বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

নিজের সঙ্গে নিজে - পিয়াস মজিদ

কবিতাজীবনী-২
পিয়াস মজিদ


সৌন্দর্যসমস্ত এবং কুৎসিতের মাঝে সমভাবে ক্রিয়শীল অলঙ্কারশাস্ত্র; এর জারকরসেই সবকিছু প্রাণ পায়। বহতা সমুদ্রের গভীরে আছে অলঙ্কারজ্ঞান, সুউঁচু পর্বতের শিরদাড়াঁয় অলঙ্কারজিজ্ঞাসা জাজ্বল্য, শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যও অলঙ্কারবহুল। নিবিড় নীলিমা, সীতার পাতাল ইত্যাকার সবাই এক গূঢ় অলঙ্কারের নির্মাণমাত্র। আমার ভাবনায় নভোম-লের যাবতীয় সৃষ্টির অমোঘ সূত্র অলঙ্কারশাস্ত্র। কবিতা যদি প্রাচীন কলা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই তার অলঙ্কারও প্রাচীনতম। অলঙ্কারের পরিস্রুতিতে কবিতার শরীরকাঠামো এবং আত্মা উভয়ই নির্মিত হয়। প্রাচীনকালে প্রকৃতির সঙ্গে কবি তথা মানুষের সম্পৃক্ততা এত ব্যাপকমাত্রার ছিল যে কাব্যালঙ্কারেও তার ছাপ দেখতে পাই। বিশেষত কৌম সমাজে কবিতা-পাঠের যে সংস্কৃতি তাতে জনমানুষের সঙ্গে যোগাযোগযোগ্য পদ্ধতিতে কবিতার সাজসজ্জার প্রচলন স্বাভাবিক। ধ্বনিবাহুল্যের কথাও এ প্রসঙ্গে প্রধানত উল্লেখ্য। আর চিত্রকল্প। সে কিভাবে কবিতার অন্তর্বয়ব ও বহির্দেশ তৈরি করে? বস্তুভিত্তির সঙ্গে দূরকল্পনার সংযোগ এমন সব চিত্রমালাকে দৃষ্টিসম্ভব করে তোলে যা একভাবে হয়তো খুব স্বাভাবিক, অন্যভাবে হয়তো অভাবিতপূর্ণ। এর আলিঙ্গন ও প্রহারে কবিতার প্রকৃত মুক্তি শুরু হতে থাকে। বাক্যের বন্ধন থেকে তার যাত্রা হয় অপার রহস্যালোকে। যে রহস্যই কবি এবং কবিতাপাঠকের অন্বিষ্ট। চিত্রকল্পের মৌলকাজ মনে হয় এমনই।
আমার নিজের কবিতার সূত্রে বলতে পারি যে কাব্যভাষাকে তার খটখটে, রুঠা ও নীরস অবস্থান থেকে দূরে সরিয়ে নেয় চিত্রকল্প। লাবণ্যের আদিখনি ওর কাছেই। সে ডাকে। কিন্তু আমার কবিতা কি তার ডাকে যথাযথ সাড়া দিতে পারে? কারণ কবিতায় বলার কথা প্রায়শই এত ক্লিশে হয় যে চিত্রকল্পের অনন্যতা বহনে সে হয় অক্ষম। আর তখনই জন্ম নেয় রাশি রাশি অকবিতার। তাই আমার কবিতার উদ্দিষ্ট কথাকে অর্থের সীমাবদ্ধ ঘেরাটোপ হতে ছিন্ন করে চিত্রকল্পের দূরগামিতার সাথে তার সংহতি প্রতিষ্ঠা। তবে সাথে সাথে এও মনে করি যে সংবেদন-প্রধান কবিতাও যেমন দূর্বল চিত্রকল্পের জন্যে মৃতবৃৎ মনে হয় তেমনি অনেক সময় চরম বক্তব্যবহুল কবিতাতেও প্রকৃত চিত্রকল্পের বিভা তাকে উত্তীর্ণ কবিতা হিসেবে প্রতিভাত করে। তাই চিত্রকল্পের ধরন তাৎপর্যবাহী। সামান্য একটি চিত্রকল্পের নির্মাণে ভূমিকা রাখে ভৌগোলিক বাস্তবতা, সমাজ-দেশগত অভিজ্ঞান, সময়ের তাপ ও শৈত্য ইত্যাদি অজস্র প্রপঞ্চ। কবিতার চিত্রকল্প অলৌকিক নয়, লৌকিক। কবির অশ্রু, রক্ত, প্রলাপ, হাহাকার, শক্তি, ক্ষয়, শান্তি ও নৈরাজ্য যেমন চিত্রকল্পের গাঠনিক উপাদান তেমনি চতুপার্শ্বের পঞ্চভূত, যাবতীয় রৌদ্র ও মেঘ, জনতা ও নির্জন সব-ই চিত্রকল্পের উদ্গাতা।
কবিতায় এমন এক চিত্রকল্পের সন্ধান করি যা স্বাভাবিক এবং একই সঙ্গে অদৃষ্টপূর্ব। যাতে মানবিক লিপ্ততার সাথে আছে অতিপ্রকৃতিক উদ্ভাবনা। কোন এক শক্তির পুরোহিত কাজ করে প্রত্যেক কবির অন্তরে; নিরন্তর। চিত্রকল্প সেই ঘুমন্ত পুরোহিতকে জাগায়। সকল ব্যাকরণ ফুরিয়ে গেলে সে পুরোহিত জ্বালিয়ে দেয় ভৌততম রসের ধারা।
এভাবে চিত্রকল্প, এভাবে কবিতা।