বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০১৪

ধারাবাহিক - সৌমিত্র চক্রবর্তী

বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – ছয়
সৌমিত্র চক্রবর্তী



কৃষ্ণচূড়ার ডাল একে একে হাসতে শুরু করেছে। খাঁটি লাল রঙ ছেনে নিবিড় মনোযোগে সে এখন ব্যাস্ত তার ভালোবাসার ফুলগুলো তৈরী করতে। প্রিয় ফুল খেলিবারই দিন যে অদ্য। সে না ফুটলে পৃথিবীর তাবৎ প্রেমিকযুগল যে অথৈ জলে পড়বে। ওদিকে পলাশ তৈরী তার ভালোলাগা-ভালোবাসার সম্ভার নিয়ে। দেখতে দেখতে আরো একটা রঙিন বসন্ত এসেই গেল। চারপাশের মানুষেরই তৈরী করা দুঃখ, অন্যায়, অভাব অতিক্রম করে যায় এই মাত্র কয়েকটা দিন। এ সময় সখী রঙ লাগানোর মনে।

কাঁধের ঝুলিটা সামলে নিয়ে থমকে দাঁড়ায় লোকটা। হাত বোলায় তার উস্কোখুস্কো চুলে। দুমড়ে যাওয়া আধময়লা জামা প্যান্ট, মুখের কতদিনের না কামানো দাড়ি, হাত পায়ের শাসনহীন নখ তার যাযাবরবৃত্তিকে প্রকট করেছে। ঠিকমতো বলতে গেলে উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করে চলেছে। এই ট্রেডমার্ক তার ইচ্ছাকৃত নির্মাণ নয়। কিছু আলস্যে, কিছু মনের ভুলে, আর কিছুবা অভিমানে। ঠোঁটের কোনায় স্নিগ্ধ হাসির একচিলতে রেখা ফুটে ওঠে তার। বাসন্তিক এই সময় প্রেমের। আর প্রেম তার জীবনে ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। কখনো নীরবে, কখনো সশব্দে রীতিমতো জানান দিয়েই। বারবার সামুদ্রিক টাইফুনের মতো আছড়ে পড়েছে তার ওপর, ছিন্নভিন্ন করে দিতে চেয়েছে তার বৈরাগ্য সত্বাকে। কিন্তু তার শতাব্দীপ্রাচীন কচ্ছপের খোলার মতো মনকে ভেদ করতে পারেনি কেউই। কেন জানিনা তার মনে হতো ওই সমস্ত প্রেমের উচ্চন্ডতায় ভালোবাসার চেয়ে দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছে কিম্বা তার আর্থিক স্তম্ভের প্রতি ভালোবাসাই বেশি ছিল। বারবার, তার বন্ধ দরজায় প্রেম কড়া নেড়ে ফিরে গেছে। লোকটার মনে এতটুকুও আঁচড় কাটতে পারেনি কেউই, শুধু একজন ছাড়া।

চমকে শক্ত মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে লোকটা। তার মনের সারাগায়ে লেগে যায় ধূলো। দুহাত দিয়ে ঝাড়তে গিয়ে নজরে পড়ে আকাশের আশ্চর্য ঔজ্জ্বল্য। চারপাশ এতো ঝলমল করছে। “ভালোবাসি ভালোবাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলেস্থলে বাজায় বাঁশি”। গলার কাছে হঠাৎ শক্ত কি একটা যেন অকারণেই দলা পাকিয়ে ওঠে। কয়েকদিন আগেই পড়েছিলো এক কবি বলেছেন – “ সব নন্দনতত্বই থাকে যোনির নিচে”। সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি সব ভালোবাসা-প্রেম উত্তরিত হয় জননেন্দ্রিয়র কেন্দ্রে? তাহলে আকাশ হাসে কেন? হাওয়া সিরসিরে ছোঁয়া দিয়ে উতল করে কেন? আপন আনন্দে একলা মাঝি গলা ছেড়ে উদাত্ত গানে কেন নিজেকে মজিয়ে দেয়? সবই কি কামগন্ধসর্বস্ব? কে জানে এর উত্তর? কে জানে? দৈহিক মিলন যে কত আনন্দের হয়, কত নিবিড় প্রেমের জন্ম দিতে পারে তা সে নিজে জানে। আসলে এই রূপকথার রাজ্যের চাবির খোঁজ সবাই পায়না। শুধুমাত্র বীর্যস্খলনেই তাদের আনন্দ। আর তাই পরস্পরের সঙ্গে দেখা হলে একে অন্যকে বলে ভালো থাকবেন। কিন্তু ভালো থাকেনা কেউই। ভালো থাকতে জানেনা কেউ।কেউ ভালো নেই মনের অসম্পূর্ণতায়।
ভালো থাকো বললেই
ভালো থাকা যায়?
যত সব স্বপ্নবাজ ইচ্ছেসকল
ভালো নেই বিষন্ন সন্ধ্যের
টুকরো আকুলতায়।

ভালো থাকো বললেই
কি করে ভালো থাকা যায়?
দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল। খিদেয় পেটের ভেতরের ভাসমান প্লেটগুলো পরস্পরের সাথে ঠোকাঠুকি শুরু করে দিয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে কোনো খাবার সংস্থান দেখার চেষ্টা করে সে। না, এই তেপান্তরের মাঠে দাঁড়িয়ে কোনো খাবারের দোকানের প্রত্যাশা তার নেই। কিন্তু যদি কোথাও... হঠাৎই চোখে পড়ে একরাশ দোদুল কাঁধসমান উচ্চতার সবুজ ফসলের ওপর। উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার দৃষ্টি। চিনতে ভুল হয়নি তার। দ্রুত এগিয়ে এসে সবুজ ক্যামোফ্লেজের আড়ালে থাকা সোনালি দানার একটা ফসল ছিঁড়ে নেয় সে। ভুট্টা। আঃ! কতদিন পরে ভুট্টা দেখলো সে। এই একটামাত্র ভুট্টা খাবার জন্যে যে চাষীর অনুমতির কোনো প্রয়োজন হয়না, তা সে জানে। সত্যি বলতে কি এক্ষেত্রে অনুমতি নিতে গেলেই তাকে চাষীর বিস্মিত চোখের মুখোমুখি হতে হবে। এই অকপটতার দেশে খাবার জন্যে একটা ভুট্টা নেওয়াকে চুরি বলেনা। এরা এখনো মুখোশটা পরতে শেখেনি।

তাকে সে বলতো ঝাম্পুলি। কেন বলতো তা লোকটা নিজেও যেমন জানেনা, ঠিক তেমনি যাকে উদ্দেশ্য করে বলা হতো সেও জানেনা। কিন্তু তার সাড়া দিতে কোনো কসুর ছিলোনা। বলতে কি সে না ডাকলেও সে ঝাঁপিয়ে পড়তো তার মনের জানলায়। কুবো পাখির মতো কুব কুব শব্দ করে তার সব মনোযোগ কেড়ে নিত। থাক আর কাজ করতে হবেনা, খেয়ে নাও এবার...। “নাইবা ডাকো রইবো তোমার দ্বারে/রইবো তোমার ফসল খেতের কাছে/যেথায় তোমার পায়ের চিহ্ন আছে...”। কেন যে চোখের কোনে ঢেউ ধেয়ে আসে... কেন যে লবণাক্ত হ্রদ বাসা বাঁধে তিস্তাপারে!

টাট্টু ঘোড়া টা আবার ছুটতে শুরু করেছে। লাইটইয়ার গতিতে ধেয়ে আসছে তার দূর বিস্তৃত পথের ওপর দিয়ে তারই দিকে। অনুভব করে লোকটা। বাসন্তিক এই বিকেলের ঘন মদিরতা আচ্ছন্ন করে তাকে। একমনে সে পৌঁছে যায় তার ফাল্গুনী হৃদয়ের ধ্যানবিন্দুতে। কোথাও কোনো কষ্ট নেই, দুঃখ নেই, আবিলতা নেই, কৌশলী প্যাঁচের বাহার নেই। আছে শুধু আনন্দ, একরাশ মুক্ত আনন্দ।