শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

ধারাবাহিক উপন্যাস - অলোকপর্ণা

চান্দের চর / অলোকপর্ণা
(ষষ্ঠ কিস্তি)

রেজ্জাকের একটা গোপন ডেরা আছে চাইনিজ হোটেলেই, যেখানে উঁকি দিতে সূর্যের আলোও আসেনা। গ্রামের রাতে তারা আর জোনাকিতে অভ্যস্থ রেজ্জাকের সেখানে লুকিয়ে থাকতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়না। এক বিকেলে তৈরী হয়ে নীচে আসার আগে জামার বুক পকেট থেকে গড়িয়ে যাওয়া একটা পয়সার পিছু পিছু রেজ্জাক পুরোনো, বিখ্যাত, ছোট চাইনিজ হোটেলের স্টোররুমে ঢুকে পড়েছিল। সেই থেকে কাস্টমারের বকা, হাবুলদার চোখরাঙানি আর ছোটোবেলার স্মৃতির হাত থেকে বাঁচতে সে সেই কাঠের পার্টিশান দিয়ে পৃথক করে রাখা স্টোরে এসে মুখ লুকোয়। এখানে এসে রেজ্জাক পুরোনো ভাঙা কড়াই-স্টোবের ফাঁকে খান চারেক চাইনিজ ক্যালেন্ডার, উইন্ডচেন, চিনা ভাষায় লেখা দুটো বই আর ফ্রেমে বাঁধানো সম্ভবত হোটেল মালিকের সপরিবার ছবি আবিষ্কার করেছে। প্রথম মালিকের সেই ছবিতে তারই বয়সী একটা ছেলেকে দেখে মাঝেমধ্যে অজান্তেই তার বুক হু হু করে ওঠে, বালক রেজ্জাক বোঝেনা কি কারণে। চিনাভাষার একটা বইয়ের মধ্যে সে আজকাল টাকা জমিয়ে রাখে,- বাড়ি ফিরতে হবে না! এই কাজটা সে গোপনে করে। টিপস পেলে তার অর্ধেক হাবুলদার পাওনা, কিন্তু রেজ্জাক টিপসের কথা গোপন রেখে মাঝরাতে স্টোরে ঢুকে নির্দিষ্ট বইটা খুলে টাকা গুণে গুছিয়ে রাখে। বাড়ি ফেরার আগে একটা ‘ছোলার ছেল’ লাগানো লাইট, মা আর আব্বার জন্য পোষাক, ভাইজানের জন্য লাল চপ্পল আর গামছা কিনে নিয়ে যাবে সে। গ্রামের আর সকলের আছে ঐ লাইট, আব্বা চাষের ভাগ পেলনা শেষবার, তাই রেজ্জাকদের রাতের পর রাত গ্রামের অন্ধকারতম ঘরটায় কাটাতে হোল। মা বলেছিল কোলকাতার ফুফার বাড়ি গেলে নাকি সে লাইট পাওয়া যেতে পারে। ‘ছোলার লাইট’ নিয়ে রাতে পুকুরের ধারে যেতে বারণ থাকতো না, ভাইজান আর রেজ্জাক হাত ধরাধরি করে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পুকুরের ওপারের আলেয়া দেখতে যেতে পারতো। দুচোখে এক আলেয়া পুরে মায়ের সাথে তিনমাস আগে শহরে এসে নেমেছিল রেজ্জাক, ‘ছোলার লাইট’ হাতে তাকে তো ফিরে যেতেই হবে।

“হ্যাঁ বলো,”
“মেসের হদিস পাওয়া গেছে, কিন্তু পিকু ওখানে নেই।”
“আমি বলেছিলাম না তোমায় বাবা! ও মেস ছেড়ে শিয়ালদহ স্টেশানে এসে থাকছিল। নয়তো খামোখা তোমাকে ওই বুথের নম্বরেই ফোন করার কথা বলবে কেন!” অস্বস্তিটা ঘাড়ে চেপে বসে দীপার।
“হুম।”
“কিন্তু মেস ছাড়লো কেন?”
“কেয়ারটেকার বলছে ভাড়া দিত না ঠিক মতো। সে নাকি বলেছিল মেস না ছাড়লে তাড়িয়ে দেবে। আর তুমি তো তোমার ভাইকে চেনোই। জাতে মাতাল তালে ঠিক।”
দীপা চেনে পিকুকে। আর যাই হোক গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্য সে অপেক্ষা করে বসে থাকবে না।
“পুলিশ জোর করে ঘর খুলিয়ে তল্লাশি করেছে আজ। সন্দেহজনক কিছু পায়নি। কিন্তু পিকুর কিছু জিনিস রয়ে গেছে ওখানে, সেগুলো নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে বলেছে আমায়। তুমি যদি পারো তো একদিন সময় করে যাও। কেয়ারটেকার বলেছে ঘর তাড়াতাড়ি ফাঁকা করে দিতে, নতুন লোক আনবে।”
“কিন্তু বাবা, পিকু মেস ছাড়ার আগে একবার ফোন করলো না কেন আমাদের কাউকে!”
“নির্বোধের থেকে আক্কেলের কাজ আশা কর তুমি? আমি নিশ্চিত শেষতম টাকাটা দিয়েই সে আমায় ফোন করেছিল। কিন্তু আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম সব ঠিক কিনা গর্দভটা খেয়াল করে বলে ঊঠতেই পারলো না যে ও আর মেসে নেই। বুদ্ধিহীন মানুষদের ঠেকে শিখতে হয়। মাইনের টাকাটাও সে উড়িয়েছে, তুমি দেখে নিও! তবে চিন্তা করো না, ভিক্ষা হোক, চুরি হোক কিছু করে সে আবার একটা টাকা যোগাড় করবেই আর সবার প্রথমে আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করবে অমুক জায়গা থেকে তাকে নিয়ে আসার জন্য।”
অস্বস্তিটা বেড়ে যায়, দীপার বিশ্বাস হয় না। পিকুকে সে চেনে। পায়ে হেঁটে সারা জগৎ ঘুরে সে আসবে তাও ভিক্ষা বা চুরি কোনোটাই করে উঠতে পারবে না। আর ফোন করতে হলে সে বাবাকে নয়, দিদিকেই করবে। এই পৃথিবীতে পিকুর সবচেয়ে কাছের মানুষ দীপা, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। বাবা পিকুকে চেনে না। বাবা দীপাকেও চেনে না। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর কাউকেই চিনে নিতে পারেনি। দীপা-পিকুর সাথে বাবার যতটুকু পরিচয় তা মায়ের প্রাচীরের ওপার থেকেই। মা চলে গেলেও তাদের মধ্যেকার এই প্রাচীর আজও অক্ষুণ্ণ। তাই বাবা পিকুকে শুধুমাত্র বোকা, নির্বোধ, বুদ্ধিহীন বলেই চেনে, তাই বাবা,- তীর্থ আর দীপার বিবাহিত জীবনের সমস্যায় মাথা ঘামায় না। বাবা মনে করে তাঁর হসপিটালকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবী ঘুরছে, সারা শহর পাক খাচ্ছে।
“বাবা, তোমার একা লাগে না?”
ডঃ ঘোষ হোঁচট খান, মেয়ের থেকে এরকম প্রশ্ন আশা করেননি তিনি, বিশেষত এরকম সংকটকালে।
“কি করে লাগবে বলো, সব সময়ই রোগী, নার্স, ফেলো ডক্টর, এম আর ঘিরে রেখেছে আমায়। একাকীত্ব বোধ করতে দিলো কোথায় তারা!” পাশ কাটিয়ে যান তিনি।
অস্বস্তি মাখা দীর্ঘশ্বাস চেপে দীপা বলে, “তুমি একদিন আসো না আমার ফ্ল্যাটে, গলদা চিংড়ি বানাবো।”
মেয়ে নিশ্চয়ই তার মায়ের থেকে জেনেছিল তাঁর গলদা চিংড়ি প্রীতির কথা। কিন্তু একুশ বছর ধরে তা মনে রাখা কম কথা নয়। দীপা উন্নতি করবে, হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট হতে তার আর বেশি দেরি নেই আন্দাজ করেন ডঃ ঘোষ।
“কিন্তু এই বয়সে যে সেটা বিষের সমান তুমি তো জানই। পিকুর এই অনর্থক হারিয়ে যাওয়াটাই হজম হচ্ছে না, সেখানে গলদা চিংড়ির নাম শোনাই বিপজ্জনক!”
দীপা দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারে না। বাবা তার কাছে আসতে ভয় পাচ্ছে, যদি একাকীত্বের ছোঁয়া তার গায়েও লেগে যায়! অস্বস্তিটা বুক খামচে ধরে তার।
“বাবা, আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি রাখি?”
“হ্যাঁ রাখো, আমি মেসের ঠিকানা তোমায় ফরোয়ার্ড করে দিচ্ছি।”
কলকাতার বুকে আরও একটা একারাতচাদর নামে। দীপা সোঁদাগন্ধ বিছানাটায় গা এলিয়ে দেয়। যাদবপুরের পরিবারের ছবি ঘুমের ঘোরে ঘুরেফিরে আসতে থাকে। বাবু আর বাবুর দিদি, পিকু আর দীপা এক হয়ে যায় স্বপ্নে। সে স্বপ্ন ভেঙে ভেঙে রবিঠাকুর গান মাখিয়ে দেন কলকাতার পথে, নির্জনতায়। আহিরীটোলার গলি ঘুরে ঘুরে আর্মেনিয়ান ঘাটের পথে অরূপরতন খুঁজে বেড়ান।

“কে সে মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।”

দশটায় হোটেল বন্ধ হয়। রেজ্জাক ওপরে এলে হাবুল লাইট অফ করে দেয়। আজ তীর্থদার পিছন পিছন অনেক ভীড় হয়েছিল। অনেক প্লেট গেছে। হাবুলসহ অন্যান্য কর্মচারীরা হিমসিম খেয়েছে সবাইকে সামলাতে সামলাতে। রেজ্জাককে এতো কাজ দেয়না হাবুল। বাচ্চাদের প্রতি এমনিই দুর্বলতা আছে তার। তার ওপর তিনমাস আগের সেই রোগা ছেলেটাকে সে অজ্ঞান অবস্থায় কোলে করে একপ্রকার কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল আশ্রয়ে, তাই রেজ্জাকের প্রতি তার টান দোকানে আগে কাজ করে যাওয়া অন্য শিশুদের চেয়ে ঢের বেশি। তাই থাকা- খাওয়ার বিনিময়ে রেজ্জাককে শুধুমাত্র দিনের বেলায় খাবার সার্ভ করতে আর রাতে দোকান বন্ধ হলে প্লেট ধুয়ে রাখতে হয়। দিব্বি আছে রেজ্জাক এখানে। হাবুল অন্তত তাকে এক দিনের জন্যেও মা বা বাড়ির কথা মনে করে কান্নাকাটি করতে দেখেনি। কোলকাতা শহরটা যেন রেজ্জাকের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। অবসর সময়ে রেজ্জাককে সে হাঁ করে পাঁচমাথা মোড় গিলতে দেখেছে। অন্য বাচ্চা গুলোর চেয়ে রেজ্জাক অনেক লড়াকু, হাবুল এরকম পছন্দ করে। সদ্য দেশজ কারণবারি পান করে এসে লোহার ঘোরানো জং ধরা সিঁড়িতে বসে হাবুল বিড়ি ধরায়। এখান থেকে রেজ্জাকের নরম কাঁধ দেখা যাচ্ছে। হলুদ বাল্বের আলো তাতে পিছলে সোজা হাবুলের চোখে আসছে। রেজ্জাক রোগা, নরম হাতদুটো দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাদা সাদা মোটা চিনেমাটির প্লেটগুলো থেকে অতিরিক্ত তেল মুছে চলেছে সযত্নে। নরম গলার গুনগুনে একটা সুর হাবুলের কানে আসে, এর চেয়ে নরম আর কিছু যেন হয়না কোলকাতায়। নিজের ছোটবেলায় চীনাম্যানের মালিকানা থাকতে দোকানে যে সবুজ চিনেটিয়া ঝোলানো থাকতো খাচায়, হাবুল সবার অলক্ষ্যে তার লেজ থেকে মাঝেমধ্যে পালক টেনে নিতো। সেই পালক ঘুমের আগে সারা গায়ে বোলাতো সে। রেজ্জাকের গলা শোনার আগে পর্যন্ত সেই চিনেটিয়ার পালকই নরমতম ছিল যা হাবুল চিনতো। হাবুলের চোখ বুজে আসে, শ্রান্তি আর নেশায়।

“হাবুলদা! উফ, কি ভারী তুমি!” রেজ্জাক অনেক চেষ্টা করেও হাবুলের দশাসই শরীরটা সিঁড়ি থেকে তুলতে পারে না।
“ও হাবুলদা! ওঠো না!” হাবুলের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে রেজ্জাকের গেঞ্জি ভিজে যায়। সে সিঁড়িতে হাবুলের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। আগে, রাতে মাটির মেঝেতে চাঁদের আলো এসে পড়লে রেজ্জাকের যখন খুব ভয় হোত, তখন ভাইজানকে ডাকতে গিয়ে তার হাত বহুদিন ভিজেছে লালায়। হাবুলদা একদম যেন ভাইজান! রেজ্জাক জানে, যেদিন সে কোলকাতা ছেড়ে যাবে সেদিন খুব কষ্ট হবে হাবুলদার জন্য। হাবুলদাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে কেমন হয়! হাবুলদা আর ভাইজান মিলে আব্বাকে চাষের কাজ এগিয়ে দেবে, রেজ্জাককে আর তাহলে জমিতে পরে থাকতে হবে না। পঞ্চাইত ইস্কুলের খাতায় তার নাম আবার উঠবে। মা দিনরাত আব্বাকে দোষ দেবে না আর। সারাদিনের কাজের পর এসব স্বপ্ন নামতে বেশি দেরী হয় না কোলকাতার বুকে জমে ওঠা রেজ্জাকের চোখে। আরো কত ছোট ছোট রেজ্জাক স্বপ্ন তার সাথে মিলে শহরে মেঘ গর্জায়, ভোররাতের দিকে ঢিমেতাল বৃষ্টি ঝরিয়ে কলকাতাঘুম আরো গাঢ় হয়।

হারিয়ে যাওয়া কাকে বলে? দ্বৈপায়নের এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে মিনার্ভা থিয়েটার। নতুন করে ফিরে এলেও কি সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া যায়? তার এক একটা পরত শহরের নানা অংশে পড়ে থাকে। যেমন মিনার্ভা। নতুন করে ফিরে এলো, নটী, বাবুদের ফেলে। ফেলতে পারলো? না পুরোটা ফিরতে পারলো! কে জানে হয়তো অর্ধেক মিনার্ভায় এখনও গিরিশচন্দ্রের ম্যাকবেথের শো’য় জুড়িগাড়ির লাইন পড়ে যাচ্ছে আর বাকী অর্ধেক বার্ধক্য মানতে না পেরে অনাবশ্যক রং চড়িয়ে এই কোলকাতার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চাইছে। দ্বৈপায়ন উদাস হয়ে যায়। হয়তো কোলকাতার পথে পথে তারও ছেড়ে আসা স্তরগুলো পড়ে আছে। সে সব কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঘরে ফিরতে হবে তাকে। ঘর! আঠারো হওয়ার পর “যাও খেটে খাও” বলে দিদির সাথে সাথে বাবা তাকেও মেসে পাঠালো, পড়া, পরা, থাকা, খাওয়া ছাড়া কোনো খরচ ডঃ ঘোষ তাঁর সন্তানদের দেবেন না, পাশ্চাত্য মত পোষন করে তিনি পিকুকে আরও দূরে ঠেলে দিলেন যেমন দীপাকে একদিন দিয়েছিলেন। সে অকুলপাথারে দিদি হাল ধরেছিল, নেট দিয়ে সে সবে তখন কলেজে ঢুকেছে, তীর্থদার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে, নিজের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পিকুকে রবিবার দুপুরে গলদা চিংড়ি রেঁধে খাওয়াচ্ছে, পিকুর চোখের সামনে কলকাতা শহরটা দিদির ডানার তলায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিয়ে সারতে দু বছর লাগলো। পিকু টিউশনির টাকা বাঁচিয়ে দিদিকে টকটকে লাল আর ঘন বেগুনী শাড়ি এনে দিল। হাসিমুখে দীপা তার ভাইয়ের দেওয়া ডিসাস্টারটা পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসল, পিকু যতটা না ভাই তার চেয়ে অনেক বেশি নিজের ছেলে আর দিদি- অনেক বেশি মা। আট বছর বয়সের পর দ্বৈপায়ন আবার মা কে হারালো, দীপা এখন আর খালি পিকুর নয়, তীর্থদাও ভাগ বসিয়েছে সেই আঁতাতে। তারপর থেকে পিকু কেমন ছাড়া ছাড়া হয়ে চলাচল করে কলকাতায়, কলেজ শেষ হয়ে ইউনিভার্সিটি অবধি এসে সে থমকে যায়। টিউশনি আর অঙ্ক করতে করতে সে এতটা দূর চলে এসেছে! ডঃ ঘোষ ফোনের ওপার থেকে বললেন “নিজের পায়ে দাঁড়াও, দিদির মত হও!” দিদি তখন ডুয়েল লড়ছে কোর্টে, কলেজে, একা ফ্ল্যাটে। দ্বৈপায়নের সাহস হয় না, দিদির মত হতে, একা থেকে আরও একা হয়ে যেতে। দ্বৈপায়ন মেঘের মত ভেসে যেতে থাকে, টিউশনি, মেসের ঘর, আরও টিউশনি, আরও অনেক মেস শেষে সে- এক জালনার একটা খোপে এসে পরে, যার সামনে কুল গাছ, পায়রা ওড়ে দিন রাত, সময় কাটানোর জন্য হেঁড়ে গলায় বাউল গেয়ে দিন কাটে। কলকাতার আকাশ থেকে চিল উধাও হয়ে গেলেও ঘুড়ি এখনো মাঝে মাঝে এখানকার আকাশ শাসন করতে বেরোয়। দ্বৈপায়ন দুচোখ ভরে দেখে। এছাড়া তার কোনো কাজ নেই। পুরনো দেওয়ালে গজিয়ে ওঠা কিশোর আগাছাটাকে নিজের মতই লাগে, যেন মা-হীন ছেলেবেলা, তাই ওতেও জল পড়ে। মটরশুঁটি পুতে ক্লাস ফাইভের মত মাটির হাঁড়িতে গাছফোটানো হয়, রাতে মুড়ি খেতে খেতে দু এক কলি জীবন বিজ্ঞান কানে এসে পরে, ওপাশের বাড়ির মেয়েটা খুব পড়াশোনা করছে। দুলে দুলে মুখস্থ করে চলেছে। হয়তো কোনো পরীক্ষা আছে। এসব নিয়ে দ্বৈপায়ন তার বেকার বেকার জীবন কাটিয়ে চলে। বাবা বলে, “ইউজলেস!” তীর্থদা নতুন গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে তাকে দেখে করুণা ভরে তাকায়। দিদিই একমাত্র কিচ্ছু বলে না। খিটখিটে হয়ে গিয়েছে মেয়েটা দিন কে দিন। পিকু দিদির থেকে দূরে পালিয়েছে, শোকগ্রস্থ মানুষের সামনে সে অসহায় বোধ করে, না পারে শোকের ভাগ চাইতে, না পারে এড়িয়ে যেতে। তাই সে দীপার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, ফোনে ফোনে ভাইফোঁটা, রাখী পার করে দ্বৈপায়ন বাবা, দিদি আর যারা ছিল না তাদের থেকে অনেক অনেক হারিয়ে গেছে, কলকাতার মধ্যে। আর কলকাতা যখন দ্বৈপায়নকে হারিয়ে দিতে চাইলো?

গোটা ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ও বাড়ির জালনা থেকে। মেয়েটার চোখে চোখ পড়তেই দ্বৈপায়ন টের পেয়েছিল, খুব ভুল হয়ে গেছে। উনত্রিশ বছর বয়েসে প্রেম এসেছে, বড্ড দেরি করে ফেলল না কি? ভাবতে ভাবতে যাদবপুর থেকে পড়িয়ে ফেরার সময় পথের ধারের গাছওয়ালার গোলাপ চারা চোখে ধরে যায়, তারও ঠিকানা হয় জালনার ধার। এখানে রোদ আসতে পারে, মেয়েটা আসতে পারে, মেয়েটা এলো, অনেক ছোট দ্বৈপায়নের থেকে, অনেক সুন্দর দ্বৈপায়নের থেকে, অনেক গোছানো, মায়ের মত, অনেক জোরালো, দিদির মত। মেয়েটার জন্য বাঁশিওয়ালা হয়ে কলকাতার আনাচ কানাচ থেকে সব প্রেমগুলো টেনে টেনে বের করে এনে দিতে ইচ্ছে করে। বাঁশি আসে। অনেক চেষ্টা করে শেখা হয়, বেছে রাখা বিকেলগুলোয় বাজানোও হয়। এরই মধ্যে একদিন জালনাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। সেই থেকে উপেক্ষা পিছু ছাড়ছেনা দ্বৈপায়নের। মেসে তাকে দেখলেই কিসব শোরগোল পড়ে যায়। খাবারের থালা দিতে আসা ছেলেটা কোনোরকমে থালাটা দরজার সামনে নামিয়ে রেখেই পালায়। কি হয়েছে এদের! বুঝে পায়না দ্বৈপায়ন। ঘর লাগোয়া ফোনের লাইনটা কেটে গেল একদিন, ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে যেতেই নোটিশ এলো এক সপ্তাহের মধ্যে মেস ছাড়তে হবে। কারণ- সে জানেনা। ম্যানেজারও কিছু না বলে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। গোলাপ ফুলটা মুশড়ে গিয়েছে, দ্বৈপায়ন ভুলে গেছে নোটিশের কথা। ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় পড়িয়ে ঘরে ফিরতে গিয়ে সে দেখে বিরাট এক তালা। কেউ কোনো কথা শোনেনি, বলেওনি। মেস থেকে দ্বৈপায়নকে ম্যানেজার বিনাবাক্যে ঘার ধাক্কা দিয়ে কোলকাতার রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

আর দ্বৈপায়নও সেই থেকে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে শুরু করলো।