শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৩

সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব - সুজন ভট্টাচার্য

সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব
সুজন ভট্টাচার্য


এত দ্রুততার সাথে এই লেখা জমা দেবার হুকুম এল যে এমন একটা গুরুগম্ভীর বিষয়কে কিভাবে সাজিয়েগুছিয়ে পাঠকের দরবারে পেশ করব, সে ভাবনাটুকুরও সময় নেই। অগত্যা খানিক কানামাছি ভোঁভোঁ করেই দায় সামলাতে হবে। এপাশে ওপাশে খামচে খামচেই আলোচনাটা করতে হবে। তাতে যদি সূত্রভঙ্গ হয়, নাচার।


বিশ্বের রহস্যময়তার মাঝখানে প্রবহমান জীবনধারা মানুষের মনে যে হিল্লোল তোলে, মানুষ সাহিত্য বা অন্য যে-কোন নান্দনিক সৃজনশীলতার মাধ্যমে তাকে পুনরাবিষ্কার করে এবং সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার নবনির্মাণ করে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার মধ্যে যে নতুন প্রসঙ্গটি চলে আসে তা হল সৌন্দর্যসৃষ্টি। অভিজ্ঞতার অনুভবের সৌন্দর্যায়িত বহিঃপ্রকাশ-ই হল মানুষের নান্দনিক সৃজনশীলতা। স্বাভাবিকভাবেই সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। এই প্রেক্ষাপটেই সাহিত্যে রাজনীতি বা অন্য যে-কোন সামাজিক প্রসঙ্গের প্রভাবকে বিচার করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের উপাদান


সাহিত্যের উপাদান জীবন এবং জীবননির্গত ভাবনাসমূহ। সাহিত্যের প্রকাশমাধ্যম বর্ণরূপ সংকেতের দ্বারা প্রকাশিত ভাষা। যেহেতু ভাষা জনজীবনের সকলেরই সাধারণ সম্পদ বা অধিকার, ফলে সাহিত্য অন্যান্য অনেক প্রকাশমাধ্যমের থেকে অনেকবেশি প্রত্যক্ষ। সাহিত্যের উপজীব্যতা এবং তার ভাববিস্তার অনেক বেশি জনবোধ্য এবং সেই কারণেই প্রাচীনকাল থেকেই তার রসমোক্ষণ অনেক ব্যাপক। সাহিত্যের এই বৈশিষ্টের জন্যই পাঠকমননে তার ক্ষরণের সম্ভাবনা যেমন অসীম, তেমনি আবার এই প্রত্যক্ষতার জন্যই সাহিত্যের চলনেরও সমস্যা অপরিসীম।

মানবসমাজে চলমান অসংখ্য দ্বন্দ্বের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হল ব্যক্তিসত্তা বনাম সামাজিক সত্তা। যদিও এমন একটা মত উঠে আসতেই পারে, আদতে সেই ব্যক্তিসত্তা কি সামাজিক সত্তারই এক সংক্ষিপ্ত ও বিশিষ্ট রূপ নয়! ভাবা যাক, একটি মিছিল চলছে; আপনি-আমি সেই মিছিলে পা মিলিয়েছি। হঠাৎই আকাশের এককোণে মেঘের আস্তরণের মধ্যে এক হলুদ-গোলাপি আলোর পটি ঝিকমিক করে উঠল। আমি হয়তো তাকে একবার দেখে নিয়েই আবার সামনে এগোলাম। আর আপনি আকাশের দিকে চোখ রেখে একটুখানি পাশে সরে দাঁড়ালেন, আরেকটু ভাল করে উপভোগ করবেন বলে। এই পার্থক্য মানুষে-মানুষে থাকবেই। কেউ হালকা আলোয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুরে নিমজ্জমান থাকতে ভালবাসবেন, আর কেউ হয়তো সেই সময়েই মোড়ের মাথায় রাজা-উজির মারবেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল, একজন সাহিত্যকার এই দুজনের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন তার সৃষ্টির চরিত্র বা ব্যাখ্যানবস্তু হিসাবে? আমি প্রথাগত কলাকৈবল্যবাদের কথা তুলতে চাইছি না। ভবিষ্যতের সৃষ্টিকর্তা হিসাবে তিনি কোন উপাদানটি বেছে নেবেন? এটাই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এবং সেই সিদ্ধান্ত তার ব্যক্তিমানসের প্রকাশ। কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল – এমন কোন সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয় না, আর তাই যে যার দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী কোন একজনকে বেছে নিতেই পারেন। কিন্তু, কেউ মিছিলের একজনকে বেছে নিয়েছেন বলে রাজনীতিকরণের দ্বারা সাহিত্যকে কলুষিত করেছেন ( যে অভিযোগ বারবার বিভিন্নজনের সম্পর্কে শোনা গেছে)- এমনটা ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়। ধরুন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’র কথা। তার মানবিক ও নান্দনিক অভিঘাত নিয়ে কোন বিরূপ প্রশ্ন কোথাও শোনা যায় নি। কিন্তু, এমন প্রশ্ন তো শোনাই গেছে, গোটা উপন্যাসে গ্রামীণ দারিদ্রের এক মহাকাব্যিক উপস্থাপনা সত্ত্বেও একবারও একজন মহাজন বা জোতদারের দেখা পাওয়া গেল না! তাহলে কি উপন্যাসের পটভূমিতে এমন একজনও ছিল না? সেটা কি বাস্তব! প্রশ্নটার যাথার্থ নিয়ে কোন সংশয় না থাকলেও, একইসাথে এটাও অবশ্যমান্য যে ‘পথের পাঁচালী’ এক অনন্য রচনা। আবার, মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’-র কথা ধরুন। এক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্য দিয়ে পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে যেতে তিনি আবার এক সন্তানহারা মায়ের অনুভূতির পরম বিকাশ ঘটিয়ে ফেলেন। অতএব, রাজনীতি নেই বা আছে, কেবল এটা দিয়েই নান্দনিক সিদ্ধান্ত টানা যায় না।

সমাজ ও রাজনীতি


সমাজে একজন মানুষ তো আর পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবেই কোন একক ও স্বয়ং-স্বতন্ত্র সত্ত্বা নয়। কখনো সে পরিবারের সদস্য, কোথাও একটা পাড়া বা গ্রামের বাসিন্দা, কখনো গোটা দেশের নাগরিক। তার একক ব্যক্তি-জীবনের অনেকটাই সেইসব সামাজিক সত্ত্বা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মননের যে অংশে এসে সে স্বাতন্ত্র দাবি করে, সেটাও আবার বিন্দুমাত্র সামাজিক ভিত্তি ছাড়া বিকশিত হতে পারে কিনা, সে বিতর্কও অতি-অবশ্যই আছে। আপাততঃ সে প্রসঙ্গ থাক। আমরা সামাজিক মানুষকেই বিচারে আনি। সেই মানুষটাকে তার খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়, ট্রেনে-বাসে যাতায়াত করতে হয়, পাড়ায় আগুন লাগলে বা বন্যা হলে প্রাণে বাঁচতে হয়, বন্ধের দিন পথে বেরোবে কিনা ভাবতে হয়। চাইলেও তার জীবন থেকে সে রাজনীতিকে বাদ দিতে পারে না। এমন নয় যে তাঁকে সিপিএম- টিএমসির কথাই ভাবতে হবে। কিন্তু গ্যাসের দাম বেড়েছে বলে সে তার বৌকে বলছে, রান্নার বহরটা একটু কমাতে হবে, অথবা ছুটির পরে দুটো টিউশন নেবে কিনা ভাবছে। তার হাতে কোন ঝান্ডা নেই; কিন্তু বিবিধ ঝান্ডার ছায়া তাকে ঘিরে রেখেছে।

এই মানুষটার জীবনকে যদি কেউ সাহিত্যের উপজীব্য করতে চায়, তাহলে সে রাজনীতিকে এড়াবে কি করে? আর সেই কারণেই সাহিত্যে রাজনৈতিক প্রভাব, চাই বা না চাই, চলে আসতেই পারে। রাজনীতি কি শুধু রাজা বা মন্ত্রীদের শলা-পরামর্শের প্রসঙ্গ? প্রাচীন ও মধ্যযুগে অবশ্য সেটাই ছিল রেওয়াজ। আর সেই সময়ের সাহিত্য যেহেতু রাজার পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব ছিল না, ফলে সেখানে এই প্রসঙ্গ আসে নি। রাজনীতিকে রাজসভার অঙ্গন ছাড়িয়ে জীবনের খোলা ময়দানে নিয়ে আসার জন্য রেনেসাঁর প্রয়োজন পড়েছিল ইউরোপে। এবং সমকালীন ইউরোপিয়ান সাহিত্যে রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা গেল। ফ্রান্সে ভিক্টর হ্যুগো-ই হোন বা ইংল্যান্ডে শেলী – রাজনীতির ভিত্তিতে সাহিত্য বা সাহিত্যে রাজনৈতিক দিকনির্দেশ একটা প্রবণতা হয়ে উঠল।
আমাদের সাহিত্যের ক্ষেত্রেই ধরা যাক। কবিকঙ্কনের ফুল্লরার বারমাস্যা তো সেই এক গ্রামীণ নারীর অভাব আর হাহাকারের গাথা। মনে রাখবেন, মার্টিন লুথারের বাইবেল অনুবাদ ইউরোপে সমাজ জাগরণের পথ খুলে দিয়েছিল। আমাদের চৈতন্যদেবও জাতপাতের বিরুদ্ধে প্রায় সমকালেই প্রবল আওয়াজ তুললেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সামাজিক শক্তি তাঁকে গ্রাস করে নিল, হারিয়ে গেল তাঁর আন্দোলনের শক্তি। কিন্তু যেটুকু নাড়া পড়েছিল, তার উপর দাঁড়িয়েই চলে এল ভাঁড়ু দত্ত, তৎকালীন বাংলার রাজশক্তির লুন্ঠনের প্রতীক। এটা কি রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নয়? কিংবা মৈমনসিংহ গীতিকার আখ্যানগুলো?

আসলে রাজনীতি বলতে যদি কোন বিশেষ দল বা মতাদর্শের কথা বলি, তাহলে এক কথা। কিন্তু রাজনীতির সেই সংকীর্ণ সংজ্ঞা আমাদের কোথাও পৌঁছে দেবে না। রাজনীতি হল সমাজের বুকে বিবদমান যাবতীয় শক্তির মধ্যে আপাত-ভারসাম্য বজায় রেখে কোন এক বিশেষ পক্ষের ক্ষমতা বজায় রাখার প্রকরণ। এখন সেই ক্ষমতা যদি প্রতিমুহূর্তে গায়ের জোরেই প্রমাণ করতে হয় তাহলে সমাজে এমন এক দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হবে যেখানে সমাজের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানোই মুশকিল। তাই রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রসারণের স্বার্থে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর গোষ্ঠী সমাজ-মননে এমন সব চিন্তা-প্রতীক গুঁজে দেয় যা তার ক্ষমতাকে প্রশ্নের অতীত করে তোলে। তাই কর্মফল বা জন্মান্তরবাদকে ভিত্তি করে যে সাহিত্য রচিত হবে, তাহলে তাকে কি রাজনৈতিক চিন্তাশ্র্য়ী বলা হবে? প্রশ্নটা জটিল।

সাহিত্য ও রাজনীতি


সরাসরি রাজনীতিকে উপজীব্য করে যে সাহিত্য, তাকে রাজনৈতিক সাহিত্য বলে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বিশ্বসাহিত্যে এমন অজস্র নমুনা পাওয়া যায় যা আদ্যন্ত রাজনৈতিক উপাখ্যান হয়েও নান্দনিক বিচারে অনুপম। হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘স্পার্টাকাস’, ‘ফ্রিডম রোড’, ‘লোলা গ্রেগ’, জ্যাক লন্ডনের ‘পিক স্কিল ইউ. এস. এ.’, ‘আয়রন হিল’, বরিস পাস্তারনেকের ‘ডঃ জিভাগো’, জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’, ম্যাক্সিম গর্কির ‘মাদার’, ‘লোয়ার ডেপথ’, - এমন উদাহরণ অজস্র। ফলে মূল বিষয় রাজনৈতিক হলে সার্থক সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না, এহেন অভিযোগ অর্থহীন।
আবার কোন-কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য সরাসরি না থাকলেও, সমাজদেহের জটিলতার ব্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে এক রাজনৈতিক বাতাবরণের স্পষ্ট আভাষ পাওয়া যায়। লিও টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’ বা ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’ – এজাতীয় উদাহরণও প্রচুর। আসলে বৃহৎ ক্যানভাসে উপাখ্যান রচনা করতে গেলে যুগযন্ত্রণার যে ছবি উঠে আসবে তার রাজনৈতিক প্রসঙ্গকে অবহেলা করা যাবে না। ছোটনাগপুরের জঙ্গলের জনজীবনের সঙ্গে দু-চারদিনের অভিজ্ঞতায় যদি শুধু কষ্টি পাথরের মত এক নারী শরীরের আখ্যানই উঠে আসে, অবহেলিত থাকে জঙ্গলের ঠিকাদারদের বা পাথর খাদানের বাবুদের সমাচার, তাহলে সেই উপাখ্যান যতই শিল্পমন্ডিত হোক না কেন সেটাও খন্ডিত। রাজনৈতিক সাহিত্য যদি শিল্পবোধের প্রতি অবহেলা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক উপাদানকে অস্বীকার করাও সমাজ-বাস্তবতার প্রতি অসততা।

শেষের শুরু

অতি-সংক্ষিপ্ত পরিসরে এবং চরম দ্রুততায় যেটুকু বলা সম্ভব হল, সেটা কখনই এক পূর্ণাঙ্গ চিন্তার প্রকাশ হয়ে উঠতে পারে না। ইলিয়াড-অডিসি বা মহাভারত কতদূর রাজনৈতিক, নাকি এক রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটকে ব্যবহার করে আসলে তারা শুধুই মানবিক দলিল – এ প্রশ্নেরও আলোচনা প্রয়োজন। মধ্যযুগে যে কবি লেখেন, ‘শুনো রে মানুষভাই/ সবার উপর মানুষ সত্য/ তাহার উপর নাই’, তিনি কি আদৌ কোন রাজনৈতিক ধারণাহীন শুধুই এক প্রেমপূজারী! সে বিচারও যে দরকার! ফলে এখানে শেষ নয়, বরং এক সন্ধানযাত্রার শুরু।