শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ১০ম সংখ্যা, ১ম বর্ষ

নেটিজেন, নেটিকেট আর আমরা

যতদুর জানা যায় 'নেটিজেন' একটি ইংরাজি শব্দ, বাংলা করলে দাঁড়ায় 'একজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যার অনলাইন কমিউনিটিতে অস্তিত্ত্ব সুস্প্ষ্ট রূপে বর্তমান'। এই অর্থে বাংলা সাহিত্যের আশি নব্বই কিংবা শূন্য দশকের অসংখ্য খ্যাতনামা লেখক/লেখিকা এখনো নেটিজেন হতে পারেননি। একটু বিশদভাবে কারণগুলি পর্যালোচনা করলে আমরা বেশ কয়েকটি মতভেদ দেখতে পাব।

প্রথমতঃ এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ লেখক/লেখিকা বিশ্বাস করেন লেখার মাধ্যম মানেই কাগজ-কলম, ইন্টারনেটে লেখা - সেতো কেবল অবসর সময় কাটানো। ভালো লেখা সেখানে দেওয়া বা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়তঃ এই প্রবীণ প্রজন্মের কতজন লেখক/লেখিকা আমরা আজকে পাবো যাঁরা আদৌ ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকেন। অনেকেই কম্পিউটারের ধারে কাছে আসেন না, ইন্টারনেট ব্যবহার আরও দুরের কথা। তৃতীয়তঃ আজকের দিনে যে কয়েকজন খ্যাতনামা লেখক/লেখিকা নবপ্রজন্মের সমকক্ষ হয়ে এগিয়ে আসতে চেয়েছেন তাদের একাংশের বক্তব্য ইন্টারনেটে লেখা চুরি হয়ে থাকে। সুতরাং লেখা লেখির জগতটা ইন্টারনেট না হয়ে খাতা-কলমই ভালো।

আসুন এবার দেখে নিই নবপ্রজন্মের পথিকৃতরা কী বলে থাকেন। তাদের মতে কাগজ-কলম লেখালেখির জন্য অপরিহার্য হতে পারে, কিন্তু এই অমূল্য সৃষ্টিকে নিজের কাছে ধরে না রেখে যদি অগুন্তি পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌছে দিতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের মতো সস্তায় সহজলভ্য মাধ্যম আর হয় না। ধরা যাক একটা সাধারণ মানের লিটল্ ম্যাগাজিন, একটা নূ্ন্যতম ১০০ কপি প্রকাশ করতে গেলে আজকাল কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচা হয়ে যায়। কবিতা বা গল্প-উপন্যাসের বইয়ের কথা তো আরও বেশি। আমরা জানা দু'একজন প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ছাড়া এখনও প্রায় সবাইকেই তাঁদের বই বের করতে হয় পকেট থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচা করে। সুতরাং কতজন লিটল্ ম্যাগাজিনের সম্পাদক, কতজন কবি-সাহিত্যিক নিজের পকেট থেকে বারবার বিপুল পরিমাণে টাকা খরচা করে তাঁর অমূল্য সৃষ্টি কতদিন ধরে পাঠক-পাঠিকাদের দরবারে পৌছে দিতে পারবেন সেটা সত্যিই সন্দেহের বিষয়। সেখানেই সাফল্য নেটিজেনের ক্ষেত্রে, খুব অল্প সময়ে ফেসবুক গ্রুপ বা অধুনা ব্লগজিন তথা ই-ম্যাগাজিনের মাধ্যমে অনেক বেশি সংখ্যক পাঠক/পাঠিকাদের কাছে পৌছে যাওয়া যায় তাঁদের অনন্য সৃষ্টি। আবার এই সমস্ত গ্রুপ বা ব্লগগুলিতে পাঠক-পাঠিকাদের মতামত বা লেখাগুলির সমালোচনা লেখক/লেখিকাদের লেখার মান সমন্ধে মূল্যায়ণের একটা সম্যক ধারণাও পাওয়া যায়। তাই বোধহয় নবপ্রজন্মের কাছে ছাপা বইয়ের চাইতে ই-ম্যাধ্যমে প্রকাশিত লেখার কদর বেশি হতে চলেছে।


এবারে আসা যাক ভালো লেখার কথায়। তরুণ প্রজন্মের উঠতি লেখক/লেখিকাদের মধ্যে আজকাল অনেকই যথেষ্ট ভালো লেখেন, কিন্তু প্রবীণ লেখক/লেখিকারা ভালো লেখার যে মাপকাঠি এতদিন ধরে তৈরী করে গেছেন সেই মানদণ্ডে হয়তো ভালো লেখার সংখ্যা তাঁদের ভাষায় কম হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের লেখার ভঙ্গিমা, শৈলী বা আঙ্গিক তা অনেকাংশেই কেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রবীণ প্রজন্মের লেখার ভঙ্গিমার থেকে সম্পূর্ন রুপে আলাদা এবং আরও বেশি উন্নত মানের। তাই এক্ষেত্রে মতভেদ আসতেই পারে যে লেখাটি সত্যিই ভালো না খারাপ। আবার একথাও ঠিক যে নতুন বা উঠতি লেখক/লেখিকাদের প্রথম দিককার লেখা সত্যি করেই হয়তো সেই মানের নয়, কিন্তু তাদের সেই লেখা নিন্মমানের ধরেই নিয়ে যদি যথাযত সমালোচনা মাধ্যমে তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করা যায় আখেরে বাংলা সাহিত্যের আকাশে হয়তো একদিন এরাই উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে। তাই মনে হয় ভালো বা খারাপ একেবারে সেই আলোচনায় না এসে সমস্ত ধরনের লেখাগুলিকে সকলের মতামতের তালিকায় এনে ফেলাটা সব থেকে আজ বেশি জরুরী।

এবারে আসা যাক লেখা চুরির ব্যাপার নিয়ে। একথা অস্বীকার করা যায় না যে লেখা হুবহু কপি করে সহজেই ই-মাধ্যমে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় এবং নিজের নামে অনেকে অপরের কবিতা এইভাবে কপি করে চালিয়েও থাকেন, যেটা ছাপা মাধ্যমে করাটা অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক, তবে সেখানেও অনেক লেখাই চুরি হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার, যদি কেউ মনে করেন যে তাঁর লেখাটি চুরির হাত থেকে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষা করা অবশ্য দরকার, সেক্ষেত্রে তিনি ইন্টারনেটে 'কমন ক্রিয়েটিভ লাইসেন্স'-এর আওতায় লেখাটি 'কপিরাইটেড' করে নিতে পারেন। তাহলে অন্য কেউ কপি করলে তিনি কপিরাইট ভঙ্গ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে থাকবেন।

চলুন এবারে নেটিকেট নিয়ে একটু আলোচনায় বসি, 'নেটিকেট' বলতে বোঝায় 'ইন্টারনেট এটিকেট' অর্থাৎ কিছু অবশ্য পালনীয় আচরণবিধি যা ইন্টারনেটে কমিউনিটি, ইমেল, ব্লগ বা অন্যান্য সাইটে মেনে চলা হয়। যদিও আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় সেই সমস্ত 'নেটিকেট' নয় যা ইন্টারনেট বা ই-মেলে ব্যবহারের জন্য অবশ্য পালনীয় বরং সেই সমস্ত নেটিকেট যা ইন্টারনেট কমিউনিটিতে বাংলা সাহিত্যের বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আমরা শুধু সেই সমস্ত আচরণবিধি নিয়ে একটু আলোচনা করব যা হয়তো বাংলা সাহিত্যের বিকাশে একটু হলেও সাহায্য করবে।

আজকে তরুণ প্রজন্মের লেখক/লেখিকারা এবং প্রবীণদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা নেটিজেন হয়েছেন তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ব্লগে বা ফেসবুকে লিখে থাকেন। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই দেখব যে লেখার সঙ্গে যেখানে পছন্দ-অপছন্দের স্থান আছে সেখানে অনেকই পছন্দের বোতামটি টিপেই সরে পড়েন, লেখাটি সম্পর্কে তিনি কোন মতবাদ পোষন করেন না বা সমালোচনাও করে থাকেন না। একথা ঠিক নতুন বা উঠতি লেখক/লেখিকাদের অনেকটাই আত্মতুষ্ঠিতে ভোগেন যে আমার লেখা অনেকজন পছন্দ করেছেন। কিন্তু তিনি ভুলে যাচ্ছে বেশিরভাগ নেটিজেনই তিনি দেখেছেন বোঝাতে লাইক বা পছন্দের বোতামটি টিপে থাকেন, প্রকৃতপক্ষে পছন্দসই বোঝাতে নয়। এখানেই আমাদের ব্লগে বা ফেসবুকে নেটিকেট হওয়া দরকার যে লেখা পড়ার পরে আমাদের প্রত্যেকের অবশ্য কর্তব্য সেই লেখা সম্পর্কে সঠিকভাবে খোলাখুলি মতামত পোষণ করা। এই বিষয়ে আশাকরি সকলে একমত হবেন।

দ্বিতীয়তঃ আজকাল কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমরা দেখি শখে বা সময় কাটাবার তাগিদে অনেকেই বাংলা কবিতা লিখতে শুরু করেছেন এবং কয়েকদিন লেখার পড়েই কিছু লাইক পেয়ে বা 'সুন্দর', 'দারুণ' বা এই ধরনের কয়েকটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য দেখে যাইপরনাই আহ্লাদিত হয়ে নিজেকে বেশ বড়মাপের লেখক বা লেখিকা ভাবতে শুরু করেছেন। এই শ্রেণীর লেখক/লেখিকারা নিজের কবিতা লিখে আশা করেন তাঁর কবিতা বা লেখা সকলে পড়বেন বা সমালোচনা করে মতামত পোষণ করবেন, কিন্তু নিজে তিনি কখনও অপরের কবিতা পড়েন না। আজকাল এই ধরণের লেখক/লেখিকাদের সংখ্যাই সবথেকে বেশি হয়ে পড়েছে।


তৃতীয়তঃ যে সমস্ত লেখক/লেখিকারা এখন প্রতিষ্টিত হয়ে গেছেন, হয়ত তারা নেটিজেন আছেন বা নেই, আমরা আশা করব নতুন প্রজন্মের এই ই-মাধ্যমে যে সমস্ত তরুণ/তরুণীরা লিখছেন তাদের হাত ধরে বাংলা সাগিত্যের মুল স্রোতে এগিয়ে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে প্রবীণদেরই অগ্রণী হতে হবে সব থেকে বেশি। তাহলেই ছাপা মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের যে আস্তে আস্তে ভাঙন ধরছে তা রোধ করা যাবে। আগামী দিনে ছাপা মাধ্যমের চেয়ে ই-মাধ্যমই যে সর্বাধিক প্রচলিত হবে এই সত্যটি স্বীকার করে নিয়ে চলুন আমরা সকলে এক সুরে বলি - "লিখুন, পড়ুন আর সকলকেও পড়ান।"

ক্ষেপচুরিয়ানসের পক্ষে
সুমিত রঞ্জন দাস