সোমবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৩

নিবন্ধ - অত্রি ভট্টাচার্য


নিবন্ধ  

অত্রি ভট্টাচার্য


তিনটি সেলুলয়েডের কবিতা ও অন্তর্গত সংলাপ
-------------------------------

     কবিতা, ভাষা তথা সমাজ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে, তার অস্তিত্ব দিয়েই একটি সর্বাধুনিক অথবা পুরাতনতম প্রকাশপদ্ধতির সূচনাকে নির্ধারণ করে থাকে। যে কোন ভাষা, তার লিপি থাক বা না থাক, কবিতার জন্ম দিতে পারলে মনে করা যায়, সে এক অনন্য পরিণতিতে উন্নিত হয়েছে। কবিতা ভাষার মূল উদ্দেশ্য যোগাযোগসাধনের পরের ধাপ, অর্থাৎ ভাষার জটিলতা ও সমৃদ্ধিনির্মাণের উপকরণ হিসেবে কাজ করে থাকে। তাই ভাষার প্রাথমিক যুগে কবিতা যেমন সুরসহযোগে বা ব্যাতিরেকে লিরিক হিসেবে যোগাযোগকেই সচল করছে, তেমনই ভাষার পরিণতির পথে ভাষাকেই ঐশ্বর্য্যশালী করছে ক্রমঃজটিল আন্তঃক্রিড়া ও আবেগের সঙ্গে গুঢ় সম্পর্কের অনুনাদে। এককথায়, কবিতা ভাষার এক উপযুগ্মমাত্র নয়, বরং উন্নতিসাধনের হাতিয়ার। কবিতার এই ভূমিকার এক স্বাভাবিক প্রসেস রয়েছে; তা হল, শব্দ বা শব্দতন্ত্রের মাধ্যমে পাঠকের চিহ্নময় দৃশ্যনিবিড় ব্যাক্তিগত বস্তুকল্পভুবনের মুকুরে উদ্ভাসিত হওয়া, যা আসলে কবিতার ক্রমশঃ ভেঙে আসা, দৃশ্যে তরল হওয়ারই আংশিক পদ্ধতি মাত্র। কবিতা শব্দ থেকে ছবিতে, ছবি থেকে স্মৃতিতে, তা থেকে পাঠকের ভাল লাগা বা মন্দ লাগার তন্ত্রীতে ঘা দেয়।

     সংস্কৃতির আধুনিকতম মাধ্যম হিসেবে সিনেমা অবিশ্যি এর উল্টোপথে হাঁটবে। সিনেমা দৃশ্য বা দৃশ্যকল্পকে তুলে ধরবে দর্শককে তা ভেঙে শব্দে (পড়ুন চিহ্নে) সরলীকৃত করবার জন্য। এবং তা সৃষ্টি করবে নতুন স্মৃতি। তফাৎ এই, যে এইসব দৃশ্য স্মৃতিতে জমা থাকবে, ভবিষ্যতে নিদ্রাজাগরণে দর্শকের কাছে আসবে চিহ্নের প্রতি আনত, শব্দের একক হয়ে। সেক্ষেত্রে সিনেমার, আধুনিক বাকবর্ণসঞ্চারক্ষম সিনেমার সঙ্গে কবিতার এই আপাত-বিপরীতমুখী সম্পর্কটি হয়ে দাঁড়ায় বহুত্ববাদী, বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রণশীল রাষ্ট্রেব্যবস্থার মধ্যে থেকেও তার জটিল নজরদারীকে এড়িয়ে সমাজতান্ত্রিক আবেগ ও সৃষ্টিশীলতা আবিষ্কারের এক উপযোগ।

     সিনেমা, প্রায় শুরু থেকে, কবিতার মতোই, মৌলিক দৃশ্য বা শব্দের জান্তব আধিপত্যকে তার নিজস্ব যুক্তিকাঠামোর আওতায় আনতে, তাকে ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে। আইজেনস্টাইনের মন্তাজ হোক বা ত্রুফো-গোদারদের নব্য তরঙ্গ, সাবেকী ও প্রচলিত অর্থপদ্ধতি তথা চিহ্নতন্ত্রকে লাথি মারার আগ্রাসী বা যৌক্তিক পন্থাই এদের ফিল্মনির্মাণের উপজীব্য। অবশ্য গত শতাব্দীর শেষে এসে সিনেমা সত্যিই পরিণত, কবিতার সঙ্গে সম্পর্কে আরোও শব্দাতীত, কল্পনাঘন ও স্বপ্নসম্ভব হয়ে উঠেছে। বলা যায়, আন্দ্রে তারকোভস্কি (১৯৩২-১৯৮৬) তার সিনেমায় স্লথতা ও নৈঃশব্দ্যের যে অপূর্ব মিশেল দিয়ে সিনেমাকে নিরুচ্চার কবিতাপাঠের প্রায় আবহে, নেপথ্যে স্থাপন করেছিলেন, গত কয়েক দশকের কারিগরী উল্লম্ফন ও সিনেমায় তার ব্যাপক ব্যবহারের অপেক্ষাকৃত মৃদু, সংবেদনশীল দিকগুলি সেই মিশেলকে প্রায় ঐশ্বরীক এক ইডেনে স্থাপন করেছে। যদিও পাসোলিনি তার The Cinema of Poetry ( জুন, ১৯৬৫) প্রবন্ধে এই বিশ্বাস ব্যাক্ত করছেন যে, “whereas the instruments of poetic or philosophical communication are already extremely perfected, truly form a historically complex system which has reached its maturity, those of the visual communication which is at the basis of cinematic language are altogether brute, instinctive”, অর্থাৎ দৃশ্য ও শব্দের মত আদিম প্রবৃত্তি (পড়ুন ইন্দ্রিয়জ্ঞান)-এর উপর নির্ভর করে বলেই সিনেমার ব্যকরণ, কবিতার মত শব্দধন্য, সংস্কৃত বা দর্শনাশ্রয়ী নয়, রাদার মোটা দাগে তার প্রকাশ, অন্তত ঐহিকে।

     ইটকাঠপাথরের শহুরে সচ্ছলতায় কবিতা বাসা বাঁধে মানুষের অতৃপ্তির, মানসিক নিষ্কাশনের অন্তর্গত বিবমিষার হাত ধরে। ২০১৪ সালের জার্মান ছবি “পরিচারিকা লিন”(Das Zimmermädchen Lynn, পরিচালক ইঙ্গো হায়েব)-এ এরকমই এক ধূসর নৈঃশব্দ্যের শিরায় শিরায় ভায়োলিন বাজে। Unterm bett, বিছানার নীচে, লিন (অভিনয়ে Vicky Krieps) তার কল্পনাকে শা দিতে হোটেলের অতিথির যাপন শোনে, যে হোটেলে সে পরিচারিকার কাজ করে। নানান কাজে আসা নানান মানুষের প্রবাসকে সাফসুতরো করার কাজ। পরিষ্কার করা তার পছন্দ। মানুষের আসা যাওয়ার মাঝে ঘরগুলি ঝকঝকে রাখা, এমনকি খালি ঘরগুলিও রোজ, বারে বারে ধোয়ামোছা করা তার পছন্দ। সে মায়ের বিছানার নীচে এক বেড়ালছানা ছেড়ে যাবার আগে বলে যায়,

Mama? You know what the best part about cleaning is? That it always gets dirty again.


চিত্র ২
: Das Zimmermädchen Lynn (২০১৪) ছবিতে লিনের চরিত্রে ভিকি ক্রিপ্স

     লিনের এই তথাকথিত মনোরোগের মানে করতে ইচ্ছে হয় এইরকম, শুয়ে শুয়ে এই অচেনা দৃশ্য ও শব্দের, চরিত্র ও বস্তুর মধ্যে দিয়ে পথ চলার অভিজ্ঞতাকেই আমরা স্বপ্ন বলি। লিনের স্বপ্নেরাও, স্টিরিওটাইপ আকাঙ্খা ও দুঃস্বপ্নের সিলেবাসের বাইরে তার এই নিষিদ্ধ জীবনের হাতছানিও তার নিজস্বতারই অংশ। বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত “হে আমার মৃত বন্ধু” (পরবাসী, ১৯৫৯) কবিতায় বলছেন,

“…স্বপ্নেরও ভিতরে এক অনির্বাণ স্বপ্ন, তাকে জানি।
জ্যোৎস্নায় ভাসছে গৃহ, মনোরম আত্মার কান্না;
এবং অনতিদূরে, হায় ছায়াখন্ড, তোর নগ্ন শবদেহ
বুদ্‌বুদের মতো ডুবছে স্মৃতিতে - সুনীল জলাশয়ে।”

     লিনের স্বপ্নের ব্যাক্ত কিন্তু অপ্রকট ঘটনাগুলি তার মনগড়া, নাকি স্রেফ তার দিনগত সক্রিয়তার সরলীকৃত রূপ – তা পরিষ্কার করেননি হায়েব। লিনের সঙ্গে কিয়ারা (অভিনয়ে Lena Lauzemis)-র কুড়িয়ে পাওয়া প্রেম পরস্পরবিরোধী দু’টি দৃশ্যে ধাক্কা খায়। একটিতে লিনের বিছানা এক অলৌকিক গাড়ি হয়ে, ভেসে ভেসে পৌঁছে যায় সমুদ্রের ধারে। পাশে এসে বসে কিয়ারা। দুজনে শান্তিতে চেয়ে থাকে চিরব্যাপ্ত ছুটির দিকে, যতক্ষণ না কিয়ারা উঠে চলে যায়। পরের দৃশ্যেই লিন কিয়ারার জন্য অনেক্ষণ অপেক্ষা করবার পর ফিরে আসে স্টেশন থেকে, তাঁর মায়ের কাছে। এর কোনটি সত্যি? ফ্রয়েড এই দিবাস্বপ্ন সম্পর্কে বলছেন, “We must not suppose that the products of this imaginative activity— the various phantasies, castles in the air and day-dreams—are stereotyped or unalterable. On the contrary, they fit themselves in to the subject's


চিত্র ১
: Das Zimmermädchen Lynn (২০১৪) ছবিতে কিয়ারা-র চরিত্রে লেনা লাউৎজেমিস

shifting impressions of life, change with every change in his (?) situation, and receive from every fresh active impression what might be called a "date-mark." সব মিলিয়ে লিন সাধারণ চোখে এক মনোরোগী, তার প্রমাণস্বরূপ একজন তাকে ক্রমাগত গতে বাঁধা প্রশ্ন করে যান ক্যামেরার পিছন থেকে। লিন তার উত্তর দেয় নিজের মনের গতিপথ ধরে, যেন ফ্রয়েড-উক্ত “shifting impressions of life”। এই আপাত-উন্মাদনা লিনের গোপনতমা সাপ, তার আয়নাসুলভ জীবনে প্রেমের প্রতিফলন খোঁজে কাঙ্খিত অত্যাচারে, অন্যের ব্যাভিচারে, সহজতম কোরাপশনে, আমাদের জীবনানন্দে উন্নিত করে –

“এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় ব’লে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতর টেনে নেয়;
অপরাহ্নে আকাশের রঙ ফিকে হ’লে।”

     লিনের জীবনের এই কয়েক মাসের অজস্র বিস্ময়চিহ্ন আমাদের স্যানিটিকে প্রশ্ন করতে করতেই তার আবেগের কুয়োর মত চোখদুটিতে হারিয়ে যায়। সেসব বিস্ময় চিরকাল আমাদের কাছে প্রশ্নচিহ্ন হয়েই থেকে যাবে।

     ক্রিস্তফ কিসলোস্কি স্মৃতিসীমায় এক অনন্য ছবিকর, যার রক্তে পোল্যান্ড থাকলেও শ্বাসবায়ু ফ্রান্সের গন্ধ বহন করে। তার চিত্রনাট্যের রূপকধর্মীতার একাধিক স্তর অবশ্য তাকে সচেতনভাবে পৃথক করেছে সাবেকী ফরাসী ত্রুফো বা গোদারেরর গতিশীল মনোগামীতার থেকে, যদিও ১৯৮৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পোলিশ ছবি Bez końca সম্ভবতঃ তার প্রথম নির্মিত ছবি যেটি সরাসরি (?) রাজনৈতীক মতামতে ঋদ্ধ। এই ফিল্মের উদ্ধত আঙুলের সবক’টিই ১৯৮১ সালে পোল্যান্ডে জারী হওয়া শ্রমীক আন্দোলন বাজেয়াপ্তকারী সামরিক শাসনের বিরোধীতা করে। কিন্তু এ ছবির কেন্দ্রে যে নারী, উরসুলা জিরো, ডাকনাম উলা (অভিনয়ে Grażyna Szapołowska ), তার এই আন্দোলনে ক্ষতবিক্ষত জীবনপথেরও এক অন্তরীন, বিয়োগক্লিষ্ট দিনলিপি আছে।

এ ছবি দু’টি সমান্তরাল কিন্তু শক্তিশালী বিষাদের স্রোতধারা ! একটি তার সদ্যমৃত স্বামী আনতেক (অভিনয়ে Jerzy Radziwilowicz)-এর শেষ মক্কেল, শ্রমীকনেতা ডারেক স্টখ (অভিনয়ে Artur Barciś)-এর মোকদ্দমা যার শেষে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ডারেক নিশ্চুপে আপোষ করতে বাধ্য হয়; অন্যটি আনতেকের স্মৃতির থেকে উলার নিজস্ব পলায়ন, অথবা তাকেই অনুধাবন। এই দুটি ঘটনাপ্রবাহ অবশেষে উলাকে মিলিয়েছে এক অমোঘ ও ভালোমন্দহিসাববিহীন এক আত্মহননের শীর্ষে। বলা যায়, ডারেককে কমরেডদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্যাক্তিগত মুক্তির পথ খুঁজে দেওয়া আনতেক-এর আদৌ অভিপ্রায় ছিল না, যা শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বিচলিত করে উলার আপাত অবিচল ও অরাজনৈতীক জীবনকে, যদিও পেশাগতভাবে অনুবাদিকা উলা আগাগোড়া অরওয়েলকেই অনুবাদ করছে । এ কিসলৌস্কির এক অন্য, অপেক্ষাকৃত Subtle ইঙ্গিত, জারুজেলস্কি সরকারের (১৯৮১-১৯৮৯) সামরিক শাসনকে স্তালিনের মৃত্যু-পরবর্তী ভ্লাদিস্লাভ গোমুলকার কম্যুনিস্ট শাসনকালের (১৯৫৬-৭০) সঙ্গে তুলনার; যদিও অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্ম ১৯৪৫-এ, স্তালিনের জীবৎকালেই প্রকাশিত।   


চিত্র ৩: Bez końca ছবিতে উরসুলার চরিত্রে Grażyna Szapołowska

     আনতেকের মৃত্যুপরবর্তী উলার প্রতিটি মূহুর্তে আনতেক নিজেই উপস্থিত। তার কান্না, আফশোষ, যৌনতা, এমনকি মুখের সামনে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনাও আনতেকের শবদেহ-ই বার করে আনে গাড়ি থেকে। উলার চিরঘুম অথবা প্রস্থানবিন্দু আনতেকের সঙ্গে, কারণ আনতেক মৃত্যুর পরেও উলার সঙ্গেই ছিল। শঙ্খ ঘোষ বলেন –

“আমাদের সেই গভীর ঘুমের মাঝখানে বৃষ্টি নামেনি -
আমরাও নামিনি বৃষ্টির মাঝখানে। তবু কেমন করে
কেটে গেল রাত্রির নির্জন থমথম
আর অলস মন্থর সকাল
কেমন করে ভেসে উঠল চোখের উপর –

আমরা কেউ জানলুম না, আমরা ঘুমিয়েছিলুম।”

     আনতেক উপস্থিত সে সে মূহুর্তে, যেখানে তার উত্তরাধিকার দুমড়ে যায় রাষ্ট্রের শক্তিশালী মুঠোর চাপে, প্রিয়জনের অভিযোজনে। আনতেক উলার কিছু নগ্ন ছবি পেয়েছিল বহুকাল আগে। নষ্ট করেনি, খামে মুড়ে রেখে দিয়েছিল গোপনে। উলার কান্না ঈশারা করে এক ওবিচুয়ারি নৈকট্যের, যার ব্যাখা থাকলেও বাস্তবায়ন শুধু আত্মহননে। রাজনীতিকে এক পরিবারের টুকরো টুকরো হয়ে যাবার অন্তরে নিরিখে প্রকাশ করবার কৌশল দেখিয়েছিলেন মৃণাল সেন-ও, “মহাপৃথিবী” (১৯৯২) ছবিতে। সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার শতাব্দীকালীন আশাভঙ্গ কুরে কুরে খায় তৃতীয় বিশ্বের ভাঙাচোরা জীবনের আবডালে, রূপকে। যদিও এই ঘটনাকল্পের ছায়া পড়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রায় কাল্ট হয়ে যাওয়া ছবি সব চরিত্র কাল্পনিক (২০০৯)-এর কাহিনীপথে-ও, যদিচ সেখানে আনতেকের ভূতের অহরহ উপস্থিতির মত কোন সুররিয়াল আবহ তৈরী হবার প্রয়োজন হয়নি।


চিত্র ৪
: Bez końca ছবিতে ডারেকের চরিত্রে Artur Barciś

     আনতেক ( Anthony-র পোলিশ সংস্করণ) নামের অর্থ অমূল্য, Priceless। ছবিতে আনতেকের মৃত্যু, নিছক হৃদাঘাত হলেও তার চলে যাওয়া এবং অতঃপর তার অন্তর্যামী উপস্থিতিই তার অবস্থানের দুর্মূল্যতাকে সমকালীন পোল্যান্ডের রাজনৈতীক পরিস্থিতিতে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। শ্রমীক নেতা ডারেকের দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, তার নিজেরই মুক্তির বিরুদ্ধে, একই সঙ্গে পরিবা্র ও কমরেডদের প্রতি কর্তব্যবোধের টানাপোড়েন শেষ হয় কারখানায় ধর্মঘটের মামলায় তার বেকসুর খালাস হবার সঙ্গে। আর উরসুলার আত্মহত্যা, একার্থে এই ত্যাগের নতিস্বীকার, ক্ষমতার কাছে।

ছবির নাম “Bez końca”, যার ইংলিশ অনুবাদ করা হচ্ছে NO END ! ভালোবাসার অপসমাপ্তির মোড়কে রাজনৈতীক বিশ্বাসের হত্যার বাস্তবিকই কোন শেষ নেই, অথবা এ সমাপ্তি আদৌ অভিষ্ট নয়। উরসুলার সঙ্গে আনতেকের প্রবল সীমানা-মিথ্যে-করা আকর্ষণ-ই সমাজতন্ত্রসংক্রান্ত মতামত কিয়েস্লোস্কির, স্পষ্ট রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান, ওই মৃত্যুপরবর্তী অতিলৌকিক মহাপ্রস্থানের মত ছেঁদো মিলনানন্তিকতা নয়। শেষহীনতার প্রকল্পে এক দুরন্ত আশাবাদ। উৎপলকুমার বসু লিখেছেন –

“দূর থেকে হাত তোলো। যদি পারো জানাও সম্মতি।
নইলে সঙ্কেত আজো বৃথা যায়। চলে যায় নৈশ ট্রেন দূরে
অর্ধেক জাগ্রত রেখে আমাদের”

     প্রসঙ্গতঃ, এ ছবিতে রাষ্ট্রের কুকুরের মত ল্যাব্রাডর ( অভিনয়ে Aleksander Bardini ) নামের এক উকিল ডারেকের এই অভাবনীয় মুক্তির নেপথ্য ভূমিকায় থাকেন। উলার জিততে জিততে হেরে যাওয়ার প্রাণপণ ক্রাইসিসের সঙ্গে ল্যাব্রাডরের নিঃশব্দ নিপুণ খুনীর মত অবিচলতাকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে অক্ষের মত বসানো যায়, ব্যাক্তিমানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের হাস্যকর ও অসম যুদ্ধের রূপক হিসেবে। ল্যাব্রাডরের প্রতিটি চলনকেই এই বুর্জোয়া আগ্রাসনের ঠারেঠোরে পন্থার মত প্রতিফলিত হতে দেখব আমরা।

     ইউরোপীয় ছবির আলোচনা অথবা তার সঙ্গে কবিতার কষ্টকল্পিত সম্পর্কের সন্ধান – কোনটিই ফরাসী সিনেমার উল্লেখ ছাড়া সমাপ্ত হয় না। কিয়েসলোস্কি মাতৃভাষা পোলিশের বাইরে সবচেয়ে বেশী খ্যাতি পেয়েছেন Trois couleurs (১৯৯৩-৯৪) বানিয়ে। মাধ্যম হিসেবে ও চিত্রভাষার মৌলিকতার নিরিখে প্রায় অসমান্তরাল এই ফরাসী পতাকার রঙে নির্মিত তিনটি ছবি। এবং গত শতাব্দীতে ফ্রান্সের অন্যান্য মায়েস্ত্রোরা, তারকোভস্কি বা গোদার, যারা কবিতাকে প্রায় চিত্রনাট্যের সাবভার্শন হিসেবে ছবি বানিয়েছেন একের পর এক – তা ইতিহাসে চিরআলোচিত, দীর্ঘকাল স্পটলাইট নিয়ে থেকে যাবে। ফ্রাসোঁয়া ত্রুফো ( ১৯৩২-৮৪), বৃহত্তর ক্রিটিকমহল নব তরঙ্গের আওতায় তাঁকে ফেললেও মার্কিন ঢং-এ পিরিয়ডিকাল বা রোমান্টিক ড্রামা-র ক্ষেত্রেও এক বা একাধিক, অথচ ট্রিটমেন্টের দিক থেকে সুবিখ্যাত “Four Hundred Blows” (১৯৫৯) থেকে খুব দূরবর্তী কি? অঁরি-পিয়ের রোশে (১৮৭৯-১৯৫৯) রচিত দুটি নভেলের ত্রুফো-নির্মিত চিত্রায়নের (Jules et Jim, ১৯৬২ এবং Les Deux Anglaises et le Continent, ১৯৭১)   মধ্যে ব্যবধান প্রায় এক দশকের, মনোক্রোম থেকে রঙিন, কিন্তু ইতিমধ্যে ত্রুফোর হলিউডদর্শন তথা প্রত্যাশাভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। ফারেনহাইট ৪৫১ ( ১৯৬৬)-র মত মেনস্ট্রিম ও অফরাসী ছবিও বানিয়েছেন, কিন্তু বলতেই হয়, একই প্রেক্ষাপটে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল) নির্মিত ছবিদুটির মধ্যে ‘টু ইংলিশ গার্লস’ নিঃসন্দেহে ‘জুলস অ্যান্ড জিম ’-এর থেকে পরিণত, এবং এর থিয়েট্রিকাল, উচ্চকিত চিত্রনাট্যের গতিও অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত।


চিত্র ৫
: Les Deux Anglaises et le Continent ছবিতে মিউরিয়েল ব্রাউনের চরিত্রে Stacey Tendeter

     জুলস ও জিম প্রায় লেখক রোশে-র আত্মজীবনী, সেখানে টু ইংলিশ গার্লস-এর কাহিনীকাঠামোয় রোশে-র থেকে ত্রুফোর নিজস্ব নবতরঙ্গের প্রভাব দেখা যায় বেশি। প্যারিস বরাবরই ফরাসী চলচ্চিত্রকারদের অতিরিক্ত সুবিধা দিয়ে থাকে, তাই এ ছবির প্রোটাগনিস্ট ক্লদ যখন শিল্প-সমালোচক হবার বা প্রকাশনায় আসবার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি আদৌ অবাস্তবোচিত বলে বোধ হয় না; সে তার পারিবারিক এবং প্রতিপত্তির চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সামাজিক বিত্ত ও গৌরব অক্ষুন্ন রেখে। এক্ষেত্রে ক্লদকে নায়ক না বলে প্রোটাগনিস্ট বলা, কারণ প্রবাহের রাশ অহরহ ছেড়ে যাচ্ছে তার মুঠো থেকে। চলে যাচ্ছে দুই ব্রিটিশ বোনের কারো না কারো হাতে। আশ্চর্য ত্রুফোর প্লট তৈরীর ক্ষমতা ! যৌন আকর্ষণ বা মিলনাকাঙ্খা যদিও কাহিনীর চালিকাশক্তি, কোথাও তা কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে না। ক্লদ ও দুই বোনের রসায়নে আগাগোড়া আবেগের চোখে ধুলো দেওয়া এক পলায়ন থাকে, কিন্তু সত্যিই কেউ কাউকে ছেড়ে গেলে তাকে আর পলায়ন বলা যাচ্ছে না এবং সে পরিসর এ ছবিতে একাধিক। ত্রিকোণ প্রেমের সাবেকী সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে এই ছবি মানবচরিত্রের চিরকালীন দ্বন্দ্বের প্রচ্ছায়া হয়ে উঠছে।

     ক্লদ, অ্যান ও মিউরিয়েলের বেশীরভাগ কথাই পরস্পরের প্রতি অব্যাক্ত, আধা-ব্যাক্ত, আন্দাজ করে নেবার দুরত্বে থেকে যায়। যেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলছেন,

“হঠাৎ—শুনতে পাওয়া কথাটা আমি
ভুলে গিয়েছি।
যে-কথা অস্ফুট স্বরে তুমি একদিন
যে-কথা অর্ধেক রাত্রে তুমি একদিন
যে-কথা স্বপ্নের মধ্যে তুমি একদিন বলেছিলে”

     এই অব্যাক্ত কথাদের স্তর ত্বকের গভীরে গোপনিত। চিত্রনাট্যে সংলাপের ঘনঘটা তথা নামমাত্র অভিনয়ের ছোঁয়া এ ছবিকে ভরাক্রান্ত করে তুলতে পারত, যদি না এক ত্রুফোর নিজস্ব স্টাইলাইজেশনের এক প্রসারিত আঙ্গিক বলে চেনা না যেত। হয়তো প্রাক্‌ বিংশ শতাব্দীর আবহ-ই এই মেলোড্রামাকে ভঙ্গুর হিসেবে দৃশ্যায়িত করে। তবে এই দৃশ্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টিসুখের অভাব পুষিয়ে দেবে প্যারিসের রাস্তা, রদ্যাঁ মিউজিয়ামের আনাচ কানাচ, Le Baiser-এর ওভাররেটেড একঝলক অথবা প্রায় এক চরিত্র হিসেবে কিংবদন্তি বালজাকের স্ট্যাচুর দ্বিতীয়বার ফিরে আসা। সেভাবেই ফিরে আসে ক্লদ, তার থিতু, নিরীহ বয়ঃসন্ধি থেকে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক কিন্তু আরোও এক্সেন্ট্রিক এক মন নিয়ে। ইতিমধ্যের উত্থানপথন, অ্যান-এর উচ্ছ্বলতার করুণ পরিণতি অথবা মিউরিয়েলের স্বাভাবিক জীবনে আশ্রয় খুঁজে নেওয়ার ধাক্কা – এই দুই অপসারী ঘটনারেখা ক্লদের মর্মের দু’ভাগ হয়ে যাওয়া ফাটা দাগ। এক দৈব সমাপতনের মত মনে হ’ল, ‘শেষের কবিতা’-র শীর্ষে অমিত রায়ের একখন্ড মন যেন ক্লদের বাস্তব। যা অমিতকে জড়াতে পারেনি, তাই ধ্বংসস্তুপ করে ফেলেছে ক্লদ-কে। তার জীবনে সত্যি হয়ে উঠেছে এই ক’টি পংক্তি –

ওগো বন্ধু,
সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেরি তার জাল--
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহু দূরে


চিত্র ৬
: Les Deux Anglaises et le Continent ছবিতে ক্লদ রচ ও অ্যান ব্রাউনের চরিত্রে
Jean-Pierre Léaud Kika Markham

টু ইংলিশ গার্লস কি ধর্মে রোমান্টিক টেক্সট? বিষাদগাঁথা? শেকসপিয়ারের কোন এক ট্র্যাজেডির সময়োচিত রূপ, যেখানে ক্রমঃবিভক্ত সামন্ততন্ত্রের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে পুঁজিবাদী লিবারালিজমের ফোঁটা ফুল? শিল্পীর কাজ উত্তর খোঁজা নয়, এমনকি নিখুঁৎ নির্মাণ-ও নয়। পিকাসো বলছেন, “Every act of creation is first an act of destruction.” এ ছবির খুঁৎ তাই সহজাত, কনট্যুর অসম। আমাদের সন্ধান-ও তাই নরনারীর জীবনের অভিঘাতবিহীন সাযুজ্যের দিকে নয়, an contraire, কবিতাকে সিনেমার সঙ্গে এই অসম সম্পর্কে নামাতে আমরা বুঝে নেব তাদের অভিজ্ঞতার মণিমুক্তোগুলি, বাধ্য হিসেবের বিরুদ্ধে অবাধ্য অন্তর্মুখীন মহাপ্রস্থানকে। এক আমিকে মুখোশ খুলে বসিয়ে নিতে হবে রোজকার আমি-র গল্পগুলিতে, সিসিফাসের মত,

“বরফ, পায়ের নীচে, সমস্ত জীবন।
সিঁড়িতে, সিঁড়ির পাশে – যা হয় তা হয়েছিলো – আমি ভুলে গেছি।

একবার মুখোশ পরে নিতে হবে আমাকেও – মিশে যেতে হবে !”

 

পুঃ- সময়াভাবে কোনও বিবলিওগ্রাফী, প্রসঙ্গনির্দেশ বা টীকাটিপ্পনীকে আশ্রয় দেওয়া গেল না, সেজন্য বর্তমান       নিবন্ধকার সবিশেষ দুঃখিত। আশা করি, ভবিষ্যতে এ লেখা ছাপাখানার মুখ দেখলে এই ত্রুটি সর্বাংশে শুধরে নেওয়া যাবে। 
 

4 comments:

নামহীন বলেছেন...

দুর্দান্ত। মেধাবী চর্চা চলুক।

নামহীন বলেছেন...

শীর্ষেন্দুর কোন একটা গল্প না উপন্যাসে এক বুড়ি যেমন বলেছিল: বুঝতে পারি না শীত না গিরিষ্যি, হাতপাখা বা লেপ যা হোক একটা দে বাপু।
ভালো না মন্দ লেখা বলতে পারব না, ভাই। তবে রমিত দে-র পরে এই একজনকে দেখলাম যার লেখা পড়ে পাঠক আর কিছু বুঝুক বা না বুঝুক, লেখক কত পড়াশুনো করেছেন সেটা বুঝতে পারবে। জিও। ভালবাসা।

নামহীন বলেছেন...

শীর্ষেন্দুর গল্পের বুড়ি হিসেবেই আপনার চরিত্রটা কল্পনা করে নিলাম, যার পাঠক বা লেখক - কিছু হবারই যোগ্যতা নেই অথচ গাজোয়ারি করে কিছু একটা বলতে হবে বলে কোন একটা দলে ঢোকার চেষ্টা করে। নিবন্ধটি যথেষ্ট সহজ ভাষায় লেখা, অন্তত আমার তো তাই মনে হল৷

নামহীন বলেছেন...

নান্দনিক হজবরল!