শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আমি যে তোমাকে পড়ি - শ্রুতি গোস্বামী

আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি... 
শ্রুতি গোস্বামী


আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান!
এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।
(বৃষ্টি)
কেমন হয় কবির জন্ম? কবির জন্মলগ্ন? ১৯৩৬ থেকে বছর গোনা হিসেবে কি মাপতে পারি কবিকে? আমাদের হৃৎ-অলিন্দে অস্থি-মজ্জায় শিরা-ধমনীর লাল-নীল স্রোতে জাতিস্মর হয়ে থাকে কবির শব্দ। কবি। রক্তবীজ।

এই শহরের রাখাল- শঙ্খ ঘোষ। যিনি মনে মনে আশ্রয় খোঁজেন, বাড়ি চান বাহির-ভুবনে। অথচ যাঁর পরম আদর এই দুনিয়ার জন্যেই। নরম রোদের মতো আঙুল বুলিয়ে যান বুক জুড়ে।--
দুপুরে-রুক্ষ গাছের পাতার
কোমলতাগুলি হারালে—
তোমাকে বকব, ভীষণ বকব
আড়ালে...
(আড়াল)
ভালোবাসার তিমিরান্ত শব্দগুচ্ছ। নিবিড় মমতায় যা দেখে মানুষের মুখ, ভিড়ের ভিতর মানুষীর মুখের আদল। অলি-গলি-স্ট্রিট-লেন পেরিয়ে গাঢ়তর কাব্যপ্রান্তরে কবি স্থিত হন।

বৈরী সময়-কে যদিও ভোলেননা। বাঁচতে চাওয়া আর বাঁচতে না দেওয়ার সংঘাতে জড়িয়ে নেন সত্ত্বা। বলেন ক্ষমতার নলে বিনা প্রশ্নোত্তরে উড়িয়ে দেওয়া প্রাণের কথা, আর তার বিপরীতে গর্জে ওঠা পদশব্দের কথা। লেখেন যমুনাবতীর গল্প। মনোরমা থানজাং-এর গাথা। কবিতায় মিলে যায় কোচবিহার আর সোয়েটো-র ঘটনা। শাসকের আঙুল যখনই ভাষার টুঁটি টিপে ধরে, তখনই চলতে থাকে তাঁর সবাক কলম। ষাট-সত্তরের ভাঙন-সময় নিয়ে একের পর এক লেখেন ‘তিমির বিষয়ে দু-এক টুকরো’, ‘বিকেলবেলা’, ‘কিছু না থেকে কিছু ছেলে’, ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘বাবরের প্রার্থনা’। সেন্ট্রাল জেল বা কার্জন পার্কে ছিঁড়ে ফেলা কৃ সেন্ট্রাল জেল বা কার্জন পার্কে ছিঁড়ে ফেলা কৃষ্ণচূড়ার ক্ষত দেখে নিজেকেও বসান তুলাযন্ত্রে। আর বিবর্ণ ক্যানভাসে তুলি ছোঁয়ান ভবিষ্যের রঙে।–-
আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার?
জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?
ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।
(বাবরের প্রার্থনা)

আজ আমাদের হাসা বারণ। বলা বারণ। রাতবিরেতে দিনদুপুরে চলাও বারণ। সেকেন্ডের কাঁটার প্রতি ফাঁক-ও চিনতে চাইছে, পরখ করছে, চেখে নিচ্ছে মানুষের রং। গোষ্ঠীর রং, চামড়ার রং, চামড়ার ভেতর রক্তমাংসহাড়স্নায়ু বা বাইরে নখচুলদাঁতলিঙ্গযোনির রং। ধর্ষক তুমি কার, ধর্ষিত তুমি কার? সব কথা দল জানে বাবা! চালাকি চলবে না। ঘোলাটে অন্ধকারে তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে জিজ্ঞাসাচিহ্ন।--
আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব তুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন্‌ দল
রাতে ঘুমোবার আগে ভালোবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্‌ দল তুমি কোন্‌ দল
(তুমি কোন্‌ দলে)

ক্লান্তিহীন মুখোশ-বিজ্ঞাপনের রেসিং ট্র্যাক থেকে তবু ফিরে তাকান কবি। পলি দেন সমস্ত ক্ষতের মুখে। তোমার চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে, গ্যারাজঘরের পাশে একলা চুপ মেয়েটাকে কবি ডিঙিয়ে দেন অন্দরমহলে। রাজপথ থেকে কানাগলিতে জমে ওঠা দলীয়তার সামনে যখন ‘কিছুই কোথাও’ নেই, তখন বাকি ‘তবু তো ক’জন’ মিলে ‘আরো হাতে হাত রেখে’ ‘আরো বেঁধে বেঁধে’ থাকার নাছোড় আদর জড়িয়ে রাখেন শান্তিকল্যাণে। ওই আদর আমাদের মিলনের লব্ধিপথ। কবি সেই রাস্তাতেই হেঁটে চলেন, আরো জন্মান্তরে, হাজার বছর ধরে। আমাদের আগ্নেয় হৃদয় আর বৃষ্টিমুখ, আমাদের বাঁচা-মরা-ওঠা-পড়া-প্রেম-ঘৃণা-বিশ্বাসের পরমাণুতে কবির অক্ষরমালা। তাঁর জন্মের শেষ নেই। পাঠক চলছে সেই অপ্রান্ত্যের দিকেই, কবিতার প্রত্যেক বাক্‌-ধ্বনিতে তার, আমাদের সঙ্গম কবির সঙ্গে। কোন পূর্ব আর কোন পশ্চিম না ভেবে আমরা জড়াই হাতে হাত, তাকাই ভূ-রেখা আর আকাশরেখার মেশামেশির দিকে, এই বাইনারি-বিশ্ব পেরিয়ে আরেক পৃথিবীর দিকে, কবি ও পাঠকের জাতক-সংবাদ শুনবো বলে --

পরস্পর অঞ্জলিতে রাখি যত উদ্যত প্রণয়
সে তো শুধু জলাঞ্জলি নয়, তারই বীজে
অসম্ভব তৃতীয় ভুবন এক জেগে ওঠে আমাদের ভেঙে,
তাই এইখানে নেমে আমাদের দেখা হলো ভূমধ্যসাগরে।
(ভূমধ্যসাগর)

1 comments:

A Fair well to pen. বলেছেন...

বেশ লাগল লেখাটি। প্রথমেই কবিকে অসংখ্য ধন্যবাদ, "বৃষ্টি" কবিতা উদ্ধৃত ক'রে প্রায় ঘন্টাধ্বনীর, প্রায় শঙ্খধ্বনীর মত শঙ্খযাত্রায় আনবার জন্য। আলোচ্য প্রতিটি উদ্ধৃতি, সুষম না হ'লেও, সু-আলোচিত নির্যাস দিয়ে লেখাকে প্রবন্ধের কড়া ধোঁয়া থেকে কবিতাবৃতা মাধুর্য্যে স্থাপন করেছে। প্রসঙ্গতঃ, শঙ্খ ঘোষ স্বয়ং যখন কবিতা নিয়ে লিখতে বসেন ( "এই শহরের রাখাল" দ্রষ্টব্য) - তখনও এই কবিতা নিয়ে এই উল্টোপথে আবার কবিতার দিকে হাঁটাটিই প্রত্যক্ষ ক'রি; বলা বাহুল্য, তার গদ্যের এই বিশেষ অন্তঃসলীলা স্রোতধারা আমাকে টানে। শ্রুতি, পুরোপুরি না হ'লেও, খানিকটা সেই স্বাদ আনতে পেরেছেন। তাকে ধন্যবাদ। শুভ জন্মমূহুর্ত, ও শঙ্খবাবু !