বাংলা কবিতায় আপন মাহমুদ এক স্বতন্ত্র স্বর। বাংলা কবিতা যতদিন পড়া হবে আপন মাহমুদের লেখাও ততদিন নিশ্চিত বেঁচে থাকবে। ক্ষেপচুরিয়াসের অন্যতম মুখ, অসময়ে চলে যাওয়া আপন আমাদের বুকের মাঝে থেকে যাবেন আপনজন হয়েই। ক্ষেপচুরিয়াসের আর্কাইভ থেকে এবারে রইল অকালপ্রয়াত কবি আপন মাহমুদের আটটি কবিতা।
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া
মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুঁড়ে
দিয়েছিলেন বাতাসে, শুনেছি,
সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিল
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি
মা, পৃথিবীর যেকোনো
নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা যায় না।
তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার
ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রঙের আকুতি রঙের
সেই অপচয় ঘোচাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর
আর সব প্রজাপতির
মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে! অথচ তার মুখের দিকে
তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি: জীবনে একটাও প্রজাপতি তার
খোঁপায় বসেছে!
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া- দুই
মায়ের মুখ মনে এলে নিজেকে রক্ষকশূন্য
গোলবার মনে
হয়--মনে হয় সব কটি গোলই
হয়ে যাচ্ছে—কিছুতেই
ঠেকাতে পারছি না--অথচ,
রেফারির বাঁশি যে পক্ষেই
বাজুক তারই জেতার কথা
হার-জিত প্রসঙ্গে ইদানীং মা খুব একটা কথা বলেন না,
মাঝেমাঝে দূর দীর্ঘশ্বাসের পালক ঝরাতে ঝরাতে
বলেন, ‘যারা জিততে জিততে
জিততে ভুলে গেছে—যারা
হারতে হারতে হারতে ভুলে গেছে--তাদের সবার উচ্চতাই
সমান’
মানুষের উচ্চতা সমান ভেবেই আমাদের
গান শুরু করার
কথা--অথচ রেফারির বাঁশি
কেবল জেতাবার জন্যই
বাজে--হারাবার জন্যই বাজে!
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া-তিন
আমার জন্মের রাতে একটাও নক্ষত্র খসে
পড়েনি মাটিতে—যদিও
আপন-আকাশ ভুলে মা
আমাকেই তুলে ধরেছিলেন তার প্রার্থনার
করতলে--প্রার্থনা শেষে মা
আজো চোখ মোছেন--যে চোখে খুব
কাছের নক্ষত্রটাকেও ঝাপসা দেখায়!
বাবা রাজমিস্ত্রি, দাদি আত্মহত্যা করেছেন পেটের পীড়ায়--তবু
আমার কখনো সাব-কন্ট্রাক্টর
কিংবা এলএমএফ ডাক্তার হতে ইচ্ছে
করেনি--বরং নক্ষত্র হতে না-পারার অহেতুক বেদনা নিয়ে আমি
আজো বেজে চলেছি সেই বেহালাবাদকের আঙুলে--ঘনকুয়াশার
দিকে নিরন্তর হেঁটে যাওয়া যার অমোঘ নিয়তি
আমার জন্মধ্বনিতে কাঁপেনি আকাশ--উৎসবের একটাও বাতি
যায়নি নিভে--কেবল কোকিল, কোকিল উড়ে গেছে দূরে...
বেহালাবাদক
আমি আছি অজস্র পাতাঝরার শব্দ নিয়ে--এই শীতে যার
কিছুটা বিক্রি হবার কথা একজন বৃদ্ধ বেহালাবাদকের অবশিষ্ট
হাসিটির বিনিময়ে--শুনেছি, যেকোনো আত্মহননকারী
মানুষের কপালের ভাঁজেই এরকম একটি হাসি লুকিয়ে থাকে--
যা কিনা সুর ও শিল্পপ্রিয় মানুষের প্রতি ঈশ্বরের শেষ উপহার
ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাশের বাড়ির অহংকারী ভালো
ছাত্রীটির মতো--যে আমাকে সঙ্গে নেয়নি, আবার ফেলেও যায়নি
শীত থেকে বসন্ত এতো দূরে যে, সেই বৃদ্ধ বেহালাবাদকের সঙ্গে
আমার আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কথা, পাহাড়ের সঙ্গে
পাহাড়, তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে--বিশেষত মনমরা
বিকেলে
কী করো তুমি--কার কথা ভাবো--কে তোমার কান্নাকে
প্রথম ঝরনা
বলেছিলো? আমি? আমি দু-চারটা সিগারেট বেশি
খাই,
চুপচাপ
ঘুরি-ফিরি--দাড়ি কেন কাটতে হবে, ভাবি...
মাঝেমাঝে নিজেকে শৈশবের হাতে তুলে দিয়ে ঘড়ি দেখি—ঘড়িতে
৩৪টা বাজে! ফুল পাখি নদী ওরা
কেমন আছে?
পাহাড় তুমি কি জানো, রজনীগন্ধা সবজি নয় কেন!
ভাঙা শ্লেট
কতগুলো মৃত পাহাড় কচ্ছপের মতো বসে
আছে বুকে
মালগাড়ি মনে করে যাদের পিঠে তুলে দিই আজো
সিগারেটের বাক্স, দেশলাই। তুলে দিই ডাক্তারের
নিষেধাজ্ঞা, মায়ের অনুরোধ...
আঁটালির মতো গোঁ-ধরে বসে থাকা অদ্ভুত মালগাড়িটা
পুরোনো স্টেশনের কোনো এক পরিত্যক্ত দুপুরের মতো
আমাকে নিঃসঙ্গতার গান গেয়ে শোনায়!
মনে পড়ে, কচ্ছপ মারতে গিয়ে একদিন ভেঙে ফেলেছি
প্রিয় শ্লেট, খড়িমাটি...
কে জানে, সেই ভাঙা শ্লেটেই তোমার নাম লেখা ছিল কি-না!
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ; আমাকে প্রেমিকার
মতো ভেজাও--দ্যাখো, চিন্তার সোনালি আঁশ শুকিয়ে
যাচ্ছে। আমি তেমন প্রার্থনা জানি না-- বড়জোর
ছেলেব্যাঙ-মেয়েব্যাঙয়ে বিয়ে
দিতে পারি--থু লেপে
ভিজিয়ে দিতে পারি নিজের শুকনো ঠোঁট
মেঘ, তুমিও কি অপচয়ের
ভয়ে আর আগের মতো
ঝরো না--জলখরচের ভয়ে আমি
যেমন কান্নাকে
দূরে রাখি--থাক অতো হিসাব-নিকাশ--দ্যাখো,
চালতাফুল তাকিয়ে আছে অবিবাহিত খালাতো
বোনের মতো! যদি ভেজাও তুমি--হবো শাপলায়
ভরে যাওয়া মাঠ
শুনো; গল্পের উঠান কি
একাই ভিজবে আমাদের
সর্দি-কাশির অজুহাতে! এসো, ছাতাহীন হাঁটুরের
মতো
ভিজি--আরো কাছে গিয়ে দেখি
আষাঢ়ের ভেজা বউদি
ও মেঘ, বউয়ের মতো মেঘ; আমাকে সাহারার হাত
থেকে বাঁচাও।
শিরোনামহীন
কোনো কোনো গান অংক পরীক্ষার চেয়েও ছোট ছিলো—কোনো
গান ছিলো কচুপাতার পানি--কান্নাও একটা গানেরই নাম, যা ছিলো
তোমার আবেগ সমান--তুমি এখন মিসকল’র মতো বড়—হাঁটুতে
থুতনি কিছুটা জড়োসড়ো!
কোনো কোনো গান সুদীর্ঘ আপেল বাগান-- কোনো গান পুঁজি
তাড়িত বিলবোর্ড-বৃষ্টি--কোনোটা বা সাম্যের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
আজ কুয়াশা দৃষ্টি...
কোনো কোনো গান কাস্তের মতো বাঁকা--ক্ষুধার তীব্রতা
নিয়ে ফসলের মাঠ দেখা!
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনআপন মাহমুদ বড় অল্প বয়সেই চলে গেলেন। কী চমৎকার সব লেখা!
উত্তরমুছুনমনে পড়ে। অনবদ্য সেই, কবি ও ঈশ্বর, আপনজন, আপন!
উত্তরমুছুন