শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার - শমীক ঘোষ

ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার
শমীক ঘোষ

 

ক্যানভাসের উপর সামান্য একটু রঙ। তুলির আঁচড়ের দাগ লাগেনি তাতে। শুধু নিকষ লাল মৃত্যুর মত জেগে আছে সাদার উপর। ট্রাফিক সিগনালের মত কিংবা ফুলস্টপ।

ঠিক ওই ভাবে সাদা জামায় রক্ত লেগে আছে। মানুষটা নিথর। লাশ। তাঁকে স্থবিরতা দিয়েছে আততায়ীর গুলি।

“সারি সারি শব রেখে চুল্লি বসে আছে গ্রাস নিয়ে
যে কোন মৃত্যুই আজ দাবি করে পোস্টমর্টেম।”

কি অনায়াসে মৃত্যু ছুঁয়ে যায়, কি অনায়াসে হেঁটে যাওয়া মানুষটা নিথর নিস্পন্দ হয়ে যায়। আর সভ্যতা আলোচনা করে মৃত্যু নিয়ে। লাশেরও রাজনীতি থাকে। “বিচার দেওয়ার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন করো তুমি কোন দল/ আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন দল।” তাই দলে দলে মানুষ দেগে যায় ভিন্ন লেবেলে। কেবল বাহিত সেইসব খবর বয়ে আনে টেলিভিশান সেট। আর সোফায় বসা মানুষটা লাশেরও রাজনীতি খোঁজে, প্রশ্ন করে তুমি কোন দল।


কিংবা সদ্য লাল আকাশের নিচে, ভোরবেলা, আরো লালমাটির উপর শুয়ে থাকে সন্ত্রাসবাদী লাশ। তাকেও দেগে দেওয়া আছে অতিবাম লাল রঙ দিয়ে। মিডিয়া ছোঁবে না ওকে। ওর খুন নিয়ে কথা বলবে না শহুরে মানুষ। এই লাশ প্রান্তিক লাশ হয়ে যায়। এঁকে দেয় দলীয় মানুষ।


অথবা সেই মানুষটা। যার শোবার ঘরটা অনেকদিন ধরেই গরাদ। যে মানুষটা মরে যাবার আগে শেষবার ফিরে যেতে চেয়েছিল শান্ত তুষারে আবৃত তাঁর জন্মভূমিতে। যে জন্মভূমিকে দেশ বললে ভুল রাজনীতি লেগে যাবে লেখাটার গায়ে। তাকে ফিরতে দেওয়া হয়নি। বরং ঘাতক এসে বলেছিল এই নাও পরোয়ানা। তুমি কাউকে মেরেছ কিনা জানা নেই আমার। জানা নেই তোমার অপরাধ আসলে দোষ কিনা। আমি শুধু জানি এই মৃত্যু পরোয়ানা রাষ্ট্র লিখেছিল বহু আগে। তারপর রাজনীতি অংক কষে কষে আজ বেছে নিয়েছে তোমার কবরের দিন। চল, সময় হয়েছে। মানুষটা হয়ত কেঁপে উঠেছিল। হয়ত পা নাড়াতে ইচ্ছা হয়নি তার। বলতে ইচ্ছা হয়েছিল আমাকে ছেড়ে দাও। এই মাটি আলো বাতাস, তোমার চোখের কালো মনি, এই পাথরের মেঝে, এই গরাদ, সব আমার চেনা। আমায় তুমি অন্ধকার করে দিওনা। আমার বাড়ির বাইরে হয়ত বা সামান্য তুষারপাত। আমার স্ত্রী –প্রিয়া, আমার সন্তান, ঘুমোচ্ছে হয়ত এই নিষ্প্রভ ভোরে। আমার দেখতে ইচ্ছা হয়, দেখতে চাই তাদের ঘুমন্ত মুখ। কম্বলের ওমে ফিরে পেতে চাই পাশে শুয়ে থাকা পরিজনের উষ্ণতা। আমায় বাঁচতে দাও। সেই সব কেউ শোনেনি। কেউ বলেনি কথা। শুধু শান্ত তার লাশ ঘুমিয়েছে অন্য গারদে। সেও সাজাপ্রাপ্ত। তাকে ফিরে যেতে দেওয়া যায়না নিজের মাটিতে। তার কবরের মাটিতে নেই কোন আত্মীয়ের চোখের জল। “হিমাচল শিলা থেকে সাগর অবধি আমি ছঁড়ে দিই ত্রাস/ আমার কি এসে যায় বাঁচে কি না বাঁচে ইতিহাস।”


অর্ধেক রাত্রির মুখে আলো এসে পড়ে

অর্ধেক নিজের কাছে স্তব্ধ হয়ে আছে-
তুমি আজও দিশেহারা, জানো না এখনও
তারারা কোথায় মরে কোথায়-বা বাঁচে।

শহরের রাস্তা জুড়ে মোমবাতি রঙা আলো। সামান্য অন্ধকার শুয়ে আছে এ-গলি ও-গলি জুড়ে। আকাশের গায়ে দূষণের মত বিচ্ছুরিত শহরের হলদেটে রঙ। আর তোমার ঘরের উলটোদিক বিরাট বিজ্ঞাপন। আরো বড় হয়ে ধারালো নারী শরীর। তোমার শহর ঘুমোয় শুধু বিজ্ঞাপন জেগে থাকে নিওনে, আলোকবৃত্তে। তোমার জানলা দিয়ে উঁকি মারে তোমার ঘরে। খাটের উপর। নিভন্ত আলোয় ঘুমের আগে তুমি অবয়ব খোঁজ। তোমার নারীর ভাঁজ বিজ্ঞাপনের নারীর মত কিনা। মিলল কি মিলল না ভাবতে ভাবতে কখন যেন চেনা শরীর অচেনা হয়ে ওঠে। আর বিজ্ঞাপনের নারীটির মুখোস কিনে এনে ঘুমের মধ্যে কিংবা নির্ঘুম মেকআপে তুমি বদলে দিতে চাও পরিচিত মুখ। “জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে/ বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।” “ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।”


আমার সন্তান শুয়ে ছিল। জ্বর গায়ে। চাদরে ঢেকেছে শরীর। আর বাইরে বৃষ্টি ঢেকে দিয়েছে পথঘাট, সন্ধ্যার রঙ। আমার বাড়ির বয়স শতক ছুঁয়ে আছে। আরো এক দশকের মামলা বাড়িওয়ালা ভাড়াটের। আমার সন্তানের মাথার উপর ছাদ আছে। শুধু সাব জুডিস সেই ছাদ সারানোর অধিকার। এমন সময় জল পড়ল টুপ করে। টলটল কয়েকফোঁটা জল, ছাদ চুঁইয়ে, সিলিং ফ্যানের গা ছুঁয়ে নেমে এল তপ্ত কপালে। লাফিয়ে উঠলাম। দৌড়ে অফ করলাম সুইচ। “ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” ছাতা মাথায় ছুটে চলেছি এদিক ওদিক, পার্টি অফিস, বাড়িওয়ালা, “ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর/ আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” যেন জল পড়া ছাদ না ভেঙে পড়ে ওর শরীরের উপর। এক সন্ধ্যায় অনেক কিছু হয়, রাষ্ট্রবিপ্লব, কিংবা সমুদ্রপারাপার। এক সন্ধ্যায় সাব জুডিসের ছাদ সারে না। অন্ধকারে শুয়ে আছি আমরা, খাটের উপর বালতি, জলের শব্দ টুপটাপ বৃষ্টিপাতের রাতে। “আমাদের মাঝখানে প্রথম বৃষ্টির বিন্দু নীল।” সন্তানের শরীরের উপর প্রায় শুয়ে আছি আমরা। মাথার উপরের ছাদ না ভেঙে পড়ে। “শূন্যে ছড়াও, আর চোখে চোখে না তাকিয়ে বলো: ভেবো না। ভেবো না কিছু! দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।”


“আর কোন শব্দ নেই, দৃশ্যে ধুয়ে গেছে রাত্রিবেলা

নীলাভ রুপোলি শূন্য ভেদ ক’রে পরিত্রাণহীন
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে আমরা চলেছি সারি সারি
চন্দ্রকিরণের নীচে, খড় নিয়ে, গোরু গাড়িতে।”

নদী ছিল জানো। আমাদের একটা নদী ছিল। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে ধু ধু ধানক্ষেতের ভিতর বয়ে যেত শান্ত। আমার মা পুড়েছে ওই নদীর ধারে। ওই নদীর জলে বয়োসন্ধিতে নিজের মুখ দেখে প্রথমবার বুঝেছিলাম বড় হয়ে গেছি। ওই নদীর জলে ধান গাছ ধুয়ে যেত। ওই নদীর জল আমার খুব চেনা ছিল। তারপর অনেকদূরে বসে থাকা রাজা বললেন, এখানে অনেক জল, জল বয়ে নিয়ে যেতে হবে দূরে, মরুভূমির ভিতর। তাই এইখানে বাঁধ হবে। জলে ডুবিয়ে দেব সব। যারা আছে তারা দূরে সরে যাবে। তাই পুলিশ এল, সরকারী কর্মচারী এল, ঝুলিয়ে দিল অধিগ্রহণের পরোয়ানা। না বললাম। বললাম উঠব না। বলল তাহলে মিলিটারি আসবে। বন্দুকে বন্দুকে ছেয়ে যাবে চারপাশ। তোর বউয়ের ইজ্জত লুটে নেব তোর সামনে। তোর মেয়েকে ছিঁড়ে খাব। তোকেও টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে রেখে যেতে পারি নদীর ধারে, কিংবা তোর কাটা মুণ্ডু লাঠিতে টাঙিয়ে তোর বাড়ির সামনে রেখে যেতে পারি। কাকতাড়ুয়ার মত তাড়াবি প্রতিবেশীদের। তাই একদিন গ্রাম মুছে গেল। মুছে গেল ছাদ, পরিত্রাণহীন আমরা সরে যাই গ্রামান্তরে।


“ঝাঁপ দিয়ে উঠে আসে কয়েক রক্তিম বিন্দু জল।

আমার বুকের কাছে, নিশ্চিন্ত শকুন ডানা ঝাড়ে।
সবুজ, সবুজ হয়ে শুয়ে ছিল প্রাকৃত পৃথিবী
ভিতরে ছড়িয়ে আছে খুঁড়ে নেওয়া হৃদপিণ্ডগুলি।”

আমরা ভেবেছিলাম সব বদলে যাবে একটা মিছিলে। আমরা ভেবেছিলাম সব রাগ উগড়ে দিলেই বুঝি পরিবর্তন হয়। আমরা ভেবেছিলাম স্লোগান আছড়ে একটা সমাজকে কেচে পরিষ্কার করে ফেলব আমরা। আমরা ভেবেছিলাম রাজারও হৃদয় আছে সেও তবে বদলাতে পারে। নইলে বদলে দেব তাকে। সংঘ বদল হল শুধু, রাজত্ব বদল করল হাত, রাজার অহং কমল না। যা ছিল তাই রয়ে গেল। শুধু আলো বলে যা ভেবেছিলাম এতকাল সব আরো অন্ধকারের মত জমাট হল। “কিছু না পারার এই ক্লীব খোলসের বন্দী ভ্রুণ/ গোপন রাত্রির স্তুপে পড়ে আছে পরিত্যাগে রাগে।”


প্রথম ফাটলাম বারুদ হয়ে বিস্ফোরণের মত। তারপর ভাঙলাম হাহাকারে। মহৎ ভেবে একদিন যাকে ছবিতে টাঙিয়েছিলাম, মনের মধ্যে যার জন্য জ্বালতাম ধূপকাঠি তাকে চুরমার করে ফেলেদিলাম। প্রথম ক্ষোভ, তারপর রাগ, তারপর কান্না, পতাকা বদল বার বার হলে মানুষ পতাকাতেই বিশ্বাস হারায়। আমরাও তাই পতাকা নামিয়ে নিয়ে অন্ধকারে শুয়ে ছিলাম। রাত্রে খাইনি। আমাদের মত সামান্য মানুষেরা যা করতে পারে শুধু তাই। মধ্য রাত্রে ঘুমে ভিতর কড়া নাড়ছিল কারা যেন।

“কয়েকজন যুবা আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলে, এই-যে,
আগুন জ্বালব, নেমে আসুন পথে।”