শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০১৩

রাজনীতি ও সাহিত্যে- একটি আলাপ - কিরীটি সেনগুপ্ত

রাজনীতি ও সাহিত্যে - একটি আলাপ
ক্লিশে …
কিরীটি সেনগুপ্ত



(বিশিষ্ট শিক্ষক, কবি, রাজনীতিজ্ঞ রণদেব দাশগুপ্ত’র সাথে একান্ত আলাপচারিতায় কিরীটি সেনগুপ্ত)


কি হে, মোল্লার দৌড় মসজিদ? রোববারের সকালে রণদেবদার মুখে এই মহার্ঘ্য শুনে তেতে উঠলাম। বললাম, হক কথা’ই বলেছেন – সার্থক বলেছেন দাদা, নিরাকার উপাসনা আর করছি কোথায়। ঐ তো সব পুতুল নিয়ে খেলাধুলো। মুখের কথা তখনো পড়েনি পুরোপুরি, রণদেব’দা শাসিয়ে উঠলেন, এত সস্তা নাকি? খেলবে আবার ধুলো’টি মাখবে না? দাদা…দাদা…দোহাই আপনার, আজ ফের পৌত্তলিকতা নিয়ে শুরু করবেন না, আজ একটা অন্য বিষয় নিয়ে আপনার কাছে এলুম…আপনার সাহায্য না পেলে বেটি’কে যে কথা দিয়েছি, আমার মুখ নিচু হয়ে যাবে দাদা। ঝেড়ে কাশো, কিরীটি – আর এই বেটি কে? তবু যেন ভয় কাটছে না, যা হয় হবে … বললাম, দাদা ঊষা’কে বেটি ডাকি। ওর আবদার, আমাকে লিখতে হবে সাহিত্যে রাজনীতির প্রভাব বিষয়ে। বেশ তো, লেখো’না, রণদেব’দা বললেন, কিন্তু আমি কি করব? খেয়াল করিনি, কখন মহুয়া’দি (রণদেব’দার সহধর্মিণী) আমার পাশে এসে বসেছেন। বললাম, আমাকে এখনো ঘন্টাদুয়েক থাকতে হবে দিদি, আজ এখানেই চা-জল খাবো। লুচি আলুরদম হয়ে যাক। কথাটা বলেছি কি বলিনি, দাদা ফোঁস করে উঠলেন, ওয়েল ডান্ ব্রাদার, লুচি মুখে সাহিত্য চর্চা জমবে ভাল। মহুয়া’দি চলে গেলেন আমার উদরপূর্তির আয়োজনে আর আমি বেটি’র আবদার রাখতে ছিনে জোঁকের মতো সেঁটে থাকলাম দাদার গায়ে। কিন্তু আমি কেন, কিরীটি? এই বিষয়ে তুমি সাহিত্যিক’দের শরণাপন্ন হও, গবেষক’দের কাছে যাও – ওনারা পারফেক্টলি বলতে পারবেন। একটু যেন সাহস পেলাম। বললাম, চেনা বামুনের পৈতে লাগে না দাদা। এই প্রথম হেসে উঠলেন রণদেব’দা, বললেন, দ্যাখো সত্যি’ই আমার পৈতে নেই। আমার বাবা এই আচার-অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমরা বৈদিক ব্রাহ্মণ, লোকে ব’লে বদ্যি, আমার গায়ে পৈতে থাক আর না থাক তাতে সমাজের কি? আর সমাজের তথাকথিত ব্রাহ্মণকুল বদ্যিদের উপনয়ন বিষয়ে মাথা ঘামান কি? বললাম, দাদা বদ্যি বামুনের ইতিহাস জেনেই বলছি যে এদেরকে যথোচিত সম্মান সমাজ দেয়না তার পেছনেও উপরমহলের প্রত্যক্ষ রাজনীতি জড়িয়ে আছে। সে যাইহোক, আপনি বিগত ৩০ বছর নিরলস সাহিত্য চর্চা করে চলেছেন, সক্রিয় রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন প্রায় সমান সময় ধরে। পদার্থবিদ্যায় শিক্ষকতা করছেন প্রায় দু’দশক কাল। আপনি যে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা করবেন সেটা অন্য কোথাও পাব বলে মনে হয় না। এবার শুরু করি, দাদা? মুচকি হেসে একটা সম্মতি সূচক আওয়াজ করলেন রণদেব দাশগুপ্ত, হুম।


আমি: দাদা, সাহিত্য আগে নাকি রাজনীতি আগে ?


রণ’দা: বেশ, চাণক্যের সাহিত্য শুনেছো নিশ্চয়। কূটনীতি হোক, শাস্ত্রচর্চা সাহিত্যচর্চার একটা দিক মানবে আশা করি। চর্যাপদের কথা যদি ভাবো, তার পেছনে যে বৌদ্ধ দর্শন সেখানেও প্রচ্ছন্ন রাজনীতির গন্ধ পাবে। এমন একটা বিষয় যার আলোচনা বিশাল ব্যাপ্তিতে চলে যেতে পারে | কারণ, সাহিত্য এবং রাজনীতি এই শব্দদুটির সংজ্ঞা নিয়েই বহু মত এবং বহুতর বিতর্ক আছে | সে তর্কে না ঢুকে বেশির ভাগ মানুষ যে অর্থে এ দুটিকে বোঝেন আলোচনাটি সেই পরিসরে রাখাই ভালো | সাহিত্যের উদ্ভব প্রথাগত রাজনীতির আগে | কিন্তু সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে এক অংশের সাহিত্যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করল |



আমি: দাদা, দুটো বিষয় এলো। সমাজ বিবর্তন এবং একাংশের সাহিত্য|



রণ’দা: ঠিক ধরেছো; সামাজিক রূপান্তরের একটি অনিবার্য চলন ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যায় | কিন্তু এখানে সেই রূপান্তরই বিবেচনা করছি যা নির্দিষ্ট দর্শনে উদ্বুদ্ধ সচেতন মানবগোষ্ঠীর ক্রিয়াশীলতা দ্বারা অর্থাৎ রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত - যা ধনাত্মক বা ঋণাত্মক দুই-ই হতে পারে | আর, সাহিত্যের একাংশ কেন ? না, সামাজিক উপপ্লবের থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে তথাকথিত বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চার উদাহরণও বিস্তর |


আমি: তাহলে আমরা এসে পড়লাম art for arts' sake আর art for peoples' sake-এর বহুচর্চিত বিভাজনে। যে প্রসঙ্গটি এখানে সরিয়ে রেখে আমরা art for peoples' sake নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো, দাদা।


রণ’দা: আরো একটি ভেদরেখা এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার | রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্যও দু-ধরণের | একটিতে ধরা পড়ে সমকালীন রাজনীতির চলনের নৈর্বক্তিক পর্যবেক্ষণ এবং আর একটিতে লেখকের সক্রিয় মনন পেশ করে রাজনৈতিক আলোড়নের আত্তীকরণ আর নিজমতের উত্সারণ | যদিও মূলতঃ বাংলা সাহিত্য নিয়েই আলোচনা হবে তবু পৃথিবীর দুটি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক উত্তরণ - ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবের প্রভাবের কথা একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না কারণ আমাদের দেশীয় সাহিত্য তথা বঙ্গসাহিত্যেও এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল |


আমি: দাদা, রাজনৈতিক আন্দোলন বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?


রণ’দা: রাজনৈতিক আন্দোলন দুই ধরণের হতে পারে | একরকম হ'ল বড় কোনো বিশ্বব্যাপী বা দেশব্যাপী আর্থ-সামাজিক অভিঘাতের উপ-উত্পাদন আর দ্বিতীয় রকমটি হ'ল এমন রাজনৈতিক আন্দোলন যা ধীরে ধীরে ভরবেগ সংগ্রহ করে দেশব্যাপী এক আমূল পরিবর্তন সূচিত করে | সাহিত্যে এই দুধরণের আলোড়নের ছবিই আসতে পারে , আবার সাহিত্য অনেক সময় এই আন্দোলনকে উত্সাহিত বা নিরুত্সাহিতও করতে পারে | মুশকিল হ'ল এই সনাক্তকরণের প্রক্রিয়াটি সর্বসম্মত নয় | তাই আমি দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া কেবলমাত্র লেখকের নাম উল্লেখ করবো | আশা করি, তুমি আবার বেঁকে বসবেনা, কিরীটি।




আমি: না না দাদা, আপনি বলুন, এই বিষয়ে মহাভারত লিখবো বলে আমি আসি নি।



রণ’দা: যেহেতু ভারতে, এমন কি স্বাধীনতা সংগ্রামেও, ফরাসী বা রুশ বিপ্লবের মতো কোনো আমূল রূপান্তরের কাহিনী ছিল না তাই বাংলা সাহিত্যে হুগো,ভলটেয়ার, গোর্কি , অস্ত্রোভস্কিদের খোঁজ করা বৃথা | কিন্তু সামগ্রিক রাজনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রভাবে যে সামাজিক অপশাসন বা নিশ্চলতা তৈরি হয় তাকে ব্যঙ্গ বা সমালোচনা করে একটি সাহিত্যধারা বাংলায় প্রায় দেড়শ বছর আগেই উপস্থিত | "হুতোম প্যাঁচার নক্সা" থেকে যদি শুরু ধরি তবে "বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ " বা " একেই কি বলে সভ্যতা" এই ধারায় পড়বে | তবুও এগুলিকে আমি রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্য বলতে কিছুটা কুণ্ঠিতই থাকব | অবশ্যই এই ধারায় একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে দীনবন্ধু মিত্রের " নীলদর্পণ"। এই একই শিরোপা দাবি করতে পারে মীর মোশাররফ হোসেনের "জমিদার দর্পণ "। কারণ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী একটি গণবিক্ষোভ ও আন্দোলন ভাষা পেয়েছিল এই সাহিত্যকর্মে | ঠিক এভাবেই, বঙ্কিমচন্দ্রের "আনন্দমঠ" | তবুও এগুলিকে আক্ষরিক অর্থে রাজনৈতিক উপন্যাস বা নাটক বলব না | সেই দিক থেকে দেখলে বঙ্গ-সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর "জাগরী"-ই প্রথম রাজনৈতিক উপন্যাস |



আমি: ঠিক বুঝলাম না দাদা, যদি বিস্তারিত বলেন…



“অনেক হয়েছে, এবার গরম-গরম খেয়ে নাওতো”, মহুয়া’দির ডাকে চমকে উঠলাম। চটপট প্রাতরাশ সেরে গরম চা’এ চুমুক দিতে দিতে



রণ’দা: যা বলছিলাম, "জাগরী" -তেই প্রথম রাজনৈতিক দল, তার নেতৃত্বের বাস্তব উল্লেখ, আন্দোলনের পথ নিয়ে তর্ক উঠে এল সাহিত্য-সীমানায় | "জাগরী" একটি অন্যদিক খুলে দিল বাংলা সাহিত্যে | অনেকে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের "গোরা", "ঘরে বাইরে", "চার অধ্যায়" এবং শরত্চন্দ্রের "পথের দাবী" এই চার’টি রচনাকে রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্যে "জাগরী"-র পূর্বসূরি বলে মনে করেন এবং আমিও তাতে আপত্তির কিছু দেখি না | কিন্তু "জাগরী" -তেই বোধহয় প্রথম এদেশে দুটি মূল রাজনৈতিক দর্শনের সংঘাতের ছায়া পড়তে শুরু করল | আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রভাব তখন দেশে দেশে পড়তে শুরু করেছে -ভারতও তার বাইরে নয় | এরই পথ ধরে পরবর্তীতে সহস্রধারায় পল্লবিত হ'ল বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক |


আমি: বেশ কয়েকজনের নাম মনে আসছে দাদা, তারাশংকর, মানিক, দুই সমরেশ, মহাশ্বেতা, তপোবিজয় প্রমুখ |


রণ’দা: তারাশংকরের 'গণদেবতা' ও 'ধাত্রীদেবতা', সমরেশ বসুর 'বি.টি রোডের ধারে' বা ' শিকলছেঁড়া হাতের খোঁজে', সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা' ট্রিলজি, মহাশ্বেতা দেবীর 'অরণ্যের অধিকার' বা 'হাজার চুরাশির মা', তপোবিজয় ঘোষের 'কালচেতনার গল্প' প্রভৃতি বাংলা সাহিত্যের চিরকালের সম্পদ | একথাও ঠিক যে রাজনীতি প্রভাবিত এই সাহিত্যে নাটকের দিক থেকে অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ,মোহিত সেন , উত্পল দত্ত এঁদের নাম উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে | অন্যায় হবে গোলাম কুদ্দুসের উপন্যাস 'লেখা নেই স্বর্ণাক্ষরে'` উল্লেখ না করলে | কবিতার দিকে সুকান্ত, নজরুল থেকে শুরু করে রাম বসু,কৃষ্ণ ধর, দীনেশ দাস,তরুণ সান্যাল , সামশুর রহমান,আবু জাফর বায়দুল্লাহ্,সত্য গুহ, শ্যামসুন্দর মিত্র, সলিল চৌধুরী এদের নাম স্মরণে রাখতে হবেই | এছাড়া আরো কত খ্যাত বা স্বল্পখ্যাত লেখক যে সাহিত্যের এই বিশিষ্ট ধারাটিকে পুষ্ট করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া অসম্ভব | জরুরি অবস্থা, কমিউনিস্ট আন্দোলন, নকশাল পর্ব, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এসবের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত গণনাতীত সাহিত্যকর্মের কথা ভুলে গেলে চলবে না। অনেক কথা বলে ফেললাম, এবার যে উঠতে হবে ব্রাদার।


রণদেব’দার বেশ কিছুটা সময় নষ্ট করে দিলাম আজ। খাতা-কলম গুটিয়ে গুডবাই এবারকার মতো। জানি, এই প্রবন্ধের পরিসর আলোচ্য বিষয়ের বিশালতাকে ধারণে অক্ষম | একটি পরিধি আঁকার চেষ্টা করেছি মাত্র।