো। তাগাদা নেই। সীটে বসলেই দেখা যাবে। সীটে বসেই মনটা থমকে গেলো। উইং এর উপরে সীট। কোন ছবি তোলা যাবে না। এই যে একটা শীতল অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরেছে সে মায়ের জরায়ুতে ঢুকেছে। এর থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ঘুরে ফিরে সারা দেহে সেই অনুভূতি। ভয় লাগছে। কেন এমন হচ্ছে। আবার বলছে ধ্যাত, এইসব কিছু না। হ্যান্ড ব্যাগ কোল থেকে নামিয়ে সীটের নীচে দিয়ে সীট বেল্ট পরে নিলো। বেচারা ক্যামেরা অকেজো বসে থাকবে। সাথে আছে নোটবুক, কলম। হাতে লেখার অভ্যেস নেই বলেই নেটবুক কিনেছিল। লিখবে বলে। প্রায় তিনঘণ্টা বসে থাকবে ঠায় সোজা হয়ে। কি করে হয়? নিজের বোকামীর জন্য নিজের চুল চিড়তে ইচ্ছে করছে। চুল টাইট করে বাধা। উঁচু করে বান বেঁধেছে সে আজ। সামনে কোন ব্যং রাখেনি ইচ্ছে করে। বারে বারে চোখে পড়ে। বিরক্ত লাগে। প্রতিদিন ব্যং রাখে। এটা তার ফ্যাশান। আজ মুড নেই, ছিল না মুড। কে জানে মুড কার বাড়ি বেড়াতে গেছে। নাকি ফাঁকিবাজি করেছে তার সাথে কেইবা জানে। মুডের তোয়াক্কা না করে সে এখন ব্যাগ থেকে হ্যান্ড লোশান বের করে আলতো করে দু’হাতে লোশান মাখিয়ে নিল। ইউক্যালিপ্টাস লোশান তার এক বন্ধু তাকে গিফট দিয়েছে আর ও অনেক জিনিশের সাথে। এই ফ্রেগ্র্যান্স তার মুডকে স্বাভাবিক করে দেয়। কেরামতি। এনাউন্সম্যান্ট। সব সেলফোন, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস অফ করে দিতে। পকেটে হাত দিয়ে সে ফোন অফ করে দেয়। হাতে তুলে নেয় স্কাইসেল ম্যাগাজিন। আকর্ষনীয় সব জিনিষের এড। বিশেষ করে ফুট পেইন রিলিভের জন্য অনেক রকম এক্সেসরিজ আছে। কয়েকটা তার জন্য খুব দরকার। তার পায়ের গোড়ালির নীচে একটা স্পার হয়েছে। এই স্পার তাকে সব সময় একটা করুণ ব্যথার মাঝে রাখে। মাঝে মাঝে সে খুড়িয়ে হাঁটে। জুতার নীচে অনেক রকমের প্যাড লাগায়। কখনো কখনো কাজ হলেও সব সময় কাজ করে না। একটা ম্যাসাজের মেশিন দেখে সেটা তখনি অর্ডার দিতে ইচ্ছে করলো। কভারটা চেক করে দেখলো, কমপ্লিম্যনাটারি ম্যাগাজিন কিনা। হা। ফ্রি। তিনবার লেখা। তিন সত্যি। সুখ পাখী সুখে ডেকে উঠলো বুকে। বুকের ব্যথা এতক্ষণ ছিল কিনা মনে পড়ে নি। এখন নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সামনে এখনো অনেকগুলো বছর প্ল্যান করা আছে। এখনি হার্ট এটাক করা চলবে না। ঘড়িটা থামিয়ে দিতে হবে। এইসব কাজ হাতে রেখে মরার কোন মানে হয় না। ইচ্ছার ঘড়িতে সে জোরে দম দেয়। বাঁচতে হবে। মরে গেলেই অন্য ভুবন। প্লেন টেক অফ করছে। সবাই যার যার সীটে বসা। এই সময় সবাইকে বসেই থাকতে হয়। জানাল দিয়ে দেখা যাচ্ছে এয়ার কানাডার আরেকটা প্লেন টেক অফ করছে। মনে হচ্ছে ছোট্ট দিয়ান তার মায়ের দিকে হাত তুলে দিয়েছে কোলে নেবার জন্য। একদিন আমরা সবাই এমনি করে হাত তুলে দিতাম বড়দের কাছে, ভাবল সে। আকাশের চেয়ে বড় কেউ নেই মাটিতে। প্লেন তার কাছে হাত উঁচু করে দিয়েছে তাকে কোলে তুলে নিতে। গোত্তা খেয়ে তার প্লেন চলে গেলো অন্যদিকে। আর দেখা হলো না। অন্য প্লেনটা কি করে আকাশের কোলে উঠলো দেখা হলো না। পানির পিপাসা লেগেছে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে এক ঢোক পানি পান করে নিল। বাংলায় সবাই পানি খায়। সে চিবোতে পারলো না পানি। অলমন্ড এর কোটা থেকে বের করলো একটা অলম্নড। মুখে দিল। পানির সাথে চিবিয়ে খেল। ব্রেদ ফ্রেশনার স্প্রে করে দিল জিহ্বার নীচে। লিক করছে তার স্বাদ। মিন্ট ফ্লেভার। গলার জন্য খুব উপকারী। পুরো ম্যাগাজিনে তার মন একেবারে এনগ্রেভ হয়ে গেছে। চারিদিকে কি হচ্ছে। কিছুই খেয়াল করছে না। দেখছে একটার পর একটা এড। ছেলেদের এডগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে স্বাচ্ছন্দ্যে। মেয়েদের ফিগার শেপের জন্য একটা মাইক্রো ফাইভারের বডি শেপার খুব পছন্দ হলো। টিক মার্ক করে পরের পৃষ্ঠায় চোখ রাখলো। একটা ইন্টারভিউ । নাসার একজন সাইন্টিস্টের সাথে স্কাইসেল ম্যাগাজিনের। খুব আকর্ষণীয়। ব্ল্যাক হোল নিয়ে অনেক রকম প্রশ্ন। উত্তরগুলো ঠিক ক্লিয়ার নয়। অনুমানের একটা ধাঁচ বজায় রেখেছে। অনুমান নির্ভর উত্তর বিজ্ঞানীকে মানায় না। হাতে সঠিক প্রমাণ না থাকলে বিজ্ঞানীরা নিরেট উত্তর দিতে পারে না। তার মনে হলো কেউ যদি ব্ল্যাক হোল থেকে একবার ফিরে আসতে পারতো, তা হলে পৃথিবীর সভ্যতা ভিন্ন দিকে মোড় নিত। এমন সময় পাশের সীটের মহিলা একটি গল্পের বই বের করে তার ব্যাগ থেকে। নাইনটি মিনিট ইন হেভেন। ইন্টারেস্টিং। নাইনটি মিনিট ইন হেভেন। এ ট্রু স্টোরি অফ ডেথ এন্ড লাইফ।(Author) Don Piper এবং Cecil Murphey । নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার বুক। জিজ্ঞেস করার আগেই মহিলা তার নাম ক্রিস্টিনা বলে বইয়ের কাহিনী বলা শুরু করে। সে তার নাম ডেইনা বলেই চুপ করে শুনতে থাকে। ডেইনা বইটা হাতে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করে। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। কভারের উপরের লাল বাসের ছবিটা তাকে খুব আনমনা করে দিচ্ছে। রাস্তায় এমন বাস এসেই কি মানুষকে নিয়ে যায় অন্য গ্রহে? তা হলে আজরাইল বলে আসলেই কেউ নেই, কিছু নেই। প্রাণ সংহার এইসব কিছু নয়। মানুষ চলে যায় একটি যানবাহন ছেড়ে অন্য রকমের যানবাহনে চড়ে অন্য গ্রহে। দেশান্তরের মত। গ্রহান্তরে। বস্তুর অবিনশানিতা বাদ। আমরা প্রতিদিন রসায়ন। প্রতিদিন পদার্থ বিদ্যা। শরীরের ভেতর রসায়ন বিক্রিয়া শুরু করে। বইটি ফেরত দিয়ে তারা কে কোথা থেকে এলো , কোথায় যাচ্ছে এইসব মামুলি গল্পে মেতে গেল, ক্রিস্টিনার নিবাস হলো গুয়েলফ, অন্টারিও তে। বয়েস সাতান্ন বছর। তার হাবি ও সে কানাডার শীতের সময়টা থাকে ট্যাম্পা, ফ্লোরিডাতে। কানাডার গরমের সময় তারা গুয়েলফে ফিরে আসে, গার্ডেনিং করে। অনেক রকমের ফুলের গাছ লাগায়। ফিশিং এ যায়। ক্যাম্পিং করা তাদের নেশা। তারা সময়কে কিনে নিয়েছে তাদের আর্থিক সামর্থ্য দিয়ে। ট্যাম্পা থেকে প্রায়ই ক্রুজে যায়। বাহামা ক্রুজ, ক্যারিবিয়ান ক্রুজ, হাওয়াইন ক্রুজ । গ্র্যান্ড চিলড্রেনদের সাথে সামারটা আনন্দেই কাটে।বুকের ভেতর কেমন যেন একটা চাপ। চাপচাপ ব্যথা, খসখসে ব্যথা। মেঘবতী আনন্দ। জলঘন আনন্দরশ্মি তাকে মুছে দিচ্ছে আলতো করে। ব্যথা ভুলে যায় সে। একটা ভাইভ চারিদিকে ছড়ানো। খুব পরিচিত একটা পারফিউমের গন্ধ এসে নাকে টোকা দিচ্ছে। না না সে কি করে এখানে আসবে? সে তো তার কাজে ব্যস্ত। সে সোজা চেল যাবে গন্তব্যে। দেখা হবে সেখানে। সেই তো উদ্দীপনা। ব্যাগে অনেক রকমের ভাইটামিন আছে। বেবি এস্পিরিন ও আছে। খেতে চাচ্ছে না সে এখন। আই ইউল উইন দা পেইন অ্যান্ড হার্ট। প্লেন এসে ঠিক টাইমেই আটলান্টা এয়ারপোর্টে থামে। নিতে হবে ট্রান্সিশান।কেউ তাড়া করছে না। ক্যারিওন ব্যাগ বের করতে হবে না ওভার হেড বিন থেকে। লাগেজগুলো সামনেই পাবে তারা। হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে জ্যাকেটটা বাম হাতের কব্জিতে ঝুলিয়ে ক্রিস্টিনার পিছু পিছু সেও বেরিয়ে আসে সীটের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে। দুই সারির সীটের মাঝে আইল ধরে হাঁটছে। সবাই এটিক্যাট বজায় রাখছে। মনের ভেতর একটা গান সুর ভাঁজছে। গানের কথা মনে আসছে না।ইস! এই গানটা যদি ওকে গেয়ে শোনাতে পারতো। মনের ভেতর ইচ্ছে ঝালমুড়ি। ক্রিস্টিনা বাই বলে চলে গেলো। মনে হলো পেছনে খুব চেনা কেউ। ঘাড় ঘুরাতে যাবে এমন সময় ফ্লাইট এটেন্ডেন্ট বললো, হ্যাভ আ নাইস ডে। বুকের ভেতর বাঁশী বাজছে। কাঁধের ব্যাগ ঠিক করে নিলো কাঁধের উপরে। বাম কাঁধেই ব্যাগ রাখে সে। জ্যাকেটটাও আরেকবার টেনে নিলো সামনের দিকে। জুতার ভেতর বাম পা-টাকে টেনে ঠিক করলো। পীঠের কাছে একটা অদ্ভুত বাতাস শীষ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘাড়টা কেমন যেন শক্ত হয়ে যাচ্ছে । ঘুরাতে পারছে না। পেছনে কে? এমন কেন লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ, মনে হচ্ছে সে ভালোবাসা তাকে জাপটে ধরছে। ডান পা জেট ওয়েতে। বাম পা প্লেনের ভেতরে। ডেইনার শরীর পড়ে যাচ্ছে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীত দিকে। ডেইনা ভেতরে ভেতরে চিৎকার করে ওঠে। না পড়ে যাওয়া চলবে না। আই উইল উইন দা পেইন এন্ড হার্ট। পাশের দেয়ালে হাত দিতে গেল। হাত ছুঁয়ে গেল। ধরতে পার লো না। জ্যাকেট পড়ে গেল পায়ের উপর। পা আটকে গেল। কাঁধ থেকে ব্যাগের ভার তাকে আরও দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে ফ্লোরের দিকে। সমানের প্যাসেঞ্জার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে, একজন ভূপাতিত হচ্ছে। তার চোখে হলুদ আলো, ক্রমশ কালো হয়ে যাচ্ছে। কালো রঙের একটা গাড়ি সে দেখছে। আসলে কোন গাড়ি নেই সেখানে। স্বপ্নের গাড়িটা কালো রঙের। অনেক দিনের স্বপ্ন।পেছন থেকে ম্যাথিউ হতভম্ব হয়ে দেখছে কি হচ্ছে? সেই সকাল থেকেই তাকে ম্যাসেজ দিচ্ছে। ম্যাসেজ সে পড়লে জানতো ম্যাথিউ উলটো পথে তার জন্য এতো দূর এসেছে তার সাথে একই ফ্লাইটে পুরো জার্ণির আনন্দ নেবে বলে। ম্যাসেজের উত্তর না পেয়ে অভিমানে পেছনে থেকেছে , আড়ালে রেখেছে নিজেকে। একই প্লেনে জার্ণি হলো। বরং অনেক আনন্দ সে পকেটে জমা করতে পেরেছে। ডেইনার কাণ্ডকারখানা সে পুরোপুরি এঞ্জয় করেছে। কিন্তু কি হয়েছে ওর? ও কেন পড়ে যাচ্ছে। ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সে ডেইনার দিকে। পড়তে পড়তে ডেইনা সেল ফোন বের করে ম্যাসেজ পড়ার চেষ্টা করছে। জেট ওয়ের মেঝে ছোঁবার আগেই ম্যাথিউ পেছন থেকে ঝাপটে ধরে ডেইনার শরীর। ডেইনা জানেনা। কে? ডেইনা ম্যাসেজ পড়ার চেষ্টা করছে। ম্যাথিউ তার হাত থেকে সেল ফোন কেড়ে নিয়ে নিজেই বলে দিচ্ছে ম্যাসেজে কি লিখেছিল সে। ডেইনার বুকের ব্যথায় ঢেউ উঠতে থাকে। বুকের উপর হাত রেখে সে ব্যথা সরিয়ে দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। প্লেনের ভেতর থেকে দু’ জন স্টুয়ার্ট বেরিয়ে এসে হেল্প করছে ম্যাথিউকে। ম্যাথিউ ঝুঁকে পড়ছে ডেইনাকে নিয়ে মেঝের দিকে। স্টুয়ার্ট দুজনের একজন বাম দিক থেকে আরেকজন ডানদিকে থেকে ডেইনাকে ধরবার চেষ্টা করছে। ডেইনার কানে ম্যাথিউ এর পড়া ম্যাসেজগুলো স্ক্রলবারের ম্যাসেজের মত একদিন থেকে ভেসে এসে অন্য দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। বলতে ইচ্ছে করছে তুমি এতো পাজি। তুমি লক্ষ্মী প্রেমিক। তুমি আমার সাধনা, তুমি অনন্য। ডেইনার মুখ থেকে ফেনা বেরুচ্ছে। নীল হয়ে যাচ্ছে শরীর। ম্যাথিউ চিৎকার করে বলছে কল নাইন ওয়ান ওয়ান। নাইন ওয়ান ওয়ান অলরেডি কল করা হয়ে গেছে।ইমারজেন্সী চারিদিকে। ছুটছে সবাই সবার দায়িত্ব হাতে, কানে, ঘাড়ে করে। আই ইউল উইন দা পেইন অ্যান্ড হার্ট। ম্যাথিউ চুমোয় চুমোয় ভরে দিচ্ছে ডেইনার চোখমুখ। অবাক করতে এসে এ কোন অবাক ব্ল্যাক হোলে যাত্রা আরম্ভ হলো? ভেতরে বাহিরে দু’জনের হেটে যাওয়া হলো না। ব্যাপক বৃষ্টি নয়। অবিরাম ব্যথা। ব্যথার মাঝে মুখোমুখি দু’জনা। ব্যাপক বৃষ্টিতে হেঁটে যাওয়া হবে এই বিশ্বাস তার আছে। ডেইনা এমন করতে পারে না। ডেইনার পাসপোর্ট কোনদিন স্ক্যান হবে না। ডেইনার কপালে আরেকটা চুমোর ছাপ একে দিল ম্যাথিউ।নাইনটি মিনিট ইন হেভেন। ডেইনা অচেতন।সময়ের আগেই অনেক লোক খটাখট স্ক্যানারে পাসপোর্ট স্ক্যান করে চলে যাচ্ছে অজানায়। গন্তব্যে, গ্রহান্তরে। দামিনী যামিনী কাটাতে পারেনি ঘরে। বাসের ভেতর পড়ে গিয়েছিল অকারণে। ইএমএস ডেইনাকে তুলে নিলো স্ট্রেচারে। গল্পটা শুরু হলো।


1 comments:

KRUCIAL বলেছেন...

ক্লাসিক্যাল এবং সফিস্টিকেটেড,প্রেক্ষাপটটি লক্ষ্মী মেয়ের মত এজমালী হলেও এটিকেটের সযত্ন লালনে ঝলমলে সুমগন এলেম আকর্ষণীয়

আপনি থ্রিলার লিখলে দুর্ধর্ষ কিছু হবে