বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

শিলালিপিতে খোদাই করে যাবো তরুণদের কবিতা - অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

শিলালিপিতে খোদাই করে যাবো তরুণদের কবিতা
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়


কাল যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় আজ আমি কী করব ?
কাল যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আজ আমি কী করব , এটা ভাবতে ভাবতেই ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে যেতে পারে । এত কিছু করার আছে , এত কিছু করতে বাকি , কোনটা করব কোনটা না করব সেটার জন্য চব্বিশ ঘন্টা বোধহয় যথেষ্ট নয় । তবু ভেতরের কিছু সুপ্ত ইচ্ছে পিপীলিকার ডানা গজায় মরিবার তরের মতো “কল্পনা আজ চলছে উড়ে হালকা হাওয়ায় পাল মেলে/ পাঁপরি ওজন চলছে তাতে সেই হাওয়াতে পাল পেলে” । যদি সত্যি তাই হয়, অর্থাৎ “ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা” যখন আমি তাহলে শ্রীজাত, বিনায়ক আর অংশুমানকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের তরুণ কবিদের জন্য মহাকালের পাশে রেখে যাবো তাঁদের সৃষ্টি । পৃথিবী যদি সত্যি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পাঠক তবলে আদৌ তো কেউ থাকবে না, আমরা যাদের নিয়ে নান্দনিকতায় মগ্ন থাকি সেই এক একটা টুকরো ইমেজারি চলে যাবে উদভ্রান্ততার ঈশ্বর গহ্বরে । থাকবে না এই কাগুজে লিপি, বৈদ্যুতিক লিপি । কিন্তু হয়তো বা অজন্তা ইলোরা রেখে যাবে তার সামান্য ধ্বংসাবশেষ । আর তার জন্যই আমি বেঁচে থাকা বাংলাভাষীদের শেষ মুহূর্তে জানিয়ে যাবো আমাদের পরবর্তী তরুণ কবিদের সৃষ্টির মাহাত্ম । আমার স্বপ্ন আমি, শ্রীজাত, বিনায়ক আর অংশুমান মিলে একটা ব্লগ করব শেষ দিনে তাতে বাংলা ভাষার সমস্ত তরুণদের প্রচুর কবিতা সংকলিত করে শেষ দিনেও অন্তত চল্লিশ হাজার পাঠককে তাদের কবিতা পড়াবো । তারপর যতখানি পারব সবাই মিলে সেই কবিতাগুলোকে খদাই করে রেখে যাবো শিলালিপির মতো কোনো গুহার ভেতরে যাতে ধ্বংসের পর আবার যদি কোনো সভ্য মানুষের উৎপত্তি হয় আর তারা যদি বাংলাভাষাটা বুঝতে পারে তাহলে তাঁদের জন্য থাকবে আমাদের চারজনের তৈরী এই তরুণ কবিদের পাথুরে শিলালিপির সংকলন । হতেও তো পারে, এটাই হয়ে উঠবে তাঁদের কাছে কবিতা কী তা জানার একমাত্র উপায় । হতে পারে কয়েক হাজার বছর পরে যখন মঙ্গলগ্রহের কোনো প্রান কিউরেটরের ধ্বংসাবশেষ দেখে পৃথিবীর সন্ধান করতে এলো , বা স্পিলবার্গের কোনও ভিনগ্রহের প্রাণী এসে যদি বাংলা বুঝতে পারে তাহলে তারা দেখতে পারবে এই সময় ভাষার এক অনুপম আঙ্গিক । সেই হবে আমার শ্রেষ্ঠ চাওয়া ।


ইচ্ছে যখন শেষ মুহূর্তেরই তখন ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে নেই । জানি স্রষ্ঠার এই ভয়ানক ধ্বংসলীলার চেয়ে সন্ত্রাস আর কিছু নেই , তবুও যারা ধ্বংসের আগে এই সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংসের পথ দেখিয়েছিলেন তাঁদের অন্তত মরার আগে কিছু দিয়ে যেতে চাই , বুঝিয়ে দিতে চাই ধ্বংসের চেয়ে জীবনের মূল্য কতখানি ছিল । যদি সেই চব্বিশঘন্টায় তাঁদের কাছে পৌঁছনোর কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তি পেয়ে যাই, তাহলে অবশ্যই আমি শেষ চব্বিশ ঘন্টায় যেতে যাই পৃথিবীর সমস্ত সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তিদের বা গোষ্ঠীদের কাছে আর উপহার দিতে চাই ‘লেভ তলস্টয়’ এর বই – ‘রেজারেকশন’ । আর ধ্বংসের আগে আমাদের এই সোনার বাংলার অন্তত ৫০ জন কিশোরকিশোরীকে উপহার দিতে চাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সমগ্র কিশোর সাহিত্য’ । আর যদি আমার একেবারে ব্যক্তিগত ইচ্ছের কথা বলতে হয় তাহলে আমার একান্ত ইচ্ছে বাইরের সেই ধ্বংসের উষ্ণ হাওয়া বইবার আগে, সমুদ্রের জল আমাদের চারপাশকে ঘিরে ঘোরার আগে আমার প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে শেষ মুহূর্তের অন্তিম অবস্থান একটা ফাঁকা সিনেমা হলের মধ্যে টাইটানিক এর সেই দৃশ্যে যেখানে রোজ আর জ্যাক সমুদ্রে ভাসছে । ঠিক সেই সময়েই যেন পৃথিবী ধ্বংস হয়, আর সিনেমাটাও যেন ফ্রিজ হয় সেখানেই , এর থেকে পরম পাওয়া আর কী হতে পারে ... 41°46' N, 50° 14' W এর সেই অন্তিম সলিল সমাধি ।