শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৩

ধারাবাহিক - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


১।


আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু দিচ্ছিল



সে তাকিয়ে থাকে আর দেখে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালগুলো শুয়ে, জানলাগুলো নুয়ে আর ছাদভুঁয়ে এসে পড়েছে। বাইরে আকাশের দিকে একটা তোরণ, হতে পারে কোন মণ্ডপ আর নহবতখানা। তার আগে মেঘে-মেঘে কিছু রঙ হয়েছিল। পৃথিবীর কন্যাদের বিদায়। এইসময়, যে, কন্যে নয়, হাইওয়ের দিকে উঠছিল। পেট্রোলভ্যানের আলো মাপমত তার পেছনে এসে পড়েছিল। তারপর আর কিছু জানা নেই।


বিষাদ জ্বর নিয়ে গাছগুলো, মনে হয়,দেখে ছিল। প্রলাপ মারীর মধ্যে ছিল তারা। তাই সেভাষা পাতায়-পাতায় বোনা আছে। কোনদিন পাঠোদ্ধার হতে পারে। এদিকে তোলাবাজরা আকছার দানা ব্যবহার করছে। সন্ধের পর থেকেই শোনা যাচ্ছে সেসব অনিপুণ হাতের কারবার। ভারী ভারী মোটর বাইক সব শহরে ঢুকে পড়ছে। যেসব দোকানীরা ফ্লাইওভার, মেট্রো, মল শুঁকেশুঁকে এসেছিল, তারা হাতের সাথে সাথে ল্যাজও গোটাচ্ছে। হয়েছে বেশ। খচ্চর ছোকরারা যা যা মারাচ্ছিল, তার সাথো সংস্কৃতি মিশিয়ে দিচ্ছে। দেদার। লুটছেও ভাল।


সে শুধু লক্ষ্য রাখছে। হিপ পকেটে একটা ছোট নোটবুক, আর পেন্সিলারদের হাতে যেরকম থাকে ঠিক সেরকম একটা পেন্সিল। সুযোগ পেলেই আঁকিবুঁকি কাটছে। আর এমন ভাবে লেখাগুলো আওড়াচ্ছে যে মনে হচ্ছে বাপের না হলেও তার নিজের শ্রাদ্ধের খরচপত্রাদি। একাজে স্টেশানটা তাকে সাহায্য করছে খুব। স্টেশানের নিচে বাজারচত্বর। সব কটা নেশার ঠেক। মদ্দামাগি। শনিমন্দির লাগোয়া মাদুলি দোকান। গেল শনিবারের শালপাতা যেখানে একটা বাছুর চাটছে, ঠিক তার পাশ দিয়েই হাইওয়েটাতে উঠে যাওয়া যায়। এখন একটা ছেলে আর দুটো মেয়ে উঠছে।



২।


তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে…



বাজারী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় যেসব মফঃস্বলের কবিদের লেখা ছাপানোর আমন্ত্রণ জানানো হয় নি, তারা স্টেশান পেরিয়ে, এই প্রাচীন রাস্তাটার মোড় পেরিয়ে, বহু জন্মের নার্সিংহোমটার ঠিক নিচে, অফ্-সপটার সামনে, বাওয়াল দেয়। আর নক্কাছক্কা নেশা করে,যাদের লেখা ছাপা হয়েছে তাদের মা-মাসি করে। এরকমই একটা চাপের সন্ধ্যায় সে সেই নার্স-দিদিমণিকে নার্সিংহোমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে ও দেখতে থাকে। তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে।


আর ঠিক তেমনই তার শাদা জুতো।


নার্সদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণেই সে বাওয়াল দৃশ্য ত্যাগ করে তাকে অনুসরণ করে। ফোর পয়েন্ট ক্রসিঙে যে একটা নিদারুণ শাদা গাড়ি যে একটা নিদারুণ লাল আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল, দিদিমণি এসে সে-টাতে উঠে পড়ে। গাড়িটা শান্ত ও স্নিগ্ধ ভাবে গড়াতে শুরু করে, যেন তার অ্যাক্সিলিয়েটরে চাপ পড়তেই সন্ধ্যা হেলে যায়। আর ঠিক সে সময়েই, ভারী মোটরবাইকটা, এই দৃশ্য-কাব্যের মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়বে বলে, যেনসাইলেন্সর পাইপ ফাটিয়ে, গর্জনরত অবস্থায় গাড়িটার পিছু নেয়। এরপর আর কিছু জানা নেই। কারণ, জানা যায় না।


সে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। গুনে গুনে দুটো হোঁচট খায়। কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টকে সময় জিজ্ঞাসা করে। কাঠিকাবাব রোলের দোকানটা বন্ধ দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তারপর তার ডেরায় ঢুকে পড়ে । আজকের যা যা অনুসন্ধান নোটবুকে লিখে ফেলে। পেন্সিলটাকে ভাঁজে যত্ন করে রাখে।


এ সময়ে মোবাইলটা দুলে দুলে ওঠে। শব্দ তার কাছে বিভীষিকা বলে সে ওটাকে নিথর করে রাখে, ঠিক সেই নির্দেশে, যেভাবে ভাষ্যময় গলায় থিয়েটার শুরুর আগে রেকর্ডেড বাজানো হয়। সে অজান্তে হেসে উঠে। নিজেকে হেসে উঠতে শুনে একটু লজ্জিতও হয়। কারণ, তার বুকশেলফের পেছনে আর একটুও তলানি স্কচ নেই। যে কলটা ইনকামিং, সেটা তাকে আরও কিছু সময় বিব্রত করবে। তার আগে গলায় ঢেলে দিতে পারলে হত। কান দুটো গরম আর ভারী পড়ত। সে বাদ দিতে দিতে শুনত। তারপর না হয় বাদানুবাদে যেত।