সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

বড়গল্প - কৌস্তভ ভট্টাচার্য

ফিসফিসোনি ইন্টারন্যাশানাল
কৌস্তভ ভট্টাচার্য



নয়-ছয়-অ্যানাবেল


নয়-ছয় মিলে যে পনেরো হয়, সেটা আমরা মাঝেসাঝেই ভুলে যাই – আর ভুলে যাওয়াটা অনেকসময় কম পেইনফুল। নইলে গোটা অগাস্ট মাস জুড়ে পনেরোই অগাস্টের দেশজ উৎসবে মাততে মাততে – আমরা বরাবর একটা আন্তর্জাতিক হয়ে যাবার চান্স মিস করে ফেলি – না ফ্রেন্ডশিপ ডের কথা হচ্ছেনা – সেটা তেসরা অগাস্ট, আমরা যথাবিধি – কুছ কুছ হোতা হ্যায়ের রিস্টব্যান্ডে, ফেসবুকে অন্যের ওয়াল থেকে ফোটো শেয়ার করে, আর প্রায় প্রেমিককে ‘উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস – ইউ সি’ বলে নির্বাহ করি।

যেটা ভুলে যাই – শুধু আমরা না, গোটা কয়েক তীব্র পলিটিক্যাল র‍্যালি ছাড়া এদেশের পৃথিবীর প্রায় সবাই আজকাল যেটা ভুলে যায় – ফ্রেন্ডশিপ ডের থেকে তিন তিন দিন দূরত্বে দুটো পাপ, আমাদের ঠাকুর্দারা যখন বাঙলাদেশ ছাড়বেন কি ছাড়বেন না ভাবছেন – তখন টুপটাপ জাপানের বুকে ঝরে পড়েছিল। কর্ণেল পল টিবেটস – যে বি-২৯ টা চালাতেন নিজের মায়ের নামে তার নাম রেখেছিলেন – এনোলা গে। ঠিকই ছিলো – মায়ের গর্ভ সবসময় ধারণ করার বস্তু নয়, মাঝে সাঝে লজ্জা ঢাকতে গর্ভপাতও সভ্যতার রুলবুকের ফুটনোটে আইনসিদ্ধ। এক্ষেত্রে গর্ভপাতটা একটু দেরিতে হওয়াতেই সম্ভবতঃ লজ্জাটা পুরোপুরি ঢাকা যায়নি – তিনের দ্বিতীয় গুণিতকে ‘লিটল বয়’ আর তৃতীয় গুণিতকে ‘ফ্যাট ম্যান’ এর পাপের মেলানকোলি, তাই আমরা তিনের প্রথম গুণিতকে বাৎসরিক বন্ধুত্ব দিবসের তলায় চাপা দিয়ে বেশ কয়েকবার উঁকি মেরে দেখি – পাছে কেউ জেনে ফেলে।

সম্ভবতঃ মিত্রশক্তির হাতে লাগা রক্ত মুছতেই হিউ হাতে ভালোবাসার পোক্ত পালিশ লাগাতে চেয়েছিলো। ভালোবাসা আল্টিমেটলি বেশ আজিব মাল। কেউ তাকে জীবনের সমস্ত কমপ্লিকেশনস ভেবেই মোলো, কেউ আবার সমস্ত কমপ্লিকেশনসের সলিউশন। থ্যাঙ্কফুলি হিউ দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী – অ্যাটলিস্ট এই কেসটায়।

হিউ প্যাক্সটন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ, কেন্টের বাসিন্দা। প্রকৃতি প্রাপ্তি হয়েছিলো সুদূর প্রাচ্যে – টোকিওর রাস্তায়। মিডোরি জাপানকন্যা – ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের হয়ে একটি ভারী শান্তশিষ্ট জানোয়ার সংরক্ষণ করাই ওর পেশা – বাঘ। হিউ, মিডোরির টইটইয়ে সদাসঙ্গী – পেশায় লেখক – আর্টিকেল লেখে বেড়াবার রসদ জোগাড় করতে – গল্পগুলো ইচ্ছের পেট ভরাতে। আফ্রিকায় টাইগার নেই – সেটা যেকোনো ঋজুদা পাঠক থাপ্পড় মেরে পৃথিবীর তাবড় শিকারীকে শিখিয়ে দিতে পারে – তাও ওরা সাউথ আফ্রিকা গেছিলো – কি জানি কি খুঁজতে – বোধহয় সিংহ আর বাঘের হিসুর সিমিলারিটি ও ডিফারেন্স জাতীয় কিছু। গিয়ে কাজের কাজ যেটা হয়েছে – হিউ প্রথম গল্পের বইটা নামিয়ে ফেলেছে।

আপাততঃ ওরা ব্যাঙ্ককেই সেটলড – একটি সাত বছরের ছটফটে হুরীপরী শুদ্ধু – মায়ের রূপ পেয়েছে – আর বাবার দেওয়া নাম – অ্যানাবেল।


হাজার দশেক

কৃষ্ণ আর আমি একবার একসাথে চাঁদের ছবি তুলতে গেছিলাম। ওর নিকন ডি৩২০০ সঙ্গে ১৮-৫৫ লেন্স – আর আমার ক্যানন এস-এক্স ৩০ডি – গাধার পুরুষাঙ্গের মতো বড়ো হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সুপার জুম কেপেবিলিটি সহ।

তো যেটা দাঁড়ালো – ওর চাঁদটাকে বেশ আকাশের গায়ে একটা দইয়ের ফোঁটার মতো দাঁড়ালো। আমারটায় বেশ ক্রেটার ফ্রেটার সহ একটা নাসা মার্কা উচ্চনাসা এফেক্ট এসে গেলো। পৃথিবীর সব ডিএসেলারের মুখে আমার বিজয়লাথ।

নাগারহোল ন্যাশানাল পার্ক এদেশে প্রায় অপরিচিত আর বিদেশে বহুপরিচিত একটি জঙ্গল। কেরালা আর কর্ণাটকের বর্ডারে কাবিনীর কাছে গা ঘাপটি দিয়ে পড়ে থাকা একটাই থাকা খাওয়ার হার্বাল মাসাজ পাবার এলাহি ব্যবস্থা। আর পৃথিবীর বেশিরভাগ ধলা চামড়ার কাছেই যেহেতু ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়াকে দান করার জন্য অঢেল ডলার থাকে তাই প্রতিদিনের খরচ – বেশি না মাথা পিছু হাজার দশেক - থাকা-খাওয়া-জঙ্গলে ঘুরঘুর-এক জানলা হনুমান সাক্ষী রেখে নতুন বউয়ের বুকের তিল আবিষ্কার ইনক্লুসিভ।

তো আম্মো গেসলাম – বাপ মা কে ট্যাঁকে গুঁজে – প্রিয়তমাসু ক্যানন এস-এক্স ৩০ডি গলায়।

সেখানে জঙ্গলে বেশ একটা হুডখোলা জিপে ঘোরায়। বালাই ষাট বাঙালি পাঠক মেলোড্রামাটিক হবার আগে পুরোটা শুনুন – জঙ্গলে গাউর, বাঘ সব থাকলেও – জিপে দু’দুটো বন্দুকবাজও থাকে।

তো হিউ, মিডোরি আর অ্যানাবেল জায়গা পেয়েছিলো আমার জিপের পেছনের সিটে। আমি সপরিবার ও সক্যামেরা সামনে। হিউদের ছিলো টেন্ট নাম্বার ৫, কিন্তু জিপে অ্যালোকেশান ছিলো রুম নাম্বার ৫ এর। কোথা থেকে কি হইলো বোঝা গেলনা – দেখা গেলো টেন্ট নাম্বার ৫ আর রুম নাম্বার ৬ কে ‘হাত ধর প্রতিজ্ঞা কর’ গাইয়ে বিদেয় দিলো ট্যুরিস্ট লজ।


পেয়েছি পেয়েছি, থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু

টাইগার কল বস্তুটি যারা শোনেননি তাদের কি করে বোঝাই জিনিসটা কিরকম। দাঁড়কাকের গলাটা ছ’মাসের বাচ্চার মতো হয়ে গেলে ব্যাপারটা যে’রম দাঁড়াবে অনেকটা সেরকম।

বুদ্ধদের গুহ হবার কোনো ইচ্ছে বা সক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই – তবু এটুকু পাব্লিকের জ্ঞাতার্থে – আমরা আসার রাস্তায় একটা বাঘের তাড়া খাওয়া গাউর দেখেছি (যাকে বাইসন লিখলে আমার জঙ্গুলে দাদা বিক্রমাদিত্য গুহ রায় আমাকে দুই কুমীরে পা দিয়ে দাঁড়াতে বলতে পারেন) যে গায়ের রঙটা বাদে টোটালি সলমন খান – কিন্তু সম্ভবতঃ ভয়ে, অথবা পরাজয়ের গ্লানিতে একটা বেচারা গাছে শিঙ ঘষে ঘষে গাছটার ছালবাকলের সাড়ে দেড়টা বাজাচ্ছিলো। ভিডিও তোলা আছে – দেখতে চাইলে বলবেন।

তো মূল জঙ্গলে ঢুকলাম – জঙ্গলটার ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে – জঙ্গলটা পর্ণমোচী গাছের জঙ্গল – আর সময়টা শেষ ডিসেম্বর – তো প্রায় একটা শান্তিনিকেতনের ঝোপঝাড়ের মতো চেহারায় জঙ্গলটা মান রক্ষার হতাশ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ট্যুরিস্টের পৌষমাস – কারণ পাইকারি রেটে অ্যানিমাল ওয়াচ হচ্ছে, হাতি ময়ূর, হাজার খানেক পাখি, শূয়োর, ওয়াইল্ড ডগ বা ঢোল কি নেই তাতে।

প্রত্যেকটা জঙ্গলেই একটা জায়গা থাকে যেখানে সব জন্তু জানোয়ার – দিনে একবার করে মাটি থেকে চেটে চেটে নুন খেতে আসে। সেই জায়গাটায় গেলে ওয়াইল্ড লাইফ দর্শনের সম্ভাবনা বেশি হয়। তো আমাদের জিপটা ঘুরতে ঘুরতে সেই পার্টিকুলার জায়গাটায় আসার পর – আমাদের পাকা চুল গাইড হঠাৎ করে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দিলো। সেই আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিলো – হরিণের, বাঁদরদের – যেটার কথা বিক্রমদার মুখে, ঋজুদার বইয়ে, ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকে শুনেইছি শুধু – এক্সপিরিয়েন্স করা হয়নি – ততপূর্বে।

গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিলো – সেই জায়গাটায় রাস্তাটা একটা এল শেপের টার্ণ নিয়েছে। গাইড ড্রাইভারকে বললো গাড়িটা চালাতে, টার্নটা নিয়ে গাড়িটা দু-তিনহাত এগিয়েছে কি এগোয়নি – ভদ্রলোক রাস্তা পেরোলেন – আমার বাবা আর মা একে অন্যের হাত চেপে লাফালাফি করতে লাগলো সাউন্ড না করে – হিউ আর মিডোরি খালি গাইডকে থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু করে গেলো।

আমি কি করলাম? আমি ঘটনাটা ঘটার পর রিয়ালাইজ করলাম যে আমি ভিডিও তুলতে এতো ব্যাস্ত ছিলাম যে একটা খাঁটি বেঙ্গল টাইগার সচক্ষে দেখা মিস করেছি। শুধু ভিডিওটা ঠিকঠাক আসার জন্য পেয়েছি পেয়েছি করে গেছি।

আর মিডোরি – নিজের ক্যানন ৬০ডি – তার সাথে একটা টেলি লেন্স এটসেট্রা হাতে নিয়ে বসে খালি বাঘটা দেখেই গেছে – ছবি আর তোলেনি।


পে প্যাল


তখন আমি হায়দ্রাবাদে। নাগারহোল থেকে ফেরৎ এসে গেছি প্রায় মাস দুয়েক। কোলকাতার জন্য মনটায় একটা টানটান না পাওয়া জমে থাকে হরবখৎ।

মিডোরি, হিউ আর অ্যানাবেলের সাথে আলাপটা সেই বাঘ দিবসের রাত্তিরেই হয়েছিলো। মিডোরি আমার কাছ থেকে বাঘের ভিডিওটা নিয়েছিলো। সেখানেই জানলাম ওর ইউনাইটেড নেশনসের সাথে কাজকম্মের কথা। হিউ টিপিক্যাল ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে বললো – ‘ইউ মাইট এন্ড আপ গেটিং সাম মানি ফর দিস’।

তো ভালো – বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলে – মেয়ে আর পয়সা চিনতে ভুল করেনা। মাঝের দু’মাস যে ছবিগুলো মেইল করিনি ওদের – সেটা নেহাৎ ল্যাদ।

প্রসেসিং ট্রসেসিং করে মিডোরির মেইল আইডিতে পাঠালাম ওগুলোকে।

কিছুদিন পর রিপ্লাই এলো – মিডোরির নয়, হিউয়ের কাছ থেকে – ওরা এখন বাঘ ছেড়ে শাশুড়ি সামলাচ্ছে। ছবিগুলো ভালো লেগেছে। ডিটেলে কথা আছে। পরে বলবে।

বললো – কিছুদিন পরেই।

হিউয়ের একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে সেই গাউরকূলের সলমন খানকে নিয়ে – আমি হিউকে বলেছিলাম – ওটা লিখলে যেন আমায় পাঠায় – আমি বাঙলা করে ছাপাবার ব্যাবস্থা করবো – সে আর হোলোনি। কারণ আমাদের ম্যাগাজিনটা তখনো নেহাত ওয়েবম্যাগ – সাহেবসুবোকে ডলার দিতে গেলে – হেঁ হেঁ ওই আর কি।

যাই হোক – বেশ কিছু পাখির ছবি তুলেছিলাম নাগারহোলে – হিউয়ের একটা বড়ো আর্টিকেল যাচ্ছে, নাগারহোলকে নিয়ে। নিপ্পন এয়ারওয়েজ নামের জাপানী এয়ারলাইন্সের ইনহাউস ম্যাগাজিন উইংস্প্যানে। সেটার জন্য আমার কিছু ছবি চেয়েছে । ছবি পিছু ৫০ ইউ-এস-ডি দেবে, চারটে ছবি অর্থাৎ ২০০ ইউ-এস-ডি।

ইউ-এস-ডি শব্দটা নেশা ধরাবার পক্ষে চুল্লু-চরসের থেকে কম যায়না – তবে কিনা সাহেব মানুষ। আর আমার থেকে আমার বাবা-মার সাহেবে বেশি ভয় – যদি ছবিগুলো নিয়ে পয়সা না দেয়। বিক্রমদাকে জিজ্ঞেস করলাম একবার। বিক্রমদা ছবিগুলো দেখে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে দিলো হিউ এন্ড কোং ছবির কিস্যু বোঝেনা – নইলে এইসব ছবি চাইতো না।

যাই হোক – আমিও বামুনের ছেলে – ঠাকুর্দা বর্ডার পেরিয়েছেন – অল্পতে নাহি দমে এই শর্মা। দিলাম পাঠিয়ে – হিউ বললো আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেবে। তার জন্য একটা পে-প্যালে অ্যাকাউন্টও খুলে ফেললাম।

সেখান থেকে আমার কাছে টাকা এলো বটে – প্রথম দু’মাসে ১.৩২ টাকা – অ্যাকাউন্ট ভেরিফিকেশানের জন্য পে-প্যাল থেকে বিনামূল্যে ইলেট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারায়িত।


ভেসে আসে কোলকাতা


হিন্দি ছবির নাচা-গানা-ঢাক-ঢোল আমার বরাবরের প্রিয় জিনিস। মানে ইয়ে রুচি নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলেন তবে স্বীকার করতে হয় আমার করণ জোহরের বোলে চুড়িয়া বোলে কঙ্গণা গানটার পিকচারাইজেশান বড়ো ভাল্লাগে।

সুরের জন্য নয়, কথার জন্য নয়, উৎসবের জন্য।

হিন্দি সিনেমায় ওই যে একটা প্রচন্ড রঙচঙে সেটে – ততোধিক রংবেরঙের কস্টিউম পড়ে প্রায় শ’খানেক লোক একসাথে তাথৈ করে ওটা আমার বড়ো ভাল্লাগে।

আমার – রঙ ভাল্লাগে।

রঙ – যেটা আমার শহর কোলকাতাকে ভারতবর্ষের আর পাঁচটা শহরের তুলনায় আলাদা করে দেয়। সেই রং - যেটা কখনো রাজনৈতিক লাল-সবুজ, কখনো একাকিনী হলদেটে, কখনো ঋতুপর্ণ ঘোষকে অকালে হারিয়ে বিষণ্ণ সাদা-কালো।

এই রঙগুলো নিয়েই কোলকাতা ঘুম থেকে ওঠে, কলোনী এরিয়াগুলোতে এখনো কলের লাইনে দাঁড়ায়, চলন্ত পাব্লিক বাসের পিছনে ছোটে, ২টাকা খুচরোর জন্য অটোওয়ালার বাবা-মা এক করে দেয়, ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট পরে ঝুপসে খেতে যায়, দাম্পত্য কলহে মুখ গোমড়া করতে করতে ‘মধ্যরাত্রের আচমকা মিলন’ আবিষ্কার করে।

মুম্বই ছাড়া আর বাকি সমস্ত ভারতবর্ষীয় শহরের কাছে কোলকাতা ঠিক এখানেই জিতে যায়। বাকি শহরগুলোর মোনোক্রোমকে হারিয়ে দিয়ে একটা ইজেল হয়ে দাঁড়ায় – যেখানে ইচ্ছে মতো রং মেলানো যায়। আর মুম্বইয়ের বর্ষাকাল দেখে কালিদাসের কথা মনে পড়েনা। তাই – কথা হবেনা।

কোলকাতা ফিরে এলাম তাই – গত জুনে। সবাই বললো ভুল ডিসিশান – সবাই বললো ব্যাঙ্গালোর জাতীয় কোথাও যেতে – সবাই বললো এ শহরে সব জান্তব, সব মৃত, সব ভুল।

মন বললো – ঠিক, ঠিক, ঠিক।

এর মাঝে আর হিউদের সাথে কথা হয়নি।


অক্টোবর


কোলকাতায় আসার থেকে বিশেষ ছবি তোলা হয়নি। আসলে এইসব আঁতলামি করতে একটু একাকীত্ব লাগে। মনটা যদি বেজায় ভালোবাসা সম্পৃক্ত থাকে – মানুষে, বাবা-মায়, বন্ধুবান্ধবে – তখন আর ক্যামেরার কথা মনে থাকেনা।

কিন্তু অক্টোবর এসে গেলো কত্তা – ওয়ান মোর নাচনকোঁদন মাস – দুগগাপুজো অন দ্য কার্ড। এইসময় ক্যামেরা হাতে না বেরোনো মানে ক্যামেরাকে ব-কার শ-কার তুলে খিস্তি দেবার সমতুল্য।

আমার বাড়ির কাছে একটা ঠাকুর বানাবার জায়গা আছে – সাইজ করে তুলতে পারলে সেটা যে কুমোরটুলি নয় বোঝে কার বাপের সাধ্যি।

তাই গেনু – সেই পুওর ম্যানস কুমোরটুলিতেই – খচখচাৎ করলুম বেশ কিছু ছবি। দু’টো ফোটোগ্রাফার বন্ধুকে দেখালাম – একজন বললো বড্ডো কমন অ্যাঙ্গলস, আরেকজন বললো থট প্রসেসটা স্টিলের নয়, ভিডিওর।

তো যাই হোক,শ্রদ্ধেয় তপন রায়চৌধুরী বলেছেন - সাহেবদের মাথায় অতো বুদ্ধি হয়না – নইলে কেউ সোনামুখ করে ওরিয়েন্টাল কুইজিনের স্বাদ পেতে কাঁচা লঙ্কা চিবোয়না।

তাই হিউকেও ছবিগুলো পাঠিয়ে দিলাম। সাথে একটা মেইলও জুড়ে দিলাম। মনটা যে একটু ইউ-এস-ডি ইউ-এস-ডি করছিলোনা তা বললে পরমপিতা আমাকে পাপ দেবেন।

হিউ,

এখন আমি প্র্যাকটিকালি ঘরের ছেলে ঘরে ফেরৎ এসে গেছি। কোলকাতা থেকে লিখছি, দূর্গাপুজো সম্বন্ধে শুনেছো বোধহয় – আমাদের এদিকে সবচেয়ে বড়ো উৎসব। বড়োই আনন্দে আছি।

আমার সেই বাঘবন্দীর ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে পাঠালাম। গুগল ড্রাইভ একটা বেশ নতুন ও ভালো ফিচার। ওটাতেই তুললাম। দেখে জানিও কেমন।

~কৌস্তভ


আনন্দ এবং

কৌস্তভ,

প্রথমে কয়েকটা কম আনন্দের খবর বলি। আমার নিজেকে বেশ গিলটি লাগছে তোমার নাগারহোলের ছবিগুলোর ভবিতব্য জানাতে। আসলে কোনো ভবিতব্য নেই – যেটা রয়েছে সেটাকে ফুলস্টপ বলাই ভালো।

আমি এডিটরকে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলাম (যে আবার কিনা বিদেশে ছুটি কাটায় বেশিরভাগ সময়), কোনো এক সাব-এডিটর ছবিগুলো হারিয়ে ফেলেছে। হপ্তা-মাস-বছর কাটতে চললো। এবার নিজেরই লজ্জা লজ্জা লাগছে।

আমার প্রত্যেক দিন মনে হয় আগামীকাল তোমাকে একটা মেইল করে খোলাখুলি জানিয়ে দিই, কিন্তু আগামীকালটা এখনো এসে পৌঁছয়নি।

এক্সিকিউটিভ সামারি – তোমার পে-প্যালের অ্যাকাউন্টে আর কেউ নিশ্চয় কিছু জমা করেছে। কিন্তু আমি কিম্বা উইংস্প্যান কিছু করিনি।

এবারের ছবিগুলো দেখতে পারলাম না। দুর্গাপুজোর সম্বন্ধে শুনেছি তো বটেই – বেশ ড্রামাটিক লেগেছিলো। আমার কম্পিউটারের টেম্পারমেন্ট ইদানীং ভালো যাচ্ছেনা। তাই গুগল ড্রাইভের লিঙ্কটা খুললো না। দেখবো নিশ্চয়। এবার ডিরেক্ট মেইল করে দিও – এই সোশাল মিডিয়াগুলো আজকাল আর ইউজ করিনা।

অন্য কথা বলি?

তুমি আনন্দে আছো জেনে ভাল্লাগছে।

আনন্দ এমন একটা জিনিস যেটার গুরুত্ব আমরা প্রায়শই বুঝিনা – আন্ডারএস্টিমেট করে ফেলি।

কোলকাতায় ফিরেছো জেনে ভালো লাগছে। আশা করি কোলকাতায় বিল্ডিংগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থা ভালোই।

বন্ধুদের বিবিসি ওয়ার্ল্ডে ধ্বংসস্তূপ থেকে রেসকিউ হতে দেখেছো কখনো? নাইরোবিতে ওয়েস্টগেটের খবর দেখছিলাম ব্যাঙ্ককে বসে বসে – চা খেতে খেতে।

অ্যানাবেল হঠাৎ করে বলে উঠলো – ‘বাবা দেখো দেখো, লুসি আর ফ্লোরা’।

নাইরোবিতে দু’মাস হলো গেছে ওরা। এর আগে একবারই মাত্র একটা প্রায় জীবনসঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলো ওরা দু’জন – একটা বাইসাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে।

আসলে আমরা স্বাভাবিক ভাবে এতো ভরে থাকি, যে টুকরো আনন্দগুলো প্রায়শই ওভারলুক হয়ে যায়। রাস্তায় চলার মধ্যে, একটা খাজা বই পড়ার মধ্যে, নিজের পরিবার গড়ে তোলার মধ্যে যে একটা তীব্র আনন্দ আছে – সেটা ভুলতে বসি।

কিন্তু জীবনটা তো আসলে সন্ধানের গল্প – মানুষ খুঁজে বেড়াবার, ইমোশন খুঁজে বেড়াবার, আশা খুঁজে বেড়াবার, বন্ধুত্ব খুঁজে বেড়াবার।

আনন্দ খুঁজে বেড়াবার।

তাই তোমার আনন্দের জন্য শুভেচ্ছা রইলো। আনন্দেই থেকো।

~ ব্যাঙ্কক থেকে হিউ, মিডোরি আর অ্যানাবেল

3 comments:

Ranjon Ghoshal বলেছেন...

চমৎকার লেখার হাত। বাংলা গদ্যসম্ভারকে সমৃদ্ধ করছ। শব্দ-সংযম দেখতে পাচ্ছি, আগের লেখগুলোর তুলনায়। ওটা বেশ জরুরী। চাপল্য আর একটু কমাতে পারলেই লেখার প্রসাদগুণ বাড়বে। তাই বলে লেখনীর তারুণ্যকে ছেঁটে ফেলো না।

Rajarshi Majumdar বলেছেন...

Tomar lekhar sathe amar prothom porichoy hoy Adorer Noukar bishesh golposonkhyay. Sekhane tomar ekta osadharon golpo porechilam Prantik ar Biyas name 2ti choritro chilo sekhane. Tomar golpo vishon sukhopathyo.... Ei lekhatao vishon valo hoyeche...vobbisshote tomar kolom (keyboard??) aro erokom golpo likhuk etai chaibo.

Koustav Bhattacharya বলেছেন...

thanx re. Pprantik ar Boyas er second part lilhechi amar blog e. ichhe hole poris :-)