বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

অপ্রকাশিত ডাইরি - মলয় রায়চৌধুরী

আলুর গৌরচন্দ্রিকা
মলয় রায়চৌধুরী




১৯৬৪ সালে ঠাকুমা ৯৪ বছর বয়সে মারা যাবার পর, আমাদের উত্তরপাড়ার বসতবাটী 'সাবর্ণ ভিলা' খন্ডহরে পরিণত হয়েছিল । কিন্তু কলকাতায় রাতে কোথাও আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না বলে ওই খন্ডহরেই রাতটা কাটাতে হতো । ঠাকুমা একা কী করে ওই বারো ঘরের বিশাল খন্ডহরে থাকতেন জানি না ; উনি পাটনায় আমাদের কাছেও যেতে চাইতেন না, বলতেন যে পাটনার বাড়িতে উনি হাঁপিয়ে ওঠেন ; গাছপালা নেই, খোলা আকাশ নেই, কুয়োতলা নেই, বাংলায় গল্প করার জন্য বুড়িদের জমায়েত নেই । ষাটের দশকে যখন আমার বিরুদ্ধে মামলা শুরু হল, আমি ওই খন্ডহরেই আদালত থেকে ফিরে যেতুম রাতটা কাটাবার জন্যে । ঠাকুমা থাকতে ওনার হবিষ্য খেয়ে চলে যেত । উনি মারা যাবার পর খাওয়াটা সমস্যা হয়ে দেখা দিল । সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে উঠত কলকাতার বাইরে থেকে আমার বন্ধুবান্ধবরা আসলে । কলকাতায় তাঁদের আস্তানা নেই । অনেকে খন্ডহরটাই পছন্দ করত প্রধানত যা ইচ্ছা তাই করার বা ফোঁকার বা পান করার স্বাধীনতার জন্যে । ত্রিদিব মিত্রের বাড়ি ছিল হাওড়ার সালকিয়ায় ; তবু ও মাঝে-মধ্যে উত্তরপাড়ার খন্ডহরে থাকতে চলে আসত আমার সঙ্গে । ঠাকুমা মারা যাবার পর বাড়ির সিংদরজার পাল্লা দুটো আর দুটো পায়খানারই কপাট চুরি হয়ে গিয়েছিল । বন্ধুবান্ধবদের বলে দিতে হয়েছিল যে পায়খানায় গেলে সামনেই মগ রেখে দিতে, যাতে জানা যায় যে কেউ একজন ভেতরে বসে ধ্যান করছেন । আমি পাটনামুখো হলে ওরা পাটনাতেও চলে আসতো ।


একবার অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, যারা আমাদের আন্দোলনের পোস্টার প্রচ্ছদ ইত্যাদির ড্রইং এঁকে দিত, ওরা এসে পৌঁছল খন্ডহরে । আমরা তিনজনে ওই বাড়িতে একত্রিত হয়েছি দেখে ত্রিদিবও পৌঁছে গেল । একেবারে খন্ডহর গুলজার । সকালে মুড়ি কাঁচালঙ্কা খেয়ে-খেয়ে কয়েকদিনে চোঁয়াঢেঁকুর আরম্ভ হলে ত্রিদিব আইডিয়া দিল যাওয়া যাক গৌরকিশোর ঘোষের বাড়ি, সকাল-সকাল । গৌরকিশোর ঘোষ থাকতেন বরানগরে । খেয়াঘাটের কাছে আমাদের বসতবাটী থেকে হন্টন দিয়ে বালিখাল, তারপর সেখান থেকে বাস ধরে বরানগর । বালিখাল ধেকে শ্যামবাজার যেত বাসগুলো । সকালের ব্রেকফাস্টটা গৌরকিশোর ঘোষের বাসায় সারা যাবে । তখন বালিখালের ফ্লাইওভারটা তৈরি হয়নি ।


সেসময়ে 'দর্পণ' নামে একটা ব্রডসাইড পত্রিকা প্রকাশিত হতো । তাতে আমাদের সম্পর্কে 'বিদেশি সাহিত্যের নকল' ধরণের টিটকিরি মেরে খবর বেরোত । প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই বেরোত কিছু-না-কিছু । ঠাট্টা করে কার্টুনও বেরিয়েছিল কয়েকবার । কার মগজ থেকে ওই মন্তব্যগুলো বেরোচ্ছে তা জানার জন্য আমি, দেবী রায়, সুবিমল বসাক আর ত্রিদিব মিত্র ঢুঁ মেরেছিলুম 'দর্পণ' দপতরে । গিয়ে পাওয়া গেল না কাউকে । ফতুয়া-লুঙ্গি পরা একজন পাকাচুল ম্যানেজার ছিলেন যিনি অফিস সামলাতেন । তাঁকে আমাদের কয়েকটা বুলেটিন দিলুম সম্পাদকদের পড়তে দেবার জন্য । তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলুম যে কাগজটা শুরু করেছেন যুগান্তর পত্রিকার অমিতাভ চৌধুরী আর আনন্দবাজার পত্রিকার গৌরকিশোর ঘোষ । ওনারা দুজনেই খবর পেলেন যে আমরা দলবেঁধে ঢুঁ মেরেছিলুম । অমিতাভ চৌধুরী, বুলেটিনগুলো পড়ে আমরা কী করতে চাইছি অনুমান করলেন, আর পর-পর দুটি সংখ্যা 'দৈনিক যুগান্তরে' সম্পাদকীয় লেখালেন ; আমাদের সমর্থন করেই বলা যায় । সম্পাদকীয় দুটো লিখেছিলেন কবি কৃষ্ণ ধর । আনন্দবাজারে আমাদের সমর্থনে লেখার প্রশ্নই ওঠেনা । অবশ্য 'দেশ' পত্রিকায় জ্যোতির্ময় দত্ত একটা দীর্ঘ তাচ্ছল্য-গদ্য লিখেছিলেন, 'বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ' শিরোনামে , তাতেও সেই একই বক্তব্য, বিদেশি প্রভাব । জ্যোতির্ময় দত্ত এখন আমেরিকায় থাকেন । সম্প্রতি দিল্লির অরুণ চক্রবর্তী আমেরিকা গিয়ে জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জ্যোতির্ময় অরুণকে জানিয়েছেন যে 'হাংরি আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যের একমাত্র আন্দোলন' । মন্দ লাগেনি শুনে !


আসল প্রসঙ্গে ফিরি । গৌরকিশোর ঘোষ আমাকে ওনার বাসায় ডেকে পাঠালেন, সকালে একসঙ্গে রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাবার নিমন্ত্রণ জানিয়ে । ওনার বাড়ির কাছে কোনো মিষ্টির দোকানে সকালে লাইন লাগে ওই কম্বিনেশান খাবার জন্যে । সেই সূত্রেই অনিল, করুণা, ত্রিদিবকে নিয়ে ওনার বাসায় ব্রেকফাস্টটা সেরে ফেলবার উদ্দেশ্যে রওনা দিলুম । চারজন পৌঁছে গেছি দেখে উনি চ্যাঁচারি ভরা রাধাবল্লভি আর হাঁড়িভর্তি আলুর দম আনালেন । খেতে-খেতে তর্কাতর্কি শুরু হল । গৌরকিশোর ঘোষ শুরু করলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান-এর লিভস অব গ্রাস দিয়ে । ত্রিদিব জীবনানন্দে ইয়েটস, বাংলা কবিতায় সনেটের আঙ্গিক, ছোটগল্পের জন্ম ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলল । অনিল-করুণা রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকায় ফরাসি প্রভাব নিয়ে তর্ক জুড়লো । গৌরকিশোর ঘোষ আমাদের নাটকে 'থিয়েটার অব দি অ্যাবসার্ড'-এর কথা তুললেন । আমি কারোর পক্ষই সমর্থন করছিলুম না । একজন কোনো কথা বললেই, আমি শুধু আলুর দমের প্রসংশা করছিলুম । কী দারুন স্বাদ, এত বড়-বড় কেটেও কত নরম, ভেজে করে না সিদ্ধ করে করে, জ্যোতি না চন্দ্রমুখি, রাধাবল্লভির সঙ্গে রাজযোটক কম্বিনেশান ইত্যাদি বলে যাচ্ছিলুম । সাহিত্য নিয়ে একটি কথাও নয় । রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাওয়াবেন শুনে আমি তর্কটার জন্যে তৈরি হয়েই এসেছিলুম ।


গৌরকিশোর ঘোষ, আমার দিকে তাকালেন , মিটিমিটি হাসি সহযোগে বললেন, ও, বুঝেছি, রূপদর্শীকে গুলগল্পের টেক্কা দিচ্ছ ! গৌরকিশোর ঘোষ রূপদর্শী ছদ্মনামে লিখতেন আর তাঁর সেই লেখাগুলোকে বলতেন গুলগল্প ।


আমি বললুম, হ্যাঁ দাদা, আলু জিনিসটা আমাদের দেশের নয় । আমাদের দেশে আসেওনি বেশিদিন হল । এই কন্দমূলটি পোর্তুগিজরা প্রথম জাহাঙ্গিরের দরবারে উপহার দিয়েছিল । স্পেন যখন ইনকাদের হারিয়ে তাদের দেশটাকে দখল করল তখন তারা লাল আলু নিয়ে গেল ইউরোপে । ইউরোপ থেকে লাল আলু এলো আমাদের দেশে । পর্তুগিজরা পেরু বলিভিয়া থেকে শাদা আলুর প্রচলন করেছিল উপনিবেশগুলোয় । আমাদের দেশে ওয়ারেন হেস্টিংস আলুচাষের ব্যবস্হা করেন । প্রথমে দেহরাদুনে চাষ হতো ; তাই তাকে বলি নইনিতাল আলু ; সেই আলুরই জাতভাই হল চন্দ্রমুখি ।


গৌরকিশোর ঘোষ পিঠ চাপড়ে বললেন, 'মক্কেল দেখছি ব্রিফ তৈরি করেই কেস লড়তে এসেছে । ঠিক আছে, পুরোদস্তুর নেমন্তন্ন রইল, পরের বার ফুল কোর্স লাঞ্চ খাওয়াবো ।'
আমার আর যাওয়া হয়নি । পঁয়ত্রিশ মাস ধরে কেস লড়তেই কালঘাম ছুটে গিয়েছিল । 



2 comments:

ঘনাদা বলেছেন...

মলয়দা
আলুর দোষ- গুণ সব পড়লাম । তবে " প্রশংসা" হবে । একটু দেখে নেবেন ।
আর এইগুলো তো এখন ইতিহাস, যেগুলো কথনই পড়ানো হবে না ।
পড়ে যাচ্ছি আপনার লেখা ।

ঘনাদা বলেছেন...

* কখনই হবে । দুঃখিত