বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ধারাবাহিক - চান্দের চর - অলোকপর্ণা।

চান্দের চর
(একাদশ কিস্তি)
অলোকপর্ণা


আপ্রাণ চেষ্টা করেও দীপা সুলগ্নার হাত থেকে বাঁচতে পারল না। গাড়িতে ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তে সুলগ্না দীপাকে ধরে ফেলল, যার অর্থ দীপা এখন সুলগ্নাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিতে বাধ্য। দীপা ভাবে আজই সুলগ্নাকে বলে দেবে যে সে তাকে একদমই পছন্দ করে না। তারপর যা হওয়ার হবে। পার্টি অবধি জল গড়ালে গড়াবে। কিন্তু দীপা কিছুই বলে উঠতে পারে না। সুলগ্না নিজেই গাড়ির দরজা খুলে বসে পড়ে। “চল...” সুলগ্নার প্রতিটা উক্তিই অত্যন্ত বিরক্তিকর। সুলগ্নার এ কথা সে কথার জবাব কোনো রকমে সারে দীপা। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের বিরক্তিকর অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান নয়, সুলগ্না তাদেরই একজন। তাই সে গাড়ি থেকে নেমে যেতেই অনাবিল আনন্দ পায় দীপা। সুলগ্না চলে যেতে গিয়েও দীপার জালনার কাছে মুখ নামিয়ে আনে, ““ও হ্যাঁ, বলতেই ভুলে গেছি...””
““কি?””
“”গত সপ্তাহে, যেদিন তুই যাদবপুর গেলি, কি বৃষ্টি, কি বৃষ্টি। আমি বাসে তখন কলেজস্ট্রীটে, দেখি তীর্থদা! কতোদিন পর দেখলাম! নতুন গাড়ি কিনেছে বোধ হয়।””
““কিনতেই পারে।””
“”তারপর দেখি একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে, গাড়িতে বসেই। মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টিতে। আমার বাসটা ছেড়ে দিল, মেয়েটা মনে হয় তীর্থদার চেনা খুব। হেসে হেসে দুজনে কথা বলছিল।””
““অনেককেই তো ও চেনে।””
““আমার ঠিক খেয়াল নেই... মেয়েটার সাথে গাড়ি করে ওই ঝড় বাদলায় কোথায় গেল তীর্থদা...””
““আমার মনে হয় ও এরপর বাড়িতেই ফিরেছিল।””
উত্তরটা সুলগ্নার আশানুরূপ হয়নি দীপা বোঝে।
“ও। ঠিক আছে, চল। কাল দেখা হবে।””
সংকীর্ণ মন নিয়ে সুলগ্নাকে চলে যেতে দেখে দীপার মায়া হয়। তার ইচ্ছে হয় সুলগ্নাকে ডাকে আবার। ডেকে বলে, “তুই ভাবিস না। ও স্যাটিস্ফায়েড না হতে হতে সত্যিই একদিন ওর এক ফ্যানকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। আর আমি সবই দেখেছিলাম।”
দীপা এরকমই একদিন কলেজ থেকে ফিরেছিল তাদের তখনকার যৌথ জীবনে। বাইরের জুতোজোড়া তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব জানিয়েছিল তাকে। তীর্থঙ্কর অবশ্য কোনো আড়াল রাখেননি। তাই বসার ঘরে আসতেই বেডরুম থেকে ভেসে আসা শীৎকার দীপাকে স্থবির করে দেয়। শোয়ার ঘর অবধি যাওয়ার সাহস পায়নি সে, লিভিং রুমে বসে অপেক্ষা করেছে সব শেষ হওয়ার জন্য। একসময় তীর্থঙ্কর বেরিয়ে এসেছেন তাঁর অনুরাগীকে নিয়ে, পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন তাকে দীপার সঙ্গে। মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে তীর্থঙ্কর ফিরে এসে লেখায় ডুবে গেছেন। দীপা কিছুই বলে উঠতে পারেনি। গোটা সন্ধ্যে লিভিং রুমে বসে থাকার পর রাত নটা নাগাদ কাজ চালানোর মত কিছু জামাকাপড়, দরকারি কাগজ, টাকা আর মায়ের পড়ে থাকা গয়না নিয়ে দীপা বেরিয়ে এসেছে নিজের পুরোনো ফ্ল্যাটে। তীর্থঙ্করকে কিছু বলার প্রয়োজন হয়নি, তীর্থঙ্করেরও দীপাকে কিছুই বলতে হয়নি। আজ গাড়িতে বসে প্রথমবার দীপা টের পায় এই বিচ্ছেদের জন্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। কোনো বিষাদও নেই। একাকীত্ব ছাড়া বিচ্ছেদ তাকে কিছুই দিতে পারেনি, কিছু নিতেও পারেনি তার থেকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে গাড়ি স্টার্ট করে। কোলকাতায় শান্তি পাওয়া একটা মানুষের সংখ্যা অবশেষে বাড়ে যা মেট্রোপলিটান শহরে দুর্লভ।
“পথিক কহে ভেবো নারে
ভেসে যাও রূপসায়রে
বিরলে বসে করো রূপসাধনা”
প্রাচীন শহর থেমে যেতে ভুলে গেছে। এখানে কথার বিরাম নেই, ইতিহাসের বিরাম নেই। সবই এখানে ঘটমান। শহরের অতীত ভবিষ্যৎ মিলে মিশে গঙ্গার ধার দিয়ে বয়ে চলে, যেন, যে কেউ মুখ দেখতে একটু ঝুঁকলেই পড়ে নিতে পারবে। কোলকাতা সবার প্রতি এতোটাই উদার। অতি সহজেই প্রেমে ফেলে দিতে পারে এই শহর। তাই হয়তো ভিনদেশী কোনো জনজাতিই কোলকাতাকে পুরোপুরি ছাড়তে পারেনি, ছাড়তে পারে না। যারা ঘরছাড়া তারাও শুধু শরীর। তাদের মন কোলকাতা যক্ষের কাছে আগলানো আছে, ময়দানের বুকে গভীর মাটিতে সেই মন আটকানো- সুরক্ষিত। মন নিয়ে অতো ভাবিত ছিলেন না বলেই তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর দুশ্চিন্তা জমাট বাঁধছে। রাইটার্স ব্লক এড়িয়ে গেছেন তিনি এক অজানা উপায়ে, এবং এর ফলে তাঁর বিস্ময়ের সীমা নেই। যখনই পেন ধরছেন শব্দ উপচে পড়ছে সাদা পাতায়, চোখ বন্ধ করেই যেন তিনি নতুন উপন্যাস শেষ করে ফেলতে পারবেন। প্রেম ছাড়া আর কিছুই এই বিস্ময়ের জবাব হতে পারে না। অসংখ্য মানুষের সম্পর্ক পেনের আঘাতে ভাঙা গড়ার পর এখন তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী নিশ্চিত হতে পারছেন। উপন্যাস প্রায় শেষ করে এনে তিনি লেখা থামালেন, টেবিলে বসে জানালা দিয়ে বাইরের শহরে তাকালেন। আনমনে অপেক্ষা করতে থাকলেন সেই মুহূর্তের জন্য, যে মুহূর্তে বৃষ্টি ভেজা কলেজস্ট্রীটের বর্ষা আনা মেয়ের সাথে তাঁর আবার দেখা হবে।
“সকাল থেকে দেখছি, তুই ভয় পাচ্ছিস আমাকে, ব্যাপার কি?”
““কই না তো!”” রেজ্জাক প্লেট ধুতে থাকে।
““তোকে কোলে করে হোটেলে নিয়ে এলাম আর তুইই মিথ্যে কথা বলছিস আমায়! আমি না দেখলে কোথায় থাকতিস এখন? কোলকাতায় কেউ তোকে দেখতো না হাবুল পুরোকায়স্থ ছাড়া, বুঝলি? আর তুই আমাকেই ভয় করছিস...””
ভয়টার সাথে লড়তে লড়তে রেজ্জাক নিশ্চুপ কাজ করে যায়।
““আয় দেখি এদিকে একবার!””
আবার ভয়টা জাঁকিয়ে আসে রেজ্জাকের সারা গায়ে, সে সাড়া দিতে পারে না।
““কি রে... আয় বলছি।””
হাতের প্লেটটা আর ধোওয়া হয় না তার, হাবুলদা কি করবে আবার?- রেজ্জাক আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
““অ বুঝেছি। তুই এইজন্য ভয় পেয়েছিস... ”” হাবুল উঠে আসে রেজ্জাকের কাছে। তার কাঁধে হাত রাখে। রেজ্জাকের সারা শরীর অবশ হয়ে যায়, সে ভাবে চিৎকার করবে কি না।
“ “আরে আমি তো তোর কোমরের মাপ দেখছিলাম, পুজোর জামা কিনতে হবে না?”” হাসিমুখে বলে হাবুল। রেজ্জাকের মাথা থেকে যেন এক শহর ভার নেমে যায়, সে বলে ““আমি জানতাম, ভয় পাইনি তো আমি। তোমাকে ভয় পাবো কেন!””
“ “চল তাহলে কাল, পরব আছে, দোকান বন্ধ থাকবে, তোর জন্য কিছু কিনে আনাই যাক!””
হাসি মুখে রেজ্জাক জিজ্ঞেস করে, ““কি কি কিনবো হাবুলদা?””
“ “কি কি? এই তো, একটা শার্ট, একটা গেঞ্জি, একটা প্যান্ট...””
“ “ফুলপ্যান্ট!!””
“ “হ্যাঁ, একদম ফুলপ্যান্ট!””
“ “আর কি কিনবো?””
“ “একটা এরম লাল চটি আর স্যান্ডো গেঞ্জি দুটো, ওই যেমন স্যালম্যান খান পরে না?””
“ “একদম ওই রকম?””
“ “হ্যাঁ রে!””
আরো কথা চলাচল হয়, আরো খোয়াব আসে যায় রেজ্জাকের চোখে ছায়া ফেলতে ফেলতে। প্লেট ধোওয়া শেষ করে এই সব স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সে চাইনিজ হোটেলের দোতলায় উঠে এসে দেখে, শতরঞ্চিতে তার জন্য কিছু ঘুম পড়ে আছে।
আজ দ্বৈপায়নের জ্বর আসেনি। সারাদিন সে ময়লার ড্রামের পাশে বসে থেকেছে,- শিশু শ্রমিকটার সাথে তার অনেক কথা আছে। জাম্বাবু সেদিন ওদের হোটেলে কি করতে এসেছিল জানতে হবে। আর এটাও বুঝতে হবে কেন জাম্বাবু পিকুকে চিনতে পারেন নি। ময়লার ড্রামের পাশে পড়ে থাকায় একটা লাভ হয়েছে, মাঝে মধ্যে কেউ এসে দু একটা পয়সা ফেলে যাচ্ছে দ্বৈপায়নের কাছে। কোলকাতার মানুষের দয়ার অভাব নেই। দুপুরের দিকে সে উঠে গিয়ে পাশের দোকান থেকে বিস্কুটের প্যাকেট কিনে আনে সমস্ত পয়সা দিয়ে। পুরো প্যাকেট শেষ করার পর হঠাৎ তার বোধোদয় হয়। আপন নির্বুদ্ধিতায় পুনর্বার বেবকুব বনে দ্বৈপায়ন নিস্পলক তাকিয়ে থাকে পাশের ফোনবুথের দিকে।
“কি ভাবছো?”
রবি বাউলকে দেখে সে খানিক স্বস্তি পায়।
“ “ভুল করলাম আবার...””
“ “ভুলই তো সব, জীবনটাই তো মস্ত ভুল!””
রবি বাউলের দার্শণিক উক্তি দ্বৈপায়নকে শান্তি দেয় না।
““আমি বাবাকে ফোন করতে পারতাম, কিছু পয়সা লোকে ফেলে গিয়েছিল এখানে,””
“ “কিন্তু?””
“ “বিস্কুট খেয়ে ফেললাম...””
রবি বাউল একমুখ সরল হাসি হাসেন, “ “তা বেশ করেছো, আমার মনে হয় না তুমি আর ফিরতে পারবে।””
দ্বৈপায়ন চটে ওঠে, “ “কেন পারবো না!””
“ “কোলকাতা তোমার মধ্যে ঢুকে গেছে, আমি গন্ধ পাচ্ছি।””
“ “এতো নেগেটিভ চিন্তা দিচ্ছেন কেন আমাকে?””
“ “ঋণাত্মক কিছু হয় কি! অস্তির না থাকাই নাস্তি, না অস্তি- নাস্তি...”” একতারার আওয়াজে দ্বৈপায়ন আর কিছু শুনতে পারেনা।

কলকাতা আর গ্রামের পায়রাগুলো একই রকম দেখতে, রেজ্জাক ভাবে। কি উঁচু একটা মিনারের দিকে উড়ে গেল সবকটা দল বেঁধে... রেজ্জাক আর দেখতে পায় না। হাবুলদা ভুল দিনে জামা কিনতে এসেছে, পরবে পুরো এস্প্ল্যানেড তাদের দোকানের মত বন্ধ থাকে। রেজ্জাকের মন খারাপ হয়ে যায়। হাবুলের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে সে চাঁদনী চকের কাছে এসে পড়ে।
“হাবুলদা, কি হবে এবার?”
“ “মন খারাপ করিস না। দেখছি কি করা যায়...””
“ “কোনো দোকানই তো খোলা নেই...””
“ “আহ্‌ চিন্তা করছিস কেন... এসেছিস যখন আমার সাথে, আমরা জামা কিনেই ফিরবো।””
“ “কোথায় পাবে?””
“ “পাবো, ধর্মতলাতেই পাবো। আজ না পেলে কাল আমরা জামা কিনতে যাবো।””
“ “আজ খালি হাতে ফিরবো?””
“ “ফিরবো বললাম কোথায়?””
“ “মানে?”” রেজ্জাক অবাক হয়।
“ “বলেছিনা জামা না কিনে আমরা ফিরছি না। আমরা এইখানে একটা ঘর নিয়ে আজ থাকি। কাল সব কিনে ফিরবো, ঠিক আছে?”” একজন লোককে ধরে হাবুল কথা বলতে থাকে।
রেজ্জাক ধন্য বোধ করে। হাবুলদা না থাকলে সত্যিই তাকে ভিক্ষা করতে হোত, রাস্তার উলটো দিকের ভিখারীটার দিকে চোখ পড়ে তার। খুব চেনা চেনা লাগে।
“ “আয়, কথা হয়ে গেছে, আজ আমরা এখানেই থাকবো”-” অন্ধকার প্যাসেজযুক্ত এক বাড়ির দিকে আঙুল তোলে হাবুল। অন্ধকারে ঢুকে যেতে যেতে রেজ্জাকের চোখে চোখ পড়ে বদ্ধ পাগলটার, সারা মুখে সাদা সাদা ছোপ নিয়ে যে এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

(ক্রমশঃ)