শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

ধারাবাহিক মৃৎ-সাহিত্য - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার


.
ভাল ভাল গান শুনে বড় হয়েছি আমি ।আচ্ছা গানের সঙ্গে কি লজ্জাবতী লতার কোন সম্পর্ক রয়েছে। আসলে আমার সবসময়ই মনে হয় গান খুব লাজুক হয় । গানের শব্দে আমি কতিপয় পাখিকে উড়ে যেতে দেখেছিলাম ।আবার কিছু পাখিকে ডালে ডালে ফিরে আসতেও। ফাঁকা রাস্তায় মানুষ খুব খোলা মনে গান গায় এবং তা ভুল সুরে ।আমি সাধারণত বাথরুমকে গানঘর বানিয়ে নিই। অগ্রজদের কাছে কলের গানের কথা ঢের শুনি । যুগপৎ বিস্মিত ও নষ্টালজিক হই। অথবা হতে বাধ্য হই ।গানে গানে বোধ করি ভরে উঠেছিল সত্তর দশক । তবে বুঝি বন্দুকের নলের মতই গানও অনিবার্যভাবে শক্তির উৎস হয়ে উঠতে পারে । পাপী ও পাগলেরা গান শুনে আমি দেখেছি এবং আমি নিশ্চিত হিমশীতল নদীগুলি পিপাসার্ত মানুষের মতো কেবল গানের জন্য প্রবাহিত হয় । মানে বয়ে চলে । অথচ কবিদের বিবাহ দিনে গান বাজে । একসময় নাকি বোকাসোকা বিপ্লবীরা গান গাইতে গাইতে ফাঁসিকাঠে চড়তেন । তবে এ নিয়ে বিচলিত হবার কিছু নাই । কেননা দীর্ঘকাল গান বিষয়ে আমি আর ভাববো না । আমার কবিতাতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে কখনো গান আসেনি । আসবার কোন সম্ভাবনাও নেই । তবে যদি কখনো খুব ইচ্ছা করে তবে বান্ধবীদের গান শুনে নিশ্চই আমি খুব আলতো ভাবে তাদের উজ্জল কাঁধে হাত রাখতেই পারি । গানের ভিতর কখনো কখনো বনভোজনের দুপুর এসে ঢোকে । সেই সব দুপুরে সেজে ওঠে থরে থরে মেঘে । আর মেঘের চোখের কাজল । আবার দীঘার ঝাউবন, শিলং পাহাড়ের পাইনবাগান বা কোচবিহার হাসপাতালের মর্গেও সীমানায় বারংবার আছড়ে পড়তেই পারে গানবাজনা, গান ঢেউ এবং এ বিষয়ে কোন সংশয় নেই জীবনানন্দ গান ভালবাসতেন, তাই তিনি সারাজীবন কষ্ট পেয়েছেন।

১০. আমি সারাজীবন বহু দোলনা দেখেছি, দেখবোও। আমার মেমরী ব্যাঙ্কে কতিপয় পাগল থাকবেন যারা মধ্যসেতুতে সাঁকো ঝাকায়। আর তারা একাজ করে বলেই আমরা হয়তো লিখতে পারি সাঁকো ও শালবন। আবার থালা বাসনের কথাও তো ভাবি। মাটির কলস আমাকে টান টান উত্তেজনায় রাখে। লোকদেবতার থানে বেড়াতে যাই। অথচ, বরাবরই আমাকে টেনেছে অপদেবতারা। যেমন আমাদের মাশানঠাকুর। অন্ধকার রাতের এই আদিম পুজো আমার জীবন টলিয়ে দিয়েছে। তাই নাচগানের আসর থেকে ঘুরে এসে আমি বালিতে মুখ ঘষি । অজগরের মতো ঘুমিয়ে পড়ি। অথচ এক সময় ঘুম ভেঙ্গে যায় যখন বোবায় ধরে । কিছু করার থাকে না । শূণ্য রুমাল নাড়াই । বিষন্ন হবার আগে আমাদের গলা লম্বা হয়ে যায় । কিন্তু দ্রতগামী অশ্বের লেজ ধরে ঝুলে থাকবার দিনগুলি যে পেরিয়ে এসেছি । তাই সন্ধ্যেবেলায় টেলিফোন বেশ বিগলিত থাকে । বড় বেশী মধ্যবিত্ত হয়ে যাই । মধ্যবিত্তরা বোধ করি নিরাপত্তার অগ্নিকুন্ডলীর বাইরে বেরিয়ে জীবনের গল্পে ভাসাতে পারবেন না । তাই কবিতার লিখার জীবন সুগন্ধের পিঁড়ি পেতে বসে । শ্বেত চন্দনমাখা রুমাল হয়ে পতপত ওরে।
অনিবার্যভাবেই আমরা মাঝে মাঝে তাই পাহাড়ে বেড়াতে যাই । পাহারের আশে পাশে প্রাচীন গুহা ,বিজ্ঞাপনের টুপি ওড়ে । ছায়া খুবই অর্থবহ; তবু্ও সংকেত টেনে আনে অধুনালুপ্ত ব্রতকথা। উপাখ্যান । এই জনপদে ঘুরে ফিরে ভোরবেলা আসে । রাস্তাগুলি নদী হয়ে যায় সব । প্রিয় শব্দেরা দলা পাকানো কুয়াশার অনুবাদে মুখর । শান্ত শব্দেরা ঢেউয়ের ডাকে পুনশ্চ চঞ্চল । উদ্বেল। বেশ তবে শিখিয়ে দাও কিভাবে উদ্বেল হতে হয় । কিভাবে রাত পাখিটির সাথে একা একা শূণ্যতাযাপন !