বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

ব্যক্তিগত গদ্য - বিমোচন ভট্টাচার্য

আমার ছোটকাকা
বিমোচন ভট্টাচার্য



যে ঘটনার কথা লিখতে যাচ্ছি সেটা আমার ছোটবেলার ..মানে আমি তখন সাত বা আট , আমাদের বিরাট যৌথ পরিবার ছিল তখন ... আমার ছোটকাকা আমার বড় দাদার চেয়ে ছোট ছিলেন.. দুজনে দুজনকে নাম ধরে ডাকলেও ছোট কাকা, তাঁর ছোট বেলা থেকে বিদ্রুপ শুনেছেন দাদার থেকে ছোট হবার জন্যে ..সেই জন্যেই , এখন মনে হয় , ছোট কাকা খুব সেক্লুডেড জীবন যাপন করতেন ,, একটি কুকুর ছিল তাঁর আলসিসিয়ান। তার নাম ছিল শীর্ষেন্দু ,,,কুকুরের নাম শীর্ষেন্দু? পরে শুনেছিলাম শীর্ষেন্দু নামে তাঁর এক অতি প্রিয় বন্ধু প্রয়াত হবার পর ই তিনি কুকুরটি পুষতে শুরু করেন .. তাই ওই নাম.. একদিন ... খুব গরম তখন .. বারান্দায় আমরা ক ভাই খেলছিলাম, এমন সময় আমার এক খুড়তুতো ভাই আমাদের দেখালো আমাদের শীর্ষেন্দুর সঙ্গে রাস্তায় একটা কুকুরের লেজের সঙ্গে লেজ জড়িয়ে গেছে ..(এটাই আমাদের বলা হত তখন ), অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন, তার মধ্যে হাসছেন ও কেউ কেউ। ওদেরই একজন আমাদের বললেন-'তোদের ছোট কাকাকে ডাক ',... আমরা সকলে মিলে ছোট কাকাকে গিয়ে ঘটনাটা বললাম, ছোট কাকা তরতর করে নেমে গেলেন নীচে.. আমরা আবার বারান্দায় .. ওপর থেকে আমরা দেখলাম আমার ফর্সা ছোট কাকার মুখটা লাল হয়ে গেছে.... মা চিত্কার করছেন -' ওরে পিন্টু ,বাড়িতে ঢুকে আয় ..ও তো চলেই আসবে একটু পরে ..আর লোক হাসাস না .. আমার দাদা দিদিরাও দেখলাম মুখ টিপে হাসছেন ... আপাতশান্ত আমার ছোট কাকা কিন্তু বাড়িতে এলেন সঙ্গে শীর্ষেন্দু কে নিয়ে .. স্নান করালেন কুকুরটিকে সাবান দিয়ে তারপর নিজের চিলে কোঠার ঘরে শীর্ষেন্দুকে নিয়ে চলে গেলেল.. দরজা বন্ধ হয়ে গেল আর তার পরেই শুরু হলো বেত দিয়ে কুকুরটিকে প্রহার... আমার এখনো মনে পরে ছোট কাকার সেই প্রলাপ আর শীর্ষেন্দুর সেই চাপা আর্তনাদ.. মা দরজা ধাক্কা দেন .. আমার অতি নিরীহ ঠাকুমা, আমার দাদা দিদিরা সবাই ডাকাডাকি করেন (বাবা বাড়ি ছিলেন না ) , আমার অন্য কাকারা ডাকেন কিন্তু ছোট কাকার কোনো হুঁশ নেই .. বেশ কিছু সময় পর ছোট কাকা দরজা খোলেন .. চোখ দুটো লাল ... ঠাকুমা ধরতে যান ছিটকে সরে গিয়ে ছোট কাকা নীচে নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন .. শীর্ষেন্দু তখন অর্ধমৃত .. মা বললেন ' আহা রে এমন করে কেউ মারে. মলম এলো ..লাল ওষুধ এলো সেগুলো লাগানো হলো ওর গায়ে ।ছোট কাকা ফিরলেন অনেক রাতে। ততক্ষণে বাবা ফিরেছেন এবং তাকে পাড়ার লোকজন ই ব্যাপারটা বলে দিয়েছেন পাড়ায় ঢোকা মাত্রা।সেটা আমরা তাঁর কাছেই শুনলাম .. মা , ঠাকুমা না খেয়ে বসে ছিলেন ..ছোট কাকাকে বাবা বললেন 'কুকুরটাকে ওই ভাবে মারলি কেন ?? তুই তো জানিস এই সময় ওদের কিছু শারীরিক প্রয়োজন থাকে (কিছুই মানে বুঝিনি তখন ).. সেই প্রথম দেখলাম ছোট কাকার চোখ ভর্তি জল .. এদিকে ছোট কাকা বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষেন্দু পায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে ... বাবা আরো বললেন -যা খেয়ে নে ..মা আর তোর বৌদি না খেয়ে বসে আছে সেই সকাল থেকে ... ছোটকাকা খাওয়া দাওয়া করে শীর্ষেন্দুকে নিয়ে ফিরে গেলেন চিলেকোঠার ঘরে । বেশ কিছুদিন ছোটকাকাকে পাড়ার বন্ধুরা ক্ষেপাতো ওই ব্যাপারটা নিয়ে ,, দাদা বেশি মেলামেশা করত পাড়াতে, মাকে প্রায় ই বলত পিন্টুর জন্যে পাড়ায় মুখ দেখানো যাচ্ছেনা ... মা বকাবকি করতেন দাদা কে ...তার পর আসতে আসতে ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল .. পাড়ায় অন্য কোনো ঘটনা ঘটলো যেটা এর চেয়েও মুখরোচক , সকলে সেটা নিয়ে পড়লো । আমাদের বাড়িতে দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটলো বেশ কিছুদিন পর। সেই কুকুরটির বাচ্ছা হলো বেশ কয়েকটি যার সবকটাকেই প্রায় আমাদের শীর্ষেন্দুর মত দেখতে ।সেই কুকুরটি থাকত আমাদের বাড়িটার নিচের রকে।আমাদের তো খুব ফুর্তি ঐরকম ফুটফুটে ছ সাত টি বাচ্ছা দেখে .. মা, ঠাকুমা সাবধান করলেন , এ সময় মা কুকুররা খুব কামড়ে দেয় কিন্তু আমরা এত আদর করা সত্যেও পাঁচী কিন্তু আমাদের কিছুই বলত না .. ব্যাস আবার পাড়ায় শুরু হয়ে গেল গুঞ্জন -দাদার মুখ গম্ভীর হলো .. ছোট কাকা আরো গম্ভীর .. বাড়ির বাইরে বেরোলেই বাচ্ছা কুকুরগুলো পায়ে পায়ে ঘুরত .. ছোট কাকা একটা লাঠি নিয়ে বেরোত .. বাচ্ছা গুলোকে নয় ওদের মাকে দেখতে পেলেই মারতে যেত ....একদিন আমরা বাইরে খেলছি .. ছোটকাকা বেরোচ্ছেন হাতে লাঠি.. ছোটকার এক অতি ঘনিষ্ট বন্ধু টনিকাকু ছোটকাতে বললেন ---কি রে তোর বৌমার ওপর এত রাগ কেন তোর ?? আর নাতি নাতনি গুলোকে তো একটু আদর টাদর করতে পারিস.. তা না দেখা হলেই লাঠি পেটা করিস... টনি কাকুর সঙ্গে যারা ছিল সবাই হেসে উঠলো আর ছোটকা এমন একটা কান্ড করলো যা ইতিপূর্বে আমরা কোনদিন করেতে দেখিনি .. হাতের লাঠিটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো টনি কাকুর ওপর, এলোপাথারী মারতে লাগলো টনিকাকুকে , মাথা ফেটে গেল টনিকাকুর ছোটকাকেও বেশ ভালই মারলো বাকি লোকেরা .. মা , ঠাকুমা দাদা কোনরকমে বাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে আনলো ছোটকাকাকে ।আজকের দিন হলে থানা পুলিশ হত কিন্তু তখন সেসব হয় নি । ছোটকা আসতে আসতে কি রকম যেন হয়ে গেল .. পাড়ায় বেরোনো বন্ধ করে দিল .. একদিন টনি কাকু এসেও বোঝালো , কিন্তু ছোটকা নির্বিকার ।বেশীর ভাগ সময় ঘরের ভেতরই থাকতো । একদিন সকালে বাড়িতে হইচই ..আমাদের ওপরে উঠতে দেওয়া হচ্ছেনা .. তবুও শুনতে পেলাম চিলেকোঠায় ছোটকা গলায় দড়ি দিয়েছে ... শীর্ষেন্দুর একটা চাপা কান্না শুনতে পাচ্ছিলাম .. দেখতে পাচ্ছিলাম মা , ঠাকুমা . পিসিমারা , দাদা দিদিরা কাঁদছেন.. পুলিশ এলো বাড়িতে .. এক সময় ছোটকার বডি নামালো হলো নীচে ..পুলিশ সেই বডি নিয়ে চলে গেল । পরদিন আবার আমাদের বাড়িতে এলেন ছোটকা .. ফুলে ফুলে ঢাকা হয়ে ,সবাই কাঁদছে .. হঠাত কোথা থেকে টনি কাকু এসে আছড়ে পড়লো ছোটকার দেহে ..বিলাপ করতে লাগলো হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে -'আমার জন্যেই তোকে চলে যেতে হলো রে পিন্টু ..কেন যে তোকে বলতে গেলাম ওই কথা গুলো সেদিন ।সরিয়ে নেওয়া হলো টনি কাকুকে ... দেখলাম পাঁচী তার বাচ্ছা কাচ্ছা নিয়ে দেখছে ছোট কাকাকে ... বাবা বললেন -' শীর্ষেন্দুকে নিয়ে চল শ্মশানে ...চলে গেল সবাই হরিধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানের দিকে । এর কিছুদিন পর শীর্ষেন্দু ও মারা যায়, কিছুই প্রায় খেত না ছোটকা চলে যাবার পর .. আমরাও অন্য পাড়ায় চলে আসি ওই বাড়িটা ছেড়ে । আজ এতদিন পর ছোটকার কথা লিখলাম কেন ? কাল ছোটকার জন্মদিন ছিল .. একটা প্রায় ধুসর হয়ে যাওয়া ছবিতে কাল আমার পঁচাত্তর বছর বয়েসের দাদা একটা মালা পরালো ..আর আমার মনে পড়লো আমার একটা ছোটকাকা ছিল ।