বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

মৃৎ-সাহিত্য - এপিটাফ - সুবীর সরকার

মৃৎ-সাহিত্য - এপিটাফ
সুবীর সরকার


১১

কাষ্ঠ নির্মিত ঘরবাড়ির প্রতি আবাল্য আকর্ষণ আমার । আমার বাল্যকালের অনেকটা কেটেছে কাঠের বাড়িতে । কাঠের সব বাড়ি ঘরের মাঝ খানে । এবং আজ কানে বাজে পিতামহর কাঠের খড়মের শব্দ । আবার ঝরনার পাশে ঝোরার কাছে কাঠের বাড়ি । কাঠের বাড়ি মানেই জঙ্গল আর জঙ্গল । জঙ্গল থেকে হাওয়া আসে । হাওয়া এসে ঢোকে কাঠের বাড়ির মধ্যে ।কাঠের বাড়ির সামনে দিয়ে উত্তরের হাতির পালদলবেধে যায় । আবার কাঠের বাড়ির কাঠের বারান্দা থেকে কেউ কেউ হাতিমিছিলের ছবি তুলে । তবে বনবাংলো এবং কাঠের বাড়ি কখনো এক নই । জদিও উভয়ই কাঠ দিয়ে নির্মিত । বনবংলোতে প্রবেশের জন্য ভ্রমনোপযোগী বিকেল দরকার । আর বর্ষাকালের ভেতরে আকুল হয়ে থাকে আমাদের কাঠের ঘরবারি ।তরাই ডুয়ার্স এ এখনও কতো কাঠের বাড়ি । ছরানো ছিটানো । কাঠের বাড়ী আমাদের স্বপ্ন ঝাপি । স্মৃতিকাতর করে । আর স্মৃতিকাতরতা খুলে দেয় দেখা জল চোখ ।আমার কবিতায় খুব চলে আসে কাঠের বাড়ি । বাড়ির সামনে চিলতে মাঠ । নাবাল জমির ঢাল । কাটাগাছে।বনতুলসী । কবিরা আসেন এখানে নদী পেরিয়ে । ছবি আঁকবার লকজনও । আর সকলে সিঁড়ি ভেঙেই কাঠের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে । আর তারা তো ঢুকেই আর চুপ চাপ বসে থাকেনা । মানে বসে থাকাই যায় না । কাঠের ঘরবাড়ী আবার নিসগপ্রীতিজাগায় ।তখন একা একাই গান ধরা । একা একাই হাততালি। কাঠের বাড়ির তৈলচিত্রে পাখিদেরও দেখা যায় । খুব মনখারাপের দিনে আমি কাঠের বাড়ির স্বপ্নে দুবে থাকি ।স্বপ্নে কাঠের বাড়ীকে পাশ কাতিয়ে চলে আসে কাঠের খড়ম , কাঠের আরামচেয়ার , ভ্রমনলাঠি ও কাঠের সিঁড়ি । অথবা সিঁড়িটাতে বাদ দিয়ে বা ঠেলে সরিয়ে দেয়াওয়া যায় কেননা সিঁড়ি তো কাঠের বারিরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ ।


১২

দিদির মৃত্যুর দিন বৃষ্টি হচ্ছিল । বৃষ্টি হচ্ছিল এটা সত্যি ।সত্যি দিদির মৃত্যুও। বৃষ্টি হচ্ছিল তবে সেটা জোরাল বা ধারালো বৃষ্টি নই । বৃষ্টি থামছিল আবার শুরু হচ্ছিল । অথবা বৃষ্টি টেনে নিয়ে যাছিল বৃষ্টিকে । আচ্ছা " টেনে নিয়ে " কাটছাঁট করে লিখি বরং " নিয়ে যাচ্ছিল " । বৃষ্টি তবে কথায় যাই । যায় বললেই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে ।ফাঁকা ফাঁকা মানে মহাশূন্যতার একতা বোধ ।অনুভূতি । কবিতা লিখবার সময় কালে এমনকি পড়বার সময়ে বা রিক্সায় চেপে একা একা ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তেও ফাঁকা ফাঁকা অবশ্যই ভাবায় ।ভাবায় এবং দীর্ঘ ভাবনার পরেও আমার শূন্যতাটা সরে না । সরে না তাই পাহাড়ে বেড়াতে গেলে আমি পাথর গড়িয়ে দিই। গড়িয়ে দিই একারণে অনুতাপ হয়ই না কোন । শহরের শীত সহজেই যুক্ত করে নেয় সার্কাসের তাঁবু । জোকারের হৈ-হল্লা রাজহাঁসের ডাক ঘোড়াদের মৃদু মেদুর সমবেত হাসি -----এইসব স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে সার্কাসের প্রসঙ্গে ।প্রসঙ্গ এমন জিনিস বারবার বদলে যাওয়া যার স্বভাবধর্ম । বদলে যাওয়াটা যথাযথ শোনাবে যদি বলি অবস্থানবিন্দুর ঘরফেরা ,চলাচল ।চলাচল এবং ঘরাফেরা চমৎকার ছবি টাঙিয়ে দেয় ।একজন পর্যটক ।একাধিক ধর্মযাজক ও অজস্র হাটফেরত জনতা সমুদয় অনুযঙ্গ এসে বসে পড়ে টাঙিয়ে দেওয়া সেই ছবিতে আর একনদী থেকে বেরিয়ে আসা আরো এক নদী থাকলে তৎসহ বেরিয়ে আসা নদীর ঢালু জুড়ে যদি কিছু উড়ন্ত পাখির ঝাঁক টেনে আনা যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে উপহারযোগ্য ছবি হয়ে উঠবে সেটা আর কথাপ্রসঙ্গে চলাচল ও ঘোরাফেরা মুদ্রাদোষের মত ঘুরে ফিরে আসবে।যেমন কত কত শব্দ রোজদিন ঘুরেফিরে আসে । আর তাদের অধিকাংশই ঘরে ফিরে চলে যায়।চলে যাওয়াটা সামান্য মর্মাহত করে ।আবার উৎফুল্লও ।চলে যায় বলেই তো আবার খুজতে সুরু করি ।জাগরণে থাকি । থাকি তাই বৃষ্টি হচ্ছিল এই শব্দটি আমাকে সবসময় দিদির মৃত্যুর কথা ,মৃত মুখের কথা মনে করিয়ে দেয় ।