সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩

ছোটগল্প - এম. কালিদাস


ছোটগল্প
 

এম. কালিদাস


পূণ্যতোয়া
 


অনল কালো পিচ রাস্তা ধরে হাঁটছিল। হাতে ঝোলানো পোড়া মাটির পাত্র। কলস বলা যায় না। একটা বড় আকারের পোড়া মাটির কালো ঘট। পাত্রটির গায়ে লাল সাদা নকশা করা। তার পরনে মলিন ধুতি, হালকা নীল রঙের ফতুয়া। কাঁধে ছোট ঝুলি। ধু-ধু প্রান্তর। কালো পিচ রাস্তার ধারে কখনো কখনো দু'একটা গাছ চোখে পড়ে। রাস্তাটা মসৃণভাবে এগিয়ে গিয়েছে তার কাঙ্খিত নদীর দিকে। কতদূর সে জানে না। নদীটির রূপ সে জানে না। শুধু একটা ছবি মনের শ্লেটে এঁকে নিয়েছে। একদিকে বালুকাময় চর অপর দিকে উঁচু পাড়। বহতা নীল জলের নদী। এক স্রোতস্বিনী নদীর স্বপ্ন দেখে সে।  দূরে ছোট ছোট গাছ-গাছালি ছাওয়া গ্রাম। ছোট ছোট জেলে নৌকো নীল জলে মেঘ হয়ে ভাসে তার কল্পনায়।


অনল হাঁটছে ... হাঁটছে ... তার কাঙ্খিত নদীর খোঁজ এখনো তার অধরা! সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর নামে আঁধার-রাত্রি। অর্ধেক পৃথিবী অন্ধকার, অর্ধেক আলোকিত। প্রতি রাত্রে মাটির ঘটটিকে সযত্নে তার ঝুলির পাশে রেখে বট, অশ্বত্থ বা নিমগাছের নিচে রাত কাটায় অনল। সাপের মত শুয়ে থাকে কালো পিচের রাস্তা। শান্তি নদীর কাঙ্খিত জল এই ঘটে ভরে আনার জন্য কতদিন আগে যে গৃহত্যাগ করেছে সে নিজেই মনে করতে পারে না। অনল যখন গৃহ থেকে নির্গত হয় তখন সূর্য উদিত হচ্ছিল। পাখিদের কূজন শুরু হয়েছে। তার বাড়ির আম গাছটির ভরা মুকুলে সুবাসিত উঠোন। কোনও কোকিলের কুহু কুহু তখনও শোনা যায় নি।


কয়েকদিন আগে একটা গ্রাম্য মেলা থেকে এই মাটির পোড়া ঘটটি কিনেছিল। কেনা বললে সঠিক হয় না, এক বৃদ্ধা তাকে এই ঘটটি একরকম গছিয়ে দিয়েছিল। বৃদ্ধা বলেছিল- এই ঘটে পূণ্যতোয়া নদীর জল ভরে আনলে সংসারের মঙ্গল হয় এবং শান্তি আসে। তবে বৃদ্ধা তাকে নদীতে যাওয়ার সঠিক বা যথাযথ পথ নির্দেশ দিতে পারেনি। বলেছিল-  'ঐ যে শহর দেখছ, ওর পূর্ব দিকে যে কালো পিচের পথ; ঐ রাস্তা ধরে শুধু পূর্ব দিকে হাঁটলেই একদিন পূন্যতোয়া নদী পাবে।'


সম্প্রতি কর্মে অবসর গ্রহণ করেছে অনল। পুত্র কন্যা প্রবাসে থাকে। স্ত্রী ক'য়েক বছর আগে গত হয়েছে। এই যাপন তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। শহরের মেলা খেলা, খবরের কাগজ, টিভি সিরিয়াল, খবর বিশ্লেষণের তর্জ্জা সবই তার কাছে একঘেয়েমিতে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামের মেলায় পৌঁছেছিল। সে সাধারণত কোন জিনিস কেনে না। শুধু দেখে। সেদিন হঠাৎ তাকে আকর্ষণ করল বিচিত্র কারুকাজ করা এই পোড়া মাটির ঘটটি। বিক্রেতা বৃদ্ধার মুখমন্ডলে প্রাচীন বটের ঝুরি, বয়সের চিহ্ন। বৃদ্ধার কথায়  প্রভাবিত  হয়ে সামান্য এই পোড়া মাটির কালো ঘটটি স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ে ক্রয় করেছিল। ভেবেছিল- দেখাই যাক না যদি ঘটটিতে পূণ্যতোয়া নদীর জল এনে ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখতে পারে! তাদের প্রাচীন বাড়ির কড়ি -বরগার ছাদের ঘরে একটা কুলুঙ্গি আছে। যেখানে তার ঠাকুরমার পাতা লক্ষ্মীঘট আছে। তার মা, পরে তার স্ত্রীও ঐ কুলুঙ্গিতে সন্ধ্যা প্রদীপ দিত।  সে মনস্থির করে বেরিয়ে পড়বে কাঙ্খিত নদীটির উদ্দেশ্যে! তখন কী জানত বৃদ্ধার বলা এই কালো পিচের রাস্তা কোথায় শেষ হয়েছে! শহর পেরিয়ে অনেকদিন হাঁটার পর দেখল রাস্তার দু'ধারে মরুভূমির মত বালুকাময় ধূ-ধূ প্রান্তর। কিছু কিছু কাঁটা ঝোপ, কখনো কখনো দু'একটা বট, পাকুড়, নিম গাছ চোখে পড়ে। এই গাছগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা পথিকদের প্রান্থনিবাসের মত। হাঁটছে তো হাঁটছেই ...পথের কোন শেষ নেই। হাতে পাটের দড়িতে ঝুলছে শূণ্য কালো পোড়া মাটির ঘট! গত দিন চোখে পড়েছিল কালো রাস্তায় শুয়ে আছে একটা মানুষের কঙ্কাল। হাড়ের আঙুলে ধরা আছে তার হাতের ঘটটির মতই একই রকমের আর একটি কালো ঘট! তবুও সে হাঁটতেই থাকে যদি কাঙ্খিত নদীর তীরে যাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত অনল। প্রথম দিকে ক্ষুধা তৃষ্ণা অনুভব করত । এখন আর খাদ্য-পানীয়র কথা মনেও পড়ে না। শরীর শুকিয়ে শীর্ণকায়। দেহের চর্বি মাংস সব গলে বায়ুমণ্ডলে মিশে গেছে। একখন্ড পোড়া কাঠ যেন — হাঁটছে ... হাঁটছে..


সকাল হয়। লাল সূর্য ওঠে। ক্রমে লাল কোমল রৌদ্র উত্তপ্ত হয়ে তাকে দগ্ধ করে। বিকেল হয়। দিগন্ত লালাভ করে সূর্য অস্ত যায়। ইদানীং আর সে রাত্রেও বিশ্রাম নেয় না। কাঁধের ঝুলিটি কবে, কখন, কোথায় ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি। শুধু হাতের মুঠোয় ঝুলছে দড়ি বাঁধা ঘটটি। একদিন তার চোখে পড়ল দূরে  — অনেক দূরে একটা সাদা পাহাড়। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধা বলেছিল— 'একটা সাদা পাহাড় ডিঙিয়ে তবেই পৌঁছানো যায় পূণ্যতোয়া নদীর তীরে!' তার বুক আশায় নেচে উঠল। কাঙ্খিত নদীর কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে! সে নতুন উদ্যমে আরো গতিতে এগিয়ে চলল। এখন তার শরীরে কোন বসন নেই। দু'হাত বুকের কাছে জড়ো করে সযত্নে ঝুলিয়ে রেখেছে কালো পোড়া মাটির ঘট। দূরে কালো পিচের রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পাহাড়। দিন যায়, রাত যায়। কখনো জোৎস্নায় সোনালি রঙ, সকালে লালাভ জিহ্বার মত, দুপুরের রৌদ্রে রূপোর মতো উজ্জ্বল সাদা! সে অনুভব করে পাহাড়টির কাছাকাছি এসে পড়েছে। তার বুকে সমুদ্রের ঢেউ-শান্তির লিপ্সা! কিন্তু কোথায় নদী! পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছোতেই পারছে না। তবে তার প্রত্যয় হয়তো অতি শীঘ্রই সে পৌঁছে যাবে সাদা পাহাড়ে। একসময় আকস্মিক ভাবে তার নিজের পা দুটো দিকে তার নজর পড়ল। সে দেখল তার পা দু'টিতে কোন চামড়া বা মাংসপেশী নেই। সাদা ধবধবে হাড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। ভয় হল। দেখল তার পুরো দেহটাও একটা সাদা কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। তার দক্ষিণ হস্তের  অস্থির আঙুলের কঠিন মুঠোয় ঝুলছে দড়ি বাঁধা কালো ঘট!


কাঙ্খিত দিনটি একদিন এল। প্রত্যুষে দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে সাদা পাহাড়ের চূড়ায়। নিচে সাপ, শুয়ে আছে পিচ রাস্তা। পাহাড় থেকে দূরে দেখা যাচ্ছে লালচে রূপালী নীল রামধনু রঙের একটা স্থির নদী!... পাহাড় থেকে নেমে জল আনার কোন তাগিদ আর অনুভব করল না। সঙ্গে আনা কালো মাটির ঘটটিকে সে ছুঁড়ে দিতে চাইল নদীর জলে। হাত তার অসাড়।সাদা হাড়ের পাহাড়ে ডুবে যেতে থাকল অনল...