বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

সাক্ষাৎকার - উৎপল বন্দ্যাোপাধ্যায়

সাক্ষাৎকার - উৎপল বন্দোপাধ্যায়


সম্পূর্ণ ব্যবহারজীবি পরিবার থেকে চিত্রকলার জগতে প্রবেশ - এটা কিভাবে সম্ভব হল ?
রেখা ও রঙের প্রতি তীব্র আকর্ষনই আমায় বরাবর তাড়িত করেছে ছবি আঁকতে। যে কোনো দৃশ্য বা ঘটনা নিজের মতো করে Represent করতে গিয়েই ছবি আঁকার সূচনা, যার থেকে এই পথ চলার শুরু।

আপনার ছবিতে Composition কিভাবে গড়ে ওঠে ?
Space বা object নিয়ে নিজের বোধ থেকে তৈরী হয় Composition। যা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে, এবং ছবিতে পরিপূর্ণতা লাভ করে। একজন মানুষ বা যে কোনো একটি object দেখে নিজের মতো করে কাগজে ক্যানভাসে তার প্রতিফলন -এর রূপ দিতে গিয়ে composition গড়ে ওঠে।

কি ধরণের চিত্রকল্প আপনার ছবিতে প্রাধান্য পায় ?

মানুষের দৈনন্দিন অনুভূতি আমায় খুব স্পর্শ করে, তার চাওয়া পাওয়া বা না পাওয়া আমায় খুব ভাবায়, মধ্যবিত্ত জীবন যা ভীষণ সাধারণ অথচ খুব অনুভূতিপ্রবণ আবার সংবেদনশীল উপলব্ধি - আমার ছবিতে খুবই প্রকত, যা সবদেশে সবসময়ে সমসাময়িক। আসলে মানুষের মাঝেই তো বেঁচে থাকা, তা যেভাবেই হোক।

কোন ধরণের শিল্পকর্ম আপনি দেখতে ভালোবাসেন ?
সব ধরণের ভালো কাজই দেখতে আমার ভালো লাগে। সবারই যেকোনো কাজের মধ্যে উত্তরণের উষ্ণতা আমায় ভীষণ টানে। দেশী বিদেশি সবার কাজই উপভোগ করতে পারি।

কোন Medium-এ আঁকতে ভালোবাসেন এবং কেন ?
আমার কাজের বিষয়ের সাথে water-colour বা acrylic খুব মানায় কিন্তু সব থেকে বেশী উপভোগ করি mixed-media এ কাজ করতে।
কি রকম ভাবে প্রদর্শনী বা Display  হলে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে বলে আপনি মনে করেন ?
Display প্রদর্শনীর গুরুত্বপূর্ন একটি দিক, এ ব্যাপারে যতটা সম্ভব নিখুঁত হওয়া যায় ততই ভালো। কিছু প্রদর্শণীতে Display-র ব্যাপারে একটা গা-ছাড়া ভাব দেখা যায় যা চোখকে পীড়া দেয়। দায়সারা display ভালো ছবির গুরুত্ব নষ্ট করে দেয় যা হওয়া একেবারেই উচিত না।

আরো বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছানোর জন্য অতীতে কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ... যেমন মেট্রোরেলে শুরুর দিকে শিল্পীদের আঁকা ওরিজিনাল ছবি ডিসপ্লে করা হত যাতে সাধারণ যাত্রীরা ছবির রস যাত্রাপথে আহরণ করতে পারেন এবং প্রয়োজন মনে হলে কতৃপক্ষের কাছ থেকে সেটি সংগ্রহ করতে পারতেন। ভাবলে গর্ববোধ হয় যে সেই কর্মকান্ডের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম।

আপনার যে কোনো একটি ছবির নির্মান সম্পর্কে বলুন ।
ছবি নির্মান অনেকটা ঠাকুর তৈরীর মতো, প্রথমে মাথায় ভাবনা আসার পর একটা প্রাথমিক lay-out তৈরী করি পেন বা পেন্সিল দিয়ে। তারপর মাধ্যম নির্বাচন, ধীরে ধীরে একটার পর একটা স্তর পেরিয়ে ছবি তৈরী হতে থাকে বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে। সব শেষে ফ্রেম তৈরী পর্যন্ত চলতে থাকে এর বিস্তার। অবশ্যই display একটা বিশেষ স্তর। এ ব্যাপারে সকলের মতই আমি ভেবে দেখি যা আমায় সমৃদ্ধ করবে।

আপনাদের গ্রুপ "আহ্লাদী-আটজন" সম্পর্কে কিছু বলুন।
এই Group-এ নবীন ও প্রবীণ দুই ধরণের সদস্যই আছেন যা exhibition ও অন্যান্য কাজের জন্য ভীষণ জরুরী, সবাই নিজের কাজের উৎকর্ষতা প্রমাণের জন্য মরিয়া - আবার একে অপরের পরিপূরক। ভালো কাজের একটা তাগিদ সবাই অনুভব করে , যা খুবই আশাদায়ক।

বাংলার শিল্পীরা কিভাবে এই সময়ের ভারতবর্ষের শিল্প ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে -একটু বিশদে বলুন।
বাংলার শিল্প ভারতীয় শিল্প ইতিহাসকে বহুদিন থেকেই সমৃদ্ধ করে আসছে। আসলে কলকাতা এখনও ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী - একথা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আর এখন বিশ্বায়নের যুগে বাঙালী বা অবাঙালী বলে কিছু নেই, তাই সবাই মিলে সমৃদ্ধকরণের প্রচেষ্টা করছে বলে আমার মনে হয়।

শিল্পকলার বাজারের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ?
বাজার কথাটা আমি মানি না। ভালো কাজ লোককে আকর্ষন করবেই, চিরকাল এটাই হয়ে এসেছে। এখন তো মাঝারি বা ছোট মাপের শিল্পীদেরও কাজ বিক্রী হচ্ছে - অন্ততঃ ২৫ বা ৩০ বছর আগেও ভাবা যেত না, তখন বহু শিল্পীই অন্য পেশায় যুক্ত থেকে ছবি আঁকতেন বিক্রির আশা না করেই। তাই বিক্রির কথা না ভেবে বালো কাজ করে যাওয়া উচিত। আর ছবি বিক্রি খানিকটা ভাগ্যের উপরেও নির্ভর করে। বহু বিখ্যাত শিল্পীর কাজই প্রথম দিকে বিক্রি না হলেও পরবর্তীকালে ভীষণভাবে আর্থিক সফলতা লাভ করেছে।

সাধারণ মানুষের ধারণা "ছবি খুব জটিল জিনিস" - আপনি সহমত পোষণ করেন ?
আসলে আমাদের দেশের বেশীরভাগ লোকেরই এরকম ধারণা রয়েছে, যা আমি নিজে ঠিক বলে মনে করি না। জটিল বা সরল এটা নির্ভর করে দেখার উপর - কই Film-এ একথা চলে না, তখন দুটো ভাগ হয়ে যায়, art film আর commercial film । তাহলে ছবি কেন দুর্বোধ্য হতে যাবে। যেভাবে represent করা হচ্ছে তার ধরণটাই একটা ব্যাপার যা মানুষকে দেখতে সাহায্য করে। দেখার চোখটাই আসল। আমি মনে করি ভাবনার প্রতিফলনটাই আসল - ছবি অযথা জটিল করাটাও ঠিক না।


কোন সময় তুলি তুলে নিতে  হয় ছবি থেকে, কিভাবে ঠিক করেন ?
ছবির একটা পরিপূর্ণতা আছে, পরিপূর্ণতা যেটা কাজ করতে গিয়ে বোঝা যায়। ছবি আঁকা নিজস্ব গতিতে পরিপূর্ণতা পায়, একটা সময় মনে হয় আর কিছু করার দরকার নেই আবার এক এক সময় মনে হয় আর একটু কাজ করলে বোধহয় ভালো হয়। এটা সব সময় শিল্পীর নিজস্ব ব্যাপার। সেটা কিন্তু অন্য কাউকে বোঝানোর মত নয় কাজের মধ্যে থাকলেই একমাত্র এটা অনুভব করা যায়। এটা শিল্পীর নিজস্ব বোধের ব্যাপার।

কোনো শব্দ বা কবিতা কি কখনো  শিল্পীর সৃজনে সাহায্য করে ?
হ্যাঁ, নিশ্চয় করে। এর আগেও দেখা গিয়েছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার অনুপ্রেরণায় শিল্পী গণেশ পাইন বহু ছবি এঁকেছেন। কবি জীবনান্দ দাশের কবিতার অনুপ্রেরণায় শুভাপ্রসন্নের মতন বহু শিল্পী কাজ করেছেন। কারণ বহু কাজ যেগুলি শব্দ দিয়ে অনুপ্রেরিত হয়েছে, শিল্পী এঁকেছেন কিন্তু আসল প্রেরণা ছিল কবির শব্দ মাধ্যম। এটা একটা সম্পুর্ণ পরিপুরক মাধ্যম যেটি আলাদা হলেও অনেক ক্ষেত্রে একই পথের পথিক।

পরবর্তী প্রজন্মের  শিল্পী/কবি/দর্শক/পাঠকদের কিভাবে সাহায্য করতে চান ?
এটা সব সময় একটা গড়ে ওঠা ... এক্ষেত্রে একজন শিল্পী, কবি, দর্শক বা পাঠক কিন্তু আলাদা নয়, একজন পাঠক কিন্তু ভালো দর্শক হতেই পারে, যে শিল্পী সে কিন্তু ভালো পাঠক হতেই পারে। বলা যেতে পারে গড়ে ওঠাটাই ব্যাপার এবং একে অন্যের সহযোগীতা না পেলে উন্নততর সুস্থ স্বাভাবিক সাংকৃতিক পরিবেশ গড়া ভীষণ মুশকিল। দ্বিতীয়ত ইতিহাস এমনটাই বলে যে ভালো কবি বা শিল্পী সঙ্গে সুস্থ মনষ্ক পাঠক বা দর্শক অবশ্যই অবশ্যই জরুরী।

ছবি আঁকিয়ে না হলে কি হতেন ?
এটা আমি কখনো ভেবে দেখি নি। আমি যেটা দেখেছি সেটা হলো ছোটবেলা থেকে ছবিটা আঁকতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। কৈশোরে আমেরিকান লাইব্রেরীতে যাতায়াত করতাম; পিকাসো, দেগা , রেমব্রান্ট, লোত্রেক বা মোনালিসার প্রিন্ট দেখে মোহিত হয়েছি, ভেবেছি প্রিন্ট এত সুন্দর ওরিজিনাল না জানি কি !!! জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনির্মল বসু বা অন্নদাশংকর রায় পড়া শুরু সেই সময়টাই থেকে, কলেজ লাইফে পেয়েছি গণেশ হালুই, রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়, নিরঞ্জন প্রধান বা বাঁধন দাসের মতন মহাপুরুষের সান্নিধ্য। ফলে অল্টারনেটিভ আমার কাছে আর কোনো অপশন ছিল না। আমার মনে হয় যে আমি যদি ছবি না আঁকি ... তাহলে সেটাই হবে দুঃস্বপ্ন ।

শিল্পীর কিছু শিল্পকর্ম -