ভালই বাস, কি হত্যাই কর!
টুকরো কথা
খুব স্বল্প আলোয় বসেছিলেন তিনি। এই সময়টায় চলে আসেন নগরের বাইরে। বানজারাদের তাঁবুতে বসে পড়েন এক পেয়ালা শরাব নিয়ে। মাথার পাগড়িটা বেশ কিছুটা নামানো, কাপড়টা মুখের এপার থেকে ওপারে টানা। শুধু পেয়ালায় চুমুক দিতে একটু উঁচু করে নেন মাঝেসাঝে। দু-চারজন এমন আদমি আসে এইখানে। তারা চায়না তাদের কেউ জানুক। অন্যরাও জানার চেষ্টা করেনা। তাছাড়া বানজারার অত কৌতুহলী নয়ও। নিশ্চিন্তে বসেছিলেন তিনি। খানিক পরেই শুরু হবে নাচ-গান। বানজারা পুরুষ ও মেয়েরা নাচবে। মরুভূমির বালি উড়বে পায়ে পায়ে। সামনের যে জায়গাটা খালি সেখানে আগুণ জ্বলে উঠবে। তিনি পেয়ালায় চুমুক দিলেন। একটা শিরশিরে হাওয়া আসছে কোথা থেকে যেন! দুটো উট কিছুদূরে নিশ্চিন্তে বসে আছে। বেশ কিছুদিন তারা এখানে বসেই থাকবে। খাবে আর বসে থাকবে। যখন এই বানজারার ডেরা-ডান্ডা গুটিয়ে যাবে তখন আবার ওরা উঠে দাঁড়াবে ভাল করে। পিঠে বোঝা নিয়ে দুলতে দুলতে হাঁটতে শুরু করবে। মিলিয়ে যাবে দিগন্তে। মিলিয়ে যাবেই। আহ্! আর সহ্য হয়না তাঁর। সব মিলিয়ে যাবে? এত, এত কিছু সব? ফতেমার মতন? যার নাভিতে ছিল পদ্মের গঠন তার মতই? তিনি তাঁর যৌবনকে দেখতে পাচ্ছেন। যে ওই মরুভূমির বালুর উপরে আধ শোয়া। পাশে ফতেমা। ফতেমার নাভিতে রেখেছেন পেয়ালা। কোথাও উঠে যেতে পারবে না সে। আর নিজে তিনি কালো আঙুরের ঝাঁক নিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছেন ফতেমার ঠোঁটে, চিবুকে, স্তনসন্ধিতে।
যদি নেশায় চুর খৈয়াম তবে আনন্দ করো আয়োজন!
যদি রমণীর পাশে ঘোর, তবে আনন্দ করো আয়োজন!
ভাবনা কিসের বল, শেষে তো জানোই বিশ্ব শুধুই শূণ্য,
তার ফাঁকে ভাব তুমি ফাঁকি নও, তুমি তো এখন পূর্ণ!
ফতেমা একদিন ওই দিগন্ত পার হয়ে বানজারাদের কাফেলার সাথে চলে গেল। চলেই গেল। তাঁর মতন মানুষের সঙ্গে থাকা অনুচিত ফতেমার। খৈয়ামের বেগম আছে। ফতেমার ঠাঁই কই? তাছাড়া এসব নেশা মাত্র। কাল নেশা ছুটে গেলে তখন? ফতেমাকে পরে থাকতে হবে ছেঁড়া কাপড়ের মতন। কাবেলার ভাই-বেরাদর যত সকলেই একথা বলেছে। ফতেমা মেনে নিয়েছে। তাঁদের মিলন নেই। তাঁদের কুষ্ঠীতে নক্ষত্রের দোষ। ফতেমা কাফেলার সঙ্গে চলে গিয়েছে মরুভূমি পার।
তারপরের থেকে নক্ষত্র দেখেছেন তিনি। দীর্ঘ্যকাল রাতের আকাশে তাকিয়ে থেকেছেন। ঘুম আসতো না তাঁর। কষ্ট ভারী হয়ে ঝুলতো তাঁর পড়ার ঘরের কোণ-কুলুঙ্গিতে। ঢুকলেই ঝাঁপিয়ে পড়তো তাঁর উপরে যেন দামাল এক শিশু। তিনি তাকে কোলে নিয়ে আদর করতেন, খেলা করতেন। কাঁদাতেন, কাঁদতেন। একদিন যখন আর জল ছিল না কোনো তখন ওই অনন্ত আকাশের দিকে চাইলেন। যখন তিনি চাইলেন তখন মনে পড়লো তাঁকে ফতেমা বলেছিল,
- আমরা দুজন যেন দুটি সমান্তরাল রেখা। চলে যাচ্ছি আর চলে যাচ্ছি।
খৈয়াম, যে সুলতান মালিক শাহ-র পরামর্শদাতা, যে কিনা বলখ-এ শেখ মুহাম্মদ মনসৌরির ছাত্র, খোরাসান-এ যাকে শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং ইমাম মোয়াফফক নিশাপুরি, সে যতই তাঁবু বানানেওয়ালা পরিবারের সন্তান হোক সে আর ফতেমা সমান না। তাঁবু বানানেওয়ালা পরিবারের অনেক অর্থ সঞ্চয় হয়েছিল। তাদের দরকার ছিল রাজ বংশের সান্নিধ্য। তারা ক্ষমতার কাছে থাকতে চেয়েছিল। তাই না আফঘানিস্তান থেকে খোরাসান সর্বত্র নিয়ে গিয়েছে ওমর-কে। এই ওমর বানজারা ফতেমার সঙ্গে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে তা কি করে হয়? অনেক পড়াশোনা করে খৈয়াম সার বুঝেছেন যখন ফতেমা এক রাতের আঁধারে চলে গেল মরুভূমির অজানা কোনো প্রান্তে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন