শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইতি হৃদয়পুর - ইন্দ্রনীল তেওয়ারি

 


নতুন এই বিভাগটিতে ক্ষেপুদের চিঠি লিখবেন ক্ষেপুরা। লিখতে পারেন পাঠক, বন্ধুরাও। এবারে ক্ষেপচুরিয়াসের অন্যতম মুখ ইন্দ্রনীল তেওয়ারি খোলা চিঠি দিলেন আরেক ক্ষেপু মিলন চট্টোপাধ্যায়কে। 

 

মিলন,                                                                                                     

১৬/০৮/২০২৫

কেমন আছিস রে? কতদিন তোর সাথে আড্ডা মারিনি। আজ এখন এই দুপুর .৪৫-এ তুই কী করছিস? হয়ত ভাত খেয়ে কবিতার বই বন্ধ করে বাগানে এসে বসেছিস। হাতের মুঠোতে ধরা বিড়ির বান্ডিল আর গোল লাইটার। চুপচাপ বিড়ি জ্বালিয়ে দেখছিস কিভাবে হাওয়ারা কাঁদে। আচ্ছা, তোর কী মনে হয় না এই দুনিয়ায় অনেক রকম হাওয়া থাকে,আর তারা সবাই কীরকম একা একা কাঁদে!

আমার এরকম মনে হয়। হাওয়াদের আলাদা আলাদা কান্না আমি শুনতে পাই, যেমন এখন শুনতে পাচ্ছি, আমার এই নির্জন অফিস ঘরে।

কিছুদিন ধরে তোকে মনে পড়ছিল খুব! ভাবছিলাম চিঠি লিখব। আমার চেয়ারের পিছনে বসা আমার সহকর্মীকে কিছুদিন ধরে বলছিলাম লেখার কথা। ও জানে আমি লিখি। আজ এসেই বলল লিখুন। বললুম খাতা কই? কলম তো নেই। আমাকে নিজের কলম ধরিয়ে দিয়ে বলল এই নিন, নতুন কিনেছি। ও ভেবেছে বোধহয় আমি কবিতা লিখব, কিন্তু

কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে অনেকদিন। এখন, আজকাল যা লিখি সেসব আমার প্রেত। আগেকার কথা ভাবলে আমার কীরকম আশ্চর্য লাগে! তুই তো কবি। তোর কতরকম আলো! আচ্ছা জুবিন, জুবিনের যে কতরকম শ্রাবণ! আর মনে আছে অত্রিকে, ওহ! সে নিজেই একটা আশ্চর্য দোল পূর্ণিমা।

অত্রিকে দেখেছিলাম, বই মেলার মাঠে। ও তো লম্বা,তার ওপর পরেছিল ফতুয়া বা পাঞ্জাবি যা বলবি। ঠোঁটে সিগারেট। ধুঁয়া উঠছে। কী যে সুন্দর লাগছিল! আমার মাথার ভিতরে তখন একটাই লাইন

দেখেছিলাম আলোর নীচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো

জুড়িয়ে দিলো চোখ আমার, পুড়িয়ে দিলো চোখ

 

আগে, পরের কন্টেক্সট সব ভুলে গেছি তখন।

তুই তো আমাকে জানিস, যেকোনো কবিতার লাইন আমার এরকম উদ্ভট ভাবে মনে পড়ে। কোনও দিন কোন লাইন, কোন কবিতাকেই তার কন্টেক্সটে বুঝতে পারিনি আমি। ভাবতেই পারিনি। সেইজন্যই বাংলা ভাষা নিয়ে পড়া হল না আমার। বাংলা ছাড়, সাহিত্য নিয়েই পড়া হল না আমার। অথচ দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি, ম্যানেজমেন্ট পড়েছি। সবই লজিক্যাল। খাপে খাপ না বসলে ঐ দুটো বিষয়ের কোনটাই আয়ত্বে আসে না। অথচ যখন কবিতা পড়ছি তখন কোন লজিকই মানতে পারিনি আমি। অনায়াসে নজরুলের পাশাপাশি জীবনানন্দ পড়েছি, দুজনেরই লাইন কেমন যেন এক হয়ে ঢুকে গেছে গভীরে আমার। 

এসব ছাড়। তোর মনে পড়ে ক্ষেপচুরিয়াসের প্রিন্ট বেরোবার আগের সেই দুপুরের কথা। দুপ্যাকেট ফ্লেক আর কুড়িটা রসগোল্লা নিয়ে ঢুকেছিলাম জুবিনের বাড়ি। তুই ছিলি, পার্থ ছিল, বাণী ছিল, প্রসেন কি ছিল? মনে নেই। প্রসেন একবার আমাকে আসানসোলের ফুটবল নিয়ে লেখার কথা বলেছিল। আমি আজও লিখছি সেই লেখা। এখনও লিখতে পারিনি। তোকে এই যে চিঠি লিখছি এও কি শেষ করতে পারব? কী জানি!

বাণীর সাথে দেখা হয়েছিল কিছুদিন আগে। ট্রেনে। যাচ্ছিলাম আমার এক কলিগের সাথে কল্যাণী ট্রেনিং করতে। দেখা হল বাণীর সাথে চলন্ত ট্রেনে আর অপেক্ষারত ষ্টেশনে কিছুটা মুহূর্ত। ওর হাতে তখন ক্যামেরা নেই। বাণী চলে যাওয়ার পর অনেক রাতে হস্টেলের ঘরে পাশের বেডে শুয়ে আমার সহকর্মী আমাকে বলেছে এই যে তোমরা যারা লেখালেখি কর তোমাদের দেখলেই বোঝা যায় তোমরা আলাদা- বাণীর একটা কবিতার শিরোনাম ছিল মাঝিপাড়া আর ইন্দ্রদেবের দল”- কবিরা কী তাহলে ইন্দ্রদেবের দল!

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কী জানিস, লোকে যে এত বই পড়ে, ক্ষেপুর প্রিন্ট ভার্সন পড়লেই তো সব হয়। ওতে সবই আছে। যার কবিতা লেখার আছে সে একটা লাইন পড়েই লিখবে। একটা মাত্র ঘটনা, পৃথিবীতে কেউ লক্ষই করে নি অথচ রত্নাকর ডাকাত, মহাকবি হয়ে গেলেন। কবি নজরুলের একটা লাইন আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো।  

মম প্রানের পেয়ালা হরদম হ্যায় হরদম ভরপুর মদ

সেই যে চলকে পড়তে শুরু করেছে আজও থামে নি। এখনও শুন্য গেলাসে দুচার ফোঁটা রয়ে গেছে মদ। 

বলছিলাম সেই দুপুরের কথা, আমি, তুই, বাণী আর পার্থ। একের পর এক বিড়ি ধরিয়ে যাচ্ছি, নতুন কবিতা পড়ছি, সিলেক্ট করছি আর তারই মাঝে আমাদের সব অগ্রজ কবিদের কবিতা খুঁজছি। চর্যাপদ থেকে পিনাকী ঠাকুর পর্যন্ত পড়েই চলেছি। সেদিন যখন ফেরৎ আসছি ভাবছিলাম কী আশ্চর্য এই কবিতা! 

আমি তো বরাবরের হাফ বাউন্ডুলে ছেলে, আসানসোল থেকে ছুটে গেছি আমার প্রিয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে। মনে পড়ছে, লাল একটা টি-শার্ট পরে নন্দনের সিঁড়িতে বসে আড্ডা মারছি। জামিলদা এসেছে বাংলাদেশ থেকে কবিতা নিয়ে। মনে পড়ছে আপন মাহমুদের কবিতার সেই চুমুর কথা প্রতিটা মানবশিশুর পিতা প্রতিটা মানবশিশুর মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে আজও। বড্ড কমবয়সে চলে গেল আপন আমাদের ছেড়ে।

বাংলাদেশ নিয়ে অনেকেরই একটা টান কাজ করে। বাংলাভাষার জন্য তাদের লড়াই আর পূর্বপুরুষের স্মৃতি হয়তবা এই জন্য দায়ী। আমার ভেতরে এরকম টান কাজ করেনি কখনও।

এই বাংলাদেশেই যখন শাহবাগ আন্দোলন চলছে, তুই জানিস সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের ভিতর এই ক্ষেপচুরিয়াস গ্রুপ নিয়ে কী অভিঘাত তৈরি হয়েছিল, যদি পারিস তাহলে কখনো সেসব লিখিস। তুই বা আমার সুহৃদ যারা আছে যেন লিখে রাখে এই দলিল।  

আড্ডা মারছি নন্দনের সিঁড়িতে বসে, বেবী পড়ে শোনাচ্ছে তার সেই কবিতা। চোখে মোটা কাঁচের চশমা, পিঠে ভারী ব্যাগ। আমার পাশে বসে অয়নদা। আমার হাতের কোনায় সিগারেট। অনেক রাতের শেষে  সিঁড়ি বেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় কবিতার লাইন। আমি একা বেবীর কবিতা নিয়ে বসে থাকি হাওড়া ষ্টেশনের সামনে, দিনের প্রথম ট্রেন পেপার লোকাল ধরে বাড়ি ফিরে আসব, সঙ্গে বেবীর বই। আর কোনদিন দেখা হবে না আমার সাথে বেবীর। অনেকদিন পর বাড়িতে বসে শুনব, ঘরের দরজা ভেঙে বের করে আনা হচ্ছে বেবীকে। বেবী নেই। মোটা কাঁচের চশমা, উলুঝুলু চুলের একটা শরীর আছে মাত্রঅয়ন দার সাথেও দেখা হল না আর। হাসপাতালে গেলে কেউ আর ফেরে না মনে হয়, অন্তত আমি কাউকে ফিরতে দেখিনি।   

হাসপাতাল থেকে মনে পড়ল অনেক বছর আগে একটা দীর্ঘ কবিতা পড়েছিলাম। সাদা নার্সিংহোম। তোর আর জুবিনের প্রিয় রঘুদা। আমার কবি পুন্যশ্লোক দাশগুপ্ত। একের পর এক সিরিজ লিখে যাচ্ছেন। মনের আনন্দে চকোলেট  খেতে খেতে ডুবে যাচ্ছেন ক্ষেপচুরিয়ানিজমে। জুবিনকে বলিস লিখতে তাঁর কথা, যে কবি জুবিনকে ভালবেসেছিল। মনে পড়ে তোর, সেদিনের কথা, তুই, আমি আর পার্থ লন্ঠনের আলোয় দেখেছিলাম কী এক অপার্থিব আলোয় জ্বলে উঠছেন শিলিগুড়ির কবি পুণ্যশ্লোক!   

দেরী হয়ে গেল, একটু সিগারেট খেতে গেছিলাম। আকাশের রোদ ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাওয়া চলছে। একটু গরম হাওয়া। সিগারেট খেতে খেতে ভাবছিলাম পুরোন কথা। আমার বিয়েতে কাউকেই নেমন্তন্ন করিনি। কেবল সুতপা আর বিকাশ গায়েন এসেছিলেন। সুতপা বিয়ে করেছে। এখন পুরুলিয়াতে।

বিয়ের পরেপরেই আমার সাথে বাবা, মায়ের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। কেন, কী জন্য, সেসব এখন থাক পরে আবার লিখব। এক সকালে বউকে নিয়ে উঠেছিলাম কলকাতার পার্কস্ট্রীটের এক হোটেলে। কলকাতার অফিসে জয়েন করে সোজা চলে গেছিলাম জুবিনের কাছে। বলেছিলাম কম খরছে কয়েকদিন একটা থাকার জায়গা যোগাড় করে দেওয়ার জন্য।

জুবিন আর আমি গোটা চুঁচুঁড়ো ঘুরেছিলাম সস্তায় একটা আস্তানা পাওয়ার জন্য। তুই তো জানিস আমি একটু আরামপ্রিয় লোক। শেষপর্যন্ত  ঘড়ি মোড়ের কাছে একটা হোটেলে ছিলাম দিন পনেরো। তারপর অজয় আর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। অনেক অনেক ঘুরে বুঝতে পেরেছি, আমার আর থিতু হওয়া হবে না কোনদিন।

মনে হয় কবিদেরে থিতু হতে নেই কখনও। আরও মনে হয় ভেসে ভেসে বেড়ানোর সময় কবিকেই বাড়িয়ে দিতে হয় কবিদের হাত। যেমন জুবিন ঘুরেছে সারাটা রোদ্দুর আমার সাথে, যেভাবে তুই আমাকে খাইয়েছিস ভাত তোর বাড়ির সবথেকে শীতল কোনটায়।  

আজ রাখি রে। অন্যদিন হয়ত আবার লিখব। আজ কাস্টমার এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।

 

                                                                                                 ইন্দ্রনীল।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন