আমাদের শিল্পকলা বিভাগটি বরাবর চিত্র তথা গদ্যশিল্পী, ঝানু ক্ষেপু অমিত বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে। এবারে, যেহেতু শেষমূহুর্ত পর্যন্ত টানাপোড়েন চলেছে মূলতঃ সময়ের অভাব নিয়ে, অমিতদাকে প্রতিবারের মত একটি সুচারু, শিল্পকেন্দ্রিক ও অজস্র চিত্রসম্বলিত বাগিচা সাজানোর জন্য কাঙ্খিত অবকাশ দেওয়া যায়নি। কিন্তু অথচ শিল্পকলা বিভাগটি ক্ষেপুর অন্যতমা, তাকে ছাড়া শারদ সংখ্যা ভাবা অন্যায় ! অতএব এবারে আমরাই কয়েকজন মিলে মুখবই-এর মেঝেতে ছক কেটে এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে বেছে নিয়েছি একজন শিল্পীকে। অর্ক কর।
অর্ক বিমূর্তে বিশ্বাসী। ওর পাতা জুড়ে রঙের খেলা, গাঢ় অ্যাক্রিলিকের স্লথ ঘোরাফেরা, কিন্তু বিভিন্ন রঙের সীমা স্পষ্ট করায় বিশ্বাসী নয় সে। এছাড়াও, ওর যাবতীয় ছবির উপরে একটি হালকা পেলব মনোভঙ্গী আলস্যে শুয়ে থাকে। এই দুই-এর প্রভাবে অর্ক-র ছবি আকর্ষণীয়, উপরন্তু ম্যাচুওর। কিন্তু তারও উপরে একটি গভীর ক্লান্তি তথা হতাশার আভ্যন্তরীন কিন্তু চরম সুপারফিশিয়াল হাতছানি ছবিকে দূর থেকে ভারী করে রাখে। এ সমস্ত-র অনুধ্যানে অর্ক-র ছবিকে সাধারণের থেকে আলাদা করা যায়। কর্কশ, মনোক্রোম ব্রাশ স্ট্রোকের তরুণ প্রগল্ভতায় কিছুটা সে অনুপস্থিত। আরোও একটি বৈশিষ্ট্য অর্কের ছবিকে আমাদের কাছে এনেছে। ওর ছবিতে একবিংশ শতকের ডার্ক, শব্দপ্রধান, ইঙ্গিতময় কবিতা প্রবলভাবে পিছু ডাকে।
কবিতা ও ক্ষেপু যেহেতু অঙ্গাঙ্গী, অর্ক-র আঁকায় ছন্দ বা অন্ত্যমিল না খুঁজে শূন্যস্থানের অব্যক্ত ও মনভাঙানিয়াকে একপ্রকার না-পাওয়ার সন্ধান করা বোধকরি বাঞ্ছনীয়। ওর একটি ছবি দেখিঃ-
ছবি – ১
উপরের ছবিটিতে কেন্দ্রের অন্ধকার পরিধি বরাবর ফিকে হয়ে যাওয়ার গতিতে অভ্যস্ত হবার আগে দেখতে পাই, একাধিক হলুদের পোঁচ ও পরস্পর সমকৌণিক রেখা ছড়িয়ে রয়েছে। ক্যানভাসজোড়া বিন্যস্ত (নাকি অবিন্যস্ত) শোকের বুকে এই দুই-একটি উজ্জ্বল অ্যাপ্রোচ-ই ছবির চাবিভূমি কি? শোকের অব্যবহৃত আশেপাশে উদ্যত কালো ঘোড়া বা রক্তাক্ত ধারালো দাঁতওলা মাছের আদল-ও লক্ষ্য করা যায়, যা প্রায় চিহ্নস্বরূপ, কিন্তু ঐ আলোর মোটা বা তীক্ষ্ণ রেখারা যে কনট্রাস্ট তৈরী করছে তা এই জ্যান্ত একখন্ড অন্ধকারের কেন্দ্রে একটা ব্লান্ট মরাল হিসেবে দেগে দেওয়া সম্ভব; যদিও, বলাবাহুল্য, কবিতা এত একরৈখিক ছিল না কোনদিন।
দ্বিতীয় ছবিতে দেখি, অনুভূমিক নয়, উল্লম্ব ক্যানভাস। তেলরঙের সুচারু বিন্যাসের গতি আগেরটির বিপ্রতীপমুখী, অর্থাৎ অন্ধকার ক্রমশঃ ছড়িয়ে গিয়েছে পরিধির দিকে; কেন্দ্রটি অবশ্য এখানে আগের ছবির থেকে প্রকট, তুলনামূলকভাবে কম vague. একাধিক আকাশী রঙের মানুষের অবয়ব লক্ষ্য করা যায়, টুকরো আকাশের আভাসসহ; যদিও, গাঢ় কালোর নেপথ্যে এই আকাশী প্রায় সাদায় পর্যবসিত।
ছবি – ২
এক্ষেত্রে, ছবিকে প্রায় স্পষ্ট ভাগ করা যাচ্ছে অন্ধকার আকাশ ও জলের বুকে তার প্রতিফলন দিয়ে। ছবির ইউজুয়াল বিষাদের ভাব অতিক্রম করে নজর কাড়ছে অন্তত দুটি বিশেষত্ব। এক, আলোচ্য অস্পষ্ট অবয়বগুলির আধার কোনও নৌকো নয়, বরং একখন্ড মেটেধূসর চরসদৃশ, যদিও একজনের হাতে প্রায় একটি দাঁড় বা লগি প্রতীয়মান। শরীরের অংশ হিসেবে সেও আকাশী রঙে রাঙা। দ্বিতীয়তঃ, এ ছবিতে ঋজু কোনও লাইন বা রঙের স্ট্রোকের বদলে একটি টকটকে লাল অনিয়ত দাগ ছবির মাঝামাঝি উপর থেকে নীচে বিছিয়ে। এ লাল ছবির সবচেয়ে উপরের লাল জমির বিচ্ছিন্ন বিস্তার হতে পারে, বা কেবলই বিদ্যুত-এর দাগ যা উপরের লালকে সূর্যাস্ত বা ঝড়ের পূর্বাভাসগামী সঙ্কেত হিসেবে দীর্ঘায়িত করছে।
বিমূর্ত ছবিকে অবয়ব বা রঙে ভেঙে ভেঙে ব্যাখার চেষ্টা যেমন অকিঞ্চিৎকর তেমন অবিমৃশ্যকারীতার নামান্তর। তবু, কবিতা মূলতঃ ব্যক্ত ও অব্যক্তের সীমারেখাকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় থাকে। যেমন তৃতীয় ছবিটি-
ছবি – ৩
এ ছবি দেখবার পরে আর কোথাও যাবার ইচ্ছা হল না। সরাসরি সম্পর্ক পেলাম একটি রক্তাক্ত রেল দুর্ঘটনার, যাবতীয় মানুষ যে ট্রেন ছেড়ে চলে গিয়েছে। যেটুকু রক্ত ও মাংস অবশিষ্ট তা শুধুই ট্রেনটির নিজের, খোলা আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে নিজেকে দেখছে। ধাতুর গাঢ় গভীর রঙে অভ্যস্ত অর্ক কেমন এখানে আয়রনিকালি ধাতুকে বদলে দিয়েছে জীবনব্যঞ্জনায়। সবুজ মাঠ, নীল আকাশ – সবকিছুর আদল থাকা সত্ত্বেও এ ছবির কেন্দ্রে ওই কুঁকড়ে পড়ে থাকা রক্তমাংসের যন্ত্রদানব, যাকে স্বচ্ছন্দে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নাম দেওয়া যায়; যন্ত্রের মাধ্যমে জন্মেও যে মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছে কালে কালে।
অর্ক-র ছবি ইচ্ছে করলেই পাঠক পেতে পারেন ওর ওয়ালে। সরাসরি যোগাযোগ-ও করতে পারেন সেভাবেই। অর্ক-র ছবি নিয়ে আমরা আবার কখনো না কখনো বসব, বায়বীয় গেলাস হাতে, আত্মগতের সরু ও নিখুঁৎ কার্নিশের নিচে গলা পেতে দিয়ে। তার আগে আপাতত এই ছবিগুলি উপভোগ করি।
ক্ষেপুর বর্তমান সংখ্যায় যারা অমিতদাকে খুঁজবেন তাদের কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নেওয়া গেল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন